https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

হিন্দুশাস্ত্রে পুত্র শব্দের অর্থ - সন্তান নাকি ছেলে ?

Thursday, June 11, 2020


পশ্চিম বঙ্গীয় বামাতিদের হালচাল বোঝা মুস্কিল। তাদের সারা জীবন স্বধর্মীয় কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দেখা না গেলেও সর্বদা পরধর্ম চর্চা করতে দেখা যায় এবং সুযোগ পেলেই স্বধর্ম নিয়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরণের অপপ্রচার চালায়। এরই ধারাবাহিকতা ধরে এবার দুর্গাপূজায় তারা রব তুলেছে দুর্গাপূজার অঞ্জলি মন্ত্রের "পুত্রান্ দেহি" অংশটি পরিবর্তন করে "সন্তানান্ দেহি" করতে হবে।

এর কারণ হিসেবে তারা দেখাচ্ছেন এই মন্ত্র "পুত্রান্ দেহি" শব্দটি দ্বারা নাকি দেবীর কাছে শুধুমাত্র পুত্র সন্তানই চাওয়া হচ্ছে! তাদের এই কথাটি যে একদম অমূলক ও অবৈয়াকরণিক তা আমরা এখন দেখবো।
আগে দেখে নেই উক্ত মন্ত্রটিতে কী রয়েছে,

"নমঃ আয়ুর্দ্দেহি যশো দেহি ভাগ্যং ভগবতি দেহি মে।
পুত্রান্ দেহি ধনং দেহি সর্ব্বান্ কামাশ্চ দেহি মে।।"

এই অঞ্জলি মন্ত্রটিতে মূলত দেবীর কাছে আয়ু, যশ, সৌভাগ্য, সন্তান, ধন ও কামনা সিদ্ধির আকাঙ্ক্ষা করা হচ্ছে।

এখন আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, মূল মন্ত্রে 'পুত্রান্' পদটি থাকলেও আমি এখানে পুত্রের উল্লেখ না করে সন্তানের উল্লেখ করছি কেন?

এর উত্তর হচ্ছে, সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসারে এই স্থানে পুত্রান্ শব্দটি সন্তান শব্দবাচক। এজন্যই আমি এখানে সন্তান ব্যাবহার করেছি। এবার আমি সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসারে দেখাবো যে, পুত্রান্ শব্দটি মূলত সন্তান অর্থই নির্দেশ করে।

'পুত্রান্' শব্দটি হচ্ছে বহুবচন। এজন্য 'পুত্রান্ দেহি' কথাটির দুটো অর্থ হয়:

i. আমাদের বহু পুত্র দাও অথবা
ii. আমাদের বহু পুত্রী ও পুত্র দাও।

বিষয়টি অনুধাবন করতে হলে সংস্কৃত ব্যাকরণের 'একশেষ' সূত্র বুঝতে হবে। পুংলিঙ্গের দ্বিবচনে এক স্ত্রী এবং এক পুরুষকেও বোঝায়। একই ভাবে পুংলিঙ্গের বহুবচনে বহু স্ত্রী এবং বহু পুরুষও বোঝায়।


এই বিষয়ে সংস্কৃত ভাষার প্রাচীন ব্যাকরণ 'অষ্টাধ্যায়ী'-তে বিধি সিদ্ধ রয়েছে। অষ্টাধ্যায়ীর ১।২।৬৭ তে রয়েছে "পুমান স্ত্রীয়া"।



এই সূত্রটির অর্থ হচ্ছে, "স্ত্রী প্রত্যয়ান্ত শব্দের সঙ্গে উক্তিতে পুংলিঙ্গ শব্দ অবশিষ্ট থাকে"।

অর্থাৎ কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্ত্রী প্রত্যয়ান্ত শব্দে শুধুমাত্র পুংলিঙ্গ শব্দটি অবশিষ্ট থাকে এবং স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটি লুপ্ত হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে যে মূলে স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটি রয়েছে সেটি বুঝতে হবে।

