এটা সত্য যে, সাংসারিক বস্তুর সাথে আমাদের সম্বন্ধ নিত্য নয়। এই বিষয় ভোগ কোন ব্যক্তিকে পূর্ণ ও স্থায়ী সুখ প্রদান করতে পারে না। এই সত্যের সমান ইহাও অটল সত্য যে, ঈশ্বরের সাথে আমাদের সম্বন্ধ সদা সর্বদা। এরূপভাবে সেই ঈশ্বর কে প্রাপ্ত করেই মনুষ্য পূর্ণ সুখী হতে পারে, অন্যথা নয়।
.
আজকের সামাজিক পরিস্থিতিতে বৈদিক ধর্ম সংস্কৃতি, সভ্যতা, রীতি-নীতি, পরম্পরা আদি লুপ্তপ্রায় হয়ে গেছে। এর বিপরীত কেবল ভোগবাদী এবং অর্থবাদী পরম্পরার অত্যধিক প্রচার এবং প্রসার। যার ফলস্বরূপ ব্রহ্মবিদ্যা দূর্লভ হয়ে গিয়েছে।
কাম,ক্রোধ, লোভ, মোহ, অহঙ্কার, ঈর্ষা, দ্বেষাদি মানসিক রোগের সমাধান কেবল ধন সম্পত্তি ও ভৌতিক বিজ্ঞান দ্বারা কদাপি সম্ভব নয়। এই মানসিক রোগের সমাধান তো আত্মা পরমাত্মার সম্বন্ধী অধ্যাত্ম বিদ্যা কে পাঠ করা - করানো, শোনা - শোনানো তথা ইহাকে ক্রিয়াত্মক রূপ দেওয়ার দ্বারাই সম্ভব।
.
সবাই আজ তন,মন ও ধন দ্বারা ভৌতিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার দ্বারাই সমস্ত দুঃখের নিবৃত্তি এবং নিত্যানন্দ কে প্রাপ্তি করতে চায়। তারা আত্মা - পরমাত্মার বিজ্ঞান তথা ঈশ্বর প্রাপ্তির লক্ষ্য কে সর্বদা পরিত্যাগ করে দিয়েছে। ফলস্বরূপ সবাই আজ বিবিধ দুঃখে অত্যন্ত সন্তপ্ত। যতক্ষন আত্মা ও পরমাত্মার বিজ্ঞান কে লাভ না করা যায় ততক্ষণ দুঃখ থেকে কদাপি নিস্তার ঘটতে পারে না।
.
যোগের অর্থই এই যে, সমস্ত দুঃখ থেকে মুক্ত হয়ে পরমানন্দে স্থিতিলাভ করা। মহর্ষি পতন্জলি বলেছেন "যোগশ্চিত্তবৃত্তি নিরোধ" অর্থাৎ মনের সঙ্কল্প বিকল্প রূপ কাম , ক্রোধ, দ্বেষ আদি সমস্ত অনাবশ্যক চিন্তা কে রুদ্ধ করে মন কে অভিষ্ট ধ্যেয় তে নিযুক্ত করে মনের সাত্বিক বৃত্তিরও নিরোধ করে ঈশ্বর কে প্রাপ্ত করাই হচ্ছে যোগ। ব্যুৎপত্তি অর্থ অনুসারে যোগ শব্দ "যুজ সমাধৌ" আত্মেনপদী ধাতুর সহিত "ঘঞ্" প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নিষ্পন্ন হয়েছে। অতঃ "যোগ" শব্দের অর্থ "সমাধি" অর্থাৎ চিত্তের বৃত্তির নিরোধ।
.
=> বেদে যোগের মহত্বঃ
.
বেদ বিদ্যাই সমস্ত বিদ্যার আদিমূল অর্থাৎ সমস্ত বিদ্যার উৎপত্তি বেদ হতে। ঈশ্বর প্রদত্ত জ্ঞানের বিনা কোন ব্যক্তির ব্যবহার সিদ্ধি, ব্যক্তির ভৌতিক বিজ্ঞান এবং না কোন আধ্যাত্মিক বিদ্যার লাভ হতে পারতো। আর না তো তারা লৌকিক সুখ লাভ করতে পারতো আর না তো মোক্ষসুখ।
.
