প্রশ্ন- জগতে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যা আচরণ ও
প্রমাণ করে সাধারণ লোক সেরূপই আচরণ করে
এবং প্রমাণিক বলে স্বীকার করে, এটা তো
গীতারই বাণী। তাহলে কেন আমরা জগতের
শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণের আচরণ ও প্রমাণগুলোকে
স্বীকার করবো না?
উত্তর- এটাই তো স্বাভাবিক, গীতায় তো
স্বীকার করার জন্য বলছে না, বলা হয়েছে
সাধারণ লোক স্বীকার করে। তাছাড়া প্রকৃত
পক্ষেই যিনি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি তাকে অনুসরণ
করলে খুব একটা ক্ষতি হয় না, লাভই হয়।
গীতায় বলা আছে
.
"য়দ্ য়দ্ আচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।
স য়ৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে।।"
গীতা ৩/২১.
অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যা যা আচরণ করেন,
সাধারণেরা সেরূপই আচরণ করে। তিনি যা
প্রমাণিক করেন, লোকেরা তারই অনুবর্তন
করে।
.
কিন্তু তাই বলে কি যাকে তাকে শ্রেষ্ঠ
ব্যক্তি হিসেবে স্বীকার করা উচিত?
.
আাশ্চর্য জনক বিষয় হল প্রতিটি মানুষই
স্বতন্ত্র থাকে মিত্র, তুমিও স্বতন্ত্র আমিও
স্বতন্ত্র। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় আমরা
বুদ্ধি পূর্বক বিচার করি না। না আমরা ধর্মের
বিচার করি, না করি অধর্মের বিচার। বরংচ
দেখা যায়, আমরা নিজ থেকে জ্ঞানবান বা
বলবান ব্যক্তিকে আমাদের কর্তী স্থানীয়
মনে করি। অন্ধ অনুকরণ করি, গুরুর অনুকরণ
শিষ্য করে, তেমনি রাজার অনুকরণ প্রজারা
করে। যদি এই গুরু ও রাজারাই ধর্ম পথে না
চলে, তাহলে তাদের দেখানো পথেই সকলে
অধর্মের দিকে ধাবিত হয়। ফলে সংসারে
নেমে আসে ঘোর অন্ধকার, কুসংস্কারে
চেয়ে যায় সমগ্র সংসার। এখানেই প্রয়োজন
শাস্ত্রের, কারণ শাস্ত্রই তখন সঠিক মার্গ
দেখাতে পারে। তাই তো গীতায় ভগবান
ঘোষণা করেছেন-
.
"তাই কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই
(বেদই) তোমার একমাত্র প্রমাণ। তাই
সংসারে শাস্ত্র বিধান উক্ত কর্ম করা
উচিত।" গীতা ১৬/২৪.
.
একটু চিন্তা করে দেখতো মিত্র! তুমি যাকে
গুরু বা শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলে স্বীকার করছো,
অথবা এই সংসারের মনুষ্য যাদেরকে শ্রেষ্ঠ
ব্যক্তি বলে স্বীকার করে তাদের অনুসরণ
করছে। তারা কি শাস্ত্রো উক্ত কর্ম করছে?
নাকি তথাকথিত অন্ধ পরাম্পরায় ও প্রথায়
বিশ্বাসী হয়ে জীবন যাপন করছে? প্রথা ও
পরাম্পরা অবশ্যই ভালো, তবে তা ততক্ষণই
ভালো যতক্ষণ তা শাস্ত্রের সাথে
সংগতিপূর্ণ থাকে। কিন্তু যখনই তা শাস্ত্র
বহির্ভূত হয় তখনই এতে বিপদ দেখা দেয়, আর
তখনই প্রয়োজন হয় সংস্কারের।
.
পরাম্পরার মধ্যে ধর্মের অবস্থান, আর প্রথাই
ধর্মকে ধরে রাখার দ্বায়িত্ব বহন করে।
বিবেচনা করে দেখ মিত্র! সত্য এই যে, যেমন
ভাবে পাষাণের ভেতরে শিল্প থাকে, ঠিক
তেমনি প্রথার মধ্যেও ধর্মকে পাওয়া যায়।
পাথরের মধ্যে শিল্প আছে কিন্তু পাথরটা
শিল্প নয়, ঠিক তেমনি প্রথার মধ্যে ধর্ম আছে
কিন্তু প্রথাটা ধর্ম নয়। আর পাথরের মধ্যে
শিল্পকে ফুটিয়ে তুলতে হলে পাথরকে
ভাংতে হয়, অপ্রয়োজনিয় অংশকে বাদ
দিতে হয়। মনেরেখো- "প্রথা পালনে যে
বেশী গোড়ামী করে, সে ধর্ম থেকে বঞ্চিত
হয়ে যায়, আর পরাম্পরার অন্ধ অনুকরণ যে
করে, সেও প্রকৃত ধর্ম পরায়ন হতে পারে না।"
.
