আজকাল অনলাইনে দেখা যায় প্রায় সময়ই বাল্মীকি রামায়ন থেকে অপপ্রচারকারীরা কিছু শ্লোক উপস্থাপন করে। এবং এর দ্বারা প্রমাণিত করার চেষ্টা করে যে শ্রীরাম চন্দ্র মাংসাহারী ছিলেন।
এই শঙ্কার সমাধান হওয়া অতন্ত্য আবশ্যক। কারন শ্রীরাম চন্দ্রের সাথে আমাদের জনসমাজের আস্থা জুড়ে রয়েছে। বৈষ্ণব মত মান্যকারী গোস্বামী তুলসীদাস দ্বারা বিরচিত রামচরিতমানসের প্রভাব দ্বারা বৈষ্ণব মতের এই মান্যতা যে শাকাহারই সর্বোৎকৃষ্ট।
এই জন্য আমাদের জনসমাজেরও এই মান্যতা এই যে, এটা কখনো হতে পারে না যে রামচন্দ্র জী মাংসাহারী ছিলেন।
আমার ও মান্যতা যে, শ্রীরামচন্দ্র পূর্ণরূপে শাকাহারী ছিলেন। কারন আমার বিশ্বাসের ভিত্তি হলো স্বয়ং বেদ। বেদে অনেক জায়গায় মানব কে শাকাহারী হওয়ার জন্য প্ররোচিত করা হয়েছে এবং মাংসাহার কে নিন্দা করা হয়েছে। নিরীহ পশুকে রক্ষা করা আর্য পুরুষের কর্তব্য বলা হয়েছে। এবং যে নিরীহ পশুর উপর অত্যাচার করে তাহাকে কঠোর দন্ড দেবার আজ্ঞা বেদ স্বয়ং দিয়েছেন।
শ্রীরামচন্দ্র জীর কাল পুরাণ অনুসারে কোটি বর্ষ পুরণো। ভারতীয় আর্যাবর্ত্ত দেশ মধ্যে মহাভারত যুদ্ধ কালের পশ্চাৎ এবং তার মধ্যে বিশেষ রূপে পূর্ব ২৫০০ বর্ষ মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ঈশ্বরীয় বৈদিক ধর্মের লোপ এবং মানব নির্মিত মত মতান্তরের প্রচারই বেশী হয়েছে। যাহার মধ্যে বেদ বিরুদ্ধ মান্যতা সর্বাধিক।
এরকমই এক মত ছিলো বামমার্গ। যাদের মান্যতা ছিলো মাংস, মদ,মৎস আদি দ্বারা ঈশ্বর প্রাপ্তির বিধান। বামমার্গের সমর্থকরা যখন এটা দেখলো যে জনসমাজের সবচেয়ে বড় আদর্শ শ্রীরামচন্দ্র। এইজন্য যতক্ষন তার মধ্যে অবৈদিক মান্যতা না পাওয়া যায় ততক্ষন আমাদের প্রভাব বিস্তার সম্ভব নয়। এজন্য তারা শ্রীরামচন্দ্র জীর সবচেয়ে প্রামাণিক জীবন চরিত্র বাল্মিকী রামায়ন বেছে নিলো।এবং যথানুসারে তাদের মত লিপিবদ্ধ করতে আরম্ভ করতে শুরু করলো যার পরিণাম আজ আপনাদের সামনে।
মহাত্মা বুদ্ধের কালে এই প্রক্ষীপ্ত ভাগের বিরুদ্ধ "দশরথ জাতক" নামে এক গ্রন্থ স্থাপন করা হয়েছিলো। যার মধ্যে ইহা সিদ্ধ ছিলো যে, শ্রীরামচন্দ্র পূর্ণরূপে অহিংসা ব্রতধারী ছিলেন। আর বুদ্ধদেব পূর্বজন্মে রাম রূপে জন্ম নিয়েছিলো। বলার অর্থ এই যে, এখানে রামচন্দ্র জীর প্রসিদ্ধতার সুযোগ নিয়ে নিজ নিজ মান্যতার প্রচার করা হয়েছে। আর এখান থেকে প্রক্ষিপ্ত শ্লোক আরম্ভ হয়েছে।
