সনাতন দর্শন একটি উৎকৃষ্ট ধর্ম দর্শন৷ এই দর্শন মানুষকে লোভ বা ভয় দেখায় না৷ এই দর্শন কর্মফলবাদে বিশ্বাসী, এই দর্শন জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী, এই দর্শন বাস্তববাদে বিশ্বাসী৷ কিন্তু কালের পরিক্রমায় যখন এই সনাতন ধর্মের উপর পৌরাণিক মতবাদ আধিপত্য বিস্তার শুরু করলো তখন থেকে কিছু অবাস্তব মান্যতা সনাতন ধর্মকে গ্রাস করতে শুরু করলো।
তেমনি একটি পৌরাণিক মান্যতা হলো 'স্বর্গ' ও 'নরক' নামের দুইটি এমন স্থান রয়েছে, যেখানে মৃত্যুর পর একজন ব্যক্তিকে তার কর্মানুসারে সুখ শান্তি প্রদান করা হয় বা শাস্তি দিয়ে দুঃখ প্রদান করা হয়৷
এই মান্যতা অনুসারে, যারা পৃথিবীতে পূণ্যকর্ম করে, তাদেরকে মৃত্যুর পর স্বর্গে প্রেরণ করা হয়। সেই ব্যক্তিগণ স্বর্গে দেবতাদের সাথে অবস্থান করে, সুখ লাভ করে, আকাঙ্ক্ষামাত্র তাদের সকল কামনা পূর্ণ হয়। অপর দিকে যেসব ব্যক্তি পাপ কর্ম করে, তাদের মৃত্যুর পর নরকে প্রেরণ করা হয়৷ নরকে যমরাজের নির্দেশ যমদূতেরা সেসব ব্যক্তিদের বিভিন্ন প্রকার কঠিন কঠিন শাস্তি দিয়ে (আগুনে পোড়ানো, অস্ত্র দিয়ে ছেদন) দুঃখ প্রাপ্ত করায়৷ এভাবেই মৃতদের তাদের কর্ম অনুসারে ফল প্রদান করা হয়৷
কিন্তু যারা বাস্তববাদী এবং সনাতন দর্শন সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন তাদের জন্য উপর্যুক্ত স্বর্গ নরক বিষয়ক মান্যতা মেনে নেওয়া ও স্বীকার করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ তারা জানে, সনাতন ধর্ম মানুষকে এভাবে লোভ বা ভয় দেখায় না, বরং তা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী৷ সনাতন ধর্ম কোনো আব্রাহামিক মতবাদ নয় যে এখানে জান্নাতে ৭২ জন হুর, সুরার নদী প্রভৃতির লোভ এবং জান্নামে কঠিন শাস্তির ভয় দেখানো হবে৷
তাই অনেকের মনে শঙ্কা ওঠে পুরাণে বর্ণিত স্বর্গ নরক কি আসলেই বিদ্যমান? নাকি সেগুলো শুধুমাত্র মানুষকে লোভ ও ভয় দেখানোর গল্প? স্বর্গ ও নরক সম্পর্কিত আমাদের বর্তমান সমাজে প্রচলিত মতবাদ কতটুকু মান্য?
