পণ্ডিত শিব শঙ্কর শর্মা কাব্যতীর্থ ——
"মাষৌদন = সবার আগে একটি মহান প্রমাদ বহু দিন ধরে চলতে থাকে, এভাবে সেটি প্রসিদ্ধ হয়। মাংসৌদন শব্দের প্রয়োজন নেই কিন্তু "মাষৌদন" অর্থাৎ মাষৌদনের স্থানে মাংসৌদনম্ লেখকের ভ্রমের জন্য অথবা কোনো মাংসপ্রিয় ধূর্ত বিদ্বানের হস্তক্ষেপের কারণে এই ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, এমনটাই অনুমান হয় যে, কেননা শ্রীমন্থ কর্মে দশ প্রকারের অন্নের নাম রয়েছে, তা হলো — ব্রীহি, যব, তিল, মাষ, অণু, প্রিয়ঙ্গু, গোধুম, মসুর, খল্ব এবং খলকূল ; এই দশ অন্ন এবং সর্বৌষধ মিলিয়ে মন্থ তৈরি করা হয় । আর এগুলো বিধিপূর্বক গ্রহণের মাধ্যমে যে ফল প্রাপ্ত হয় — শুকনো বৃক্ষের উপরও যদি এই মন্থ রাখা হয়, তো সেই বৃক্ষের পাতা তৈরি হবে, ইত্যাদি বর্ণন বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৬ষ্ঠতম অধ্যায়ের তৃতীয় ব্রাহ্মণে বিস্তারিত হয়েছে । এখানে লক্ষণীয় যে, তিল শব্দের পর মাষ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে । এই প্রকারে " তিলৌদন " এরপরে " মাষৌদন " এর প্রয়োগ আবশ্যক, "মাংসৌদন " নয় ; কেননা ১৭ নং কণ্ডিকায় তিলৌদন শব্দের প্রয়োগ হয়েছে, অতএব ১৮নং কণ্ডিকায় অবশ্যই " মাষৌদন " শব্দের উল্লেখ থাকতে হবে ।
পূর্বের ক্রমও লক্ষণীয় — ক্ষীরৌদন, দধ্যোদন এবং উদৌদন শব্দের উল্লেখ রয়েছে । এখন ক্ষীর, দধি এবং অন্ন ত্যাগ করে মাংসের বিধান দেওয়া যা পুরোপুরি অসংগত প্রতীত হয়, অতএব এখানে মাষৌদন শব্দেরই প্রয়োগ হবে,
পণ্ডিত জে. পী চৌধুরী জী কাব্যতীর্থ —
গর্ভাধানের সময় " মাষৌদন " প্রয়োজন, " মাংসৌদন " নয় ; যা গর্ভাধানে সর্বদা বর্জনীয় । পুস্তকে একবার অশুদ্ধ ছাপিয়ে গেলে তো গেলো, কেউই এই বিষয়ের উপর পর্যবেক্ষণ করে শুদ্ধ করে না ।
চতুর্বেদ এর প্রসিদ্ধ প্রকাণ্ড ভাষ্যকার পণ্ডিত জয়দেব শর্মা বিদ্যালঙ্কার মীমাংসাতীর্থ —
৩০/১০/১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীমতী আর্য প্রাদেশিক প্রতিনিধি সভায় স্বর্ণ জয়ন্তী, লাহোরে পণ্ডিত জীকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বলেন যে, তাঁর সিদ্ধান্ত —
" উক্ত স্থানে পাঠভেদ রয়েছে, মাংস নয় বরং " মাষ " শব্দের পাঠই যথোপযুক্ত ।
উক্ত দিনই স্বামী অভেদানন্দজী বিদ্যাবারিধি, ব্যাকরণাচার্য বিজয় মিত্র শাস্ত্রী, মহোপদেশক আদি বিদ্বানগণ বৈদিক বাঙময়ের সুপ্রসিদ্ধ বিখ্যাত ইতিহাসবিদ পণ্ডিত ভগবদ্দত্ত জীর নিকট এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে উনিও একই মত প্রকাশ করেন যে, কণ্ডিকায় উক্ত স্থানে " মাষ " শব্দের প্রয়োগ হবে ।
