প্রশ্ন- নাম যজ্ঞ করা কি ঠিক? হোম
যজ্ঞের কথা শাস্ত্রের সর্বত্রই আছে জানি,
কিন্তু বর্তমানে নামযজ্ঞ নিয়ে অনেক কথা
কাটাকাটি হচ্ছে, প্রকৃত পক্ষে সত্যিটা কি?
যজ্ঞের কথা শাস্ত্রের সর্বত্রই আছে জানি,
কিন্তু বর্তমানে নামযজ্ঞ নিয়ে অনেক কথা
কাটাকাটি হচ্ছে, প্রকৃত পক্ষে সত্যিটা কি?
উত্তর- দুটোই ঠিক, কোনটাই ভুল নয়। তবে
সমস্যা হল এটাই যে অনেকে শাস্ত্র মেনে
করে না এগুলো। এখানেই যত গন্ডোগোল!
প্রথমে যজ্ঞ কি তা একটু শাস্ত্র থেকে বলি-
সমস্যা হল এটাই যে অনেকে শাস্ত্র মেনে
করে না এগুলো। এখানেই যত গন্ডোগোল!
প্রথমে যজ্ঞ কি তা একটু শাস্ত্র থেকে বলি-
" যজ্ঞেন যজ্ঞময়জন্ত দেবাস্তানি ধ
র্মাণি প্রথমান্যসন্ ।
তে হ নাকং মহিমানঃ সচন্ত য়ত্র পূর্বে সাধ্যাঃ সন্তিদেবাঃ ।।
ঋগবেদ ১০/৯০/১৬.
অর্থাৎ সত্য নিষ্ঠ বিদ্বানেরা যজ্ঞের
দ্বারাই পরমেশ্বরের পূজা করেন। যজ্ঞে সব
শ্রেষ্ঠ ধর্মের সমাবেশ হয়। মহান ব্যক্তিরা
যজ্ঞ দ্বারা ভগবানের পূজা করে দুঃখরহিত
হয়ে মোক্ষ লাভ করেন। সাধন সাধন সম্পন্ন ও
জ্ঞান সম্পন্ন বিদ্বানেরা যেখানে পূর্ব
হতেই বাস করছেন।
.
এই সবই উপরোক্ত মন্ত্রের উল্লেখ যোগ্য
বিষয়। এখানে বুঝতে হবে যে 'যজ্ঞ' শব্দ 'যজ্'
ধাতু থেকে তৈরি হয়েছে। যার তিনটি অর্থ
ধাতু পাঠে বর্ণিত আছে- ১.দেবপূজা,
২.সংগতিকরণ ৩.দান। এর মধ্যেই আমাদের
সকল কর্তব্য নিহিত আছে। এই জন্য
শতপথ ব্রাহ্মণ ১/৭/৩/৫. এ বলা আছে-
" যজ্ঞো বৈ শ্রেষ্ঠতমং কর্ম ।"
আবার
তৈত্তিরীয়_সংহিতা ৩/২/১/৪. নং এ আছে-
" যজ্ঞো হি শ্রেষ্ঠতমং কর্ম ।
এই সব
ক্ষেত্রে যজ্ঞকে শ্রেষ্ঠতম কর্ম বলে
অভিহিত করা হয়েছে, গীতাতেও এরূপই বলা
আছে। আর যারা যজ্ঞ করে না তাদের কি
দুর্গতি ও অধপতন হয় তা দেখুন-
.
" ন য়ে শেকুর্য়াজ্ঞিয়াং নাবমারুহম্ ইর্মেব
তে ন্যবিশন্ত কেপয়ঃ ।"
ঋগবেদ ১০/৪৪/৬. অথর্ববেদ ২০/৯৪/৬.
অর্থাৎ যে ব্যক্তিরা যজ্ঞময়ি নৌকায়
আরোহন করতে সক্ষম হয় না, তারা কুৎসিৎ
অপবিত্র আচরণকারী হয়ে এই লোকেই ক্রমশঃ
অধপতিত হতে থাকে।
.
যজ্ঞ আবার ৫ প্রকার, মহর্ষি মনু মহারাজ
মনুসংহিতা ২/২৮ নং শ্লোকে বলেছেন-
"মহায়জ্ঞৈশ্চ য়জ্ঞৈশ্চ ব্রাহ্মীয়ং ক্রিয়তে
তনুঃ।
অর্থাৎ পঞ্চমহাযজ্ঞ ও সোমযজ্ঞের
অনুষ্ঠানে দ্বারা মানুষ ব্রহ্ম প্রাপ্তির যোগ্য
হয়ে যায়।
.