বিষয়বস্তকে পরিষ্কার করার করার জন্য লেখাটিকে তিন অংশে বিভক্ত করা হলো-
(১) বাল্মিকী রামায়নের প্রক্ষীপ্ত ভাগ।
(২)রামায়ন মধ্যে মাংসাহারের বিরুদ্ধে স্বয়ং সাক্ষী।
(৩)বেদ এবং মনুস্মৃতি মধ্যে মাংস বিরুদ্ধ সাক্ষী।
(১) বাল্মীকি রামায়নের প্রক্ষীপ্ত ভাগ -
এই সময় দেশ মধ্যে বাল্মীকি রামায়নের যে পান্ডুলিপি পাওয়া যায় তার দুই খন্ড রয়েছে। এক বঙ্গ দেশ মধ্যে মিলেছে যার মধ্যে বাল, অযোধ্যা,অরণ্য, কিষ্কিন্ধা, সুন্দর এবং যুদ্ধ ৬কান্ড রয়েছে। এবং মোট সর্গ ৫৫৭ এবং শ্লোক সংখ্যা ১৯৭৯৩। এবং দ্বিতীয় খন্ড বোম্বাই এ মিলেছে যার মধ্যে উক্ত ৬কান্ড ছাড়াও আরো একটি উত্তর কান্ড রয়েছে। মোট সর্গ ৬৫০ এবং শ্লোকসংখ্যা ২২৪৫২৮ টি।
দুই খন্ডের পাঠ ভেদ হওয়ার কারনে উত্তর কান্ড সম্পূর্ণ প্রক্ষীপ্ত। এবং সেই সাথে কোন সর্গ এবং কোন শ্লোক প্রক্ষীপ্ত হয়ে যায়।
★ প্রক্ষীপ্ত শ্লোক এই প্রকার যে -
i) বেদের শিক্ষার প্রতিকুল- যেহেতু বেদ মধ্যে মাংস খাওয়ার মান্যতা নেই সেহেতু বাল্মীকি রামায়নে কিছু শ্লোক মাংস ভক্ষনের সমর্থন করে। অতএব ইহা প্রক্ষীপ্ত।
ii) শ্রীরামচন্দ্রের কালে বামমার্গ আদি কোন প্রচলন ছিলো না। এইজন্য বামমার্গের কোন মান্যতা বাল্মীকি রামায়ন মধ্যে রয়েছে তা প্রক্ষীপ্ত।
iii) ঈশ্বরের সৃষ্টি নিয়মের বিরুদ্ধ যে মান্যতা তাহা প্রক্ষীপ্ত। যেমন হনুমান জীর বানর আদি কোন পশু হওয়া সম্ভব নয়। কারন পশুরা কখনো মানুষের মতো কথা বলতে পারে না। হনুমান জী বেদজ্ঞ বিদ্বান এবং পরম বলশালী ছিলেন।
iv) যা প্রকরন বিরুদ্ধ সেটাই প্রক্ষীপ্ত। যেমন সীতা মাতার অগ্রি পরীক্ষা আদি অসম্ভব ঘটনা। শ্রীরাম চন্দ্র জীর যুদ্ধ বিজয় উল্লাস তথা ১৪ বছর বনবাসের পর অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন এবং অযোধ্যা বাসীর আনন্দ উল্লাস। সেখানে এই প্রকার অগ্নি পরীক্ষা অনাবশ্যক বর্ণনা।
(২) রামায়ন মধ্যে মাংসাহারের বিরুদ্ধে স্বয়ং সাক্ষী-
রামায়ন বাল কান্ডের মধ্যে ঋষি বিশ্বামিত্র রাজা দশরথের সমক্ষ এসে তার সমস্যার কথা বললেন যে , যখন তিনি যজ্ঞ করতে বসেন তখন সবাহু এবং মারীচ নামে দুই রাক্ষস মাংস, রক্ত আদি অপবিত্র পদার্থ দ্বারা যজ্ঞে বিঘ্ন ঘটায় এবং যজ্ঞকে অপবিত্র করে। এজন্য বিশ্বামিত্র তার যজ্ঞ রক্ষার জন্য সাহায্য চাইলেন। তখন রাজা দশরথ শ্রীরামচন্দ্র এবং লক্ষণ জী কে যজ্ঞ রক্ষার্থে পাঠালেন। যার পরিণাম স্বরূপ যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয় এবং সেই সাথে রাক্ষস সংহার হয়।