তাই বলে এমন নির্মম ভাবে সংস্কার করতে
হবে?
হে মিত্র! বিশাক্ত ফল দানকারী বৃক্ষকে
স্বমূলে উপড়ে না ফেললে তা থেকে আরো
অনেক নূতন বৃক্ষ জম্ম নিবে। আর এতে করে
বর্তমান তো বটেই, ভবিষ্যৎও বিষাক্ত হয়ে
যাবে। সেই বৃক্ষের ঢাল পালা কেটে কিছুটা
ছোট করলেও তার থেকে মুক্তি সম্ভব নয়, তা
থেকে আবার ঢালপালা গজাবেই। তাই মূল
উৎপাটনই একমাত্র অবলম্বন মিত্র, এছাড়া
দ্বিতীয় কোন মার্গও নেই।
.
আর্যাবর্তের যে সম্পর্ক বেদ এর সাথে ছিল,
তাকে ছেড়ে দিয়ে যে সকল অন্ধ পরাম্পরা
মানুষ সৃষ্টি করেছে এবং ধরে রেখেছে।
সেগুলোর মূল উৎপাটন করে আবার বেদ তথা
বৈদিক পরাম্পরাকে ধরাই সকলের জন্য
মঙ্গলজনক। এর মধ্যেই ধর্মকে খুজা উচিত।
.
বিবেচনা করে দেখ মিত্র! যদি সকলে এক
বৈদিক পরাম্পরার মধ্যে থাকতো, তাহলে কি
এত মত মতান্তর থাকতো? প্রতিটি সম্প্রদায়ই
তাদের নিজ নিজ উপাস্য দেবকে প্রধান বলে
এবং অন্যদের উপাস্য দেবকে তাদের উপাস্য
দেবের দাস বলে গোষণা করেছে। যার ফলে
এই সকল সম্প্রদায় পরস্পর কলহ বিবাদে
জড়িয়ে পড়ছে এবং বৃথা সময় নষ্ট করছে।
শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, গনপত্ত্ব, শৌর ইত্যাদি
নানা মত।! অথচ প্রভু একই! তাই উপরের এই
নামগুলো এক এরই, বহুর নয়।
.
তাহলে কি পঞ্চমতের সমন্বের কথা ঠিক
আছে?
আপাত দৃষ্টিতে কিছুটা ঠিক, কিন্তু বৃহৎ
ক্ষেত্রে তথা কর্য ক্ষেত্রে ঠিক নয়। কারণ,
তাহলে অগ্নির উপাসকদেরকে কি বলবে?
বায়ু, বরুণ, বিশ্বকর্মা, প্রজাপতি, লক্ষ্মী,
সরস্বতী, দেবী ইত্যাদির উপাসকদেরকে কি
বলবে? তারা কি দোষ করল? বেদের কোথাও
বলা হয়নি তুমি একটা লোকে শৈব বানাও বা
বৈষ্ণব বানাও বা শৌর বানাও বা শাক্ত
বানাও। বেদ বলে " কৃন্বস্তো বিশ্বম্ আর্যম্ .
অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বকে আর্য বানাও। তাই
কোন মতই নয়, সরাসরি শাস্ত্র তথা বেদ উক্ত
নির্দেশনা অনুসরণ কর মিত্র। নিজের
বিবেককে প্রশ্ন করে দেখ, উত্তর তোমার
ভেতর থেকেই আসবে। আর এতেই তোমার ও
এই সংসারের কল্যাণ নিহিত। উপরোক্ত এই
নামগুলো এক ব্রহ্মেরই নাম। প্রমাণ দেখতে
চাও? দেখে নাও প্রমাণ-
.
