১. কর্মের পরিভাষা কি ?
সমাধান:
দার্শনিক দৃষ্টিকোণ দ্বারা সামান্য রূপে কর্মের পরিভাষাকে যেভাবে
সংজ্ঞায়িত করা যায় -- " সুখের প্রাপ্তি এবং দুঃখ নিবৃত্তির জন্য
জীবাত্মা শরীর দ্বারা, বাণী দ্বারা এবং মন দ্বারা যে চেষ্টা বিশেষ করে
থাকে তাকে কর্ম বলা হয় ।
শরীরে সংঘটিত বিভিন্ন ক্রিয়া/চেষ্টাকে দুই বিভাগে ভাগ করা যায় -- প্রথমটি ইচ্ছাপূর্বক চেষ্টা, দ্বিতীয়টি অনিচ্ছাপূর্বক চেষ্টা ।
হাসি,
বলা, খাওয়া, চলা, দেখা, বিচার করা আদি ক্রিয়াসমূহ ইচ্ছাপূর্বক
চেষ্টায় হয়ে থাকে । এর বিপরীতে শ্বাস-প্রশ্বাসের চলন, হৃদস্পন্দনের
গতিবিধি, রক্ত সঞ্চালন, হেঁচকি, মল-মূত্রের ত্যাগ আদি ক্রিয়াসমূহ
দ্বিতীয়টি অর্থাৎ অনিচ্ছাপূর্বক চেষ্টায় হয়ে থাকে ।
মনুষ্যের
শরীর এক মূহুর্তের জন্যও ক্রিয়ারহিত হয় না, কেননা এটা তার স্বাভাবিক
ধর্মই । শরীরে বিদ্যমান কর্মেন্দ্রিয়, জ্ঞানেন্দ্রিয়, প্রাণ, যকৃত,
প্লীহা আদি অসংখ্য অবয়ব/যন্ত্র প্রতি মুহূর্ত কিছু না কিছু চেষ্টা করতেই
থাকে কিন্তু শরীরে সংঘটিত এই সমস্ত ক্রিয়াসমূহকে দার্শনিক দৃষ্টিতে
কর্মের অন্তর্গত বলা যায় না ।
যদিও অনৈচ্ছিক ক্রিয়াসমূহ শরীরে বিদ্যমান জীবাত্মার অবস্থানের জন্যই হয়ে থাকে ; নির্জীব শরীরে এসব সংঘটিত হয় না ।
তবুও
এসব ক্রিয়াসমূহ সংঘটিত হওয়ার পিছে জীবাত্মার ইচ্ছাময়ী প্রেরণা হয়
না, বরং স্বতঃ এই ক্রিয়াসমূহ বিনাই জীবাত্মার ইচ্ছায় শরীরকে জীবিত রাখার
জন্য ঈশ্বরের ব্যবস্থা রূপে সংঘটিত হয়ে থাকে, এজন্য একে কর্মের
পরিভাষায় রাখা যায় না ।
২. কর্ম, ক্রিয়া, প্রবৃত্তি, চেষ্টা, ব্যাপার, প্রযন্ত এই শব্দগুলো পর্যায়বাচী নির্দেশ করে নাকি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ নির্দেশ করে ?
সমাধান:
দর্শন শাস্ত্রে সামান্যতঃ এই শব্দসমূহকে পর্যায়বাচী হিসেবেই বর্ণনা করা
হয়েছে, লক্ষণীয় যে, জীবের শরীরে কিছু চেষ্টা/ক্রিয়াসমূহ অনিচ্ছাপূর্বক
হয়ে থাকে, কর্মমীমাংসার সাথে তার কোনো সম্বন্ধ থাকে না । এসব সংঘটিত হয়ে
থাকে ঈশ্বরের ব্যবস্থা দ্বারা শরীরের স্থিরতা, রক্ষা, বৃদ্ধি, হ্রাস আদি
দৃষ্টির মাধ্যমে ।
এই
ক্রিয়াসমূহের পিছে জীবাত্মার ইচ্ছা বিশেষ কার্য সংঘটিত হয় না যেমন
ঈশ্বরের সৃষ্টি এই সংসারে গ্রহ,উপগ্রহ, নক্ষত্রের চলন, বায়ুর চলন,
নদীর গতিবিধি, বৃক্ষের বিভিন্ন কার্য ক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত কিন্তু
কর্মমীমাংসা অনুসারে এসব ক্রিয়াসমূহ কর্মের কোটিতে অন্তর্ভুক্ত নয় ।
৩. কর্ম করার জন্য সাধন কতটুকু প্রয়োজন ?
