https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

বেদ এবং ঋষি-মুনিগণের‌ পরম্পরা

Friday, May 6, 2022

 


বেদ পরমপিতা‌ পরমাত্মার‌ জ্ঞান । বেদ কোনো মনুষ্যকৃত নহে, সর্বদা‌ অপৌরুষেয় । নিত্য‌ প্রভুর‌ নিত্য‌ প্রকাশ ( জ্ঞান ) ।
বেদ বলেছে –
তস্মাদ্যজ্ঞাতসর্বহুত‌ ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে‌ ।
ছন্দাঁসি জজ্ঞিরে‌ তস্মাদ্যজুস্তস্মাদজায়ত ।।
( যজু: ৩১/৭ )
সেই সর্বপূজ্য‌, সর্বোপাস্য‌, পূর্ণ‌ ব্রহ্ম পরমেশ্বর‌ হতে‌ ঋগ্বেদ‌, যজুর্বেদ‌, সামবেদ‌ এবং অথর্ববেদ উৎপন্ন হয়েছে‌ ; অর্থাৎ, সেই পরমেশ্বর‌ই বেদের‌ প্রকাশ‌ করেছেন । এখানে‌ লক্ষ্যণীয় যে‌, ঋগ্‌-য়জুঃ-সাম‌ এই তিন‌ বেদে ছন্দ‌ বিদ্যমান, তাহলে মন্ত্রে প্রযুক্ত " ছন্দাংসি‌ " শব্দের অভিপ্রায় কি ? " ব্যর্থ‌ সজ্ঞাপয়তি " এই নিয়মে‌ " অথর্ব " এর গ্রহণ জ্ঞাপক দ্বারা‌ প্রকাশ হয়, এমনটা নির্দেশ করে ।
য়স্মাদৃচো‌ অপাতক্ষন্যজুর্য়স্মাদপাকষন্ ।
সামানি‌ য়স্য‌ লোমান্যথর্বাঙ্গিরসো‌ মুখং‌ স্কম্ভং‌ তং‌ ব্রুহি অতমঃ স্বিদেব‌ সঃ ।।
( অথর্ব. ১০/৭/২০ )
যে সর্বশক্তিমান জগদীশ্বর থেকে ঋগ্বেদের উৎপন্ন হয়েছে, যে পরব্রহ্ম থেকে যজুর্বেদের প্রাদুর্ভূত হয়েছ, সামবেদ যাঁর লোম-স্বরূপ এবং অথর্ববেদ যাঁর মুখ-স্বরূপ, অর্থাৎ যাঁর থেকে সামবেদ ও অথর্ববেদ প্রকাশিত হয়েছে । 
 

  • সেই ব্রহ্মের স্বরূপ কেমন ? 

 
" বৃহস্পতে‌ প্রথমং‌ বাচো‌ অগ্রম্‌ " ( ঋগ্বেদ‌. ১০/৭১/১ ) বেদবাণী‌ই সৃষ্টির‌ সর্বপ্রথম বাণী । সংসারের‌ সমস্ত পদার্থের‌ নাম‌কর্মাদি‌র বোধ‌ বেদ জ্ঞান দ্বারাই হয়ে থাকে । তা শ্রেষ্ঠ সর্বোৎকৃষ্ট । সবার‌ জন্য সমান‌ পরিশ্রম‌-সাধ্য‌ এবং প্রভুর‌ প্রেরণা দ্বারা‌ ঋষিগণের‌ হৃদয়ে‌ নিহিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে । উক্ত‌ সূক্তের‌ তৃতীয় মন্ত্রে উল্লেখিত " য়জ্ঞেন‌ বাচঃ পদবীয়মায়ন্ " পদ দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছে‌, বেদ‌ জ্ঞান সর্বপ্রথম ঋষিগণের হৃদয়ে প্রবিষ্ট হয়েছে, এরপর পরবর্তীতে সাধারণ মনুষ্য‌ তা‌ প্রাপ্ত করে । এই প্রকরণে‌ উপকৃত দুটি মন্ত্র‌ অতীব স্পষ্ট ভাবে বেদে‌ই বেদ স্বরূপ সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা করছে । এই দুটি মন্ত্র দ্বারা স্পষ্ট নির্দেশ করছে যে‌, বেদ জ্ঞানের প্রকাশ তথা বাণী‌র প্রকাশ সেই পরম পিতা পরমেশ্বর হতে হয়েছে । চার বেদের‌ই বিভাগ জগদীশ্বর কর্তৃক হয়েছে তথা‌ এই জ্ঞান ঋষিগণ‌ দ্বারা‌‌ই সাধারণ মনুষ্য‌দের হৃদয়ে বোধগম্য হয়েছে । উক্ত‌ মন্ত্রে " অনু‌-অবিন্দন্‌ " পদ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য । " ঋষিষু প্রবিষ্টাম্‌ " পদ দ্বারা‌ স্পষ্ট বুঝায় যে‌, এই ( বেদ ) জ্ঞান ঋষিগণের‌ হৃদয়ে প্রবিষ্ট হ‌ওয়া জ্ঞান বা বাণী ; ঋষিগণের স্বরচিত জ্ঞান‌ বা বাণী কদাপি নয় ।
 
