https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

মহর্ষি দয়ানন্দ ও পণ্ডিতা রমাবাঈ

Monday, November 6, 2023

 


বিষয়বস্তু

১. প্রাককথন–

২. রমাবাঈয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয়–

৩. বিপিন বিহারী মেধ্বী ও রমাবাঈ–

৪. বিপিন বিহারী মেধ্বী ও রমাবাঈয়ের বিবাহ -

৫. বিবাহের প্রকৃত তারিখ–

৬. রমাবাঈ এবং মহর্ষি দয়ানন্দের পত্রব্যাবহার–

৭. আর্যসমাজ মেরঠে পণ্ডিতা রমার আগমন এবং অবস্থানের প্রামাণিক বৃত্তান্ত। তিন জীবনীগ্রন্থের বর্ণনা–

৮. রমাবাঈয়ের পরবর্তী জীবন–

৯. পৌরাণিকদের অপপ্রচার খণ্ডন ও মন্তব্য-

১০. উপসংহার–

 

প্রাককথন-

ओ३म्  , নমস্কার।

একথা সর্বজনবিদিত যে, আধুনিক ভারতবর্ষের পিতামহ মহর্ষি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী বৈদিক ধর্মের পুনরুদ্ধারক, সমাজ সংস্কারক হিসেবে সর্বত্র সম্মানিত। এ কথাও কারো অজানা নয় যে মহর্ষির প্রতি মতান্ধ পৌরাণিকরা প্রবল বিদ্বেষ পোষণ করে । মহর্ষির জীবদ্দশায় তাদের হিংসা এত প্রবল ছিল যে তারা মহর্ষিকে হত্যার কোনো ষড়যন্ত্রই বাকি রাখে নি। এবং শেষ পর্যন্ত মহর্ষির খাবারে তীব্র বিষ মিশিয়ে দিলে তিনি দেহত্যাগ করেন। মহর্ষির মৃত্যুর পরও পৌরাণিকদের হিংসার আগুন শান্ত হয়নি। তারা এবার মহর্ষির চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করে তাঁর মহান আদর্শ ম্লান করার জন্য বিভিন্ন ভিত্তিহীন মিথ্যাচারের আশ্রয় নিতে থাকে ।

প্রসঙ্গত, দীর্ঘকাল যাবৎ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ভারতীয় মা-বোনদের শিক্ষার সুযোগ করে দেয়া মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর একটি আন্তরিক কামনা ছিল ।  মেরঠে এমন একটি কন্যা পাঠশালা স্থাপন করা হলে সেখানে পণ্ডিতা রমাবাঈ নামক এক সুপ্রসিদ্ধ বিদুষী নারীকে অধ্যাপিকা হিসেবে নিযুক্ত করতে চান এবং নারীশিক্ষার কার্যে যোগদানের জন্য আহ্বান করেন। রমাবাঈ এসেছিলেনও। কিন্তু তাঁকে যে  উদ্দেশ্যে ডাকা হয়েছিল; ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যস্ত থাকায় তিনি সেই মহৎ কার্যে যোগদান করতে সম্মত হন নি । শুদ্ধচরিত্র ঋষির চরিত্রে কোনো দোষ বের করতে না পেরে পৌরাণিকরা এই রমাবাঈকে নিয়ে এক মনগড়া কাহিনি প্রচার করে দেয় যে, উক্ত রমাবাঈয়ের সাথে নাকি মহর্ষির প্রেমের সম্পর্ক ছিল! বিমলচরিত্র ব্রহ্মচারী, এবং যিনি আজীবন ভারতবর্ষের মা-বোনদের হিতচিন্তক হয়ে ছিলেন সেই ঋষির চরিত্রের উপর এই আরোপ যে কতটুকু পাপপূর্ণ; তার পরিমাপ পরমাত্মাই ভালো জানেন।

মহর্ষি দয়ানন্দ নিজেই এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র সুতরাং কোনো অতিরিক্ত প্রশংসাবাক্য কীর্তন করে তাঁর কীর্তিকে উজ্জ্বল করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বৈদিক সত্যমার্গের প্রদর্শক নিজেদের পূজনীয় গুরুদেবের নামে কোনো কলঙ্ক আরোপ করলে আমরা চুপ হয়ে বসে থাকব না। যখন আর্যসমাজের নব্য অনুসারী হয়েছিলাম তখন এই মিথ্যা কলঙ্ক আরোপ দেখেছিলাম এর পরেও অনেক দিন দেখেছি। আজ পরমাত্মার কৃপায় পর্যাপ্ত অবসর পেয়ে পৌরাণিকদের অভিযোগগুলোকে তথ্যপ্রমাণ দ্বারা খণ্ডবিখণ্ড করতে উদ্যত হলাম । যেসব বঙ্গীয় পৌরাণিক এই বিষয়ে মহর্ষির চরিত্রে কলঙ্ক আরোপের চেষ্টা এখনও করে চলেছে তাদের আহ্বান করছি যে, যদি এক বিন্দু সামর্থ্যও থাকে তাহলে এই লিখার প্রতিবাদ করো। নতুবা আর্যসমাজীরা তোমাদের অপপ্রচারকে পাগলা কুকুরের ঘেউ ঘেউয়ের মতো উপেক্ষণীয় বলে গণ্য করবে।

যেসব সজ্জন এবং নবীন বিদ্যার্থী এসকল পৌরাণিকদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়েছেন। এই লেখার পর আশা করি আর কারো কোনো বিভ্রান্তি থাকবে না। লিখাটি বেশ দীর্ঘ হতে পারে। কারণ এই প্রসঙ্গে যত তথ্য আছে সবকিছু এই লিখাতেই রয়েছে। বানানাদি ভুলত্রুটি ক্ষমা  করবেন।

বিদুষাং বশংবদঃ

-সুব্রত দেবনাথ


  • রমাবাঈয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

যে রমাবাঈকে নিয়ে পৌরাণিকরা কলঙ্ক আরোপ করে থাকে; প্রথমে তাঁর পরিচয় জানা উচিত। এর জন্য আমরা সব প্রামাণিক (authentic) উৎস  ব্যবহার করবো। আমরা পৌরাণিকদের মতো লুকোচুরি খেলায় বিশ্বাসী নই। উইকিপিডিয়া একটি সর্বজনীন উৎস, পাঠক এটি দেখতে পারেন। Pandita Rama  পণ্ডিতা রমাবাঈ [Bangla] এই প্রবন্ধে পণ্ডিতা রমাবাঈয়ের সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখা হয়েছে। বিশেষত প্রাসঙ্গিক দিকসমূহের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।


১৯৮৯ সালে ভারত সরকার দ্বারা প্রকাশিত পণ্ডিতা রমাবাঈয়ের নামে ডাকটিকিট । অবৈধ কুলজাত পৌরাণিকদের নিকট অবশ্য তা বোধগম্য হবে না । 


[মেরঠে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রমাবাঈয়ের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত ]


পণ্ডিতা রমাবাঈ সরস্বতী ১৮৫৮ সালে একটি মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা অনন্ত ডোংরে সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। রমাবাঈয়ের ডাকনাম ছিল রমা ডোংরে। ১৯৭৬-৭৮ সালের মহাদুর্ভিক্ষে রমাবাঈ নিজের মা বাবাকে হারান। এরপর শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে অগ্রজ ভ্রাতা শ্রীনিবাস ডোংরের  সাথে দেশের নানা স্থানে ভ্রমণ করেন। তিনি শিক্ষালাভের পাশাপাশি প্রভাষকের কাজও করতেন বলে জানা যায়। এভাবে ধীরে ধীরে তাঁর পাণ্ডিত্য বা সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতার সুনাম দেশের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। প্রভাষক হিসাবে রমাবাইয়ের খ্যাতি কলকাতায় ছড়িয়ে পড়লে, কলকাতার পণ্ডিতদের দ্বারা রমাবাঈ কলকাতায় বক্তব্য প্রদানের জন্য আমন্ত্রিত হন । আর ১৮৭৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে 'পণ্ডিতা' এবং 'সরস্বতী' উপাধিতে ভূষিত করে। তৎকালে সরস্বতী উপাধি পণ্ডিত মহলে অন্যতম সর্বোচ্চ উপাধি ছিল। আর প্রথম কোনো নারী হিসেবে তিনি এটি অর্জন করেছিলেন। সুতরাং তিনি যে সংস্কৃত ভাষায় বিদুষী নারী ছিলেন, তা সহজেই অনুমেয়।

১৮৮০ সালে রমাবাঈয়ের ভাই শ্রীনিবাস ডোংরের অকালমৃত্যু হয়। এতে রমাবাঈ সম্পূর্ণ অনাথ হয়ে যান। 

  • বিপিন বিহারী মেধ্বী ও রমাবাঈ -

কলকাতা হাইকোর্ট এর উকিল বিপিন বিহারী মেধ্বী রমাবাঈয়ের ভাই শ্রীনিবাসের বন্ধু ছিলেন। শ্রীনিবাসের মৃত্যুর পর তিনি রমার পাশে দাঁড়ান। বিপিন রমাবাঈয়ের গুণে আগে থেকেই  মুগ্ধ ছিলেন। এজন্য তিনি রমাবাঈকে বিবাহ করতেও ইচ্ছুক ছিলেন। এ বিষয়ে আলোকপাত করে শ্রী বিপিন বিহারীর সুপরিচিত বিপ্লবী বন্ধু শ্রী বিপিন চন্দ্র পাল লিখেছেন যে -

 বিপিন বিহারী কখনই রমাবাঈয়ের পিছু করা ছাড়েননি, সে যেখানে-যেখানে যায় সেখানে-সেখানে  বিপিন বিহারীও যেতেন। অবশেষে বিপিন বিহারীর প্রচেষ্টা ফল দেয়। বিপিন বিহারী দেখতে সুদর্শন, প্রভাবশালী এবং তেজস্বী । তিনি শুধু লম্বাই ছিলেন না, তার শরীরও সুদৃঢ় ছিল। সংক্ষেপে বলতে গেলে, তার দেহ ছিল অনুপাতিক এবং আকর্ষণীয়। নারীরা যদি তার মতো একজন সুদর্শন পুরুষের প্রতি মুগ্ধ হতেন, তবে আশ্চর্যের কিছু ছিল না। রাজপুরুষের মতো সুদর্শন সুন্দর শরীরের পাশাপাশি তার বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরও ছিল অতিশয় শ্রেষ্ঠ। এমন অবস্থায় পণ্ডিতা রমাবাঈয়ের হৃদয় এবং বুদ্ধিকে আকৃষ্ট করে থাকেন, তবে সেটা অস্বাভাবিক এবং আশ্চর্যজনক নয়।”

(তথ্যসূত্র- মহারাষ্ট্র টাইমস: ১৮ অক্টোবর ১৯৯২ঃ রবিবারীয়- মৈফল-পরিশিষ্টঃ পৃষ্ঠ ১)


এছাড়া অন্য সূত্র থেকে জানা যায় যে,বিপিন বিহারী এবং পণ্ডিতা রমাবাঈয়ের বিবাহে শ্রীনিবাসের মতও ছিল। পণ্ডিতার বড় ভাই (অগ্রজ) শ্রীনিবাস শাস্ত্রী তাঁর মৃত্যুর আগে (৮ ই মে ১৮৮০) পণ্ডিতাকে বলেছিলেন যে তিনি যদি চান তাহলে তিনি বিপিনবিহারীকে বিয়ে করতে পারেন। বিপিনবিহারীর আপ্ত হেমেন্দ্রনাথ দাসের ভাষায়-

“ মৃত্যুকালে শ্রীনিবাস শাস্ত্রী তাঁর একান্ত স্নেহপাত্রী ভগিনী কে বলিয়াছেন যে ইচ্ছা করিলে সে বিপিনবিহারী কে বিবাহ করিতে পারে ”

[তথ্যসূত্র-: পণ্ডিতা রমাবাই ও শ্রীহট্ট: সম্মেলনের হীরক জয়ন্তী স্মারক গ্রন্থ (বাংলা ভাষায়) পৃষ্ঠা ৮০]

 


  • বিপিন বিহারী মেধ্বী ও রমাবাঈয়ের বিবাহ -

রমাবাঈ এবং বিপিন বিহারী মেধ্বীর বিবাহও হয়ে গিয়েছিল। এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রামাণিক সূত্র থেকে জানা যায়। যেমন-

প্রকৃতপক্ষে, পণ্ডিতা রমা এবং বিপিন বাবুর বিবাহ ইতিমধ্যেই ১৩ ই জুন, ১৮৮০ তারিখে হয়েছিল, পণ্ডিতা মেরঠে আসার আগেই। রমা- বিপিনের বিবাহ উপলক্ষে সাক্ষী হিসাবে বাংলার সুপরিচিত ইতিহাসবিদ মি. বেবারিজ, আই.সি.এস. সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন। শ্রী হেমেন্দ্রনাথ দাস তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন যে- 'বিখ্যাত ঐতিহাসিক মিঃ বেবারিজ আই.সি.এস. ও তার স্ত্রী উক্ত বিবাহে স্বাক্ষীরূপে উপস্থিত ছিল।”