চলুন, আজ এসব প্রশ্নের উত্তর বেদাদি শাস্ত্রের আলোকে জেনে নেওয়া যাক। পাশাপাশি জেনে নেওয়া যাক স্বর্গ ও নরকের প্রকৃত সত্যতা ও মূল অর্থ৷
বেদাদি গ্রন্থে 'স্বর্গ' শব্দের উল্লেখ উল্লেখ বহুবার পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানকার কোথাও স্বর্গ আলাদা কোনো স্থানবাচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। 'স্বর্গ' শব্দটিকে বিশ্লেষণ করে এর অর্থ সম্পর্কে চন্দ্রকান্ত উপাধ্যায় সম্পাদিত 'বৈদিক কোশ' গ্রন্থের ১৪৭৫–১৪৭৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে–
স্বর্গ = স্বর্ + গ।
(১) সুখ প্রদান করে এমন পদার্থ৷
(২) আনন্দময় মোক্ষ।
(৩) সুখার্থ পুরুষার্থ৷
এখানে দেখতে পাচ্ছেন, স্বর্গ শব্দটিকে এখানে কোথাও আলাদা স্থানবাচক শব্দ হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি। বরং পরমসুখরূপ মোক্ষ, সুখদায়ক অবস্থা এবং সুখের উপকরণকে স্বর্গ বলা হয়েছে। চলুন এবার এই অর্থগুলোর যথার্থতা দেখে নেওয়া যাক৷
প্রথমেই 'স্বর্গ' শব্দটির 'স্বঃ' (স্বর্) এর অর্থ দেখে নেই৷ নিঘণ্টুতে (১।৪) স্বঃ শব্দটিকে সাধারণ নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। সাধারণ নাম হিসেবে গ্রহণ করায় এটির বহু অর্থ হতে পারে৷ এজন্য 'স্বঃ' শব্দ দ্বারা সুখ অর্থ গ্রহণ করা যায়৷
নিঘণ্টুতে (১।৪) আরেকটি সাধারণ নামবাচক শব্দ রয়েছে৷ তা হলো 'নাকঃ'।
'নাকঃ' শব্দের নির্বচন করতে গিয়ে নিরুক্তে (২।১৪) বলা হয়েছে ''কমিতি সুখনাম, তৎপ্রতিষিদ্ধং প্রতিষিধ্যেত'' অর্থাৎ 'ক' হলো সুখনাম। তার বিপরীত (অক = দুঃখ) এর বিপরীত হলো নাক (ন+অক = না দুঃখ অর্থাৎ সুখ)। এভাবে 'নাকঃ' সাধারণ নাম হিসেবে নিঘণ্টুতে পঠিত হওয়ার পরও সুখ নাম সিদ্ধ হওয়ায় একই পর্যায়বাচী 'স্বঃ' শব্দটিকে সুখনাম হিসেবে বিনা সংকোচে গ্রহণ করা যায়৷ আর 'স্বঃ' (স্বর্) এর সাথে যে 'গ' যুক্ত হয়ে স্বর্গ শব্দটি সিদ্ধ করে, সেই 'গ' গতি বোধক 'গম্লৃ গতৌ' ধাতু থেকে উৎপন্ন। গতির আবার তিন প্রকার অর্থ হয়ে থাকে– জ্ঞান, গমন ও প্রাপ্তি। তাই স্বর্গ শব্দটির অর্থ হয় সুখ প্রাপ্তি অথবা সুখের দিকে গমন।
যত প্রকারের সুখ রয়েছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ সুখ হলো মোক্ষসুখ। মোক্ষ লাভ করলে কল্পান্ত পর্যন্ত আত্মা জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে মুখ হয়৷ ফলে তাকে জন্ম মৃত্যুরূপ দুঃখ, কষ্ট, ভয়, ক্লেশ, জরা, বৃদ্ধত্ব প্রভৃতি প্রাপ্ত করতে হয়৷ বরং মোক্ষ অবস্থায় জীবাত্মা আনন্দময় পরমেশ্বর থেকে আনন্দ লাভ করে– "রসো বৈ সঃ। রসং হ্যেবায়ং লব্ধ্বা আনন্দী ভবতি।" (তৈত্তিরীয় উপনিষদ ২।৭।১)। ফলে মোক্ষরূপ সুখ বা আনন্দই হচ্ছে স্বর্গ।
