এই আর্যাবর্তের দূর্ভাগ্য যে, বিদ্বানের কম হওয়ার কারনে সত্য অসত্যের নির্ধারন ঠক, কপট, চালাক তথাকথিত স্বয়ম্ভূ ধর্মের ঠিকাদারীরা নিয়ে নিয়েছে। এ কারনে মহাপুরুষ দের বদনাম শুরু হয়েছে। সত্য ইতিহাসের বদনাম প্রচার হয়েছে। ইতিহাসের নামে বিভিন্ন কপোলকল্পিক গল্প প্রচারিত হয়েছে। ওইরূপ তেমনি এক কথা রামায়ন মধ্যে যুক্ত হয়েছে -
লক্ষ্মণ রেখা -
যা মহানুভাব লক্ষ্মণ জী সীতা মাতার জন্য একেছিলো। লোকমুখে এরকম ঘটনা প্রচলিত যে, মাতা সীতার জন্য যখন শ্রীরাম চন্দ্র হরিণ ধরতে গেলেন। এর কিছুক্ষন পর এক আর্তনাদ শোনা যায়, ঠিক শ্রীরাম চন্দ্রের কন্ঠের মতো। এতে সীতার মনে শঙ্কা হয় যে, নিশ্চয় শ্রীরামচন্দ্র বিপদে পড়েছেন। তখন তিনি লক্ষ্মণ কে বড় ভাইয়ের রক্ষার জন্য যেতে বিবশ করেন। তারপর লক্ষ্মণ জী সীতা মাতার জন্য একটি রেখা টেনে যান। যা সীতা মাতাকে একটি নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করে।
মূলত কি ঘটনা তাই ছিলো? আসুন এক নজরে বাল্মীকি রামায়নের উপর আরোপকৃত এই লোকক্তির সত্যতা জানি -
রামায়নের মতো মহাকাব্য ঋষি বাল্মীকি লিখেছে। এই মহাকাব্য এতটাই মহান যে, পরবর্তীতে অনেক কবিও এই মহাকাব্য নিজ ভাষায় রচনা করেছেন। কিন্তু আমাদের চিন্তা রাখা আবশ্যক যে, রামায়ন বিষয়ের প্রামানিকতা কেবল বাল্মীকি ঋষি দ্বারা রচিত বাল্মিকী রামায়ানই। দেখুন বাল্মীকি রামায়নে কি লেখা রয়েছে -
গচ্ছামি যত্র কাকুস্থ স্বস্তি তেহস্ত বরাননে।
রক্ষন্ত ত্বাৎ বিশালাক্ষি সমগ্না বনদেবতা।।
(অরণ্যকান্ড, ৪৫।৩৪)
হে বিশাললোচনে কাকুস্থ রাম যেখানে আছে আমি সেখানে যাচ্ছি। আপনার মঙ্গল হোক, সমস্ত বন দেবতা আপনাকে রক্ষা করুন।
মাতা সীতা লক্ষন জীর এরুপ বচন শুনে ব্যথিত হয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন যে, শ্রী রাম ব্যতিরেকে আমি নদীতে নিমগ্ন হবো অথবা উচ্চ থাকে বন্ধুর সাথে পড়ে আত্ম বিসর্জন করবো। তীব্র বিষ পান করবো অথবা অগ্নিতে প্রবেশ করবো। কিন্তু কোন পর পুরুষকে স্পর্শ করবো না।
(অরণ্যকান্ড ৪৫।৩৬-৩৭)
মাতা সীতার প্রতিজ্ঞা শুনে তিনি আর্ত হয়ে তাকে সান্তনা দিলেন। কিন্তু সীতা কোন প্রত্যুত্তর করলেন না। অতঃপর তিনি মাতা সীতাকে প্রণাম করে রামচন্দ্রের কাছে চলে গেলে।
(অরণ্যকান্ড ৪৫।৩৯-৪০)
পুরো প্রকরনে এমন কোন ঘটনা আসে নি যেখানে লক্ষ্মণ জী কোন রেখা টেনেছিলো। বরং তিনি বনদেবতার কাছে মাতা সীতাকে সঁপে দিয়ে চলে যান। যদি কোন রেখা টেনে মাতা সীতার সুরক্ষা সুনিশ্চিত হতো তবে লক্ষ্মন মাতা সীতার মার্মিক বচন শুনে বিবশ না হয়ে শ্রীরামের কাছে রেখা টেনে চলে যেতেন।
