গুরু শব্দের অর্থ — পূর্ণ জ্ঞানস্বরূপ। জড়দেহের মধ্যে জ্ঞান -অজ্ঞান বলিয়া কোন বস্তু নাই, মনেরই জ্ঞানময় অবস্থার নাম গুরু।
🔹“গুকারশ্চান্ধকারঃ স্যাৎ, রু-কারস্তন্নিরোধকঃ।
অন্ধকারঃ নিরোধিত্বাৎ গুরুরিত্যভিধীয়তে।। (গুরুগীতা)
গু’ শব্দে অন্ধকারকে বুঝায় এবং ‘রু’ শব্দ অন্ধকারের নিরোধক । সুতরাং
যেই জ্ঞানের দ্বারা মানবের অজ্ঞানরূপ অন্ধকার নিরোধ প্রাপ্ত বা নিবারণ হয়
তাহার নাম গুরু ।
অতএব গুরু অর্থে অজ্ঞান নিরোধক জ্ঞান বুঝায়— মনুষ্য বা
দেবতা বুঝায় না। গুরু সম্বন্ধে সাংখ্যদর্শন বলিয়াছেন,—
🔹“স পূর্বেষাং অপি গুরু, কালেন ন অবচ্ছেদাৎ”।
পূর্ব পূর্ব সময়ে যেসব গুরু ছিলেন— যেমন, বশিষ্ঠ, বেদব্যাস,
যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি— আত্মা সেই সকলেরই গুরু। তিনি কালেরদ্বারা অবিচ্ছিন্ন
হন না। অর্থাৎ বশিষ্ঠ, বেদব্যাস প্রভৃতি গুরুগণ ভিন্ন ভিন্ন যুগে পৃথক
পৃথকভাবে জন্ম গ্রহণ করিলেও আত্মা সকলেরই গুরু। তাই গুরু নমস্কারে বলা
হইয়াছে —
🔹গুরুব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ।
গুরুরেব পরমব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমো।।
অর্থ— গুরুইব্রহ্ম (সৃষ্টিকর্তা) গুরুই বিষ্ণু (পালনকর্তা, তাহা দ্বারাই
সমস্ত জীব বাঁচিয়া রহিয়াছে) এবং গুরুই মহেশ্বর (সংহারকর্তা) । গুরু শুধু
সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের কর্তা নহেন, তিনিই পরমব্রহ্ম। আমি সেই
পরমব্রহ্মরূপী গুরুকে প্রণাম করি ।
🔹“ন
তু মাং মানুষীং জ্ঞেয়া ব্রহ্ম রূপা ন সংশয়ঃ” । অর্থ— আমাকে (গুরুকে)
মানুষী (প্রাকৃত দেহবান) বলিয়া মনে করিও না। আমি নিশ্চয়ই পরমব্রহ্ম।
ইহাতে কিছুমাত্র সংশয় নাই। [মানুষের স্ত্রীলিঙ্গ মানুষী - মানুষ পুরুষ,
মানুষী প্রকৃতি। প্রকৃতি হইতে এই বিশ্বের যাবতীয় রূপের সৃষ্টি হইয়াছে ;
সুতরাং বিশ্বান্তর্গত সকলই মানুষী বা প্রাকৃত দেহ। ]
⬆
উপরি-উক্ত শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্তদ্বারা স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, আত্মা বা
ভগবানই সকলের গুরু । যেহেতু নিজ আত্মাকে কেহই ত্যাগ করিতে পারে না, সেইহেতু
গুরুত্যাগ কখনই হইতে পারে না ।
🛂 প্রশ্নঃ— আত্মাই যখন সকলের গুরু, তখন কোন্ ব্যক্তি আত্মবিৎ এবং কে নহেন, কি লক্ষণের দ্বারা তাঁহাকে জানা যাইবে ?
