নিম্নের আলোচনায় প্রশ্নকর্তা হলেন “কমল” আর উত্তরদাতা হলেন “বিমল”।
কমল- বিমলদা ! তুমি প্রায়ই বলে থাকো—“নিত্য ঈশ্বর প্রার্থনা করবে” আমি জিজ্ঞাসা করি, আচ্ছা বলতো, ঈশ্বর কোথায় আছেন যে, তাঁর কাছে প্রার্থনা করব?
বিমল- কেন? ঈশ্বর তো সব জায়গায় আছেন। এমন কোনও স্থান নেই যেখানে তিনি নেই।
কমল- এ এক ভাল কথা শুনালে দাদা। আচ্ছা বলতো, ঈশ্বর যদি সর্বত্রই আছেন আর থাকেন, তাহলে আর সব জিনিষগুলো থাকবে কোথায়? ঈশ্বর তো সমস্ত স্থান জুড়েই নেবেন। যদি ঈশ্বর ছাড়া কোন স্থান খালি না থাকে, তাহলে অন্য জিনিষগুলো কি বিনা স্থানে থাকবে?
বিমল- না রে ভাই, ঈশ্বর ছাড়া কোন স্থান খালি নেই একথা বলার উদ্দেশ্য হল এই যে, সর্বত্র তাঁর অস্তিত্ব আছে। এই সাধারণ কথাটা বলতে হলে ঐ ভাবেই বলতে হয়—ঈশ্বর ছাড়া কোন স্থান খালি নেই,বুঝলে? শোনো, ঈশ্বরের অস্তিত্ব কোনও স্থানকে অধিকার করে থাকে না, প্রকৃতিই (Material) স্থান অধিকার করে থাকে। পৃথিবী,অগ্নি,জল,বায়ু তথা তাদের পরমাণু,এরাই স্থান অধিকার করে থাকে। ঈশ্বর, ঐ সমস্ত পদার্থে ব্যাপক। তাই বলা হয়,- ঈশ্বর সর্বত্র আছেন।
কমল- বেশ, ভাল কথা। কিন্তু ঈশ্বর যদি সর্বত্র বিদ্যমান, তাহলে তাঁকে দেখা যায় না কেন? যখন তাঁকে দেখা যায় না, সে অবস্থায় সব স্থানে তাঁর থাকার প্রমাণ কী?
বিমল- তুমি কি বলতে চাও যে, যে বস্তু চোখে দেখা যায় না, সে বস্তুটাও থাকে না? জগতে এমন বহু পদার্থ আছে যার অস্তিত্ব আছে। অথচ তাঁকে দেখা যায় না। যেমন নাকি—শীত-গ্রীষ্ম,সুখ-দুঃখ,সময়,দিক্,ক্ষুধা,পিপাসা,সুড়সুড়ি,ব্যথা ইত্যাদি। কোন বস্তুর দৃশ্যমান হওয়ার বহু কারণ থাকতে পারে এবং থাকেও। জগতে থেকেও যা দূরে আছে কিন্তু দেখা যায় না। যথা-ইউরোপ,আমেরিকা; বহু দূরে উড্ডীয়মান ঘুড়ী বা পাখি। আবার এমন জিনিসও আছে যা অত্যন্ত নিকট থেকেও দেখা যায় না,যেমন নাকি,-চোখ,চোখের কাজল। এমন বহু জিনিস আছে, যা অত্যন্ত সূক্ষ,কিন্তু দৃশ্যমান নয়। যথা-পরমাণু;ঠিক অনেক প্রকার কীটাণু যাদের অনুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না, যথা শেওলা ঢাকা পুকুরের জল। দর্পনে ময়লার আবরণ থাকায় প্রতিচ্ছবি দেখা যায় না। প্রাচীর থাকার কারণে প্রাচীরের অপর পারের মানুষকে দেখা যায় না। যথা-দুগ্ধে জল। কেননা,এরা উভয়ই তরল পদার্থ। এমন বহু জিনিস আছে যা চোখের দোষে দৃষ্টিগোচর হয় না,যথা-পীত রোগে শ্বেত বর্ণ। তাই, যারা বলে যে, দেখা যায় না অর্থাৎ দৃশ্যমান নয়, তার অস্তিত্ব নেই,এ কথা বলা মহা ভুল।
কমল- দাদা ! সত্যি বলতে কি, না দেখলে আমার তো বিশ্বাসই হয় না।
বিমল- এটা তোমার হঠকারিতা ছাড়া কিছুই নয়। আমি পূর্বেই বলেছি যে,এমন বহু জিনিস আছে যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তা’ আছে, সে কথা তোমার বিশ্বাস করতেই হবে। আচ্ছা বলতো, আমি যা বলছি, তুমি তা’ শুনছ নাকি শুনছ না?
