পৌরাণিক ভাবে অশ্বমেধের অর্থ যজ্ঞে অশ্ব অর্থাৎ ঘোড়াকে কেটে তার অঙ্গ অগ্নিতে আহুতি দিয়ে যজ্ঞ করা। পৌরাণিক সায়ন, রমেশ আদির বেদ ভাষ্যে এর উল্লেখ বহু স্থলে মিলে। তন্মধ্যে বহুল প্রচারিত মন্ত্রটি হচ্ছে -
-হে অশ্ব।রন্ধনকালে তোমার মাংস হইতে যে রস (ঝোল) নির্গত হয় এবং তোমার যে অংশ শূলে বিদ্ধ থাকে, তা যেন মৃত্তিকাতে পতিত বা তৃণাদির সহিত একত্র না হয়। দেবগন মাংস লোলুপ হইয়াছে অতএব সমস্ত মাংসই তাহাদিগের তৃপ্তার্থে প্রদত্ত হউক।
(ঋগবেদ ১।১৬২।১১)
আলোচনাঃ
এই পক্ষের আলোচনার জন্য আমরা দেখবো যে, বেদে অশ্বের বধ সমন্ধ্যে কি লেখা রয়েছে। যদি বেদে অশ্বের বধ কে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়ে থাকে তো অশ্বমেধের পৌরাণিক ভাব বেদের দৃষ্টিতে সর্বদা অসংগত এবং ত্যজ্য হবে। অতঃ ইহার নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত বেদমন্ত্রের উপর অবশ্যই বিচার করা উচিৎ। যথাঃ
(i) যঃ পৌরষেযেণ ক্রবিষাং সমঙ্কতে যো অশ্বয়েন পশুনাং যতুধান।
যো অঘ্ন্যায় ভরতি ক্ষীরমগ্নে তেষাং শীর্ষাণি হরসাপি বৃশ্চ।।
(অথর্ববেদ ৮।৩।১৫)
- যে দুঃখদায়ী জীব পুরুষ বধ দ্বারা প্রাপ্ত মাংস দ্বারা যে ঘোড়ার মাংস এবং পশু দ্বারা নিজেকে পুষ্ট করে এবং যে হত্যার অযোগ্য গাভীর দুধকে নষ্ট করে হে অগ্নি তাহার শির কে নিজের বল দ্বারা ছিন্ন করো।
(ii) ইমং মা হিংসীরেকশফং পশুং কনিকদং বাজিনং বাজিনেষু।।
(যজুর্বেদ ১৩।৪৮)
- হে পুরুষ এই হর্ষ ধ্বনিকারক এক ক্ষুর বিশিষ্ট বেগবান অশ্বকে মেরো না।
( iii) " একশফো বা এষ পশুর্যদশ্চ; তং মা হিংসীরিতি"
(শতপথঃ ৭।৫।২।৩৩)
- ইহার অভিপ্রায় এই যে, একশফ শব্দ দ্বারা অশ্বের গ্রহন হয়ে থাকে। এইজন্য একশফ পশু অশ্বকে তুমি হিংসা করো না।
(iv) যে অর্বন্ত জিঘাংসতি তমজ্যসীতি বরুণঃ পরো মর্তঃ পরঃশ্ব।।
(যজুর্বেদ ২২।৫)
-যে মনুষ্য অশ্বকে হত্যার ইচ্ছা করে হে বরুণ তাকে শাস্তি প্রদান করো।
(v) যদি নো গাং হংসি যদ্যশ্বং যদি পুরুষম।তং ত্বা সীসেন বিধ্যামো যথা নোহসো অবীরহা।।
(অথর্বেদ ১।১৬।৪)
- যদি আমাদের গাভীকে হিংসা কর যদি অশ্বকে যদি মনুষ্যকে হিংসা কর তবে তোমাকে সীসক দ্বারা বিদ্ধ করিব যাহাতে আমাদের মধ্যে বীরদের বিনাশক কেহ না থাকে।
(vi) "অনাগো হত্যা বৈ ভীমা কৃত্যে মা নো গাম অশ্বম পুরুষং বধী"
(অথর্ববেদ ১০।১।২৯)
- নির্দোষের হত্যা অবশ্যই ভয়ানক। আমাদের গাভী, অশ্ব, পুরুষকে মেরো না।
( vii) রাজসূয়ং বাজপেয়মগ্নিষ্টোমস্তদধ্বরঃ।
অর্কাশ্বমেধাবুচ্ছিষ্ট জীবর্বহিভমদিন্তম।।
(অথর্ববেদ ১১।৭।৭)
- রাজসূয়, বাজপেয়, অগ্নিষ্টোম এইসব যজ্ঞ অধ্বর অর্থাৎ হিংসারহিত। অর্ক এবং অশ্বমেধ যজ্ঞ প্রভূর মধ্যে স্থিত, যাহা জীবের বৃদ্ধিকারী এবং অতন্ত্য হর্ষদায়ক।
বেদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইহা স্পষ্ট যে, অশ্ব কে বধ করা সর্বদা নিষিদ্ধ এবং কেউ যদি বধের চেষ্টা করে তবে তাকে শাস্তির বিধান পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। রাজসুয়, বাজপেয়, অশ্বমেধ যজ্ঞ আদিকে অধ্বর বলা হয়েছে অর্থাৎ যাতে হিংসা না হয়। অতএব সায়ন এবং রমেশের ভাষ্য বেদের সাংঘর্ষিক তথা অসংগত। উক্ত মন্ত্রের সুনির্মল অর্থ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বের করেছেন। পাঠকদের জন্য তারই উপস্থাপন করা হলো -
যত্তে গাত্রাদগ্নিনা পচ্যমানদভি শূলং নিহতস্যাবধাবতি।
মা তদ্ভূম্যামাশ্রিষন্মা তৃণেষু দেবেভ্যস্তদুশদভ্যো রাতমস্তু।।
(ঋগবেদ ১।১৬২।১১)
পদার্থঃ হে বিদ্বান! (নিহতস্য)নিরন্তর চলময়মান [নি পূর্বক হন ধাতুর অর্থে, হন= গতি ] (তে) তোমার (অগ্নিনা) ক্রোধাগ্নি দ্বারা (পচ্যয়মানাত্) তপ্ত হয়ে (গাত্রাত্) শরীর থেকে বা হাত থেকে (যত্) যে অস্ত্র (অভিশূলম) লক্ষ্যে শুলের সমান [পীড়াকারক শত্রুর সম্মুখে] (অবধাবতি) ধাবিত হয় (তত্) ইহা (ভূম্যাম) ভূমির মধ্যে ( মা, আ, শ্রিষত) পড়ে না থাকে (তৃণেষু) ঘাসআদির মধ্যে থাকে।( উশদম্ভঃ) আমাদের সম্পদকে ইচ্ছাকারী (দেবেভ্য) গুণবান দের জন্য (রাতম অস্ত) অর্পনকৃত হোক।
সরলার্থঃ হে বিদ্বান! নিরন্তর চলময়মান তোমার ক্রোধাগ্নি দ্বারা তপ্ত হয়ে শরীর থেকে বা হাত থেকে যে অস্ত্র লক্ষ্যে শুলের সমান [পীড়াকারক শত্রুর সম্মুখে] ধাবিত হয় ইহা ভূমির মধ্যে পড়ে না থাকে ঘাসআদির মধ্যে না থাকে। আমাদের সম্পদকে ইচ্ছাকারী গুণবান দের জন্য অর্পনকৃত হোক।
0 মন্তব্য(গুলি)
Author
অমৃতস্য পুত্রা