এই পঞ্চমহা যজ্ঞ হল- ব্রহ্মযজ্ঞ দেবযজ্ঞ
পিতৃযজ্ঞ অতিথিযজ্ঞ
বলিবৈশ্যদেবযজ্ঞ । যেহেতু প্রশ্নের
আলোচ্য বিষয় হল নাম যজ্ঞ, তাই আলোচনা
অন্যদিকে না নিয়ে শুধু নাম যজ্ঞ নিয়েই
করছি। প্রকৃত পক্ষে নাম যজ্ঞ ব্রহ্মযজ্ঞ এর
অন্তর্গত, প্রশ্ন হতে পারে এটা আবার কিরূপ?
তাই এই ব্যাপারে একটু বিস্তারি লিখা
দরকার বলে মনে করি।
.
ব্রহ্মযজ্ঞের দুইটি ভাগ-
১.সন্ধ্যা-উপাসনা,
প্রাতকালীন ও সায়ংকালীন ঈশ্বর_স্তুতি ,
প্রার্থনা ও উপাসনা করা।
২.স্বাধ্যায় করা।
প্রথম ভাগে বর্ণিত ঈশ্বর স্তুতির মধ্যেই মূলত
সেই নামযজ্ঞ বিদ্যমান! হোম যজ্ঞের
ব্যাপারে বেদ উপনিষদ গীতা ইত্যাদি সকল
শাস্ত্রেই বলা আছে স্পষ্ট ভাবে, তা আপনিও
জানেন। নাম যজ্ঞের ব্যাপারে খুব স্পষ্ট
ভাবে বলা নেই, তাই এই ব্যাপারটাই তুলে
ধরছি এখানে।
.
প্রশ্ন হল ঈশ্বরের স্তুতি বা নাম স্মরণ করলে
কি হয়? উত্তরও খুব পরিষ্কার, ঈশ্বরের স্তুতি
বা নামের স্মরণ দ্বারা ঈশ্বরের প্রতি
প্রীতি জম্মে। ওনার গুণ, কর্ম ও স্বভাব
দ্বারা নিজের গুণ, কর্ম ও স্বভাবের সংশোধন
হয়। যেমন কিনা বলা চলে পরমেশ্বরের একটা
নাম তৈজস । কেহ যদি ইচ্চা করে ওনাকে এই
নামে স্মরণ করতে পারে এবং নিজের মধ্যে
তেজ স্থাপন করতে পারে। একটু বেদ মন্ত্রের
মাধ্যমে ওনার স্তুতি করছি-
"তেজোহসি তেজো ময়ি দেহি অর্থাৎ হে
তেজস্বী! আমাতে তেজ স্থাপন করুন।"
যজুর্বেদ ১৯/৯.
.
এইরূপ পরমেশ্বরের অনন্ত নাম যথা- ব্রহ্ম,
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, রুদ্র, গণেশ, দেব, দেবী,
বুদ্ধ, শ্রী, লক্ষী, সরস্বতী, দয়াল, অদ্বৈত, যম,
শংকর, মহাদেব, বিশ্বকর্মা, অগ্নি, মনু,
প্রজাপতি, প্রাণ, ইন্দ্র, ঈশ্বর, পরমাত্মা, সত্য,
মিত্র... ইত্যাদি স্মরণ হতে পরে, আর একেই
নাম যজ্ঞ বলে। তবে পরমেশ্বরের অনন্ত
নামের মধ্যেও একটি নাম আছে যার স্মরণের
কথা সর্ব শাস্ত্রেই বর্ণিত আছে। আর তা হল
"ওম্", বেদ মন্ত্র থেকেই দেখি-
.
"ওমিত্যেতদক্ষরমুদ্গীথমুপাসতি।
ছান্দোগ্যোপনিষদ্ ১/১/১.
অর্থাৎ "ওম্" এই অক্ষরকে (যিনি কখনো
বিনষ্ট হন না) উপাসনা করিবে, কারণ "ওম্" এই
শব্দ হতে আরম্ভ করে উদগীথ গান করেন।
.
"ওম্ বায়ুরনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম্।
ওম্ ক্রতো স্মর কৃতং স্মর ক্রতো স্মর কৃতং
স্মর।।" যজুর্বেদ ৪০/১৫
ভাবার্থ- হে কর্মশীল জীব! শরীর পৃথক
হওয়ার সময় তুমি "ওম্" এর স্মরণ কর, নিজ
সামথ্যের জন্য ওম্ স্মরণ কর, কৃত কর্মকে স্মরণ
কর, ধনঞ্জয়াদি বায়ু নিজ কারণরূপে পরিণত
হতেই এই শরীর ভস্ম হয়ে যায়।
.
