https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

গীতায় কি উত্তরায়ণ - দক্ষিণায়ন অনুযায়ী মোক্ষলাভের কথা রয়েছে ?

Monday, April 25, 2022



গীতার এই শ্লোকদুটো পড়লে আমাদের অনেকেরই মনে হয় যে মোক্ষ এবং পুনর্জন্ম বিষয় দু’টো হয়তো মৃত্যুর সময়কালের উপর নির্ভর করে, আমাদের কৃতকর্মের উপর নয়।

"ব্রহ্মবিৎ পুরুষগণ অগ্নি, জ্যোতি, শুভদিন, শুক্লপক্ষে এবং ছয়মাস উত্তরায়ণকালে দেহত্যাগ করলে ব্রহ্মকে লাভ করেন আর ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষে বা ছয়মাস দক্ষিণায়নকালে দেহত্যাগ করলে পুণরায় জন্মগ্রহণ করেন।"
(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৮/২৪-২৫)


🔸 এমনকি মহাভারতেও আমরা দেখেছি মহামহিম ভীষ্ম শরশয্যায় শুয়ে উত্তরায়ণের অপেক্ষা করছিলেন, কারণ মৃত্যুর জন্য উত্তরায়ণ হল প্রশস্ত সময়। কিন্তু মৃত্যুর পরবর্তী গতি যদি মৃত্যুর সময়ের উপরই নির্ভর করে তাহলে গীতার বাকী অধ্যায়সমূহের সকল শিক্ষাই ব্যর্থ হয়ে যায়। ঈশ্বরভক্তি ও নিষ্কাম কর্মের কোনো গুরুত্বই রইল না। তাহলে এই উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়নের সঠিক তাৎপর্য কি?

🔹আমরা গীতার সংশয় সমাধানের পূর্ববর্তী পর্বতেই জেনেছি যে গীতার ব্যাখ্যা করা উচিত বৈদিক শাস্ত্রের (বেদ, উপনিষদের) অনুসরণ করে, কারণ গীতা হল সকল উপনিষদের সারসংকলন। এবং অবাক বিষয় হল, এই উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়ন এর কথা উপনিষদগুলোতে বারবার এসেছে। ১১টি বৈদিক উপনিষদে ন্যূনতম ৫ বার এই তত্ত্ব রয়েছে, আরও থাকতে পারে। বেদ, বেদান্তসূত্র এবং নিরুক্তেও এই বিষয়ে বলা আছে। আর প্রশ্ন-উপনিষদ এই বিষয়ের বলতে গেলে প্রায় সমাধানই প্রদান করেছে। আমরা শুরুতেই দেখে নিই উপনিষদগুলো এই ব্যাপারে কি বলে—

♦️—"যাঁহারা এই পঞ্চাগ্নিবিদ্যা জানেন এবং যাহারা অরণ্যে সত্যভাবে শ্রদ্ধার উপাসনা করেন (কিংবা শ্রদ্ধাকে সত্যরূপে উপাসনা করেন) তাঁহারা সকলেই অর্চিকে (জ্যোতিকে) লাভ করেন। অর্চি হইতে তাঁহারা দিনে, দিন হইতে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ হইতে সূর্যের উত্তরায়ণের ছয় মাসে, মাসসমূহ হইতে দেবলােকে, দেবলোক হইতে আদিত্যে, আদিত্য হইতে বিদ্যুৎলােকে যান। তখন এক অমানব পরুষ অসিয়া তাহাদের বিদ্যুৎলােক হইতে ব্রহ্মলােকে লইয়া যান। শ্রেষ্ঠ অবস্থা লাভ করিয়া তাহারা সেই ব্রহ্মলোকে চিরকাল বাস করেন ; আর তাহাদের সংসারে ফিরিতে হয় না। একে বলা হয় দেবযান।
♦️আর যাহারা স্বর্গলাভের আশায় গ্রামে ইষ্টপূর্ত, দান ইত্যাদির অনুষ্ঠান করে, তাহারা মত্যুর পর ধূমে গমন করে। ধূম হইতে রাত্রিতে, রাত্রি হইতে কৃষ্ণপক্ষে, কৃষ্ণপক্ষ হইতে দক্ষিণায়নের ছয়মাসে গমন করে। মাসসমূহ হইতে পিতৃলােকে, পিতৃলােক হইতে আকাশে, আকাশ হইতে চন্দ্রলােকে গমন করে। যে পর্যন্ত কর্মক্ষয় না হয়, সে পর্যন্ত চন্দ্রমণ্ডলে বাস করিয়া যে পথে গিয়াছিল সেই পথেই ফিরিয়া আসে (মানে পুনর্জন্ম লাভ করে)। একে বলা হয় পিতৃযান।"
(বৃহদারণ্যক-৬/২/১৫-১৬, ছান্দোগ্য- ৫/১০/১-৬, কৈষীতকি- ১/২, ছান্দোগ্য- ৪/১৫/৫, প্রশ্ন- ১/৯-১০, ঋগ্বেদ ১০/৮৮/১৫, নিরুক্ত ১৪/৯)


