https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

কেন মীরজাফরই বিশ্বাসঘাতক, বিভীষণ নন?

Saturday, July 22, 2017
Rama and   Vibhishana এর চিত্র ফলাফল
মীরজাফর বিশ্বাসঘাতক হলে বিভীষণ কেন নন, এমন প্রশ্ন অনেকেরই। কারণ, দুজনেই স্বপক্ষ ত্যাগ করে প্রতিপক্ষে ভিড়েছিলেন এবং প্রতিপক্ষকে কিছু অযাচিত সুবিধা দিয়েছিলেন, যা স্ব স্ব পরিস্থিতির ফলাফল নির্ধারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রমানিত হয়েছিল।
বৌদ্ধপ্রভাবিত বলে বাঙ্গালী প্রাচীনকাল থেকেই কিছুটা বামাচারী (বর্তমানের ফ্যাশনেবল এন্টি স্টাব্লিশমেন্ট এটিচিউডের মতই আরকি) হলেও, এই প্রশ্নটিকে সাধারণ জনমানসের চিন্তাজগতে প্রকটিত করতে প্রথম কাব্যিক স্টিমুলাস ছিল, সম্ভবত মাইকেল মধুসুধন দত্তের অমর “মেঘনাদ বধ” কাব্যটি। যাই হোক, আমি এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে যাচ্ছি, আমার এই অভিযানে আপনাকেও স্বাগত জানাই এবং স্বচ্ছন্দে দ্বিমত প্রকাশে ও স্বাগত জানাই।

প্রথমত, মীরজাফর, সিরাজুদ্দৌলার বিশ্বস্ত হয়েছিলেন, নৈকট্য লাভ করেছিলেন তাঁর মনের অভিসন্ধি গোপন রেখেই। তিনি সিরাজের সেনাপতি ছিলেন, ইংরেজের সাথে সমঝোতায় এসেও তিনি স্বীয় পদ ত্যাগ করেননি বিশ্বাসঘাতকতার সর্বোচ্চ সুবিধা নেওয়ার জন্য। অপরদিকে, রাবণের সীতা অপহরণের দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে বিভীষণের বিরোধিতা শুরু থেকেই ছিল উচ্চমুখ ও স্পষ্ট। যুদ্ধপূর্বকালে অঙ্গদ যখন শেষবারের জন্য সীতাকে ফিরে পাবার দূতিয়ালি করতে আসেন, ঠিক তখন থেকেই একেবারে স্পষ্ট ভাষায়, বিভীষণ রাবণের বিরোধিতা করেন। তিনি বার বার রাবণকে চাপ দিতে থাকেন, সীতাকে ফিরিয়ে দেবার জন্য। আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাবণ বিভীষণকে রাজসভাতেই চরম অপমান করেন। তারপরেই বিভীষণ লঙ্কাপুরী ত্যাগ করে রামের পক্ষে যোগ দেন।
দ্বিতীয়ত, মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, ইংরেজদের কাছ থেকে ক্ষমতা প্রাপ্তির ব্যাপারে আশ্বস্ত হবার পর। অর্থাৎ, তাঁর গোপন সিরাজ বিরোধিতা ছিল সম্পূর্ণ ক্ষমতার লোভ থেকেই। অপরদিকে, বিভীষণ, রাবণের সামনেই তাঁর বিরোধিতার কারণ স্পষ্ট করেছিলেন। কারণটা ছিল, ধর্ম। রাবণরা বিশ্বশ্রবা মুনির পুত্র, আর মুনিপুত্রের এমন কাজ যে ধর্মবিরোধী সেটাও বিভীষণ রাবণকে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন। ধর্ম আর আব্রাহামিক বিশ্বাস কে আমরা অনেক শতাব্দী ধরেই গোলাচ্ছি, আর ক্যাথলিক কনভার্ট মধুসুধন ও সম্ভবত বিবিলিক্যাল মোর‍্যালিটি’র “আমরা বনাম তোমরা’র” সাথে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলেছেন।
তৃতীয়ত, মীরজাফর সিরাজের বিরুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র ধরেননি, বরং নিজে নিষ্ক্রিয় থেকে সিরাজের বাহিনীর একটা বড় অংশকে নিস্ক্রিয় করে রেখেছিলেন। অপরদিকে, বিভীষণ সরাসরি যুদ্ধ না করলেও, মন্ত্রণা ও স্ট্রাটেজি’র সাহায্যে রামকে যুদ্ধে জিততে সাহায্য করেছিলেন। এখানে, প্রশ্ন আসতে পারে, ধর্মাশ্রয়ী বিভীষণ তো যুদ্ধে নিষ্ক্রিয় ও থাকতে পারতেন, তিনি সরাসরি রামের পক্ষে যোগ দিয়ে প্রতিপক্ষকে যুদ্ধে জেতালেন কেন?
গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখুনঃ
তং তথা কৃপয়াবিশটমশ্রুপূর্ণাকুলেক্ষনম্‌,
বিষীদন্তমিদং বাক্যমুবাচ মধুসুদনঃ...... দ্বিতীয় অধ্যায় ১ম শ্লোক।
অর্থাৎ, তখন মধুসূদন কৃপাবিস্ট হয়ে অশ্রুপূর্ণলোচন, বিষণ্ণ অর্জুনকে বললেন (প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শুরু করলেন)
এখানে, কৃপা শব্দটাকে খেয়াল করুন। অন্যের কষ্ট দেখলে ধার্মিক মানুষের দুই ধরনের অনুভূতি হয়, দয়া ও কৃপা।
কৃপা হল অন্যের দুঃখে কাতর হওয়া আর দয়া হল, শুধু কাতর হওয়ায় নয়, বরং দুঃখ লাঘবে সাহায্য করা বা তাঁর সাহায্যার্থে এগিয়ে যাওয়া, যাকে আমরা আজকাল পজিটিভ ইন্টারভেনশন বলি। কৃষ্ণ এই মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়া অর্জুনকে কৃপা করছেন, আর বিভীষণ, রামকে করেছেন দয়া। অরবিন্দের মতে, “দয়া” হল বলবানের ধর্ম। বিভীষণ, এখানে দয়া করে ধর্মাশ্রয়ী নীতিই নিয়েছেন।
চতুর্থত, বিভীষণ যেমন রাবণের কুকর্মের বিরোধিতা করেছিলেন, তেমনিই বিরোধিতা করেছিলেন কুম্ভকর্ণ। কিন্তু, কুম্ভকরন সব জেনেও রাবণকে অধর্মের ব্যাপারে সতর্ক করেও রাবণকে ত্যাগ করেননি, বরং ভায়ের পক্ষে, স্বকুলের রক্ষার্থে যুদ্ধ করেছিলেন। প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, কুম্ভকর্ণের দৃষ্টান্তই কি মহত্ত্বর ছিলনা? বিভীষণ কি কুম্ভকর্ণকেই ফলো করতে পারতেন না, সরাসরি শত্রুপক্ষে যোগ না দিয়ে? আচ্ছা, মহাভারতের ভীষ্ম, দ্রোণের কথা কি মনে আছে? তাঁরা পাণ্ডবদের হিতাকাঙ্খীই ছিলেন, দুর্যোধনের সমস্ত কুকীর্তির কথা জেনে এবন সেসব কীর্তির বিরোধিতা করেও শেষপর্যন্ত দুর্যোধনের হয়েই যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁদেরকে মারা ও হয়েছে, বাঁকাপথে, সোজাপথে নয়! দ্রোণ, ভীষ্ম অধার্মিক ছিলেন না, কিন্তু অধর্মের গোঁড়া দুর্যোধনের রক্ষাকবচ ছিলেন। তাই, দুর্যোধনকে বাগে পেতে, ভীষ্ম, দ্রোণকে হত্যা, কর্তব্য, এমনই মত ছিল শ্রীকৃষ্ণের।
একই ভাবে, কুম্ভকর্ণ ছাড়াও মেঘনাদ, অতিকায়, বীরবাহু প্রভৃতি রাবণপুত্র সহ সমস্ত লঙ্কাসেনাও রামের প্রতিপক্ষ ছিলেন না, অধার্মিক ছিলেন না। কিন্তু, রাবণের রক্ষাকবচ ছিলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ যে অধর্ম করেছিলেন, কুম্ভকর্ণ ও নিজে ভাল হলেও একই দোষে দোষী ছিলেন।
আরেকটা কথা, দুর্যোধনের এক ভাইয়ের নাম ছিল যুযুৎসু। সে কিন্তু যুদ্ধের শুরুতেই প্রকাশ্যে ধর্মের দোহাই দিয়ে, পাণ্ডবদের পক্ষে যোগ দিয়েছিল। বিভীষণ ও এখানে তাই করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায়, হিংস্র সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা করে এই বর্বর প্রথা রদ করার জন্য, সরাসরি তৎকালীন হিন্দু সমাজের বিরোধিতা এমনকি নিজের মায়ের বিরোধিতা করেছিলেন। ইংরেজদের সাহায্যে এই বর্বরতা বন্ধে আইন পাশ করেন। তাহলে, রাম মোহন কি অনুচিত, ধর্মবিরুদ্ধ কাজ করেছিলেন? আজকাল, অনেক মুসলিমই ইসলামি সন্ত্রাসের ভয়াবহতা দেখে, ইসলামের বিরোধিতা করছেন। ইসলামি মৌলবাদীরা তাঁদের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাইলে, এই মুসলিমরা কি ভুল করছেন?
