https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

গীতা বিশ্লেষনঃ ১৩ - নির্গুন, সগুন বা অব্যক্ত, ব্যক্ত উপাসনা কি?

Monday, May 15, 2017


প্রশ্ন- গীতার ১২তম অধ্যায়ে অর্থাৎ ভক্তিযোগের ১ ও ২নং শ্লোকে বলা আছে নির্গুণ বা নিরাকার উপাসনা থেকে সগুণ বা সাকার উপাসনা শ্রেষ্ট ও সহজ। তারপরও আপনারা বৈদিকরা এটা মানেন না কেন ?

উত্তর- প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার গীতার ঐ অধ্যায়ে এমন কিছু বলা নেই! বলা আছে অব্যক্ত অক্ষর ও ব্যক্ত এই দুটি শব্দ এবং বলা হয়েছে অব্যক্ত থেকে ব্যক্ত উপাসনা সহজ। তাছাড়া নির্গুণ মানে নিরাকার নয় এবং সগুণ মানে
সাকার নয়। প্রথমে দেখুন নিরাকার, সাকার, সগুণ ও নির্গুণ বলতে কি বুঝায়া, তারপর অব্যক্ত ও ব্যক্ত শব্দ দুটো নিয়ে আলোচনা করবো-
নিরাকার :- (নির্ ও আঙ) পূর্বক ডুকৃঞ্ করণে
এই ধাতু হতে নিরাকার শব্দ সিদ্ধ হয়। 'নির্গত
আকারাৎ স নিরাকারঃ', যাহার কোন আকার নেই, যিনি কখনো শরীর ধারণ করেন না সেই কারণে পরমেশ্বরের নাম নিরাকার।
নিরাকার উপাসনা কিরূপ তা একটু দেখুন(এই মন্ত্রগুলো উপাসনা বিধির মনসা_পরিক্রমা এর অন্তর্গত ৬টি মন্ত্র, একটি দেওয়া হল)-
              
"ওম্ প্রাচী দিগগ্নিরধিপতিরসিতো রক্ষিতা দিত্যা ইষবঃ।
তেভ্যো নমো ধিপতিভ্যো নমো রক্ষিতৃভ্যো নম ইষুভ্যো নম এভ্যো অস্তু।
য়ো৩স্মান্দ্বেষ্টি য়ং বয়ং দ্বিষ্মস্তং বো জম্ভে দধমঃ।।
(অথর্ববেদ ৩/২৭/১)
ভাবার্থ- পূর্বে প্রভু অগ্নি নামে তুমিই রক্ষক। সূর্যরশ্মি বাণ তব তমোবিনাশক।।
তোমারে প্রণাম করি, জগতের পতি।
রক্ষক তুমিই প্রভু, তোমারে প্রণতি।।
রক্ষার কৌশল তব অতি চমৎকার।
তোমারে প্রণাম প্রভু করি বারংবার।।
আমা সবাকারে দ্বেষ যাহারা করিবে।
আমাদের দ্বেষভাব যাহার প্রতি রবে।।
সবাকার দ্বেষভাব ন্যায় দন্ড তলে।
রাখিনু, বিনাশো তাহা সব শক্তি বলে।।
সাকার - সাকার অর্থ যার সুনির্দিষ্ট আকার আছে। এখন আমার প্রশ্ন হল ঈশ্বর কী
সুনির্দিষ্ট আকারের মধ্যে আবদ্ধ? তাহলে ঐ সুনির্দিষ্ট আকারের বাহিরে কে আছে? তিনি কে? এক কথায় সাকার নামক কোন শব্দ ঈশ্বরের ক্ষেত্রে প্রযোয্য নয়।
সগুণ :- 'য়ো গুণৈঃ সহঃ বর্ত্ততে স সগুণ'
পরমেশ্বর সর্বজ্ঞান,সর্বস ুখ, পবিত্রতা এবং
অনন্ত বলাদি গুণযুক্ত বলিয়া সেই পরমেশ্বরের
নাম 'সগুণ'।
সগুণ ব্রহ্মের উপাসনা উপস্থাপনা মন্ত্রের মাধ্যমেও হয়, আমি ভিন্ন একটি বেদ মন্ত্রের মাধ্যমে দেখাচ্ছি-
              
