https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

অবতার বুদ্ধ আর গৌতম বুদ্ধ এক নয় ! পড়ুন প্রমাণসহ

Thursday, September 26, 2024

 


🔸পুরাণের অবতার বুদ্ধ বনাম ত্রিপিটকের নাস্তিক গৌতমবুদ্ধ। 

অনেক বৌদ্ধরাই দাবি করে থাকে যে তাদের নাস্তিক বৌদ্ধমতের প্রভাবককে হ্রাস করার জন্য ব্রাহ্মণরা নাকি গৌতমবুদ্ধকে পুরাণবর্ণিত হিন্দু অবতারসমূহের তালিকায় প্রবেশ করিয়েছিল। পুরাণের অবতার বুদ্ধ যে নাস্তিক গৌতমবুদ্ধ নয় সেই বিষয়টিই আজকে বিস্তারিত প্রমাণসহকারে পরিষ্কার করে দেওয়া হবে। তবে বৌদ্ধদের এই অভিযোগ যদি সত্যি হয় তবে শুধু গৌতমবুদ্ধই কেন জৈন, শিখ, চার্বাক প্রভৃতি দর্শনের প্রবর্তকদের নামও পুরাণে একইভাবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা। কেননা হিন্দুদের মহান পরমতসহিষ্ণুতার কারণেই কালের বিবর্তনে কেবল বৌদ্ধমতই নয় জৈন, অজীবিক, চার্বাক, অজ্ঞান, শিখ প্রভৃতি সনাতনধর্ম বহির্ভূত দর্শন ভারতে উদ্ভব হয়েছিল ও সারা ভারতজুড়েই বেশ প্রভাবশালী অবস্থানও গড়ে তুলতে পেরেছিল। এতগুলো প্রভাবশালী অহিন্দু দর্শনের প্রবর্তকদের বাদ দিয়ে কেবল নাস্তিক গৌতমবুদ্ধের নামই ব্রাহ্মণরা পুরাণে অন্তর্ভুক্ত করেছে এমন দাবি নিঃসন্দেহে অযৌক্তিক। 


উপরন্তু সনাতনধর্মে পুরাণের প্রামাণিকতা কতটুকু তা প্রথমে স্পষ্ট করা দরকার। প্রথমত কিছু একটা সংস্কৃততে লিখে দিলেই তা হিন্দুশাস্ত্র হয়ে যায় না। ধর্মের মূল হলো বেদ। যখন কোনো গ্রন্থ বেদসিদ্ধ হয় তখনই তা হিন্দুশাস্ত্র রূপে মান্যতা পায়। বর্তমান প্রচলিত পুরাণসমহের অধিকাংশ কথাই বেদবিরুদ্ধ ও স্ববিরোধী। যা থেকে স্পষ্ট হয় যে পুরাণ কোনো ঋষিকৃত শাস্ত্র নয় বরং একাধিক ব্যক্তি-সম্প্রদায় দ্বারা নিজ নিজ মান্যতা মন্ডনের নিমিত্তই লেখা। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা পুরাণকে মেনে থাকে তাদের অধিকাংশও এর কাহিনীগুলোকে রূপক হিসেবেই মানে। অতএব পুরাণকে আমরা Indian Mythology হিসেবেই পড়তে পারি ও এগুলো হতে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো গ্রহণ করতে পারি। অতএব পুরাণ যে সনাতনধর্মে অত্যন্ত প্রামাণিক কোনো শাস্ত্র এমনটা কখনোই না। তথাপি এই পুরাণসমূহকেই ব্যবহার করে যেই নাস্তিক বৌদ্ধগুলো সনাতনধর্মকে আঘাত করার চেষ্টা করে তাদের প্রতিহত করাই এই লেখার উদ্দেশ্য। 


এইবার পুরাণসমূহ থেকে সেই অবতার বুদ্ধের বর্ণনা আমরা পড়ে নিই,


★তৎপরে কলিযুগ সমাগত হলে দেব বিদ্বেষীদের সম্মোহনের নিমিত্ত বুদ্ধ নামে অঞ্জনা-গর্ভজাত হয়ে গয়াপ্রদেশে অবতীর্ণ হবেন। 

[ভাগবৎপুরাণ ১|২|২৪] 


