https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

রাধা রাণীর সত্য উন্মোচন

Saturday, January 25, 2025

 'রাধা’ শব্দটি শুনতেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে সুদীর্ঘ পল্লববিশিষ্ট একটি নারী চরিত্র। মনে জেগে ওঠে একটি যুগল মূর্তি — কৃষ্ণ ও রাধা একসাথে বাঁশি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। এইসব কথার প্রমাণ চাইলে তাঁরা বিবিধ শাস্ত্র থেকে প্রমাণ করে যে রাধা রয়েছে, এবং তাঁর সাথে কৃষ্ণের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর……!

অনেকে আবার বেদ থেকে রাধার অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করে, তো চলুন দেখে আসি বেদে রাধার অবস্থান —
পবিত্র বেদে ‘রাধা’ শব্দটি ৪৩ জায়গায় পাওয়া যায়। ঋগ্বেদঃ ১/২২/৮, ১/৩০/৫, ১/৪১/৭, ১/৮৪/২০, ১/১০০/১৭, ৩/৩৩/১২, ৩/৫১/১০, ৪/২/৪, ৪/৫/৪, ৪/১৬/১৬, ৪/১৭/৮, ৪/২৪/২, ৪/২৯/১, ৫/৪০/৭, ৫/৪০/৮, ৫/৭৯/৬, ৫/৭৯/৭, ৬/৪৪/১২, ৬/৪৮/৯, ৭/১৫/১১, ৭/১৬/১০, ৭/৩৭/২, ৭/৩৭/৮, ৮/৬/৪৬, ৮/৮/১৩, ৮/৭০/১৩, ১০/২৯/৭, ১০/৪৯/১১, যজুর্বেদঃ ১৯/১৬, সামবেদঃ ৪১, ১৬৫, ৩৩৫, ৩৮৬, ৭৩৭, ১৫০৯, ১৬০০, ১৬২৩, ১৭২৪, অথর্ববেদঃ ১/২৬/২, ১২/২/৬, ১৯/৭/৩, ২০/৪৫/২, ২০/৭৬/৭ । এই সব মন্ত্রে রাধা শব্দটি উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এই রাধা সেই যুগল মূর্তির রাধা নয়। নিরুক্তকার যাস্কের মতে “राध इति धननां” “রাধ ইতি ধননাম” [নিরুক্ত ৪।৪] অর্থাৎ রাধা বলতে ধন বা ঐশ্বর্য বুঝায়।
 
সেই অনুসারে কিছু মন্ত্রের অর্থ দেখে নেওয়া যাক —
★ সখায় আ নিষীদত সবিতা স্তোভ্যো নু নঃ।
দাতা রাধাংসি শুম্ভতি।।
[ঋগ্বেদ ১।২২।৮]
পদার্থ: (সখায়ঃ) হে মিত্র! (আ নিষীদত) চারিদিক থেকে এসে একত্রে বসো। (স্তোভ্যঃ) স্তুতিযোগ্য (সবিতা) সকল ঐশ্বর্যযুক্ত, জগৎ কর্তা জগদীশ্বরের (নু) শীঘ্র স্তুতি কর, যিনি (নঃ) আমাদের প্রতি (রাধাংসি) ঐশ্বর্যের (দাতা) দাতা, (শুম্ভতি) শোভা দানকারী এবং শোভা যুক্ত।
★ স্তোত্রং রাধানাং।। [ঋগ্বেদ ১।৩০।৫]
হে (রাধানাং পতে) সমস্ত ঐশ্বর্যের স্বামিন্ !
★ তে রাধাংসি।। [ঋগ্বেদ ১।৮৪।২০]
(তে) তোমার (রাধাংসি) ঐশ্বর্য।
★ রাধানাং পতে।। [ঋগ্বেদ ৩।৫১।১০]
হে (রাধানাং পতে) ধনের স্বামিন্ !
★ সুরাধাঃ।। [ঋগ্বেদ ৪।২।৪]
(সুরাধাঃ) উত্তম সুখজনক ঐশ্বর্যের স্বামী।
—— এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে পবিত্র বেদে যেসব স্থানে রাধা শব্দের উল্লেখ রয়েছে সেখানে কোনো সাকার রূপধারী ব্যক্তিত্বের কথা উল্লেখ নেই।
> তাহলে প্রশ্ন হতে পারে যে, যদি বেদে রাধার কথা উল্লেখ না থাকে তাহলে এই রাধা এলো কোথা থেকে?
পৌরাণিক রাধার উৎপত্তি ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে।
পুরাণের কথা যেহেতু উঠে এলো তো চলুন পুরাণের রাধার বৈশিষ্ট্য গুলো দেখে নিই —
১. রাধা হলো শ্রীকৃষ্ণের প্রেমিকা :
দক্ষিণাঞ্চ শ্রীকৃষ্ণো বামাঙ্গং সা চ রাধিকা৷৷
[ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, প্রকৃতিখণ্ড-৪৮/২৯]
অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের দক্ষিণ অংশ শ্রীকৃষ্ণরূপ হলো এবং বাম অংশের অঙ্গ রাধারূপ ধারণ করেছেন।
২. শ্রীকৃষ্ণই রাধা রাধাই শ্রীকৃষ্ণ:
যথা তঞ্চ তথাহঞ্চ ভেদো হি নাবয়োর্ধ্রুবম্।।
[ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, জন্মখণ্ড-১৫/৫৭]
হে রাধা! তুমিই আমি, আমিই তুমি, আমাদের কোন ভেদ নেই।
৩. রাধা হলো শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী:
গর্গ সংহিতা, গোলকখণ্ড, ১৬ তম অধ্যায়ে ব্রহ্মা দ্বারা রাধা- কৃষ্ণের বিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ব্রহ্মাকে তারা চার মস্তকযুক্ত মনে করিয়া থাকেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, প্রকৃতিখণ্ড-৪৮/৪৭ শ্লোকেও 'স্বয়ং রাধা কৃষ্ণপত্নী' বলিয়া উল্লেখিত আছে।
৪. রাধা হলো শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি:
হে রাধা! তুমি আমার এবং সকলের শক্তিস্বরূপা।
[ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড-৪৫/৬৩]
৫. রাধা শ্রীকৃষ্ণের পরম ভক্ত ছিল:
রাধা শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করিতেন এর উল্লেখ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, প্রকৃতি খণ্ড-৪৮/৩৮ শ্লোকে রয়েছে।
৬. রাধা মানে শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত অর্থাৎ যে/যারা শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত সে/তাহারাই রাধা:
এরূপ বিভিন্ন উত্তর পেয়েছি। যারা রাধাকে কৃষ্ণ হইতে আলাদা এবং নির্দিষ্ট এক ব্যক্তি বলিয়া থাকেন তারা সকলেই রাধাকে বৃষভানুর কন্যা বলিয়া জানেন, যার উল্লেখ পুরাণাদিতেও রয়েছে। রাধার মাতার নাম নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে পাওয়া যায় যে রাধার মাতার নাম কলাবতী।
বৃষভানুসুতা সা চ মাতা যস্যাঃ কলাবতী।
[ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণ-জন্মখণ্ড-২৩/৯৩]
অর্থাৎ, রাধা বৃষভানুসুতা তাহার মাতার নাম কলাবতী।
প্রকৃতিখণ্ড-৪৮/৫৫ শ্লোকেও রাধার পিতা-মাতার নাম বৃষভানু-কলাবতী পাওয়া যায়।
৭. রাধা শ্রীকৃষ্ণের মামি:
অতীতে দ্বাদশাব্দে তু দৃষ্টা তাং নবযৌবনাম্।
সার্দ্ধং রায়াণবৈশ্যেন তৎ সম্বন্ধং চকার সঃ।।
[ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, প্রকৃতিখণ্ডম- ৪৯/৩৯]
দ্বাদশ বৎসর অতীত হইলে, বৃষভানু, রায়াণ বৈশ্যের সহিত নবযৌবনা নিজ-কন্যার [রাধার] বিবাহ সম্বন্ধ করে।
৮. রাধা শ্রীকৃষ্ণের কন্যা:
আবির্বভূব কন্যৈকা কৃষ্ণস্য বামপার্শ্বতঃ।
তেন রাধা সমাখ্যাতা পুরাবিদভিশ্বজোত্তম।।
[ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, ব্রহ্মখণ্ড-৫/২৫ ও-৫/২৬]
শ্রীকৃষ্ণের বামপার্শ্ব হইতে এক কন্যা আবির্ভূত হইয়াছিলো, পুরাণজ্ঞ পন্ডিতেরা তাহাকে রাধা নাম দিয়াছেন।
 