[তথ্যসূত্র- শ্রীহট্ট সম্মেলনের হীরক জয়ন্তী স্মৃতি  গ্রন্থ, পন্ডিত রমাবাঈ এবং শ্রীহট্ট, পৃষ্ঠা ৮০]

 

“ ১৮৭২ সালের সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুসারে, এই বিবাহটি কোনও ধরণের ঐতিহ্যগত সাম্প্রদায়িক পদ্ধতি অবলম্বন না করেই সরকারী রেজিস্ট্রি পদ্ধতিতে বাঁকিপুরের রেজিস্ট্রারের সামনে রেকর্ড করা হয়েছিল। ১৮৭২ সালের উল্লিখিত আইনটি মূলত ব্রাহ্মসমাজের অনুসারীদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, কারণ ব্রাহ্মরা নিজেকে হিন্দু বলতে প্রস্তুত ছিলেন না, এই আইন অনুসারে যে বর-কনে বিয়ে করেছিলেন তাদের শপথে এটি বলতে হয়েছিল যে, আমরা কোনো বিশেষ ধর্মের অনুসারী নই, আমরা হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি, জরাথুস্ট্র এগুলোর কেউ নই।”

[তথ্যসূত্র- পণ্ডিতা রমাবাঈ সরস্বতী: একটি অজানা পৃষ্ঠা, লেখক - মধু লিময়ে- মহারাষ্ট্র টাইমস: মারাঠি দৈনিক, ১৮ অক্টোবর ১৯৯২, রবিবারীয় পরিশিষ্ট, মৈফল পৃষ্ঠা ৩]।

 

  • বিবাহের প্রকৃত তারিখ

রমাবাঈয়ের বিবাহের তারিখ নিয়ে একটু মতভেদ আছে। যেমন পূর্বে  বলা হয়েছে, পণ্ডিতা রমা এবং বিপিন বাবুর বিবাহ  ১৩ ই জুন, ১৮৮০ তারিখে হয়েছিল, আবার উইকিপিডিয়া বলছে, “১৮৮০ সালের ১৩ নভেম্বর তাদের বিয়ে হয়েছিল। ” এই মতভেদের মীমাংসায় কুশবাহ গ্রন্থাবলীর সম্পাদক ডা০ জ্বলন্তকুমার শাস্ত্রীজী লিখেন, 

 

यद्यपि पण्डिता रमा के विवाह की तिथि को लेकर कुछ लोग  मतभेद रखते हैं कि उनका विवाह १३ अक्टूबर या १३ नवम्बर १८८० ई० को हुआ थाकिन्तु अधिकांश ग्रन्थ लेखक विवाह तिथि १३ जून १८८० ई० ही मानते हैंक्योंकि इस तिथि ( १३ जून १८८०) को विवाह-दिवस मानने पर उनकी कन्या की जन्मतिथि १५ अप्रैल १८८१ [जो निश्चित है ] सुसङ्गत हो जाती है।”

অর্থাৎ-  যদিও পণ্ডিতা রমার বিবাহ তিথি নিয়ে কিছু লোক ভিন্নমত পোষণ করেন যে, উনার বিবাহ ১৩ অক্টোবর বা ১৩ নভেম্বরে হয়েছিলো। কিন্তু অধিকাংশ গ্রন্থ লেখক ১৩ জুন ১৮৮০ তারিখকেই বিবাহ তিথি বলে মনে করেন। কারণ এই তিথিতে বিবাহ হলে তাঁর কন্যার জন্মতিথি (১৫ এপ্রিল ১৮৮১, যা নিশ্চিত) সুসংগত হয়।”

[তথ্যসূত্র- কুশবাহ গ্রন্থাবলী , পৃ- ৪২২-৪২৩]

  • মেরঠে আসার আগে

রমাবাঈ এবং মহর্ষি দয়ানন্দের পত্রব্যবহার।

[মূল পত্র ও বঙ্গানুবাদ]

জীবনীগ্রন্থের প্রামাণিক বর্ণনা দেখার আগে আমরা মহর্ষি দয়ানন্দ এবং রমাবাঈয়ের ব্যক্তিগত পত্রব্যবহার দেখবো । কারণ পৌরাণিকদের দাবি হল- মহর্ষির পত্রসমূহ রমাবাঈয়ের প্রতি প্রেমপত্র ছিল। এখন প্রত্যক্ষভাবে সত্য জানার জন্য সেই পত্রসমূহ কেমন ছিল তা দেখা অত্যন্ত আবশ্যক।


প্রেক্ষাপট ও পত্রসংখ্যা:- মহর্ষি রমাবাঈকে মেরঠে আগমনের আমন্ত্রণ এবং ব্যাক্তিগত জিজ্ঞাসাদি করে দুটো পত্র প্রেরণ করেন তদুত্তরে রমাবাঈও দুটো পত্র প্রেরণ করেন। সুতরাং উভয়পক্ষের পত্রব্যবহারের সংখ্যা চার। আগে লিখা হয়েছে যে মহর্ষি ও রমাবাঈয়ের পত্রব্যবহার সংস্কৃত ভাষায় হয়েছিল। পৌরাণিকদের দাবি হল আর্যসমাজ এই চিঠিপত্র গুলো গোপন করে রেখেছে। অথচ মজার ব্যাপার হল এই মূল সংস্কৃত পত্রসমূহ মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত যুধিষ্ঠির জী মীমাংসকজীর দ্বারা সম্পাদিত, মহর্ষির পত্র ও বিজ্ঞাপন গ্রন্থে উপলব্ধ আছে। এখানে সংস্কৃতের বঙ্গানুবাদ সহ যুধিষ্ঠির জীর গ্রন্থের ভাগ, পৃষ্ঠাসংখ্যা এবং পত্রের পূর্ণসংখ্যা দেওয়া হলো। পত্রসমূহের ছবি ও বঙ্গানুবাদ নিম্নরূপ-

 

 

মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর পত্র  -১

॥ বঙ্গানুবাদ ॥

 

 স্বস্তি, শ্রীমতি শ্রেষ্ঠোপমার্হা, শ্রুতশাস্ত্রা, বিদ্যাভ্যাসাপন্না শ্রীযুতা রমার প্রতি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর অনেক অনেক আশীর্বাদ রইল। আশা করি যেখানে কল্যাণ আছে আপনি সেখানে কল্যাণের সাথে বর্ধিত হচ্ছেন।  সংস্কৃতবিদ্যার অভ্যাসে আপনার সুখ্যাতি শুনে আনন্দিত হয়েছিলাম।

    পত্রের মাধ্যমে শ্রীমতির সম্পর্কে আমার মতামত প্রকাশ করার পর একইভাবে আপনার অভিপ্রায়ও জানতে চাই । আশা করি আপনি শীঘ্রই আপনার অভিপ্রায় প্রকাশ করে কৃতার্থ করবেন।

এখন এবং ভবিষ্যতে আপনি কি কি করতে চান। যেমন জনশ্রুতি আছে যে আপনি ব্রহ্মচারিণী। এটি সত্য কি না? আপনি বিভিন্ন স্থানে সভাসমূহে; সুশোভিত, শাস্ত্রোক্ত লক্ষণ এবং প্রমাণযুক্ত তথা বিদ্বানগণের দ্বারা সমাদৃত বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। একথা কি ঠিক ?

    আমি শুনেছি যে আপনি বিবাহের জন্য স্বয়ংবর বিধিতে নিজের মতো গুণ, কর্ম ও স্বভাবসম্পন্ন কুমার উত্তম পুরুষকে খুঁজছেন। এটি সত্য কি না ? বিবাহ না করে ব্রহ্মচর্যে স্থিত থাকা কি অসম্ভব?

    আর্যাবর্তের সতী, বিদুষী গার্গী আদি কুমারীগণ যেভাবে ব্রহ্মচর্য ব্রতে স্থিত হয়ে নারী জাতির যতটুকু উপকার করেছেন সেভাবে ততটুকু উপকার বিবাহ করার পর অনেক প্রতিবন্ধকতার কারণে আপনি তাদের দিতে পারবেন না । এমন হওয়ায় আপনার ইচ্ছা কী?

নিজের সমান পুরুষকে প্রাপ্ত হয়ে বিবাহ করে যেভাবে নারীরা সাধারণত সন্তান জন্মদান, পালন , এবং স্বগৃহকর্মে প্রবৃত্ত হন সেভাবে আপনিও কি প্রবৃত্ত হবেন? কিংবা মেয়েদের পড়াবেন এবং নারীদের সুশিক্ষিত করবেন, এই ইচ্ছা রাখেন কি?

    শ্রীমতি বঙ্গদেশে থাকেন। অন্য স্থানে যান না এর কারণ কী? আমি মনে করি যে যতটা উপকার সর্বত্র গমনাগমনের মাধ্যমে হতে পারে ততটা এক স্থানে থাকলে হতে পারে না।

    যদি এখানে আসার ইচ্ছা হয় ; তাহলে আসুন। আসতে রাস্তায় যতো টাকা খরচ হবে তা আপনি এখানে পেয়ে যাবেন। যদি আসেন ; তাহলে যাত্রা শুরুর পূর্বে একটি পত্রের মাধ্যমে আসার সময় জানিয়ে দিবেন। যাতে এখানে আপনার থাকার জন্য স্থান ইত্যাদির ব্যাবস্থা হয়ে যায়।

    যদি শ্রীমতির ইচ্ছা হয় যে সর্বত্র উপদেশের জন্য যাত্রা করবেন তাহলে আর্যাবর্তের সব জায়গায় যাওয়ার জন্য এবং যোগক্ষেমের জন্য এখানের নিবাসী আর্যপুরুষগণ আপনাকে অর্থ সহযোগিতা করতে পারেন। এতে কোনো সংশয় নেই ।

    যদি আপনি পত্র প্রেরণ করেন অথবা আসেন তাহলে নিম্নলিখিত স্থানের সূচনা অনুসারে পত্র প্রেরণ করবেন বা আসবেন। বিদুষীর প্রতি অধিক কী লিখব?

-দয়ানন্দ সরস্বতী ।

১৯৩৬ বর্ষ, আষাড়মাস, শুক্লপক্ষ , ষষ্ঠী তিথি শনিবারে এই মান্যবর্ধক শিবপত্র লিখা হয়েছে।

মেরঠ ছাওনী বাবু ছেদিলাল গুমাস্তে কামসারয়াতের মাধ্যমে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর কাছে পৌঁছাবে। কিন্তু এতটুকুই লেখা যথেষ্ট যে (মেরঠ স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী) বরাবর যাবে।

তারিখ- ২৪ জুন ১৮৮০ । ফরাক্কাবাদ থেকে

[তথ্যসূত্র:- মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংসক দ্বারা সম্পাদিত ‘ ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী কা পত্র ব্যবহার ঔর বিজ্ঞাপন ’ পূর্ণসংখ্যা- ৪১২/ পৃষ্ঠা- ৪৪১]

 



 

পণ্ডিতা রমাবাঈয়ের পত্র - ১ [মহর্ষির প্রথম পত্রের উত্তরে]

 

॥ বঙ্গানুবাদ ॥

 

“ শ্রীমান! যিনি দ্যুলোক এবং পৃথিবীতে অখণ্ড জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূর্য প্রকাশিত করেছেন সেই শ্রী শ্রী  দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামীর পাদপ্রান্তে বহু প্রণামের সাথে, সম্যক উদাচারের সাথে এবং উচিত সম্মানের সাথে নিবেদন করছি,

    হে আর্যপাদ! এখন শ্রীমৎপাদের (আপনার) অনুগ্রহযুক্ত অনুকম্পাসূচক পত্র পেয়ে দুঃসহ শোকাদি তাপে আমার দগ্ধ হৃদয় অমৃতসিক্তের মতো শান্তি লাভ করেছে।  

শ্রীমৎপাদের দেবদুর্লভ অনুগ্রহ কোথায়? আর মহান ব্যাক্তিদের চরণধূলির উপমার অযোগ্যা বেচারী কোথায়? আর এই দাসীর আপনার মতো শ্রীমানের অনুগ্রহপ্রাপ্তির আশাও কোথায়? এতে তো আমার মতো অকিঞ্চিৎকর জনকে দয়া করা মহান পুরুষের অনুপম পরম ঔদার্যই সর্বত্র জয়লাভ করছে।

    সৎপুরুষগণের দয়া সমান হয়ে থাকে সেখানে উচ্চ-নীচের গণনা হয় না।  বৃক্ষের শাখাসমূহ কী কদাচিৎ পাদাশ্রিত অত্যন্ত নীচ ব্যাক্তির উপর থেকেও নিজের ছায়া তুলে নেয়?