তস্মৈ‌ নূনমভিদ্যবে‌ বাচা বিরূপ নিত্যয়া । বৃষ্ণে চোদস্ব‌ সুষ্টুতিম্ ।।
( ঋগ্বেদ: ৮/৭৫/৬ )
এই মন্ত্রে‌ উল্লেখিত‌ " বাচা‌ বারূপনিত্যয়া‌ " পদ‌ দ্বারা‌ বেদবাণীকে‌ নিত্য‌ বলা হয়েছে । সায়ণ‌ও এ‌ই পদের‌ এমন‌ই অর্থ‌ করেছে — " নিত্যয়া উৎপত্তিরহিতয়া‌ বাচা‌ মন্ত্ররূপয়া‌ সুষ্টুর্তি নূনমিদানীং‌ চোদস্ব স্তুহি " অর্থাৎ, হে‌ মহর্ষে‌ ! উৎপত্তিরহিত মন্ত্ররূপ বেদবাণী দ্বারা স্তুতি করো ।
 
বেদ‌ এর প্রমাণ‌ দর্শানোর‌ পর‌ এখন দর্শানো প্রযোজ্য‌ যে‌, বৈদিক পরম্পরা‌য়‌ ঋষি-মুনিগণের‌ দৃষ্টিতে বেদের‌ স্বরূপ সম্বন্ধে —

শতপথ‌ তথা‌ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ

শতপথ‌ ব্রাহ্মণে‌ যাজ্ঞবল্ক্য‌-মৈত্রেয়ী সংবাদে‌ বর্ণন হয়েছে —
 
ক‌. এবম্‌ বা অরেऽস্য‌ মহতো‌ ভূতস্য নিঃশ্বসিতভেতদ্‌ য়দ্‌ ঋগ্বেদো য়জুর্বেদঃ সামবেদোऽথর্বাঙ্গিরসঃ ।।
( শতপথ ব্রাহ্মণ. ১৪/৫/৪/১০ )
অর্থাৎ, হে মৈত্রেয়ি‌ ! সেই মহান পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর‌ হতে চার‌ বেদ নিঃশ্বাস স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে ।
 
শতপথে আর‌ও বর্ণনা করা হয়েছে –
অগ্নেঋর্গ্বেদো‌ বায়োর্য়জুর্বেদঃ সূর্য়াৎ‌ সামবেদঃ । ( শতপথ ব্রাহ্মণ‌. ১১/৫/৮/৩ )
অর্থাৎ, ( পরমাত্মার‌ প্রেরণা‌ দ্বারা‌ ) অগ্নি‌ থেকে ঋগ্বেদ‌, বায়ু থেকে যজুর্বেদ‌ এবং সূর্য‌ থেকে সামবেদের‌ প্রকট‌ হয়েছে ।
 
খ‌. এরূপ বর্ণন ঐতরেয়‌ ব্রাহ্মণের ২৫/৭ নং‌ শ্লোকে‌ও বিদ্যমান ।
" ঋগ্বেদ‌ এবাগ্নেরজায়ত‌, য়জুর্বেদো‌ বায়োঃ, সামবেদ‌ আদিত্যাৎ‌ "

নিরুক্তকার মহর্ষি যাস্ক

ক. পুরুষবিদ্যাऽনিত্যত্বাৎ‌ কর্মসম্পত্তির্মন্ত্রো বেদে‌ । ( নিরুক্ত‌. ১/২ )
পুরুষ কৃত বিদ্যা অনিত্য‌ হ‌ওয়ার‌ দরুণ‌ বেদ‌ই সম্পূর্ণ কর্মের‌ বোধক ।
খ‌. নিয়তবাচো‌ য়ুক্তয়ো‌ নিয়তানুপূর্ব্যা ভবন্তি ( নিরুক্ত. ১/১৬ )
বেদবাণী‌ নিত্য‌ তথা তাঁর আনুপূর্বী‌ও নিত‌্য‌ ।

পাণিনি‌ তথা পতঞ্জলি

বৈদিক পরম্পরার ইতিহাসে এই দুইজন আচার্য অত্যন্ত মহত্ত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করছেন । এই দুইজন‌ আচার্য‌ও বেদ‌কে নিত্য‌ মেনেছেন ।
 
পাণিনি মুনি‌ " ছন্দোব্রাহ্মণানি‌ চ‌ তদ্‌বিষয়াণি " ( অষ্টাধ্যায়ী‌. ৪/২/৬৬ ) সূত্রসহ আরো‌ বিভিন্ন সূত্রে‌ ব্রাহ্মণ শাস্ত্র বেদ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন‌ শাস্ত্র‌ হিসেবে উল্লেখ করেছেন । " কৃতে‌ গ্রন্থে‌ " ( অষ্টাধ্যায়ী‌. ৪/৩/১১৬ ) এবং " তেন প্রোক্তম্‌ " ( অষ্টাধ্যায়ী‌. ৪/৩/১০১ ) এই দুইটি সূত্রে‌ কৃতি‌ এবং প্রবচন‌ এর ভেদ‌ দর্শিয়েছেন ।
 