পণ্ডিত সত্যব্রত জী " সিদ্ধান্তালঙ্কার " ( ভূতপূর্ব আচার্য তথা মুখ্যাধিষ্ঠাতা, গুরুকুল কাঁগড়ী ) ——
কণ্ডিকার উক্ত অংশের ভাষ্যে অনেক বিদ্বান লিখেছেন — মাতা-পিতা যেনো মাংস এবং চাউল মিশ্রিত করে ঔক্ষ বা আর্ষভ দ্বারা ঘৃত সহিত রন্ধন করে ভক্ষণ করে । এরূপ অর্থের কারণ হলো, কণ্ডিকায় উক্ত অংশে
" মাংসৌদন " শব্দে মাংস শব্দের উল্লেখ রয়েছে । পরন্তু এই কণ্ডিকার সম্পূর্ণ অংশ যাচাই করলে উক্ত অংশে মাংস শব্দের প্রয়োগ বা উল্লেখ অসম্ভব ।
সমস্ত প্রকরণ অধ্যয়ন করলে লক্ষ্য করা যায় যে, তিল, চাউল, ঘৃত ব্যতিরেকে অন্য কোনো বস্তু বা উপাদানের বর্ণন নাই । হুট করে এক স্থানে মাংস শব্দের উল্লেখ হলো ।
মূল বিষয় — উক্ত স্থানে " মাষ " এর জায়গায় কোনো লেখক ভুলবশত " মাংস " শব্দের উল্লেখ করেছে ।
সেই লেখকের ভুল বর্তমানে ছাপাখানার ভুল ( Printer's devil ) বলা হয় । চাউলের সাথে মাষ অর্থাৎ মাষকলাই ডাল সঙ্গতির স্পষ্টতা নির্দেশ করছে, মাংসের সাথে সম্পূর্ণ অসংগত । আজ পর্যন্ত শুভকার্যের অনুষ্ঠানে তিল-চাউল-মাষ এর মিশ্রিত খাবারের প্রস্তুত হয়ে থাকে । তিল-চাউলের সাথে মাংসের প্রয়োগ কখনই সম্ভব নয় ।
মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত আর্যমুনি জী ——
যদি কামনা করে যে, "আমার পুত্র পণ্ডিত হোক", সে যেনো মাংস = মাষ = চিকন মাংসল = মাষকলাই ডাল এর সাথে রন্ধনকৃত চাউলকে উক্ষ বা ঋষভ ঔষধের রস সহযোগে খায়, আর যে উক্তবাক্যে মাংস শব্দের আশঙ্কা করা হয়, যা কোনো প্রাণীর মাংসের অর্থ দেওয়া হয় ঔষধের নয়? এর উত্তর হলো, এই কণ্ডিকার পূর্ব প্রকরণ অন্ন বা ঔষধেরই ।
পাণ্ডেয় পণ্ডিত শ্রীরামনারায়ণদত্ত জী শাস্ত্রী 'রাম' ——
" বেদ এবং উপনিষদে মাংস ভক্ষণ এবং অশ্লীলতা নেই " এই বিষয়ের শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেন --
উদাহরণের জন্য বৃহদারণ্যক উপনিষদ এর ৬/৪/১৮ নং শ্লোকের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন । সেখানে সুযোগ্য এবং বিদ্বান পুত্র উৎপন্ন করার জন্য দম্পতিকে ঔক্ষ অথবা আর্ষভের সাথে রন্ধন করে খিচুড়ি খাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে ।
প্রায়ঃ মুগ বা মাষকলাই ডালের সাথে খিচুড়ি রান্না করা হয় । মুগের খিচুড়িকে
