https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

রহস্য--অহিংস নীতি ও ধর্ম্যযুদ্ধ

Friday, May 11, 2018
Image result for war of mahabharat

★প্রশ্নঃ- গীতার সারার্থ বুঝিলাম,কিন্তু "নির্বৈর" কথাটির মর্ম বুঝিলাম না। গীতায় সর্বত্রই ভগবান প্রিয় শিষ্যকে যুদ্ধকার্যে প্রণোদিত করিতেছেন, অর্জুনও ভগবদ্-বাক্যে প্রবুদ্ধ হইয়া পরিশেষে যুদ্ধই করিলেন। এ স্থলে কিন্তু "নির্বৈর" হইতে বলা হইতেছে। ইহাই যদি গীতার সারকথা হয়,তবে "যুদ্ধ কর" "যুদ্ধ কর" এসব কথা কি কথার কথা মাত্র? "নির্বৈর" হইলে আবার যুদ্ধ হয় কিরূপে?
এই শ্লোকে এবং ১২/১৩ প্রভৃতি শ্লোকে "অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাম্" "সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী" ইত্যাদি রূপেই জ্ঞানী ভগবদ্ভক্তের বর্ণনা আছে এবং উহাকেই ১২/২০ শ্লোকে "ধর্মামৃত" বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। এ সকল ত অহিংসা ও ক্ষমাধর্মের চরম আদর্শ। মহাভারতের অন্যান্য বহু স্থলেই এইরূপ অহিংসা, অক্রোধ ও ক্ষমাধর্মেরই উপদেশ আছে। যেমন---"ন পাপে প্রতিপাপঃ স্যাৎ সাধুরেব সদা ভবেৎ" (---মহাভাঃ বনপর্ব) ;"ন চাপি বৈরং বৈরেণ কেশব ব্যুপশাম্যতি" (---উন্যোঃ ৭২/৬৩) ; "অক্রোধেন জয়েৎ ক্রোধং অসাধুং সাধুনা জয়েৎ" (---বিদুর-বাক্য) ; "ধর্মেণ নিধনং শ্রেয়ঃ ন জয়ঃ পাপকর্মণা" (---ভীষ্ম-বাক্য,শাং ৯৫/৯৬) ।
এ সকল কথার মর্ম এই যে,শত্রুকে প্রীতি দ্বারা, অসাধুকে সাধুতা দ্বারাই জয় করিবে। শত্রুর সহিত শত্রুতাচরণ করিবে, এ উপদেশ কোথায়?

★উত্তরঃ- তাহাও আছে,বহু স্থলে। শান্তিপর্বে ভীষ্মদেব যুধিষ্ঠিরকে ধর্মতত্ত্ব এইরূপে বলিতেছেন--- 


"যস্মিন্ যথা বর্ততে যো মনুষ্যস্তস্মিংস্তথা বর্তিতব্যং স ধর্মঃ" 
(শান্তিপর্ব ১০৯/৩০ )(In some Edition 106.33)
=>>যে যেরূপ ব্যবহার করে তাহার সহিত সেইরূপ ব্যবহার করাই ধর্মনীতি




 অর্থাৎ যে হিংসুক---যেমন দুর্যোধনাদি, তাহার প্রতি হিংসানীতিই অবলম্বনীয় এবং উহাই সে স্থলে ধর্ম, নচেৎ লোকরক্ষা হয় না ; কারণ,

"যঃ স্যদ্ধারণসংযুক্তঃ স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ"  
( শান্তি ১০৯/­১১) (In some Edition 106.14)
=>> যাহাদ্বারা লোকরক্ষা হয় তাহাই ধর্ম




"ন শ্রেয়ঃ সততং তেজো ন নিত্যং শ্রেয়সী ক্ষমা"।
"তস্মান্নিত্যং ক্ষমা তাত পণ্ডিতৈরপবাদিতা"
( মহাভাঃ বন ২৮।৬,৮ )
=>>সর্বদ­াই তেজ বা ক্ষমা প্রকাশ শ্রেয়স্কর নহে, অবস্থানুসারে ব্যবস্থা ; সকল অবস্থায়ই ক্ষমা করাটা পন্ডিতেরা মন্দ বলিয়া থাকেন