★তৎপরে কলিযুগের সন্ধ্যান্তে দেব বিদ্বেষীদের সম্মোহনের নিমিত্ত বুদ্ধ নামে জিন পুত্র হয়ে গয়াপ্রদেশে অবতীর্ণ হবেন।

[গরুড়পুরাণ পূর্বখন্ড|১|৩২]


ভাগবৎপুরাণের শ্লোকে অঞ্জনা নামটি স্ত্রীবাচক ও গরুড়পুরাণের শ্লোকে জিন নামটি পুরুষবাচক হওয়ায় বোঝা যাচ্ছে যে এখানে জিন হচ্ছে অবতারবুদ্ধের পিতা, অঞ্জনা তাঁর মাতা। এবং অবতার বুদ্ধ ভারতের বিহার রাজ্যের গয়াপ্রদেশে (কীকটদেশ) জন্ম নিবেন এমনটাই বলা হচ্ছে। 


অপরদিকে বৌদ্ধশাস্ত্র অনুসারে নাস্তিক গৌতমবুদ্ধের পিতা ছিলেন শুদ্ধোদন ও মাতা ছিলেন মায়াদেবী এবং তিনি নেপালের লুম্বিনীতে(কপিলাবস্তু) জন্মেছিলেন। 


এইখানে খুবই স্পষ্ট যে অবতারবুদ্ধের সাথে নাস্তিক গৌতমবুদ্ধের বর্ণনা মিলছে না। এজন্য গৌড়ীয় বৈষ্ণবসহ বিভিন্ন হিন্দু মত-পরম্পরা নাস্তিক গৌতমবুদ্ধকে অবতারবুদ্ধরূপে মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।  


তবে এইটাও সত্য যে কিছু অপ্রধান পুরাণের বর্ণনা গৌতমবুদ্ধের সাথে মিলেও যায় (অগ্নি ১৬.৪৯.৮, বৃহন্নারদীয় শারদা তিলকতন্ত্র ১৭.১৫৮)। এর কারণ হতে পারে পুরাণের অবতার বুদ্ধ স্বতন্ত্র থাকলেও পরবর্তীকালের গৌতমবুদ্ধের সাথে নাম সম্পূর্ণ মিল থাকায় পুরাণকারদের মধ্যে এইবিষয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয় এবং অবতারবুদ্ধ ও নাস্তিক বুদ্ধ দুটোই একই ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হওয়া শুরু হয়। পুরাণসমূহ যে কোনো ঋষিকৃত গ্রন্থ নয় ও তা বিভিন্ন কালে বিভিন্ন ব্যক্তি দ্বারা রচিত হয়েছে তা প্রথমেই স্পষ্ট করা হয়েছে। 


🔹এইবার বৌদ্ধমতের সাথে পেরে না উঠে হিন্দুরা গৌতমবুদ্ধকে নিজেদের অবতার বানিয়ে ফেলেছে তাদের এই হাস্যকর দাবিটিতে আলোকপাত করা যাক। 


- প্রথমত একেই বুঝি বলে চোরের মায়ের বড় গলা! আমরা শুরুতেই দেখিয়েছি পুরাণের অবতার বুদ্ধ নাস্তিক বুদ্ধ নন। তথাপি যদি কিছুক্ষণের জন্য তা ধরেও নিই তাহলে তাদের কাছে আমার প্রশ্ন - বৌদ্ধমতের পূনর্জন্মবাদ, নির্বাণ বা মুক্তি, কর্মবাদ, কল্পবাদ, অহিংসা, অনাসক্তি, সন্ন্যাস প্রভৃতি দর্শন কি গৌতমবুদ্ধের নিজস্ব আবিষ্কার ছিল? এগুলো কি পূর্ব হতেই হিন্দু শাস্ত্রসমূহে বিদ্যমান ছিল না? এগুলোত তিনি সনাতনধর্ম থেকেই গ্রহণ করে কিছুক্ষেত্রে নিজস্ব ব্যাখ্যা যুক্ত করে প্রচার করেছেন? এরজন্যত কোনো হিন্দুর মনেই গৌতমবুদ্ধের প্রতি কোনো অবমাননা বোধ হয়নি।