" তেন প্রোক্তম‌ " সূত্রে‌ ভাষ্যকার‌ পতঞ্জলি মুনি বর্ণনা করেছেন –
 
‌য়া‌ ত্বসৌ‌ বর্ণানুপূর্বী সা‌ऽনিত্যা । তদ্‌ভেদাচ্চৈতদ্‌ ভবতি‌ কাঠকং‌ কালাপকং‌ মৌদকং‌ পৈপ্পলাদকমিতি‌ । ( অষ্টাধ্যায়ী. ৪/৩/১০১ ভাষ্য‌ )
 
এখানে‌ কঠ-কলাপ-পৈপ্পলাদাদি‌ শাখা‌ গ্রন্থের‌ আনুপূর্বীকে মহাভাষ্যকার‌ অনিত্য‌ মেনেছেন‌ । এদিকে বেদের‌ আনুপূর্বী নিত্য‌ মেনেছেন —
 
" স্বরো‌ নিয়ত‌ আম্নায়েऽস্যবামশব্দস্য‌ ।
বর্ণানুপূর্বী খল্বপ্যাম্নায়ে‌ নিয়তাস্যবামশব্দস্য‌ ।। ( মহাভাষ্য‌. ৫/২/৫৯ )
আম্নায় অর্থাৎ বেদ এর আনুপূর্বী তথা‌ স্বর সর্বদা নিত্য‌, বেদের স্বরূপ সম্বন্ধে‌ পাণিনি‌ এবং পতঞ্জলির‌ মত‌ এটাই ।
 
 বৈদিক পরম্পরার‌ এই দুই মহান আচার্যের‌ সিদ্ধান্ত দ্বারা‌ বেদের‌ নিত্যতা‌ দেদীপ্যমান সূর্যের ন্যায় পুষ্ট হয় ।

মানবধর্মশাস্ত্র

বেদ বিষয়ে মহর্ষি মনুর‌ সিদ্ধান্ত —
 
পিতৃদেব-মনুষ্যাণাং বেদশ্চক্ষুঃ সনাতনম্। অশক্যঞ্চাপ্রমেয়ঞ্চ বেদশাস্ত্রমিতি স্থিতিঃ।।
( মনু: ১২/৯৪ )
অনুবাদঃ পিতর, (দেব) দিব্যগুণ সম্পন্ন বিদ্বান ও মনুষ্যদের বেদ সনাতন চক্ষুস্বরূপ এবং বেদ অশক্য অর্থাৎ যাকে কোনো পুরুষ তৈরি করতে পারে না তথা অপৌরুষেয় আর বেদ অনন্ত সত্যবিদ্যার সহিত যুক্ত, এটি নিশ্চিত সিদ্ধান্ত ।
 
চাতুর্বণ্যং ত্রয়ো লোকাশ্চত্বারশ্চশ্রমাঃ পৃথক্। ভূতং ভব্যং ভবিষ্যং চ সর্ব বেদাৎপ্রসিধ্যতি।।
( মনু: ১২/৯৭ )
অনুবাদঃ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চার বর্ণ ও এদের ব্যবস্থা, পৃথ্বী, আকাশ এবং দ্যুলোক অর্থাৎ সমস্ত ভূ-মন্ডলের লোক, গ্রহ আদি, ব্রহ্মচর্য, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস এই চার আশ্রমের পৃথক, পৃথক বিধান আর ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান সব কালের বিদ্যা এই সমস্ত কিছু বেদ থেকেই প্রসিদ্ধ, প্রকট ও জ্ঞাত হয় অর্থাৎ এই সমস্ত ব্যবস্থাসমূহের ও বিদ্যার জ্ঞান প্রকৃতভাবে বেদের দ্বারাই হয়।
 
বিভর্তি সর্বভূতানি বেদশাস্ত্রং সনাতনম্। তস্মাদেতৎ পরং মন্যে যজ্জন্তোরস্য সাধনম্।।
( মনু: ১২/৯৯ )
অনুবাদঃ নিত্য বেদশাস্ত্র সকল প্রাণীদের জ্ঞান-বিদ্যা দান দ্বারা ধারণ-পোষণ করে। আর এটি মনুষ্যমাত্রের জন্য সুখ, উন্নতি, পুরুষার্থ আদির প্রাপ্তির সাধন। এর জন্য আমি বেদশাস্ত্রকে সর্বোত্তম মানি।
 
" ধর্ম জিজ্ঞাসামানানাং‌ প্রমাণং পরমং‌ শ্রুতিঃ " ( মনু: ২/১৩ ) এই শ্লোকেও বেদকেই পরম প্রমাণ মেনেছেন মহর্ষি মনু ।
 