এখানে বিভিন্ন জায়গায় রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের বিভিন্ন সম্পর্কের বর্ণন রয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে যে, প্রকৃতপক্ষে কৃষ্ণের সাথে কি সম্পর্ক রাধার?
 
> রাধা সম্পর্কে যারা ভক্তিময় কথপোকথন করে, রাধা নামে দুহাত তুলে নৃত্য করে, রাধা ব্যতিত কৃষ্ণকে চিন্তা করতে পারে না তাদের জন্য মানস ভট্টাচার্যের লেখা “ভণ্ডের ভগবান” এর কিঞ্চিৎ লেখনি —
আমরা পারি। শুধু আমরাই পারি। বীর, তেজস্বী, অসাধারণ, রাজনীতিবিদ, দূরদর্শী, ধর্মরক্ষাকারী ও দুস্কৃতির বিনাশকারী হিসাবে যার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, যিনি নিজে সারাজীবনের বেশীর ভাগ সময় লড়াই আর যুদ্ধ করে কাটিয়েছেন, একের পর এক দুর্বৃত্তকে বিনাশ করেছেন, গত ৫০০ বছর ধরে তার লীলাকে এমনভাবে আমরা কীর্তন করতে শুরু করলাম যাতে বর্তমান ভাবে গাছের ডালে বসে পা দোলাতে দোলাতে মেয়েদের চান করা দেখা আর মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনষ্টি করা ছাড়া তার কোনও কাজ ছিল না। জীবন যার বীরত্বময় আর যুদ্ধময় আমাদের পাল্লায় পড়ে সেই জীবন হয়ে উঠল। লীলাময় আর নারীময়। সারা জীবনে একটা নারীকে, নিজের স্ত্রীকে যিনি ঠিকমত সময় দিতে পারেননি তাকে ষোলোশ নারীর সঙ্গে নাচিয়ে দিলাম। তিনি কাউকে খোল-করতাল নিয়ে নাচগান করার পরামর্শ দেননি অথচ সেটাকেই মূখ্য করে আমরা কাঁদতে লাগলাম। সেই যে কান্নার শুরু সেই কান্না আজও সমানে চলছে। অলৌকিক অবাস্তব আর যুক্তিহীন কল্পনা মানুষকে কাঁদতে শেখায় । আমরা ভণ্ড। তাই ভক্তের ভগবান যখন ভণ্ডের ভগবান হয়ে ওঠে তখন কেঁদেই কেটে যায়। আমরা কাপুরুষ এবং দুর্বল চিত্ত । যৌনতা আমাদের মজ্জায় মজ্জায়। ভক্তের ভগবানকেও আমরা আমাদের মত বানিয়ে নিয়েছি। আমাদের ভণ্ডামির পাহাড় প্রমাণ ছাই-এর আড়ালে চাপা পড়ে গেছে ভগবান । আর কিছুতেই মাথা তুলতে পারছে না। আমি কেষ্টঠাকুর, নাড়ুগোপাল বা গোপালঠাকুর নয়— আমি শ্রীকৃষ্ণের কথা বলছি। ভারতের ভগবানকুলের অন্যতম চরিত্র। অসাধারণ বীর এবং বাগ্মী। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা। অত্যন্ত যুক্তিবাদী। জীবন ও সমাজ কেমন হবে তাঁর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে গীতায়। প্রচণ্ড অস্থির সময়েও কি করে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয় তা বলেছেন কুরুক্ষেত্রের মত এক যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে। তার এই চরিত্র আমাদের পছন্দ হয়নি। ভক্ত নয় বলে হয়নি। আমরা ভণ্ড। যণ্ড মানে যদি ষাঁড় হয়, তাহলে ভণ্ড মানে ভাঁড় হতে পারে। কৃষ্ণকে নিয়ে আমাদের সেই ভণ্ডামো বা ভাঁড়ামো চলছে দীর্ঘদিন ধরে।
 
আমরা জানি ভাবনা আমাদের প্রভাবিত করে। কেউ যদি সর্বদা ভাবে আমি চোর হবো সে চোর হবেই। কেউ যদি ভাবে আমি ভালো হবো, আমাকে ভালো হতে হবে তাহলে সে ভালো হবেই। গত ৬০০ বছর ধরে একদল মানুষ ভাবছেন জগতে একমাত্র কৃষ্ণই পুরষ আর সব নারী। এরকম ভাবতে ভাবতে গোটা ভারতবর্ষের বেশীর ভাগ অংশ নারীতে পরিণত হয়েছে। দেখতে শুনতে পুরুষের মতে কিন্তু পৌরুষ নেই, তেজ নেই, দীর্ঘদিন ধরে ভাবছে আমরা তো কেউ পুরুষ নই কৃষ্ণ একমাত্র পুরুষ। এরকম ভাবতে ভাবতে নিজেরাই কখন পৌরুষ হারিয়েছি সে হুঁশ নেই। পুরুষ যদি নারী হবার চেষ্টা করে তাহলে নারীও হয় না পুরুষও হয় না। এই মাঝামাঝি লোকের ভিড়ে ভরে গেছে ভারতবর্ষ। চারপাশের অন্যায় সয়ে সয়ে আমাদের পিঠে ঘা চারপাশে ভন ভন করে বেড়াচ্ছে বিষাক্ত মাছি। তবুও আমাদের চিন্তা নেই চেতনা নেই। আমরা শুধু কৃষ্ণের নামে হাউ হাউ করে কাঁদছি। ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে সেকি হাপুস নয়নে কান্না, দুহাত তুলে কাঁদছি। সেই সুযোগে আমাদের কাপড় খুলে নিয়ে পালাচ্ছে দুষ্কৃতিরা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থানের অর্ধেকটাই দুষ্কৃতিরা দখল করে নিয়েছে। তবুও আমরা কাঁদছি, ভাবছি কৃষ্ণ বড় খুশি হচ্ছেন। কৃষ্ণ জানেন এরা কাপুরুষ। এদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তিনি মুচকি হাসছেন এদের ভণ্ডামো আর নপুংসতা দেখে।
এইসব কৃষ্ণ ভক্তরা মিথ্যার জাহাজ। বীর আর সাহসী কৃষ্ণের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পুরো জীবনটাকেই ভণ্ডামি দিয়ে আর মিথ্যা দিয়ে চাপা দিয়েছেন। যে কোন টিকিধারী নামাবলীধারী কপালে রস তিলকধারী কৃষ্ণ ভক্তকে জিজ্ঞাসা করুন—আচ্ছা পৃথিবীতে কৃষ্ণ জন্মেছিলেন কেন—অমনি চটপট জবাব কেন লীলাময় এসেছেন লীলা করার জন্য। এই চূড়ান্ত মিথ্যাটি বহুবার বহুজনকে বলতে শুনেছি। প্রেমাবতার প্রেম ছড়াবার জন্য অবতীর্ণ হয়েছেন। মানুষও গোগ্রাসে গেলে এসব, অথচ শ্রীকৃষ্ণ নিজে কি বলেছেন তা আমরা পাত্তাই দিই না। কেন ভগবান জন্ম নেন স্পষ্ট করে বলা আছে গীতায়। শ্রীকৃষ্ণ নিজে বলেছেন— —দুষ্কৃতির বিনাশ আর সাধুদের পরিত্রাণ করার জন্য তিনি জন্ম নেন। অধর্ম নাশ করে ধর্ম সংস্থাপন করার জন্য তিনি আসেন (গীতা-৪/৮)। কোন ভণ্ডামো নেই, কোন লুকোছাপা নেই, শ্রীকৃষ্ণ যা বলেছেন স্পষ্ট বলেছেন, বলেছেন বীর অর্জুনকে, তাহলে কোন বৈষ্ণব ভক্তের কানে কানে তিনি বলতে গিয়েছিলেন যে, আমি লীলা করতে আসি। অথচ কৃষ্ণের এ কথাটা আমরা প্রচার করিনি কারণ দুষ্কৃতি বিনাশ বা ধর্ম সংস্থাপন করতে গেলে সাহস দরকার পৌরুষ দরকার । তার চেয়ে লীলা অনেক সহজ। রস আছে, তাই বার বার লীলার মতো মিথ্যাকথা আওড়ে চলি।
 