"ন দ্বিতীয়ো ন তৃতীয় শ্চতুর্থো নাপ্যুচ্যতে।
ন পঞ্চমো ন ষষ্ঠঃ সপ্তমো নাপ্যুচ্যতে।
নাষ্টমো ন নবমো দশমো নাপ্যুচ্যতে।
য এতং দেবমেক বৃতং বেদ।।"
অথর্ববেদ ১৩/৪/২. (১৬/১৭/১৮).
.
ভাবার্থ- পরমাত্মা এক, তিনি ছাড়া কেহই
দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম,
অষ্টম, নবম, বা দশম ঈশ্বর বলিয়া অভিহিত হন
না। যিনি তাহাকে শুধু এক বলিয়া জানেন
তিনিই তাঁহাকে প্রাপ্ত হন।
.
"ইন্দ্রং মিত্রং বরুণমগ্নিমাহু, রথো দিব্যঃ স
সুপর্ণো গরুত্মান। একং সদ্বিপ্রা বহুধা
বদন্ত্যগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ।।"
ঋগবেদ ১/১৬৪/৪৬.
ভাবার্থ- এক সত্তা পরম ব্রহ্মকে জ্ঞানীরা
ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য, সুপর্ণ, গরুৎমান,
যম, মাতারিশ্বা আদি বহু নামে অভিহিত
করেন।
.
"এতমেকে বদন্ত্যগ্নি মনুমন্যে প্রজাপতিম্।
ইন্দ্রমমেকে পরে প্রাণমপরে ব্রহ্ম শাশ্বতম্।।"
মনুসংহিতা ১২/১২৩.
ভাবার্থ- এই পরম পুরুষকেই কেউ কেউ অগ্নি
বলে জানেন, কেই একে মনু বলেন, কেউ
প্রজাপতি, কেউ ইন্দ্র, কেউ প্রাণ এবং কেউ
আবার সনাতন ব্রহ্ম বলে থাকেন।
.
তাই মত মতান্তরের এই ধরণের সংঘাত
আমাদের একদমই কাম্য নয়, বিচার বিবেচনা
করে দেখ মিত্র। আয়নার উপর ধুলো বালি
পড়লে যেমন আয়নাতে দেহের ছবি দেখা যায়
না, ঠিক তেমনি ধর্মের মধ্যে কুসংস্কার ও
মিথ্যা প্রথা ও পরাম্পরা প্রবেশ করলে তা
দিয়ে আত্মিক উন্নতি করা সম্ভব নয়। তাই
আয়নাটাকে পরিষ্কার করতে হয় প্রথমে,
তাহলেই দেহের ছবি দেখা যায়। ঠিক তেমনি
ধর্মের উপর পড়া কুসংস্কার, কুপথা ও
কুপরাম্পরার আবরণকে উপড়ে না ফেললে,
সেই ধর্ম দিয়ে জগতের উন্নতি সম্ভব নয়। এই
ধর্ম দিয়ে আত্ম স্বরূপ দেখা যায় না, আর
আত্মস্বরূপ দেখতে না পেলে পরমাত্মার
স্বরূপও দর্শণ সম্ভব নয়।
.
সর্পকে রশি বলে ভ্রমে পতিত হইও না, এতে
করে তোমার অমঙ্গলই হবে। কারণ তুমি এখন
এই চিন্তাই করছো যে- এই রশি দিয়ে তোমার
অনেক উপকার হবে, প্রকৃত পক্ষে তা রশিই নয়।
বাস্তবে যখন এই রশিরূপী সর্পকে ধরবে, তখন
রশিরূপী সর্পের ধ্বংশনে তোমার শরীরও
বিশাক্ত হবে এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
তাই যাকে তাকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলে গন্য
করিও না বা এই সংসার যাদেরকে শ্রেষ্ঠ
বলে ঘোষণা করছে তাদেরকেও শ্রেষ্ঠ
ব্যক্তি বলে মনে করো না। নিজের
বিবেককে প্রশ্ন করে বিচার বিবেচনা করে
অন্তর আত্মা থেকে উত্তর নিয়ে শ্রেষ্ঠ
ব্যক্তি নির্ণয় কর মিত্র। আর এতেই তোমার
মঙ্গল। এই কারণেই ঋষিগণ বেদ
অধ্যাপনান্তে শিষ্যদের উপদেশ দিয়ে
বলেছেন-
.