সেনাপত্যং চ রাজ্যং চ দন্ডনেতৃত্বমেব চ। সর্বলোকাধিপত্যং চ বেদাশাস্ত্রবিদর্হতি।।
( মনু: ১২/১০০ )
অনুবাদঃ সেনা প্রবন্ধের কার্য এবং রাজ্যের প্রশাসনিক কার্য এবং দন্ডব্যবস্থা অর্থাৎ ন্যায়ব্যবস্থার কার্য আর প্রজাসকলের অধিপতি অর্থাৎ রাজা হবার কার্য, প্রভৃতি বিষয় সকলের, বেদশাস্ত্রের জ্ঞাতাই উত্তমভাবে করতে সমর্থ ও যোগ্য।
 
স সর্বোঽভিহিতো বেদে সর্বজ্ঞানময়ো হি সঃ । ( মনু: ২/৭ )
বেদে‌ সমস্ত ধর্ম অর্থাৎ, নিয়মের‌ প্রতিপাদন করা হয়েছে, কেননা, বেদ সর্বজ্ঞানের‌ স্রোত‌ । সমস্ত বিদ্যা এবং বিজ্ঞান বেদে বিদ্যমান ।
 
উৎপদ্যন্তে চ্যবন্তে চ যান্যতোঽন্যানি কানি চিৎ ।তান্যর্বাক্কালিকতয়া নিষ্ফলান্যনৃতানি চ ॥
( মনু: ১২/৯৬ )
অনুবাদঃ অতএব বেদের মান্যতা থেকে ভিন্ন অথবা বেদের প্রতিকূলে যেসব স্মৃতিশাস্ত্র রয়েছে অর্থাৎ ধর্মীয় নিয়ম রয়েছে অথবা ভবিষ্যতে হবে সেসব কালক্রমে উৎপন্ন হবে এবং নষ্টও হয়ে যাবে, সেসব শাস্ত্র ও নিয়মের মানত্যা নিষ্ফল ও মিথ্যা ।
 
বেদ‌ বিষয়ে কতোটা গম্ভীর মহত্ত্বপূর্ণ চিন্তাভাবনা মহর্ষি মনুর‌ বিদ্যমান ছিলো তার কিয়দংশ উপরোক্ত শ্লোক গুলো দ্বারা দর্শানো হয়েছে ।
 
বেদ‌ কার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সে বিষয়ে স্পষ্ট বর্ণনা করেছেন মহর্ষি মনু –
 
অগ্নিবায়ুরবিভ্যস্তু ত্রয়ং ব্রহ্ম সনাতনম্। দুদোহ যজ্ঞসিদ্ধ্যর্থমৃগ্যজুঃ সামলক্ষণম্।।
( মনু: ১/২৩ )
অনুবাদঃ সেই পূজনীয় পরমাত্মা জগতে সকল ধর্ম, অর্থ,কাম ও মোক্ষ প্রভৃতি পুরুষার্থ সিদ্ধির জন্য অথবা জগতের সিদ্ধি অর্থাৎ জগতের সকল প্রকারের জ্ঞানের জন্য অগ্নি, বায়ু ও রবি নামক ঋষিদের মাধ্যমে ক্রমশঃ ঋগ্= জ্ঞান, যজুঃ= কর্ম, সাম= উপাসনা রূপ ত্রিবিধ জ্ঞানযুক্ত ঋগ্বেদ, যর্জুবেদ, সামবেদ নামক নিত্য বেদ সমূহের দোহন করে প্রকট করেন।
 
এই শ্লোকের‌ কুল্লূকভট্টকৃত টীকা
 
" বেদাপৌরুষেয়ত্বপক্ষ‌ এব মনোরভিমতঃ । পূর্বকল্পে‌ য়ে‌ বেদাস্ত এব পরমাত্মমূর্ত্তের্ব্রহ্মণঃ সর্বজ্ঞস্য‌ স্মৃত্যারূঢাঃ । তানেব‌ কল্পাদৌ‌ অগ্নিবায়ুরবিভ্য‌ আচকর্ষ…. "
অর্থাৎ, মহর্ষি মনু বেদকে অপৌরুষেয় মানতেন । উহা‌ পূর্বকল্পে‌ যেরূপ বিদ্যমান‌ ছিলো, বর্তমানেও সেরূপ বিদ্যমান ।

মহাভারত

অনাদিনিধনা‌ নিত্যা‌ বাগুতসৃষ্টা স্বয়ম্ভুবা ।
আদৌ‌‌ বেদময়ো‌ দিব্যা য়তঃ সর্বাঃ প্রবৃত্তয়ঃ ।।
( মহাভারত: শান্তিপর্ব: অধ্যায়: ২৩২ )
সৃষ্টির‌ প্রারম্ভে‌ স্বয়ম্ভু পরমাত্মা থেকে যে‌ বাণীর‌ ( বেদ‌ ) প্রকাশ হয়েছে, যার‌ আদি‌ বা অন্ত‌ নেই, যা‌ নিত্য‌ তথা যার‌ কোনো নাশ‌ হয় না ; যা দিব্য‌, তা‌ দ্বারাই সমগ্র সংসারের প্রবৃত্তিসমূহ চলে । উক্ত শ্লোকে উল্লেখিত " অনাদিনিধনা‌ " পদ‌ দ্বারা‌ অক্রমারূঢ় জ্ঞান জ্ঞান নির্দেশ করছে ।
বৈদিক পরম্পরা‌য়‌ দর্শনকার ঋষিগণের দৃষ্টিতে বেদের‌ স্বরূপ —