    আজ আমার আর্যাবর্তে আসার প্রায় তিন হইতে চার বছর হয়। সেই থেকে আমি শ্রীমৎপাদের জ্ঞান-গৌরবের কথা সবসময় শুনে আসছি এবং আপনার চরণ দর্শনের জন্য মন খুবই উৎসুক হয়েছিল কিন্তু এতদিন যাবৎ সংশয়ের দোলায় আরূঢ় মন হৃদয়ের উৎসাহকে থামিয়ে রেখেছে যে , না জানি চতুর্থ আশ্রমে স্থিত শ্রীমৎপাদ এই বালবুদ্ধি স্ত্রীলোক আমাকে দর্শনদানের প্রসাদ দ্বারা কৃপা করবেন কি না? আজ ভবৎপাদের পত্র আমার সংশয়ের অন্ধকারকে দূর করে দিয়েছে।

    মহৎপাদ আমার বৃত্ত এবং অভিলাষ জিজ্ঞাসা করেছেন। জনশ্রুতি অনুসারে আজ পর্যন্ত আমি কুমারী। আমার ইচ্ছা আছে আমি যাবজ্জীবন কুমারী হয়েই থাকব। কিন্তু ভবিষ্যতে বিধির প্রবল সংযোগবশে যে, কি হবে তা জানি না।  

    সনাতন ভারতবর্ষের ভূষণ স্ত্রীরত্ন গার্গী আদি আজন্ম ব্রহ্মচারিণী এবং ব্রহ্মবাদিনী স্ত্রীগণ যেভাবে স্বজাতি এবং দেশের উন্নতি সাধন করতেন। এটা স্পষ্ট যে তাঁদের উপমেয় মহত্ত্বপূর্ণ কর্মের নাম গ্রহণও আমার মতো বালবুদ্ধি বালিকামাত্রের শোভা পায় না । তা নয় ঠিক,, কিন্তু নানা দেশের পর্যটন এবং শ্রীমৎপাদের মতো অতি বুদ্ধিমান মহাপুরুষগণের দর্শনের মাধ্যমে কিছু জ্ঞানলাভের ইচ্ছা রাখি।  

     প্রায় দুই বছর যাবৎ বঙ্গদেশ এবং রমনীয়তর ব্রহ্মপুত্রের পুলিন এবং বিশাল পর্বতের বন বিভাগে পরিবেষ্টিত আসাম দেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষিত দৃষ্টিসম্পন্ন সহোদরের সাথে আমি বাস করেছি। এখন শ্রীমৎপাদের সেবায় নিবেদন করতে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে যে আজ আড়াই মাস হবে , আমার সেই সহোদর ভ্রাতা তথা আজন্ম সহচর মৃত্যুবরণ করেছেন।  এখন আমি এই দুঃসহ শোকে ব্যাকুল-হৃদয় হয়ে কিছু সময়ের জন্য নিভৃতে একান্ত স্থানে থাকতে চাই এবং আশা করি যে এমন করলে চিত্ত স্থির হয়ে যাবে ।  তারপর  মাস বা দেড় মাস পরে শ্রীমৎপাদের দর্শন করে জীবন কৃতার্থ করবো । শ্রীমৎপাদের সেবায় অধিক লিখা থেকে নিবৃত্ত হয়ে আজ এখানেই সমাপ্ত করছি। ইতি শিবম্।

শ্রীমৎ চরণেষু -রমা ”

তারিখ- ৯ জুলাই ১৮৮০

[তথ্যসূত্র- মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংসক দ্বারা সম্পাদিত ‘ ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী কো লিখে গয়ে পত্র ঔর বিজ্ঞাপন-১ ’  তৃতীয় ভাগ। পূর্ণ সংখ্যা- ১৭৭/ পৃষ্ঠা- ১৯১]

 





মহর্ষির পত্র -২  [রমাবাঈয়ের প্রথম পত্রের উত্তরে]

॥ বঙ্গানুবাদ ॥

“ শ্রীমতী অনবদ্যা এবং অভ্যাসকৃত উত্তমবিদ্যারূপ অলঙ্কার দ্বারা শোভিতা, বর্তমান ভারতবর্ষের স্ত্রীজাতির মূর্খতাদি কলঙ্ক নিবারণের জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপা, সত্ত্ব, সুজনতা, আর্দ্রতা এবং সভ্য আর্য বিদ্বাগণের দ্বারা বরণযোগ্য স্বভাবযুক্তা, নিজ অভিপ্রায় লেখ দ্বারা প্রকাশিকা, প্রিয় এবং বর মন যুক্তা শ্রীযুতা রমার প্রতি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর অনেক অনেক আশীর্বাদ রইল।

  এখানে কল্যাণ (সবকিছু ভালো) আছে । আপনার কল্যাণের নিত্য আশা করি। আপনার প্রেমাস্পদ (প্রীতিপূর্ণ) আনন্দপ্রদ পত্র পেয়েছি। তা দেখে অতীব সন্তোষ লাভ করেছি। শ্রীমতিকে একটু কষ্ট দিচ্ছি, ক্ষমা করবেন। আমার আশ্চর্য হচ্ছে যে আনন্দবর্ধনের জন্য আপনার প্রতি পত্র পাঠানো হয়েছিল কিন্তু এর উত্তরে পত্র আসতেই , তা কেন হর্ষ এবং শোকদায়ক হলো?

শ্রীমতির লিখা দেখে আনন্দিত এবং শ্রীমতির ভ্রাতার মৃত্যুসংবাদ শুনে দুঃখী হবেন না। এমন কে আছেন? কিন্তু এর পরও এখন এই অশক্য সাংসর্গিক সংযোগবিয়োগাত্মক জন্মমরণস্বরূপ লোকব্যবহারে শ্রীমতি শোক করার যোগ্য নন।

শ্রীমতির জন্ম কোথায়? আয়ু কত? আপনি কী কী পড়েছেন বা শ্রবণ করেছেন? সংস্কৃত এবং আর্যাবর্তের ভাষা ছাড়া কোনো অন্য দেশের ভাষা আপনি শিখেছেন কি না ? আপনার নিজের বাড়ি কোথায় এবং আত্মীয় স্বজন কোথায় থাকেন? মা বাবা আছেন কি? যিনি মারা গিয়েছেন তিনি আপনার চেয়ে বড়ো না ছোট ছিলেন? এখন আপনি নির্দোষার কাছে স্বজাতির কোনো নারী-পুরুষ আছেন কি? অথবা একাকিনী আছেন? 

আহা! আমি আশ্চর্যান্বিত যে আমাদের পত্র কাকতালীয় ন্যায়ের মত কিভাবে আনন্দ ও দুঃখের সংযোগসূচক হলো! কিন্তু এই ভেবে আমার সন্তোষ হচ্ছে যে আপনাদের মধ্যে যারা বিদ্বানগণের দ্বারা সৎকারের যোগ্য তাদের মধ্যে শোকের লেশমাত্র থাকতে পারে না ।

যদি পথখরচের জন্য অর্থের প্রয়োজন থাকে তাহলে শীঘ্রই জানাবেন কত টাকা পাঠাতে হবে? পূর্ব পরিচয় ছাড়া কিভাবে টাকার জন্য লিখবেন, আপনার এরকম সংশয় বা লজ্জাবোধ করা উচিত নয় । যদি আপনার কাছে টাকা থেকে থাকে তাহলে (আপাতত) লিখবেন না। যেভাবে আমি আগের পত্রে লিখেছি সেভাবে আপনার এখানে আসার পর পথখরচের টাকা পেয়ে যাবেন। হে নির্দোষে! এভাবে কার্য হোক।

  যেভাবে আপনি আপনার শুভ আগমনের সূচনা দুই ভাবে লিখেছেন। তার মধ্যে প্রথম প্রতিজ্ঞা এই ছিল যে এই মাসের পরে আসবেন, যদি এই বচন অনুসারে আসতে পারেন তবে এই উদ্যোগ খুবই ভালো হবে। আমিও ২৫ দিন পর্যন্ত সেখানে থাকতে চাইছি । যদি আপনি এ সময়ের মধ্যে আসেন তাহলে আমার সাথে দেখা হবে। (নতুবা পরবর্তীতে) এরপর যেখানে যাব, সে খবর শ্রীমতিকে লিখে জানাব।

ইতি। বিদুষী বিচক্ষণার প্রতি অধিক লেখা থেকে বিরত হচ্ছি।

সং ১৯৩৭ বর্ষ, আষাড় মাস, শুক্লপক্ষ পৌর্ণমাসী বুধবারে লিখে অলঙ্কৃত করা হয়েছে ॥

– দয়ানন্দ সরস্বতী ”

 তারিখ- ২১ জুলাই ১৮৮০। মেরঠ থেকে

[তথ্যসূত্র:- মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংসক দ্বারা সম্পাদিত ‘ ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী কা পত্র ব্যবহার ঔর বিজ্ঞাপন ’ পূর্ণসংখ্যা- ৪২৬/ পৃষ্ঠা- ৪৫৭]

 



রমাবাঈয়ের পত্র -২  [মহর্ষির দ্বিতীয় ও শেষ পত্রের উত্তরে]

 

 ॥ বঙ্গানুবাদ ॥

 

যেই শ্রীমান সমস্থ জগৎকে অনবদ্য এবং উদার সুজনতার গুণে নত করিয়েছেন, সেই শ্রী দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামীজির চরণে বিহিত অনেক প্রণাম, সম্যক উদাচার এবং উচিত সম্মানপূর্বক নিবেদন,

  আর্যপাদ! শ্রীমানের (আপনার) প্রেরিত দুই অনুগ্রহ পত্র যথাসময়ে পেয়ে আমি খুবই আহ্লাদিত হয়েছি। কিন্তু নিজের দুর্ভাগ্যবশত এখনও পর্যন্ত এরর উত্তর প্রদানে অসমর্থ হয়েছি। এর কারণ প্রবল মাথাব্যাথা এবং জ্বর ছিল। এখন গত রাতের দুই আড়াই মূহুর্ত অতিবাহিত হওয়ার পর শ্রীমৎপাদের দর্শনের জন্য বাষ্পীয় যানে আরোহণ করে চলার ইচ্ছা হচ্ছে। শ্রীমানের আজ্ঞানুসারে এই সমাচার প্রথমেই পত্রদ্বারা সূচিত করছি।

এখন শ্রীমৎপাদ আমার সম্পর্কে যা যা বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করেছেন তা লিখা হয়েছে-

ভারতবর্ষের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে শ্রীমৎ মৈসূর রাজার দেশে যে সহ্য পর্বত আছে তার মধ্যে গঙ্গামূল নামক স্থানে আমার জন্ম। এখন আমার বাইশ বছর বয়স অতিক্রান্ত হয়েছে এবং বর্তমানে তেইশ বছর চলছে।

   শ্রীমান ! আমার অধ্যয়নের সীমা সাধারণত ক, চ, ট, ত, প  আদি বর্ণ পর্যন্ত অনুমান করে নিবেন। এর অতিরিক্ত কিছু বলার উৎসাহ হচ্ছে না। আমি কোনো ভিনদেশি ভাষা শিখি নি। 

   নিজ আবাস পূর্বলিখিত মৈসূর দেশেই জন্মস্থানের কিছু দূরে পর্বতের উপত্যকায় । এবং বংশও সেখানেই অল্প অবশিষ্ট আছে। মাতা-পিতা লোকান্তরে গমন করেছেন। যেই ভাইয়ের মৃত্যু  হয়েছে তিনি আমার ছয় বছরের অগ্রজ  ছিলেন। বংশে কেবল দুই সৎ ভাই আছে। এখন আমার কাছে কোনো স্বজাতীয় ব্যাক্তি নেই। কেবল একজন পরিচারিকা একজন ভৃত্য এবং এক কৃতকভ্রাতা সাথে আছেন।

  শ্রীমৎপাদের কৃপায় মার্গব্যায়ের টাকা আছে। চার-পাঁচ দিনের মধ্যে শ্রীমৎপাদের দর্শনের মাধ্যমে জীবন কৃতার্থ করবো। এই সংকল্প রইল। তারপর দেবেচ্ছা।

শ্রীমৎপাদের প্রতি অধিক কী লিখব?