যে লোক যজ্ঞ আদি মধ্যে পশু বলির বিধানের সমর্থন করেন। বাল্মীকি রামায়ন মধ্যে রাজা দশরথ কৃত অশ্বমেধ আদি যজ্ঞ মধ্যে পশু বলি মানেন। তো তাদের কাছে প্রশ্ন যে, যদি যজ্ঞ মধ্যে পশু বলির বিধান থাকে তো ঋষি বিশ্বামিত্র কেন বললেন রাক্ষস আমার যজ্ঞ মাংস,রক্ত দিয়ে অপবিত্র করছে। আমার সহায়তা করুন। ইহাতে তো ইহা স্পষ্ট যে, রামায়ন মধ্যে পশু বলির বর্ণনা প্রক্ষীপ্ত।
★ ঋষি বশিষ্ঠ দ্বারা ঋষি বিশ্বামিত্রের সৎকার-
এক আক্ষেপ এই যে, প্রাচীন ভারত মধ্যে নাকি অতিথী সৎকার মাংস দ্বারা করা হতো।এই দাবীর সত্যতা এবং খন্ডন স্বয়ং বাল্মীকি রামায়ন মধ্যে রয়েছে। যখন ঋষি বিশ্বামিত্র ঋষি বশিষ্ঠের আশ্রম মধ্যে পদাচারন করেন। তখন ঋষি বশিষ্ঠ ঋষি বিশ্বামিত্রকে মাংস দ্বার নয় বরং মিষ্টান্ন পদার্থ ক্ষীর দধি সৎকার করেছিলেন।
( বাল কান্ড সর্গ ৫২ শ্লোক ১-৬)
শ্রীরামচন্দ্র জীর মাংসাহারের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ঘোষনা অযোধ্যা কান্ড সর্গ ২০শ্লোক ২৯ মধ্যে রয়েছে। যখন শ্রীরাম জী বনমধ্যে যাবার জন্য প্রস্তুত তখন মাতা কৌশল্যাকে রাম জী বললেন যে,
চতুর্দষ হি বর্ষাণি বৎস্যামি বিজনে বনে।
কন্তমূলফলৈজীবনে হিত্বা মুনিবদমিষম্।। ২৯
অর্থাৎ আমি চতুর্দশ বর্ষ পর্যন্ত বষ্কল পরিধান করিয়া ফল মূল ভক্ষন পূর্বক জীবন ধারন করত বনে বাস করবো। এর থেকে মাংস বিরুদ্ধ সাক্ষী আর কি হতে
পারে?
শ্রীরাম জী দ্বারা সীতা মাতার কথা অনুসারে স্বর্ণ হরিণ শিকার এক শঙ্কা। যেখানে রাম জী না কি স্বর্ণ হরিন শিকার করেছে তার মাংস খাবার জন্য।
এই শঙ্কার সমাধান রামায়ন অরণ্য কান্ড মধ্যে রয়েছে-
মাতা সীতা শ্রীরাম জী কে স্বর্ণ হরিণ ধরার জন্য এইরূপ বলছে-
যদি আপনি জীবিত ধরতে পারেন তো আশ্চার্যপ্রদ রূপে আশ্রমে বিচরন করে বিষ্ময় করবে।
( অরণ্য কান্ড সর্গ ৪৩ শ্লোক ১৫)
আর যদি মারা যায় তবে তার সোনালী চামড়া চাটাইয়ের উপরে বিছিয়ে উপবেশন করা যাবে।
( অরণ্য কান্ড সর্গ ৪৩ শ্লোক ১৯)
ইহা দ্বারা নিশ্চিতরূপে সিদ্ধ হয় যে, স্বর্ণ হরিণ শিকার মাংস খাওয়ার জন্য করা হয় নি।
বীর হনুমান যখন অনেক বাধা অতিক্রম করে অশোক বাটিকা মধ্যে পৌছে তখন সীতা মাতা রাম জীর কুশল জীজ্ঞাসা করেন। অর্থাৎ তিনি কি শোকে ব্যাকুল হয়ে অবৈদিক পথে চলছে?