"ওম্ তেজোহসি তেজো ময়ি ধেহি, বীর্য্যমসি বির্য্যং ময়ি ধেহি।
বল মসি বলং ময়ি ধেহি, ওজোহস্যো জোময়ি ধেহি।
মনু্যরসি মন্যুং ময়ি ধেহি, সহোহসি সহোময়ি ধেহি।
(যজুর্বেদ ১৯/৯)
আনুবাদ- হে প্রভু! তুমি তেজোময়, আমাতে তেজ স্থাপন কর। তুমি বীর্যময় আমাতে বীর্য স্থাপন কর। তুমি বলবান, আমাতে বল স্থাপন কর। তুমি ওজসি, আমাতে ওজ স্থপন কর। তুমি অধর্মের দন্ড দাতা, আমাতে অধর্ম দমনের শক্তি স্থাপন কর। তুমি সহনশীল, আমাকে সহনশক্তি দাও।
নির্গুণ :- 'গণ্যন্তে য়ে তে গুণা বা য়ৈর্গণয়ন্তি তে গুণাঃ য়ো গুণেভ্যো নির্গতঃ স নির্গুণ ঈশ্বরঃ।' জড়ের সত্ত্ব রজ তম রূপ রস স্পর্শ ও গন্ধাদি যত গুণআছে এবং জীবের অবিদ্যা অল্পজ্ঞতা রাগ দ্বেষ ও অবিদ্যাদি ক্লেশ এইরূপ যতগুণ আছে, সে সব হতে তিনি পৃথক। এই বিষয়ে 'অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ম্' ইত্যাদি উপনিষদের
প্রমাণ আছে। তিনি শব্দ স্পর্শ এবং রূপাদি গুণ রহিত, এই কারণে সেই পরমেশ্বরের নাম 'নির্গুণ'
যেমন পৃথিবী গন্ধাদি গুণ যুক্ত বলে সগুণ ও ইচ্ছাদি গুণ নেই বলে নির্গুণ। সেইরূপ জগৎ
তথা জীবের গুণ হইতে পৃথক পরমেশ্বর নির্গুণ
এবং সর্বজ্ঞতাদি গুণ যুক্ত বলিয়া সগুণ।
অর্থাৎ এমন কোন পদার্থ নাই যাহা সগুণতা ও
নির্গুণতা হইতে পৃথক। চেতন গুণ রহিত বলে জড়পদার্থ যেরূপ নিগুণ এবং স্ব-গুণযুক্ত বলে সগুণ ।সেরূপ জড় গুণ হতে পৃথক বলে জীব নির্গুণ, আবার ইচ্ছাদি নিজ গুণযুক্ত বলিয়া সগুণ। পরমেশ্বরের ক্ষত্রেও এইরূপ বুঝতে হবে।
এখন আসুন অব্যক্ত ও ব্যক্ত শব্দ দুটিতে-
বাংলা ভাষায় প্রাপ্ত প্রায় সব গীতাতেই আলাদা আলাদা করে সংস্কৃত শাব্দের অর্থ লিখার সময় অব্যক্ত অর্থ অপ্রাকাশিত ও ব্যক্ত অর্থ প্রকাশিত লিখেছেন, যা কিনা ঠিক। অথচ পুরো শ্লোকের অনুবাদ করার সময় তারা অপ্রকাশিত এর বদলে
নির্গুণ অথবা নিরাকার ও প্রকাশিত বলতে সগুণ অথবা সাকার লিখেছে, যা কিনা বলা চলে ভুল। এখন প্রশ্ন হল অব্যক্ত অর্থ যে অপ্রাশিত এবং ব্যক্ত অর্থ প্রকাশিত তার প্রমাণ কি এবং এই
অপ্রকাশিত ও প্রকাশিত বলতে কি বুঝায়, তা জানানোর জন্য আপনাদের গীতা, উপনিষদ ও মনুসংহিত এর দিকে নজর দেওয়ার জন্য
অনুরোধ করছি। প্রথমে দেখি গীতা কি বলছে-
"অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধানিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা।।"
গীতা ২/২৮.