পঞ্চমত, অনেকেই দাবী করেন, বিভীষণ রাজ্যলোভে এই কাজ করেছিলেন। সেদিক থেকে দেখলে, বিভীষণের সাথে আসলেই মীরজাফরের কোন পার্থক্য নেয়। কিন্তু, বিভীষণ সবসময় স্পষ্টই বিরোধিতা করেছেন এবং বারবারই ধর্মের দোহায় দিয়েছেন। এক্ষেত্রে, পাল্টা প্রশ্ন করা যেতে পারে। মেঘনাদ কেন নিজের বাবার বিরোধিতা করেন নি? মানে ছেলের কুকর্মকে প্রশ্রয় দিয়ে ধৃতরাষ্ট্র যদি দোষী হন, তাইলে বাবার কুকর্মের সহায় হয়ে মেঘনাদ কেন দোষী হবেন না? মেঘনাদ যদি বিরোধিতা করতেন, তাহলে যুদ্ধটা ভেস্তে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। কারণ, স্পষ্টতই রাবণ যতটা মেঘনাদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন, ততটা আর কারোর উপর ছিলেন না। কুম্ভকর্ণ ও অতিকায়ের মৃত্যুতে রাবণ ততটা ভেঙ্গে পরেননি, যতটা ভেঙ্গে পরেছেন মেঘনাদের মৃত্যুর পর। মেঘনাথ যদি, যুদ্ধে নিষ্ক্রিয় ও থাকতেন, তাহলেও কি লঙ্কাকুলে বাতি দিতে বিভীষণের উপর নির্ভর করতে হত?
শেষকথায় আসি। ব্রিটিশসাম্রাজ্যবাদকে জাস্টিফাই করতে, ভারতবর্ষে সামাজিক ফাটল ধরাতে, খ্রিষ্টান মিশনারিদের জন্য গোচারণের ক্ষেত্র তৈরি করতে, রামকে ব্রাম্মন্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদী আর্‍্য দস্যু হিসেবে চিহ্নিত করার চেস্টা করা হচ্ছে গত দেড়শ বছরের বেশী সময় ধরে। আর্‍য আক্রমণ তত্ত্ব, আর্‍য-দ্রাবিড় তত্ত্ব ইত্যাদী আবিষ্কার করা হচ্ছে/ হয়েছে সেই রবার্ট ক্যাল্ডওয়েলের সময় থেকেই, সেইন্ট থমাস কে তামিলনাডুতে আবিস্কারের পর থেকেই। এই লঙ্কাযুদ্ধকে, রামের মাধ্যমে আর্‍যদের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে বার বার। হতেই পারে, সীতা উপলক্ষ মাত্র ছিল। রামের মনের আসল উদ্দেশ্য ছিল লঙ্কা জয়। হতেই পারে। কিন্তু, কেউ যেটা অস্বীকার করতে পারবেন না, যে সীতাকে অপহরণের মাধ্যমে রাবনই প্রথম আঘাত হেনেছিল। প্রত্যাঘাত করাতো রামের কর্তব্যই হয়ে দাঁড়ায়, তাই না? বিশেষ করে, রাম যেখানে ক্ষত্রিয় ছিলেন, অযথা বাক্যব্যয় করে, প্রচুর বিদ্যার বহর সাজিয়ে, শেষতক অপারগতা প্রকাশ করার বা প্রত্যাঘাতের প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রশ্ন তোলার পাত্র তো তিনি ছিলেন না! বা এই কাজটাকে তিনি বুদ্ধিবৃত্তি আখ্যা দিয়ে নিজেকে আর আশপাশের সবাইকে ঠকাননি, এইই বা কম কি?