সমাধান:
নেত্রাদি জ্ঞানেন্দ্রিয়, হস্ত-পাদ আদি কর্মেন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি আদি
অন্তঃকর্ণ আদি কর্মের সাধন পদ্ধতি অনেক রয়েছে কিন্তু এই সমস্ত কর্মের
আধার শরীরই হয়ে থাকে কেননা সমস্ত করণ, শরীর রূপী পিণ্ডতেই স্থিত ।
ঋষিগণ বিশেষ কিছু লক্ষণের আধারে কর্ম করার জন্য সাধনার তিনটি বর্গ
রচনা করেছেন । এই তিন বর্গ -- শরীর, বাণী এবং মন । জীবাত্মা শরীরে
স্থিত হয়ে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যা কর্ম করে থাকে তা শরীর, বাণী
তথা মন এই তিন সাধনা দ্বারাই করে থাকে ।
৪. মনুষ্য কত প্রকারের কর্ম করে থাকে অর্থাৎ, কর্মের ভেদ কত প্রকার হয়ে থাকে ?
**সমাধান:
**মনুষ্য তার জীবন কালে শরীর, ইন্দ্রিয়, তথা মনের দ্বারা হাজার, লাখ
প্রকারের কর্ম করে থাকে যার গণনা অসম্ভব । পুনরপি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ
দ্বারা ঋষিগণ তাঁদের রচিত গ্রন্থে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারে কর্মের ভেদ
করেছেন, যার বর্ণনা সংক্ষেপে দেওয়া হল:
ক. সাধনের ওপর ভিত্তি করে কর্মের তিনটি ভেদ --
১. মানসিক
২. বাচনিক
৩. শারীরিক
খ. সাধনার ওপর ভিত্তি করে কর্মের তিনটি ভেদেরও পুনঃ শুভ-অশুভ প্রকার উল্লেখ করে ২০ প্রকার ভেদ বর্ণনা করা হয়েছে ।
যার বিবরণ --
শুভ
শরীরের দ্বারা বাণীর দ্বারা মন দ্বারা
১. রক্ষা ৪. সত্য ৮. দয়া
২. দান ৫. মধুর ৯. অস্পৃহা
৩. সেবা ৬. হিতকর ১০.আস্তিকতা
৭. স্বাধ্যায়ী
অশুভ
শরীরের দ্বারা বাণীর দ্বারা মন দ্বারা
১. হিংসা ৪. অসত্য ৮. দ্রোহ
২. চুরি ৫. কঠোর ৯. স্পৃহা
৩. ব্যভিচার ৬. অহিতকর ১০.নাস্তিকতা
৭. ব্যর্থ কথা
প্রমাণ:
রাগদ্বেষ অধিকারাচ্চাসত্যের্ষ্যামায়ালোভাদয়ো দোষা ভবন্তি । দোষেঃ প্রয়ুক্তঃ শরীরেণ প্রবর্ত্তমানো হিংসাস্তেয়প্রতিষিদ্ধমৈথুনান্যাচরতি, বাচানৃতপরুষসূচনাসম্বদ্ভানি, মনসা পরদ্রোহং পরদ্রব্যাভীপ্সাং নাস্তিক্যং চেতি । সেয়ং পাপাত্মিকা প্রবৃতিরধর্মায় । শুভা শরীরেণ দানং পরিত্রাণং পরিচরণং চ, বাচা সত্যং হিতং প্রিয়ং স্বাধ্যায়ং চেতি, মনসা দয়ামস্পৃহাং শ্রদ্ধাং চেতি । সেয়ং ধর্মায় ।[ ন্যায় দর্শন [ বাৎস্যায়ন ভাষ্য ] ১/১/২ ]
- মনুস্মৃতি অনুসারে
মানসিকভাবে খারাপ কর্ম:-