শ্রীকৃষ্ণের ছোটবেলা নিয়েও আমাদের ভণ্ডামোর শেষ নেই। বিভিন্ন বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো থাকে নাদুস-নুদুস গোপালের ছবি। কোথাও ননী চুরি করছে। কোথাও মাখন চুরি করছে। হাতে মুখে লেগে আছে চুরি করে খাওয়া ননী আর মাখন। বাড়ির ছোটছেলেরা আচার বা বিস্কুট চুরি করে খেলে বকুনির অন্ত নেই, অথচ ঘরের দেওয়ালে টাঙানো চোর কৃষ্ণের ছবি, বিভিন্ন মন্দিরেও, যেন চুরি করে খাওয়াটাই কৃষ্ণের ছোটবেলার প্রধান ঘটনা। আমরা আমাদের স্মরণীয় ঘটনাগুলিকেই ছবি করে তুলে ধরে রাখি। কৃষ্ণের ছোটবেলার ছবি দেখলে মনে হবে ননী আর মাখন চুরিই তার শিশুকালের প্রধান ঘটনা। অথচ বাস্তববুদ্ধি অন্য কথা বলে। ছোটবেলাতেই পুতনা বধ, বকাসুর বধ, যমুনায় কালীয় দমন করে রমনক দ্বীপে পাঠানো, তৃণাবর্ত বধ। এমন নানা বীরত্বব্যঞ্জক ঘটনা জড়িয়ে আছে শিশু কৃষ্ণের জীবনের সাথে। অথচ আমরা এগুলিকে পাত্তা দিই না। তার চেয়ে যশোদা ভগবানের কান ধরে আছে এ ছবি আমাদের অনেক বেশি পছন্দ। আর আমাদের সবচেয়ে পছন্দের নাড়ুগোপাল গোপালঠাকুর। হাতে মণ্ডা, নিদেনপক্ষে নকুলদানা নিয়ে বসে আছেন। আমরা ভণ্ড এবং কাপুরুষ তাই কৃষ্ণের শিশুকালের বীরত্বব্যঞ্জক জীবনকে ঢেকে দিয়েছি নাড়ু আর ননী মাখন দিয়ে, বীরত্বকে ঢেকে দিয়েছি দুর্বলতা আর কাপুরুষতা দিয়ে, মেয়েলি ন্যাকামো দিয়ে।
কৃষ্ণের জন্ম নিয়ে আমাদের হাজার গালগল্প। সেইসব গল্পে আমরা বুঁদ হয়ে থাকি। বাস্তবটাকে এড়িয়ে চলি, সত্যকে খোঁজার কোনও চেষ্টাও করি না। আমরা কিছুতেই বুঝিনা যে শুধুমাত্র লীলা করার জন্য টুক করে ভগবান আকাশ থেকে ঝরে পড়েননি। অন্যান্য আর পাঁচটা শিশুর মত নিয়ম মেনেই তাঁর জন্ম হয়েছে। দেবকীকেও ১০ মাস ১০ দিন গর্ভধারণ করতে হয়েছে। নিদারুণ দুঃখ আর যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে কারাগারের মধ্যে, পৃথিবীতে আসতে গেলে ভগবানকেও যে পৃথিবীর নিয়ম মেনে চলতে হয় এটা তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কংসের হাত থেকে বাঁচাতে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে যমুনা পার করে গোকুলে লুকিয়ে রেখে আসতে হয়েছে। অথচ এই বাস্তবকে ভুলে তার যাবতীয় দুঃখ কষ্টকে ভুলে আমরা মনে রাখলাম ননী চোরা কৃষ্ণকে, তাকে পৃথিবীতে আনার জন্য কারাগারের মধ্যে দিনরাত কাটানো গর্ভবতী দেবকীকে ভুলে গেলাম। মনে রাখলাম যশোদাকে। যাকে তেমন কোনও কষ্টই করতে হয়নি। হাতে পায়ে শিকল বাঁধা বসুদেবকে ভুলে গেলাম। মনে রাখলাম বর্ধিষ্ণু নন্দরাজকে। কৃষ্ণ বসুদেবের পুত্র এই পরিচয় ভুলিয়ে দিলাম অর্ধেকের বেশি লোককে। কৃষ্ণ হয়ে গেলো আর যশোদা নন্দন আমাদের ভণ্ডামি আর গালগল্পের পরিমাণ বেশি বলে। দেওয়ালের গোপালঠাকুর আর ননীচোরার ছবি দেখিয়ে এমন করলাম যে তার ছোটবেলার বীরত্বের কথাগুলি ভুলেই গেলাম।
 
