নিমিত্ত কারণ দুই প্রকার - প্রথম ও মুখ্য নিমিত্ত কারণ "পরমাত্মা"। তিনি কারণ হতে সকল সৃষ্টির সৃজন, ধারণ, প্রলয় এবং সকল ব্যবস্থার রক্ষক। দ্বিতীয় কারণ - পরমেশ্বরের সৃষ্টি হতে পদার্থ সমূহ নিয়ে বহুবিধ কার্যান্তর নির্মাণকারী সাধারণ নিমিত্ত কারণ "জীব"।
উপাদান কারণ - প্রকৃতি পরমাণু, তাহা অনাদি অর্থাৎ পূর্ব হতেই তাহার বিদ্যমানতা রয়েছে (প্রকৃতিং পুরুষং চৈব বিদ্ধনাদী উভাবপি (গীতা ১৩।১৯)। তাহাকে সমস্ত জগৎ নির্মাণের সামগ্রী বলা হয়। তাহা জড় পদার্থ বলে স্বয়ং নির্মিত বা বিকৃত হতে পারে না। কিন্তু অপর কারো দ্বারা নির্মিত বা বিকৃত হয়ে থাকে। কখনও কখনও জড় নিমিত্ত দ্বারা জড়ের উৎপত্তি এবং বিকৃতও হয়। উদাহরণস্বরূপ পরমেশ্বর সৃষ্ট বীজ ভূমিতে পতিত হয়ে জলপ্রাপ্ত হলে বৃক্ষাকার এবং অগ্নি প্রভৃতি জড় পদার্থের সংযোগ বশ বিকৃতও হয়ে থাকে। কিন্তু নিয়মানুসারে এই সকল পদার্থের নির্মাণ অথবা বিকৃত হওয়া পরমেশ্বর ও জীবের অধিন।
যখন কোন বস্তু নির্মিত হয়, তখন যে যে সাধন অর্থাৎ জ্ঞান, দর্শন, বল হস্ত ও নানাবিধ উপকরণ এবং দিক, কাল ও আকাশ আদি সাধারণ কারণ। উদাহরণস্বরূপ ঘট নির্মাণকর্তা কুম্ভকার নিমিত্ত, মৃত্তিকা উপাদান, দন্ড, চক্র প্রভৃতি সামান্য নিমিত্ত এবং দিক, কাল, আকাশ, আলোক চক্ষু, হস্ত জ্ঞান ও ক্রিয়া প্রভৃতি নিমিত্ত সাধারণ এবং নিমিত্ত কারণও হয়ে থাকে। এই তিন কারণ ব্যতিত কোন বস্তু নির্মিত অথবা বিকৃত হতে পারে না।
নবীন বেদান্তিগণ বেদান্তের ১।৪।২৩-২৭ সূত্রের উল্লেখ করে পরমেশ্বরকে জগতের উপাদান কারণ বলে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা করে।
প্রথম কথা এই যে, ব্রহ্ম যদি জগতের উপাদান কারণ হন তবে তিনি পরিণামী ও অবস্থান্তরযুক্ত হয়ে পড়বেন। কেননা উপাদান কারণের গুন কর্ম স্বভাব কার্যেও স্থিত থাকে।
কারণগুণপূর্বকঃ কার্য্য গুণো দৃষ্টঃ।।
(বৈশেষিক সূ০ ২।১।২৪)
যদি উপাদান কারণের সদৃশ কার্যেও গুণ থাকে, তবে ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দস্বরূপ কার্য্যরূপ জগৎ হওয়াতে অসৎ, জড় এবং আনন্দরহিত হবেন। ব্রহ্ম উৎপন্নরহিত কিন্তু জগৎ উৎপন্ন হয়েছে। ব্রহ্ম অদৃশ্য কিন্তু জগৎ দৃশ্য। ব্রহ্ম অখন্ড কিন্তু জগৎ খন্ডরূপ। যদি ব্রহ্ম হতে পৃথিবী প্রভৃতি কার্য্য উৎপন্ন তবে পৃথিবী প্রভৃতি কার্য্যের জড়ত্ব গুণ ব্রহ্মেও থাকবে। অর্থাৎ পৃথিবী আদি জড় পদার্থের ন্যায় ব্রহ্মও জড় হবে। যেরূপ পরমেশ্বর চেতন সেইরূপ পৃথিবী আদি কার্যেরও চেতন হওয়া উচিৎ। সেহেতু পরমেশ্বরকে জগতের উপাদান কারণ বলা চলে না।