পরদ্রব্যেষ্বভিধ্যানং মনসানিষ্টচিন্তনম্।বিতথাভিনিবেশশ্চ ত্রিবিধং কর্ম মানসম্॥ ( মনু. ১২/৫ )অনুবাদঃ অপরের ধন (অন্যায়রূপে গ্রহণের) চিন্তা, মনে (ব্রহ্মবধাদি) অনিষ্ট চিন্তা, (পরলোক নেই, দেহই আত্মা) এইরূপ অভিনিবেশ—এই ত্রিবিধ (অশুভফলদ) মানসিক কর্ম।
- মনুস্মৃতি অনুসারে বাচনিক ভাবে কর্ম:-
পারুষ্যমনৃতঞ্চৈব পৈশুন্যঞ্চাপি সৰ্ব্বশঃ।
অসম্বদ্ধপ্রলাপশ্চ বাঙ্ময়ং স্যাচ্চতুর্ব্বিধম্॥ ( মনু. ১২/৬ )
অনুবাদঃ
বাক্পারুষ্য, মিথ্যাবাক্য, পরদোষাবিষ্কার (রাজার, দেশের বা
পুরসম্বন্ধীয়) নিষ্প্রয়োজন প্রলাপ—(অশুভফলজনক) এই চার প্রকার বাচনিক
কর্ম।
- মনুস্মৃতি অনুসারে
শারীরিক ভাবে খারাপ কর্ম:-
অদত্তানামুপাদানং হিংসা চৈবাবিধানতঃ।
পরদারোপসেবা চ শারীরং ত্রিবিধং স্মৃতম্॥ ( মনু. ১২/৭ )
অনুবাদঃ অদত্ত ধনগ্রহণ, অশাস্ত্রীয় হিংসা ও পরদারগমন—শারীর (অশুভলক্ষণ) কর্ম তিন প্রকার।
গ. যোগ দর্শন অনুসারে পাপ পূণ্যের ভিত্তিতে কর্মের চারটি ভেদ বর্ণনা করা হয়েছে --
১. শুক্লকর্ম - অর্থাৎ, শুভ কর্ম - সুখ প্রাপ্তিকারী পূণ্য কর্ম যথা দান, সেবা আদি ।
২. কৃষ্ণকর্ম - অর্থাৎ, অশুভ কর্ম, দুঃখ প্রাপ্তিকারী পাপ কর্ম - যথা চুরি, হিংসা আদি ।
৩.
শুক্লকৃষ্ণকর্ম - শুভ তথা অশুভ এই দুইয়ের সমন্বয়ে কিছু সুখ তথা
কিছু দুঃখ দুইই প্রাপ্তিকারী মিশ্রিত কর্ম যথা - ক্ষতি করা, চুরি করে
দান, খাবার বানানো আদি । এসব কর্মের মাধ্যমে কারো সুখ হয়ে থাকে এবং
কিছু ক্ষুদ্র জন্তুর হিংসাও হয়ে থাকে ।
৪.
অশুক্লঅকৃষ্ণকর্ম - অর্থাৎ, নিষ্কাম কর্ম যা লৌকিক সুখকে প্রাপ্ত না
করিয়ে ঈশ্বরকে প্রাপ্তি বা মুক্তিকে প্রাপ্তিকারী হয়ে থাকে । এখানে
কেবল শুক্ল কর্মই হয়ে থাকে ।
ঘ. ফলের ভিত্তিতে কর্মের তিনটি ভেদ -
১. সঞ্চিত - পূর্ব জন্ম থেকে শুরু হয়ে এখনও পর্যন্ত করা কর্ম -- যার ফল প্রাপ্ত সম্পন্ন হয়েছে ।
২.
প্রারব্ধ - যে কর্মের ফল প্রথমেই প্রাপ্ত হয়েছে অথবা বর্তমানে
প্রাপ্ত হচ্ছে তা প্রারব্ধ কর্ম । যথা - দেহ বা শরীর প্রাপ্ত হওয়া ।
৩. ক্রিয়মাণ - যে কর্ম বর্তমানে করা হচ্ছে তাকে ক্রিয়মাণ কর্ম বলা হয় ।
ঙ. কর্তার ওপর ভিত্তি করে কর্মের তিনটি ভেদ
১. কৃত কর্ম - এমন কর্ম যার কর্তা স্বয়ং জীবই হয়ে থাকে তাকে কৃত কর্ম বলা হয় ।
২.
কারিত কর্ম - যেসব কর্ম জীব স্বয়ং না করে অন্যকে দিয়ে করিয়ে থাকে
অথবা অন্যকে করার প্রেরণা দিয়ে থাকে তা কারিত কর্ম নামে পরিচিত ।
৩.