বৈশেষিক দর্শন

ক. তদ্বচনাদাম্নায়স্য‌ প্রামাণ্যম্‌ ।।
( বৈ. দর্শন‌. ১/১/৩ )
বেদ ঈশ্বরোক্ত‌ বচন‌ হ‌ওয়ায় তাঁর প্রামাণিকতা সিদ্ধ ।
 
বেদ ঈশ্বরকৃত‌, বেদে সত্য‌বিদ্যা‌ এবং পক্ষপাতরহিত‌ ধর্মের‌ সত্য‌ স্বরূপ সম্বন্ধে প্রতিপাদন করা হয়েছে । চার বে‌দ‌ই নিত্য‌, সমগ্র‌ মনুষ্যজাতির এটাই 
মানা উচিত, কেননা ঈশ্বর‌ নিত্য‌, তাঁর বচন‌ও ( বিদ্যা ) নিত্য‌ হ‌ওয়ায়‌ তা প্রমাণ্য ; যা‌ কণাদমুনির‌ মত ।
উদয়নাচার্য‌ও এই সূত্রে উল্লেখিত " তৎ‌ " শব্দ দ্বারা ঈশ্বর পক্ষে বর্ণনা করেছেন যে‌, বেদ‌ ঈশ্বরোক্ত‌ হ‌ওয়ার দরুণ তা প্রমাণ, এ কারণে‌ বেদপ্রমাণক‌ ধর্ম নিরুপণের প্রতিজ্ঞা করায় কোনো দোষ নেই ।
 
খ‌. বৈশেষিক‌ দর্শনের টীকাকার‌ শঙ্কর মিশ্র‌ তাঁর স্বরচিত‌ উপস্কারে‌ বর্ণনা করেছেন —
 
" তদ্বচনাদিতি । তদিত্যনুপক্রান্তমপি‌ প্রসিদ্ধিসিদ্ধতয়েশ্বরম্ পরামৃশতি, য়থা‌ " তদপ্রামাণ্যমনৃতব্যাধাতপুনরুক্তদোষেভ্যঃ " ( ন্যায়. ২/১/৫৬ ) ইতি‌ গৌতমীয়সূত্রে‌ তচ্ছব্দেনানুপক্রান্তোऽপি বেদঃ পরখমৃশ্যতে । তথা চ‌ তদ্‌বচনাৎ‌ তেনে‌শ্বরেণ‌ প্রণয়ানাদাম্নায়স্য‌ বেদস্য‌ প্রামাণ্যম্‌ " ।।
( বৈশেষিক‌ দর্শন‌. ১/১/৩. উপস্কার )
অর্থাৎ, বৈশেষিক এর এই সূত্রের‌ " তদ্‌ " পদ দ্বারা ঈশ্বরের গ্রহণ হয় । ঈশ্বরের বচন হ‌ওয়ার দরূণ বেদ স্বতঃপ্রমাণ ।
 
গ. উদয়নাচার্যকৃত কিরণাবলী‌তে‌ উদ্ধৃত‌ " তদ্‌বচনাদাম্নায়স্য‌ প্রামাণ্যম্‌ " সূত্রের‌ বিষয়ে‌ " কিরণাবলীপ্রকাশে‌ " বর্ণনা করেছেন‌ – " তদ্‌বচনাদিতি । তেনেশ্বরেণ‌ বচনাৎ‌ প্রণয়নাদাম্নায়স্য‌ প্রামাণ্যমিত্যর্থঃ ।
অর্থাৎ, তদ্বচন‌ = ঈশ্বরের‌ বচন‌ বা‌ কৃতি‌ হ‌ওয়ার‌ দরুণ‌ বেদ প্রামাণ্য‌ ।
 