উপরের শ্লোকগুলি মোটামুটি অপরিবর্তিতভাবে সকল উপনিষদে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই বাহুল্য এড়াবার জন্য একবারই উল্লেখ করলাম। বেদে এবং নিরুক্তে একেই দেবযান এবং পিতৃযান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু শ্লোকগুলো থেকে অন্তত এটুকু বোঝা যায় যে এখানে দিন-রাত, শুক্লপক্ষ-কৃষ্ণপক্ষ, উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়ন কোনো সময় নির্দেশ করছে না বরং বিভিন্ন পথ বা মার্গ নির্দেশ করছে। কিন্তু এইসকল মার্গের প্রকৃতি কেমন? তাদের বিশেষত্ব কি? এর উত্তর পাওয়া যায় প্রশ্নোপনিষদের প্রথম প্রশ্নের উত্তরেই।

শিষ্য কবন্ধী যখন তার গুরু পিপ্পলাদকে প্রশ্ন করলেন, "ভগবান, কোথা থেকে এই প্রাণীসকল জন্মলাভ করে?", তখন পিপ্পলাদ উত্তর দিলেন—

🔸"প্রজাপতি যখন প্রজা সৃষ্টি করার সংকল্প করলেন তখন তিনি নিজেকে দ্বন্দ্বরূপে প্রকাশ করলেন। দ্বন্দ্বরূপ বলতে দুই বিপরীত তত্ত্বে প্রকাশিত হলেন, একটি হল প্রাণ এবং অপরটি হল রয়ি (বা জড় পদার্থ বা Matter)। এই দ্বন্দ্বাত্মক তত্ত্ব পূর্বে পরমাত্মাতেই অন্তর্ভুক্ত ছিল, সৃষ্টিকালে তাঁর থেকেই আবির্ভূত হল। এই প্রাণ এবং রয়ি (বা জড়) মিলেই এই সমস্ত সৃষ্টি হয়েছে।" এইবার ঋষি পিপ্পলাদ সৃষ্টির ক্রম ব্যাখ্যা করবেন এবং সেখানে পরমাত্মার স্বরূপ এবং প্রাণ ও রয়ির প্রকৃতি বর্ণনা করবেন। বোঝার সুবিধার্থে আমরা প্রাণকে জ্ঞান এবং রয়িকে অজ্ঞানতা হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।

➡️ আদিত্যই (সূর্যই) প্রাণ, রয়িই চন্দ্র। সৃষ্টিতে আদিত্য ও চন্দ্ররূপে প্রাণ এবং রয়ির প্রথম প্রকাশ। আদিত্যই প্রাণের উৎস, সূর্য উদিত হলেই বিশ্বের সব কিছু প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, সূর্য অস্ত গেলেই সমস্ত প্রাণী নিদ্রিত হয়।

➡️সৃষ্টির ক্রমে আদিত্য (সূর্য) ও চন্দ্র বৎসরে পরিণত হয়। এই বৎসরই প্রজাপতি/ঈশ্বর। সুতরাং বৎসরেও দ্বন্দ্বাত্মক ভাব থাকবে। তাহলে বৎসরে প্রাণ ও রয়ির স্বরূপ কি? বৎসরের দুটি অয়ন - দক্ষিণায়ন এবং উত্তরায়ণ। উত্তরায়ণ সংবৎসরের প্রাণ অংশ আর দক্ষিণায়ন হল রয়ি অংশ। উত্তরায়ণ সূর্যের পথ। সূর্য প্রাণ, জ্যোতি ও জ্ঞানের প্রতীক। এই কারণে যারা ইহজীবনে ব্রহ্মবিষয়ক জ্ঞান লাভ করেন ও নিষ্কাম কর্ম করেন তারা উত্তরায়নের পথে (প্রাণের পথে বা জ্ঞানের পথে) গমন করেন। এভাবে তারা মুক্তিলাভ করেন। আর দক্ষিণায়ন হল চন্দ্রলোকের পথ। চন্দ্রলোক অজ্ঞানের লোক। তাই যেসকল মানুষ ইহজীবনে আত্মজ্ঞান লাভের কোনো চেষ্টা না করে শুধু জাগতিক সকাম কর্ম করে স্বর্গলাভ করতে চান তারা দক্ষিণায়নের পথে (রয়ির পথে বা অজ্ঞানতার পথে) গমন করে। পুণ্যফল ভোগ করে তারা আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন।
এই পয়েন্টেই আমরা আমাদের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছি, কিন্তু সৃষ্টির পরবর্তী ক্রমগুলো দেখলে আমাদের উত্তর আরো পরিষ্কার হবে।