অস্মানকম্ যানি সুচরিতানি তানি
ত্বয়া উপাস্যানি । অর্থাৎ আমাদের যে সকল
শাস্ত্রসম্মত আচরণ, সেই সকল তোমার দ্বারা
নিয়মিত ভাবে অনুষ্ঠেয়। ইতরাণি নো- অপর
আচরণ সকল অনুষ্ঠেয় নয়। যে কে চ ব্রাহ্মণাঃ
অস্মৎ শ্রেয়াংসঃ-যে সকল ব্রাহ্মণ আমাদের
থেকে শ্রেয়তর। ত্বয়া তেষাম্ আসনেন
প্রশ্বসিত্ব্যম্- তোমাকে দিয়ে তাদের আসন
দান পূর্বক শ্রম দূর করবে। অথ য়দি তে
কর্মবিচিকিৎসা বা বৃত্তি বিচিকিৎসা বা
স্যাৎ- আর যদি কর্ম সম্পর্কে তোমার সংশয়
উপস্থিত হয়, অথবা আচার সম্পর্কে সংশয়
উপস্থিত হয়, তবে। ঐ সময় বা ঐ স্থানে যে
সকল বিচারক্ষম, কর্মপরায়ণ,কর্মাদিতে
স্বতঃপ্রবৃত্ত, অক্রূরমতি ও নিষ্কাম ব্রাহ্মণ
থাকিবেন, তারা ঐ কর্ম বা আচারে যেরূপ
নিরত থাকেন, তুমিও উহাতে তদরূপ থাকিবে।
আবার পূর্বোক্ত ব্যক্তিগণের কাহারও
আচরণে যদি কেহ সংশয় উপস্থিত করে, তবে
ঐ কালে বা স্থানে যে সকল বিচারক্ষম,
কর্মনিষ্ঠ, কর্মাদিতে স্বতঃপ্রবৃত্ত,
অক্রূরমতি ও নিষ্কাম ব্রাহ্মণ থাকিবেন,
তারা ঐ সকল বিষয়ে যেরূপ নিরত থাকেন,
তুমিও সেইরূপই থাকিবে। ইহাই আদেশ, ইহাই
উপদেশ, ইহাই বেদের রহস্য, ইহাই ঈশ্বর
আজ্ঞা। এই প্রকারে সমস্ত অনুষ্ঠান করিবে,
এই প্রকারেই সমস্ত অনুষ্ঠান করিবে।"
তৈত্তিরীয়োপনিষদ ১/১১/২-৪.
স্বীকার করার জন্য বলছে না, বলা হয়েছে
সাধারণ লোক স্বীকার করে। তাছাড়া প্রকৃত
পক্ষেই যিনি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি তাকে অনুসরণ
করলে খুব একটা ক্ষতি হয় না, লাভই হয়।
গীতায় বলা আছে
.
"য়দ্ য়দ্ আচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।
স য়ৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে।।"
গীতা ৩/২১.
অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যা যা আচরণ করেন,
সাধারণেরা সেরূপই আচরণ করে। তিনি যা
প্রমাণিক করেন, লোকেরা তারই অনুবর্তন
করে।
.
কিন্তু তাই বলে কি যাকে তাকে শ্রেষ্ঠ
ব্যক্তি হিসেবে স্বীকার করা উচিত?
.
আাশ্চর্য জনক বিষয় হল প্রতিটি মানুষই
স্বতন্ত্র থাকে মিত্র, তুমিও স্বতন্ত্র আমিও
স্বতন্ত্র। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় আমরা
বুদ্ধি পূর্বক বিচার করি না। না আমরা ধর্মের
বিচার করি, না করি অধর্মের বিচার। বরংচ
দেখা যায়, আমরা নিজ থেকে জ্ঞানবান বা
বলবান ব্যক্তিকে আমাদের কর্তী স্থানীয়
মনে করি। অন্ধ অনুকরণ করি, গুরুর অনুকরণ
শিষ্য করে, তেমনি রাজার অনুকরণ প্রজারা
করে। যদি এই গুরু ও রাজারাই ধর্ম পথে না
চলে, তাহলে তাদের দেখানো পথেই সকলে
অধর্মের দিকে ধাবিত হয়। ফলে সংসারে
নেমে আসে ঘোর অন্ধকার, কুসংস্কারে
চেয়ে যায় সমগ্র সংসার। এখানেই প্রয়োজন
শাস্ত্রের, কারণ শাস্ত্রই তখন সঠিক মার্গ
দেখাতে পারে। তাই তো গীতায় ভগবান
ঘোষণা করেছেন-
.