এখন ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে জন্মাষ্টমী হয়। সরকারিভাবে ছুটি থাকে অনেক জায়গাতেই, বিভিন্ন জায়গায় যে উৎসব হয়, তার মূলে হরিনাম আর দইয়ের হাড়ি ভাঙা। ছোট ছোট ছেলেদের হাতে বাঁশি আর মাথায় ময়ূরের পালক গুঁজে ননী মাখন খাওয়ানো হয়। এমন গোপালঠাকুর এখন ঘরে ঘরে। হরিনামের চোটে উঠোন কাদা। দই হলুদে মাখামাখি। অথচ কৃষ্ণের জন্মদিনে অন্যরকম শপথ নেওয়ার কথা ছিল। শ্রীকৃষ্ণ যেখানে জন্মেছিলেন সেই মথুরার কারাগার আমাদের প্রাণের ধন। সব মুসলমানের যেমন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য জীবনে অন্তত একবার মক্কায় হজ করতে যাওয়া। তেমনই প্রত্যেক কৃষ্ণভক্তের উচিত ছিল জীবনে একবার ভগবানের জন্মস্থানে যাওয়া। যাবেন কোথায় ? যে কারাগারে তাঁর জন্ম হয়েছিল সেটাইতো এখন অন্যধর্মের দখলে। হাজার হাজার বৈষ্ণব অথবা কৃষ্ণভক্ত জন্মাষ্টমীতে দুহাত তুলে নেচে নেচে কাঁদতে পারেন। কিন্তু কৃষ্ণের জন্মস্থান উদ্ধারের কোন চেষ্টা করতে পারেন না। কৃষ্ণভক্তদের এগুলো শুনতে খারাপ লাগবে, কারণ এটাই নির্মম সত্য। এর মধ্যে ভণ্ডামি নেই। রসের গল্প নেই। এদের পাল্লায় পড়েই ভক্তের ভগবান ভণ্ডের ভগবান হয়েছে। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ভক্তির সাইনবোর্ড। কারও সরু টিকি কারও মোটা টিকি। এদের জিজ্ঞাসা করুন—ভগবান কৃষ্ণের পূতঃ পবিত্র জন্মস্থান অন্যের দখলে গেল কেন। আপনারা তার ভক্ত হয়ে উদ্ধারের চেষ্টা করছেন না কেন। অমনি ভক্ত বলবে এসবই তো তেনার লীলা। উত্তর একেবারে রেডি। সত্যের মুখোমুখি হলে এমনই হয়। লীলা কি দাদ হাজা চুলকানি নাকি । যখন খুশী যেখানে খুশী হবে। ভক্তদের হবে, ভগবানের হবে, ভক্ত না হয়ে হলে এমনই হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৈশোর আর যৌবনকে আরও নীচে নামিয়ে এনেছি। সমগ্র যুবসমাজের কাছে হাসির খোরাক করে তুলেছি ভগবানকে। যাত্রা-নাটক-সিনেমা- আড্ডা-ঠেক সর্বত্র এখন কৃষ্ণকে নিয়ে ফাজলামো হয়। দোষ যুবকদের নয়, কৃষ্ণভক্তদের। কৃষ্ণের কৈশোর আর যৌবনকে আমরা গত ৫০০ বছর ধরে এমনভাবে তুলে ধরেছি যেন কৃষ্ণ একটা লম্পট। যার চরিত্র বলে কিছু ছিল না। যার প্রধান কাজ ছিল মেয়েদের সঙ্গে স্ফূর্তি করা। স্নানের ঘাটে মেয়েদের কাপড় চুরি। পরের বউকে নিয়ে টানাটানি। লুকিয়ে তার সঙ্গে ক্রীড়া। হ্যাঁ এভাবেই উপস্থাপিত করেছি কৃষ্ণকে। যা সত্যের একেবারে বিপরীত। চরম এবং চূড়ান্ত মিথ্যাকথাগুলিকে শ্রীকৃষ্ণের জীবনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভগবানের লীলা বলে এই কাজকে সমর্থনও করা হয়। ছোট থেকে বড় এখন, সবাই আমরা সেই প্রভাবে প্রভাবিত। পথে ঘাটে স্কুলে কলেজে সর্বত্র এসব নিয়ে হাসিঠাট্টা। আমরা শুনি। কৃষ্ণভক্তরাও শোনে। হজম করতে হয়। কারণ ভণ্ডামি ঢাকতে এসব হজম করা ছাড়া কোনও উপায় নেই। কোন ছেলে যদি তার বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প করে অমনি আমরা বলি—কিহে তুমি তো কলির কেষ্ট। এগুলো পরিচিত বাক্যবন্ধনী। অনেকেই শুনি। অনেকেই বলি। একবারও ভাবি না কি বলছি, কেন বলছি। একথা বলে কি আমরা এগুলোই বোঝাতে চাই যে মেয়েদের সঙ্গে বসে গল্প করা ছাড়া আর কোনও কাজ ছিল না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাকে কৃষ্ণভক্ত বলি না। ভণ্ড ভক্তরা বলেন প্রেমময়ের লীলা। স্বর্গে কি অপ্সরার অভাব ছিল। মর্তে আসতে হলো মেয়েদের সঙ্গে গল্প করার জন্য। কিছুতেই সত্য স্বীকার করব না। আমাদের হাড়ে মজ্জায় শিরায় শিরায় এই ন্যাকামি চলছে দীর্ঘকাল ধরে। তাই সিনেমা নাটক গান সর্বত্র কৃষ্ণের কৈশোর যৌবনকে নিয়ে চূড়ান্ত ছ্যাবলামো চলছে। বিকৃতভাবে গাওয়া হচ্ছে ভজ গৌরাঙ্গ। সিনেমায় গোঁফধারী কৃষ্ণ কুঞ্জবনে বসে বসে সিগারেট ফুঁকছে আর রাধাকে চুমো খাচ্ছে। এসব দেখে কোনও কৃষ্ণভক্ত প্রতিবাদ করেন না। কারণ নপুংসকেরা প্রতিবাদ করতে ভয় পায়। লাগাতার ভণ্ডামো মানুষকে কাপুরুষ করে তোলে। নিজেদের এই বীর্যহীনতা আর মিথ্যাচারিতাকে সমর্থনের জন্য হাজার যুক্তি। আসলে সত্যের মুখোমুখি হতে হলে সাহসী হতে হবে। বীর্যবান হতে হবে। নির্ভীক হতে হবে। আমরা অসৎ। আমাদের বেশিরভাগের চরিত্র দুর্বল। তাই বীর্যবান তেজস্বী কৃষ্ণও আমাদের পছন্দ নয়। আমরা আমাদের ভগবানকেও আমাদের মতো বানিয়ে নিয়েছি। নিজেদের অবদমিত ইচ্ছাগুলো চাপিয়ে দিয়েছি ভগবানের উপর। নিজেরা মেয়েদের চান করা দেখতে গেলে লোকে ঠ্যাঙাবে। তাই ভগবানকে দিয়ে দেখিয়েছি। পরের বউ এর সাথে প্রেম করলে ধরা পরার ভয়, ভগবানের প্রেম বলে চালিয়ে দিচ্ছি। বয়সকালে একটা মানসিক তৃপ্তিতো পাওয়া যাচ্ছে। ভক্তিও হলো আবার তৃপ্তিও হলো।
 
এমন বাড়ি খুব কমই আছে যেখানে রাধাকৃষ্ণের ছবি নেই। রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি তে প্রায় বাঙালি বাড়িতে। শিখিপুচ্ছধারী বাঁশিধারী কৃষ্ণের পাশে রাধা। এ ছবি আমাদের চিরচেনা। এখনতো এমন অনেক সংগঠন আছে যারা কৃষ্ণের থেকে রাধাকে বেশি গুরুত্ব দেন। আমরা যদি গালগল্প ভালো না বাসতাম তাহলে কখনই এগুলো সম্ভব হতো না। তমাল তলায় কৃষ্ণ রাধাকে নিয়ে দোল খাচ্ছে এটা ভাবতে ভালো লাগে। কিন্তু যুক্তিতে টেকে না। একবারও ভাবিনা কৃষ্ণের গোটা যৌবনটা যদি রাধাকে নিয়ে দোল খেতে খেতে কেটে গেল তাহলে এত যুদ্ধবিগ্রহ, কংস, শিশুপাল, জরাসন্ধবধ, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধপরিচালনা এসব কখন করলেন। দুটো চরিত্রকে মেলানো যাবে কি ভাবে, যাঁর জন্ম দুস্কৃতিদের বিনাশ আর সাধুদের পরিত্রাণের জন্য, তিনি রাধা নামের এক পরস্ত্রীকে নিয়ে তমালগাছে দোল খাবেন এতো অতি বড় কষ্টকল্পনা। তবুও আমাদের ছেলেমেয়েদের মন থেকে কৃষ্ণের সেই তেজস্বী রূপটাকেই মুছে দিতে পেরেছি। আমাদের দীর্ঘদিনের ভণ্ডামো আর মিথ্যাচারিতা দিয়ে। দাদের ধারে ধারে চুলকেও তৃপ্তি।
 