নিতান্ত অনুগৃহীতা  - রমা

কলকাতা ১-৮-৮০

[তথ্যসূত্র:- মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংসক দ্বারা সম্পাদিত‘ ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী কো লিখে গয়ে পত্র ঔর বিজ্ঞাপন-১ ’  তৃতীয় ভাগ। পূর্ণ সংখ্যা- ১৯২ / পৃষ্ঠা- ২০৬ ]

 

 

  • আর্যসমাজ মেরঠে পণ্ডিতা রমার আগমন এবং অবস্থানের  বৃত্তান্ত।

তিনটি জীবনীগ্রন্থের বর্ণনা।

[মূল পৃষ্ঠাসহ বঙ্গানুবাদ]

মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী সালে ৮ জুলাই ১৮৮০ সালে মেরঠে পদার্পণ করেন। এবং এখানেই রমাবাঈয়ের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। পূর্বে লিখিত বিপিন বিহারী মেধ্বীর সাথে রমাবাঈয়ের বিবাহের তারিখটি লক্ষ্য করুন। রমাবাঈ বিপিনের সাথে ১৩ ই জুন, ১৮৮০ তারিখে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এবং  ৬ আগস্ট ১৮৮০ তারিখে মেরঠে আসেন। অর্থাৎ স্পষ্টভাবে রমাবাঈ মেরঠে আসার আগে থেকেই বিবাহিত ছিলেন। যদিও মহর্ষি দয়ানন্দ এবং আর্যসমাজের কাছে তিনি নিজের বিবাহের কথা গোপন রাখেন।  ৯ জুলাই ১৮৮০ তারিখে মহর্ষির উদ্দেশ্যে লিখা নিজের প্রথম পত্রে রমাবাঈ লিখেন,

जनप्रवादमहमद्यावधि कुमारीयावज्जीवं कौमार्यमेवावलम्ब्यमिति ममाभिलषितम्भविष्यति काले प्रबलविधिनियोगवशात्कि भविष्यतीति वेद्मि ।” অর্থাৎ:- “জনপ্রবাদ অনুসারে আজ পর্যন্ত আমি কুমারী। আমার ইচ্ছা আছে আমি যাবজ্জীবন কুমারী হয়ে থাকব। কিন্তু ভবিষ্যতে বিধির প্রবল সংযোগবশে যে, কি হবে তা জানি না।” [দেখুন - রমাবাঈয়ের প্রথম পত্র]

এখানে রমাবাঈ ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা কথা লিখেছেন। কারণ এই পত্র লিখার আগেই (১৩ই জুন) তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিলো।

পণ্ডিতা রমাবাঈয়ের আর্যসমাজ মেরঠে আগমন বিষয়ে মহর্ষির জীবনীগ্রন্থের রচয়িতাগণ বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এখন মহর্ষির তিনজন সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রামাণিক জীবনী লেখকের প্রদত্ত বৃত্তান্ত এখানে উদ্ধৃত করছি।

 

  • ১. শ্রী পণ্ডিত লেখরাম জীর বর্ণনা-

 

মেরঠ নগরের বৃত্তান্ত

[ ৮ জুলাই সন ১৮৮০ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৮০ পর্যন্ত]

…৮ জুলাই, সন ১৮৮০ তে স্বামীজি মেরঠ আর্যসমাজের প্রার্থনায় সেখানে পদার্পণ করেন এবং ছাওনী স্থিত মুন্সী রামশরণদাস জী, উপমন্ত্রী আর্যসমাজ মেরঠের কোঠীতে বাস করেন।

…সারাংশ এই যে, এবার স্বামীজি দুইমাসের অধিক মেরঠে বাস করেন। এবং প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় নিজ বাসস্থানে বসে লোকেদের সত্যোপদেশ দ্বারা উপকার করতে থাকেন। তখন প্রতি সপ্তাহে দুইটি ব্যাখ্যান হতো। যেখানে বিদ্যার মহত্ত্ব এবং বিদ্যালাভের প্রয়োজনীয়তা, ধর্মের সত্য জ্ঞান, ঈশ্বর এবং মায়ার বর্ণনা, পবিত্র বেদ ঈশ্বরকৃত হওয়ার প্রমাণ, প্রকটরূপে মুক্তির সাধনা এবং এর ব্যাখ্যা, বেদান্তদর্শন, স্বার্থপর দের স্বার্থ, পাপ এবং পুণ্যের বিচারের সমর্থন, নাস্তিকদের আক্ষেপের খণ্ডন, এক উপনিষদের অনেক স্থল এবং অন্য বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করেন।

… স্বামীজি এবং রমাবাঈয়ের অনেক সময় ধরে পত্রব্যবহার হয়েছিল। এজন্য এই পত্রব্যবহারের সময় রমাবাঈ একজন বাঙালি এবং দুইজন সেবকের সাথে (যেখানে এক নারী এবং এক পুরুষ ছিল) মেরঠে আসেন। তিনি নিজেকে দক্ষিণের অধিবাসিনী বলতেন এবং এখন কিছু বছর ধরে কলকাতা এবং এর নিকটস্থ প্রদেশে থাকতেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এদেশে বর্তমান সময়ের নারীদের তুলনায় তিনি সংস্কৃত বিদ্যায় অতি নিষ্ণাত এবং বক্তৃতা দেওয়ার জন্য জগদ্বিখ্যাত ছিলেন। তিনি নারীশিক্ষার বিষয়ে চার বা পাঁচটি বক্তব্য প্রথমে বাবু ছেদীলালের কোঠীতে এবং শেষে আর্যসমাজে দিয়েছিলেন। এসব ব্যাখ্যান বড়ো ধুমধামের সাথে হয়েছিল। বক্তব্যে প্রথমত ভাষা পরিস্কার, তারপর সেখানে যুক্তি এবং উদাহরণের সংযুক্তি প্রবল এবং প্রকরণানুকূল ছিল।

সারাংশ এই যে রমাবাঈ দুই সপ্তাহের বেশি সেখানে বাস করেন। তারপর নিজের এক বাঙালি বন্ধুর সাথে; (যিনি তাঁর আসার পর মেরঠে আসেন) দিল্লী হয়ে নিজের জন্মভূমির দিকে চলে যান। স্বামীজি মহারাজ স্বরচিত পুস্তকের এক প্যাকেট (যেখানে সংস্কারবিধি, সত্যার্থপ্রকাশ, সন্ধ্যা, আর্য্যাভিবিনয়ঃ আদি অনেক বই-পুস্তক ছিল।) রমাবাঈকে প্রদান করেন এবং সমাজ (আর্যসমাজ) তাঁকে মার্গব্যায় এবং উৎসাহবৃদ্ধি বিবেচনায় একশত পঁচিশ রূপী নগদ এবং দশ রূপী মূল্যের একটি থান প্রস্থানের সময় তাঁকে উপহার দেন। রমাবাঈ জীর বিদ্যা সম্পর্কিত যোগ্যতায় কোনও সন্দেহ নেই এবং এসব কিছু হওয়ার পরেও আশ্চর্য যে, যদি তিনি সদাচারিণী না থাকেন এবং দুরাচারের দ্বারা নিজের যোগ্যতাকে নষ্ট করেন। তাঁর কিছুদিন এখানে থাকা দেখে আমাদের এই অনুভব হয়েছে। এর চেয়ে অধিক বৃত্তান্ত সম্পর্ক হলেই জানা যেতে পারে।”

[তথ্যসূত্র:- শ্রী পণ্ডিত লেখরাম আর্য কৃত, জীবনচরিত্র- মহর্ষি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী। তৃতীয় অধ্যায় / তৃতীয় পরিচ্ছেদ। মেরঠ নগর কা বৃত্তান্ত / পৃষ্ঠা -৫১০]

 


  • ২. স্বামী সত্যানন্দজীর রচিত, ‘শ্রীমদ্দয়ানন্দ-প্রকাশ’ গ্রন্থের বর্ণনা-

 

“ আষাঢ় ১ সংবৎ ১৯৩৭ এ স্বামীজি মেরঠে পদার্পণ করেন এবং শ্রীমান রামশরণদাসের কুঠিতে বাস করা শুরু করেন। সেখানে তিনি এক, দুই সপ্তাহে অনেক ব্যাখ্যানমালা দেন। এতে মেরঠের অধিবাসীরা কৃতার্থ হন। এক দিন মহারাজের ব্যাখ্যানে অনেক পণ্ডিত, খ্রিস্টান এবং মুসলমান নিজেদের শঙ্কা লিখছিলেন। কিন্তু ব্যাখ্যানের পর সবাই নিজের টিপ্পনী পত্র নিজেই ছিড়ে দেন। যখন তাঁদেরকে এমনটা করার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয় তখন তাঁরা বলেন, আমাদের শঙ্কার উত্তর ব্যাখ্যানেই এসেছে।

স্বামীজি মহারাজের আন্তরিক কামনা  ছিল যে কোনো ভাবে মাতৃ শক্তির সংশোধন হোক। নারীদের মধ্যেও ধর্ম প্রচার এবং শুভ শিক্ষা সমূহ বিস্তার লাভ করুক। সুক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন স্বামীজি এই সিদ্ধান্তের মর্মার্থ জানতেন যে , মায়েদের হাতই তাদের সন্তানদের নতুন জীবনের ভিত্তি স্থাপন করে। মিষ্টি কথার দ্বারা মায়েরা সন্তানদের মধ্যে সেই ভাবের সঞ্চার করতে পারেন যা অন্য কোনো স্থানে পাওয়া যায় না। মায়েরা জাতীর জীবনের বাস্তবিক মূল। তাঁরা সন্তানদের উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রজ্বলিত জ্যোতি। কিন্তু তিনি এমন কোনো আর্য দেবীকে দেখতে পেতেন না, যিনি ভারতের সহজ সরল ভাই বোনদের শিক্ষা দীক্ষার ভার নিজের উপর নিতে পারেন, যিনি নারীদের উন্নতির জন্য প্রাণপণে উদ্যোগী হতে পারেন।

     মহারাজের হৃদয় এই চিন্তা এবং বিচার পরম্পরায় নিবেদিত ছিল যে, উনার সেবায় একে একে রমাবাঈয়ের পত্র আসতে থাকে। সেসব পত্র পূজ্যভাব, আদর, এবং ভক্তি বিনয়ে পরিপূর্ণ ছিল। শ্রী রমা নিজের বিনয়পূর্ণ পত্রে স্বামীজির দর্শনের তীব্র ইচ্ছা প্রকট করেন সেখানে স্বামীজির আদেশ পালন করার আশাও প্রদান করেন ।

     মহারাজ নিজের অপার কৃপা দ্বারা রমাবাঈকে দর্শন দেওয়া স্বীকার করেছিলেন। শ্রী রমাজী বড়ো ভক্তি ভাব নিয়ে মেরঠে আসেন এবং শ্রী দর্শনের লাভ গ্রহণ করতে থাকেন । শ্রী রমাবাঈ জী এক মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণের কন্যা ছিলেন । তাঁর সংস্কৃতপাণ্ডিত্যের বিশেষ খ্যাতি ছিল। তিনি ধারাবাহিক সংস্কৃতে বক্তৃতা দিতেন। উনি কিছু স্বাধীনচেতা মানুষও ছিলেন। তিনি এক বঙ্গীয় কায়স্থের সাথে বিবাহ করতে ইচ্ছুক ছিলেন। এজন্য বন্ধু বান্ধবরা তাঁকে ঘর থেকে আলাদা করে দিয়েছিলেন। যখন তিনি কলকাতা থেকে মেরঠে আসেন, তখন তার সাথে একজন সেবক, একজন সেবিকা এবং একজন বাঙ্গালী সভ্য ছিলেন। সম্ভবত উনিই সেই ভদ্র পুরুষ যার সাথে রমাবাঈ বিবাহ করতে ইচ্ছুক ছিলেন।

      মেরঠে রমাবাঈয়ের অনেক ভাষণ হয়েছিল । সে সময় পণ্ডিত ভীমসেন জী, জ্বালাদত্তজী, পালীরাম জী এবং শ্রীমান জ্যোতি স্বরূপ জী ইত্যাদি বিদ্যার্থীগণ স্বামীজি মহারাজের কাছে বৈশেষিক দর্শন অধ্যয়ন আরম্ভ করেছিলেন। তাদের সাথে শ্রীমতি রমাজীও অধ্যয়ন শুরু করেন।  মহারাজের অধ্যাপনার কৌশল খুবই ভালো ছিল, তাঁর ব্যাখ্যা করার পদ্ধতিও ছিল অপূর্ব। শ্রী রমা আদি সব বিদ্যার্থীগণ স্বামীজির সুশৃঙ্খল পাঠদানে খুবই প্রসন্ন হতেন। যার মনে যেমন সংশয় আসুক না কেন; পাঠ পড়তে পড়তেই সংশয় দূর হয়ে যেত।

    মহারাজ শ্রীরমাজীকে উপদেশ দিয়েছিলেন, “ এসময় আর্য জাতিতে নারীদের অবস্থা খুবই শোচনীয় । তারা এই সংসারে ভ্রম এবং কুসংস্কারের  শিকার হচ্ছেন। আপনি আজীবন ব্রহ্মচারিণী থেকে তাঁদের রক্ষা করুন। তাদের শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করুন। এই দীনহীন দশা থেকে তাদের উদ্ধার করুন। এই শুভ কার্য আর্যসমাজের পদ্ধতিতে চালানোর জন্য আপনি পর্যাপ্ত আর্থিক সহযোগিতা পেতে থাকবেন। ”