এক্ষনে বেদান্তসূত্রগুলোর উপর আলোচনা করা যাইতেছে -
প্রকৃতিশ্চ প্রতিজ্ঞাদৃষ্টান্তানুপরোধাত্।।
(বেদান্তসূত্র ১।৪।২৩)
(প্রকৃতিঃ - চ) প্রকৃতিও জগতের জন্মাদি কারণ কিন্তু পরমাত্মার অধিন উপাদানস্বরূপে না কি স্বতন্ত্র কারণ। জগতের কারণ উপাদানরুপ কারণ প্রকৃতি কেমন, ইহা বলছে (প্রতিজ্ঞাদৃষ্টান্তানুপরোধাত্) প্রতিজ্ঞার এবং দৃষ্টান্তের উপলব্ধ হওয়ার কারণে। প্রতিজ্ঞা - " য এষ সুমেষু জাগর্তি কামং কামং পুরুষো নির্মিমাণঃ। তদেব শুক্রং তদ্ ব্রহ্ম...." (কঠ ২।২।৮) এই বচনে যথেষ্ঠ জগতের নির্মাণের হেতু সুপ্তের মধ্যে জাগ্রত, এরূপ বলা হয়েছে। তখন সুপ্তের সত্তাও সিদ্ধ হয়। তাহাতে প্রকৃতি সুপ্ত অথবা জীবও সুপ্ত, সেই সুপ্তের মধ্যে পরমাত্মাই জাগ্রত। উক্ত কথন দ্বারা সৃষ্টির পূর্বে কেবল পরমাত্মাই ছিলো এরূপ কথা নয়, তাহা ভিন্ন প্রকৃতিও অব্যক্ত ছিলো। তাহাও জগতের কারণ, তথা 'কামং কামং নির্মিমাণঃ' কথন দ্বারা নির্মাতা পরমাত্মা থেকে ভিন্ন অন্য বস্তুও অপেক্ষিত কারণ একাকী চেতন পরমাত্মায় কামনা অর্থাৎ সঙ্কল্প সঙ্গত নয়, যখন নিজ থেকে ভিন্ন বস্তু কে দেখা যায় তখনই তাহার সমন্ধ্যে সঙ্কল্পের প্রাদুর্ভাব হয় অন্যথা নয়। সাথে 'নির্মিমাণঃ' শব্দ দ্বারা তিনি নির্মাতা = কর্তা এবং তাহা ভিন্ন যাহা দ্বারা নির্মাণ করেন, তাহা প্রকৃতি প্রতিজ্ঞাত হয়ে সিদ্ধ হয়, অতঃ প্রকৃতিও জগতের কারণ, ইহা সিদ্ধ হয়। নির্মাতা থেকে ভিন্ন বস্তুর নাম প্রকৃতি সার্থক। আরো দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় - "অগ্নির্যথৈকো ভূবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব। একস্তথা সর্বভূতান্তরাত্মা রূপং রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ" (কঠো ২।২।৯) এই দৃষ্টান্তে যেমন অগ্নি সমস্ত ভূতের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে তৈজস ধর্ম দ্বারা তার ভিতরে বর্তমান, ওইরূপ পরমাত্মা সমস্ত ভূতের মধ্যে থেকে তাদের ভিতরে বর্তমান, এবং তিনি বাহিরেও। এই কথন কেবল ব্রহ্মই নয়, বরং তার থেকে ভিন্ন অন্য বস্তুও রয়েছে, যাহার বাইরে তাহার বর্তমানতা দেখানো হয়েছে।