"তাই কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই
(বেদই) তোমার একমাত্র প্রমাণ। তাই
সংসারে শাস্ত্র বিধান উক্ত কর্ম করা
উচিত।" গীতা ১৬/২৪.
.
একটু চিন্তা করে দেখতো মিত্র! তুমি যাকে
গুরু বা শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলে স্বীকার করছো,
অথবা এই সংসারের মনুষ্য যাদেরকে শ্রেষ্ঠ
ব্যক্তি বলে স্বীকার করে তাদের অনুসরণ
করছে। তারা কি শাস্ত্রো উক্ত কর্ম করছে?
নাকি তথাকথিত অন্ধ পরাম্পরায় ও প্রথায়
বিশ্বাসী হয়ে জীবন যাপন করছে? প্রথা ও
পরাম্পরা অবশ্যই ভালো, তবে তা ততক্ষণই
ভালো যতক্ষণ তা শাস্ত্রের সাথে
সংগতিপূর্ণ থাকে। কিন্তু যখনই তা শাস্ত্র
বহির্ভূত হয় তখনই এতে বিপদ দেখা দেয়, আর
তখনই প্রয়োজন হয় সংস্কারের।
.
পরাম্পরার মধ্যে ধর্মের অবস্থান, আর প্রথাই
ধর্মকে ধরে রাখার দ্বায়িত্ব বহন করে।
বিবেচনা করে দেখ মিত্র! সত্য এই যে, যেমন
ভাবে পাষাণের ভেতরে শিল্প থাকে, ঠিক
তেমনি প্রথার মধ্যেও ধর্মকে পাওয়া যায়।
পাথরের মধ্যে শিল্প আছে কিন্তু পাথরটা
শিল্প নয়, ঠিক তেমনি প্রথার মধ্যে ধর্ম আছে
কিন্তু প্রথাটা ধর্ম নয়। আর পাথরের মধ্যে
শিল্পকে ফুটিয়ে তুলতে হলে পাথরকে
ভাংতে হয়, অপ্রয়োজনিয় অংশকে বাদ
দিতে হয়। মনেরেখো- "প্রথা পালনে যে
বেশী গোড়ামী করে, সে ধর্ম থেকে বঞ্চিত
হয়ে যায়, আর পরাম্পরার অন্ধ অনুকরণ যে
করে, সেও প্রকৃত ধর্ম পরায়ন হতে পারে না।"
.
তাই বলে এমন নির্মম ভাবে সংস্কার করতে
হবে?
হে মিত্র! বিশাক্ত ফল দানকারী বৃক্ষকে
স্বমূলে উপড়ে না ফেললে তা থেকে আরো
অনেক নূতন বৃক্ষ জম্ম নিবে। আর এতে করে
বর্তমান তো বটেই, ভবিষ্যৎও বিষাক্ত হয়ে
যাবে। সেই বৃক্ষের ঢাল পালা কেটে কিছুটা
ছোট করলেও তার থেকে মুক্তি সম্ভব নয়, তা
থেকে আবার ঢালপালা গজাবেই। তাই মূল
উৎপাটনই একমাত্র অবলম্বন মিত্র, এছাড়া
দ্বিতীয় কোন মার্গও নেই।
.
আর্যাবর্তের যে সম্পর্ক বেদ এর সাথে ছিল,
তাকে ছেড়ে দিয়ে যে সকল অন্ধ পরাম্পরা
মানুষ সৃষ্টি করেছে এবং ধরে রেখেছে।
সেগুলোর মূল উৎপাটন করে আবার বেদ তথা
বৈদিক পরাম্পরাকে ধরাই সকলের জন্য
মঙ্গলজনক। এর মধ্যেই ধর্মকে খুজা উচিত।
.
বিবেচনা করে দেখ মিত্র! যদি সকলে এক
বৈদিক পরাম্পরার মধ্যে থাকতো, তাহলে কি
এত মত মতান্তর থাকতো? প্রতিটি সম্প্রদায়ই
তাদের নিজ নিজ উপাস্য দেবকে প্রধান বলে
এবং অন্যদের উপাস্য দেবকে তাদের উপাস্য
দেবের দাস বলে গোষণা করেছে। যার ফলে
এই সকল সম্প্রদায় পরস্পর কলহ বিবাদে
জড়িয়ে পড়ছে এবং বৃথা সময় নষ্ট করছে।
শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, গনপত্ত্ব, শৌর ইত্যাদি
নানা মত।! অথচ প্রভু একই! তাই উপরের এই
নামগুলো এক এরই, বহুর নয়।
.