কমল- হ্যাঁ শুনছি বৈকি।
বিমল- কী দিয়ে শুনছ?
কমল- কান দিয়ে শুনছি।
বিমল- যে শব্দটা উচ্চারিত হচ্ছে, তা’ আছে, নাকি নেই?
কমল- কেন থাকবে না?- আছে।
বিমল- তাহলে বলতো, সেই উচ্চারিত শব্দটাকে দেখতে পাচ্ছ না কেন? আরও বলি শোনো। আমার হাতে এই যে ফুলটা দেখছো, বলতো এটা কি ফুল?
কমল- এটা গোলাপ ফুল।
বিমল- এতে সুগন্ধ আছে,- নাকি নেই?
কমল- হ্যাঁ, এতে সুগন্ধ আছে।
বিমল- কিভাবে জানলে যে, এতে সুগন্ধ আছে?
কমল- কেন,-নাক দিয়ে শুঁকে জানলাম।
বিমল- আর এক কথা। আচ্ছা বলতো, রাত্রে তুমি যে দুধটুকু খেয়েছিলে তাতে চিনি ছিল,-নাকি ছিলনা?
কমল- ছিল।
বিমল- তা’ তুমি জানলে কি করে?
কমল- জিভ দিয়ে।
বিমল- এবার আর এক কথা জিজ্ঞাসা করি। বলতো, শব্দ-জ্ঞান কান দিয়ে হয়, সুগন্ধের জ্ঞান নাক দিয়ে, আর চিনির জ্ঞান জিভ দিয়ে কেন হল? চোখ দিয়ে শব্দের, কান দিয়ে সুগন্ধের, আর নাক দিয়ে মিষ্টতার জ্ঞান হল না কেন? গন্ধ আর মিষ্টতা থাকা সত্ত্বেও চোখ কেন তা দেখতে পেল না?
কমল- যে ইন্দ্রিয়ের যা বিষয়, সে সেই বিষয়ের জ্ঞানই লাভ করেছে। কিন্তু ঈশ্বরকে যখন কোন ইন্দ্রিয় দিয়ে জানা যায় না, এমতাবস্থায় তাঁকে কি দিয়ে জানা যাবে যে, এ তিনি।
বিমল- তোমার পক্ষ ছিল যে, যেহেতু ঈশ্বর দৃশ্যমান নহেন, অতএব তিনি নেই। দেখতে না দেখতে তুমি তোমার কথা বদলে দিচ্ছ দেখি। যাই হোক, একথা তো তুমি স্বীকার করে নিলে যে, যে জিনিস চোখ দিয়ে দেখা যায় না, সে জিনিসেরও অস্তিত্ব থাকে। একথা পৃথক যে,তা জ্ঞান চক্ষু ব্যতীত অপর ইন্দ্রিয় দ্বারাও জানা সম্ভব। এবার তুমি একথা স্বীকার করছ যে, ঈশ্বরকে কোন ইন্দ্রিয় দ্বারা যখন জানা যায় না, এ অবস্থায় তুমি কেমন করে স্বীকার করবে-এই তিনি? এবার বলো-ইন্দ্রিয় দ্বারা জানা যায় না বলে, তুমি যখন ঈশ্বরকে স্বীকার করছ না, তখন এ অবস্থায় তুমি ইন্দ্রিয়গুলোকেই বা কেমন করে জানলে? যদি বলো, কেন, ইন্দ্রিয় সমূহকে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জানতে পারা যায়, তাহলে তো আত্মাশ্রয় দোষ হয়ে যাবে। কেননা, যে কোনও দ্রষ্টা, সে নিজে দৃশ্যমান হতে পারে না। ইন্দ্রিয় সমূহের বিষয় যে ভিন্ন ভিন্ন । চোখের—রূপ, কানের—শব্দ, নাসিকার—গন্ধ, জিহ্বার—রস এবং ত্বকের—স্পর্শ, এগুলো ইন্দ্রিয় সমূহের আপন আপন বিষয়। নাক,চোখকে জানতে পারে না, জিহ্বা, কানকে জানতে পারে না।
