https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

গীতা বিশ্লেষণঃ৪২.শ্রীকৃষ্ণ গুরুরূপে যেখানে অজুর্নকে ঈশ্বরের শরণ নিতে বলেছেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণই তো ঈশ্বর এর সমাধান কি?

Wednesday, July 19, 2017


প্রশ্ন- শ্রীকৃষ্ণ গুরুরূপে যেখানে অজুর্নকে গীতা জ্ঞান দিয়েছেন, সেখানে তিনি বলেছেন ঈশ্বরের সরণ নেওয়ার কথা। আর যেহেতু শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ঈশ্বর সেহেতু গীতাতে আবার কখনো কখনো আমাকেই স্মরণ কর
বলেছেন। আপনার মত কি এই ব্যাপারে?

উত্তর- না, ব্যাপারটা ঠিক এই রকম নয়, আপনি গীতা থেকেই যাচাই করে দেখুন। গীতা ২।৭নং শ্লোকে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের শিষ্য হয়েছেন। এখানে বলা আছে-


"এদের মেরে কিভাবে জীবন ধারণ করব-এইরূপ ভাবনায় দীন হয়ে আমার শৌর্য বীর্য অভিভূত হয়েছে, ধর্ম সম্বন্ধেও আমি মোহ গ্রস্ত হয়েছি, তাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি, 'আমার যাহা নিশ্চিৎ শ্রেয়, তাহা বল। আমি তোমার শিষ্য শরণাপন্ন, আমকে শিক্ষা দাও'।" গীতা ২/৭.
অর্থাৎ এখান থেকেই অর্জুন কৃষ্ণের শিষ্য হয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল তখন কি অর্জুন আপনার মতো জানতো কৃষ্ণই স্বয়ং পরমেশ্বর? যদি জেনেই থাকতো তাহলে তো শ্রীকৃষ্ণের এক কথাতেই অর্জুন লাফিয়ে উঠে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতেন, কৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতেন না। কারণ তার তো জানাই ছিল যে কৃষ্ণই ঈশ্বর, আর ঈশ্বর তো ভুল করতে পারেন না ও স্বয়ং মাটিতে নেমে এসে অর্জুনের রথের সারথী হয়ে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারেন না। কিন্তু অর্জুন তা করেনি, কারণ প্রকৃতপক্ষে অর্জুন তখনো জানতোই না যে শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর (প্রশ্নকর্তার কথানুসারে ঈশ্বর)। তার প্রমাণ হিসেবে বলা চলে গীতা ৪।৪ নং শ্লোক, এখানে অর্জুন কৃষ্ণের জম্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন-
"আপনি আদিতে বা পূর্বে সূর্যকে এই কর্মযোগ সম্পর্কিত জ্ঞান বলেছিলেন, এই কথা কেমন করে জানবো?" গীতা৪/৪ (অথচ ঈশ্বরের জম্ম মৃত্যু নেই!)।

শ্রীকৃষ্ণ গুরুর মতই যখন অর্জুনকে জ্ঞান দিলেন তখন অর্জুনের কি অবস্থা হয়েছিল তাও একবার দেখুন-
"ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন বুদ্ধিং মোহয়সীব মে। অর্থাৎ তোমার মিশ্রিত কথা দিয়ে আমার বুদ্ধি বিভ্রান্ত হচ্ছে।" গীতা ৩।২.
আর ঠিক এর পরের শ্লোকেই ভগবান কি বলেছেন তাও দেখুন- "এই জগতে পূর্বে আমি দুই প্রকার নিষ্ঠার কথা বলেছিলাম..।" গীতা ৩।৩.

দেখুন দাদা গীতা২।৭ থেকে শুরু করে গীতা৩।২ পর্যন্ত কৃষ্ণ অর্জুনের গুরু ছিলন, অথচ গীতা৩।৩ এ তিনি কি
করে হঠাৎ করে বলে বসলেন যে তিনি এই জগতে পূর্বে তিনি ২ প্রকার নিষ্ঠার কথা বলেছেন? কৃষ্ণ এই কথা
বলার পরও অর্জুন বলে নাই যে আপনি এটা কি করে বললেন? কারণ অর্জুন তখনো তো জানতোই না যে
শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর! অথচ তিনি ২নং অধ্যায়ের কথাগুলোকে
"ব্যামিশ্রেণব বাক্যেন" বলেছেন। তাহলে কি গীতার৩/৩ নং কথাটাও "ব্যামিশ্রেণব বাক্যেন" নয়? কারণ
বেদে তো এই দুই প্রকারের জ্ঞান পূর্ব থেকেই ছিল। এখন যদি বলেন যে বেদ জ্ঞান কৃষ্ণই দিয়েছেন, তাহলে আমার প্রশ্ন অর্জুন কি জানতো কৃষ্ণই ঈশ্বর? কিন্তু তা
তো নয়!