আর এই মোক্ষের (ন্যায় দর্শনে মোক্ষকে অপবর্গ বলে) বর্ণনা দিতে গিয়ে বাৎসায়ন মুনি ন্যায় দর্শনের (১।১।২২) সূত্রের ভাষ্যে লিখেছেন–
"তেন দুঃখেন জন্মনাত্যন্তবিমুক্তিঃ অপবর্গ।কথম্ ? উপান্তস্য জন্মনো হানম্ অন্তস্য চানুপাদানম্ এতামবস্থামপর্যন্তামপবর্গ বেদয়ন্তেপবর্গবিদঃ। তদ্ অভয়মজরমমৃত্যুপদং ব্রহ্ম ক্ষেমপ্রাপ্তিরিতি।।"
অর্থাৎ দুঃখের = জন্মের অত্যন্ত বিচ্ছেদকে অপবর্গ বলে। কিভাবে ? গৃহীত জন্মের নিবৃত্তি এবং পুণরায় জন্মের গ্রহণ হয় না। এই বিনাশরহিত (জন্ম-মৃত্যু রহিত) অবস্থাকে (মোক্ষকে) বিদ্বানগণ অপবর্গ বলেন। এই অবস্থাকে অভয়, জরা, বৃদ্ধত্ব রহিত, মৃত্যুরহিত অবস্থা বলে।
অর্থাৎ আমরা স্বর্গের একটি অর্থ হিসেবে মোক্ষকে পাচ্ছি। আর এই মোক্ষ কোনো স্থান নয়, বরং জন্ম, মৃত্যু জনিত দুঃখ, ভয়, জরা প্রভৃতি মুক্ত একটি আনন্দময় অবস্থা৷
এবার আসি পার্থিব সুখের বিষয়ে। বলা হয়ে থাকে 'স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল'৷ অর্থাৎ একজন ব্যক্তির যদি নিজের শরীর ঠিক না থাকে, শরীরে যদি সুখ শান্তি না থাকে তবে সে কোনো দিনই পার্থিব সুখ ভোগ করতে পারবে না৷ এজন্য আমাদের এই দেহই ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাতেই স্বর্গ নিহিত রয়েছে।
এর সমর্থনে সুন্দর একটি বেদমন্ত্র পাওয়া যায়। অথর্ববেদে (১০।২।৩১) বলা হয়েছে–
"অষ্টচক্রা নবদ্বারা দেবানাং পুরযোধ্যা।
তস্যাং হিরণ্ময়ঃ কোশঃ স্বর্গো জ্যোতিষাবৃতঃ।।"
অর্থাৎ আট চক্র এবং নয় দ্বার বিশিষ্ট এই দেহ হলো দেবতাদের অজেয় নগরী। এই দেহে হিরণ্যময় কোষ রয়েছে, তাকে স্বর্গ বলে, যা ব্রহ্মজ্যোতি দ্বারা আবৃত রয়েছে৷
- এই মন্ত্রে নবদ্বার হলো– দুই চোখ, দুই কান, দুই নাকের ছিদ্র, এক মুখ, এক মলদ্বার ও এক উপস্থ।
- হিরণ্ময় কোশ হলো– মানবের হৃদয়, যেখানে ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হওয়া যায়৷
- এই জ্যোতি হলো– ব্রহ্মজ্যোতি৷
- আর দেবতারা হলো– ইন্দ্রিয়াদি দেবতা৷
ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থেও মানবদেহকে দেবতাদের গ্রাম, দেবতাদের সংসদ অর্থাৎ আবাসস্থল বলা হয়েছে–
"নরাঃ দেবানাং গ্রামঃ" (তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ ৬।৯।২)
এই মানব দেহ হলো দেবতাদের গ্রাম (আবাসস্থল)।
"এষা দৈবী সভা, দৈবী সংসদ্" (জৈমিনি উপনিষদ ব্রাহ্মণ ২।৪।২)
এই দেহই হলো দেবতাদের সভা, দেবতাদের সংসদ।
ফলে আমরা দেখতে পেলাম, স্বর্গ বলতে যেমন মোক্ষ সুখ বোঝায় তেমনি পার্থিব সুখও বোঝায়৷