ঘ‌. প্রশস্তপাদভাষ্যের‌ ব্যাখ্যায়‌ কিরণাবলী‌তে উদয়নাচার্য‌ বর্ণনা করেছেন —
" অবিচ্ছেদে‌ তদ্বচনাদাম্নায়স্য‌ প্রামাণ্যমিতি ব্যাকুপ্যেৎ । লোকসন্তত্যবিচ্ছেদে‌ বেদসম্প্রদায়স্যখপ্যবিচ্ছেদাৎ । "
অর্থাৎ, যদি‌ সৃষ্টির‌ আরম্ভের মান্যতা না দেওয়া হয় তাহলে‌ কণাদ মুনির‌ বচন‌, " বেদ প্রামাণ‌্য‌ কারণ‌ তা ঈশ্বরোক্ত বচন " এই উক্তি‌ যুক্তিসঙ্গত হয় না । কেননা, যদি সৃষ্টির আরম্ভ‌ এবং অন্ত না হয় তাহলে বেদের‌ও আরম্ভ‌ এবং অন্ত হবে না । অতঃ সূত্রকারের মতানুযায়ী‌ সৃষ্টির আরম্ভ বিদ্যমান এবং সৃষ্টির প্রারম্ভে‌ ঋষিগণের‌ হৃদয়ে ঈশ্বর বেদ জ্ঞান প্রদান করেছেন ।

ন্যায় দর্শন

মন্ত্রায়ুর্বেদপ্রামাণ্যবচ্চ‌ তৎপ্রামাণ্যমাপ্তপ্রামাণ্যাৎ ।।
( ন্যায় দর্শন. ২/১/৬৭ )
মহর্ষি গৌতম বর্ণন করেছেন – আপ্তগণ দ্বারা সদা প্রামাণ্য‌ স্বীকার করার দরূণ‌ বেদের‌ প্রামাণ্য‌ মানা আবশ্যক‌ । যেমন, মন্ত্র‌ এবং আয়ুর্বেদ‌ এর প্রমাণত্ব স্বীকার করাই‌ উচিত ।
 
ন্যায় ভাষ্যকার বর্ণনা করেছেন – " য়‌ এবাপ্তা‌ বেদার্থানাং দ্রষ্টারঃ প্রবক্তারশ্চ‌ ত এবায়ুর্বেদপ্রভৃতীনাম্‌ । ( ন্যায় ভাষ্য‌. ২/১/৬৭ )
অর্থাৎ, আপ্তগণ ( ঋষি‌ ) বেদের প্রবক্তা‌ ( প্রবচনকর্তা ) তথা দ্রষ্টা‌ । কর্ত্তা নয় ।
 
আর‌ও বর্ণনা করেন – " মন্বন্তরয়ুগান্তরেষু‌ চাতীতানাগতেষু‌ সম্প্রদায়াভ্যাসপ্রয়োগাবিচ্ছেদো‌ বেদানাং নিত্যত্বম্‌ । আপ্তপ্রামাণ্যাচ্চ‌ প্রামাণ্যং‌ লৌকিকেষু‌ শব্দেষু‌ চৈতৎ‌ সমানমিতি‌ । "
অতীত‌ বা অনাগত‌ মন্বন্তর‌ বা যুগ‌-যুগান্তরে বেদ জ্ঞান অবিচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হচ্ছে, অতঃ বেদ জ্ঞান নিত্য‌ ।

সাংখ্য‌ দর্শন

সাংখ্য‌ শাস্ত্রের‌ ৫ম অধ্যায়ে‌ বেদের‌ নিত্যত্ব‌ তথা অপৌরুষেয়ত্ব‌ বিষয়ে একটি সূত্রে বর্ণনা করা হয়েছে —
 
ন নিত্যত্বৎ বেদানাং কাৰ্য্যত্বশ্রুতেঃ।।
( সাংখ্য‌. ৫/৪৫ )
( পূর্ব পক্ষ‌) বেদে দেখিতে পাওয়া যায় ঋগ্বেদাদি চারিবেদ উৎপন্ন হইয়াছে বেদের উৎপত্তি দেখা যাইতেছে সে কারণে বেদ কার্য্যরূপ বলিয়া তাহা অনিত্য ও মনুষ্যকৃত মানাই উচিত।
 
পূর্বপক্ষ খণ্ডনে পরবর্তী সূত্রে বর্ণনা হয়েছে –
ন পৌরুষেয়ত্বং তৎকর্ত্তুঃ পুরুষস্যাভাবাৎ
( সাংখ্য‌. ৫/৪৬ )
বেদের কর্ত্তা কোন মনুষ্য নহে। বেদ ঈশ্বরীয় অভ্রান্ত জ্ঞান।
 
জীবের জ্ঞান অভ্রান্ত নহে বলিয়া জীবে বেদপ্রণয়ন শক্তির অভাবই দেখিতে পাওয়া যায়।
 
এক‌ই বর্ণনা বৌদ্ধমত বিধ্বংসক কুমারিল ভট্ট তাঁর স্বরচিত মীমাংসা ভাষ্যের‌ ব্যাখ্যায় করেছেন —
" কর্ত্তুঃ স্মরণাভাবাদপৌরুষেয়া বেদা‌ ইতি‌ । ( তন্ত্রবার্তিক )
যদি এমনটা দাবি করা হয় যে‌, মুক্ত পুরুষ দ্বারা রচিত হয়েছে সেটা‌ও যুক্তিসঙ্গত নহে ।
 