সংযোজন :
অগ্নিদাতা গরদোশ্চৈব শস্ত্রপাণীর্ধনাপহঃ ।
ক্ষেত্রদারাপহারী চ ষড়েতেহ্যাততায়িনঃ ।। 
বশিষ্ঠ সংহিতা ৩.১৬
=>>অগ্নিদাতা,বিষদাতা,ধারালো অস্ত্রহাতে আক্রমণকারী ,ধন সম্পদ লুণ্ঠনকারী,ক্ষেত্র দখলকারী,গৃহের রমণীদেল অপহরণকারী এই ৬ প্রকার দুষ্কৃতকারীরা আততায়ী

দুর্যোধন,কর্ণাদি সকলেই পাণ্ডবগণকে বারণাবতে পোড়াইয়া মারিতে চাহিয়াছিল সুতরাং তাঁহারাও আততায়ী আততায়ীদের প্রতি কি করা আচরণ করা সমুচিত এ বিষয়ে মহারাজ মনু মনুসংহিতার ৮.৩৫০,৩৫১ এ কহিয়াছেন -

বীরনারী বিদুলাও শত্রুকর্তৃক আক্রান্ত অথচ প্রতিকারে পরাঙ্মুখ নিরুদ্যম পুত্রকে ভর্ৎসনা করিয়া বলিয়াছিলেন- '

উক্তিষ্ঠ হে কাপুরুষ , মা স্বাস্পীঃ শত্রুনির্জিতঃ', 'ক্ষমাবান্নিরমর্যশ্চ­ নৈব স্ত্রী ন পুনঃ পুমান্'( -মহাভাঃ উদ্যো, ১৩৪।১২,৩৩ )(In some Edition 124.8,32)

- হে কাপুরুষ, শত্রুনির্জিত হইয়া আর শয়নে থাকিও না, উঠ





যে নিয়ত ক্ষমাশীল, নির্জিত হইয়াও যে ক্রুদ্ধ হয় না, প্রতিকার করে না, সে স্ত্রী ও নহে, পুরুষ ও নহে- অর্থাৎ ক্লীব





এ সকল স্থলে অবস্থাবিশেষে যুদ্ধদি হিংসাত্মক কর্মের অনুমোদন এবং ক্ষমাধর্মের অপবাদই করা হইয়াছে। বস্তুতঃ, ব্যবহারিক ধর্মতত্ত্ব বড় স্থূল ও জটিল।
অহিংসনীতি ও অত্যাচারী সংহার, সত্যকথন ও দস্যুতাড়িত পলায়নপর আশ্রিতের রক্ষা, ইত্যাদি স্থলে যখন পরস্পর বিরোধ উপস্থিত হয়, তখন কোনটি অধর্ম তাহা নির্ণয় করা বড় সহজ নহে, এই হেতু মহাভারতে পুনঃ পুনঃ বলা হইয়াছে,

'সূক্ষ্মা গতির্হি ধর্মস্য।'

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরও বিভিন্ন শ্রুতি, স্মৃতি ও নানা মুনির নানা মত দেখিয়া,

'ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াম্',

অর্থাৎ ধর্মতত্ত্ব একরূপ অজ্ঞেয় এইরূপই বলিয়াছেন এবং মহাজনো যেন গতঃ সঃ পন্থা,' এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। কিন্তু ইহাতেও পথ সুস্পষ্ট দেখা যায় না, কেননা মুনিগণও মহাজনের মধ্যেই এবং অন্য মহাজনগণের মধ্যেও মতভেদ হইতে পারে।

তবে স্বনামখ্যাত টীকাকার শ্রীমন্নীলকণ্ঠ এস্থলে 'মহাজন ' শব্দের অর্থ করেন 'বহুজন' অর্থাৎ তাঁহার মতে অধিক লোক যে পথ অবলম্বন করে সংশয়স্থলে তাহাই অনুসরণ-যোগ্য, এই অর্থ।ইহারই নামান্তর লোকাচার।