কমল- বেশ তো বললে! কেন জানতে পারবে না? যখন আমি আয়না হাতে নিই,তখন তাতে চোখ,মুখ,কান,জিভ এই সমস্ত ইন্দ্রিয় তো দেখা যায়। চোখ এমন একটি ইন্দ্রিয়, যে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের জ্ঞান করিয়ে দেয়।
বিমল- ভাইটি! এ তোমার ভুল ধারণা। তুমি চোখ দিয়ে যা কিছু দেখো, সে তো রূপ। অন্য ইন্দ্রিয় বা তাদের বিষয়কে তো দেখতে পাও না, আয়নায় ইন্দ্রিয় দেখা যায় কে বলল? যা দেখো সে তো ইন্দ্রিয়ের গোলক অর্থাৎ রূপবান স্থানকে দেখতে পাও। ইন্দ্রিয় সমূহ তো সেই সব স্থানে শক্তিরূপে বিদ্যমান থাকে। চোখের পক্ষে সমগ্র ইন্দ্রিয়ের জ্ঞান করানো তো দূরে থাক, চোখ তো নিজেই নিজেকে দেখতে পায় না। আর যদি তোমার এই ধারণা জন্মে থাকে যে, আয়নায় চোখ দেখা যায়, তাহলে আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। আচ্ছা বলতো, আমার হাতে কি আছে?
কমল- আয়না।
বিমল- আয়না। ভাল কথা, একে কী দিয়ে দেখলে?
কমল- চোখ দিয়ে।
বিমল- বেশ। চোখ দিয়ে আয়না দেখছ, কেমন? তাহলে তো আয়নায় চোখ দেখার পূর্বে তোমার চোখের জ্ঞান ছিল। এর অর্থ এই হ’ল যে, যদি চোখ না থাকতো তাহলে আয়নাতে দেখতে পেতে না। এবার বলো তো দেখি, চোখ দ্বারা আয়নায় জ্ঞান হয়; নাকি আয়না দ্বারা চোখের জ্ঞান হয়ে থাকে? যদি বলো, আয়না দ্বারা চোখের জ্ঞান হয়, তাহলে চোখ কানা হয়ে গেলে আয়না অবশ্যই নষ্ট চক্ষুর জ্ঞান করিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু চোখ নষ্ট হয়ে গেলে, আয়না সে চোখের জ্ঞান করাবে কেমন করে? সে তো নিজেই তার জ্ঞান লাভ করতে পারে না। আর যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা কর, তাহলে দেখবে যে, চোখ যা দেখে তা সাধনের সহায়তায় দেখে, স্বতন্ত্রভাবে দেখে না। কিন্তু একথা ঠিক যে, চোখ ব্যতীত রূপের জ্ঞান হতে পারে না,কেননা—রূপের জ্ঞানও চোখ নিজে নিজে করতে পারে না।
কমল- জিজ্ঞাসা করছ, চক্ষুর কোন কোন সাধনের প্রয়োজন হয়? কেননা, চোখ তো স্বাধীনভাবেই দেখে থাকে। চোখের বিষয়ই তো দর্শন করা। আচ্ছা, বিমলদা—চোখ সাধন ব্যতীত স্বতন্ত্ররূপে দেখতে পারে না কেন?