যোগদর্শন আদি সমস্ত আর্ষশাস্ত্রে প্রতিপাদিত যে বিদ্যা তা বেদের মাধ্যমে প্রদানকারী আদিমূল ঈশ্বরই। এভাবে যোগের ধারণার স্রোতও বেদ হতেই প্রবাহিত। যথাঃ
.
যুঞ্জতে মন-উত যুঞ্জতে ধিয়ো বিপ্রা বিপ্রস্য বৃহতো বিপশ্চিতঃ।
বি হোত্রা দধে বয়ুনাবিদেক ইন্মহী দেবস্য সবিতুঃ পরিষ্টুতিঃ।।
(ঋগবেদ ৫।৮১।১)
.
ভাবার্থঃ যাহারা ঈশ্বরের উপাসক (বিপ্রাঃ) অত্যন্ত মেধাবী, বিদ্বান্ ও হোত্রা, অর্থাৎ উপাসনারূপ যোগক্রিয়াশীল যোগীজন (বিপ্রস্য) সেই বৃহতের অপেক্ষা বৃহৎ অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা বৃহৎ (বিপশ্চিতঃ) সর্বজ্ঞ সর্বপ্রকার বিদ্যাযুক্ত পরমেশ্বরের মধ্যে (মন যুঞ্জতে) আপনার মন কে যথাযোগ্য বা সম্যক প্রকার যুক্ত বা স্থির [ অর্থাৎ চিত্তবৃত্তির নিরোধ] করেন, তথা (উত ধিয়) আপনার বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানকেও (যুঞ্জতে) সদা পরমাত্মাতে ধারণ করে থাকেন। যে পরমাত্মা এই সমগ্র জগতের (বিদধে) ধারণ ও বিধান করেন (বয়ুনাবিদেক ইৎ) যিনি সকল জীবের শুভাশুভ কর্ম বিষয়ে জ্ঞাত আছেন এবং যিনি সাক্ষীস্বরূপ, যিনি একমাত্র অদ্বিতীয় ও সর্বব্যাপক, যাহাপেক্ষা আর শ্রেষ্ঠতম কোন পদার্থ নেই, সেই (দেবস্য) দেব অর্থাৎ জগতের প্রকাশক ও (সবিতুঃ) সকল পদার্থের রচয়িতা স্রষ্টারুপী পরমেশ্বরের (মহী পরিষ্টুতিঃ) আমরা সর্বপ্রকারে অত্যন্ত মহতী স্তুতি করি।।
.
যুঞ্জানঃ প্রথমং মনস্তত্ত্বায় সবিতা ধিয়ঃ।
অগ্নের্জ্যোতিনর্নিচায্য পৃথিব্যা অধ্যাভরত।।
(যজুর্বেদ ১১।১)
.
ভাবার্থঃ (যুঞ্জানঃ) যোগাভ্যাসী মানুষেরা (তত্ত্বায়) তত্ব অর্থাৎ ব্রহ্মবস্তু বা ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্তির জন্য (প্রথম মনঃ) সর্বাগ্রে মনকে পরমেশ্বর যুক্তি করিয়া থাকেন (সবিতা) পরমেশ্বরও এইরূপ যোগীর প্রতি কৃপা করিয়া তাহার (ধিয়ম্) বুদ্ধিকে আপনাতে যুক্ত করিয়া নেন (অগ্নের্জ্যো) তখন সেই যোগী পরমেশ্বরের প্রকাশ নিশ্চয় করিয়া জ্ঞাত হইয়া (অধ্যাভরৎ) স্বীয় আত্মাতে পরমেশ্বর কে ধারণ করেন (পৃথিব্যাঃ) পৃথিবীর মধ্যে যোগীর উপরোক্ত লক্ষণ প্রসিদ্ধ আছে।।
.
যুক্তেন মনসা বয়ং দেবস্য সবিতুঃ সবে।
স্বর্গায় শক্ত্যা।।
(যজুর্বেদ ১১।২)
.
ভাবার্থঃ মনুষ্যমাত্র এরূপ ইচ্ছা করিবেন (বয়ম্) যেন আমরা (স্বর্গায়) মোক্ষসুখ হেতু (শক্ত্যা) যথাযোগ্য সামর্থ ও যোগবলানুসারে (দেবস্য) সর্বপ্রকাশক ও সর্ব্বানন্দপ্রদ (সবিতু) সর্বান্তর্যামী পরমেশ্বরের সৃষ্টি মধ্যে উপাসনারুপ যোগসাধন দ্বারা (যুক্তেন মনসা) শুদ্ধান্তঃকরণ হইয়া, নিজ আত্মায় সেই পরমাত্মস্বরূপ আরাধিত করিয়া পরমানন্দ প্রাপ্ত হই।
.