প্রায় বছর দশেক আগের কথা। এক কৃষ্ণভক্তের বাড়িতে বসে আছি। তার বাড়ির দেওয়ালে রাধাকৃষ্ণের ছবি। যেমন থাকে জড়াজড়ি করে, রাধার প্রায় শিথিল বসন, হঠাৎ ক্লাস ফাইভে পড়া ছেলেটি তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করে—আচ্ছা বাবা রাধা কি কৃষ্ণের বউ। বাবা নিরুত্তর, অনেক কষ্টে ঢোক বলেন না রে বউ নয়। ছেলের মা বাবা পরস্পরের দিকে তাকায়। নাইনে পড়া দিদি পড়া ছেলে উঠে এসে বলে –তুই জানিস না রাধা কৃষ্ণের মামিমা ছিল। ছেলে বলে তাহলে ওরকম জড়িয়ে ধরেছে কেন, বাবা মা নিরুত্তর। আমাদের প্রতিক্রিয়া যে কি সুদূরপ্রসারী হতে পারে তা ভাবি না। আমরা নব নব তত্ত্বের অবতারণা করি। আমরা বলি রাধাই কৃষ্ণের শক্তি, আবার সেই শক্তির নানা নাম দিই। শিশু কিশোররা এসব শক্তিও বোঝেনা, তত্ত্বও বোঝেনা । ছোট থেকে ওই ছবি দেখতে দেখতে তাদের মনে আঁকা হয় কৃষ্ণ বনে বনে বাঁশি বাজিয়ে ঘুরে বেড়াত, আর নিজের মামিমার সঙ্গে ফস্টিনস্টি করত। সেটাই তাদের মনে থাকে সারাজীবন। আমি জানি কৃষ্ণভক্তরা এসব শুনে রেগে যাবেন। কারণ এগুলো সত্য, সত্য শুনলে সবার রাগ হয়। খোঁড়াকে খোঁড়া বললে, কানাকে কানা বললে রেগে যায়। সুতরাং এসব শুনে ভণ্ড ভক্তরাও রেগে যাবেন।
কৃষ্ণের জীবনে আদৌ রাধার অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। রাধাতত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করার জন্য আলাদা একটা বই লেখা যায়। কৃষ্ণের জীবনে যে রাধার বিন্দুমাত্র প্রভাব নেই তাও প্রমাণ করা যায়। অথচ আমরা সেই গালগল্প বিশ্বাস করি। আমরা মুখে বলি 'যা নেই ভারতে তা নেই ভারতে’ অর্থাৎ মহাভারতে যা নেই তা ভারতবর্ষে নেই। মহাভারতের প্রতিটি পাতা আঁতিপাতি করে খুঁজেছি। কোথাও রাধার নাম পর্যন্ত নেই। অথচ রাধা ছাড়া বাকি অনেকের আছে। কৃষ্ণের জীবনদর্শন গীতা। গীতা সারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। গীতার কোথাও রাধা নেই। অথচ এমন নয় যে মহাভারতে কোথাও রাধার নাম উল্লেখের জায়গা ছিল না। নারদ নিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণকে। গোকুল থেকে। সকলে আকুল। সত্যভামা রুক্মিনীসহ অনেকের নাম আছে। রাধা নেই। পাণ্ডবদের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে গোকুলে যাচ্ছেন কৃষ্ণ। নিজের বাবা মা পালিত বাবা মার জন্য মন খারাপ । আরও অনেকের জন্য মন খারাপ । রাধার নাম নেই, মহাভারতের শেষ পর্বে কৃষ্ণের বহু প্রিয়জন বহু সখীর নাম আছে রাধার নাম তার মানে কৃষ্ণের জীবনে রাধা প্রক্ষিপ্ত। আমাদের অবদমিত মনের ফসল। কৃষ্ণের রাধাপ্রেম ঝুলন এসব গল্প, সত্য নয়। অথচ সেই গল্পেই আমাদের বিশ্বাস। আর গল্পের গরু যেমন গাছে ওঠে তেমনই রাধার গল্প বিশ্বাস করানোর জন্য আরও গল্প আরো বর্ণনা। বীরপুরুষকে কাপুরুষ বানানো ঠিক আমাদের মত করে।
 
যে রাধার অস্তিত্ব শুধু গালগল্পে সেই রাধার জন্য ভগবানকে দিয়ে কি না। করিয়েছি। শেষে পা পর্যন্ত ধরিয়েছি। ‘দেহি পদপল্লব মুদারম’, শুনে আমরা গদ গদ হই। অনেকের দুচোখ বেয়ে গড় গড় করে জল পড়ে। ভাবিনা যে কৃষ্ণের মতো বীরপুরুষ এমন পায়ে ধরতে যাবেন কেন। সত্যভামা পারিজাত চেয়েছিল। ইন্দ্রের সঙ্গে ভয়ানক যুদ্ধ করে ফুলসুদ্ধ পারিজাত গাছ এনে পুঁতে দিলেন। সত্যভামার দরজায়। বীর যুবকের মতো কাজ। কিন্তু কঠিন, তাই আমরা সেটা ভুল গেলাম, তার থেকে পা ধরা অনেক সহজ সেটাকেই গ্রহণ করলাম মনে প্রাণে। ভণ্ডামির চূড়ান্ত।
 
এখন যদি কেউ বলেন রাধা আর কৃষ্ণের প্রেমকাহিনীকে নিয়ে অসংখ্য উৎকৃষ্ট সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে তবে তাকে নিশ্চয় স্বীকার করতে হবে। একথা সত্য যে রাধা কৃষ্ণের প্রেমভাব সংস্কৃত আর বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। সেখানে গোল বেঁধেছে ওইসব সাহিত্যকে ধর্মের সঙ্গে এক করে দেওয়ায়। রাধার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য বক্তৃতার ফুলঝুরি ছোটে বৈষ্ণব গুরুদের মুখে। মূলত তিনটি যুক্তি দেন। এক, রাধা কৃষ্ণের শক্তিস্বরূপা। দুই, এই দুইয়ে কোন ভেদ নেই। রাধাকৃষ্ণ অভেদ। তিন, জগতে প্রেমের বিস্তারের ক্ষেত্রে রাধা প্রেমের বড়ো ভূমিকা আছে। বার বার এগুলি শুনি। আমাদের বোঝানো হয় যে রাধাকৃষ্ণের প্রেম নাকি অধ্যাত্মভাব ভক্তি আর প্রেমের সঞ্চার করে। এগুলো সব আবেগের কথাবার্তা। ভাবের ভক্তির বা ভণ্ডামির কথাবার্তাও হতে পারে। কারণ এর সারবত্তা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা হয় না।
 