বিমল- তা,শোনো। আমি এ সময় সব কিছু দেখছি কিন্তু ঘন অন্ধকারে চার দিক ছেয়ে যায়, তাহলে আমি এই সমস্ত বিষয় দেখতে পাব নাকি পাবো না?
কমল- না। দেখতে পাবে না।
বিমল- তা’হলে জানা গেল যে, কোনও বস্তুকে দেখতে হলে কেবল চোখেরই প্রয়োজন হয় না, আলোরও প্রয়োজন হয়। আলো যদি না থাকে, তাহলে চোখ থাকতেও অন্ধ। শুধু তাই নয়, আলোও আছে, তাতেও দেখতে পাই না। কেননা, দ্রষ্টব্য বস্তুর এক নিশ্চিত স্থানে থাকাও প্রয়োজন। দেখো, এ একটা বই। যদি আমি এক মাইল দূর হতে বই-এর অক্ষর দেখতে চাই, তাহলেও আমি বইয়ের অক্ষর দেখতে পাবো না। আর যদি চোখের উপরেই বইয়ের পাতা লাগিয়ে রাখি, তাহলেও বইয়ের অক্ষর দেখতে পাবো না। অক্ষর দেখবার জন্য নিশ্চিত দূরত্বে বই থাকা চাই, তবে তা দেখতে বা পড়তে পারা যাবে। আবার দেখো—চোখ, আলো এবং নিশ্চিত দূরত্বে বই থাকা সত্ত্বেও তা দেখা যায় না, চোখের সঙ্গে মনের সম্বন্ধ থাকা চাই। মন যদি অন্য কোন বিষয়ে যুক্ত থাকে, সে অবস্থায় চোখের সামনে দিয়ে কোনও কিছু চলে গেলেও চোখ তা দেখতে পায় না। প্রায়ই এমনও দেখা যায় যে, চোখের সামনে দিয়ে কোন কিছু চলে গেল, তারপর যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে- তুমি কি এখন কিছু যেতে দেখেছ? উত্তর পাবে-“কৈ, তা তো দেখি নি।“ এবার তুমি নিশ্চয়ই বুঝেছই যে, দেখতে হলে কতটা সাধনের প্রয়োজন হয়।
কমল- তুমি যে এত কথা শোনালে এর অর্থ কি? কেন এত কথার অবতারণা করলে বলতো?
বিমল- এতেও বুঝলে না? এর মানে হল, ঈশ্বরকে যেমন কোনও ইন্দ্রিয় দ্বারা জানা যায় না, তেমনি ইন্দ্রিয়কেও ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জানা যায় না। ইন্দ্রিয়কে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জানা না গেলেও, তোমায় স্বীকার করতে হবে যে, ইন্দ্রিয় আছে। যদি তাই হয়, তাহলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে তোমার সন্দেহ কিসের বলো?
কমল- ইন্দ্রিয় সমূহকে কিভাবে জানা যেতে পারে?
বিমল- জীবাত্মার অনুভূতি দ্বারা ইন্দ্রিয় সমূহকে জানতে পারা যায়। কেননা, যখন জীব—রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ ও স্পর্শ জ্ঞান লাভ করতে থাকে, তখন সে জানতে পারে যে, তার কাছে এর সাধন আছে। যাকে দিয়ে সে কাজ করিয়ে নিচ্ছে সেই সমস্ত বিষয় জানার সাধনই তো ইন্দ্রিয়।
কমল- তাহলে ঈশ্বরকে কেমন করে জানা যায়?
বিমল- ঈশ্বরকে অনুভূতি দ্বারা জানা যায়।
কমল- অনুভূতি হবে কোথায়?