তাহলে কি পঞ্চমতের সমন্বের কথা ঠিক
আছে?
আপাত দৃষ্টিতে কিছুটা ঠিক, কিন্তু বৃহৎ
ক্ষেত্রে তথা কর্য ক্ষেত্রে ঠিক নয়। কারণ,
তাহলে অগ্নির উপাসকদেরকে কি বলবে?
বায়ু, বরুণ, বিশ্বকর্মা, প্রজাপতি, লক্ষ্মী,
সরস্বতী, দেবী ইত্যাদির উপাসকদেরকে কি
বলবে? তারা কি দোষ করল? বেদের কোথাও
বলা হয়নি তুমি একটা লোকে শৈব বানাও বা
বৈষ্ণব বানাও বা শৌর বানাও বা শাক্ত
বানাও। বেদ বলে " কৃন্বস্তো বিশ্বম্ আর্যম্ .
অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বকে আর্য বানাও। তাই
কোন মতই নয়, সরাসরি শাস্ত্র তথা বেদ উক্ত
নির্দেশনা অনুসরণ কর মিত্র। নিজের
বিবেককে প্রশ্ন করে দেখ, উত্তর তোমার
ভেতর থেকেই আসবে। আর এতেই তোমার ও
এই সংসারের কল্যাণ নিহিত। উপরোক্ত এই
নামগুলো এক ব্রহ্মেরই নাম। প্রমাণ দেখতে
চাও? দেখে নাও প্রমাণ-
.
"ন দ্বিতীয়ো ন তৃতীয় শ্চতুর্থো নাপ্যুচ্যতে।
ন পঞ্চমো ন ষষ্ঠঃ সপ্তমো নাপ্যুচ্যতে।
নাষ্টমো ন নবমো দশমো নাপ্যুচ্যতে।
য এতং দেবমেক বৃতং বেদ।।"
অথর্ববেদ ১৩/৪/২. (১৬/১৭/১৮).
.
ভাবার্থ- পরমাত্মা এক, তিনি ছাড়া কেহই
দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম,
অষ্টম, নবম, বা দশম ঈশ্বর বলিয়া অভিহিত হন
না। যিনি তাহাকে শুধু এক বলিয়া জানেন
তিনিই তাঁহাকে প্রাপ্ত হন।
.
"ইন্দ্রং মিত্রং বরুণমগ্নিমাহু, রথো দিব্যঃ স
সুপর্ণো গরুত্মান। একং সদ্বিপ্রা বহুধা
বদন্ত্যগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ।।"
ঋগবেদ ১/১৬৪/৪৬.
ভাবার্থ- এক সত্তা পরম ব্রহ্মকে জ্ঞানীরা
ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য, সুপর্ণ, গরুৎমান,
যম, মাতারিশ্বা আদি বহু নামে অভিহিত
করেন।
.
"এতমেকে বদন্ত্যগ্নি মনুমন্যে প্রজাপতিম্।
ইন্দ্রমমেকে পরে প্রাণমপরে ব্রহ্ম শাশ্বতম্।।"
মনুসংহিতা ১২/১২৩.
ভাবার্থ- এই পরম পুরুষকেই কেউ কেউ অগ্নি
বলে জানেন, কেই একে মনু বলেন, কেউ
প্রজাপতি, কেউ ইন্দ্র, কেউ প্রাণ এবং কেউ
আবার সনাতন ব্রহ্ম বলে থাকেন।
.
তাই মত মতান্তরের এই ধরণের সংঘাত
আমাদের একদমই কাম্য নয়, বিচার বিবেচনা
করে দেখ মিত্র। আয়নার উপর ধুলো বালি
পড়লে যেমন আয়নাতে দেহের ছবি দেখা যায়
না, ঠিক তেমনি ধর্মের মধ্যে কুসংস্কার ও
মিথ্যা প্রথা ও পরাম্পরা প্রবেশ করলে তা
দিয়ে আত্মিক উন্নতি করা সম্ভব নয়। তাই
আয়নাটাকে পরিষ্কার করতে হয় প্রথমে,
তাহলেই দেহের ছবি দেখা যায়। ঠিক তেমনি
ধর্মের উপর পড়া কুসংস্কার, কুপথা ও
কুপরাম্পরার আবরণকে উপড়ে না ফেললে,
সেই ধর্ম দিয়ে জগতের উন্নতি সম্ভব নয়। এই
ধর্ম দিয়ে আত্ম স্বরূপ দেখা যায় না, আর
আত্মস্বরূপ দেখতে না পেলে পরমাত্মার
স্বরূপও দর্শণ সম্ভব নয়।
.