    মহারাজ তাঁকে এটাও বলেছিলেন যে,

“ আপনাকে ছাড়া কোনো নারীকে সামনে বসিয়ে আমি কখনো ধর্মোপদেশ দিইনি। আপনাকে দিচ্ছি কারণ আপনি অদ্বিতীয় বিদুষী। হতে পারে আমার উপদেশ শুনে আপনি আজীবন ব্রহ্মচারিণী হয়ে নারী জাতির উপকাররূপ পরম পুণ্য  কার্যে প্রাণপণে পরায়ণ হবেন। ”

    শ্রী রমা বিনীত নিবেদন করে বলেন, “ মহারাজ! গৃহস্থ লোকও তো উপকারের কাজ করতে পারে। তাদেরও তো পুণ্য কর্মের পুঁজি উপার্জন করার পুষ্কল সুযোগ মিলে যায়। ”

    এতে স্বামীজি বলেন, “বন্ধুবান্ধবের বিবিধ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ব্যাক্তি ততটুকু পরোপকার করতে পারে না, যতটুকু একজন ব্রহ্মচারী এবং ব্রহ্মচারিণী করতে পারেন। যারা দুই একজন ব্যাক্তিকে নিজের প্রেমের কেন্দ্র বানিয়ে নেয়, তাদের মধ্যে পরোপকার করার মাত্রা সহজেই অল্প হয়ে যায়। তাদের কাজ ইত্যাদি থেকে অবকাশই হয় না। যখন সন্তানের জন্ম হয় তখন সন্তান পালন পোষণের চিন্তা এসে যায়। পতি, পুত্র-পৌত্র ইতুআদির  মৃত্যু সকল সুখকে নিরস করে দেয়। যখন কেউ এভাবে গৃহস্থীর অতল গহ্বরে চাপা পড়ে যায় তখন সে পরোপকারের কথা এক এক করে ভুলে যেতে থাকে। এজন্য রমা আপনি নিজের জীবনকে পরার্থে অর্পণ করুন। নারীদের মঙ্গল কার্য সাধিত করুন। ”

     যেভাবে জ্বরগ্রস্থ মানুষের খাবারে রুচি হয় না। ঠিক এভাবেই পূর্বকৃত কর্মের প্রভাবে শ্রীমতি রমার মনে মহারাজের উপদেশের জায়গা হয়নি । শ্রী রমা আজীবন ব্রহ্মচর্য ব্রতে স্থিত থাকার জন্য সমুদ্যত হন নি।

     রমাজী, স্বামীজি মহারাজের কাছে অন্যান্য দর্শনও অধ্যয়ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রমাজী স্বামীজির উপদেশ শুনেন এবং পুনরায় কলকাতায় প্রস্থান করেন । যাওয়ার সময় মহারাজ সেই দেবীকে নিজের সব পুস্তকের একটি করে কপি প্রদান করেন।

[তথ্যসূত্র:- শ্রীমদ্দয়ানন্দ প্রকাশ। সংগঠন কাণ্ড/ দ্বাদশ সর্গ। পৃষ্ঠা- ৪৫৪–৪৫৭]

 



 


  • ৩. পণ্ডিত ঘাসীরাম জীর বর্ণনা-

 

একই প্রসঙ্গে মহর্ষির আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ জীবনীগ্রন্থের প্রণেতা, মেরঠ নিবাসী এডভোকেট শ্রী পণ্ডিত ঘাসীরাম জীর গ্রন্থ, ‘ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী কা জীবন-চরিত ’ গ্রন্থের ষড়বিংশ অধ্যায়ে আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় । এই বিস্তারিত বর্ণনায় বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট হয়। সুতরাং ঘাসীরাম জীর প্রদত্ত তথ্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য,

 

মেরঠ- শ্রী মহারাজ ৮ জুলাই ১৮৮০ সালে মেরঠ আর্যসমাজের নিমন্ত্রণে মৈনপুরী থেকে মেরঠে পদার্পণ করেন। এবং লালা রামশরণদাসের কোঠী মেরঠ ছাওনীতে বাস করেন। নিজ স্থানে জিজ্ঞাসুদের সন্দেহ নিবারণ করতে থাকেন। এবং সপ্তাহে বিভিন্ন বিষয়ে দুইটি বক্তৃতা দিয়ে ভ্রমজালকে ছিন্নভিন্ন করে বৈদিক ধর্মের প্রচার করতে থাকেন।

 অধ্যাপিকার আবশ্যকতা- মেরঠ আর্যসমাজে কন্যা পাঠশালা স্থাপিত হয়। এজন্য একজন সুযোগ্য শিক্ষিকার প্রয়োজন হয়েছিল। স্বামীজি মহারাজ রমাবাঈ নামক একজন সুশিক্ষিত এবং সংস্কৃতজ্ঞ মহারাষ্ট্রীয় নারীর কথা জানতে পারেন। সেসময় রমাবাঈ কলকাতায় ছিলেন। স্বামীজি মহারাজ তাঁকে পত্র লিখে পাঠান এবং উভয়ের কিছু পত্রব্যবহার হয় । তাতে রমাবাঈ মেরঠে আসতে রাজি হন। এই পত্রব্যবহার সংস্কৃতে হয়েছিল।

রমাবাঈয়ের আগমন – রমাবাঈ দুইজন ভৃত্য ( এক পুরুষ ও এক নারী) কে সাথে নিয়ে মেরঠে আসেন। তাঁকে বাবু ছেদীলালের বাংলোতে থাকার স্থান করে দেওয়া হয়েছিল। যেখানে কর্নেল অল্কাট এবং ম্যাডাম ব্লাভাটস্কি আগে থেকেই ছিলেন। রমাবাঈয়ের আসার পর তাঁর এক বাঙালি বন্ধু মেরঠে আসেন এবং তাঁর সাথে থেকে যান । এই ভদ্রলোকের নাম ছিল, বাবু বিপিনবিহারী এম০ এ০ বি০ এল০ । সেখানে নারীশিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে রমাবাঈ চার পাঁচটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন । প্রথম বক্তৃতা বাবু ছেদীলাদের কুঠিতে এবং শেষ বক্তৃতা স্থানীয় আর্যসমাজে হয়েছিল।  স্বামীজি মহারাজ রমাবাঈয়ের বক্তৃতা শুনতে যেতেন না। পণ্ডিত জ্বালাদত্তকে পাঠিয়ে দিতেন যাতে বক্তব্যের সারকথা লিখে এনে শুনিয়ে দিতে পারেন। রমাবাঈ সন্ধ্যার সময় স্বামীজি মহারাজের থেকে বৈশেষিক দর্শন পড়তে আসতেন। সে সময় স্বামীজি মহারাজের বিশেষ আদেশে পণ্ডিত ভীমসেন, পণ্ডিত জ্বালাদত্ত এবং আর্যসমাজের সভাসদ পণ্ডিত পালীরাম এবং বাবু জ্যোতিস্বরূপ উপস্থিত থাকতেন।

রমাবাঈয়ের প্রচারকার্যে অসম্মতি- মহারাজ চাইতেন যেন রমাবাঈ আজীবন ব্রহ্মচর্যব্রত পালন করে নারীশিক্ষার প্রসার এবং বৈদিক ধর্মের প্রচার করেন । কিন্তু রমাবাঈ এই কাজে নিজের অসমর্থতা (অসম্মতি) প্রকাশ করেন ।

রমাবাঈয়ের উদ্দেশ্য- রমার স্বামীজি মহারাজের কাছে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যে, স্বামীজি যেন ঐ বাঙালি যুবকের সাথে তার বিবাহ হওয়াকে শাস্ত্রসম্মত বলে স্বীকার করে নেন। রমাবাঈ মহারাষ্ট্রের ব্রাহ্মণকন্যা ছিলেন আর বিপিনবিহারী ছিলেন বাঙালি কায়স্থ। রমাবাঈ জানতেন যে এই বিবাহ কেবল স্বামীজিই শাস্ত্রসম্মত বলে অনুমোদন করতে পারেন, কারণ তিনি প্রাচীন ভারতের বর্ণব্যাবস্থাকে গুণ, কর্ম, স্বভাব নির্ভর বলে মানতেন। কিন্তু মহারাজ তার এই বিবাহের অনুমতি দেন নি বরং রমাবাঈকে বলেন, তুমি নিজের জীবন নারীশিক্ষা এবং উদ্ধারে নিযুক্ত করো। রমাবাঈ এ কথায় সম্মত হন নি।  এতে স্বামীজি অনেক নিরাশ হন এবং বলেন যদি আমি জানতাম যে রমাবাঈ স্বদেশের পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ করতে রাজি হবে না তাহলে আমি কখনোই নিজের নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে সামনে বসিয়ে শাস্ত্র শিক্ষা দিতে উদ্যত হতাম না ।

রমাবাঈ মহারাজের কাছে প্রার্থনা করেন, আমাকে থাকার আজ্ঞা দিন এবং দয়া করে অন্য শাস্ত্রও পড়ান। কিন্তু মহারাজ তাকে বলেন, আজ থেকে তোমার সাথে আমার কোনো সম্বন্ধ নেই। তাঁর উদ্দেশ্য কেবল এটুকুই ছিল যে , রমাবাঈ যেন প্রাচীন ঋষিকাদের মত ভারতবর্ষের মা বোনদের উপকারের জন্য কাজ করেন। এই উদ্দেশ্য বিফল হতে দেখে তিনি রমাবাঈয়ের উপর বিরক্ত হন।

রমাবাঈয়ের চরিত্র নিয়ে সন্দেহ- তার চরিত্রের বিষয়েও স্বামীজি মহারাজের কিছু সন্দেহ হয়েছিল। সুতরাং তিনি মেরঠ আর্যসমাজের কার্যকর্তাদের জানান তাঁরা যেন রমার দিকে দৃষ্টি রাখেন । কার্যকর্তারাও রমাবাঈয়ের বিষয়ে ভালো মত দেন নি।

রমাবাঈ এটাও বলেছিলেন যে তিনি তখনই অধ্যাপন এবং উপদেশ ইত্যাদি কাজ করতে পারবেন যখন তার পিতার ঋণ পরিশোধ করা হবে । যার সংখ্যা ষাট থেকে সত্তর হাজার রুপি বলেছিলেন।

এরপর রমাবাঈয়ের মেরঠে থাকার কোনো অর্থ ছিল না । সুতরাং তাকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত হলো। স্বামীজি মহারাজ মেরঠ আর্যসমাজের কার্যকর্তাদের বলেন, যে সম্মানের সাথে রমাবাঈকে আনা হয়েছিল একই সম্মানের সাথে তাকে বিদায় করা হোক। সুতরাং রমাবাঈয়ের বিদায়ের পূর্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সম্মান প্রদর্শন – সভায় পণ্ডিত পালীরাম রমাবাঈকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ পণ্ডিতা রমাবাঈয়ের নিজের দৃষ্টি এবং উদ্দেশ্য উচ্চ রাখা উচিত। স্বামী দয়ানন্দের মতো উপদেশ প্রবচন দিয়ে নারীদের উপকারে প্রবৃত্ত হওয়া উচিত। বিবাহ করে সন্তানোৎপত্তি করা উচিত নয়। ” রমাবাঈ এর উত্তরে স্বামীজি মহারাজকে বৃহস্পতির উপমা দিয়ে বহু প্রশংসা করেন এবং বলেন যে প্রস্তাবিত কার্যে তিনি অক্ষম। এমন কাজ তো স্বামীজির মতো উত্তম কোটির লোকই করতে পারেন। নারী হওয়ার কারণে তার জন্য বিভিন্ন স্থানে যাওয়া আসা সম্ভব নয়। ইত্যাদি।

রমাবাঈয়ের বিদায়ের সময় আর্যসমাজ মেরঠের পক্ষ থেকে তাকে ১২৫ রুপি নগদ এবং দশ রুপির একটি থান উপহার দেওয়া হয়। স্বামীজি মহারাজ তাকে সংস্কারবিধি, সত্যার্থ প্রকাশ, পঞ্চমহাযজ্ঞবিধি, আর্য্যাভিবিনয় ইত্যাদি গ্রন্থ দিয়েছিলেন।

রমাবাঈ খ্রিস্টান- রমাবাঈ পরবর্তীতে খ্রিস্টান হয়ে যান এবং পূনায় শারদা সদন নামে এক বিধবা আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করে শত শত হিন্দু বিধবাকে ধর্মান্তরিত করেন।

স্বামীজির বিষয়ে রমাবাঈয়ের মতামত- দেবেন্দ্র বাবু রমাবাঈয়ের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে স্বামীজির আদেশের ব্যাপারে রমাবাঈয়ের মতামত এবং ধারণা জিজ্ঞাসা করেন । এই চিঠির উত্তর রমাবাঈ ২৩ নভেম্বর ১৯০৩ সালে দিয়েছিলেন। তাতে তিনি লিখেন,