🛃
উত্তর— বাহিরের চেহারা দেখিয়া আত্মজ্ঞ পুরুষকে চিনিতে পারা যায় না। তবে
তাঁহার মুখমন্ডলে মনের কিছু ছাপ পড়ে এবং তাঁহার সকলের প্রিয় ব্যবহার
দেখিয়া কিছুটা ধারণা করা যাইতে পারে। জ্ঞানী চিনিবার বিশেষ লক্ষণ হইতেছে—
তিনি কি সর্বদা ঈশ্বরীয় কথায় আনন্দ পান অথবা সাংসারীক কথায় প্রীতি অনুভব
করেন, তাহা লক্ষ্য করিলেই বুঝা যায় । সর্বোপরি নিজের মধ্যে কিছু জ্ঞান না
থাকিলে জ্ঞানীকে চিনিতে পারা যায় না । জ্ঞানীর লক্ষণ সম্বন্ধে মুণ্ডুক
উপনিষদে বলিতেছেন :—
🔹“তদ্বিজ্ঞানার্থং স গুরুমেবাভিগচ্ছেৎ শ্রোত্রিয়ং ব্রহ্মনিষ্ঠম্। (১।২।১২)
অর্থ— আত্মজ্ঞান লাভের জন্য শ্রোত্রিয় ও ব্রহ্মনিষ্ঠ গুরুর আশ্রয় গ্রহণ করিবে।
📖
উপনিষদের এক নাম শ্রুতি । শ্রুতিশাস্ত্রে যিনি পারদর্শী, তিনিই
শ্রোত্রিয়, ‘ব্রহ্মনিষ্ঠ’ অর্থ— ব্রহ্মে যাহার নিষ্ঠা (নিঃশেষরূপে
স্থিতিলাভ) হইয়াছে, তিনিই ব্রহ্মনিষ্ঠ । যাহার মন বিষয়াসক্তি হইতে মুক্ত
হইয়া শান্তভাব ধারণ করিয়াছে, তিনিই ব্রহ্মনিষ্ঠ ।
⬆
উপরের লক্ষণ দুইটি কাহারও মধ্যে দেখিতে পাইলে তাঁহাকে গুরুপদে বরণ করা
যাইতে পারে । অন্যথা শিষ্যের জীবনে বহু কাদামাটি ঘাটা সার হয়— শুধু কতকগুলি
বাহ্যিক আচারানুষ্ঠানের মধ্যেই তাহার জীবন অতিবাহিত হয়, — ভগবৎ দর্শন হয়
না।
🌚
গুরু যদি কেবল সাংসারীক কথাতেই মত্ত থাকেন, উপাদেয় খাদ্য, অর্থ, বিত্তের
প্রতি যদি তাঁহার লোভ থাকে, তবে বুঝিতে হইবে, তাঁহার মনের চাহিদা এখনও মিটে
নাই, তাঁহার মনও শান্ত হয় নাই। মন শান্ত না হইলে ভগবৎ দর্শনও হয় না ।
যে সাধন-ভজনের দ্বারা গুরু নিজের মনকে শান্ত করিতে পারিল না, সেই
সাধনাদ্বারা শিষ্যের মন শান্ত হইবে কিরূপে ? সুতরাং আত্মকল্যাণেচ্ছু
ব্যক্তির পক্ষে অনতিবিলম্বে এরূপ গুরুকে ত্যাগ করিয়া উন্নততর গুরু গ্রহণ
করা উচিৎ । কারণ “পাষাণে ক্রিয়তে নৌকা ন তরন্তি ন তারয়েৎ” —
প্রস্তরনির্মিত নৌকা নিজেও নদী পার হইতে পারে না, অপরকেও ডুবাইয়া মারে ।
জীবনের কিছুই নিশ্চয়তা নাই, কখন যে মৃত্যু আসিয়া জীবনের সব শেষ করিয়া দিবে
তাহা কে বলিতে পারে ? “ক্ষণমপি সজ্জন সঙ্গতিরেকা ভবতি ভবার্ণবতরণে নৌকা”
—সজ্জনের সঙ্গ ক্ষণকালের জন্য হইলেও তাহাই হয়তো সংসার সমুদ্র পারের কারণ
