দুর্গাদাস লাহিড়ী (১৮৬৩–১৯৩২) বিশিষ্ট বাঙালি গ্রন্থকার ও সম্পাদক। মূলত জ্ঞানবিজ্ঞান-মূলক গ্রন্থ
রচনা ও সংগীত সংকলনের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অনুসন্ধান ও বঙ্গবাসী
পত্রিকার সম্পাদক । কলিকাতা মেট্রোপলিটান কলেজে
অধ্যয়নকালেই সাহিত্যচর্চায় প্রবৃত্ত হন এবং প্রচলিত পত্রিকাদিতে রচিত
কবিতা ও প্রবন্ধাবলী প্রকাশ করতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উপদেশ ও উৎসাহে
সাহিত্যসেবায় অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮৮৭ সাল , অনুসন্ধান পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং
১৯০৫ অব্দি তার পরিচালনা করেন। পত্রিকাটি মাসিক, পাক্ষিক, দৈনিক
আকারে এবং পরে ইংরেজী বাংলা উভয় ভাষাতেই প্রকাশিত হত । পরে বঙ্গবাসী’
পত্রিকার সম্পাদক হয়ে ১৯o৯ সাল অব্দি এই পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন ।ভারতবর্ষের ইতিহাস সাতখণ্ডে সমাপ্ত করেই তিনি মারা যান। মূল চারবেদ সায়ণ মহীধরভাষ্য বাংলা অক্ষরে প্রকাশ তাঁর অক্ষয় কীর্তি । তাঁর নিজস্ব বেদব্যাখ্যা শৈলী আদিতে প্রশংসিত হলেও স্বীকৃত ও সম্পূর্ণ নয় । প্রমাণহীনতা , অপ্রাসঙ্গিকতা পদে পদে দৃশ্যমান । সম্প্রতি অনেকেই পরম্পরার নামে পিঠ বাঁচাতে এনার ব্যাখ্যাকে আশ্রয় করে পরম্পরাযুক্ত ভাষ্য বলে মিথ্যাচার করেন । আজকে তারই সত্য উন্মোচন হবে -
- যজুর্বেদ ১।১ এ তিনি প্রচলিত বেদব্যাখ্যা গ্রহণ করে বেদকে হাস্যাস্পদ করতে চাননি বলে উল্লেখ করেছেন ।
এখনকার বোধোপযোগী করিবার লক্ষ্য রাখাই কর্তব্য বলিয়া মনে করি । শাখা দেবতা যখন এখন ববিকতা - প্রাপ্ত হইয়াছেন , অথবা আমাদের স্বর যখন তাঁহাদের কর্ণে এখন আর পৌছিতে সমর্থ হইতেছে না , তখন কেন আর,কূট-কল্পনায় অর্থকে প্রচ্ছন্ন রাখিতে যাই ? অথবা ,কেন আর , সহজবোধ্য অর্থ গ্রহণ না করিয়া , পরম পবিত্র বেদকে হাস্যাস্পদ করিতে চাই ? অতএব , আমরা সাধারণভাবেই মন্ত্রের মর্মার্থ প্রকাশ করিলাম । যিনি যে দেবতার উদ্দেশেই : স্ব প্রয়োগ করিতে চাহেন , তাহাতেই তিনি এ মন্ত্র প্রয়োগ করিতে পারিবেন । মন্ত্র বিশ্বজনীন ভাবপূর্ণ । কষ্ট - কল্পনায় , কেন তাহাকে একমাত্র শাখা দেবতাতে আবদ্ধ রাখিব ? আমরা তাই মন্ত্রের শেষাংশের অর্থ করিতে চাই , – ' হে দেব ! এই আমার পশুবৃত্তি - সমূহকে বিনাশ করিয়া আমায় রক্ষা ( পরিত্রাণ ) করুন । ” ফলতঃ , মন্ত্র দেবোদ্দেশে বিনিযুক্ত বলিয়াই বুঝিতে হইবে । বিতর্কে প্রয়োজন নাই । আপনার অন্তরকে জিজ্ঞাসা করিবেন — ঐ অর্থ সঙ্গত কি - না ? অন্তরই সে প্রশ্নের উত্তর প্রদান করিবে ।
অথচ পরম্পরাবাদীদের শ্রী নিরঞ্জন দেবতীর্থ এখানে সায়ণ মহীধরের নাম উল্লেখ করে তাদের কর্মকাণ্ডপরক অর্থই প্রামাণিক বলে স্বীকার করেছে ।