অন্যদিকে হিন্দুরা নাহয় গৌতমবুদ্ধকে অবতারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে কিন্তু গৌতমবুদ্ধ স্বয়ং নিজেই যে সনাতনধর্মের দুই মহাপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাম উভয়কেই তার জাতককথায় যুক্ত করেছে এর পেছনে তার উদ্দেশ্য কী ছিল? চলুন তাহলে সেগুলোর বর্ণনা দেখে নিই। 


প্রথমে জাতক কী সেই বিষয়ে যারা জানেন না তাদের অবগতির জন্য বলে রাখি ত্রিপিটক অনুসারে গৌতমবুদ্ধ তার উক্ত জন্মে বুদ্ধত্বলাভের পূর্বে তাকে আরো বহুজন্ম অতিবাহিত করে আসতে হয়েছে। বুদ্ধের ওই সমস্ত পূর্ব জন্মগুলোকেই জাতক বলা হয়। 


ত্রিপিটকের জাতককথায় দশরথ জাতকে(৪৬১) বুদ্ধ নিজেকে পূর্বজন্মে রাম বলে উল্লেখ করছেন। ত এখানে হিন্দু অবতারবাদের স্বীকৃতিত বুদ্ধ নিজেই দিয়ে দিলেন তাই নয় কি? উপরন্তু দশরথ জাতকের কাহিনী পড়লে দেখতে পাবেন সম্পূর্ণ বাল্মীকি রামায়ণের কাহিনীকেই কপি মেরে বুদ্ধ কিছুটা এদিক-ওদিক করে চালিয়ে দিয়েছে। 

এছাড়া ঘট জাতকে(৪৫৪) বুদ্ধ চক্রধারী শ্রীকৃষ্ণের জীবনবৃত্তান্ত বর্ণনা করছেন। এখানেও মহাভারত থেকে শ্রীকৃষ্ণের জীবনি কপি মেরে কিছুটা এদিক-ওদিক করে চালিয়ে দিয়েছে বুদ্ধ। শ্যাম জাতক (৫৪০) রামায়ণের দশরথ কর্তৃক ভুলবশত অন্ধ পিতা-মাতার সন্তান বালক শ্রবণকে হত্যার সেই বিখ্যাত কাহিনীই কপি-পেস্ট। এইভাবে জাতককথায় অগণিত জাতকে রামায়ণ-মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্র, নাম, স্থান কপি করা হয়েছে। যেমন কুণাল জাতকে(৫৩৬) বুদ্ধ (তখন কুনাল নামে জন্মেছিলেন) নারীর দুঃশ্চরিত্রতার উদাহারণ দিতে গিয়ে কৃষ্ণা (যেইটা মহাভারতে দ্রৌপদীর অপর নাম) নামক এক নারীর উল্লেখ করছে যার অর্জুন, ভীম, যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব এই পঞ্চস্বামী থাকা সত্ত্বেও নাকি অপর এক কুব্জ বামন পরপুরুষের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছিল। দ্রৌপদীকে হিন্দুরা অত্যন্ত সতী নারী হিসেবে বিশ্বাস করে কিন্তু নাস্তিক বুদ্ধ তাঁর নামেই এমন জঘন্য মিথ্যা কাহিনী বানালো! 


এখানে আবার কিছু দুঃসাহসী বৌদ্ধ দাবি করতে পারে যে জাতককথা থেকে চুরি করেই হিন্দুরা রামায়ণ ও মহাভারত লিখেছে। প্রথমত রামায়ণ-মহাভারতে কোথাও গৌতমবুদ্ধ কিংবা বৌদ্ধমতের সাথে সম্পর্কিত কোনোকিছুরই কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু ত্রিপিটকের অগণিত স্থানে বিভিন্ন ব্রাহ্মণকে বেদ, বেদাঙ্গ, দর্শন, ব্যাকরণের সাথে ইতিহাস, পঞ্চমবেদের জ্ঞাতা বলে বর্ণনা করা হচ্ছে যেমন, সোণদন্ড ব্রাহ্মণ [দীর্ঘ নিকায়, সোণদন্ড সূত্র]। হিন্দুশাস্ত্রসমূহের মধ্যে ইতিহাস বলতে রামায়ণ - মহাভারতকেই নির্দেশ করা হয় ও পঞ্চমবেদ বলতে নির্দিষ্টভাবে মহাভারতকেই বলা হয়। তার মানে প্রমাণিত হয় যে রামায়ণ - মহাভারত বুদ্ধের অনেক পূর্বেই রচিত হয়েছে।