শঙ্করভাষ্যে যে, " যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে"।(তৈ০ উ০ ৩।১) এই তৈতেরীয় বচনে পঞ্চমী বিভক্তির আশ্রয় নিয়ে ব্রহ্ম জগতের প্রকৃতি এরূপ অর্থ করেছেন, তাহাতে "জনিকর্তুঃ প্রকৃতি" (অষ্টা০১।৪।৩০) প্রমাণ দ্বারা অপাদান কারক পরমাত্মাকে স্থাপিত করেছেন, তাহা ঠিক নয়। অন্যত্রও পঞ্চমী বিভক্তির প্রয়োগ হওয়ার কারনে, যেমন - "আদিত্যাজ্জায়তে বৃষ্টিঃ (মনু ০ ৩।৭৬) অর্থাৎ সূর্য থেকে বৃষ্টি হয়। এখানে বৃষ্টির জনক আদিত্যের কথন দ্বারা আদিত্য শব্দে পঞ্চমী বিভক্তি তার প্রকৃতি হওয়ার কারণে নয় তথা " তস্মাদ্ যজ্ঞাৎসর্বহুত ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে।।" (যজু০ ৩১।৭) এখানে যজ্ঞ থেকে অর্থাৎ যজ্ঞস্বরূপ পরমাত্মা থেকে ঋগবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদের জায়মানতা = উৎপত্তি বলা হয়েছে এবং যজ্ঞ শব্দে পঞ্চমী বিভক্তি। এখানে ঋগবেদাদির জায়মানতায় প্রকৃতি নয়। এবং শঙ্করাচার্যের প্রদত্ত বচন " যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে" (তৈ০উ০ ৩।১) এ কেবল জায়মানতার বর্ণনা নেই, বরং পুরো বচনে তো আরো কিছু বলা হয়েছে। পুরো বচন হচ্ছে - " যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে যেন জাতানি জীবন্তি যত্ প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি তদ্ বিজিজ্ঞাসস্ব তদ্ ব্রহ্ম" (তৈ০উ০ ৩।১) ইহাতে কেবল জায়মানতারই নির্দেশ নেই, বরং স্থিতি এবং নাশেরও বলা হয়েছে এবং তৃতীয়া তথা দ্বিতীয়া বিভক্তিরও প্রয়োগ হয়েছে। এই প্রকার এখানে পঞ্চমী বিভক্তি দ্বারা অপাদানতা লক্ষিত নয়, বরং পঞ্চমী বিভক্তি হেতুতে জানা উচিৎ যেমন বেদান্তসূত্রে "জন্মাদ্যস্য যতঃ" (বেদা০ ১।১।২) এই সূত্রে জগতের জন্মের সাথে তার স্থিতি এবং নাশের যোগেও পঞ্চমী বিভক্তি হওয়ার কারনে তাহা পঞ্চমী হেতু অর্থাৎ পরমাত্মা জগতের জন্ম উৎপত্তি, স্থিতি এবং নাশের হেতু অর্থাৎ প্রবর্তক।।২৩।।
অভিধ্যোপদেশাচ্চ।।
(বেদান্তসূত্র ১।৪।২৪)