এই সূত্রটির টীকা করতে গিয়ে সিদ্ধান্তকৌমুদীতে উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, "হংসী চ হংসশ্চ হংসৌ"।

অর্থাৎ হংসী এবং হংস শব্দে হংসৌ হয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয়টি হচ্ছে, হংসৌ শব্দটি পুংলিঙ্গ হলেও এটি মূলত হংসী ও হংস শব্দদ্বয় দ্বারাই গঠিত।

অষ্টাধ্যায়ীর এরপরের সূত্রটি অর্থাৎ ১।২।৬৮ দেখলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। এই সূত্রে পাণিনি বলেছেন,

"ভ্রাতৃপুত্রৌ স্বসৃদুহিতৃভ্যাম্"।

এর অর্থ হচ্ছে,

"স্বসৃ ও দুহিতৃ শব্দের সাথে যথাক্রমে ভ্রাতৃ ও পুত্রৌ অবশিষ্ট থাকে।"


অর্থাৎ সহজ ভাবে বলতে গেলে, কোনো উক্তিতে স্বসৃ ও ভ্রাতৃ শব্দটি একত্রে থাকলে স্বসৃ লুপ্ত হয় এবং ভ্রাতৃ অবশিষ্ট থাকে। একই ভাবে, দুহিতৃ লুপ্ত হয়ে পুত্রৌ অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু মূলে যেহেতু স্বসৃ ও দুহিতৃ শব্দটি রয়েছে, তাই কোনো বাক্যে শুধুমাত্র ভ্রাতৃ ও পুত্রৌ থাকলেও এদের অর্থের ক্ষেত্রে লুপ্ত স্বসৃ ও দুহিতৃ এসে যাবে।


এই সূত্রটির টীকা করতে গিয়েসিদ্ধান্তকৌমুদী উল্লেখ করেছে, "পুত্রশ্চ দুহিতা চ পুত্রৌ"।  

সহজ ভাবে বললে, সংস্কৃত বাক্যে কোথাও পুত্রৌ থাকলে এর অর্থের ক্ষেত্রে পুত্র ও দুহিতা উভয়ই অর্থ গ্রহণ করতে হবে। 

একই ভাবে, পুত্রান্ শব্দটির অর্থের ক্ষেত্রেও সংস্ক্রিয়ভাবে পুত্র শব্দের সাথে কন্যা (দুহিতা) শব্দটিও এসে যায়, এটি পাণিনি সিদ্ধ, যার উপর আর কোনো কথা চলে না। 


পাণিনির এই নিয়ম যে প্রাচীনকালে সংস্কৃত সাহিত্যে ব্যবহার হতো তার কয়েকটি উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক। অমরকোষের ২।৬।৩৭ মতে, "পুত্রৌ পুত্রশ্চ দুহিতা চ" অর্থাৎ পুত্রৌ মানে একটি পুত্র এবং একটি কন্যা।



আরেকটি বিখ্যাত উদাহরণ হলো "পিতরৌ"। এর মানে হলো দুই পিতা হয় বা দুই পূর্বপুরুষ হয় অথবা মাতাপিতাও হয়। যদি কেউ এই পিতরৌ শব্দটির অর্থ শুধুমাত্র দুই পূর্বপুরুষ (পুংলিঙ্গ অর্থে) করে, তবে কালীদাসের বিখ্যাত রঘুবংশের প্রথম শ্লোকেই অর্থের বিপর্যয় ঘটে যাবে। মহামবি কালিদাস এখানে বলেছেন, 

"জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতী-পরমেশ্বরৌ।" অর্থাৎ "জগতের মাতাপিতা পার্বতী এবং শিবকে আমি বন্দনা করি।"




 

এই স্থলে যদি বর্তমান বামাতিরা তাদের ব্যাকরণ জ্ঞান দিয়ে অনুবাদ করে, তবে এটির অর্থ হবে, জগতের দুই পূর্বপুরুষ পার্বতী ও শিবকে আমি বন্দনা করি!!! 