অনুমোদিত কর্ম - যেসব কর্ম জীব স্বয়ং করে না এবং করানোর জন্য কাউকে
প্রেরিত/ আদেশ করে না কিন্তু স্বতন্ত্র রূপে অন্য কারও দ্বারা কৃত কর্মের
অনুমোদন বা সমর্থন করে থাকে তাকে অনুমোদিত কর্ম বলে ।
চ. গীতায় কর্মের তিনটি ভেদ
১. কর্ম - ভালো কর্ম
২. বিকর্ম - খারাপ কর্ম
৩. অকর্ম - নিষ্কাম কর্ম
ছ. বাসনার ভিত্তি করে কর্মের দুটি ভেদ
১. সকাম কর্ম - যা রাগ দ্বেষ দ্বারা যুক্ত হয়ে করা হয়ে থাকে, এর মাধ্যমে লোভ, বাসনা, চাহিদার উৎপন্ন হয়ে থাকে ।
২. নিষ্কাম কর্ম - যেসব কর্ম রাগ দ্বেষ রহিত ; কোনো রূপ বাসনা, লোভ উৎপন্ন হয় না ।
৫. কর্মের কর্ত্তা কে ?
সমাধান :- শরীরে ইচ্ছাপূর্বক কৃত কর্মের কর্ত্তা স্বয়ং জীবাত্মাই ।
যদ্যপি
কর্ম করলে বা না করলেও তৎ সম্বন্ধিত প্রেরণা, উৎসাহ, আদেশ অন্য
ব্যক্তির থেকেও প্রাপ্ত হওয়া যায় ; যা কর্ম সম্পাদন করতে বা না করতে
নিমিত্ত হয় , কিন্তু মুখ্য কর্ত্তা তো স্বয়ং শরীরে অবস্থিত অভিমানী
জীবাত্মাই “কর্তুমকর্তুমন্যথাকর্তুং স্বতন্ত্রঃ য়ঃ স কর্তা" যার ইচ্ছা
এবং প্রযত্ন দ্বারা শরীর, মন, বাণী (কর্মের সাধন) কর্মে প্রবৃত্ত হয়ে
থাকে । পাপ কর্মের বিষয়ে কিছু ব্যক্তি এমনটা মেনে থাকে যে, আমাদের
বুদ্ধি বা মন পাপ করিয়ে থাকে । কিছু ব্যক্তি ইন্দ্রিয়কে , তো কিছু
ভূত-প্রেতকে, তো কিছু প্রকৃতিকে কর্মের কর্ত্তা মেনে থাকে । কোনো-কোনো
মূর্খ, নির্বোধ সম্প্রদায়ী তো শয়তানকে পাপ কর্মের কর্ত্তা বলে থাকে ।
কিছু ব্যক্তি পেটকে দোষ দেয় । তো কিছু ব্যক্তি ক্ষুধাকে কর্মের কারণ
মানে ।
এই
প্রকারে কেউ সমাজকে, তো কেউ পরিস্থিতিকে পাপ কর্মের নিমিত্ত কারণ মেনে
থাকে । কেউ-কেউ তো সরাসরি ঈশ্বরকেই সংসারের ভালো-মন্দ সমস্ত কর্মের
কর্ত্তা মেনে থাকে ।
বস্তুতঃ
এই সমস্ত মান্যতা অনুপযুক্ত, ভ্রান্তিপূর্ণ তথা যথার্থতা রহিত । প্রকৃতি
তথা প্রকৃতি থেকে রচিত সমস্ত পদার্থ জড় তথা ইচ্ছা-প্রেরণা রহিত হওয়ায়
শরীরে কর্মের কর্ত্তা গঠিত হতে পারে না । এই দৃষ্টিতে তো এক শরীরে অনেক
কর্ত্তা সৃষ্টি হবে এবং পরস্পর বিরোধও উপস্থিত হবে । অতঃ এমনটা হওয়া
অসম্ভব ।
যদি
এমনটা মানা হয় তো ঈশ্বরের ইচ্ছা/ আদেশ / প্রেরণা থেকেই মনুষ্য সব কর্ম
সম্পাদন করে থাকে । তাহলে সমগ্র সংসারে যা কিছু ভালো-মন্দ ঘটনা ঘটছে
তার জন্য ঈশ্বরই উত্তরদায়ী হবেন ।
কেননা,
মনুষ্য এমন স্থিতিতে ঈশ্বরের হাতের পুতুল হয়ে যাবে । এমন পরাধীন
স্থিতিতে কর্মের ফল জীব কিরূপ প্রাপ্ত হবে ? যিনি আদেশ দিচ্ছেন তিনিই
প্রাপ্ত হবেন । এসব অজ্ঞানী, স্বার্থী, দুষ্ট ব্যক্তিগণেরই ধূর্তামি,
স্বয়ং কুকর্ম করে কর্মফল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সে ঈশ্বর অথবা শয়তানের
দোহাই দেয় ।
যথার্থ
স্থিতি এই যে, জীব স্বয়ং ইচ্ছা, প্রযত্ন, জ্ঞান আদি গুণসমূহ দ্বারা
যুক্ত এক চেতন তত্ত্ব তথা এক স্বতন্ত্র কর্ত্তা । মন দ্বারা বিচার করে,
বাণী দ্বারা উচ্চারিত তথা শরীর দ্বারা সম্পাদিত সমস্ত কর্ম, ব্যবহার
জীবেরই ইচ্ছা প্রযত্ন দ্বারা হয়ে থাকে, জীবই সমস্ত কর্মের কর্ত্তা ।
৬. কর্মের ফলপ্রদাতা কে ?