মুক্তামুক্তয়োরযোগ্যত্ত্বাৎ ।। ( সাংখ্য. ৫/৪৭ )
বদ্ধ ও মুক্ত কোন পুরুষেরই বেদ প্রণয়নের যোগ্যতা দেখা যায় না বলিয়া বেদ কোন মনুষ্যকৃত হইতে পারে না। মুক্ত পুরুষ সূক্ষ্ম শরীর লইয়া মুক্তাবস্থায় ব্রহ্মানন্দে অবস্থান করে, গোলকের অভাবে বাক্যের দ্বারা কিংবা লেখনীর দ্বারা কোন প্রকারেই বেদ প্রণয়ন করিতে পারে না এবং বদ্ধ জীব অজ্ঞ বলিয়া অভ্রান্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার বেদের কর্ত্তা হইতে পারে না। সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান ও স্বয়ংসিদ্ধ বলিয়া ঈশ্বরই বেদের কর্তা।
 
নিজশক্ত্যভিব্যক্তেঃ স্বতঃ প্রামাণ্যম্ ।।
( সাংখ্য‌. ৫/৫১ )
ঈশ্বরের স্বাভাবিক শক্তি বেদরূপে প্রকাশিত বলিয়া বেদ স্বতঃপ্রমাণ। ঈশ্বর জ্ঞানস্বরূপ বলিয়া তিনিই বেদরূপে প্রকাশিত। ব্রহ্মই বেদ। এই কারণ বেদ স্বতঃপ্রমাণ অর্থাৎ উহার প্রমাণের জন্য কোন প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না ৷ সূর্য যেমন সমস্ত পদার্থকে প্রকাশ করিয়া স্বয়ং প্রকাশিত হইয়া আছে তদ্রুপ বেদ জ্ঞানস্বরূপ বলিয়া স্বতঃ প্রকাশমান্ এবং সমস্ত বিদ্যার কারণ ও ভাণ্ডার

যোগ‌ দর্শন

ক্লেশকর্মবিপাকাশয়ৈরপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ।। ( যোগ‌. ১/২৪ )
শব্দার্থ – (ক্লেশ-কর্ম-বিপাক-আশয়ৈঃ) অবিদ্যা ইত্যাদি পাঁচটি ক্লেশ, শুভ-অশুভ এবং মিশ্রিত কর্ম, সুখ-দুঃখ রূপী ফল, সুখ-দুঃখ ভোগের সংস্কার; এই সকল হতে (অপরামৃষ্টঃ) সম্বন্ধ রহিত (পুরুষবিশেষঃ) জীব হতে ভিন্ন স্বভাব যুক্ত চেতন বিশেষ (ঈশ্বরঃ) ঈশ্বর।
 
সূত্রার্থ- অবিদ্যা ইত্যাদি পাঁচটি ক্লেশ, শুভ-অশুভ এবং মিশ্রিত কর্ম, সুখ দুঃখ রূপী ফল, সুখ-দুঃখ ভোগের সংস্কার; এই সকল হতে সম্বন্ধ রহিত এবং জীব হতে ভিন্ন স্বভাব যুক্ত চেতন বিশেষকে ঈশ্বর বলা হয়।
 
 
এই সূত্রের‌ ব্যাসভাষ্য‌ –
 
" তস্য‌ শাস্ত্রং নিমিত্তম্ । শাস্ত্রং‌ পুনঃ কিন্নিমিত্তম্ ? প্রকৃষ্টসত্ত্বনিমিত্তম্‌ । এতয়োঃ শাস্ত্রোৎকর্ষয়োগরীশ্বরসত্বে‌ বর্ত্তমানয়োরনাদিসম্বন্ধঃ । এতস্মাদেতদ্‌ ভবতি‌ সদৈবেশ্বরঃ সদৈব মুক্ত ইতি " ।
( ব্যাসভাষ্য: ১/২৪ )
সেই উৎকর্ষের নিমিত্ত‌ শাস্ত্র । শাস্ত্রের নিমিত্ত‌ কোনটি ? প্রকৃষ্ট সত্ত্ব অর্থাৎ সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞান শাস্ত্রের নিমিত্ত । ঈশ্বরের জ্ঞান সহিত শাস্ত্রের‌ সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞানের সমন্ধ অনাদি । এ কারণে‌ তিনি সদা‌ ঐশ্বর্যশালী তথা‌ সদৈব‌ মুক্ত‌ ।
 
বাচস্পতি মিশ্রের বর্ণনা‌ও উক্ত বর্ণনার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ –
 
" তথা চাম্যুদয়নিঃশ্রেয়সোপদেশপরোऽপি বেদরাশিরীশ্চরপ্রণীতস্তদ্‌বুদ্ধিসত্ত্বপ্রকষদিব‌ ভবিতুমর্হতি… ততিসদ্ধং‌ প্রকৃষ্টসত্ত্বনিমিত্তং‌ শাস্ত্রমিতি "
লৌকিক এবং পরলৌকিক সুখ সাধনার‌ উপদেশ প্রদানকারী ঈশ্বরের জ্ঞান বেদ‌ও তাঁর থেকে উৎপন্ন হয়েছে । …. এ দ্বারা সিদ্ধ হয় যে‌, বেদের‌ নিমিত্ত ঈশ্বরের‌ সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞান‌ই ।