প্রসঙ্গতঃ উক্ত ভাষ্যের করপাত্রীকে ভূমিকায় ' ব্রহ্মস্বরূপ ' বলা হয়েছে ।
তাদের ব্রহ্মস্বরূপ করপাত্রী নামক কুপাত্র স্বীয় হঠকারীতা বজায় রাখতে সূর্যকেই পৃথিবীর চারিদিকে প্রদক্ষিণ করিয়েছে । বিশ্বাস নাহয় পড়ুন এখানে - http://back2thevedas.blogspot.com/2021/04/blog-post_19.html
যারা কিনা লাহিড়ীর অনুবাদ দিয়ে বেদের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দাবি করতে চায় আবার পরম্পরার দোহাই দিয়ে করপাত্রী - সায়ণ - মহীধরদের ইতর শ্রেণীর ভাষ্য [ পড়ুন এখানে - শতপথ ব্রাহ্মণে অশ্বমেধ - বিবেকানন্দ সমর্থিত অশ্লীলতা ও সদর্থ , মহীধর ভাষ্য সমীক্ষা ] প্রমোট করে তাদের এহেন দ্বিচারিতার কারণ সহজেই অনুমেয় ।
- লাহিড়ী স্বীয় ভাষ্যে কোন প্রমাণাদির অপেক্ষা করেননি এবং তার নিজস্ব মনমতো ভাষ্য করেছেন৷ যেমন যজুর্বেদের ১ম মন্ত্রের ভাষ্যটি দেখুন কোন প্রমাণ উল্লেখিত আছে কি না ?
- সামবেদের ৪৭২ নং মন্ত্রটির দেবতা পবমান সোম এবং এখানে 'ইন্দো' শব্দটি পরমাত্মাবাচক । লাহিড়ী মহাশয় একে দেবতার আশয় বিরুদ্ধ অর্থ ' শুদ্ধসত্ত্ব ' কোন প্রমাণে নিলেন তা অজ্ঞাত ।
- ' ইন্দো । ' ( হে শুদ্ধসত্ত্ব ) ত্বং' মরুহুতে ' ( বিবেকলাভার ) ' অর্ক ” ' ( অনিযজ্ঞ ইত্যৰ্থা ) ‘ যোনিং’ ( উৎপত্তিমুলং – হৃদয়ং ইতি ভাবঃ ) ‘ আসদং ’ ( প্রাপ্ত হি ইত্যৰ্থঃ ) ; অপিচ ইন্দ্রায় ’ ( ভগবৎগ্ৰীত্যর্থং ) ‘ মধুমত্তমঃ ( মধুরতমঃ , অভিষ্টবর্ষকঃ সন্ ইতি যাবৎ ) ' পবঙ্গ ' ( ক্ষর , করুণাধারায়া মম হৃদি উপজিতঃ ভব ইত্যর্থ। প্রার্থনামূলকেহিরং মন্ত্রঃ । অরং ভাবঃ - ভগবরাভার মম হুদি সম্বভাঃ আবির্ভবতু – ইতি ভাবঃ ॥( ৩প - ৫ম – ১খ – ৬ সা) -বঙ্গানুবাদ | হে শুদ্ধসত্ত্ব ! বিবেকলাভের জন্য জ্ঞানযজ্ঞের উৎপত্তিমূল আমার হৃদয়কে প্রাপ্ত হও ; অপিচ ভগবৎ প্রাপ্তির নিমিত্ত মধুরতম অর্থাৎ অভীষ্টপূরক হইয়া করুণাধারায় আমার হৃদয়ে উপজিত হও । ( মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক । ভাব এই যে , – ভগবানকে লাভের নিমিত্ত আমার হৃদয়ে সত্ত্বভাব আবির্ভূত হউক ) ।
- একইভাবে যজুর্বেদ ১।২ - এর ব্যাখ্যায় মহীধরাদি কুশ ও স্থালীর আহ্বানের কোন কারণই তিনি দেখছেন না এবং মন্ত্রার্থ নিয়ে ভাষ্যকারের সাথে একমত না বলে জানিয়েছেন । অহো ! পরম্পরাবাদীদের তথাকথিত ভাষ্যের প্রামাণ্যতা অস্বীকারের কি নিদারুণ দৃশ্য ।
পূর্ব্ববর্ত্তী ভাষ্যকারগণ , এই কণ্ডিকার প্রথম মন্ত্রে কুশ - দ্বয়কে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় মন্ত্রে স্থালীকে আহ্বান করা হইয়াছে বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন । আমরা সেরূপ আহ্বানের কোনই কারণ দেখিতেছি না । আমরা মনে করি , এখানে সেই সর্ব্বকারণ - কারণ পরমেশ্বরকে লক্ষ্য করিয়াই প্রার্থনা জানান হইয়াছে ।