“ ..আমি মেরঠে আর্যসমাজের এক সভাসদের ঘরে থেকেছিলাম। আমি তখন স্বামীজির বিশেষ শিক্ষার বিষয়ে সর্বথা অনভিজ্ঞ ছিলাম। আমি মেরঠে তিন সপ্তাহের বেশি সময় কাটিয়েছিলাম যে কারণে আর্যসমাজের মুখ্য মান্যতাসমূহের বিষয়ে স্বয়ং এর প্রবর্তকের কাছ থেকে জানার সুযোগ হয়েছিল। স্বামীজির সম্পর্কে যে ধারণা আমার মনে অঙ্কিত রয়েছে তা বাস্তবে অতি উত্তম। স্বামীজি সর্ব প্রকারে দয়াস্বরূপ ছিলেন। তিনি এক বিশাল দর্শন ভদ্র পুরুষ ছিলেন, তথা সত্য ও শুদ্ধভাবযুক্ত পিতৃপ্রকৃতির পুরুষ ছিলেন। আমার সাথে তাঁর আচরণ পিতৃতুল্য এবং কৃপাপূর্ণ ছিল।

স্বামীজি শুদ্ধ ভাষায় এবং প্রভাব উৎপাদক স্বরে কথা বলতেন। তিনি কখনো হিন্দি আবার কখনো সংস্কৃতে কথা বলতেন । তবে সংস্কৃতই তাঁর প্রিয় ভাষা ছিলো। হিন্দুদের ষড়দর্শনের মধ্যে তিনি বৈশেষিক দর্শন কে বেশি পছন্দ করতেন । উনার শিক্ষা অদ্বৈতবাদ থেকে ভিন্ন ছিল এবং তখন আমি শুধু এই এক বিষয়ে  উনার সাথে সহমত ছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, আমি চাই তুমি আর্যসমাজে সম্মিলিত হও, আমি তোমাকে শিক্ষা দিয়ে আর্যসমাজের সিদ্ধান্ত প্রচারের জন্য প্রস্তত করবো। কিন্তু আমি ধর্মীয় বিষয়ে অব্যবস্থিত ছিলাম, সুতরাং আমি এই প্রস্তাবকে অস্বীকার করে দিয়েছিলাম।

সেই পত্রের এক স্থানে রমাবাঈ লিখেন যে , 

“ স্বামী দয়ানন্দ নারীদের জন্য ধর্মের আবশ্যকতা মানতেন। তিনি বলতেন যে নারীরা বেদ পড়তে পারে। যে বিষয়ে কি না হিন্দুধর্ম আজ্ঞা দেয় না। এ কারণে হিন্দু ধর্ম নারী এবং শুদ্রদের প্রতি বিদ্বেষ করে। আমার আত্মা এর বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল। যেখান পর্যন্ত স্বামীজির শিক্ষা নারীদের বেদ, দর্শন এবং ধর্ম শাস্ত্রসমূহ পড়ার অধিকার দেওয়ার সাথে সম্পর্কিত ছিল সে পর্যন্ত আমি তাঁর উপর প্রসন্ন ছিলাম। ” 

[তথ্যসূত্র- পণ্ডিত ঘাসীরাম কৃত, মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী কা জীবন চরিত্র। ষড়বিংশ অধ্যায়/পৃষ্ঠা- ৫৩১-৫৩২]




রমার বিষয়ে মহর্ষির মন্তব্য–

রমাবাঈয়ের বিদায়ের পর মহর্ষির ঘনিষ্ঠ কিছু ভক্তজন রমাবাঈয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে মহর্ষি তাদেরকে পত্রের মাধ্যমে লিখে জানান। যেমন তারিখ, ৮ সেপ্টেম্বর ১৮৮০ তে বাবু দুর্গাপ্রসাদ জীর উদ্দেশ্যে একটি পত্রে মহর্ষি লিখেন,

“…রমাবাঈ তার বাড়িতে যাবে বলেছে। এখানে আর্যসমাজের পক্ষ থেকে তাকে ১২৫ রুপী এবং একটি মলমল থান দিয়ে সৎকার করা হয়েছে। আগামীকাল সে এখান থেকে দিল্লি যাবে, দিল্লি থেকে এলাহাবাদ যাবে এবং সেখান থেকে সে নিজের বাড়িতে যাবে। এখন কোনো সমাজে (আর্যসমাজে) যাবে না বলেছে। সম্ভবত সেখান থেকে ফিরে তখন যাবে । তার ভাইয়ের মৃত্যুতে তার কিছু কুমতি হয়েছে এমনটা লোক সংশয় করে। তার মনও চঞ্চল। শরীর রোগা, হালকা এবং নির্বল, রাগও অনেক। তার যে কুমতিতে লোকেরা সংশয় করে সেটা লিখার যোগ্য নয়। আমি তাকে বৈশেষিক এবং ন্যায়দর্শনের কিছু সূত্র পড়িয়েছি। বুঝিয়েছিও অনেক। আশা করি যে, কুমার্গ ছেড়ে উপদেশ মার্গে প্রবৃত্ত হয়ে যাবে। তার সাথে একজন বাঙালি লোক আছে। সে ই তার কুমতির কারণ। সে বলতো যে, আমি দেশে গিয়ে সেখান থেকে নিজের কোনো আত্মীয় একজন পুরুষ এবং  রুটি তৈরি করার জন্য একজন নারীকে সাথে নিয়ে আসব। তার বুদ্ধি অনেক ভালো এবং সুবোধ। কাব্যালংকার, কিছু কিছু ব্যাকরণ, বাল্মিকী রামায়ণ, মহাভারত এতটুকু পড়েছে । অনেক ভালো সংস্কৃত বলে। বক্তব্যও খুবই ভালো দেয়। পরশু রবিবারে গোপালরাও হরি তাকে (নিমন্ত্রণ) ডেকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সে বলেছিল যে, “ এখন তো আমি দেশে যাবো, তারপর। সেখান থেকে আসলে, দেখা যাবে ।

বেশি কি লিখবো? আর তো সব ভাবেই ভালো কিন্তু যেভাবে চাঁদে গ্রহণ লেগে যায় এমন অবস্থা আরকি। রমার এই অবস্থা সব জায়গায় প্রসিদ্ধ (জানাজানি) হওয়া উচিত নয়। তার ভাইয়ের শোক নিবৃত্ত হয়েছে।…”

 [তথ্যসূত্র:- মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংসক দ্বারা সম্পাদিত ‘ ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী কা পত্র ব্যবহার ঔর বিজ্ঞাপন ’ প্রথম ভাগ, পূর্ণসংখ্যা- ৪৫৮। পৃষ্ঠা- ৫০৯]

 


এ বিষয়ে ১২ সেপ্টেম্বর ১৮৮০ সালে মুন্সী বখতাবরসিংহ জীর উদ্দেশ্যে লিখিত আরেকটি পত্রও পাওয়া যায়। এই পত্রের এক অংশে মহর্ষি লিখেন,

“…রমাবাঈয়ের অবস্থা এতটুকুই যে, ব্যাকরণ, কাব্যালঙ্কার পড়েছে। সংস্কৃত ভালোই বলে, ব্যাখ্যানও ভালো দেয় এবং বেশ বুদ্ধিমতীও। কিন্তু কিছু অকথ্য দোষ আছে। এই কারণে সে সেখানের সভাসদদের দ্বারা উপেক্ষিত হয়েছে। আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছি। তার ভাগ্য হবে যদি শুধরে যায়। এতে সে অনেক প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে আর তার উপদেশের মাধ্যমে নারীদেরও বড়ো উপকার হবে। এই রমার অবস্থা কোথাও ছাপাবেন না। নাহলে এতে ওর দুর্দশা হবে।…”

[তথ্যসূত্র:- মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংসক দ্বারা সম্পাদিত ‘ ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী কা পত্র ব্যবহার ঔর বিজ্ঞাপন ’ প্রথম ভাগ, পূর্ণসংখ্যা- ৪৬৩। পৃষ্ঠা- ৫১৭]

 


পূর্বে উল্লিখিত পণ্ডিত লেখরামজী ও ঘাসীরামজী তাদের বর্ণনায় রমার দোষের সামান্য সংকেত করেছেন। আর এই পত্রদ্বয়ে মহর্ষিও রমাবাঈয়ের কিছু অনুচিত দোষের ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু রমার ক্ষতি হবে ভেবে দোষের কথা বিস্তারিত ভাবে প্রকাশ করেন নি। এখানে উনার সেই দোষ কী? এই প্রশ্ন আসে।

প্রকৃতপক্ষে এই অকথ্য দোষ বলতে বিপিন বাবুর সাথে রমাবাঈয়ের মেলামেশাকে বোঝানো হয়েছে। কারণ মেরঠে অবস্থানকালে বিপিন বাবু, রমাবাঈয়ের কাছে থাকতেন। আর রমা ও বিপিন যে ইতোমধ্যে বিবাহ করে নিয়েছেন  একথাও কেউ জানতেন না। বরং তখন রমাবাঈ নিজেকে কুমারী হিসেবে পরিচয় দিতেন।

  • রমাবাঈয়ের পরবর্তী জীবন–

বিপিন-রমার আন্তঃবর্ণ বিবাহের কারণে, বিপিন বিহারীর জ্ঞাতি ও পরিবার তাদেরকে বহিষ্কার করে দিয়েছিলো। এ কারণে তিনি শ্রীহট্ট (বাংলা) ছেড়ে শিলচরে (আসাম) বসবাস শুরু করেন। বিপিনবিহারী মৃগীরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯ মাস বিবাহিত জীবনের পর ত্রিশ বছর বয়সে ১৮৮২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি অকাল মৃত্যুবরণ করেন।

...যখন১৮৮২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, পণ্ডিত রমাবাঈয়ের স্বামী বিপিন বিহারী দাসও অকাল মৃত্যুবরণ করেন, তখন মহারাষ্ট্রের প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গের দ্বারা আমন্ত্রিত হয়ে, পণ্ডিতা রমাবাঈ ১৮৮২ সালের এপ্রিল মাসে মুম্বাই হয়ে মহারাষ্ট্রের কাশী হিসেবে খ্যাত,বিদ্বানগণের নগরী পুনেকে তার কেন্দ্রে পরিণত করেন।  তিনি পুনেতে 'আর্য মহিলা সমাজ' প্রতিষ্ঠা করেন। যার শাখা মুম্বাই, সোলাপুর, পন্ধরপুর এবং আহমেদনগরেও চালু হয়েছিল।  পুনেতে পণ্ডিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল হান্টার কমিশনের সামনে, তিনি ভারতীয় নারীদের দুর্দশার কথা তার মাতৃভাষা মারাঠিতে উপস্থাপন করেন এবং তা দূর করার জন্য জোরালো আবেদনও করেছিলেন।

২০ এপ্রিল ১৮৮৩ তারিখে তিনি বিশেষ পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে মুম্বাই ত্যাগ করেন। যাওয়ার আগে তিনি এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে - 

“ সব ধর্মেই কিছু ভুল আছে, তাই আমি হিন্দু ধর্ম ছেড়ে কখনই খ্রিস্টান হব না। ” 

কিন্তু  ছয় মাসও পূর্ণ না হতেই সেখানকার খ্রিস্টানদের সেবামূলক কাজের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৮৮৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি খ্রিস্টমত গ্রহণ করেন।  ১৮৮৩ থেকে ১৮৮৯ সাল পর্যন্ত বিদেশে থাকার পর পণ্ডিতা রমাবাঈ যখন দেশে ফিরে আসেন, তখন মহারাষ্ট্র তাকে 'মেরি রমা' হিসেবে দেখতে পায়। ১৮৮৯ সালের ১১ মার্চ মুম্বাইয়ে রমাবাঈ 'শারদা সদন' প্রতিষ্ঠা করেন।  'শারদা সদন' সংস্থার মাধ্যমে পুনেতে (নভেম্বর ১৮৯০) অবহেলিত মহিলাদের শিক্ষিত করার এবং তাদের অবহেলার ক্ষত সারাতে পণ্ডিতা প্রচার শুরু করার সাথে সাথেই শুধু পরম্পরাবাদী মহারাষ্ট্র নয়, মহারাষ্ট্রের প্রগতিশীল সমাজও তার কাজে ধর্মান্তরের খবর পাওয়া শুরু করে। ফলস্বরূপ, লোকমান্য তিলকের লেখনী উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং রণদে-ভান্ডারকরের প্রার্থনাসমাজও পণ্ডিতা রমাবাইয়ের 'শারদা সদন' সংস্থার সাথে তাদের সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে।

আমরা যদি সেই সময়ের ভারতীয় সমাজ তথা খ্রিস্টানদের চেয়ে নারীদের প্রতি বেশি উদার হতাম, তাহলে কখনই 'পণ্ডিতা রামাবাঈ'কে 'মেরি রমাতে'-এ পরিণত হতে দেখতে হত না। পণ্ডিতার দুর্ভাগ্য যে একজন জ্ঞানী পিতা, স্নেহময়ী মা, সরল ভাই, প্রেমময় স্বামী, স্বামী দয়ানন্দের মতো গুরু এবং  রনোদা-ভান্ডারকরজী ও মহাত্মা ফুলের মতো সহযোগী পেয়েও, তার সারা জীবন শুষ্ক, নির্জন এবং অবহেলিত ছিল এবং তিনি নিজের সংস্কৃত জ্ঞানকে ভারতীয় মহিলাদের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে কার্যকর করতে পারেননি।

প্রশ্ন হলো- রমাবাঈ খ্রিষ্টান হয়ে যাওয়ার পরেও কি তার সমস্যাগুলোর পূর্ণ সমাধান হয়েছিল ? 