এবার আসা যাক মিশ্রলিঙ্গাত্মক পুংলিঙ্গের বহুবচনের উদাহরণগুলিতে। যেমন: হংসাঃ মানে বহু হংস এবং বহু।হংসহংসী উভয়ই হতে পারে। তেমনি পুত্রাঃ মানে বহু পুত্র এবং বহু পুত্রপুত্রী উভয়ই হতে পারে। আর পুত্রপুত্রীকে একত্রে যে সন্তান বলে সেটি সকলেই জানে। 


যেমন: বেদে সমগ্র মানবদের 'অমৃতস্য পুত্রা' বলা হয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে, মানবগণ হচ্ছে অমৃতরূপ ঈশ্বরের সন্তান [দ্রষ্টব্য: স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীকৃত যজুর্বেদ ভাষ্যে ১১।৫]



উদাহরণস্বরূপ আবার আসা যাক সেই কবিবর কালিদাসের অপর একটি বিখ্যাত কাব্য কুমারসম্ভব কাব্যের [১।২৭] 'পুত্রবতঃ' শব্দটিতে। 

এর টীকায় মল্লিনাথ লিখছেন, "পুত্রাশ্চ দুহিতরশ্চ পুত্রাঃ...তেঽস্য সন্তীতি পুত্রবানহ্...তস্য পুত্রবতঃ" অর্থাৎ "পুত্ররা এবং দুহিতারা  একত্রে পুত্রাঃ হয়...যাঁর পুত্রাঃ আছে তিনি পুত্রবান্...এবং পুত্রবতঃ বলে বোঝায় পুত্রবান সম্বন্ধীয়।"



এখানে লক্ষণীয় বিষয়টি হচ্ছে, মল্লিনাথ কেবল বলছেন না যে পুত্রাঃ মানে পুত্রপুত্রীরা বোঝায়, উপরন্তু বলছেন পুত্রবান্ মানে বহু পুত্রপুত্রীর পিতাকে বোঝায়। পুত্রবানেরই ষষ্ঠী বিভক্তির একবচনে আসে পুত্রবতঃ। যেরকম প্রথমা বিভক্তির বহুবচনের "পুত্রাঃ" বলতে বহু পুত্র এবং বহু পুত্রপুত্রী বোঝায়, তেমনি এই
শব্দটির দ্বিতীয় বিভক্তির বহুবচনের "পুত্রান্"
বলতে শুধু পুত্রদেরকে নয় পুত্রপুত্রীদেরকেও বোঝায়।


এবার বিষয়টি আরও পরিষ্কার হওয়ার জন্য সংস্কৃত অভিধান হতে পুত্র শব্দটিরও অর্থ দেখে নেওয়া যাক। Oxford University থেকে প্রকাশিত Mac Donell এর A Sanskrit-English Dictionary-তে 'পুত্র' শব্দের অর্থ son এর পাশাপাশি child-ও দেওয়া আছে। একই ভাবে সংস্কৃত-ইংলিশ ভাষার সবচেয়ে সমৃদ্ধ অভিধান, মনির উইলিয়ামসের ডিকশনারিতেও পুত্র শব্দের অর্থ son ও child উভয়ই রয়েছে। 



এসব অষ্টাধ্যায়ী, সিদ্ধান্তকৌমুদী, কালীদাসের কাব্য, অভিধানের প্রমাণ হতে বোঝা যায়, পুত্র, পুত্রা, পুত্রৌ, পুত্রান্– এসব শব্দ শুধুমাত্র ছেলে সন্তান বাচক নয়, বরং পুত্র ও কন্যা উভয় সন্তান বাচক। এজন্য বেদসহ যেসব প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ রয়েছে সেগুলোতে উল্লেখিত পুত্রা, পুংসবন, পুত্রান্ ইত্যাদি শব্দ পুত্র ও কন্যা উভয় সন্তানের সাথেই সম্পর্কিত। তাই পশ্চিম বঙ্গীয় বামাতিদের নারীবাদী মুখোশের আড়ালে  সনাতনী নারীদের বিধর্মীকরণ প্রক্রিয়ার জন্য পাতা ফাঁদ হতে সকলে সাবধান থাকুন এবং সত্যকে জানুন।