সমাধান :- জীব দ্বারা কৃত কর্মের মুখ্য ফল দাতা সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, ন্যায়কারী, পরমপিতা পরমাত্মাই ।
কিন্তু
মনুষ্যগণের কর্মের ফল কেবল ঈশ্বরই প্রদান করেন, এমনটা নয় । বাল্য কালে
অবুঝ শিশু কৃত ভালো-মন্দ কর্মের ফল তার মাতা-পিতা আদি প্রাপ্ত হয় ।
বিদ্যালয়ে বিদ্যা প্রদানকারী অধ্যাপক, আচার্যগণ দ্বারাও বিদ্যার্থীরা
তাদের কর্মের ফল প্রাপ্ত হয়ে থাকে । সমাজ, গ্রাম, নগরে অবস্থিত ভালো-মন্দ
কর্মের ফল সমাজের নেতা, পুলিশ, ন্যায়াধীশ, নগরপালিকা আদি দ্বারাও প্রদান
করা হয় । সেবার চাকরি আদি কর্মরত সেবক, কর্মচারী, কার্যকর্ত্তাদেরও
তাদের স্বামী সরকার অধিকারী দ্বারাও কৃত কর্মের ফল প্রদান করা হয় ।
কিন্তু মাতা-পিতা থেকে শুরু করে রাজা পর্যন্ত সবাই কর্মফলদাতা, প্রথম তো
সম্পূর্ণ কর্মকে সঠিক প্রকারে দৃষ্টিপাত করা, শ্রবণ করা, ঠিকমতো জানতেই
পারে না তাহলে অল্পজ্ঞ, অল্পশক্তিমান, রাগ দ্বেষ আদি গুণসমূহ দ্বারা যুক্ত
হওয়ার দরুণ এটা আবশ্যক নয় যে মনুষ্য কৃত কর্মের ফল পুরোপুরি প্রদান
করা সম্ভব । তা কম-অধিকও হতে পারে ।
পরন্তু পরমাত্মা সমগ্র মনুষ্য জাতির প্রত্যেক ক্রিয়াকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, শ্রবণ করেন তথা পরিপূর্ণভাবে জানেন
প্রমাণ --
একোঽহমস্মীত্যাত্মানং যত্ত্বং কল্যাণং মন্যসে ।
নিত্যং স্থিতস্তে হৃদয়েষ পুণ্যপাপেক্ষিতা মুনিঃ ॥
( মনু. ৮ / ৬২ )
ভাবার্থ:
হে ভদ্র ! তুমি যদি এরূপ ভেবে থাকো যে, আমি আত্মা একজনই তোমার
অভ্যন্তরে অবস্থান করছি, তো তা ঠিক নয় , কেননা সবার পুণ্য এবং পাপ কর্ম
পর্যবেক্ষণরত সর্বজ্ঞ ন্যায়কারী পরমাত্মা তোমার হৃদয়ে অবস্থিত ।
যেসব
কর্মের ফল উপর্যুক্ত ব্যক্তি দ্বারা প্রদান করা হয়েছে, তার মধ্যে কোনো
কিছু কম থাকলে বা যে কর্মের ফল কোনো ব্যক্তি দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায়
না সেই সব অবশিষ্ট কর্মের ফল অন্তে ঈশ্বরই প্রদান করে থাকে । স্বয়ং
জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ব্যক্তিও তার কৃত কর্মের ফল অপর কারো নিকট হতে
প্রাপ্ত করে থাকেন ।
অনূনং পাত্রং নিহিতং ন এতৎ
পক্তারং পক্বঃ পুনরা বিশাতি ॥
( অথর্ব ১২ / ৩ / ৪৮ )
ভাবার্থ:- আমাদের পাত্র ( কর্মাশয়) পূর্ণ রূপে পরিপূর্ণ, এ কারণে তা ফল প্রদানে সমর্থ ।
স্বয়ং কর্ম করোত্যাত্মা স্বয়ং তৎফলমশ্নুতে
স্বয়ং ভ্রমতি সংসারে স্বয়ং তস্মাদ্ বিমুচ্যতে ।
( চাণক্যনীতি ৬/৮)
ভাবার্থ
:- স্বয়ং আত্মাই কর্ম করে এবং কর্মানুসারে ফল ভোগ করে । তথা
কর্মানুসারেই বিবিধ যোনিতে জন্ম নিয়ে সংসারে ভ্রমণ করে । স্বয়ংই তার
পুরুষার্থ দ্বারা সংসারের বন্ধন এবং জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে মুক্তি প্রাপ্ত
হয় ।
৭. কৃত, কারিত এবং অনুমোদিত কর্মের ফল ন্যূনাধিক হয় নাকি সমান হয়ে থাকে ?