তবে কেউ কেউ প্রচলিত রামায়ণের একটি শ্লোক দেখাতে পারে যেখানে নাকি তাদের মতে গৌতমবুদ্ধের উল্লেখ আছে,

*यथा हि चोर: स‌ तथा हि बुद्धस्तथागतं नास्तिकमत्र विद्धि। तस्माद्धि य: श‌ङ्क्यतमः प्रजानाम् न नास्तिकेनाभिमुखो बुध: स्यात्।। [বাল্মীকি রামায়ণ ২|১০৯|৩৪] 

অর্থ - যেরূপ চোর সেরূপই বুদ্ধ তথাগতকে নাস্তিক বলে জানবে। যে প্রজাদের দ্বারা বিশ্বাসের অযোগ্য। জ্ঞানী ব্যক্তি কখনোই নাস্তিকের অভিমুখী হবেন না।  


১) প্রথমত রামায়ণ - মহাভারতে সময়ে সময়ে অসংখ্য শ্লোক বাইরে থেকে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে এইটি সকল গবেষকগণই স্বীকার করেন। তবে রামায়ণ-মহাভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত পুরনো পাণ্ডুলিপিগুলো একসাথে মিলিয়ে দেখলে প্রক্ষিপ্ত শ্লোকগুলো কিছুটা নির্ণয় করার সুযোগ থাকে। যেমন ধরুন রামায়ণের একটা পুরনো পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেল কেরালা থেকে, আরেকটা পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেল বাংলা থেকে। এখন বাংলার কিছু অসৎ ব্যক্তি রামায়ণের অযোধ্যা কান্ডে কিছু শ্লোক ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ফলে বাংলায় প্রক্ষিপ্ত হওয়া শ্লোকগুলো বাংলা থেকে পাওয়া ওই পাণ্ডুলিপিতেই থাকবে, কেরালার পুরনো পাণ্ডুলিপিতে তা থাকার কোনো সুযোগ নেই। এখন আমরা যদি কেরালা ও বাংলার দুই পুরনো পাণ্ডুলিপি মিলিয়ে দেখি তাহলে সহজেই বাংলায় প্রক্ষিপ্ত হওয়া শ্লোকগুলো বের করে ফেলতে পারব। ঠিক এই কাজটাই করেছে ভারতের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান Oriental Institute of Baroda । তারা রামায়ণের সবগুলো পুরনো পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে সেগুলোর মধ্যে তুলনা করে যেই শ্লোকগুলো সবগুলো পাণ্ডুলিপিতেই বিদ্যমান কেবল সেগুলোকেই রেখে বাকিগুলো বাদ দিয়ে রামায়ণের তুলনামূলক বিশুদ্ধ সংস্করণ বা Critical Edition প্রকাশিত করেছে। রামায়ণের সেই Critical Edition এ এই শ্লোকটি কিন্তু বিদ্যমান নেই। ১০৯ নং সর্গে থাকা প্রচলিত ৩০,৩২-৩৫,৩৭-৩৯ নং শ্লোক Critical Edition এ নেই মূলত গীতাপ্রেস হতে প্রকাশিত রামায়ণ থেকেই অপপ্রচারকারীরা এই শ্লোকটি দেখিয়ে থাকে। গীতাপ্রেসের ব্যবহৃত পাণ্ডুলিপিতে এই শ্লোকটি হয়ত আছে কিন্তু এর বাইরে অন্যান্য প্রায় সকল পাণ্ডুলিপিতে তথা পুরনো পাণ্ডুলিপিগুলোতে এই শ্লোক অনুপস্থিত। তাই এই বৌদ্ধদের যদি মেরুদণ্ড নামক কিছু না থাকে তাহলেই পরবর্তীতে এই অত্যন্ত দুর্বল একটা প্রমাণ দিয়ে রামায়ণে বুদ্ধ দেখাতে আসবে। 