শিশুকাল থেকে পূর্ণযৌবন পর্যন্ত কৃষ্ণ অনেক যুদ্ধ করেছেন। শেষে ব্যাধের তীরের আঘাত মরেও গেছেন। যা করেছেন নিজের শক্তি প্রতিভা সাহস আর ক্ষমতা দিয়ে। কোথাও বলেননি রাধাই আমার শক্তি। কোথাও রাধার নামই করেননি। কাউকে বধ করতে যাবার আগে রাধার আরাধনা করেননি। একবারের জন্যও বলেননি, হে রাধা আমাকে শক্তি দাও। রাধা যদি শক্তিস্বরূপা হতো তাহলে কায়দা করে জরাসন্ধকে, সুদর্শন চক্র দিয়ে শিশুপালকে, ক্ষমতা দিয়ে কংসকে মারার দরকার হতো না। ভীম যখন জরাসন্ধকে কিছুতেই মারতে পারছেন না তখন তিনি নিশ্চয় বলতেন—ভীম তুমি ১০৮ বার রাধা নাম জপ করো তাহলেই জরাসন্ধ হত হবে। শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতে বা গীতায় একবারও স্বীকার করেননি যে রাধাই তার শক্তি। কারণ এগুলো সত্য নয়। শ্রীকৃষ্ণ যা বিশ্বাস করেননি আমরা তা বিশ্বাস করি। শ্রীকৃষ্ণ বাস্তববাদী ও যুক্তবাদী। আমরা আবেগবাদী ও মিথ্যাবাদী। অনেক বৈষ্ণব পণ্ডিত বলেন --- রাধাকৃষ্ণ অভেদ। এটা আরেক প্রবঞ্চনা। কৃষ্ণের জন্ম হয়েছে মানুষের গর্ভে তেমনই রাধারও হয়েছে। দুজনেরই বাবা মাও আলাদা। লিঙ্গও আলাদা। গায়ের রং আলাদা। এমনকি চিন্তাভাবনাও আলাদা। তাহলে অভেদ কিসে। জানি ভণ্ডরা কি বলবেন। বলবেন সেটা বোঝাই তো লীলা। সেই একই চুলকানি। যা বুঝতে পারো না তাই লীলা। আগে বিভিন্ন ছবির প্রদর্শনীতে ছবি দেখতে যেতাম। অনেক ছবি বুঝতাম না। সহপাঠীরা বলতো ABSTRACT আর্ট। এই অভেদতত্ত্বও তাই। যুক্তি তর্কের বাইরে। অথচ কৃষ্ণ বরাবর যুক্তিবাদী। তা সে রাজসভাতেই হোক বা যুদ্ধক্ষেত্রেই হোক। সবসময় সর্বত্র যুক্তি দিয়েছেন। আমরা যুক্তিহীন। আমরা একবারও প্রশ্ন তুলি না। ব্রহ্মবৈবর্ত নামে একটি পুরাণ আছে। সেখানে আবার রাধাকৃষ্ণের বিয়ে এবং বিয়ের পর সারারাত কাটানোর সরস গল্পও আছে। বৈষ্ণব পদাবলীর ছত্রে ছত্রে যে রাধাপ্রেমের ঘনঘটা তা কোন্ অভেদতত্ত্ব প্রমাণ করে। তা তো আমার আপনার বাড়ির ছেলেমেয়েদের মতই। নেহাত তখন মোবাইল ছিল না, নাহলে বড়াইবুড়ির দরকার হতো না। সুতরাং অভেদ তত্ত্ব ধোপে টেকে না।
 
বৈষ্ণব কুলশিরমনিদের তৃতীয় যুক্তি— রাধাকৃষ্ণের প্রেম নাকি জগতে সমাজে প্রেমের সঞ্চার করে। বুদ্ধি যখন বাস্তবতা হারায় তখন এমন চিন্তাই আসে। গত ৫০০ বছরের বেশিসময় ধরে রাধাকৃষ্ণের প্রেমের গল্প শুনে আসছে মানুষ। তাহলে পৃথিবীতে এত বিদ্বেষ কেন, এত হিংসা কেন। এত যদি প্রেমের ঘনঘটা তাহলে ভারতবর্ষে আজ এত প্রেমের অভাব কেন। জীবনানন্দের মত কবিকেও কেন লিখতে হয়—জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই। রাধাকৃষ্ণের নামে দেশ জুড়ে প্রেম বিলিয়ে বেড়ান তাদের বেশিরভাগ এত রুক্ষ মেজাজী কেন। ভক্তে ভক্তে এত হানাহানি কাটাকাটি কেন।
 
গরিব বড়লোকে এত পার্থক্য কেন। আমি জানি এইসব কেনর উত্তর বৈষ্ণব বাবাজীরা এক কথায় দেবেন—সবই লীলা। সেই একই উত্তর চুলকানি। আমাদের একবারও মনে হয় না ভগবান নিজে যাকে যেমন তাকে তেমন শাস্তি দিয়েছেন, নিজে বলেছেন আমি দুষ্ট লোকেদের মারতে এসেছি – সেই ভগবান অন্ততঃ অহেতুক প্রেম ছড়ানোর কথা বলবেন না। ভগবান না বলছেন তো কি হয়েছে আমরা বলছি, কারণ প্রেমের এই ধাপ্পাবাজিটা আমাদের ভালো স্যুট করে। তাতে সমাজের যা হচ্ছে হোক। আমাদের তো মানসিক তৃপ্তি। কৃষ্ণ হতদরিদ্র সুদামাকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। এদেশের বেশিরভাগ বৈষ্ণবগুরু গরিব দরিদ্রের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলেন। স্টেজে উঠলেই আবার সেই বস্তাপচা প্রেমের গল্প। এমনই চলছে শত শত বছর ধরে। ভণ্ডামো আর মিথ্যাচারিতার ধারাবাহিকতা। এ সিরিয়াল চলছে দিনের পর দিন।
 
রাধা মহাভাবস্বরূপিণী অথবা মহাশক্তির দ্যোতক এসব তো নিছকই কল্পনা বলে মনে হয়। আধ্যাত্মিক তত্ত্বকথাও হতে পারে। কিন্তু বাস্তব দৃষ্টিতে রাধার কোন মহাভাবের অথবা মহাশক্তির পরিচয় তো আমরা পাই নি। বৈষ্ণব পদাবলীর ছত্রে ছত্রে রাধার যে প্রেম তাতো নিছক একালের কলেজে পড়া প্রথম বর্ষের মেয়েদের মতো ।
 
‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে শুনে মন ভোর প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।
এ তো স্রেফ শরীরী প্রেমের ঘনঘটা। একালের অবুঝ কলেজছাত্রীরা যেমন বাবা-মা'কে লুকিয়ে রাত জেগে মোবাইল অথবা ফেসবুকে প্রেম করে এ তো তেমনিই। রাতের অন্ধকারে অভিসারে। এর মধ্যে কোন গভীর তত্ত্ব সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। সাধারণ দৃষ্টিতে যা ধরা পড়ে না, সমাজের বা সাধারণ মানুষের যা কাজে লাগে না তা নিয়ে বেশি মাতামাতি করে লাভ কি? রাধার এই লালসা তো চণ্ডীদাসও ধরতে পারেন নি। তিনি তা নিজেই লিখেছেন।
“বয়সে কিশোরী রাজার কুমারী-
—তাহে কুলবধূ বালা, কিবা অভিলাযে—
রচয়ে লালসেনা বুঝি তাহার ছলা।”
সুতরাং প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষকে এই দুর্বোধ্য বাস্তবতত্ত্ব বোঝানোর চেষ্টা তো নিরক্ষর মানুষকে ‘বিগব্যাং থিয়োরী' বোঝানোর মতো। রাধার মহাভাব স্বীকার করলে একালের সব কলেজ ছাত্রীই রাধিকা । বরং তাদের ভাব আরও প্রবল। রাধার প্রেমের মধ্যে তাও একটু ভয় ছিল। এখনকার মেয়েদের মধ্যে সেই ভয়টুকুও নেই।
রাধা মহাশক্তিস্বরূপা। রাধাই কৃষ্ণের শক্তি। এর যুক্তি কোথায় । রাধার যে লীলা; তার যে জীবন সেখানে শক্তির প্রকাশ কোথায় তা অন্ততঃ বাহ্যদৃষ্টিতে চোখে পড়ে না। লুকিয়ে ভগবানের সঙ্গে প্রেম করার মধ্যে অন্তত সামাজিক দৃষ্টিতে কোন মহাশক্তি চোখে পড়ে না। রাধা না কোন অসুর বধ করেছিলেন অথবা সামাজিক ভাবে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন, সমাজ গঠনে সাহায্য করেছিলেন এমন কোন শক্তির প্রকাশ আমরা দেখি না। আমাদের বাড়ির মেয়েরা যে ছেলের সঙ্গে প্রেম করে তার সঙ্গে আমরা তার বিয়ে দিতে না চাইলে সে মেয়ে যেমন দরজায় খিল এঁটে বসে থাকে, তেমনই অবস্থা রাধারও। বিরতি আহারে রাঙাবাস পড়ে যেমত যোগিনী পারা। এর মধ্যে মহাশক্তি কোথায়?
 