এবার আসি নরকের প্রসঙ্গে৷ বেদাদি শাস্ত্রে নরক শব্দটির উল্লেখ নাই বললেই চলে। 'নরক' শব্দটির অর্থ করতে গিয়ে চন্দ্রকান্ত উপাধ্যায় সম্পাদিত 'বৈদিক কোশ' গ্রন্থের ৭৬৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন–
নরকম্–
(১) নীচৈঃ গমনম্ অর্থাৎ নীচে গমন বা অধঃপতিত হওয়া৷
(২) নীচৈঃ অস্মিন্ অর্যতে অর্থাৎ নীচ বা দুঃখ মানুষের সাথে সহবাস বা অনুকরণ।
'নরক' শব্দের উপর্যুক্ত অর্থ যে অপ্রাসঙ্গিক নয়, বরং শাস্ত্র সম্মত তা আমরা নিরুক্তে (১।১১) দেখতে পাই। সেখানে বলা হয়েছে–
"নরকং ন্যরকং নীচৈর্গমন।" অর্থাৎ নরক অর্থ অধঃপতিত হওয়া বা নিম্নাভিমুখে গমন।
এরপর আবার বলা হয়েছে–
"নাস্মিন্ রমণকং স্থানমল্পমপ্যস্তীতি বা।" অর্থাৎ অথবা এখানে আনন্দকর স্থান অল্পমাত্রও নাই৷ এটিই নরক শব্দের নির্বচন।
অর্থাৎ নিজের চরিত্র, নৈতিকতা প্রভৃতিকে অধঃপতিত করে দুঃখ লাভই নরক৷ আবার যখন বিভিন্ন কারণে এই পৃথিবীতেই আমরা সামান্যতম সুখের স্থান খুঁজে পাই না, তখন সেটিই আমাদের জন্য নরক হয়ে যায়৷ ফলে নরক শব্দের শাস্ত্রীয় বিশ্লেষণেও আমরা পুরাণোক্ত কোনো কঠিন শাস্তির আলাদা স্থান খুঁজে পেলাম না৷
আশাকরি সকলের স্বর্গ ও নরকের অর্থ পরিষ্কার হয়েছে। তবে এখানে আরেকটু অতিরিক্ত বিষয় যোগ করতে চাই। তাহলে আর কারও আক্ষেপের কোনো সুযোগ থাকবে না। বেদাদি শাস্ত্রের অনেক স্থানে 'স্বর্গ' শব্দটির সাথে 'লোক' শব্দটি যুক্ত থাকতে দেখা যায়। অর্থাৎ 'স্বর্গলোক' শব্দটিতে 'লোক' শব্দটি দেখে অনেকে ধারণা করেন এই লোক শব্দ দ্বারা পৃথিবী ভিন্ন অন্য কোনো স্থানকে স্বর্গ হিসেবে নির্দেশ করছে৷ কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। কারণ লোক শব্দটির প্রয়োগ বিভিন্ন প্রাচীন শাস্ত্রে পৃথিবীকেই নির্দেশ করে৷ যেমন–
'' প্র মে পতিয়ানঃ পন্থাঃ কল্পত শিবা অরিষ্টা পতিলোক গমেয়ম্।।''
(মন্ত্রব্রাহ্মণ ১।১।৮, গোভিল গৃহ্যসূত্র ২।১।১৯)
অর্থাৎ আমার যাওয়ার রাস্তা কল্যাণকারী হোক। আমি পতিলোক প্রাপ্ত হই।
''কন্যলা পিতৃভ্যঃ পতিলোকং যতীয়ম্।।''
(মন্ত্রব্রাহ্মণ ১।২।৫, গোভিল গৃহ্যসূত্র ২।২।৮)
অর্থাৎ কন্যা পিতৃলোক থেকে পতিলোক প্রাপ্ত হয়৷
এই উদাহরণে দেখা যাচ্ছে, পিতৃলোক, পতিলোক এসব পৃথিবী ভিন্ন আলাদা কোনো স্থান নয়৷ বরং কন্যার অবস্থান পরিবর্তনকেই এখানে লোক বলা হয়েছে। এর দ্বারা আমরা 'স্বর্গলোক' শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো– স্বর্গের অর্থ সুখ এবং "লোকয়তেহনেনেতি লোকঃ" = যেখানে তার অনুভব করা যায় তার নাম "লোক"। তাই এই ব্যুৎপত্তিগত অর্থ দ্বারা 'লোক' শব্দটি স্থানবিশেষ নয়, বরং অবস্থাবিশেষকেই বোঝায়।
এরপরও যদি স্বর্গ বা নরক বলতে পৃথিবী ভিন্ন আলাদা স্থানকে নির্দেশ করতে চান, তবে মীমাংসা দর্শনের (৬।১।১) সূত্রের ভূমিকায় শাবরস্বামীর ভাষ্য দেখে নিতে পারেন৷ তিনি সরাসরি সেখানে স্বর্গ শব্দ দ্বারা স্থানবিশেষের ধারণাকে খণ্ডন করেছেন। তিনি ভাষ্যে লিখেছেন–