২) তাদের ত্রিপিটকে রামায়ণ - মহাভারতের অগণিত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও এইসব বেকারদের নির্লজ্জের মতো রামায়ণের ওই একটা প্রক্ষিপ্ত শ্লোক দেখিয়ে সারাদিন অপপ্রচার করার অফুরন্ত সময় থাকে কিন্তু পাঁচ মিনিট খরচ করে ৩০৮ ও ৩০৯ নং সর্গের সম্পূর্ণ সংলাপটি পড়ার সময় বা সৎসাহস কোনোটিই তাদের নেই। শ্রীরাম মূলত আলোচ্য উক্তিটি করছেন জাবালিকে উদ্দেশ্য করে। এখন জাবালি কে ছিলেন? মূলত ভরত যখন রামকে convince করতে গিয়েছিলেন তখন তিনি কিন্তু একা ছিলেন না, তাঁর সাথে সাধারণ প্রজা থেকে শুরু করে অনেকেই গিয়েছিল রামকে ফিরিয়ে আনার আশায়। অতঃপর ভরত যখন রামের কাছে যুক্তিতে পরাস্ত হলেন তখন সেই তাদের মধ্যেই জাবালি নামক এক ব্রাহ্মণোত্তম রামকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন(সর্গ ৩০৮) ও রাম তাঁকেও একইভাবে যুক্তিতে পরাস্ত করেছিলেন(সর্গ ৩০৯)। 


৩০৯ নং সর্গটি সম্পূর্ণ পড়লে দেখতে পায় যে একদম ১-৩২ নং শ্লোকের যেই শৈলী আর তার পরবর্তী প্রক্ষিপ্ত শ্লোকগুলোর যেই শৈলী তার মধ্যে আকাশ - পাতাল তফাৎ। প্রথম শ্লোক থেকে যদি পড়েন তাহলে দেখবেন শ্রীরাম কতটা বিনয়ের সাথে মিষ্টভাষী হয়ে জাবালিকে উত্তর দিচ্ছেন। প্রথম শ্লোকেই কিন্তু বলা হচ্ছে, “রাম অবিচলিত থেকে সমীচীন ভাষায় বললেন।” সেই রামের ভাষা কিনা একদম শেষের দিকে গিয়ে পুরো ১৮০ ডিগ্রী উল্টে গেল? এই প্রক্ষিপ্ত শ্লোকগুলোর একদম আগের শ্লোকটিতেই রাম জীবের প্রতি অনুকম্পা ও প্রিয়বচনকে স্বর্গে যাওয়ার পথ বলছেন(৩১) সেই রাম ঠিক পরের শ্লোকেই এতটা কঠোর বচন বলবেন? উপরন্তু ৩৩ নং প্রক্ষিপ্ত শ্লোকে রাম সরাসরি তাঁর নিজ পিতা দশরথের কাজকেই নিন্দা করছেন জাবালিকে যজ্ঞকর্মে রাখার জন্য। কী হাস্যকর! যেই রাম তাঁর পিতৃভক্তির জন্য জগদ্বিখ্যাত। কেবল পিতার অন্যকে দেওয়া কথা যেন মিথ্যা না হয়ে যায় সেজন্য একবারও না ভেবে চক্রবর্তী সম্রাটের পদ ছেড়ে দিয়ে চৌদ্দবছরের জন্য বনবাসে যেতে রাজি হয়ে গেলেন সেই রাম কিনা সকলের সামনে পিতৃনিন্দা করেছেন!


৩০৮ নং সর্গের প্রথম শ্লোকেই জাবালিকে ব্রাহ্মণোত্তম বলা হচ্ছে ও তিনি সত্যিই যে ব্রাহ্মণোত্তম তা তাঁর শুরু থেকে বলা উক্তিগুলো(শ্লোক ৩-১২) পড়লেই অনুধাবন করা যায়। এইগুলোত আমাদের হিন্দুশাস্ত্রেরই common কথাবার্তা, খুবই আস্তিকতাপূর্ণ ও জগৎসংসারের নশ্বরতাকেই প্রতিপাদন করছে। এইগুলো কোনো বস্তুবাদী নাস্তিকের বিশ্বাস হয় কীভাবে? উপরন্তু তাঁর ৫,৬,৯ নং শ্লোক পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায় তিনি পরলোকে অবিশ্বাসী নন কিন্তু ১৭ নং শ্লোকে তিনি পরলোক অস্বীকার করলেন। আর ১৪,১৫,১৬ নং প্রক্ষিপ্ত শ্লোকে শ্রাদ্ধের কথাগুলোও কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক। 