অতএব, বাল্মিকী রামায়নে লক্ষ্মণ রেখার কোন অস্তিত্বই নেই । এখন তবে অন্য রামায়নের আধারে ঘটনার নিরীক্ষন করা যাক -
আর এক মান্য গ্রন্থ আজ হিন্দু সমাজে বাল্মিকী রামায়ন থেকেও অধিক বেশী প্রচলিত তাহা তুলসীদাস জী কৃত "রামচরিতমানস্"। কিন্তু এই গ্রন্থেও লক্ষ্মণ রেখার কোন বিবরন আসে নি।
অরণ্যকান্ডে সীতা হরনের প্রসঙ্গে সীতা জী দ্বারা লক্ষ্মন জী কে মর্ম বচন বলার পর লক্ষ্মণ জী তাকে বন এবং দিশা আদির কাছে সপে রামের নিকট চলে যান-
পরম বচন জব সীতা বোলা। হরি প্রেরিত লছিমন মন ডোলা।।
বন দিসি সৌঁপে সব কাহূ। চলে জঁহা রাবন সসি রাহু।।
(রামচরিতমানস, অরণ্যকান্ড চৌপায় ২-৮)
এখানেও লক্ষ্মণ জী দ্বারা কোন রেখা টানা এবং তাহা লঙ্ঘনের কোন উল্লেখ নেই। যখন কোন লক্ষ্মণ রেখার উল্লেখ কোন মান্য গ্রন্থ করেন নি তখন কিভাবে রামায়নে রামায়নে লক্ষ্মণ রেখা প্রচলিত হলো?
আসুন এক বিচার ইহার উপর রাখি -
লক্ষ্মণ রেখার অর্থ কোন পঞ্চবটি কুটিরের দ্বারে অঙ্কিত কোন রেখা নয় বরং প্রত্যেক নর নারীর জন্য ঋষি দ্বারা বর্ণিত নিয়ম এবং নির্ধারিত আদর্শ লক্ষণ প্রতীত হয়। এখানে নারী মাত্রের জন্য নয় বরং সম্পূর্ণ মানব জাতির জন্য আবশ্যক যে বিপত্তিকালে ধৈর্য রাখবে। কিন্তু মাতা সীতা শ্রীরামের প্রতি অগাধ প্রেমের কারন মারীচের কন্ঠ দ্বারা শ্রী রামের আওয়াজে ভ্রমিত হয়ে যান। এবং শ্রীরাম দ্বারা লক্ষণ জী কে দেওয়া আদেশের আজ্ঞা উলঙ্ঘন হেতু লক্ষ্মণ জী বিবশ থাকেন। তখন মাতা সীতা লক্ষ্মণ জীকে মর্মী বচন বলেন। মাতা সীতা সেই সময়ে শ্রীরামের আজ্ঞা পালনকারী তৎপর দেবর শ্রী লক্ষ্মণ কে যে, মার্মিক বচন বলেন তাহাই মাতা সীতা দ্বারা সুলক্ষণ রেখার উলঙ্ঘন বলা যায় তো উচিৎ মনে হয়।
কারণ মাতা সীতা স্বয়ং স্বীকার করেছেন -
হা লছিমন তুমহারা নহিঁ দোসাঃ। সো ফলু পায়উ কীনহেউঁ রোসা।।
(রামচরিতমানস অরণ্যকান্ড, চৌপায় ২-১২)
অর্থাৎ হে লক্ষ্মণ তোমার কোন দোষ নেই। আমিই রুষ্ট হয়েছি ও কুকথা বলেছি এবং তার ফল ভোগ করছি।
নিষ্কর্ষ রূপে বলা যায় যে, লক্ষ্মণ রেখা কে সীতা হরণের সন্দঁর্ভে উল্লেখিত করে স্ত্রীর মর্যাদিত আচরন মাত্রে যুক্ত করে দেখা যায় তো ইহা সমস্ত মানব জাতির জন্য নির্ধারিত সুলক্ষণ রেখার সীমাকে নির্দেশ করে। যা পার করলে মানব মাত্রকেই কষ্ট ভোগ করতে হয়।
0 মন্তব্য(গুলি)