কৃষ্ণ যখন গোকুল ছেড়ে মথুরায় যাচ্ছেন কংসকে বধ করতে। ব্রজবাসী কেঁদে আকুল । কৃষ্ণ যদি মনে করতেন রাধাই তার শক্তি তাহলে তো রাধাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। রাধাকে বলতেন—চল রাধা, তুমিই তো আমার শক্তি। তুমি না গেলে আমি কংসকে কি করে মারব। তুমিই তো আমার শক্তি, চলো। আমার রথে ওঠো। তারপর আবার ফিরে চলে আসবে। সে কথা কিন্তু কৃষ্ণের মুখে শোনা যায় নি। বরং অন্যান্যদের সঙ্গে রাধাও কেঁদেছেন। কৃষ্ণ মথুরা চলে যাবার পরবর্তী কালে রাধার নাম পর্যন্ত করেন নি। তাহলে কি করে বিশ্বাস করবো রাধা কৃষ্ণের শক্তি স্বরূপ। এ ন্যাকামো অন্ধভক্তিতে চলতে পারে, যুক্তিতে টেকে না। জ্ঞানেও না।
 
বৈষ্ণব দর্শনের তত্ত্ব অনুসারে ভগবানের তিনটি শক্তি। চিৎশক্তি, জীবশক্তি আর মায়াশক্তি। এই চিৎশক্তির আনন্দ অংশের নাম হ্লাদিনী শক্তি। সেই শক্তির শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ রাধার মধ্যে। বৈষ্ণবরা এও বিশ্বাস করেন যে শ্রীরাধা অথবা শ্রীমতী রাধারানী মহাভাব স্বরূপিণী। রাধা কৃষ্ণগত প্রান। শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর কিছুই জানেন না। এই ধারার প্রেমের দ্বারাই শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্যের বিকাশ হয়। আমি জানি এসব তত্ত্বকথা সাধারণ মাথায় ঢোকার কথা নয়। লৌকিক দৃষ্টিতে সাধারন মানুষ হিসাবে আমরা যা দেখি তা হলো— রাধা একজন সুন্দরী মহিলা। পরস্ত্রী। শ্রীকৃষ্ণ তার কাছে পরপুরুষ। সামাজিক শাসন অস্বীকার করে, আত্মীয় স্বজনের লাঞ্ছনা গঞ্জনা উপেক্ষা করে রাধা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। বৈষ্ণবরা এর মধ্যেই পরমপুরুষের সঙ্গে মিলনের আকুলতা দেখেন। এখন প্রশ্ন হলো এই সব তত্ত্ব ও তথ্যকে স্বীকার করে নিয়ে যদি দেখি আমার আপনার ঘরের বউ যদি রাধার মতো রাতের আঁধারে ঘর ছেড়ে পরপুরুষের কাছে যায় এবং তারপর আপনি কোন প্রশ্ন করলে সেও যদি ধারার মত বলে —— -“কুলমরিয়াদ-কপাট উদ্ঘাটলু তাহে কি কাঠ কি বাধা।।” তাহলে কি আমাদের খুব ভালো লাগবে। সমাজ সংসার তাতে কি রক্ষা পাবে। বস্তুত বৈষ্ণবদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা নিয়েই বলছি—সব বাড়ির বউরা যদি রাধা হয় তাহলে সমাজ-সংসারে কোন্ উপকার সাধিত হবে? এমন পরকীয়া দিয়ে আমরা সামাজিক উন্নতি সাধন করতে পারবো ? একগাদা গোপী কৃষ্ণকে ঘিরে নাচছেন তা দেখতে বা শুনতে ভালো লাগতেই পারে। কিন্তু জগতের কোন উপকার সাধিত হবে না। আধ্যাত্মিক চেতনা একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। সমাজ চেতনাকে এভাবে গুলিয়ে ফেলা কেন? ভারতের শক্তিস্বরূপা দেবীদের আরাধনা করি। দুর্গা আছে, কলি আছে, লক্ষ্মী, সরস্বতীও আছে। চণ্ডী জগদ্ধাত্রী সবই আছে। সেই শক্তির দেবীদের তালিকাতেও রাধা নেই। যদি আমরা বুঝতাম রাধা শক্তির আধার। তাকে ছাড়া আমাদের গতি নেই, তাহলে নিশ্চয়ই আমরা এতদিন রাধা পূজায় মেতে উঠতাম।
 
ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য মাতৃত্ব। প্রতিটি নারীর পূর্ণতা মাতৃত্বে। সেই মনুষ্য চরিত্রই হোক বা দেবী চরিত্র। মা দুর্গা, মা কালি, মা লক্ষ্মী, মা সরস্বতী এসব সাবেকী মায়েরা তো আছেন। এমন নয় যে আমরা সবার ছেলেপুলের নামও জানি তবুও দেবী হিসাবে আমরা মায়ের আসনেই বসিয়েছি। রাধার সে যোগ্যতাও নেই। শুনেছেন কেউ কখনও বলেছেন ‘মা রাধা’। মালা টিকি শোভিত, বৈষ্ণবগণ এনিয়ে নানাতত্ত্ব কথা বলেন। এর কিছু কারণও দেখান। কিন্তু এসব... ছেদো যুক্তি। ধোপে টেকে না। মায়ের দেশ ভারতেই রাধার মাতৃত্বের উত্তরণ ঘটেনি। তার পরেও রাধা প্রেম কান্তা প্রেম, পরকীয়া প্রেম এসব নিয়ে আমাদের কি মাতামাতি। কৃষ্ণ আদর্শ ভুলে গিয়ে সমাজকে সংগঠিত না করে শুধু রাধা প্রেম নিয়ে মেতে থেকে যা হবার তাই হচ্ছে। বৈষ্ণব পদাবলীতে আছে নগর বসালাম সাগর বাঁধিলাম-মানিক পাবার আশে-সাগর শুকাল মানিক লুকাল অভাগ। করম দোষে।। রাধা নিজেও জানতেন তিনি অভাগী ৷
 
এখন দেশের বৈষ্ণবদের দোষে কৃষ্ণের অবস্থা বেহাল। কিছুদিন আগে একটি আশ্রমে মচ্ছব চলছিল। অন্যান্য আরও আশ্রমে যে সব ছবি দেখা যায় । এখানেও তাই। আশ্রমের বাইরে ক্ষুধার্ত একদল কুকুরের সঙ্গে ভিখারীদের মারামারি। এক যুবক ছেলেকে ডেকে বললাম, ভাই কুকুরগুলোকে একটু তাড়িয়ে দেবে। আমার কথা বোধহয় মহারাজ শুনতে পেলেন ৷ মহারাজ বলেন, না না, ছি ছি, আমরা অহিংসার পূজারি। আমার আশ্রমে কুকুর মারা যাবে না বাবা। ওরাও তো প্রাণী। বললাম কিন্তু ছেলেমেয়ে গুলোকে কামড়ে দেবে সে। বললেন, বাবা সবই তো কৃষ্ণের লীলা। ওসব শুনে আর মাথার ঠিক ছিল না। বললাম, মহারাজ কিছু মনে করবেন না, আপনার কি মনে হয় কৃষ্ণের জীবন অহিংস ছিল। কৃষ্ণের জীবনের কোন অংশই তো অহিংস নয়। সেখানে তো সমাজ ও যুগের প্রয়োজনে হিসাংই হিংসা। একের পর এক হত্যা। শুধু হত্যা নয়। কুরুক্ষেত্রের মাঠে দাঁড়িয়ে' তো রীতিমত হিংসার প্ররোচনা। হত্যা করতে, যুদ্ধ করতে প্ররোচনা। এমনকি তিনি আবার যদি আসেন সেতো দুষ্কৃতিদের বিনাশ করতে আসবেন। বাবাজী চুপ করে গেলেন। ক্রুদ্ধ হলেন কিন্তু কিছু বললেন না। বললেন, চলুন ওঠা যাক।
 