এরকম তো মনে হয় না। রমাবাঈ নিজের কন্যা মনোরমা-কে যে চিঠি লিখেছেন, তা তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্ব তথা হতাশা-নিরাশাকে ব্যাক্ত করেছে – [ মূল মারাঠী চিঠীর বাংলা রূপান্তর ]।

"মনু বেটা! [ প্রিয় কন্যা মনোরমা! ] আমার মনকে এই কথার গভীর দুঃখ হৃদয়ের ভিতরেই ব্যাথিত রয়েছে যে- আমি যে ধর্মকে ত্যাগ করেছিলাম আমি সেই ধর্মেরও থাকি  নি এবং যে ধর্ম গ্রহণ করেছি সে ধর্মেরও থাকি নি।  আমি এবং আমার যন্ত্রণাগুলোর মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।"

১৯২১ সালে তাঁর এই একমাত্র কন্যা মনোরমারও অকাল মৃত্যু হয়ে যায়। নিজ কন্যার মৃত্যুর সাত আট মাসের পরে ১৯২২ সালে পণ্ডিতা রমাবাঈও পরলোক গমন করেন।

পণ্ডিতা রমাবাঈয়ের বিষয়ে মারাঠীর সুপ্রসিদ্ধ পত্রিকার আচার্য প্রহ্লাদ কেশব অত্রে লিখেছেন , -'এটি সত্য যে পণ্ডিতা রমাবাঈ হিন্দু ধর্মকে ত্যাগ করে পরে খ্রিস্টান ধর্ম স্বীকার করে নিয়েছেন, কিন্তু কেবলমাত্র এই কারণে  তার অবশিষ্ট  মহৎ কর্ত্তৃত্ব বাধাগ্রস্ত হয়েছিল- এমনটা কেউ বলতে পারবে না। এই বিষয়ে তিনি আরো লিখেছেন যে- 'পণ্ডিতা খ্রিস্টমত গ্রহণ করে নিঃসন্দেহে ভারতীয় খ্রিস্টান সমাজের অনেক বড় সেবা করেছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে হিন্দু সমাজে তার জন্ম হয়েছিল , যে হিন্দু সমাজ তাঁকে পাণ্ডিত্যের বিশেষ গুণ-গৌরবে গৌরবান্বিত করেছিলো, সে সমাজ তাঁর অসাধারণ বুদ্ধি, জ্ঞান ও কর্ত্তৃত্ব থেকে একটুও লাভবান হয়নি। এটি পরিতাপের সাথে বলতে হচ্ছে যে, তিনি যদি ধর্মান্তরিত না হয়ে, নিজ সমাজে থেকে বিদ্যাদান এবং সমাজ-সংস্কারের কাজ করতেন তাহলে বিষ্ণু শাস্ত্রী চিপলুণকর, রনোদা, তিলক, ভান্ডারকর এবং মর্হষিদের তালিকায় পণ্ডিতা রমাবাঈয়ের নামও নিঃসন্দেহে অন্তর্ভুক্ত হত। (তথ্যসূত্র- মারাঠী মানসে মারাঠী মনে, পৃ০ ৪৭)


  • পৌরাণিকদের অপপ্রচার খণ্ডন ও মন্তব্য-

পৌরাণিকদের মূল আক্ষেপ হলো রমাবাঈ মহর্ষি দয়ানন্দের প্রেমিকা ছিল। তাই চিঠিপত্র পাঠিয়ে দয়ানন্দ তাকে ডেকে এনেছেন। কিন্তু তাঁদের আক্ষেপে স্বয়ং রমাবাঈ ই জল ঢেলে দিয়েছেন। যেমন দেবেন্দ্র বাবুকে লিখা পত্রে রমাবাঈ লিখেছেন-

“ স্বামীজির সম্পর্কে যে ধারণা আমার মনে অঙ্কিত রয়েছে তা বাস্তবে অতি উত্তম। স্বামীজি সর্ব প্রকারে দয়াস্বরূপ ছিলেন। তিনি এক বিশাল দর্শন ভদ্র পুরুষ ছিলেন, তথা সত্য ও শুদ্ধভাবযুক্ত পিতৃপ্রকৃতির পুরুষ ছিলেন। আমার সাথে তাঁর আচরণ পিতৃতুল্য এবং কৃপাপূর্ণ ছিল। ”

(পণ্ডিত ঘাসীরামজীর বর্ণনা দ্রষ্টব্য)

রমাবাঈ এখানে মহর্ষি দয়ানন্দকে ‘পিতৃপ্রকৃতির পুরুষ’ এবং তাঁর সাথে মহর্ষির আচরণে 'পিতৃতুল্য' অর্থাৎ পিতার মতো বলে অভিহিত করছেন। এখন পাঠক অনুমান করে নিন, কতটা নিকৃষ্ট মানসিকতা লালন করলে পৌরাণিকরা পিতা-কন্যার মতো সম্পর্ককেও ব্যাভিচার বলতে পারে।

কে জানে? পৌরাণিক সমাজেই হয়তো পিতা-পুত্রীর ব্যাভিচার লীলা চলে থাকে।

এখন বঙ্গীয় পৌরাণিকদের আক্ষেপ এবং অপদাবি খণ্ডন করা হবে। এখানে পৌরাণিকদের দাবিকে ‘পাখণ্ডি’ শব্দ এবং লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে।

পাখণ্ডি

রমাবাঈ ও রঙ্গিলা দয়ানন্দ সরস্বতী :

কবিরত্ন শ্রীমৎ অখিলানন্দ শর্মা ছিলেন আর্য সমাজের একজন সদস্য, আর্যসমাজী থাকাকালীন দয়ানন্দের ভক্ত হওয়ার দরুণ‘দয়ানন্দদিগ্বিজয়ম্’ নামক সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ লেখেন ৷ কিন্তু পরে তিনি উপলব্ধি করেন যে তিনি ভুল পথে হাঁটছেন, আর্যসমাজীরা কেবল বেদাদি শাস্ত্রের অপব্যাখ্যাকারী ৷ তাই তিনি আর্যসমাজ ত্যাগ করে সনাতন ধর্মাবলম্বী হন এবং দয়ানন্দের 'সত্যার্থপ্রকাশ' খণ্ডন করে ‘সত্যার্থপ্রকাশালোচনম্’ গ্রন্থ লেখেন ৷ ইতোপূর্বে রাজস্থানের আজমীর থেকে আর্য সমাজ কর্তৃক স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর জীবনী ছাপা হয়েছিলো; তো এই গ্রন্থের রেফারেন্স দিয়ে অখিলানন্দ শর্মা তার সত্যার্থপ্রকাশালোচনম্ গ্রন্থের ২২-২৪ পৃষ্ঠায় দয়ানন্দ সম্পর্কে লিখেছেন-

রমাবাঈ নামে অতি বিদুষী এক নারীর খ্যাতি চারিদিকে পরিব্যাপ্ত হয় ৷ তার সামনে দয়ানন্দের বিদ্যাবুদ্ধি অতি নগণ্য ছিল ৷ দয়ানন্দ তাই তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে তাকে চিঠি পাঠাতে থাকেন ৷

সমীক্ষক-  বাংলাদেশ অগ্নিবীরের এই খণ্ডনমূলক লিখায় ভালোভাবে অখিলানন্দ শর্মার মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে। এর বেশি কিছু লিখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না ।

📎 https://back2thevedas.blogspot.com/2021/04/blog-post.html?m=1

পাখণ্ডি এর পরে যে কথা বলেছে তা নিন্তান্ত বিনোদনমূলক। রমাবাঈয়ের সামনে দয়ানন্দের বিদ্যাবুদ্ধি অতি নগণ্য এই মন্তব্য নিয়ে আমরা কিছু  বলবো না। কারণ মহর্ষির বিদ্বতা নিয়ে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা বরং স্বয়ং রমাবাঈয়ের মন্তব্যই দেখি।

 পণ্ডিতা রমা নিজের প্রথম পত্রে লিখেন-

“ শ্রীমান যিনি দ্যুলোক এবং পৃথিবীতে অখণ্ড জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূর্য প্রকাশিত করেছেন সেই শ্রী শ্রী  দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামীর পাদপ্রান্তে বহু প্রণামের সাথে, সম্যক উদাচারের সাথে এবং উচিত সম্মানের সাথে নিবেদন করছি,

শ্রীমৎপাদের দেবদুর্লভ অনুগ্রহ কোথায়? আর মহান ব্যাক্তিদের চরণধূলির উপমার অযোগ্যা বেচারী কোথায়?

…আজ আমার আর্যাবর্তে আসার প্রায় তিন হইতে চার বছর হয়। সেই থেকে আমি শ্রীমৎপাদের জ্ঞান-গৌরবের কথা সবসময় শুনে আসছি এবং আপনার চরণ দর্শনের জন্য মন খুবই উৎসুক হয়েছিল, কিন্তু এতদিন যাবৎ সংশয়ের দোলায় আরূঢ় মন হৃদয়ের উৎসাহকে থামিয়ে রেখেছে যে , না জানি চতুর্থ আশ্রমে স্থিত শ্রীমৎপাদ এই বালবুদ্ধি স্ত্রীলোক আমাকে দর্শনদানের প্রসাদ দ্বারা কৃপা করবেন কি না? ”


দ্বিতীয় পত্রে রমাবাঈ লিখেন,

যেই শ্রীমান সমস্থ জগৎকে অনবদ্য এবং উদার সুজনতার গুণে নত করিয়ে দিয়েছেন, সেই শ্রী দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামীজির চরণে বিহিত অনেক প্রণাম, সম্যক উদাচার এবং উচিত সম্মানপূর্বক নিবেদন,

‌…শ্রীমান ! আমার অধ্যয়নের সীমা সাধারণত ক, চ, ট, ত, প  আদি বর্ণ পর্যন্ত অনুমান করে নিবেন। এর অতিরিক্ত কিছু বলার উৎসাহ হচ্ছে না।

(রমাবাঈয়ের উপরোক্ত প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র দ্রষ্টব্য)

 

পাখণ্ডি– দয়ানন্দের কাছ থেকে রমাবাঈের প্রতি প্রথম চিঠিতে লেখা ছিল—

“... আপনার কীর্তি শুনে মনে আনন্দ পেয়েছি ৷ শ্রীমতীর নিকট পত্র দ্বারা নিজের অভিপ্রায় প্রকাশ করে আপনার অভিপ্রায়ও এই প্রকার জানতে চাই.... আমি শুনেছি যে আপনি বিবাহের জন্য স্বয়ম্বর বিধি দ্বারা নিজের তুল্য গুণ-কর্ম-স্বভাবের উত্তম কুমার পুরুষ খুঁজছেন? ইহা কি সত্য অথবা নয়?.... যদি এখানে আসার ইচ্ছা থাকে তো চলে আসুন ৷ আসতে যত টাকা পথখরচ হিসেবে ব্যয় হবে তা এখান থেকে আপনাকে দেওয়া হবে ৷”

সমীক্ষক- পত্রের মাঝখান থেকে দুই তিনটি লাইন উদ্ধৃত করলে সম্পূর্ণ পত্রের উদ্দেশ্য বোঝা যায় না। বরং এভাবে সুবিধামত বাক্য উদ্ধৃত করা পৌরাণিক পাখণ্ডিদের চরম অসততা ও ধূর্ততার পরিচায়ক। উপরে পত্রের যে কথাগুলো উদ্ধৃত করেছে তা পরবর্তী কথাসহ দেখলে মহর্ষির অভিপ্রায় বোঝা যায়। মহর্ষির সম্পূর্ণ  পত্রগুলো আমরা আগেই বঙ্গানুবাদ সহ দিয়ে রেখেছি। সেখান থেকেই লিখা উদ্ধৃত করছি, মহর্ষি লিখেছেন,

আমি শুনেছি যে আপনি বিবাহের জন্য স্বয়ংবর বিধিতে নিজের মতো গুণ, কর্ম ও স্বভাবসম্পন্ন কুমার উত্তম পুরুষকে খুঁজছেন। এটি সত্য কি না? বিবাহ না করে ব্রহ্মচর্যে স্থিত থাকা অসম্ভব কি?