সর্পকে রশি বলে ভ্রমে পতিত হইও না, এতে
করে তোমার অমঙ্গলই হবে। কারণ তুমি এখন
এই চিন্তাই করছো যে- এই রশি দিয়ে তোমার
অনেক উপকার হবে, প্রকৃত পক্ষে তা রশিই নয়।
বাস্তবে যখন এই রশিরূপী সর্পকে ধরবে, তখন
রশিরূপী সর্পের ধ্বংশনে তোমার শরীরও
বিশাক্ত হবে এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
তাই যাকে তাকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলে গন্য
করিও না বা এই সংসার যাদেরকে শ্রেষ্ঠ
বলে ঘোষণা করছে তাদেরকেও শ্রেষ্ঠ
ব্যক্তি বলে মনে করো না। নিজের
বিবেককে প্রশ্ন করে বিচার বিবেচনা করে
অন্তর আত্মা থেকে উত্তর নিয়ে শ্রেষ্ঠ
ব্যক্তি নির্ণয় কর মিত্র। আর এতেই তোমার
মঙ্গল। এই কারণেই ঋষিগণ বেদ
অধ্যাপনান্তে শিষ্যদের উপদেশ দিয়ে
বলেছেন-
.
অস্মানকম্ যানি সুচরিতানি তানি
ত্বয়া উপাস্যানি । অর্থাৎ আমাদের যে সকল
শাস্ত্রসম্মত আচরণ, সেই সকল তোমার দ্বারা
নিয়মিত ভাবে অনুষ্ঠেয়। ইতরাণি নো- অপর
আচরণ সকল অনুষ্ঠেয় নয়। যে কে চ ব্রাহ্মণাঃ
অস্মৎ শ্রেয়াংসঃ-যে সকল ব্রাহ্মণ আমাদের
থেকে শ্রেয়তর। ত্বয়া তেষাম্ আসনেন
প্রশ্বসিত্ব্যম্- তোমাকে দিয়ে তাদের আসন
দান পূর্বক শ্রম দূর করবে। অথ য়দি তে
কর্মবিচিকিৎসা বা বৃত্তি বিচিকিৎসা বা
স্যাৎ- আর যদি কর্ম সম্পর্কে তোমার সংশয়
উপস্থিত হয়, অথবা আচার সম্পর্কে সংশয়
উপস্থিত হয়, তবে। ঐ সময় বা ঐ স্থানে যে
সকল বিচারক্ষম, কর্মপরায়ণ,কর্মাদিতে
স্বতঃপ্রবৃত্ত, অক্রূরমতি ও নিষ্কাম ব্রাহ্মণ
থাকিবেন, তারা ঐ কর্ম বা আচারে যেরূপ
নিরত থাকেন, তুমিও উহাতে তদরূপ থাকিবে।
আবার পূর্বোক্ত ব্যক্তিগণের কাহারও
আচরণে যদি কেহ সংশয় উপস্থিত করে, তবে
ঐ কালে বা স্থানে যে সকল বিচারক্ষম,
কর্মনিষ্ঠ, কর্মাদিতে স্বতঃপ্রবৃত্ত,
অক্রূরমতি ও নিষ্কাম ব্রাহ্মণ থাকিবেন,
তারা ঐ সকল বিষয়ে যেরূপ নিরত থাকেন,
তুমিও সেইরূপই থাকিবে। ইহাই আদেশ, ইহাই
উপদেশ, ইহাই বেদের রহস্য, ইহাই ঈশ্বর
আজ্ঞা। এই প্রকারে সমস্ত অনুষ্ঠান করিবে,
এই প্রকারেই সমস্ত অনুষ্ঠান করিবে।"
তৈত্তিরীয়োপনিষদ ১/১১/২-৪.
0 মন্তব্য(গুলি)