তাছাড়া ৩০৯ নং সর্গে ১-৩২ এ যদি দেখেন শ্রীরাম কিন্তু জাবালির কোনো মতকেই খন্ডন করেননি, ২৩ নং শ্লোকে জাবালির বাক্যগুলোকে যুক্তিপূর্ণও বলছেন। শ্রীরাম উত্তরে simply এইটাই বলেছেন যে ব্রাহ্মণোত্তম জাবালি ধর্মের শুধু একটা দিক নিয়েই বললেন। কিন্তু সত্যওত বড় ধর্ম। শ্রীরাম যেখানে একবার পিতাকে কথা দিয়ে এসেছেন সেই কথার বিরুদ্ধে যদি তিনি মিথ্যাচরণ করেন তাহলে এর থেকে বড় অধর্ম আর কী হতে পারে? রাম যদি নিজেই এরূপ স্বেচ্ছাচারিতা করেন তাহলে প্রজারাওত তা করতে উৎসাহিত হবে। মূলত প্রক্ষিপ্তকারীরা ভেবেছিল যে বাইরে থেকে কিছু শ্লোক ঢুকিয়ে যদি এখানে জাবালিকে নাস্তিক চার্বাক সাজানো যায় তাহলে বেশ মশলাদার একটা কাহিনী হবে যেমনটা বর্তমানের টিভি সিরিয়ালগুলোতে করা হয়। পরবর্তীতে আরো বিভিন্নভাবে এই সংলাপে আরো কিছু শ্লোক প্রক্ষিপ্ত হয়ে আজকের এই রূপে এসেছে। 

আর জাবালি যদি নাস্তিক-বৌদ্ধই হউন তাহলে ৩০৭ নং সর্গের প্রথম শ্লোকে জাবালিকে ব্রাহ্মণোত্তম বলা হয়েছে কেন? অবশ্য এই প্রশ্নটা যে প্রক্ষিপ্তকারীদেরকে ভাবাইনি এমনটা নয়। তাই ১০৯তম সর্গের ৩৮ ও ৩৯ নং শ্লোকে তারা এর পেছনে খুবই হাস্যকর কিছু কারণ দেখিয়েছে তা আপনারা নিজেরাই পড়লে বুঝতে পারবেন। উপরন্তু প্রক্ষিপ্ত শ্লোকগুলোতে জাবালির কথা শুনে একবারও মনে হচ্ছে না যে তিনি বৌদ্ধমত অনুসারে কথাগুলো বলছেন বরং এইগুলো বস্তুবাদী চার্বাক মতের কথা। তাহলে অপ্রাসঙ্গিকভাবে শ্রীরাম তথাগত বুদ্ধের নিন্দা করতে যাবেন কেন চার্বাকের নাম একবারও উল্লেখ না করে? 

তবে ৩০৮ নং সর্গের ১ম শ্লোকে বলা হচ্ছে, “ধর্মজ্ঞ রামকে ব্রাহ্মণোত্তম জাবালি ধর্মের বিপরীত বচনে বললেন। “ এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে জাবালির কথাগুলো ধর্মের বিপরীত এমনটা বলা হলো কেন? প্রথমত আমি শুরুতেই বলেছি জাবালির বলা ৩-১২ এর বিশুদ্ধ শ্লোকগুলোকে কেউই হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধ প্রমাণ করতে পারবে না, বরং এগুলোর হিন্দু ধর্মগ্রন্থেরই কথা। তাই এখানে ধর্মের বিপরীত বলতে বোঝা উচিত যে ওই পরিস্থিতিতে রামের যা ধর্ম ছিল ব্রাহ্মণ জাবালি রামকে ফিরিয়ে আনার জন্য তার বিপরীতকে শাস্ত্রবচন দ্বারা সিদ্ধ করার চেষ্টা করছিলেন।


© মনুর্ভব - Manurbhava 


[ছবি- মধ্যযুগীয় একটি পৌরাণিক অবতার বুদ্ধের মূর্তি]