বিমল- ঈশ্বরের অনুভূতি হয় আত্মায়।
কমল- এ অনুভূতি হয় কখন?
বিমল- যখন মনের ত্রিদোষ ঘুচে যায় তখন ঈশ্বরের অনুভূতি হয়।
কমল- ত্রিদোষ আবার কি?
বিমল- মল, বিক্ষেপ এবং আবরণ এই তিনটি দোষকে ত্রিদোষ বলে।
কমল- মল, বিক্ষেপ এবং আবরণ কাকে বলে? এদের পরিভাষাই বা কী?
বিমল- মনের মধ্যে অপরের অনিষ্ট চিন্তা করা তথা আত্মায় পাপের সংস্কার পড়াকে “মল” বলে। সদাসর্বদা বিষয় চিন্তন অথবা মনকে সদা চঞ্চল রাখাকে “বিক্ষেপ বলে। জগতের যাবতীয় নাশবান পদার্থের অভিমান মনের উপর পর্দার মত পড়ে থাকাকে “আবরণ” বলে।
কমল- এই তিন প্রকার দোষকে কী উপায়ে নাশ করা যায়?
বিমল- ত্রিদোষ দূর করার তিনটি সাধন।
কমল- কী?
বিমল- জ্ঞান, কর্ম ও উপাসনা।
কমল- জ্ঞান, কর্ম ও উপাসনার মানে কি?
বিমল- যে পদার্থ যেরূপ তাকে সেই রূপ মনে করা অর্থাৎ জড় বস্তুকে জড়, চেতনকে চেতন, নিত্যকে নিত্য এবং অনিত্যকে অনিত্য জানা “জ্ঞান”। শরীর, সমাজ তথা আত্মার উন্নতি করা, অভিপ্রেত পদার্থ সমূহ লাভ করার জন্য পুরুষার্থ করাকে “কর্ম” বলে। পদার্থের সমীপে গিয়ে, তার গুণ নিজের মধ্যে ধারণ করা এবং আপন দোষ সংশোধন করার নাম “উপাসনা”। কল্পনা কর, একজন শীতে কাতর বা শীতার্ত। সে যদি শীত হতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য জলের কাছে যায়, তাহলে তাকে অজ্ঞানী বলা হয় কিনা? এটা তার অজ্ঞানতা যে, শীত নিবারণ করার জন্য সে জলের সমীপস্থ হচ্ছে। একে জ্ঞান বলে না। শীত তখনই দূর হতে পারে। যদি তার মধ্যে প্রথম থেকেই অগ্নির বিষয়ে জ্ঞান থাকে। তারপর তাকে অগ্নির সমীপস্থ হয়ে শীত রূপী দোষকে অগ্নির যে উষ্ণতা গুণ তা দিয়ে দূর করতে হবে। অর্থাৎ জ্ঞান দ্বারা মল; কর্ম দ্বারা বিক্ষেপ এবং উপাসনা দ্বারা আবরণ দূর হলে তার পর পরমাত্মার অনুভূতি হবে।
কমল- এ বিষয়টিকে আরও একটু পরিষ্কার করে বলনা দাদা! জ্ঞান দ্বারা মল, কর্ম দ্বারা বিক্ষেপ এবং উপাসনা দ্বারা আবরণ দোষ কেমন করে দূর হয়?