একটু পরেই গীতা ৩।১০ নং শ্লোকে কৃষ্ণই বলেছেন যে-
"সৃষ্টির প্রারম্ভে যজ্ঞের সহিত প্রজা সৃষ্টি করে প্রজাপতি
বলেছেন, এই যজ্ঞের দ্বারা তোমরা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হও,...। "
আবার গীতা ৩।১৫ এ বলেছেন-
"যজ্ঞাদি কর্ম বেদ থেকে উৎপন্ন জানবে। বেদ অক্ষর পরমাত্মা থেকে সমুদ্ভুত...।"
আবার গীতা ৩।৩০ এ বলা আছে- "সকল কর্ম আমাতে সমর্পণ করে...যুদ্ধ কর।"

গীতা ৩।২নং শ্লোকের পর এত 'ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন' বলার পরও অর্জুন এখানে বলেনি যে এগুলো ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন। তাহলে কি বলতে হবে অর্জুন বুঝে গিয়েছিল কৃষ্ণই ঈশ্বর? কিন্তু তা তো নয়, কারণ ঐ শ্লোকগুলোর পরে গীতা ৪।৪ নং শ্লোক বলছে অর্জুন তখনো কৃষ্ণকে ঈশ্বর মানেনি বরংচ তার জম্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং কৃষ্ণকে এক জন মানুষরূপী গুরু হিসেবেই যেনে ছিলো!

তাহলে কি করে কৃষ্ণ নিজেকে তার ঐশ্বরিক ক্ষমতা প্রদর্শনের পূর্বেই গীতা ৩/৩০নং এ বলল ওনাকে সকল কর্ম সমর্পণ করতে ও ওনাকে স্মরণ করতে (যদিও এটা কৃষ্ণের কথা নয়, এটা কৃষ্ণের মধ্যে প্রকটিত পরমেশ্বরের বাণী)? আর যখন বিশ্বরূপ দেখালো তারপর তো অর্জুন বুঝেই যাওয়ার কথা যে (আপনার কথা অনুসারে) কৃষ্ণই স্বয়ং পরমেশ্বর (যদিও বিশ্বরূপ কৃষ্ণের মধ্যে প্রকটিত পরমেশ্বরের, কৃষ্ণের নয়)। আর তারপর কৃষ্ণ যত কথা বলেছে তার প্রতিটা জায়গাতেই অমুক তমুকের স্মরণের কথা না বলে শুধুমাত্র কৃষ্ণ নিজেকে স্মরণের কথা বলতো। অথচ এক্ষেত্রেও তা দেখা যায় না, কারণ অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শণের পরেও অসংখ্য বার কৃষ্ণ বিভিন্ন অধ্যায়ে বলেছেন ব্রহ্ম, পরমাত্মা, ঈশ্বর ও ওম্ এর স্বরণ নেওয়ার কথা।

এবার বাবা লোকনাথের কথায় আশা যাক- যদি আপনার কথা মত ধরেই নেই যে কৃষ্ণ এক বার গুরুরূপে ও আরেক বার ঈশ্বর রূপে গীতা বলেছে। তাহলে তো বাবা লোকনাথের ক্ষেত্রেও আপনার কথা মত একই কথা প্রযোজ্য হওয়া উচিত। কারণ তিনিও বলেছেন-
"তোরা আমার চরণ ধরিস না, আচরণ ধর(গুরুরূপে)।"
"রনে বনে জলে জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়িবে আমাকে স্মরণ করিও, আমিই রক্ষা করিব (ঈশ্বররূপে)।"

এখন কি বলবেন-বাবা লোকনাথও স্বয়ং পরমেশ্বর? যদি লোকনাথ বাবাই পরমেশ্বর হয় তাহলে এই কলি যুগের মানুষ কেন সেই ঈশ্বরের নাম জপ করছেনা? এখন তো কৃষ্ণ থেকেও ওনার নাম জজপ করার কথা বেশি, কারণ হিসেবে বলা চলে তিনি তো সাম্প্রতিক কালের পরমেশ্বর! আর কৃষ্ণ তো অতিদূরের (প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বের) পরমেশ্বর! আর আপনাদের কথা অনুসারে যেহেতু সময়ে সময়ে তারকব্রহ্মের নাম পরিবর্ত হয়, সেহেতু তারকব্রহ্মের আধুনিক নাম তো লোকনাথ হওয়া উচিৎ। যদিও এটাও ঠিক লোকনাথ নামটাও ঈশ্বরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু প্রশ্ন হল পুরাণ প্রিয় ও যারা কৃষ্ণকে স্বয়ং পরমেশ্বর ভাবেন তারা কেন লোকনাথ বাবার ক্ষেত্রে এমনটা বলেন না?