আপনি যেহেতু প্রশ্ন করেছেন গীতার উপর,
তাই সেখান থেকেই এখন নাম স্মরণের
ব্যাপারে তুলে ধরছি। প্রশ্ন থেকে যায় যে-
'আমরা কি নাম স্মরণ করবো?' পূর্বে বলেছি
পরমেশ্বরের গুণ, কর্ম ও স্বভাব যেহেতু অনন্ত,
সেহেতু ওনার নামও অনন্ত। যদিও পূর্বে বেদ
থেকে দেখিয়েছি, তারপরও একটা কথা
থেকে যায় যে, গীতা এই ব্যাপারে কি বলে?
তাও একটু দেখে নেওয়া যাক! আমরা সকলেই
জানি অর্জুন ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের সখা, বন্ধু
তথা সবচেয়ে প্রিয়পাত্র। আর সেই অর্জুনই
কিন্তু নাম স্মরণের ব্যাপারে মূল প্রশ্নটা
তুলে দিয়েছেন গীতাতে! দেখে নেওয়া যাক
সেটি কি-
.
"আপনার এরূপ মহিমা না জেনে প্রমাদবশত,
কখনো বা ভালোবেসে সখা মনে করে
আপনাকে হে কৃষ্ণ , ওহে যাদব, সখা বলে
অবিনয়ে সম্বোধন করে যা বলেছি। বিহার
শয্যা উপবেশন ও ভোজনকালে একাকী
আপনার সাক্ষাতে বা অসাক্ষাতে বা বহুজন
সমক্ষে পরিহাসচ্ছলে আপনাকে যে অসম্মান
বা অমর্যাদা করেছি, আপনার কাছে তার
জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। পিতা যেমন পুত্রের,
সখা যেমন সখার, প্রিয় যেমন প্রিয়ার অপরাধ
ক্ষমা করে, আপনিও সেরূপ আমার অপরাধ
ক্ষমা করুন।"
গীতা ১১/৪১,৪২,৪৪.
.
এর থেকে বুঝা যায় যে, যেন তেন নাম স্মরণ
(হরে কৃষ্ণ এর মত) করলেই নাম যজ্ঞ হয়ে
যাবে না, কারণ প্রত্যকটা ব্যাপারেরই একটা
বিধি নিষেধ আছে। তাই তো শ্রীভগবান
গীতায় বলেছেন-
"কর্তব্য অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার
একমাত্র প্রমাণ। তাই এই সংসারে শাস্ত্র
বিধান উক্ত কর্ম করা উচিত।" গীতা ১৬/২৪.
.
তাই আমাদের দেখতে হবে যে নাম যজ্ঞের
ব্যাপারে শাস্ত্র/গীতা উক্ত বিধান কি।
গীতায় শ্রীভগবান এই ব্যাপারে বলেছেন-
.
" # প্রণবঃ সর্ববেদেষু শব্দঃ ।" গীতা ৭/৮।।
অর্থাৎ সর্ব বেদের প্রণব(ওম্)।
" ওম্ এই এক অক্ষর ব্রহ্ম উচ্চারণ করে
আমাকে অনুস্মরণ করে যিনি দেহ ত্যাগ
করেন, তিনি পরম গতি লাভ করেন।" গীতা
৮/১৩.
"যা অব্যক্ত অক্ষর বলে কথিত হয়, তাঁকেই
পরম গতি বলে। গীতা ৮/২১.
"আমি এই জগতের পিতা, মাতা, ধাতা,
পিতামহ এবং একমাত্র জ্ঞেয়,
পবিত্রওঙ্কার, আমি ঋক্ সাম যজুর্বেদ।"
গীতা ৯/১৭.
"শব্দসমূহের মধ্যে আমিই এক অক্ষর
যজ্ঞসমূহের মধ্যে আমি জপযজ্ঞ...।"
গীতা১০/২৫.
"সামমন্ত্র_সমূহের_মধ্যে_আমি_বৃহৎসাম,
গায়ত্রী ছন্দসামহম্ অর্থাৎ মন্ত্রের(ছন্দ) মধ্যে
আমি গায়ত্রী।" গীতা ১০/৩৫.
ওঁ তৎ সৎ এই নির্দেশ নাম তিনটি ব্রহ্মের,
এরূপ বলা আছে। এই নাম দিয়ে পুরাকালে
যজ্ঞের কর্তা ব্রাহ্মণ, যজ্ঞের কারণ বেদ ও
যজ্ঞররূপ ক্রিয়া নির্মিত হয়েছে। গীতা
১৭/২৩.