    আর্যাবর্তের সতী, বিদুষী গার্গী আদি কুমারীগণ যেভাবে ব্রহ্মচর্য ব্রতে স্থিত হয়ে নারী জাতির যতটুকু উপকার করেছেন সেভাবে ততটুকু উপকার আপনি বিবাহ করার পর অনেক প্রতিবন্ধকতার কারণে তাদের দিতে পারবেন না । এমন হওয়ায় আপনার ইচ্ছা কি?

নিজের সমান পুরুষকে প্রাপ্ত হয়ে বিবাহ করে যেভাবে নারীরা সাধারণত সন্তানোৎপত্তি, পালন , এবং স্বগৃহকর্মে প্রবৃত্ত হন সেভাবে আপনিও কি প্রবৃত্ত হবেন? কিংবা  মেয়েদের পড়াবেন এবং নারীদের সুশিক্ষা দান করবেন এই ইচ্ছা রাখেন?”

(মহর্ষির প্রথম পত্র দ্রষ্টব্য)

পথখরচের টাকা নিয়ে পরে বলা হয়েছে


পাখণ্ডি-দয়ানন্দের ২য় পত্র—

“শ্রীমতী, আপনার প্রেমাস্পদ আনন্দপ্রদ পত্র পেয়েছি ৷ ঐ পত্র দেখে আমি অতীব সন্তুষ্ট হয়েছি ৷ শ্রীমতীকে সামান্য কষ্ট দিচ্ছি তা ক্ষমা করবেন ৷ ... শ্রীমতীর জন্ম কোথায়? বয়স কত? আপনার কি কোন সঙ্গী আছে না আপনি একাকিনী?....

যদি আপনার পথখরচের অসুবিধা থাকে, তাহলে শীঘ্রই জানান, যত টাকা লাগে আমি এখান থেকে পাঠিয়ে দিচ্ছি ৷”

খেয়াল করুন-দয়ানন্দের আর দেরী সহ্য হচ্ছে না ।

এই চিঠির উত্তরে রমাবাঈ তার জন্মস্থানের বৃত্তান্ত লেখেন, তার বয়স ২৩ বছর জানান, আরো জানান যে তিনি একাকিনী, তার কোন সঙ্গী নাই ৷

সমীক্ষক- আগের মতো পাখণ্ডির কথার সাথে আমরা মূল পত্র মিলিয়ে দেখবো-

“ আপনার নিজের বাড়ি কোথায় এবং আত্মীয় স্বজন কোথায় থাকেন? মা বাবা আছেন কি? যিনি মারা গিয়েছেন তিনি আপনার চেয়ে বড়ো না ছোট ছিলেন? এখন আপনি নির্দোষার কাছে স্বজাতির কোনো নারী পুরুষ আছেন কি? অথবা একাকিনী আছেন? ”

যদি পথে খরচের জন্য অর্থের প্রয়োজন থাকে তাহলে শীঘ্রই জানাবেন যে কত টাকা পাঠাতে হবে। পূর্ব পরিচয় ছাড়া কিভাবে টাকার জন্য লিখবেন, আপনার এরকম শঙ্কা বা লজ্জাবোধ করা উচিত নয় ।”

(মহর্ষির দ্বিতীয় পত্র দ্রষ্টব্য)

এটা মহর্ষি কেন লিখলেন তা বিবেকহীন মূর্খ পাখণ্ডিদের বোঝার প্রয়োজন নেই।

রমার ভাই মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার পর তাঁর পারিবারিক ব্যাপারে খোজখবর নেয়া, কেমন আছে কিভাবে আছে সেই কুশলমঙ্গল জিজ্ঞাসা করা কি গুরুজন হিসেবে মহর্ষি দয়ানন্দের কর্তব্য ছিল না?

আর রমাবাঈকে অতিথি হিসেবে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। তৎকালীন সমাজে নারীরা অর্থ উপার্জন করতেন না এজন্য আসতে রাস্তায় যত টাকা খরচ হয় তত টাকা পাথেয়স্বরূপ দেওয়ার কথা বলা একজন বিবেকবান ব্যক্তির কাজ।

মজার ব্যাপার হলো, পাখণ্ডির প্রমাণ দেয়া এখানেই শেষ। মহর্ষির চরিত্রে কলঙ্ক আরোপের জন্য আর কোনো প্রমাণ নেই 🤣🤣। কেমন কাটঝাট প্রমাণ তা তো দেখলেনই। এত অল্প প্রমাণ নিয়ে, তার উপর কাটঝাটের জোচ্চুরি করে, মহর্ষি দয়ানন্দের চরিত্রে কলঙ্ক আরোপের সাহস তারা কিভাবে করে সেটা আমার জানা নেই। যখন আসল তথ্যপ্রমাণ সহ তাদের লিখা খণ্ডন করা হবে তখন যে লজ্জিত হতে হবে এই ভয়ও পাখণ্ডিদের মনে বিন্দুমাত্র নেই। অবশ্য নির্লজ্জদের লজ্জা থাকবে না এটাই স্বাভাবিক।

পাখণ্ডি– দয়ানন্দ ও রমাবাঈের মধ্যের পরবর্তী পত্রব্যবহার আর্যসমাজীরা আর ছাপায়নি, সম্ভবত ছাপানোর অযোগ্য ছিলো বলে বা পত্রালাপ হয় নি বলেই ছাপাই নি; কারণ, এরপর রমাবাঈ মেরঠে দয়ানন্দের সাথে কয়েক মাস কাটিয়ে যান ৷

সমীক্ষক- পাখণ্ডি “ সম্ভবত ” কথাটি  লিখে নিজের মুখোশ নিজেই খুলে দিয়েছে। পাখণ্ডি প্রমাণ করে দিলো যে, সে  জানেই না যে আসলে কয়টি পত্রব্যবহার হয়েছিল। মূর্খদের কথাবার্তা এরকমই মূর্খতাপূর্ণ।

মহর্ষির প্রতিটি পত্র ছাপানো হয়েছে। আর সেসব আর্যসমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিতরাই ছাপিয়েছেন।  যেমন , পণ্ডিত ভগবদ্দত্ত জী এবং মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত যুধিষ্ঠিরজী মীমাংসক।

রমাবাঈ মেরঠে দয়ানন্দের সাথে কয়েক মাস কাটিয়ে গিয়েছিলেন। এটি আরেক মিথ্যা। পণ্ডিত লেখরাম জীর বর্ণনা অনুসারে,  ” রমাবাঈ দুই সপ্তাহের বেশি সেখানে বাস করেন। তারপর নিজের এক বাঙালি বন্ধুর সাথে; (যিনি তাঁর আসার পর মেরঠে আসেন) দিল্লী হয়ে নিজের জন্মভূমির দিকে চলে যান।”

[ শ্রী পণ্ডিত লেখরাম আর্য কৃত, জীবনচরিত্র- মহর্ষি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী। তৃতীয় অধ্যায় / তৃতীয় পরিচ্ছেদ। মেরঠ নগর কা বৃত্তান্ত / পৃষ্ঠা -৫১০]

পাখণ্ডিপক্ষ– দয়ানন্দ সন্ন্যাসী হয়ে একজন স্ত্রীলোকের বয়স, সে একাকিনী কিনা জিজ্ঞাসা করা ও তার জন্য পথখরচ পাঠানোর উদ্দেশ্য কী? বুদ্ধিমানরা তো তা সহজেই বুঝে নিবেন, কিন্তু আর্যসমাজীরা যে দয়ানন্দকে অখণ্ড ব্রহ্মচারী মানে তা বড় হাস্যকর বিষয় ৷

সমীক্ষক- একটি অনাথ মেয়ে, যার কোনো আপনজন পৃথিবীতে বেঁচে নেই; তার বয়স, সে কিভাবে আছে কেমন আছে? একা আছে অথবা কিভাবে আছে? এসব জিজ্ঞাসা করা গুরুজন হিসেবে তো অবশ্যই উচিত ছিল, এছাড়া যেকোন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি এটা জিজ্ঞেস করতো। এসব ছাড়াও রমার শিক্ষাগত যোগ্যতা, অধীত ও শ্রুত শাস্ত্রসমূহ, নারীশিক্ষায় যোগদানের ইচ্ছা আছে কি না আরও বিভিন্ন বিষয় মহর্ষি জিজ্ঞাসা করেছেন। আর এরকম পিতৃসুলভ আচরণের কারণে রমাবাঈ মহর্ষি সম্পর্কে লিখেছেন,

“ স্বামীজি সত্য ও শুদ্ধভাবযুক্ত পিতৃপ্রকৃতির পুরুষ ছিলেন। আমার সাথে উনার আচরণ পিতার মতো এবং কৃপাপূর্ণ ছিল। ” 

এর পরে সজ্জনগণ পাখণ্ডির মূল লেখায় চরম মূর্খতাপূর্ণ কথাবার্তা দেখতে পাবেন। এইসব মূর্খতাপূর্ণ দাবি উদ্ধৃত করে লেখা বড় করার ইচ্ছা আমার নেই। বুদ্ধিমানরা এতক্ষণে পাখণ্ডির নিকৃষ্ট ধূর্ততা ধরে ফেলেছেন।

 রমাবাঈয়ের ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রসঙ্গেও অনেক পৌরাণিকরা খুব জোরালো আক্ষেপ করে থাকে। তাদের কথা হল- দয়ানন্দ যদি খ্রিস্টমত খণ্ডনই করতেন তাহলে রমাবাঈ তাঁর উপদেশ শুনেও কেন খ্রিস্টান হয়ে গেল? স্বামীজির শিক্ষা কী কাজে আসলো তাহলে?

উত্তর- ১/ মহর্ষি দয়ানন্দ যে খ্রিস্টমতের প্রবল খণ্ডনকর্তা ছিলেন তা বোঝার জন্য বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। সত্যার্থ প্রকাশের পুরো একটি অধ্যায়জুড়ে তিনি খ্রিস্টমত খণ্ডন করে রেখেছেন। মহর্ষির জীবনীগ্রন্থের অজস্র স্থানেও তাঁর খ্রিস্টমতের কঠোর খণ্ডনের প্রমাণ আছে। অনেককে খ্রিস্টমতে ধর্মান্তরিত হওয়া থেকে রক্ষাও করেছিলেন। যেমন- দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘দয়ানন্দ চরিত’ গ্রন্থের ১৪২ তম পৃষ্টার বর্ণনা অনুসারে, প্রয়াগের মহাদেবপ্রসাদ নামক ব্যাক্তি যাকে কোনো পণ্ডিত সনাতন ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ত্ব প্রতিপাদন করে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া থেকে  নিবৃত্ত করতে পারেন নি। মহর্ষি দয়ানন্দই তাঁকে খ্রিস্টমত গ্রহণ থেকে নিবৃত্ত করে সনাতন ধর্মে নিয়ে আসেন।

২/ মহর্ষি রমাবাঈ ইত্যাদি বিদ্যার্থীদের বৈশেষিক দর্শন পড়িয়েছিলেন। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নয়। আর্যসমাজ মেরঠ থেকে রমাবাঈকে বিদায়ের সময় সত্যাসত্য জ্ঞানের জন্য মহর্ষি রমাবাঈকে সত্যার্থ প্রকাশ ইত্যাদি পুস্তকের একেকটি কপি প্রদান করেন। রমাবাঈ যদি সেসব পড়তেন তাহলে সেখানে খ্রিস্টমতের প্রবল খণ্ডন দেখতে পেতেন এবং কখনোই ধর্মান্তরিত হতেন না।

এর পরও কারো আক্ষেপ থেকে থাকে তাহলে দেখুন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, পিতামহ ভীষ্ম, মহর্ষি ব্যাসদেব এবং মহাপ্রাজ্ঞ বিদুরের মতো মহান ব্যাক্তিদের সদুপদেশে দুর্যোধন ইত্যাদি কৌরবদের মন পরিবর্তন হয়েছিল কি? যদি না হয়ে থাকে তাহলে প্রমাণ হল, মহাপুরুষদের সদুপদেশ সবাই হৃদয়ঙ্গম করে না।

উপসংহার–

পরিশেষে আর্য ভজনোপদেশকগণের ভাষায় শুধু এটুকুই বলবো,

“ ইস সংসার ম্যায় মহাপুরুষ, বহুত আতে হ্যায়।

বেদাগ দয়ানন্দ জেসা জীবন, না দেখ পাতে হ্যায়।”

অর্থাৎ- এই সংসারে অনেক মহাপুরুষ আসেন কিন্তু মহর্ষি দয়ানন্দের মতো নিষ্কলঙ্ক জীবন দেখা যায় না।

মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী কী -জয় ।