সমাধান :-
পরিস্থিতি বিশেষকে বাদ দিয়ে সামান্য রূপে কৃত কর্ম = স্বয়ং কৃত কুকর্মের
ফল কারিত = সম্পন্ন হয়েছে এমন তথা অনুমোদিত = সমর্থিত কর্মের অপেক্ষা
অধিক হয়ে থাকে । কেননা অতি = দ্বেষ আদি প্রবৃত্তি হওয়ার পর ব্যক্তি
স্বয়ংই হিংসাদি দুষ্কর্ম করে থাকে । অতি উগ্রতা হওয়ার দরুণ ব্যক্তির
ধৈর্য্য, সহনশক্তি নষ্ট হয়ে যায় । কোনো ব্যক্তি দ্বারা কার্য সম্পাদন
করাতে প্রায়ঃ অধিক সময় অতিবাহিত হওয়া, কর্মের অনিশ্চয়াত্মক হওয়া তথা
পূর্ণ রূপে সন্তোষ প্রাপ্ত না হওয়া আদি দোষ হয়ে থাকে । যখন ব্যক্তি
স্বয়ংই কোনো কর্ম করে থাকে তো তার তৃপ্তি / সন্তোষ প্রাপ্তি হয়ে থাকে
এমনটাও দেখা যায় ।
কৃত
দ্বারা কারিত কর্মের ফল স্বল্প প্রাপ্ত হয় । কেননা অন্যের নির্দেশে
ব্যক্তির কৃত কর্ম অন্য কর্ত্তার অধীনে হয়, তার কৃত কর্মের একটি ভাগ সেও
প্রাপ্ত হয় । কর্ত্তা এবং প্রেরকে কর্মফলের একাংশ ভাগ হয়ে যায় । যদি
কর্ম কৃত এবং কারিত উভয়েই যুক্ত থাকে তো এই প্রকারে অনেক পরিস্থিতিতে
অপবাদ রূপে কর্মকারী অপেক্ষা অন্যের অধীনে কর্ম সম্পাদন করা অথবা
অনুমোদন প্রদানকারী ব্যক্তি অধিক দোষী হয়ে থাকে । এটা সেই স্থিতিতেই সম্ভব
যখন প্রেরক, আদেশকর্ত্তা বা সমর্থক ব্যক্তি শক্তি, বুদ্ধি, সামর্থ্য,
পদ, প্রতিষ্ঠা আদি দৃষ্টিতে উচ্চ হয়ে থাকে । সমাজে যার প্রভাব, বর্চস্ব
অধিক হয়ে থাকে সে তার এই গুণসমূহের কারণে নিম্ন স্তর সম্পন্ন ব্যক্তিকে
তার অধীনে কার্য করার হেতু প্রভাবিত / প্রেরিত করে বিবশও করে দেয় ।
এ
দ্বারা স্বয়ং কার্য সম্পাদনকারী কর্ত্তা ব্যক্তি ভয়, প্রলোভন, স্বার্থ,
আশঙ্কিত হানি আদি কারণে কোনো কাজ খারাপ জেনে এবং মেনেও সম্পাদন করে থাকে ।
এই স্থিতিতে স্বয়ং কর্তা প্রেরক আদেশকর্ত্তা ব্যক্তি অপেক্ষা কম দোষী
হয়ে থাকে ।
৮. মানসিক, বাচনিক, শারীরিক এই তিন প্রকার পাপ কর্মের মধ্যে অধিক দণ্ড প্রাপ্ত হতে হয় কোনটিতে ?
