এই লেখার উদ্যেশ্য মাতা সীতার অগ্নি পরীক্ষা বিষয়ে রামায়ণের এক বিবাদিত প্রসঙ্গে। বলা হয়ে থাকে যে, রাবণের সংহার এবং সীতাকে উদ্ধার করার পর, রামচন্দ্র সীতাকে সন্দেহ করে তাকে পুনঃ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। অতঃ নিজের পবিত্রতার সাক্ষী দেবার জন্য সীতা অগ্নিতে প্রবেশ করে। যেখানে অগ্নিদেব তাকে রক্ষা করেন এবং তিনি অগ্নিতে ভস্ম বিনা ফিরে আসে। এরপর রাম চন্দ্র সীতাকে পুনঃ স্বীকার করে।
এই ঘটনা অপপ্রচার মহলে বেশ প্রচলিত। অন্য মতের প্রচারক এই প্রসঙ্গ কে হাথিয়ার বানিয়ে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে তাদের মতে আসার জন্য আহ্বান করে।
চমৎকার বাদীদের অনুসারে তো রাবন দ্বারা সীতার ছায়াকে হরণ করা হয়েছিলো, আসল সীতা তো অগ্নি মধ্যে ছিলো। এই জন্য ছায়ারূপী সীতা অগ্নির মধ্যে যেতেই আসল সীতা প্রকট হলো।
এই প্রসঙ্গে অসম্পূর্ণতা -
রামের মতো মহাপুরুষের দ্বারা ওইরূপ বিপরীত কিছু করা যা আগে কেউ কখনো করে নি। সেহেতু তিনি কি দ্বিতীয় উপাই এর সাহায্য নিতে পারে নি?
আর ওই চমৎকার কাহিনী কি মনভূলানো গল্প নয়? বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের পূর্বের কাল কে চমৎকারের কাল বলা হয়ে থাকে। কোন ঘটনা যতটা পুরোনো হবে, তাহার অতিরন্জিত হওয়ার সম্ভবনা তত বেশী। সমুদ্র মন্থন, চাঁদ দু টুকরো হয়ে যাওয়া, সীতার অগ্নিপরীক্ষা ইত্যাদি চমৎকার যেসব কেউ না কখনো দেখেছে আর না দেখার সম্ভবনা ভবিষ্যতে রয়েছে। এই যে চমৎকার কিছু হয়েছে এগুলোর সত্যতার তো কোন নিশ্চয়তা নেই।
নাস্তিকদের জন্য তো ইহা হাসি উড়ানোর এবং ধর্মকে ঘৃণার এক বড় কারণ। কারন তারা তো কেবল রাসায়নিক প্রকৃয়ার পরিণাম মানে। কেউ যদি রামায়ন কে পৌরাণিক গাথা মেনে সেসব বর্ননাকে সাংকেতিক বর্ণনা মনে করে। তবে বলতে হবে কোন স্ত্রীর পবিত্রতার মাপদন্ড কি তাকে অগ্নিরোধী হতে হবে? যদি তাই হয় তবে সমস্ত স্ত্রীকে "অগ্নিরোধী" হওয়া উচিৎ। আর ইহা কখনো সম্ভব নয় যে, পবিত্রতা শরীরের উপর কোন "অগ্নিরোধী" কবচ জড়িয়ে দেন। এইরূপ করে কোন আদর্শ স্থাপিত হবে এটা স্পষ্ট নয়। কোন স্ত্রীর সতীত্বের পরিক্ষনের এইরূপ অবধারনা বেদের সাথে সাংঘর্ষিক।
প্রথমত বেদের মতো রামায়ন কোন ঐশ্বরীয় গ্রন্থ নয়, বরং এক মহাকাব্য। আলাদিনের জাদুর প্রদীপের মতো কাহিনী নয় ।আর না শুধুমাত্র হিন্দু পরম্পরার সাথে যুক্ত কোন গ্রন্থ। রাম চন্দ্র কোন ধর্ম বিশেষের নয় পরন্তু সম্পূর্ণ মানব জাতীর আদর্শ পুরুষ। তিনি আমাদের মানবতার প্রতীক। রাম চন্দ্রের স্ত্রী বিরোধের প্রসঙ্গ ভারতবর্ষ তথা হিন্দুত্বের অপমান। বেদ তো নিজ রক্ষন বিধি দ্বারা জন্মকাল থেকেই সম্পূর্ণ সুরক্ষীত। তাহার লেশমাত্র পরিবর্তন সম্ভব হয় নি। কিন্তু অন্য গ্রন্থ রক্ষনের এইরূপ কোন প্রণালী উপলব্ধ হয় নি। এই কারনে রামায়ন এবং মহাভারতের মতো গ্রন্থ প্রক্ষিপ্ততার স্বীকার হয়েছে। মনুস্মৃতিরও একই দশা।
অতএব রামায়ন এবং শ্রী রাম চন্দ্রের বিষয়ে আমাদের সিন্ধান্তগুলো এরূপ যে,
(i) বাল্মীকি রামায়নে শ্রী রাম চন্দ্র মহান ব্যক্তিত্ব, মর্যাদাপুরষোত্তম, জ্ঞানী, বীর, মহামানব, পরমাত্মার পরম ভক্ত, ধীর বীর পুরুষ, বিজয়ের পশ্চাৎ বিনম্রতা আদি গুন দ্বারা বিভূষিত, মহানায়ক, সদগৃহস্থ তথা আদর্শ মহাপুরুষ ছিলেনন। ওইরূপ মহান ব্যক্তিত্বের মহান গুনের সম্মুখে সীতার অগ্নিপরীক্ষা করে সীতার পবিত্রতা নির্ধারন করা এক আরোপিত মিথ্যা এবং অস্বীকার্য ঘটনা প্রতীত হয়।