" মুদ্গৌদন " এবং মাষকলাই ডাল মিশ্রিত খিচুড়িকে " মাষৌদন " বলা হয় । সম্ভবতঃ কোনো মাংস প্রেমী এই মাষৌদন শব্দটিকে পরিবর্তন করে " মাংসৌদন " করে দিয়েছে ।
যদি কারও এই মতই থাকে যে, উক্ত স্থানে
" মাংসৌদন " পাঠেরই উল্লেখ রয়েছে, তবুও উক্ত পাঠের অর্থ ঔষধ বা অন্নই হবে ।
এই বিষয় প্রথম বিবেচনা অনুসারে মানতেই হবে । ঔক্ষ বা আর্ষভ মিশ্রিত ওদনের জন্য " মাষৌদন " বা " মাংসৌদন " নাম উক্ত স্থানে উল্লেখ হয়েছে এটাই সংগত ।
পণ্ডিত দীনানাথ জী শর্মা শাস্ত্রী সারস্বত, বিদ্যাবাগীশ, বিদ্যাভূষণ, বিদ্যানিধি ——
" বৃহদারণ্যক এবং বৃষভ মাংস ভক্ষণ ? " এই বিষয়ের শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেন --
" ..... প্রথমে এক বেদ বক্তার জন্য ওদন এর দুধ, দুই বেদ বক্তার জন্য ওদন এর দই, তিন বেদ বক্তার জন্য ওদন এর গঙ্গা আদি উদকে রন্ধন করার বর্ণনা রয়েছে । যা তরল তথা পরস্পর সম্বন্ধ বস্তু । ১৭ নং কণ্ডিকায় পুত্রী পুত্রীর পণ্ডিততা বুদ্ধিমত্তার জন্য তিল এবং তণ্ডুল মিশ্রিত করে রন্ধন করার বর্ণনা রয়েছে । এখানে তিল বিশেষ লক্ষণীয় । তাহলে ১৮ নং কণ্ডিকায় পণ্ডিত পুত্র লাভের মাংসের প্রয়োগ কিভাবে হতে পারে ?
প্রথমে দুধ, দই তথা জল পরস্পরের সম্বন্ধ রয়েছে, এরপর পরবর্তী কণ্ডিকায় তিলের সাথে মাংসের সম্বন্ধ কিভাবে আসবে ?
এখানে মাংসও সাহচর্যানুসারে লক্ষণীয় ।
" ঔক্ষেণ, আর্ষভেণ " এই পদগুলো তৃতীয়ান্ত,
এর বিশেষ মাংস তৈরিও হতে পারে না ; কেননা, এখানে মাংস শব্দে তৃতীয়া নাই ।
মূল নিয়ম — বিশেষণ-বিশেষ্য এর বিভক্তি সমান হয় এবং সেই বিশেষ্য এর অন্য পদের সাথে সমাসের যুক্তও সম্ভব নয় ।
অন্য আরেকটি বিষয় বিচারণীয় ——
" মাংসৌদনম্ " শব্দটিকে নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে ।
মাংস শব্দের অর্থ মাংস-ই করলে এই দ্বন্দ্ব হয় না । " তিলৌদনম্ " এর বিভাষা " বৃক্ষমৃগতৃণধান্যব্যঞ্জনপশুশাকুন্যশ্ববডবপূর্বাপরাধরোত্তরাণাম্ " ( পা. ২/৪/১২ ) এই সূত্রে
" ব্রীহিয়ধম্ " এর ভ্রান্তি উভয় " খাদ্যশস্য " হওয়ায় বিষয়টিতে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে , কিন্তু " মাংসৌদনম "শব্দে " মাংস " কোনো খাদ্যশস্য জাতীয় পদার্থ নয়, অতএব তা দ্বন্দ্ব হতে পারে না । কিন্তু এখানে মাংস শব্দটি যদি কোনো ভক্ষ্য শস্য-সম্বন্ধীয় পদার্থ সিদ্ধ হয়, তাহলে সঠিক সংগতি হবে ।
এই সংগতি এই প্রকারে — " অতো মাষান্নমৈবৈতদ্ মাংসার্থে ব্রহ্মণা স্মৃতম্....