(অভিধ্যোপদেশাত্ চ) প্রকৃতিও জগতের কারণ ইহাতে অভিধ্যোপদেশ ও এক হেতু যে অভিধ্যা = অভিমুখ্য রূপ ধ্যান অর্থাৎ কোনও পদার্থ কে লক্ষ্য করে যে ধ্যান বা বিচার হয় তাহা অভিধ্যান বা অভিধ্যা, তাহার প্রতিপাদ হওয়ার কারনেও। অভিধ্যা বা অভিধ্যানের লক্ষ্য প্রকৃতি যাহা জগতের কারণ সিদ্ধ হয় তাহার অভিধ্যানের উপদেশ - "সোহকাময়ত বহু স্যাং প্রজায়েয়" (ছান্দো০ ৬।২।৩) = যেমন কোন জন নিজ স্ত্রীর লক্ষ করে ধ্যান করেন যে আমি ইহার মধ্যে প্রবেশ করে প্রজারূপ দ্বারা বহু হবো, সেই প্রকার পরমাত্মা নিজ শরীররূপ প্রকৃতির মধ্যে অভিধ্যান দ্বারা প্রবিষ্ট হয়ে বহু নামের দ্বারা বলার যোগ্য হবো। কেবল নিজ আশ্রয়ের উপর বহু হওয়ার কল্পনা একেলা চেতন পরমাত্মার মধ্যে নয়, তাহার অখন্ড হওয়ার কারনে তথা স্বরূপ জ্ঞানের প্রসঙ্গে দোষ ঘটে। স্বরূপহানিতে তাহার কোন লাভ নেই যখন তাহা ভিন্ন কোন অন্য বস্তুই নেই, অতঃ তাহার নিজ থেকে ভিন্ন কে অভিলক্ষিত করার দ্বারাই প্রকৃতির সত্তা জগতের উপাদানকারণরূপে সিদ্ধ হয়ে যায়।।২৪।।
সাক্ষাচ্চোভয়াম্রানাত্।।
(বেদান্তসূত্রঃ ১।৪।২৫)
(সাক্ষাত্ চ উভয়াম্রানাত্) সাক্ষাৎ উভয় পরমাত্মা এবং প্রকৃতির সৃষ্টি উৎপত্তির কারণরূপে বিধান হওয়ার কারনে, যেমন " তস্মাদ্বা এতস্মাদাত্মন আকাশঃ সম্ভূতঃ। আকাশাদ্বায়ুঃ। বায়োরগ্নিঃ। অগ্নেরাপঃ।অদভ্যঃ পৃথিবী...(তৈ০উ০ ২।১) এই বচনে তস্মাদ্ শব্দ দ্বারা অব্যক্ত প্রকৃতি এবং "এতস্মাদ" শব্দ দ্বারা পরমাত্মা থেকে আকাশ আদি সৃষ্টি উৎপন্ন হয়েছে, এরূপ বলা হয়েছে। এবং "যদা পশ্যঃ পশ্যতে রুক্মবর্ণ কর্তারমীশং পুরুষং ব্রহ্মযোনিম্" (মুন্ডক ৩।১।৩) এই বচনে জগতের উৎপত্তি কর্মে পরমাত্মা নিমিত্তি কারণ বলা হয়েছে এবং "অজামেকাং লোহিমশুক্লকৃষ্ণাং বহ্লীঃ প্রজাঃ সৃজমানাং সরূপাঃ" (শ্বেতা০ ৪।৫) এই বচনে ত্রিগুণময়ী = তিন গুণময়ী প্রকৃতি কে জগতের কারণ বলা হয়েছে। এই প্রকার এই প্রকার এই বচনে সাক্ষাৎ পরমাত্মা এবং প্রকৃতি কে জগতের কারণ প্রসঙ্গে পাঠ করা হয়েছে, অতঃ উভয় কারণ। তথা " মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং তু মহেশ্বরম্" (শ্বেতা০ ৪।১০) এই বচনে পরমেশ্বর এবং প্রকৃতি উভয়কে সাক্ষাৎ পাঠ করা হয়েছে। বেদে সৃষ্টির উৎপত্তির প্রসঙ্গে উভয় পাঠ হয়েছে - " ইয়ং বিসৃষ্টির্যত আবভূব....সোহস্যাধ্যক্ষঃ" (ঋ০ ১০।১২৯।৭) এই বচনে বিবিধ সৃষ্টি যেই উপাদান কারণ দ্বারা ব্যক্ত হয়েছে সেই অব্যক্ত প্রকৃতির অধ্যক্ষ্য পরমাত্মাকে বলা হয়েছে, অতঃ পরমাত্মা এবং প্রকৃতি উভয়ই জগতের কারণ। নিমিত্ত কারণ পরমাত্মা এবং উপাদান কারণ প্রকৃতি।