অর্থাৎ কৃষ্ণ একবার গুরুরূপে ও একবার ঈশ্বর রূপে গীতা বলার কথা সম্পূর্ণ আপনার ব্যক্তিগত ধারণ
ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ গীতা ও মহাভারত তা সাক্ষ দেয় না। প্রকৃত পক্ষে গীতায় কৃষ্ণ কখনো গুরুরূপে এবং কখনো পরমব্রহ্মের সহিত যোগযুক্ত
হয়েই গীতা বলেছেন ( মহাভারতের অনুগীতা অংশে কৃষ্ণ তা নিজেই স্বীকার করেছে, যা পূর্বের কয়েকটা পর্বেই তা দেখিয়েছি)। যেমন কিনা বাবা লোকনাথও কখনো গুরুরূপে ও কখনো পরমব্রহ্মের সহিত যোগযুক্ত হয়ে বলেছেন।

ভাগবতের যেখানে কপিলদেব, ঋষভদেব ও ভূমাপুরুষের প্রসঙ্গ আছে সেই অধ্যায়গুলো একটু মন দিয়ে পড়বেন! কপিলদেব তার পিতাকে উপদেশ দিচ্ছেন এই বলে-
"এখন যথা ইচ্ছা গমন কর,আমাতে সমস্ত কর্ম সমর্পণ করে, দুর্জয় মৃত্যুজয় এবং অমৃতত্ব লাভের জন্য আমায় ভজনা কর।"
ঋষভদেবও বলেছেন- "আমার প্রীতির জন্য কর্ম করা, আমার কথা বলা, আমার ভক্তগণের সঙ্গ, আমার
গুণকীর্তন" এরকম আমি আমার সূচক উপদেশ দিয়ে পুত্রগণকে বলছেন- "স্থাবর জঙ্গম যা কিছু আছে সেইসকল পদার্থেই আমার অধিষ্ঠান জেনে পবিত্র দৃষ্টিতে সতত তাদের সম্মান কর, তাহাই আমার পূজা।" ভূমাপুরুষও উপদেশ কালে মম, মাম, ময়ি কথা ব্যবহার
করেছেন এবং ঐ কৃষ্ণকেই তার নিজের অংশ বলে বলেছেন। কৈ এর জন্য তো আপনারা তাদেরকে পূর্ণ ভগবান বলে মনেন না? কেবল কৃষ্ণের বেলাতেই
কি মম, ময়ি, মাম্ কথাগুলো পূর্ণ ভগবত্তা সূচনা করে? শংকরাচার্য যখন বলেছেন, "অহং নির্বিকল্পো
নিরাকাররূপো বির্ভূব্যাপী সর্বত্র সর্বেন্দ্রিয়াণাম্.." তখন কি আপনারা বলবেন তিনি নিজেকে পূর্ণ
পরমাত্মা বলে ঘোষণা করেছেন? বর্তমান কালের রমণ মহর্ষি, ব্রহ্মানন্দস্বামীও 'আমি আমার' কথা উপদেশ কালে ব্যবহার করতেন। কৃষ্ণের জম্মের হাজার হাজার বছর পূর্বেও বেদের ঋষিগণ আত্মতত্ত্ব উপদেশ কালে
অহং, মম ইত্যাদি ব্যবহার করতেন। কৈ এর জন্য তো তারা স্বয়ং ভগবান্ হয়ে যাননি! গীতার যেখানে যেখানে
কৃষ্ণ মম, ময়ি, মাম্ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছেন, সেই সমস্তই বাবা লোকনাথ, কপিল, ঋষভ, শংকরাচার্যের মত আত্মাকে লক্ষ্য করে পরমাত্মাতে সমাহিত হয়েই বলেছেন (যা পরমেশ্বরেরই বাণী, কৃষ্ণের নয়)। আবার কিছু কিছু স্থানে গুরুরূপে নিজের অতীত জম্ম ও কর্মের কথা বলেছেন (গুরুরূপে যা কৃষ্ণের নিজের বাণী)।