যথাবলিষ্টং মাংসত্বাদ্ মাষান্নমপি তৎসমম্ ।
সৌগন্ধিকং চ স্বাদিষ্ঠং মধুরং দ্রব্যভেদতঃ ( প্রজাপতি স্মৃতি: ১৫২, ১৫৩ ) এই প্রমাণ দ্বারা " মাংস " এর অর্থ " মাষ " ভক্ষ্য শস্য-সম্বন্ধীয় পদার্থই হয় । কেননা —
" মাংসল " পদার্থও " অর্শআদ্যচ্ " দ্বারা
" মাংস " শব্দের সম্বোধন করা হয় ।
এজন্য বৃহদারণ্যক উপনিষদে দশ গ্রাম্য শস্য জাতীয় খাবার গণনা করতে যেয়ে
" ব্রীহিয়বাঃ " তিল-মাষাঃ ( ৬/৩/১৩ ) তিলের সাথে মাষের উল্লেখ করা হয়েছে ।
পূর্বোক্ত সমাহার দ্বন্দ্বের বৈকল্পিকতার কারণে এখানে এক বচন না হয়ে ইতরেতরযোগ্যে বহুবচন হয়েছে । এই প্রকার প্রকৃত স্থলে " মাংসৌদনম্ " শব্দেরই প্রয়োগ বুঝতে হবে । তখন উক্ত স্থানে " মাংস " দ্বারা " মাষ " এর গ্রহণ হলে সমস্ত সংগতি সঠিক হয়ে যায় ।
তাৎপর্য হলো, মাষ এবং ওদন ঘৃতাক্ত সহযোগে রন্ধন করে উক্ষা বা ঋষভক এর সরসের সহিত পতি-পত্নী ভক্ষণ করলে পূর্বোক্ত গুণবান পুত্র লাভ করবে । মাষের ক্ষীর অত্যন্ত পুষ্টিকর হয়, তাই এর বর্ণন উক্ত স্থানে পুত্রোৎপত্তি সম্বন্ধে নির্দেশ করছে ।
এখন বিচার্য বিষয়
" উক্ষা " এবং " ঋষভক " শব্দের অর্থ —
" ঔক্ষণ বা আর্ষভেণ বা " এই শব্দের প্রয়োগ দুইবার হয়েছে । এই " বা " শব্দ দ্বারা এটা সিদ্ধ হয় যে, এই দুটি ভিন্ন পদার্থ ।
" বৃষ " অর্থ করা সংগতিপূর্ণ নয় । আয়ুর্বেদে উক্ষা " সোম " ওষধির নাম ।
সায়ণাচার্যও ঋগ্বেদ: ১/১৬৪/৪৩ নং মন্ত্রের ভাষ্যে লিখেন —
" সোম উক্ষাऽভবৎ " । ঋষভ " ঋষভক " ওষধির নাম । এই দুটি পদার্থই ঔষধিমূলক হওয়ার কারণে বলবর্ধন, বীর্য উৎপাদন এবং মেধাবী পুত্র উৎপাদন করার শক্তি রাখে ।
সুতরাং, উক্ত ঘৃতাক্ত মাষৌদন উক্ত ঔষধগুলোর মধ্যে যে কোনো একটি সোমলতার ; যদি তা পাওয়া না যায় তাহলে ঋষভক এর স্বরসের সাথে মিশ্রিত করে গ্রহণ করলে তেমন পুত্রই লাভ করবে — যা উক্ত কণ্ডিকার অর্থ ।
যদি এখানে বৃষের মাংস দ্বারাই বেদবক্তা বালক লাভের কামনা করা হতো তাহলে সেই ভক্ষক যবন বা ম্লেচ্ছই সর্ববেদ বক্তা সিদ্ধ হতো, বৈদিক ধর্মালম্বী নয় । পরন্তু এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, কাল্পনিক । অতএব এই অর্থ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ।
উপরোক্ত আর্য জগতের বিখ্যাত আটজন বিদ্বানগণের মতানুসারে বৃহদারণ্যক উপনিষদের উক্ত কণ্ডিকার উক্ত অংশে
"" মাষৌদন """ শব্দের প্রয়োগ হওয়াই সম্পূর্ণ যথোপযুক্ত ।
নমস্কার
0 মন্তব্য(গুলি)