এই ব্যাখ্যাই সমীচীন বোধ হয়, কিন্তু ইহাতেও প্রকৃত তত্ত্বের কোন মীমাংসা হয় না। মহাভারতে এ সকল প্রসঙ্গে অনেক সূক্ষ্মানুসুক্ষ্ম বিচার-বিতর্ক আছে। তাহার আলোচনা করার স্থানাভাব, এস্থলে প্রয়োজনও নাই। কেননা গীতায় ভগবান্ ধর্মাধর্ম নির্ণয়ের এ সকল লৌকিক নীতিশাস্ত্রের পন্থা অবলম্বন করেন নাই। যে সার্বভৌম মূলতত্ত্বের উপর সমগ্র ধর্মশাস্ত্র প্রতিষ্ঠিতত এবং যাহা অধিগত হইলে জীবের পরম নিঃশ্রেয়স লাভ হয় এবং জগৎব্যাপারও অব্যাহত থাকে, সেই সনাতন অধ্যাত্মতত্ত্বের ভিত্তিতেই ভগবান্ অর্জুনকে কর্মযোগের উপদেশ দিয়াছেন। উহার স্থূল কথা হইতেছে এই, -আত্মজ্ঞান লাভ কর, কামনা ত্যাগ কর, স্থিত-প্রজ্ঞ হও, সর্বভূতে সমদর্শী হও, অহংকার ও মমত্ব-বৃদ্ধি দূর কর,-আমাতে আত্মসমর্পণ ও সর্বকর্ম সমর্পণ কর, আমারই ভৃত্যবোধে আপনাকে নিমিত্তমাত্র জ্ঞান করিয়া নিষ্কামভাবে যথাপ্রাপ্ত কর্ম করিয়া নিষ্কামভা‌বে যথাপ্রাপ্ত কর্ম ক‌রিয়া যাও,তাহা‌তে ক‌র্মের শুভাশুভ-ফলভাগী হই‌বে না।

এস্থ‌লে '‌নি‌র্বৈর' শ‌ব্দের অর্থ এই যে, কাহারও প্র‌তি‌ বৈরভাব রা‌খি‌বে না। অাস‌ক্তি যাহার ত্যাগ হইয়া‌ছে, অহংজ্ঞান যাহার নাই, সর্বভূ‌তে যাহার সমত্ববু‌দ্ধি জ‌ন্মিয়া‌ছে_যাহার অাত্মপ‌রে; শত্রু‌মি‌ত্রে ভেদবু‌দ্ধি নাই, তাহার ম‌নে বৈরভাব অা‌সি‌বে কিরূ‌পে? এই রূপ সমত্ববু‌দ্ধি- সম্পন্ন শুদ্ধ অন্তকর‌ণে নি‌র্বৈর হইয়াও যুদ্ধ করা চ‌লে এবং তাহাই শ্রীভগবা‌নের উপ‌দেশ।‌লোকরক্ষা বা লোকহত্যা ইত্যা‌দি ধর্মাধর্ম বিচার এস্থ‌লে উপ‌স্থিত হয় না,‌কেননা ধর্মাধর্ম,পাপপুণ্য ক‌র্মে নাই_উহা বু‌দ্ধি‌তে, বাসনায়।বু‌দ্ধি য‌দি সমত্ব প্রাপ্ত হইয়া শুদ্ধ হয়, অহংজ্ঞান ও অাস‌ক্তি য‌দি ত্যাগ হয়, ত‌বে কর্ম যাহাই হউক উহা‌তে কোন বন্ধন হয় না

তত্রৈবং সতি কর্তারমাত্মানং কেবলং তু য়ঃ  
পশ্যত্যকৃতবুদ্ধিত্বান্ন পশ্যতি দুর্মতিঃ  
য়স্য নাহঙ্কৃতো ভাবো বুদ্ধির্যস্য লিপ্যতে  
হত্বাঽপি ইমাঁল্লোকান্ন হন্তি নিবধ্যতে  
(১৮।১৬-১৭ )