তখন হনুমান জী বলেন
ন মাংস রাঘবো ভূঙ্ক্তে ন চাপি মধুসেবতে।
(সুন্দর কান্ড ৩৬।৪১)
রাম জী না মাংস খান, না মদ্য পান করেন।
অতএব বাল্মিকী রামায়নে মাংস ভক্ষনের অনুমোদন যেসব শ্লোকে রয়েছে তা নিশ্চিতভাবে প্রক্ষীপ্ত।
(৩) বেদ এবং মনুস্মৃতি মধ্যে পশুহত্যা এবং মাংস বিরুদ্ধে স্বয়ং সাক্ষী -
(i) অথর্ববেদ ৮।৩।১৫
" যঃ পৌরুষেয়েণ ক্রবিষা সমঙ্কতে য অশ্বয়েন পশুনাং...... তেষাম শীর্ষাণি হরসাষি বৃশ্চ"
অর্থাৎ যে পুরুষ বধ করে ঘোড়া, পশু আদির মাংস দ্বারা নিজেকে পুষ্ট করে। হে অগ্নি তার শির ছেদন করো।
(ii) যজুর্বেদ ১।১
পশু সমূহ (অঘ্না) হত্যা করার অযোগ্য। সর্বদা (পশুন্ পাহি) পশুদের রক্ষা করো।
( iii) অথর্ববেদ ১০।১।২৯
"অনাগো হত্যা বৈ ভীমা কৃত্যে মা নো গাম অশ্বম পুরুষং বধী"
নির্দোষের হত্যা অবশ্যই ভয়ানক। আমাদের গাভী, অশ্ব, পুরুষকে মেরো না।
(iv) যজুর্বেদ ৩০।১৮
" গোঘাতম্ ক্ষেধে যঃ গাম্ বিকৃন্তন্তম"
গাভীর ঘাতক অর্থাৎ হত্যাকারী যে, ক্ষুধার জন্য গাভীকে হত্যা করে। তাকে ছেদন করি।
(v) যজুর্বেদ ১৩। ৪৯
" অদিতিম মা হিংসী"
হত্যার অযোগ্য গাভীকে কখনো মেরো না।
(vi) ঋগবেদ ৮।১০১।১৫
" মা গাম অনাগাম অদিতিম বধিষ্ট"
নিরপরাধ গাভী এবং ভূমিতূল্য গাভীকে কখনো বধ করো না।
(vii) অথর্ববেদ ৩।৩০।১
" অঘ্না ইব" গাভী সমূহ বধের অযোগ্য। সর্বদা ( পশুন ত্রায়েথাম, যজুঃ ৬।১১) পশুদের রক্ষা করো তাদের পালন করো।
মনুস্মৃতি মধ্যেও মাংস বিরুদ্ধ অনেক প্রমাণ মেলে। যদিও প্রচলিত মনুস্মৃতিতে অনেক প্রক্ষীপ্ত রয়েছে। এর মধ্যে বেদানুকুল শ্লোকগুলো গ্রহন করা উচিৎ। এবং বেদ বিরুদ্ধ যা তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
(i) মনুস্মৃতি ৫।৪৩
কি গৃহাশ্রমে, কি ব্রহ্মচর্যাশ্রমে, কি বানপ্রস্থশ্রমে সকল অবস্থাতেভ শুদ্ধাত্মারা বিপদেও কখনো বেদ নিষিদ্ধ হিংসা করবে না।
(ii) মনুস্মৃতি ৫।৪৫
যে ব্যক্তি হিংসাশূন্য হরিণাদি পশুকে নিজ সুখের জন্য বিনাশ করে সে কি জীবিত অবস্থা কি পরলোকে উভয়ত্রই সুখ প্রাপ্ত হয় না।
(iii) মনুস্মৃতি ৫।৫১
যাহার অনুমতিতে পশু হনন করা হয়, যে অস্ত্র দ্বারা পশুর অঙ্গ প্রতঙ্গ খন্ড করা হয়, যে পশু বধ করে, যে মাংসের ক্রয় বিক্রয় করে, যে মাংস পাক করে, যে মাংস পরিবেশন করে, যে ব্যক্তি ভোজন করে ইহাদিগকে ঘাতক বলা যায়।
(iv) মনুস্মৃতি ৫।৫৫
ইহ লোকে আমি যাহার মাংস ভোজন করিতেছি পরলোকে সে আমাকে ভোজন করবে। পন্ডিতরা মাংস শব্দের অর্থ (মাং আমাকে সঃ ভোজন করবে) এইরূপ প্রতিপন্ন করেছে।
এইসব প্রমাণ দ্বারা ইহা সিদ্ধ হয় যে, রামচন্দ্র জী কখনো মাংস খেতেন না। কারন তিনি নিজেই বড় বেদের জ্ঞাতা ছিলেন। একজন বেদজ্ঞ হয়ে তিনি কখনো বেদ বিরুদ্ধ আচরন করবেন না।
ধন্যবাদ।
ReplyDeletegopd
ReplyDeleteখুব ভাল বিশ্লেষণ
ReplyDeleteখুবই ভালো।
ReplyDeleteঅসাধারণ
ReplyDelete