বিমল- জ্ঞানের দ্বারা জানতে হবে যে, জগতের সমস্ত প্রাণী এবং সমস্ত পদার্থ নাশবান, এই জন্য অপরের অধিকার ছিনিয়ে নেবার ভাবনা না রাখলেই “মল” দোষ দূর হবে। যখন মানুষ সাংসারিক পদার্থ সমূহকে জীবনের উদ্দেশ্য মনে করে উপভোগ আরম্ভ করে, তখন তার চিত্ত চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়, সেই চাঞ্চল্যকে “বিক্ষেপ” বলে। বাস্তবিক পক্ষে সাংসারিক পদার্থ সমূহ যে সাধন মাত্র, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু সাংসারিক পদার্থ সমূহ লাভ করা জীবনের সাধ্য নয় অর্থাৎ জীবনের উদ্দেশ্য নয়। এই সত্যকে জেনে যে কর্ম করা যায়, সেই কর্ম মানুষকে জলে পদ্ম পত্রের ন্যায় সাংসারিক মমতায় লিপ্ত হতে দেয় না। নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠান দ্বারা বিক্ষেপ দূর হয়। মানুষের মনের উপর অহংকার বা অভিমানের আবরণ পড়লে, সে পরমেশ্বর প্রদত্ত বস্তু সমূহকে আপন মনে করতে থাকে। “আমার ধন, আমার স্ত্রী, আমার জন, আমার রাজ্য, আমার শাসন ইত্যাদি ইত্যাদি।“ অভিমানে বশীভূত হয়ে সে অপরকে পীড়ন করা আরম্ভ করে। সে মনে করতে থাকে, তার মত বড় এ সংসারে আর কেউ নেই। কিন্তু যখন সে জ্ঞানপূর্বক কর্ম করে, মন এবং ইন্দ্রিয় সমূহকে বাহ্য বিষয় সমূহ হতে দূরে সরিয়ে শক্তিকে হৃদয়ে একাগ্র করে এবং মনে করে যে, পরমাত্মা তার সমীপে বর্তমান এবং সে পরমাত্মার সমীপে; এই রূপ উপাসনা দ্বারা অহংকার অর্থাৎ আবরণ দোষ দূর হয়ে যায়। এইভাবে, ত্রিদোষ দূরীকরণ সাধনা দ্বারা ত্রিদোষ নাশ করার নিরন্তর অভ্যাসই পরমাত্মার অনুভূতি করিয়ে দেয়।
কমল- বিমলদা! তোমার বিষয়বস্তুকে বিশদভাবে বুঝিয়ে বলার দক্ষতা অতি চমৎকার, তুমি তর্কে বড়ই চতুর। যাই হোক; আমার জিজ্ঞাসা এই যে, ঈশ্বরকে দিয়ে জগতের কোন প্রয়োজনটা সিদ্ধ হবে?
বিমল- ঈশ্বরকে দিয়ে জগতের কোন প্রয়োজনটা সিদ্ধ হবে এই তো প্রশ্ন? দেখো, যদি ঈশ্বর না থাকেন, তাহলে জগৎ সৃষ্টি হবেন কেমন করে? এই পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র সমূহ, নদ-নদী, হৃদ, ঝরণা, সরোবর, পাহাড়, পর্বত, বন-উপবন, লতা, পাখী, জলচর, স্থলচর, নভচর, অশুজ, উদ্ভিদ, জরায়ুজ প্রভৃতি অনেক প্রকার জীব, তথা অন্যান্য যাবতীয় পদার্থ, কে সৃষ্টি করবে বল? ঈশ্বর ছাড়া কে এই সব সৃষ্টি করতে সক্ষম?