শঙ্করভাষ্যে "উভয়াম্রানাত" শব্দ দ্বারা প্রভব এবং প্রলয়ের জন্য হয়েছে, ইহা উচিৎ নয়। কারণ উভয় শব্দ সর্বনাম এবং সর্বনাম শব্দ সমীপী বা উপস্থিত বা লক্ষিত বস্তুর জন্য প্রযুক্ত হয়। সমীপী বা উপস্থিত বা লক্ষিত এখানে পরমাত্মা বা প্রকৃতি হওয়ার কারণে উভয়ই গ্রহন করার যোগ্য, অন্য কিছু নয়। এবং যে প্রভব তথা প্রলয় সেই পরমাত্মার মধ্যে, পরমাত্মার কার্য দর্শায়, তাহা না কেবল উভয়ই পরমাত্মার কার্য বরং তিন অর্থাৎ প্রভব স্থিতি এবং প্রলয়। যাহা বলাও হয়েছে - "যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে, যেন জানাতি জীবন্তি, যৎপ্রত্যন্ত্যভিসংবিশন্তি তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব তদ্ ব্রহ্ম " (তৈ০উ০ ৩।১) যাহা থেকে সমস্ত ভূত উৎপন্ন হয়েছে, যাহার আধারে জীবিত রয়েছে এবং যাহার মধ্যে প্রলয় কে প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ যে উৎপত্তি স্থিতি এবং প্রলয়ের প্রবর্তক তাহাকেই তুমি ব্রহ্ম জানো। এই প্রকার বিবেচন দ্বারা এই সূত্রের শঙ্করভাষ্য অনর্গল, অযুক্ত।।২৫।।
আত্মকৃতেঃ পরিণামাত্।।
(বেদান্তসূত্রঃ ১।৪।২৬)
(আত্মকৃতেঃ পরিণামাত্) প্রকৃতির পরিণাম চেতন পরমাত্মার কৃতি = কারীগরী, অতঃ প্রকৃতি উপাদান কারণ, কারণ তাহাতে পরিণাম হয় এবং পরমাত্মা নিমিত্ত কারণ যেহেতু তিনি পরিণামের কর্তা। যেমন বলা হয়েছে - " স তপোহতপ্যত স তপস্তপ্ত্বা। ইদং সর্বমসৃজত্" (তৈ০উ০ ২।৬) = সেই পরমাত্মা নিজ জ্ঞানময় তপ তপিয়েছেন।, পুনরায় জ্ঞানময় তপ করে এই সমস্ত জগৎ কে উৎপন্ন করেছেন। বেদেও - দ্যাবাভূমী জনয়ন দেব একঃ" (ঋ০ ১০।৮১।৩, যজু০ ১৭।১৯) = দ্যুলোক থেকে ভূলোক পর্যন্ত সমস্ত সৃষ্টি কে উৎপন্ন কারক এক পরমাত্মাদেব। সূত্রে পরিণামের কর্তা পরমাত্মা বলা হয়েছে এবং পরিণাম হয় অনাত্মা অর্থাৎ জড়তে, সূত্রে প্রদত্ত "আত্মকৃতে" শব্দ দ্বারা স্পষ্ট। এই প্রকার এখানে আত্মা অর্থাৎ চেতন পরমাত্মা পরিণামের কর্তা এবং অনাত্মা জড় প্রকৃতি পরিণাম কে প্রাপ্ত উপাদান কারণরূপ সংকেতিত।।২৬।।