হইয়া থাকে । এইজন্য মৃত্যুর পূর্বে যদি প্রকৃত গুরুর নিকট হইতে সৎপথের
নির্দেশ পাওয়া যায়, তবে সেই শুভ সংস্কারই মানবকে পরজন্মে উন্নত পিতামাতার
গৃহে জন্মগ্রহণে সাহায্য করে।
🔹 “শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টোভিজায়তে। অথবা যোগিনামেব কুলে ভবতি ধীমতাম্।।
(গীতা ৬।৪১)—
নির্মল মনযুক্ত, অর্থ এবং জ্ঞানধনে ধনী পিতামাতার গৃহে যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করে ।
ইহাও লক্ষণীয় যে এখানে সকল প্রকার উন্নত জ্ঞানের অধিকার লইয়া জন্ম
গ্রহণ করে না । যে ব্যক্তি যেরূপ জ্ঞানের অধিকারী, তাহার সহিত নিজ
জ্ঞানানুরূপ ব্যক্তির সহিতই যোগাযোগ হয় ও প্রীতি উৎপন্ন হয় । অতএব
সর্বক্ষেত্রে শ্রোত্রিয় ও ব্রহ্মনিষ্ঠ গুরু তাহার শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতে
পারে না । এরূপ ক্ষেত্রে সাধককে নিজ সাধন-ভজনের দিকে লক্ষ্য করিয়া দেখা
উচিৎ যে, তাহার সাধনা অগ্রসর হইতেছে কি না ? সাধনা গ্রহণের পর হইতে তাহার
মনের কামক্রোধাদি বৃত্তির বেগ কিঞ্চিৎ প্রশমিত হইয়াছে কি না ? তাহার মন
ঈশ্বরীয় কথাতে অধিক আনন্দানুভব করে, অথবা সাংসারীক কথাতেই সমধিক প্রীতিলাভ
করে ? ভগবৎ তত্ত্বের অনুভব তাহার জীবনে কতটুকু হইয়াছে ? উল্লিখিত
প্রশ্নগুলির যদি সদুত্তর পাওয়া না যায়, তবে সেই গুরুকে ত্যাগ করিয়া অন্য
গুরু গ্রহণ করিলে কোন পাপ হয় না । কেননা—
🔹মধু-লুব্ধো যথা ভৃঙ্গ পুস্পং পুস্পান্তরং ব্রজেত।
জ্ঞান-লুব্ধো তথা শিষ্যঃ গুরুব্যন্তরং ব্রজেৎ ।।
(মনুভাষ্যে মেধাতিথি )
অর্থ— মৌমাছি যেমন ক্ষুধার্ত হইয়া মধু পাইবার আশায় কোন ফুলের উপরে বশে
এবং সেখানে আশানুরূপ মধু না পাইলে ক্ষুধা নিবারণের জন্য অন্য ফুলে গমন করে,
সেইরূপ যাহার হৃদয়ে ভগবৎ প্রাপ্তির তৃষ্ণা জাগিয়াছে, সে তাহার অভিস্পীত
বস্তু না পাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই নিরস্ত হইতে পারে না — যেখান হইতে ভগবৎ
জ্ঞান পাওয়া যাইতে পারে, সেখানে যাওয়াই কর্তব্য ।
🔊
আপনারা অবশ্যই অবগত আছেন যে, বর্তমান সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, বুদ্ধ
প্রভৃতি অনেকেই একাধিক গুরু গ্রহণ করিয়াছিলেন কিন্তু সে জন্য তাঁহারা