.
গীতা থেকে মোট সাতবার দেখা যায় যে,
নাম স্মরণের ব্যাপারে শ্রীভগবান "ওম্" জপ
করার জন্য বলেছেন, অর্থাৎ আজকাল কিছু
কিছু সম্প্রদায় যে নাম যজ্ঞ করে তা
তামসিক নাম যজ্ঞ। কারণ সেখানে
শাস্ত্রের নির্দেশনা অনুসারে নাম যজ্ঞ
হচ্ছে না। বরংচ নিজেদের তৈরি বিধান
অনুসারে তথাকথিত নাম যজ্ঞ হচ্ছে,
যেখানে অর্জুনও যেন তেন নামে ডাকার
জন্য ক্ষমা চেয়েছেন, যেখানে এরা এই রকম
সাহস দেখায় কি করে? তারা বলে ভগবান হল
ভক্তির কাঙ্গাল, তাই ভক্ত যে নামেই ডাকুক
না কেন কোন সমস্যা নেই। এখন তাদের প্রতি
আমার প্রশ্ন-বুঝলাম ভগবান হল ভক্তের
কাঙ্গাল। তাই বলে আপনি এক জন ভক্ত হয়ে
কেন আপনার প্রিয় ভগবানকে ওনার প্রকৃত
নামে ডাকবেন না? যেখানে উনি নিজেই
বলেছেন ওনার প্রকৃত নাম কি। ধরুন আপনি
আপনার বাবাকে খুব ভালোবাসেন, বাবা
আপনাকে শিক্ষা দিয়ে বলছেন যে- খোকা
আমাকে তুমি "বাবা" বলে ডেকো। আপনি
"বাবা" বলে না ডেকে ওনাকে হাবা, বোবা,
গাধা ইত্যাদি নামে ডাকলে কি উনি খুশি
হবে? নাকি মনে কষ্ট পাবেন? যদি বলেন
যে-'আমরা তো জানি না ভগবানের প্রকৃত
নাম কি!' তাদের উদ্দ্যেশে এটাই বলতে
চাই-'এখন তো জেনেছেন প্রকৃত নাম কি?'
তাহলে এখন থেকেই প্রকৃত নামে ডাকুন। কেন
অযথা নিত্য নতুন সম্প্রদায় তৈরির লক্ষে
ভগবানকে নিত্য নতুন নিজেদের সৃষ্ট নামে
ডাকছেন? এগুলো তো ভালো লক্ষণ নয়,
তাইতো গীতায় ভগবান বলেছেন-
.
"শাস্ত্র বিধান না মেনে, অন্ন ও দান না
করে, যথাযথ মন্ত্র উচ্চারণ না করে,
দক্ষিনা না দিয়ে, শ্রদ্ধাহীন ভাবে যে যজ্ঞ
করা হয় তাকে তামস যজ্ঞ বলা হয়।" গীতা
১৭/১৩.
"যজ্ঞ করাই কর্তব্য এই ভাবে মন স্থির করে
ফলাকাঙ্ক্ষা না করে শাস্ত্রের নির্দেশনা অনুসারে যে যজ্ঞ করা হয় তাই
সাত্ত্বিক যজ্ঞ।" গীতা ১৭/১১.
.
মনে রাখা উচিত-
"বেদমুখে এরূপ বহুবিধ যজ্ঞ বিহিত হয়েছে।
সে সকলই কর্ম জাত বলে জানবে, এরূপ যেনে
মুক্তি লাভ করবে। দ্রব্য যজ্ঞ অপেক্ষা
জ্ঞানরূপ যজ্ঞ প্রশস্ততর। সকল কর্ম
নির্বিশেষে জ্ঞানে গিয়েই শেষ হয়।" গীতা
৪/৩২,৩৩.
"সকল পাপী অপেক্ষাও যদি তুমি অধিক
পাপী হও, তা হলেও জ্ঞনরূপ ভেলার দ্বারা
তুমি পাপ সমূদ্র অতিক্রম করতে পারবে। এই
জগতে জ্ঞানের সদৃশ পবিত্র আর কিছুই নেই।
নিজের চেষ্টাকৃত যোগ বলে দীর্ঘ কাল পর
নিজের আত্মাতেই সেই জ্ন লাভ করে
থাকেন।"
গীতা ৪/৩৬,৩৮.
.