(i) বৈদিক কালে নারী জাতির স্থান সমাজের মধ্য কালের মতো নিকৃষ্ট ছিলো না। বৈদিক কালে নারী বেদের ঋষি থেকে শুরু করে গার্গী, মৈত্রেয়ীর সমান মহান বিদুষী ছিলো, কৈকেয়ীর সমান মহান ক্ষত্রিয়াণী ছিলো যিনি রাজা দশরথের সাথে যুদ্ধে পরাক্রম দেখিয়েছিলেন, কৌশল্যার সমান দৈনিক অগ্নিহোত্রী এবং বেদপাঠি ছিলো। সম্পূর্ণ রামায়নে এই তথ্য কে সিদ্ধ করে যে, রাবনের অশোক বাটিকার মধ্যে সীতার নিকট রাবন শক্তিশালী এবং সমর্থ হওয়ার কারনেও সীতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাহার নিকট যাবার সাহস করে নি। ইহাই সেই কালে সমাজিক মর্যাদা এবং নারী জাতির পতিব্রতার উদ্বোধক। রামায়ন কালে সমাজিক মর্যাদার এক অন্য উদাহরন এই তথ্যে মিলে যে, পরনারীকে অপহরনকারী রাবনকে এবং পরপুরুষ কে ইচ্ছাকারী শূর্পনখা কে তাদের দূরাচারের কারণে রাক্ষস বলা হয়েছে। ওইরূপ মহান সমাজে বিদুষী এবং তপস্বী সীতার সত্য বচনই তাহার পবিত্রতা সিদ্ধ করার জন্য পূর্ণ ছিলো। এই আধারে সীতার অগ্নিপরীক্ষা এক মনগড়া প্রসঙ্গ সিদ্ধ হয়।
(iii) বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতেও ইহা সম্ভব নয় যে কোন মানুষের শরীরকে অগ্নিতে সমর্পন করলে তাহা ভস্ম বিনা ফিরে আসে। অগ্নি কি কোন পবিত্রতার পরীক্ষা নিতে সক্ষম? বৈজ্ঞানিক তর্কের বিরুদ্ধে সীতার অগ্নিপরীক্ষা কে চমৎকারের সঙ্গা দেওয়া মন ভূলানো গল্পের সমান। কেবল আস্থা, বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধারূপী মান্যতা দ্বারা সংসার চলে না। যে কোন মান্যতাকে সত্য এবং জ্ঞান দ্বারা সিদ্ধ হওয়ার পরই গ্রহন করার যোগ্য মানা উচিৎ। এই আধারে সীতার অগ্নিপরীক্ষা মনগড়া প্রসঙ্গ সিদ্ধ হয়।
(iv) সুগ্রীবের পত্নি রূমা যাকে বালী নিজের কব্জায় রেখে নিজের মহলে রেখেছিলেন। বালী বধের পশ্চাৎ যখন সুগ্রীব তার পত্নি কে কোন পরীক্ষা বিনাই স্বীকার করেন তো শ্রীরাম হরণকৃত সীতাকে কেন স্বীকার করবেন না? এখান থেকে স্পষ্ট হয় যে, রামের দ্বারা সীতার অগ্নিপরীক্ষা প্রকরণ বিরুদ্ধ এবং পরবর্তী সংযোজন।
(v) এই পুস্তকের রামায়নের প্রক্ষিপ্ত বিশেষ করে উত্তর কান্ডের মধ্যে এই অগ্নিপরীক্ষার প্রসঙ্গ আসার কারনে অস্বীকার্য। রামায়নের মহান গাথা তো যুদ্ধের পশ্চাত হনুমান দ্বারা রাম চন্দ্রের বিজয় সীতা কে সংবাদ দেবার জন্য অশোক বাটিকা যাবার পর শ্রী রাম দ্বারা সীতার পূণর্মিলন এবং অযোধ্যায় ফিরে আসার মধ্যে দিয়ে সমাপ্ত হয়ে যায়। রামায়ন মধ্যে প্রক্ষীপ্ত সংযোজন করে শ্রীরামের আদর্শ চরিত্র কে দুষিত করা এবং সীতার পরীক্ষা কে ব্যর্থ আরোপিক করার কার্য মধ্য কালে ঘটেছে।
রামায়নে নারী জাতির সম্মান শৌর্য গাথা। ইহা সন্দেশ দেয় যে, একজন অত্যাচারী পরনারীর হরণ করে তো ,সাগরের উপর সেতু বানানোর প্রয়োজন পড়ে, বর্ষ পর্যন্ত জঙ্গলে ক্লেশ ভোগ করার প্রয়োজন পড়ে, নিজের শক্তি যতটাই সীমিত হোক না কেন। দৃঢ নিশ্চয়ী এবং সত্য মার্গের পথিক নারী জাতির তিরস্কার, অপমানের প্রতিশোধ প্রাণ হরণ করে নেয়। ওইরূপ মহান গাথায় সীতার অগ্নিপরীক্ষা যেমন অমিল, অপ্রাসঙ্গিক বর্ণন প্রক্ষিপ্ত ব্যতিত কিছু নয়।
0 মন্তব্য(গুলি)