যোনিশ্চ হি গীয়তে।।
(বেদান্তঃ ১।৪।২৭)
(যোনিঃ চ হি গীয়তে) অতএব পরিণামের কর্তা পরমাত্মা যোনি অর্থাৎ সবার আশ্রয় বলা যায়। জীবের, প্রকৃতির এবং ভূতের তিনি আধার। তাহার অনন্ত এবং পরিণামকর্তা হওয়ার কারণে অনন্ত বস্তু স্বয়ং পরিণাম কে প্রাপ্ত হয় না কিন্ত একদেশী এবং জড় বস্তুই পরিণাম কে প্রাপ্ত হয়। পরমাত্মা তো যোনী অর্থাৎ আধাররূপেই বর্তমান যেমন বলা হয়েছে - "এষ হ যোনিঃ সর্বস্য " (মান্ডু০ ৬) "কর্তারমীশং পুরুষং ব্রহ্মযোনিম্" (মুন্ড০ ৩।১।৩) "সর্বাণি হ বা ইমানি ভূতান্যাকাশাদেব সমুৎপদ্যন্তে, আকাশং প্রত্যস্তং যন্তি, আকাশো হ্যেভ্যো জ্যায়ান্ আকাশঃ পরায়ণম্" (ছান্দো০ ১।৯।১) এই বচনে পরমাত্মা কে সবার যোনি অর্থাৎ আধার বলা হয়েছে, অতঃ পরমাত্মা নিমিত্ত কারণ, ইহা জানা উচিৎ।
যদি তো সবার উৎপত্তিস্থান হওয়ার কারণে পরমাত্মাকে যোনি বলা যায়, যেমন নবীন বেদান্তী মানে, কিন্তু তিনি তো সবার লয় স্খানও এবং এই সব উৎপন্ন তথা লীন হয়েও অর্থাৎ প্রকৃতির রূপে প্রাপ্ত হয়েও মহান। তাহার লীনাবস্থা প্রকৃতিই, সেই প্রকৃতি থেকেও মহান, প্রকৃতি সেই পরমাত্মার সম্মুখ একদেশী, তুচ্ছ। ইহা বেদে বলা হয়েছে - " তম আসীত্ তমসা গূঢমগ্নেহপ্রকেতং সলিলং সর্বভা ইদম্। তুচ্ছ্যেনাভ্বপিহিতং যদাসীত্তপসস্তন্মহিনা জায়তৈকম্।।(ঋ০ ১০।১২৯।৩) = সৃষ্টির পূর্বে অন্ধকা্ ছিলো, জলের সমান এব এক রস বিস্তারিত ছিলো। "আভু" নামের পদার্থ তুচ্ছরূপে একদেশী রূপে বর্তমান বলা হয়েছে, এই উপাদান স্বরূপ প্রকৃতি পরিণামী। পরিণাম কে প্রাপ্ত বস্তু অনন্ত হয় না, অতঃ পরমাত্মা পরিণামকর্তা অনন্ত সিদ্ধ হয়। যদি পরমাত্মাই পরিণাম কে প্রাপ্ত হয় তো পুনরায় উৎপন্ন তথা লীন হওয়া পদার্থ কিভাবে মহান বলা যেতে পারে। প্রকৃতি তাহার সম্মুখে একদেশী, তাহার বিকার অর্থাৎ উৎপন্ন পদার্থ এবং পুনঃ তাহা লীণ হয়ে প্রকৃতিরূপে আগত একদেশীই হয়ে থাকে। যদি পরমাত্মাই স্বয়ং বিকার কে প্রাপ্ত হয় তখন বিকৃতি কে প্রাপ্ত এবং বিনাশকালে প্রকৃতি কে প্রাপ্ত হওয়া লীন পদার্থে মহান কিভাবে হতে পারে ? অতঃ পরমাত্মা অনন্ত এবং সবার আশ্রয় হওয়ার কারণে নিমিত্ত কারণ।
0 মন্তব্য(গুলি)