পরিশেষে এটাই বলতে চাই যে, যারা বলে
'নাম যজ্ঞ ঠিক নয়' এই কথাটা যেমন
অজ্ঞনতা। ঠিক তেমনি যারা শাস্ত্র অমান্য
করে নাম যজ্ঞ করে তদের নাম যজ্ঞও
সাত্ত্বিক নাম যজ্ঞ নয়, শাস্ত্র উক্ত নাম
যজ্ঞ নয়, তা তামসিক নাম যজ্ঞ। কারণ
তাদের সেই তথাকথিত নাম যজ্ঞের জপ
করার অক্ষর ও মন্ত্র এর কোনটাই বেদ,
উপনিষদ, বেদান্ত সূত্র, গীতা ইত্যাদি বৈদিক
শাস্ত্র উক্ত নয়।
র্মাণি প্রথমান্যসন্ ।
তে হ নাকং মহিমানঃ সচন্ত য়ত্র পূর্বে সাধ্যাঃ সন্তিদেবাঃ ।।
ঋগবেদ ১০/৯০/১৬.
অর্থাৎ সত্য নিষ্ঠ বিদ্বানেরা যজ্ঞের
দ্বারাই পরমেশ্বরের পূজা করেন। যজ্ঞে সব
শ্রেষ্ঠ ধর্মের সমাবেশ হয়। মহান ব্যক্তিরা
যজ্ঞ দ্বারা ভগবানের পূজা করে দুঃখরহিত
হয়ে মোক্ষ লাভ করেন। সাধন সাধন সম্পন্ন ও
জ্ঞান সম্পন্ন বিদ্বানেরা যেখানে পূর্ব
হতেই বাস করছেন।
.
এই সবই উপরোক্ত মন্ত্রের উল্লেখ যোগ্য
বিষয়। এখানে বুঝতে হবে যে 'যজ্ঞ' শব্দ 'যজ্'
ধাতু থেকে তৈরি হয়েছে। যার তিনটি অর্থ
ধাতু পাঠে বর্ণিত আছে- ১.দেবপূজা,
২.সংগতিকরণ ৩.দান। এর মধ্যেই আমাদের
সকল কর্তব্য নিহিত আছে। এই জন্য
শতপথ ব্রাহ্মণ ১/৭/৩/৫. এ বলা আছে-
" যজ্ঞো বৈ শ্রেষ্ঠতমং কর্ম ।"
আবার
তৈত্তিরীয়_সংহিতা ৩/২/১/৪. নং এ আছে-
" যজ্ঞো হি শ্রেষ্ঠতমং কর্ম ।
এই সব
ক্ষেত্রে যজ্ঞকে শ্রেষ্ঠতম কর্ম বলে
অভিহিত করা হয়েছে, গীতাতেও এরূপই বলা
আছে। আর যারা যজ্ঞ করে না তাদের কি
দুর্গতি ও অধপতন হয় তা দেখুন-
.
" ন য়ে শেকুর্য়াজ্ঞিয়াং নাবমারুহম্ ইর্মেব
তে ন্যবিশন্ত কেপয়ঃ ।"
ঋগবেদ ১০/৪৪/৬. অথর্ববেদ ২০/৯৪/৬.
অর্থাৎ যে ব্যক্তিরা যজ্ঞময়ি নৌকায়
আরোহন করতে সক্ষম হয় না, তারা কুৎসিৎ
অপবিত্র আচরণকারী হয়ে এই লোকেই ক্রমশঃ
অধপতিত হতে থাকে।
.
যজ্ঞ আবার ৫ প্রকার, মহর্ষি মনু মহারাজ
মনুসংহিতা ২/২৮ নং শ্লোকে বলেছেন-
"মহায়জ্ঞৈশ্চ য়জ্ঞৈশ্চ ব্রাহ্মীয়ং ক্রিয়তে
তনুঃ।
অর্থাৎ পঞ্চমহাযজ্ঞ ও সোমযজ্ঞের
অনুষ্ঠানে দ্বারা মানুষ ব্রহ্ম প্রাপ্তির যোগ্য
হয়ে যায়।
.
এই পঞ্চমহা যজ্ঞ হল- ব্রহ্মযজ্ঞ দেবযজ্ঞ
পিতৃযজ্ঞ অতিথিযজ্ঞ
বলিবৈশ্যদেবযজ্ঞ । যেহেতু প্রশ্নের
আলোচ্য বিষয় হল নাম যজ্ঞ, তাই আলোচনা
অন্যদিকে না নিয়ে শুধু নাম যজ্ঞ নিয়েই
করছি। প্রকৃত পক্ষে নাম যজ্ঞ ব্রহ্মযজ্ঞ এর
অন্তর্গত, প্রশ্ন হতে পারে এটা আবার কিরূপ?