অধোগতি প্রাপ্ত হন নাই অথবা হইয়া যান নাই । বরং উন্নত গুরু গ্রহণ না
করিলেই তাঁহারা পাপী হইতেন, আত্মঘাতী হইতেন । আত্মাকে না জানাই আত্মঘাতী
হওয়া ।
🔹“আত্মজ্ঞানবিহীনা মুঢ়ান্তে পচ্যন্তে নরকনিগূঢ়াঃ”
আত্মজ্ঞানহীন মূঢ় ব্যক্তি ঘোর অন্ধকারময়, নরকে পচিয়া মরে ।
🌞
ভগবানকে পাইবার জন্যই সাধন-ভজন করা হয় । যাহাতে এই জীবনেই তাঁহাকে
পাওয়া যায়, তারজন্য যত্নবান হওয়া সকলেরই কর্তব্য । সমাজের বাধাবিঘ্ন গৌণ
হইয়া ভগবৎ লাভই যেন জীবনে মুখ্যস্থান অধিকার করে ।
👉
সর্বশেষ একশ্রেণীর স্বার্থসেবী কুলগুরু আছেন, যাহারা শুধু নিজেদের
স্বার্থটাকেই বড় করিয়া দেখেন— অন্যের (শিষ্যের) স্বার্থের দিকে তাকানোর
কোন প্রয়োজনই তাঁহারা মনে করেন না । শিষ্যগণ যেন তাঁহাদের মৌরশী পাট্টা
সম্পত্তি । শিষ্যদের সম্পত্তি শোষণ করিয়া লওয়াই তাঁহাদের পেশা । তাঁহারা
প্রচার করিয়া বেড়ান, ‘‘কুলগুরু ত্যাগ করা মহাপাপ”। কুলগুরু অর্থ সেই
বংশের সকলেই গুরু আখ্যাপ্রাপ্ত— তাহাদের বিদ্যা, জ্ঞান, সমদর্শন,
ইন্দ্রিয় সংযম, পরোপকার প্রভৃতি গুণরাজি থাকুক বা না-থাকুক । কুলগুরুগণ
ভগবৎ দর্শনের কোন ধার ধারেনা না “তোমরা শিষ্য, আমরা তোমাদের গুরু” ইহাই
দীক্ষা দিবার উদ্দেশ্য । তাঁদের নিকট হইতে দীক্ষা লইলেই নাকি শিষ্যগণের
হাতের জল শুদ্ধ হইয়া যায় । অন্যথায় শিষ্যদের নরকে গতি হয় ।
🚮
জলের আবার জাতিগত হাতের গুণে শুদ্ধ বা অশুদ্ধ কি, তাহা বুঝা দূরূহ ।
মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে হয়, যে কোন মানুষের হাতের জল একই প্রকারের হয় ।
জলের মধ্যে শুদ্ধ বা অশুদ্ধ বলিয়া কোন বস্তু বা ভাব নাই । শুদ্ধাশুদ্ধ
মনের ভাব বা মনের ধর্ম— জলরূপ বিষয়ের ধর্ম নহে । জলের ধর্ম তরলতা
শুদ্ধাশুদ্ধ নহে । অজ্ঞানী কুলগুরুদেবের খপ্পরে পড়িয়া ইহকাল ও পরকাল নষ্ট
না করিতে নিরীহ জনগণকে অনুরোধ করি ।
⏩
বর্তমানে মানুষ অনেক শিক্ষিত হইয়াছে । একজন অশিক্ষিত বা শিষ্য হইতে কম
শিক্ষিত হইয়াও শুধু গুরুগিরির জোরে সে শিষ্যের মস্তকে পাও তুলিয়া দিবে,
ইহা আজ আর কেহ বরদাস্ত করিতে চাহে না । কুলগুরুর যদি ভগবৎ দর্শন করাইবার
ক্ষমতা না থাকে তবে তাহাকে ত্যাগ করাই পুণ্যের কাজ ।
0 মন্তব্য(গুলি)