সমাধান :- বিশিষ্ট পরিস্থিতি বাদ দিয়ে সামান্য রূপে মানসিক পাপ অপেক্ষা বাচনিক পাপ তথা বাচনিক পাপ অপেক্ষা শারীরিক পাপের কর্মফল অধিক ।
এর
কারণ হলো মানসিক এবং বাচনিক পাপ অপেক্ষা শারীরিক পাপের স্থিতিতে ব্যক্তি
অধিক পীড়িত / দুঃখী হয়ে থাকে । যদি অধর্ম / পাপের ভাবনা স্বল্প হয় তো
কর্ম মন পর্যন্তই সীমিত থাকে । কিন্তু পাপের ভাবনা দ্বারা বেগ বৃদ্ধির ফলে
তা বাণী পর্যন্ত পৌঁছে যায় । অর্থাৎ, ব্যক্তি না কেবল পাপ করতে মনে
বিচার করে থাকে, বরং তার স্ব-বাণী দ্বারাও অপরকে বলে যে, আমি এই-সেই করবো
। ভাবনা তথা লালসা অধিক হওয়ার দরুণ ব্যক্তি তার স্ব-বাণী পর্যন্ত সীমিত
না থেকে শরীর দ্বারাও পাপ কর্ম করে থাকে । পাপ ভাবনা লালসার অধিক হওয়ার
কারণও শারীরিক পাপে তা সবচেয়ে অধিক, বাচনিক পাপে স্বল্প কর্মফল
প্রাপ্তি তথা মানসিক পাপে সবচেয়ে কম কর্মফল প্রাপ্তি হয় ।
শরীর
দ্বারা পাপ কর্ম করার পর বাণী এবং মন দ্বারাও পাপ হয় । এই প্রকারে বাণী
দ্বারা পাপ কর্ম করার দরুণ মন থেকেও অনিবার্য রূপে পাপ হওয়া অবশ্যম্ভাবী
। এ কারণে শারীরিক পাপ বাচনিক এবং মানসিক পাপ থেকে অধিকতর দণ্ডনীয়
৯. মনুস্মৃতিতে আট প্রকারের পাপীর বর্ণনা করা হয়েছে ।
অনুমন্তা বিশসিতা নিহন্তা ক্রয়বিক্রয়ী ।
সংস্কর্তা চোপহর্তা চ খাদকশ্চেতি ঘাতকাঃ (মনু. ৫ / ৫১ )
অর্থাৎ, যিনি পশুবধ করতে অনুমতি দেন, যিনি অস্ত্রাদির দ্বারা পশুর অঙ্গপ্রতঙ্গ খণ্ড করেন, যিনি পশু বধ করেন, যিনি সেই প্রাণীর মাংস ক্রয় করেন, যিনি তা বিক্রয় করেন, যিনি মাংস পাক করেন, যিনি পরিবেশন করেন এবং যিনি মাংস ভক্ষণ করেন—তাঁরা সকলেই সেই পশুর 'ঘাতক' রূপে অভিহিত হন ।
এই আট প্রকারের ঘাতক উল্লেখ করা হয়েছে । এই আট প্রকারের ঘাতকের মধ্যে সব ঘাতক সমান পাপী হয় নাকি কম-অধিক হয় ?
**সমাধান
**:- মাংস ভক্ষণকারী ব্যক্তিই সবচেয়ে অধিক পাপী । কেননা যদি সে
খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ না করে, তো কেই-বা কোনো প্রাণীকে হত্যা করবে, বিক্রয়
করবে, রান্না করবে ? এই প্রকারে অনেক হেতুর দরুণ ভক্ষণকারী সবচেয়ে বেশি
এবং অপরকে দিয়ে এমন পাশবিক, নিকৃষ্ট, নির্মম কর্ম করানোর ফলে তাদের কৃত
পাপ কর্মেরও ফল ভোগ করে থাকে । তাই ভক্ষণকারীই সবচেয়ে অধিক পাপী ।
ক্ষেত্র বিশেষে ভক্ষণকারীর প্রাপ্ত সমপরিমাণ পাপ উক্ত আট প্রকার ঘাতকের মধ্যে অনেক ঘাতক প্রাপ্ত করে থাকে ।
যথা- মাংস খাওয়ার জন্য প্রেরণা প্রদানকারী ব্যক্তির মনও মাংস খাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে ।
মাংসাদি
অভক্ষ্য, নিকৃষ্ট পদার্থ খাওয়ার জন্য মিথ্যা লাভ, মহত্ত্বের মিথ্যা
প্রচার-প্রসার, লোভ আদি করার দরণ মনুষ্যগণের মধ্যে সেই পদার্থ খাওয়ার
ইচ্ছা উৎপন্ন হয়ে থাকে ।
১০. কেউ তার স্বকৃত কর্মের ফল অপরকে প্রদান করতে পারবে ?