=>>যে কর্মের পাঁচটি কারণের কথা বিবেচনা না করে নিজেকে কর্তা বলে মনে করে সে অবশ্যই নির্বোধ এবং দুর্মতি, সে যথাযথভাবে দর্শন করতে পারে নাআমি কর্তা এই অভিমান যার নাই, যার বুদ্ধি কর্মফলে লিপ্ত হয়না, তিনি জগতের সমস্ত প্রাণী হত্যা করলেও হত্যাকারী হয় না বা হত্যার ক্রিয়া ফলে আবদ্ধ হয়না




"সমত্ববু‌দ্ধি‌তে কৃত ঘোর যুদ্ধও ধর্ম্য ও শ্রেয়স্কর"_ইহাই গীতার সমস্ত উপ‌দে‌শের সার ; দু‌ষ্টের স‌হিত দুষ্ট ব্যবহার ক‌রি‌বে না,ক্রুদ্ধ হই‌বে না,ইত্যা‌দি ধর্মতত্ত্ব স্থিতপ্রজ্ঞ যোগীর মান্য ন‌হে, এরূপ ন‌হে ; কিন্তু '‌নি‌র্বৈর' শ‌ব্দের অর্থ নি‌ষ্ক্রিয় বা প্র‌তিকার শূন্য, নিছক সন্ন্যাসমা‌র্গের এইমত তাঁহার মান্য ন‌হে। বৈর অর্থাৎ ম‌নে দুষ্টবু‌দ্ধি ত্যাগ ক‌রি‌বে, কর্ম‌যোগী নি‌র্বৈর প‌দে এই অ‌র্থেই; এবং কেহই যখন কর্ম হই‌তে মুক্ত হই‌বে না


হি কশ্চিত্ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃত্
কার্যতে হ্যবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ  
(৩।৫)

=>>সকলেই অসহায়ভাবে মায়াজাত গুণসমূহের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কর্ম করতে বাধ্য হয় তাই কর্ম না করে ক্ষণকাল থাকতে পারে না


তখন লোক-সংগ্রহ কিংবাপ্র‌তিকারা‌র্থে­ যাহা অাবশ্যক ও সম্ভব সেইটুকু কর্ম ম‌নে দুষ্ট বু‌দ্ধি না রা‌খিয়া কেবল কর্তব্য ব‌লিয়া বৈরাগ্য ও নিঃসঙ্গ বু‌দ্ধি‌তে ক‌রি‌তে থা‌কি‌বে, এইরূপ কর্ম‌যো‌গের উক্তি

তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর
অসক্তো হ্যাচরন্কর্ম পরমাপ্নোতি পূরুষঃ  
(৩।১৯)

=>>অতএব কর্মফলের প্রতি অনাসক্ত হয়েই কর্তব্য কর্ম সম্পাদন কর, অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার ফলেই মুক্তি 
লাভ করা যায়


তাই এই শ্লো‌কে শুধু '‌নি‌র্বৈর' পদ প্র‌য়োগ না ক‌রিয়া তৎপূ‌র্বেই 'মৎকর্মকৃৎ', অর্থাৎ 'অামার' অর্থাৎ 'পর‌মেশ্ব‌রের প্রীত্যর্থ পর‌মেশ্বরার্পণ- বু‌দ্ধি‌তে যে কর্ম ক‌রে' এই অার এক‌টি গুরুতর রকম বি‌শেষণ দিয়া শ্রীভগবান গীতায় নি‌র্বৈর ক‌র্মের ভ‌ক্তিদৃ‌ষ্টি‌তে জোড়া‌নৌকা ভাসাইয়া‌ছেন। এই জন্যই এই শ্লো‌কে সমস্ত গীতাশা‌স্ত্রেরসারভূত­ তাৎপর্য ভাসাইয়া‌ছেন। এই জন্যই এই শ্লো‌কে সমস্ত গীতাশা‌স্ত্রের তাৎপর্য অা‌সিয়া‌ছে।
_গীতা-রহস্য, লোকমান্য তিলক