ভাবার্থ- হে ভারত! প্রাণিগণ বা সমস্ত জীব আাদিতে অব্যক্ত বা অপ্রকাশিত ছিল, মধ্যে বা স্থিতীকালে ব্যক্ত বা প্রকাশিত হয়, নিধনে বা বিনাশের পর আবার অব্যক্ত বা অপ্রকাশিত হয়ে যায়। সুতরাং এর জন্য শোক কেন?
দেখুন মনু কি বলেছেন-
"তারপর অব্যক্ত বা অপ্রকাশিত (যোগলব্দ) ভগবান স্বয়ম্ভু প্রলয় অবস্থায় ধ্বংসক,মতান্তরে
প্রকৃতিপ্রেরক হয়ে এই স্থুল আকাশাদি মহাভূত-যা পূর্বে অপ্রকাশ ছিল-সেই বিশ্বসংসারকে ক্রমে ক্রমে প্রকটিত করে প্রকাশিত হলেন।"
(মনুসংহিতা ১।৬)
"যিনি মনোমাত্রাগ্রাহ্য,সূক্ষতম, অব্যক্ত বা অপ্রকাশক, চিরস্থায়ী, সর্বভূতে বিরাজমান এবং যিনি চিন্তার বহির্ভূত সেই অচিন্ত্য পুরুষ
স্বয়ংই প্রথমে ব্যক্ত বা প্রকাশিত হয়েছিলেন।"
(মনুঃ১।৭)
উপরের শ্লোকগুলো থেকেই প্রমাণ হয় যে অব্যক্ত অর্থ ঈশ্বরের জগৎ সৃষ্টির পূর্বের অবস্থা,আর
ব্যক্ত অর্থ ঈশ্বরের জগৎ সৃষ্টির পরের অবস্থা। এবং জীবের ক্ষেত্র জম্মের পূর্বের ও পরের অবস্থা। আবার আসুন গীতার বাণীতে-
"দেহ ধারী ব্যক্তিদের পক্ষে ঈশ্বরের ঐ অবক্ত অবস্থাকে উপলব্দি করা দেহধারীদের পক্ষে
কষ্ট কর, তবে যোগীদের দ্বারা সম্ভব।
(গীতা১২।৫)
কেননা জগৎসৃষ্টির পূর্বে ঈশ্বর কেমন ছিলেন তা
আমরা দেহধারী সাধারণ মানুষরা শুধু
মুখে বলতে পারি, কিন্তু খুব সহজে উপলব্দি করতে পারিনা। আর ব্যক্ত উপাসনা দেহধারীদের
পক্ষে সহজ (গীতা১২।৬)।
কেননাতখন আমরা দেহধারীরা ঈশ্বরের গুণ
ও কর্মগুলোকে চিন্তা করে উপাসনা
করতে পারি।
ছান্দোগ্য_উপনিষদ ৩।১৯।১ এ
অব্যক্ত ও ব্যক্তকে যথাক্রমে অসৎ ও সৎ এই দুটো শব্দ দ্বারা মনুসংহিতার ঐ কথাগুলোই বলা
হয়েছে অর্থাৎ ঈশ্বরের অপ্রকাশিত অবস্থা ও প্রকাশিত অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে।
এখন ব্যক্ত উপাসনা কি ভাবে করে তা একটু দেখাচ্ছি (এই মন্ত্র ৩টি উপাসনা বিধির
অঘমর্ষণ এর অন্তর্গত, একটি দিলাম)-
               
"ওম্ ঋতং চ সত্যং চ ভীদ্ধাত্তপসোহধ্
যজায়ত।
ততো রাত্র্যজায়ত ততঃ সমুদ্রো অর্ণবঃ।।
ঋগবেদ ১০/১৯০/১.
অনুবাদ- নিত্যজ্ঞানময় বেদ এবং কারণ প্রকৃতি তোমার জ্ঞানময় সামর্থ্য হতে প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই সামর্থ্য হতেই জলপূর্ণ আকাশ উৎপন্ন হয়েছে।
পরিশেষে একটা কথাই বলতে চাই, ঈশ্বর অব্যক্ত, ব্যক্ত, নির্গুণ, সগুণ ও নিরাকার। কিন্তু কোন ক্রমেই সাকার নয় অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট গঠনের মধ্যে আবদ্ধ নয়। হে ঈশ্বর সকলের জ্ঞান চক্ষু জাগ্রত হোক, এই কামনাই করি।