তাই এই ব্যাপারে একটু বিস্তারি লিখা
দরকার বলে মনে করি।
.
ব্রহ্মযজ্ঞের দুইটি ভাগ-
১.সন্ধ্যা-উপাসনা,
প্রাতকালীন ও সায়ংকালীন ঈশ্বর_স্তুতি ,
প্রার্থনা ও উপাসনা করা।
২.স্বাধ্যায় করা।
প্রথম ভাগে বর্ণিত ঈশ্বর স্তুতির মধ্যেই মূলত
সেই নামযজ্ঞ বিদ্যমান! হোম যজ্ঞের
ব্যাপারে বেদ উপনিষদ গীতা ইত্যাদি সকল
শাস্ত্রেই বলা আছে স্পষ্ট ভাবে, তা আপনিও
জানেন। নাম যজ্ঞের ব্যাপারে খুব স্পষ্ট
ভাবে বলা নেই, তাই এই ব্যাপারটাই তুলে
ধরছি এখানে।
.
প্রশ্ন হল ঈশ্বরের স্তুতি বা নাম স্মরণ করলে
কি হয়? উত্তরও খুব পরিষ্কার, ঈশ্বরের স্তুতি
বা নামের স্মরণ দ্বারা ঈশ্বরের প্রতি
প্রীতি জম্মে। ওনার গুণ, কর্ম ও স্বভাব
দ্বারা নিজের গুণ, কর্ম ও স্বভাবের সংশোধন
হয়। যেমন কিনা বলা চলে পরমেশ্বরের একটা
নাম তৈজস । কেহ যদি ইচ্চা করে ওনাকে এই
নামে স্মরণ করতে পারে এবং নিজের মধ্যে
তেজ স্থাপন করতে পারে। একটু বেদ মন্ত্রের
মাধ্যমে ওনার স্তুতি করছি-
"তেজোহসি তেজো ময়ি দেহি অর্থাৎ হে
তেজস্বী! আমাতে তেজ স্থাপন করুন।"
যজুর্বেদ ১৯/৯.
.
এইরূপ পরমেশ্বরের অনন্ত নাম যথা- ব্রহ্ম,
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, রুদ্র, গণেশ, দেব, দেবী,
বুদ্ধ, শ্রী, লক্ষী, সরস্বতী, দয়াল, অদ্বৈত, যম,
শংকর, মহাদেব, বিশ্বকর্মা, অগ্নি, মনু,
প্রজাপতি, প্রাণ, ইন্দ্র, ঈশ্বর, পরমাত্মা, সত্য,
মিত্র... ইত্যাদি স্মরণ হতে পরে, আর একেই
নাম যজ্ঞ বলে। তবে পরমেশ্বরের অনন্ত
নামের মধ্যেও একটি নাম আছে যার স্মরণের
কথা সর্ব শাস্ত্রেই বর্ণিত আছে। আর তা হল
"ওম্", বেদ মন্ত্র থেকেই দেখি-
.
"ওমিত্যেতদক্ষরমুদ্গীথমুপাসতি।
ছান্দোগ্যোপনিষদ্ ১/১/১.
অর্থাৎ "ওম্" এই অক্ষরকে (যিনি কখনো
বিনষ্ট হন না) উপাসনা করিবে, কারণ "ওম্" এই
শব্দ হতে আরম্ভ করে উদগীথ গান করেন।
.
"ওম্ বায়ুরনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম্।
ওম্ ক্রতো স্মর কৃতং স্মর ক্রতো স্মর কৃতং
স্মর।।" যজুর্বেদ ৪০/১৫
ভাবার্থ- হে কর্মশীল জীব! শরীর পৃথক
হওয়ার সময় তুমি "ওম্" এর স্মরণ কর, নিজ
সামথ্যের জন্য ওম্ স্মরণ কর, কৃত কর্মকে স্মরণ
কর, ধনঞ্জয়াদি বায়ু নিজ কারণরূপে পরিণত
হতেই এই শরীর ভস্ম হয়ে যায়।
.
আপনি যেহেতু প্রশ্ন করেছেন গীতার উপর,
তাই সেখান থেকেই এখন নাম স্মরণের
ব্যাপারে তুলে ধরছি। প্রশ্ন থেকে যায় যে-
'আমরা কি নাম স্মরণ করবো?' পূর্বে বলেছি
পরমেশ্বরের গুণ, কর্ম ও স্বভাব যেহেতু অনন্ত,
সেহেতু ওনার নামও অনন্ত। যদিও পূর্বে বেদ
থেকে দেখিয়েছি, তারপরও একটা কথা
থেকে যায় যে, গীতা এই ব্যাপারে কি বলে?