কমল- এই সব সৃষ্টি করতে আবার ঈশ্বরের প্রয়োজন হয় নাকি? এ সমস্ত সৃষ্টি তো নিজে নিজেই হয়েছে, আর চিরকাল হতেই থাকবে।
বিমল- জগতের কোনও পদার্থ স্রষ্টা ব্যতীত সৃষ্টি হয় না। এ সমস্ত যদি নিজেই সৃষ্টি হ’ত, তাহলে পাচক ব্যতীত অন্নাদি, কুম্ভকার ব্যতীত ঘট, স্বর্ণকার ব্যতীত অলংকার, ময়রা ব্যতীত মিষ্টি, দর্জি ব্যতীত জামা-কাপড়, আপনি আপনিই হ’ত। আর এক কথা, সৃষ্ট বস্তু চিরকাল থাকে না। প্রত্যেক বস্তু উৎপন্ন হয়, বৃদ্ধি রুদ্ধ হয়, পরিবর্তন হয়, হ্রাস পায় এবং পরিশেষে তার বিনাশ হয়। প্রত্যেক সৃষ্ট বস্তুতে এই ছয় প্রকার বিকার দেখা যায়। বিশাল হতে বিশালতর পর্বত, অতিকায় হতে মহাতিকায় গাছ, বৃহৎ হতে বৃহত্তর পশু তথা জগতের মহান হতে সুমহান এবং ক্ষুদ্র অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর প্রত্যেকটি বস্তু সৃষ্ট, এবং পরিশেষে বিনষ্ট হয়।
কমল- কিন্তু দাদা ! পরমেশ্বর কোথাও কোনও বস্তু সৃষ্টি করেছেন তা তো কোথাও দেখা যায় না, এরূপ ক্রম তো চিরকালের। পৃথিবী, জল, বায়ু আর এদের পরমাণু জগতে আছে, আর ঐ সমস্ত এক সাথে সংযুক্ত হয়ে পদার্থ সমূহের সৃষ্টি হচ্ছে আর পরস্পর পৃথক হয়ে বিনষ্টও হচ্ছে। এতে ঈশ্বরের সৃষ্টি করার কি আছে?
বিমল- এ ধারণা তোমার ভুল। পৃথিবী প্রভৃতি তত্ত্ব আর তাদের পরমাণু চেতন নয়, তারা তো জড়। তাদের যদি পরস্পর কেউ মিলন না ঘটায়, তারা পরস্পর যুক্ত হবে কেমন করে? এই ভাবে তাদের যদি কেহ পৃথক না করে, তারা নিজেরা পৃথকও হতে পারবে না। সংযোগ এবং বিয়োগ এ দুটি বিপরীত গুণ। কোন জড় অর্থাৎ প্রাণহীন পদার্থে এই বিপরীত গুণ থাকা সম্ভব নয়। যদি কোন পদার্থে তাদের সম্মিলিত হওয়ার স্বাভাবিক গুণ থাকে, তো তারা কদাপি বিযুক্ত হতে পারবে না। তারা কেবল যুক্ত হয়েই থাকবে। যদি কারও মধ্যে সংযুক্ত হওয়ার স্বাভাবিক গুণ থাকে, তো, সে সংযুক্ত হয়েই থাকবে। আর যদি পৃথক থাকার স্বাভাবিক গুণ থাকে, সে কোনও দিন সংযুক্ত হবেই না। যদি বলো যে, প্রাকৃতিক তত্ত্বের কিছুটার মধ্যে সংযুক্ত এবং কিছুটার মধ্যে বিযুক্ত হওয়ার ক্ষমতা থাকবে, সে অবস্থায় তারা জগৎকে কখনো নষ্ট হতে দেবে না এবং যদি বিনষ্ট মূলক তত্ত্বের ক্ষমতা থাকে, তাহলে তারা জগৎকে কখনও গঠন হতে দেবে না। আর যদি বারংবার থাকার স্বভাব থাকে, তাহলে যেখানে দুই তত্ত্ব সংযুক্ত হবে সেখানে তারা পরস্পর বিচ্ছিন্নও হবে। এরূপ অবস্থায় কোনও বস্তুর নির্মাণ হবে না। কিন্তু জগতে প্রত্যেক বস্তু নির্মিত হয়, স্থির থাকে এবং ধ্বংস হয়, এই তো আমরা দেখি। প্রকৃতি তত্ত্বে তুমি যতো ইচ্ছে গুণের কল্পনা করোনা কেন, সে নিয়মানুসারে উৎপন্ন হবে, স্থির থাকবে এবং বিনষ্ট হবে। এই যে উৎপত্তি, স্থিতি এবং বিনাশ এ ক্রিয়া ঈশ্বর ছাড়া হতে পারে না। জড় এবং চেতনে পার্থক্য কি জানো? প্রথমতঃ—জড় বস্তু, সে স্বভাবতঃ ক্রিয়াহীন; দ্বিতীয়তঃ- যদি সে চেতনের সাহায্যে কিছু কর্ম করেও, সে একই প্রকারের কর্ম করতে থাকবে। চেতন অর্থাৎ জ্ঞানবান সত্ত্বায় কর্ম করা, না করা এবং বিপরীত করার শক্তি আছে। এ গুণ চেতন সত্ত্বায় স্বাভাবিকভাবে বিদ্যমান।
কমল- কোনও বস্তুর নির্মাতাকে তো প্রত্যক্ষ্যভাবে দেখা যায়। যথা, অলংকার নির্মাতা স্বর্ণকারকে, মিষ্টি নির্মাতা ময়রাকে, ঘটনির্মাতা কুম্ভকারকে, নীড় নির্মাণকারী পাখীকে আমরা তো দেখতে পাই। ঈশ্বর যদি জগৎ নির্মাতা হন, তাকে দেখা যায় না কেন?