➡️সৃষ্টির ক্রমানুসারে বৎসরব্যাপী প্রজাপতি মাসরূপে বিবর্তিত হন। কাজেই এই মাসও দ্বন্দ্বাত্মক বা বিপরীতাত্মক লক্ষণযুক্ত। এখানে প্রাণ ও রয়ির স্বরূপ কি? এক মাসে দুটি পক্ষ- শুক্লপক্ষ আর কৃষ্ণপক্ষ। এখানে শুক্লপক্ষই প্রাণরূপ আদিত্য আর কৃষ্ণপক্ষই রয়ি। শুক্লপক্ষ জ্ঞানের পথ, তাই প্রাণদর্শী পুরুষ যেসব কর্ম করেন তা শুক্লপক্ষে করেন অর্থাৎ জ্ঞানের সাথে নিষ্কামরূপে সম্পাদন করেন। তারা শুক্লপক্ষে বা কৃষ্ণপক্ষে যখনই যজ্ঞ/কর্ম করুক না কেন, তা শুক্লপক্ষে সম্পন্ন হয় (অর্থাৎ জ্ঞানের সাথে নিষ্কামভাবে সম্পন্ন হয়)। এভাবে তারা মুক্তি লাভ করেন।
আর যারা অজ্ঞানী তারা যখনই কর্ম করুক না যেন তা কৃষ্ণপক্ষে সম্পন্ন হয় অর্থাৎ তারা জাগতিক সকামকর্মে লিপ্ত হয়। এভাবে তারা জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হয়।

➡️সৃষ্টির ক্রমানুসারে মাসরূপী ঈশ্বর অহোরাত্রি/দিনরাত্রিতে নিজেকে প্রকাশ করেন। এই দিনরাত্রিও প্রজাপতি এবং এটাও দ্বন্দ্বাত্মক। এই দ্বন্দ্ব বা বৈপরীত্য কি? দিনই প্রাণ এবং রাত্রিই রয়ি। ব্যাখ্যা পূর্ববৎ।

➡️ সৃষ্টির ক্রমানুসারে সূর্য, চন্দ্র, বৎসর, মাস, দিনরাত্রির ক্রিয়া দ্বারা অন্ন উৎপন্ন হয়। এই অন্নও প্রজাপতি। এই অন্ন থেকেই সৃষ্টির ক্রমানুসারে শুক্র উৎপন্ন হয়। শুক্রও প্রজাপতি সুতরাং দ্বন্দ্বাত্মক (পুরুষশুক্র হল প্রাণ, স্ত্রীশুক্র হল রয়ি)। এই শুক্র থেকেই ক্রমে প্রাণীসমূহ উৎপন্ন হয়।

ঋষি পিপ্পলাদ এভাবে তার শিষ্যের প্রশ্নের উত্তর দিলেন (কিভাবে প্রাণীসমূহ সৃষ্টি হয়) এবং আমরাও আমাদের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম (উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়ন কি)।

🔹একবার সারমর্মটা উপলন্ধি করা যাক। সূর্য, দিন, শুক্লপক্ষ, উত্তরায়ণ সকলে একই অর্থবাচক— জ্ঞানের পথ, নিষ্কাম কর্মের পথ। আত্মদর্শী ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তি মাত্রই এই পথে গিয়ে ব্রহ্মকে লাভ করবেন। তাই গীতায় বলা হয়েছে " ব্রহ্মবিৎ পুরুষগণ অগ্নি, জ্যোতি, দিন, শুক্লপক্ষে এবং উত্তরায়ণের ছয়মাস এই পথে গমন করে ব্রহ্মকে লাভ করেন।"

🔹আর চন্দ্র, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ, দক্ষিণায়ন সকলে একই অর্থজ্ঞাপক— অজ্ঞানতার পথ, জাগতিক সকাম কর্মের পথ। অজ্ঞানীরা এই পথে গমন করে বারবার জন্মমৃত্যুর পথে আবৃত হয়। তাই গীতায় বলা হয়েছে "ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ, দক্ষিণায়নের ছয় মাস এই পথে গমন করে সাধারণ সাধকগণ চন্দ্রজ্যোতি প্রাপ্ত হয়ে পুনরাবর্তন করেন।"

🔅গীতা বরাবরই আমাদেরকে নিষ্কাম বৈদিক কর্মের উপদেশ প্রদান করে। আমাদের কর্মই আমাদের গতিনির্ধায়ক। মৃত্যুর জন্য ভালো দিন মন্দ দিন বলে কিছু নেই। সৎভাবে ঈশ্বরের প্রদর্শিত পথে কর্ম করলে ইহজীবনে জীবন্মুক্তি এবং মৃত্যুর পর চিরমুক্তি লাভ হবে।


তথ্যসূত্র:
১. উপনিষদ সমগ্র, অতুল চন্দ্র সেন অনুদিত।
২. ঋগ্বেদ ভাষ্য, ড. তুলসিরাম শর্মা।
৩. শ্রীগীতা, জগদীশ চন্দ্র ঘোষ।
৪. Prasna Upanishad, Swami Sharvanand, R.K Math.