"ননু স্বর্গশব্দো লোকে প্রসিদ্ধ বিশিষ্টে দেশে৷ য়স্মিন্নোষ্ণং, ন শীতং, ন ক্ষুদ্, ন তৃষ্ণা, নারতিঃ ন গ্লানিঃ, পূণ্যকৃত এব প্রেত্য তত্র গচ্ছন্তি নান্যে। অত্রোচ্যতে৷ য়দি তত্র কেচিদমৃত্বা ন গচ্ছন্তি, তত আগচ্ছন্ত্যজনিত্বা বা, ন তর্হি স প্রত্যক্ষ দেশ এবংজাতীয়কঃ। নাপ্যনুমানাদ্ গম্যতে, নান্যেন। ননু চান্যে সিদ্ধাঃ কেচিদ্ দৃষ্টবন্তঃ, তে চাऽऽখ্যাতবন্তঃ ইতি চেৎ? ন তত্র প্রমাণমস্তি, সিদ্ধাঃ এবংজাতীয়কাঃ সন্তি, তে চ দৃষ্টবাऽऽচক্ষীরন্নিতি। তস্মাদেবংজাতীয়কো দেশ এব নাস্তি।।"
অর্থাৎ
আক্ষেপ– স্বর্গ শব্দ সমাজে বিশিষ্ট দেশ (স্থান) অর্থে প্রসিদ্ধ। যেখানে না উষ্ণ আছে, না শীত আছে, না ক্ষুধা আছে, না তৃষ্ণা আছে, না দুঃখ আছে, না পীড়া আছে আর না তো গ্লানি আছে। পূণ্যকর্মকারীই মৃত্যুর পর এখানে গমন করে। অন্য কেউ এখানে যেতে পারে না৷
সমাধান– যদি সেখানে (স্বর্গ নামক স্থানে) মৃত্যু বিনা কেউ যেতে পারে না এবং সেখান থেকে কেউ জন্ম গ্রহণ ব্যতীত এখানে আসতে পারে না, তবে এই কারণে স্বর্গ নামক স্থান প্রত্যক্ষ নয়। অনুমান দ্বারাও এটি সিদ্ধ নয় বা অন্য কোনো প্রমাণ দ্বারাও৷ 'কোনো অন্য সিদ্ধ পুরুষগণ স্বর্গ নামক স্থান দেখেছেন এবং তাঁরা এটির বর্ণনা করেছেন' এরূপ যদি বলা হয় তবুও তা ঠিক নয়। এই বিষয়ে কোনো প্রমাণ নাই যে সেই সব পুরুষ স্বর্গ নামক স্থান দেখে এসে বর্ণনা করছেন৷ এজন্য স্বর্গ কোনো দেশ (স্থান) নয়৷
তাই পুরো আলোচনার আলোকে আমরা এই সারসংক্ষেপ বলতে পারি যে–
১. স্বর্গ বা নরক আলাদা কোনো স্থান নয়৷
২. স্বর্গ অর্থ সুখ। এই সুখ মোক্ষের মাধ্যমে বা পার্থিব অন্য কোনো মাধ্যমে দেহের সাহায্যে প্রাপ্ত হতে পারে।
৩. নরক অর্থ অধঃপতিত হওয়া, দুঃখময় পরিস্থিতিতে অবস্থান করা৷
৪. লোক শব্দটি দ্বারা আলাদা কোনো স্থান বোঝায় না, বরং অবস্থা বোঝায়৷
এই সমগ্র আলোচনার মূলভাব স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী তাঁর অমর গ্রন্থ "সত্যার্থপ্রকাশ"-এ বলেছেন–
"এই সুখ বিশেষই 'স্বর্গ' আর বিষয় তৃষ্ণায় আবদ্ধ হয়ে দুঃখ বিশেষ ভোগ করার নাম 'নরক'। সুখের নাম 'স্বঃ'। 'স্বঃ সুখং গচ্ছতি য়স্মিন স স্বর্গঃ' 'অতো বিপরীতো দুঃখ ভোগো নরক ইতি'। যা সাংসারিক সুখ তা 'সামান্য স্বর্গ' এবং পরমেশ্বরের সাক্ষাৎকারজনিত আনন্দকে 'বিশেষ স্বৰ্গ' বলে ।" (সত্যার্থ প্রকাশ, নবম সমুল্লাস)।
পরিশেষে সকলের প্রতি আহ্বান রইল, পৌরাণিক বা আব্রাহামিক মতবাদের লোভ বা ভয়ে আকৃষ্ট না হয়ে নিজেদের উদার, মহান ও বাস্তবসম্মত বৈদিক সনাতন দর্শন মেনে চলুন।
0 মন্তব্য(গুলি)