তাও একটু দেখে নেওয়া যাক! আমরা সকলেই
জানি অর্জুন ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের সখা, বন্ধু
তথা সবচেয়ে প্রিয়পাত্র। আর সেই অর্জুনই
কিন্তু নাম স্মরণের ব্যাপারে মূল প্রশ্নটা
তুলে দিয়েছেন গীতাতে! দেখে নেওয়া যাক
সেটি কি-
.
"আপনার এরূপ মহিমা না জেনে প্রমাদবশত,
কখনো বা ভালোবেসে সখা মনে করে
আপনাকে হে কৃষ্ণ , ওহে যাদব, সখা বলে
অবিনয়ে সম্বোধন করে যা বলেছি। বিহার
শয্যা উপবেশন ও ভোজনকালে একাকী
আপনার সাক্ষাতে বা অসাক্ষাতে বা বহুজন
সমক্ষে পরিহাসচ্ছলে আপনাকে যে অসম্মান
বা অমর্যাদা করেছি, আপনার কাছে তার
জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। পিতা যেমন পুত্রের,
সখা যেমন সখার, প্রিয় যেমন প্রিয়ার অপরাধ
ক্ষমা করে, আপনিও সেরূপ আমার অপরাধ
ক্ষমা করুন।"
গীতা ১১/৪১,৪২,৪৪.
.
এর থেকে বুঝা যায় যে, যেন তেন নাম স্মরণ
(হরে কৃষ্ণ এর মত) করলেই নাম যজ্ঞ হয়ে
যাবে না, কারণ প্রত্যকটা ব্যাপারেরই একটা
বিধি নিষেধ আছে। তাই তো শ্রীভগবান
গীতায় বলেছেন-
"কর্তব্য অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার
একমাত্র প্রমাণ। তাই এই সংসারে শাস্ত্র
বিধান উক্ত কর্ম করা উচিত।" গীতা ১৬/২৪.
.
তাই আমাদের দেখতে হবে যে নাম যজ্ঞের
ব্যাপারে শাস্ত্র/গীতা উক্ত বিধান কি।
গীতায় শ্রীভগবান এই ব্যাপারে বলেছেন-
.
" # প্রণবঃ সর্ববেদেষু শব্দঃ ।" গীতা ৭/৮।।
অর্থাৎ সর্ব বেদের প্রণব(ওম্)।
" ওম্ এই এক অক্ষর ব্রহ্ম উচ্চারণ করে
আমাকে অনুস্মরণ করে যিনি দেহ ত্যাগ
করেন, তিনি পরম গতি লাভ করেন।" গীতা
৮/১৩.
"যা অব্যক্ত অক্ষর বলে কথিত হয়, তাঁকেই
পরম গতি বলে। গীতা ৮/২১.
"আমি এই জগতের পিতা, মাতা, ধাতা,
পিতামহ এবং একমাত্র জ্ঞেয়,
পবিত্রওঙ্কার, আমি ঋক্ সাম যজুর্বেদ।"
গীতা ৯/১৭.
"শব্দসমূহের মধ্যে আমিই এক অক্ষর
যজ্ঞসমূহের মধ্যে আমি জপযজ্ঞ...।"
গীতা১০/২৫.
"সামমন্ত্র_সমূহের_মধ্যে_আমি_বৃহৎসাম,
গায়ত্রী ছন্দসামহম্ অর্থাৎ মন্ত্রের(ছন্দ) মধ্যে
আমি গায়ত্রী।" গীতা ১০/৩৫.
ওঁ তৎ সৎ এই নির্দেশ নাম তিনটি ব্রহ্মের,
এরূপ বলা আছে। এই নাম দিয়ে পুরাকালে
যজ্ঞের কর্তা ব্রাহ্মণ, যজ্ঞের কারণ বেদ ও
যজ্ঞররূপ ক্রিয়া নির্মিত হয়েছে। গীতা
১৭/২৩.
.