**সমাধান
**: ব্যক্তি তার স্বীয় কৃত কর্মফল স্বয়ংই ভোগ করে । কোনো ব্যক্তি তার
স্বীয় কৃত কর্মফল অপর কাউকে প্রদানে সর্বদাই অক্ষম ।
আত্মান্তরগুণানামাত্মান্তরেঽকারণত্বাৎ । (বৈশেষিক-৬/১/৫)
এক
আত্মা দ্বারা কৃত পাপ-পুণ্য ধর্মা-ধর্মের ফল অন্য আত্মা প্রাপ্ত হয় না ।
এই গুণ অন্যের সুখ-দুঃখের কারণ নয় । এ কারণে কোনো ব্যক্তি অপর কৃত কর্মফল
ভোগ করতে পারে না । কিন্তু স্বয়ং কৃত কর্মফল অবশ্যই ভোগ করে । যদি
একজনের কর্মফল অপর কোনো ব্যক্তি প্রাপ্ত হয় এমনটা মানা হয় তাহলে শাস্ত্র
অনুসার 'কৃতহানি অকৃত- অভ্যাগম' রূপী অন্যায়ের দোষী হবেন ঈশ্বর । ঈশ্বর
নির্দেশিত পরম শুদ্ধ ন্যায় ব্যবস্থায় এমন অন্যায় কদাপি অসম্ভব ।
বর্তমানে
তথাকথিত ধার্মিক সমাজে এমন পরম্পরা লক্ষ্যণীয় যে, কিছু ব্যক্তি যজ্ঞ,
জপ, তপ আদি অন্যের দ্বারা করিয়ে থাকে এবং মানে যে সেই পণ্ডিত, সাধু,
পূজারী আদি দ্বারা কৃত জপ-তপাদির ফল সেই ব্যক্তি প্রাপ্ত হবে, তার
প্রায়শ্চিত্ত হবে ।
পরন্তু
এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, যদি এমনটা হতো তো ধনবান্, বলবান্, বিদ্বান্
ব্যক্তি নির্ধন, নির্বল, নির্বুদ্ধি ব্যক্তিদের ধন, বল আদি দ্বারা ভয়
দেখিয়ে, ধমক দিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে স্বীয় কৃত পাপ কর্মের ভার অপরকে
দিতো তথা অপরের ভালো কর্ম ক্রয় করতো ।
কিন্তু
এমনটা অসম্ভব । এই প্রকারের একটি ঘটনা সারিকা মাসিক পত্রিকায় কয়েক
বর্ষ পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিলো । নেপাল সম্রাট মহেন্দ্র জীর মৃত্যুর পর এক
ব্রাহ্মণ সেই সম্রাটের সমস্ত পাপের ভার গ্রহণ করে । এর বদলে সেই ব্রাহ্মণ
সম্রাটের প্রচুর ধন-সম্পত্তি হাতিয়ে নেয় এবং বলে মহারাজ স্বর্গে গমন
করেছেন । বস্তুতঃ এমনটা সম্পূর্ণ পাখণ্ডীপনা, দোষপূর্ণ, ভ্রান্তিপূর্ণ ।
এসব পাখণ্ডীদের এহেন কুকর্মের জন্য সাধারণ অজ্ঞ ব্যক্তি ঈশ্বরকে
পক্ষপাতপূর্ণ ভেবে থাকে ।
এক
ব্যক্তি মাসিক ৫০০০ টাকা বেতন পায়, যা তার এক মাস কৃত কর্মফল ,সেই
ব্যক্তি তার সমস্ত বেতন গরীব, রোগী, অনাথ, নির্ধনদের দান করে । এমন
স্থিতিতে এরূপ মনে হবে যে সেই ব্যক্তি তার সমস্ত কর্মফল অন্যদের দিয়েছে ,
কিন্তু এমনটা নয় । ধন দান করে কর্মফল প্রাপ্তির এক নয়া পন্থা যে
উন্মোচন করেছে সেই ফল ঈশ্বর ভবিষ্যতে প্রদান করবেন ।
এই
প্রকারে কোনো দোষী, পাপী, অধর্মী ব্যক্তি তার স্বীয় কৃত মন্দ কর্মের দোষ
কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে প্রদান করে তাকে দণ্ড দিয়ে সে তার স্বীয় কৃত দোষ
হতে রেহায় পায় না । বরং তা এক নব্য কর্মের রূপান্তরিত হবে যার ফল সে
ভবিষ্যতে প্রাপ্ত হবে ।
– বিদুষাং বশংবদঃ
নমস্কার
0 মন্তব্য(গুলি)