বিমল- বিশ্বাস করো, নির্মাতা অর্থাৎ কর্তাকে কখনও দেখা যায় না তুমি যে বলছ স্বর্ণকার, ময়রা, কুম্ভকার এদের দেখা যায়, একথা সত্য নয়। তুমি হয়ত বলবে কেন? আচ্ছা, কেন তাই বলছি শোনো। কুম্ভকার, স্বর্ণকার, ময়রা প্রভৃতি যত প্রকারের যত কর্তা আছে, তারা দুই প্রকার পদার্থের দ্বারা নির্মিত। প্রথম—নাশবান পার্থিব শরীর; দ্বিতীয়—অমর জীবাত্মা। শরীর জীবাত্মার কোন কাজে লাগে সেটা শোনো। শরীর জীবাত্মার কর্ম করার এক সাধন। যখন জীবাত্মা শরীররূপী সাধনকে কর্মে নিযুক্ত করে, তখনই সে কিছু নির্মাণ করতে সমর্থ হয়। আর যদি সে এই শরীর রূপী সাধনকে কর্মে নিযুক্ত না করে, তার দ্বারা তখন কোন পদার্থ গড়া যায় না। এবার চিন্তা কর—স্বর্ণকার, কুম্ভকার, ময়রা এদের যেটি শরীর—সেটি তাদের কর্মের যন্ত্র, তা তো দেখতে পাওয়া যায়। পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ প্রভৃতি পঞ্চতত্ত্ব দ্বারা শরীর নির্মিত। কিন্তু, জীবাত্মা, যে শরীর সহযোগে কর্ম করে অর্থাৎ কর্তা; তাকে তো দেখা যায় না। জীবাত্মা শরীর ব্যতীত কোনও পদার্থ নির্মাণ করতে পারে না। কেননা জীবের শক্তি পরিমিত। এই কারণেই পরমাত্মা তাকে যে শরীর দান করেছেন তা’ দৃশ্যমান। পরমাত্মা অসীম, অনন্ত এবং সর্বব্যাপক। তিনি শরীর ব্যতীতই নিজের যাবতীয় কর্ম করে থাকেন। উভয় কর্তাই অর্থাৎ জীবাত্মা ও পরমাত্মা কেহই দৃশ্যমান নন। জীবাত্মারূপী অল্পজ্ঞ কর্তাও দৃশ্যমান নয়, আর পরমাত্মারূপী সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ কর্তাও দৃশ্যমান নন।
কমল- যদি পরমাত্মার শরীর না থাকে, তাহলে তিনি জগৎ সৃষ্টি করেন কেমন করে? শরীর ব্যতীত ক্রিয়া এবং কার্য, উভয়ের কোনটাই সম্ভব নয়।
বিমল- এবার বিচার বিনিময় করার সময় পূর্ণ হয়েছে, আগামীকাল আবার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে।
কমল- বেশ,কালই হোক।
Courtesy- বৈদিক ধর্ম ধারা - পন্ডিত সিদ্ধগোপাল কবিরত্ন
0 মন্তব্য(গুলি)