বৈষ্ণবদের বাবাজীদের এই মৃত্যুসাধনা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। আমাদের খিচুড়ি । খাওয়া যখন শেষের দিকে তখন কানে এলো মাইকে গান- -“মরিব মরিব সখী নিশ্চয়ই মরিব”। বাবাজীকে বললাম— শুনছেন। এভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাজীবন যদি কেবল ‘মরিব মরিব’ করেন—যদি জোর দিয়ে বলেন, নিশ্চয়ই মরিব। তাহলে আপনাদের বাঁচাবে সাধ্য কার। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণেরও ক্ষমতা নেই এইসব ভণ্ড কৃষ্ণভক্তদের বাঁচাবার। গীতার শেষে আছে যেখানে শ্রীকৃষ্ণ সেখানেই বিজয়। এতো দেখছি উল্টো। পরমপুরুষ তেজস্বী, বীর, শ্রীকৃষ্ণের নামে মৃত্যুসাধনা। কৃষ্ণ সারাজীবন শেখালেন জীবনের সাধনা। আমরা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে মেতে গেলাম মৃত্যুসাধনায় ৷
 
কৃষ্ণ গীতায় অর্জুনকে নানা কথা বলেছেন। তত্ত্বকথা, গৃহ্যকথা। সবশেষে বলেছেন— সবই তো শুনলে এবার – “যথেচ্ছসি তথা কুরু”। অর্থাৎ যেটা ভালো বোঝ তাই কর। আমাদের বোঝা উচিত ছিল—এই হলো যুগের উপযোগী কথাবার্তা। যুগ ও সমাজ কি চাইছে তা বিচার করা। যুক্তিবাদী হও। চারপাশটা ভালো করে দেখ। তারপর তোমার যা ভাল মনে হয় তা কর। এর চেয়ে সহজ যুক্তিগ্রাহ্য বুদ্ধিগ্রাহ্য আর কি হতে পারে।
যদি আমরা প্রকৃত কৃষ্ণভক্ত হতাম তাহলে চারপাশটা দেখে নিতাম ৷ কৃষ্ণ যেমন শত্রু-মিত্র চিনতেন, তেমনই আমরা কে শত্রু আর কে মিত্র তা জেনে নিতাম। যখন যেমন তখন তেমন প্রয়োজন বুঝে কাজ করতাম ৷ পাঁচশো বছর আগে কে কি বলে গেছে তা নিয়ে নিশ্চয় মেতে থাকতাম না। কবেকার কোন এক রাধা যে আবার চোখে কাজল পরে চিত্ত হরণে দক্ষ তাকে এখন না হলেও চলবে। হিন্দুসমাজ যদি না থাকে, তাহলে টিকিধারী মালাধারী, চৈতনধারী রসকলিধারী কোন বৈষ্ণবই থাকবে না। একা রাধা বৈষ্ণবী সেজে তখন আর বসে থাকার জায়গা পাবে না। কোন বৈষ্ণব পদকর্তাও আর লিখতে পারবেন না—“এমন পিরিতে কভু-দেখি নাই শুনি—পরাণে পরাণ বান্ধা আপনা আপনি।” দ্বিজ চণ্ডীদাসের একটি পদে আছে—‘পিরীতি নগরে বসতি করিব-পিরিতে বান্ধিব ঘর-পিরিতি দেখিয়া পড়শি করিব, তা বিনে সকলি পর।' প্রত্যেক বৈষ্ণবের এটুকু অন্ততঃ মনে রাখা উচিত যে পিরিতি নগরে বসতি স্থাপন করতে গেলে হিন্দুসমাজ দরকার। পিরীতি পালঙ্কে শোয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার । এখন ভারতের কোন পুরোপুরি সিদ্ধ বাবাজীও ভাবেন না যে পাকিস্তান বা বাংলাদেশে পিরিতি নগর গড়ে উঠবে। গান্ধারীর দেশ গান্ধারের তালিবান, অঞ্চলে - যদি রাধা যান তাহলে তার কি হাল হবে কেউ কি ভেবে দেখেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বাস্তববাদী ছিলেন। তাকে নিয়ে একালের বৈষ্ণবদের যে ন্যাকামো তা ছিল না কোথাও। আমরা যদি ভণ্ড কৃষ্ণভক্ত না হই তাহলে আমরা অন্ততঃ এটুকু শপথ নিতে পারি যে-ভাগে আমরা ভারতের যেটুকু অংশ পেয়েছি সেটুকুকেই আমরা বৃন্দাবন বানাবো। কৃষ্ণের দেশে এত আতঙ্ক-এত সন্ত্রাসবাদী কেন। এটাকে আমরা নিধুবন বানাবো। কৃষ্ণের নামে সেটুকু সৎসাহস কি আমরা দেখাতে পারি,,,,,,!
 
সর্বশেষে রাধা কোনো ব্যক্তি চরিত্র নয়, বরং একটি কাল্পনিক চরিত্রমাত্র। তাই আমাদের উচিত যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদর্শ চরিত্রকে কলঙ্কিত না করে, তাঁর প্রকৃত ভাবধারাকে নিজের মধ্যে ধারণ করা।
 
বৈদেহ্যাং চ যথা রামো রুক্মিণ্যাং চ জনার্দনঃ।
[মহাভারত উদ্যোগপর্ব-১১৭/১৭]
অর্থাৎ যেমন বিদেহনন্দিনী সীতার জন্য রাম তেমনি রুক্মিণীর জন্য ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ।
পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের মতোও আমাদের জীবন হয়ে উঠুক সৌহার্দ্য, সংকল্প এবং বীরত্বময় এই প্রার্থনা।
 
📌
রাধার পরিচয় কি /কোনটি ❓👇
https://aryapsbd.blogspot.com/2023/01/blog-post.html

কাল্পনিক রাধা চরিত্র 👇
http://back2thevedas.blogspot.com/2016/07/blog-post_13.html

রাধা কৃষ্ণের প্রেম সত্য নাকি কষ্টকল্পনা 👇
http://back2thevedas.blogspot.com/2016/07/blog-post_22.html

বেদ মন্ত্রে রাধার নাম ও তার বাস্তবিক অর্থ 👇
http://back2thevedas.blogspot.com/2016/07/blog-post_71.html

কৃষ্ণচরিত্র - https://drive.google.com/file/d/1aNMIBbXz9eAKPHm41GUg44rLg-GU-Xmm/view?usp=drivesdk

কৃষ্ণের আহ্বান - https://drive.google.com/file/d/1I3qsmN04StDSdrVZbmzSWfZqrWK896nX/view?usp=drivesdk

পুরাণের কৃষ্ণ - https://drive.google.com/file/d/17VrVgama5hMdSqQ7sTDmjVc3HZTa-TpF/view?usp=drivesdk

ভণ্ডের ভগবান - https://drive.google.com/file/d/1ZWkrYKxSpdNlA0BMnwzlqghZo-07b5x1/view?usp=drivesdk
ও৩ম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