- যজুর্বেদ ২৩।১৯ এর ভাষ্যে পরম্পরাবাদীদের মহীধর - উবট আদি ভাষ্য সম্পর্কে বলেছেন - [ জ্ঞানবেদ - পৃ ২৩০ ]
চতুর্ব্বেদের ব্যাখ্যায় অনেক সময় আমরা পূর্ব্ববর্ত্তী ভাষ্যকারগণের মতের অনুসরণ করিতে পারি নাই। তজ্জন্য, গোঁড়া সামাজিকগণ কেহ কেহ আমাদিগের প্রতি ভ্রুকুটি প্রদর্শন করেন। তাঁহারা কূপমণ্ডূক ; বেদ যে কি অনির্বচনীয় সামগ্রী, তাঁহারা তাহা অনুভব করিবারও অবসর পান নাই। তাই বেদের ব্যাখ্যায় সত্য-তত্ত্ব প্রকাশের প্রয়াস পাইলে, তাঁহারা আমাদের উপর খড়্গ-হস্ত হন। পরন্তু তাঁহারা একবার ভ্রমেও ভাবিয়া দেখেন না যে, কি অমূল্য রত্ন কি আবর্জ্জনার দ্বারা আচ্ছাদিত হইয়া আছে।
- যজুর্বেদ ২৩।২৪ এ বলেছেন - [ জ্ঞানবেদ - পৃ ২৪৫ ]
হায় বেদ! হায় ভাষ্য! আর হায় প্রাচীন ভাষ্যের ধ্বজাধারী গোঁড়ামির প্রশ্রয়দাতাগণ! তোমরা কেহই একটু বুঝিবার চেষ্টা করিবে না কি,—কি মন্ত্রে কি কদর্থেরই আরোপ করা হইয়াছে!
- এছাড়াও লাহিড়ী বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে ছিলেন ও এই বিষয়ে একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন -
বিধবা-বিবাহের পক্ষপাতিগণ এই মন্ত্রটী বিধবা-বিবাহের স্বপক্ষে বলিয়া প্রচার করেন। আমার বোধ হয়, সেটা ভুল। আমি বিধবা-বিবাহের বিরুদ্ধে একটী প্রবন্ধ লিখিতেছি । [ জ্ঞানবেদ - পৃ ২২৫ ]
- এছাড়াও ঋগ্বেদ নিয়ে আলোচনায় তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বিধবার বিবাহ নাই , তা ঘোড়ার ডিমের মত অসম্ভব এবং সহমৃতা হওয়া বা ব্রহ্মচর্য ব্যতীত তার কর্ম নাই । [ জ্ঞানবেদ - পৃ ২২৮ ]
প্রথম—‘বিধবা’ বলিতে কি বুঝি! শাস্ত্রানুসারে পতিহীনা নারীর দুই কৰ্ম্ম নির্দিষ্ট, সহমৃতা হওয়া বা ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করা। সহমৃতা অথবা ব্রহ্মচর্য্যপরায়ণা পতিহীনা সতীই ‘বিধবা’ নামের বাচ্য। সহমৃতা হওয়া অথবা ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করা ভিন্ন, বিধবার আর অন্য কৰ্ম্ম (শ্রেষ্ঠ কৰ্ম্ম) নাই। এই দৃষ্টিতে’ ‘বিধবার বিবাহ’—এইরূপ বাক্যই ‘সোণার পাথর বাটী’ বা ‘অশ্বডিম্ববৎ’ অলৌকিক।
- সবার শেষে তার বৈষ্ণবীয় ভাবের অতি আতিশয্যে তিনি চূড়ান্ত মায়াবাদ বিরোধী ও গৌড়ীয়গণের মতই শ্রীচৈতন্যকে বিষ্ণুর অবতারের মধ্যে পরিগণিত করেছেন । [ জ্ঞানবেদ - পৃ ৬০৮ ]
- এছাড়াও ঋগ্বেদের বিবিধ স্থলে তিনি ' গৌর ' পদ দৃশ্যমান হলেও সেখানে কোনরকম যুক্তিপ্রমাণ প্রাসঙ্গিকতার বালাই ব্যতীতই ' গৌরাঙ্গ ' ধরে নিয়ে ইতিহাস [ নাকি লীলা ? ] দেখিয়েছেন ।
- পৃথিবীর ইতিহাস [ ১ম খণ্ড ] তিনি বলেছেন - বর্ণ জন্ম থেকেই হয়৷, কর্মানুযায়ী নয় ।