গীতা থেকে মোট সাতবার দেখা যায় যে,
নাম স্মরণের ব্যাপারে শ্রীভগবান "ওম্" জপ
করার জন্য বলেছেন, অর্থাৎ আজকাল কিছু
কিছু সম্প্রদায় যে নাম যজ্ঞ করে তা
তামসিক নাম যজ্ঞ। কারণ সেখানে
শাস্ত্রের নির্দেশনা অনুসারে নাম যজ্ঞ
হচ্ছে না। বরংচ নিজেদের তৈরি বিধান
অনুসারে তথাকথিত নাম যজ্ঞ হচ্ছে,
যেখানে অর্জুনও যেন তেন নামে ডাকার
জন্য ক্ষমা চেয়েছেন, যেখানে এরা এই রকম
সাহস দেখায় কি করে? তারা বলে ভগবান হল
ভক্তির কাঙ্গাল, তাই ভক্ত যে নামেই ডাকুক
না কেন কোন সমস্যা নেই। এখন তাদের প্রতি
আমার প্রশ্ন-বুঝলাম ভগবান হল ভক্তের
কাঙ্গাল। তাই বলে আপনি এক জন ভক্ত হয়ে
কেন আপনার প্রিয় ভগবানকে ওনার প্রকৃত
নামে ডাকবেন না? যেখানে উনি নিজেই
বলেছেন ওনার প্রকৃত নাম কি। ধরুন আপনি
আপনার বাবাকে খুব ভালোবাসেন, বাবা
আপনাকে শিক্ষা দিয়ে বলছেন যে- খোকা
আমাকে তুমি "বাবা" বলে ডেকো। আপনি
"বাবা" বলে না ডেকে ওনাকে হাবা, বোবা,
গাধা ইত্যাদি নামে ডাকলে কি উনি খুশি
হবে? নাকি মনে কষ্ট পাবেন? যদি বলেন
যে-'আমরা তো জানি না ভগবানের প্রকৃত
নাম কি!' তাদের উদ্দ্যেশে এটাই বলতে
চাই-'এখন তো জেনেছেন প্রকৃত নাম কি?'
তাহলে এখন থেকেই প্রকৃত নামে ডাকুন। কেন
অযথা নিত্য নতুন সম্প্রদায় তৈরির লক্ষে
ভগবানকে নিত্য নতুন নিজেদের সৃষ্ট নামে
ডাকছেন? এগুলো তো ভালো লক্ষণ নয়,
তাইতো গীতায় ভগবান বলেছেন-
.
"শাস্ত্র বিধান না মেনে, অন্ন ও দান না
করে, যথাযথ মন্ত্র উচ্চারণ না করে,
দক্ষিনা না দিয়ে, শ্রদ্ধাহীন ভাবে যে যজ্ঞ
করা হয় তাকে তামস যজ্ঞ বলা হয়।" গীতা
১৭/১৩.
"যজ্ঞ করাই কর্তব্য এই ভাবে মন স্থির করে
ফলাকাঙ্ক্ষা না করে শাস্ত্রের নির্দেশনা অনুসারে যে যজ্ঞ করা হয় তাই
সাত্ত্বিক যজ্ঞ।" গীতা ১৭/১১.
.
মনে রাখা উচিত-
"বেদমুখে এরূপ বহুবিধ যজ্ঞ বিহিত হয়েছে।
সে সকলই কর্ম জাত বলে জানবে, এরূপ যেনে
মুক্তি লাভ করবে। দ্রব্য যজ্ঞ অপেক্ষা
জ্ঞানরূপ যজ্ঞ প্রশস্ততর। সকল কর্ম
নির্বিশেষে জ্ঞানে গিয়েই শেষ হয়।" গীতা
৪/৩২,৩৩.
"সকল পাপী অপেক্ষাও যদি তুমি অধিক
পাপী হও, তা হলেও জ্ঞনরূপ ভেলার দ্বারা
তুমি পাপ সমূদ্র অতিক্রম করতে পারবে। এই
জগতে জ্ঞানের সদৃশ পবিত্র আর কিছুই নেই।
নিজের চেষ্টাকৃত যোগ বলে দীর্ঘ কাল পর
নিজের আত্মাতেই সেই জ্ন লাভ করে
থাকেন।"
গীতা ৪/৩৬,৩৮.
.
পরিশেষে এটাই বলতে চাই যে, যারা বলে
'নাম যজ্ঞ ঠিক নয়' এই কথাটা যেমন
অজ্ঞনতা। ঠিক তেমনি যারা শাস্ত্র অমান্য
করে নাম যজ্ঞ করে তদের নাম যজ্ঞও
সাত্ত্বিক নাম যজ্ঞ নয়, শাস্ত্র উক্ত নাম
যজ্ঞ নয়, তা তামসিক নাম যজ্ঞ। কারণ
তাদের সেই তথাকথিত নাম যজ্ঞের জপ
করার অক্ষর ও মন্ত্র এর কোনটাই বেদ,
উপনিষদ, বেদান্ত সূত্র, গীতা ইত্যাদি বৈদিক
শাস্ত্র উক্ত নয়।
0 মন্তব্য(গুলি)