অষ্টাবিংশনি শিবানি শগ্নানি সহ যোগং ভজন্ত মে।
যোগং প্রপদ্যে ক্ষেমং প্রপদ্যে যোগং চনমোহোরাত্রাভ্যামন্ত।।
(অথর্ববেদ ১৯।৮।২)
.
ভাবার্থঃ হে পরমেশ্বর! ( অষ্টাবিংশনি) ২৮ [দশ ইন্দ্রীয়, দশ প্রাণ, মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার বিদ্যা, স্বভাব, শরীর এবং বল ] (শিবানি) কল্যাণকারক এবং (শগ্নানি) সুখকারক হয়ে (সহ) একসাথে (মে) আমার (যোগম্) উপাসনা যোগ কে (ভজন্তাম্) সেবন করে। (যোগম্) সেই যোগ কে (চ) এবং (ক্ষমম্) রক্ষা কে [অর্থাৎ যোগের দ্বারা রক্ষা কে (প্র পদ্যে) আমি প্রাপ্ত হবো এবং (ক্ষেমম্) রক্ষা কে (চ) এবং (যোগম্) যোগ কে [রক্ষা দ্বারা যোগ কে ] (প্র পদ্যে) আমি প্রাপ্ত হবো, এইজন্য আমার আপনাকে (অহোরাত্রাভ্যামন্ত) দিন রাত্রি (নমঃ অস্তু) নমস্কার হোক।
.
=> গীতাই যোগের মহত্বঃ
.
যোগ অনাদি কাল ধরে রয়েছে। গীতার ৪র্থ অধ্যায়ে যোগেশ্বর কৃষ্ণ জী বলেছেন - "ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানমহব্যয়ম্" এই যোগ আমি বিবস্বান কে বলেছিলাম। "স এবায়ং ময়া তেহদ্য যোগঃ প্রোক্তঃ পুরাতনঃ" (৪।৩) সেই পুরাতন যোগের বর্ননা আমি তোমার নিকট করবো। এভাবে মহাযোগী এবং যোগের প্রবক্তারূপে গীতাই শ্রী কৃষ্ণকে যোগেশ্বর বলে সম্বোধন করা হয়েছে। যথা - "যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্দ্ধরঃ" (গীতা ১৮।৭৮)।
গীতা মধ্যে দুঃখের বিয়োগকেই যোগের সঙ্গা দেওয়া হয়েছে -
.
তং বিদ্যাদ্দুঃখসংযোগ বিয়োগং বিয়োগং যোগসঙ্গিতম্।
স নিশ্চয়েন যোক্তব্যো যোগহনবর্ব্বিণ্নচেতসা।।
(গীতা ৬।২৩)
অর্থাৎ দুঃখ সংযোগের বিয়োগ কে যোগ বলে জানবে। এই প্রকার অধ্যাবসায় সহকারে যোগাভ্যাস করা কর্তব্য।
যোগ কে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে যোগেশ্বর কৃষ্ণ জী অর্জুন কে যোগী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন -
.
তপস্বিভ্যোহধিকোযোগী জ্ঞানিভ্যোহপিমতোহধিকঃ।
কর্ম্মিভ্যশ্চা ধিকাযোগী তস্মাদযোগী ভবার্জ্জুন।।
(গীতা ৬।৪৬)
অর্থাৎ যোগীগণ তপস্বী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানীগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, কর্মিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, ইহাই আমার মত। অতএব যে অর্জুন তুমি যোগী হও।
.
এই প্রকার যোগের মহত্বতার বর্ণনা এতো কম পরিসরে লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। যোগক্রিয়ার দ্বারাই যোগের মহত্বতার পূর্ণ জ্ঞান লাভ সম্ভব। এইপ্রকার "তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু যোগযুক্ত ভবার্জুন" ( ৮।২৭) গীতার এই শ্লোক অনুসারে আমাদের সর্বদা যোগযুক্ত অর্থাৎ ঈশ্বরে চিত্ত সমাহিত করা কর্তব্য।
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর
0 মন্তব্য(গুলি)