' ফলতঃ , জাতি - বর্ণ - ক্রমে জন্মগ্রহণ করিয়াই মানুষ এক - এক কর্ম্মের অধিকার প্রাপ্ত হইয়া থাকে ; পরন্তু , অধিকার প্রাপ্ত হইবার পর কেহই জন্মগ্রহণ করে না । আর এক কথা , যদি আগে গুণ - কর্ম্মের বিচারই হইবে , তাহা হইলে , চতুব্বর্ণ না হইয়া , অসংখ্য বর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না কি ? ইহ - সংসারে গুণ - কর্ম্মের কি কখনও সংখ্যা নির্দেশ করা যায় ? গুণকৰ্ম্মানুসারে জাতি - বিভাগ হইলে , বংশানুক্রমিক জাতি - বর্ণ কেনই বা অব্যাহত থাকবে ? তাহা হইলে , ব্রাহ্মণের পুত্র ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয়ের পুত্র ক্ষত্রিয় , বৈশ্বের পুত্র বৈশ্য , শূদ্রের পুত্র শূদ্র , — এরূপ নিয়ম - পদ্ধতিই বা কেন চলিয়া আসিবে ?
- একই বইয়ে তিনি বেদে সুদাস রাজার কাহিনী বলে ইতিহাসও স্বীকার করেছেন যা কিনা আবার গ্রন্থান্তরে তিনিই অস্বীকার করেছেন । অস্থির চিত্তের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।
সুদাস সমগ্র পৃথিবী জয় করিয়াছিলেন।ঋগ্বেদে সুদাসের যে বীরত্ব - কাহিনীর পরিচয় পাওয়া যায় , তাহাতে সুদাসকে অদ্বিতীয় বীর বলিয়া মনে হয়। অম্বু এবং দ্রুহ্যু নামক দুই বীরের অধিনায়কত্বে এক সময়ে ষষ্টিশত এবং ঘটসহস্ৰ ষড়ধিক ষষ্টিসংখ্যক যোদ্ধা , রাজা সুদাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত হইয়াছিল। কিন্তু সুদাস তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করিয়াছিলেন । সুদাসের এই বীরত্ব বর্ণনা—ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলের অষ্টাদশ সূক্তে দেখিতে পাওয়া যায় । এক সময়ে রাজা সুদাস দশ জন স্বাধীন নৃপতিকে পরাজিত করিয়াছিলেন বলিয়া , বেদে উল্লিখিত আছে । সুদাসের একটি প্রধান প্রতিষ্ঠার পরিচয় — তিনি সাহিত্য সেবী কবিগণের উৎসাহদাতা ছিলেন । বসিষ্ঠ এবং বিশ্বামিত্রের বংশধর কবিগণ তাঁহার নিকট যে উৎসাহ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন , নানা স্থানে তাহা বর্ণিত আছে । এক সময়ে কবি ত্রিৎশু বা বসিষ্ঠ , রাজা সুদাসের নিকট হইতে শত গাভী , দুইখানি রথ , চারিটি অঞ্চ এবং বহু স্বর্ণালঙ্কার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। অন্যান্য কবিগণও রাজা হুদাষের নিকট সর্ব্বদা বিবিধ প্রকার উপকার প্রাপ্ত হইতেন । ঋগ্বেদের সপ্তম মগুলে অষ্টাদশ সূক্তের দ্বাবিংশ ও ত্রয়োবিংশ শ্লোকে মহর্ষি বসিষ্ঠ সুদাসের গুণ - গাথা কীর্তন করিয়া গিয়াছেন ।
আধুনিক মায়াবাদী পরম্পরাবাদীদের তথাকথিত শুদ্ধ বা আধ্যাত্মিকভাষ্যেই এই হলো ইতিহাস, মতবাদ ও যোগ্যতা যা কিনা প্রচারকারীগণ স্বয়ংই স্বীকার করেন না ।
0 মন্তব্য(গুলি)