বেদান্ত দর্শন

শাস্ত্রয়োনিত্বাৎ‌ ।। ( বেদান্ত. ১/১/৩ )
ঋগ্বেদাদি‌ শাস্ত্রের‌ কারণ‌ হ‌ওয়ার‌ দরুণ ব্রহ্ম সর্বজ্ঞ তথা সর্বশক্তিমান ।
 
এই সূত্রের‌ ভাষ্যে‌ শঙ্কর‌ বর্ণনা‌ করে –
 
"মহৎ ঋগ্বেদাদেঃ শাস্ত্রস্যানেকবিদ্যাস্থানোপবৃংহিতস্য প্রদপিবৎ সবথিবিদ্যোতিনঃ সর্বজ্ঞকল্পস্য যোনিঃ কারণঃ ব্রহ্ম। নহীদৃণস্য শাস্ত্রস্যর্গ্বেদাদিলক্ষ্ণস্য সর্বজ্ঞগুণান্বিতস্য সর্বজ্ঞাদন্যতঃ সম্ভবোঽস্তি"।।
বেদান্ত: শঙ্কর ভাষ্য‌: ( ১/১/৩ )
অর্থাৎ, অনেক বিদ্যা‌ দ্বারা‌ পরিপূর্ণ, প্রদীপের সমান‌ সমস্ত পদার্থের‌ প্রকাশকর্ত্তা‌ মহান‌ ঋগ্বেদাদি শাস্ত্রের কারণ‌ একমাত্র ব্রহ্ম‌ই । সর্বজ্ঞ‌ ব্রহ্ম ব্যতীত‌ আর‌ কার‌-ই বা সামর্থ্য রয়েছে এমন শাস্ত্র‌ রচনার ?
 
অত‌ এব‌ চ‌ নিত্যত্বম্‌ ।। ( বেদান্ত. ১/৩/২৯ )
পরমব্রহ্ম‌ পরমেশ্বর‌ হতে‌ বেদ‌ প্রকাশ‌ হ‌ওয়ায়‌ তা‌ নিত্য।
এই সূত্রের শাঙ্কর‌ ভাষ্য‌ –
" য়জ্ঞেন‌ বাচঃ পদবীয়মায়ন্‌ তামন্ববিন্দন্নৃষিষু‌ প্রবিষ্টাম্‌ ( ঋগ্বেদ‌. ১০/৭১/৩ ) ইতি‌ স্থিতামেব‌ বচমনুবিন্নাং‌ দর্শয়তি‌ । বেদব্যাসশ্চৈবমেব‌ স্মরতি‌ –
য়ুগান্তেऽন্তর্হিতান্‌ বেদান্‌ সেতিহাসান্‌ মহর্ষয়ঃ ।
লেভিরে‌ তপসা‌ পূর্বমনুজ্ঞাতাঃ স্বয়ংভুবা ।। ইতি " ( মহাভারত )
অর্থাৎ, নিত্য‌ বেদবাণী‌ যা‌ ঋষিগণের‌ হৃদয়ে প্রবিষ্ট হয়ে প্রকাশিত হয়েছে, তৎপশ্চাৎ সাধারণ মনুষ্যগণ প্রাপ্ত হয়েছে । মহর্ষি ব্যাস‌ও মহাভারতে বর্ণনা করেছেন, বেদ স্বয়ম্ভু পরমাত্মা দ্বারা প্রকাশ হয়েছে ।

মীমাংসা দর্শন

জৈমিনি‌ মুনিও‌ তাঁর মীমাংসা শাস্ত্রের প্রথমাধ্যায়স্থ‌ প্রথম পাদের‌ পঞ্চমাধিকরণে বেদ‌ এর প্রামাণ্য‌ সিদ্ধ করে ষষ্ঠাধিকরণে শব্দের‌ নিত্যতা‌ প্রতিপাদন‌ করার সময় বর্ণনা করেছেন‌ –
 
নিতৃস্তু‌ স্যাদ্‌ দর্শনস্য‌ পরার্থত্বাৎ‌ । ( মীমাংসা. ১/১/১৮ )
এই সূত্রে শব্দের‌ নিত্যতা‌ স্বীকার করা হয়েছে । যখন‌ লৌকিক শব্দ‌ পর্যন্ত নিত্য‌ তখন‌ বৈদিক শব্দ‌ তো নিত্য‌ই হবে ।
 
৮ম অধিকরণের‌ বেদাপৌরুষেয়ত্ব‌ বিষয়ে‌ বর্ণনা করা হয়েছে –
বেদাংশ্চৈকে‌ সন্নিকর্ষ পুরুষাখ্যা‌
( মীমাংসা. ১/১/২৭ )
মহর্ষি জৈমিনি‌ এই সূত্রে পূর্বপক্ষের‌ শঙ্কা উত্থাপিত করেন‌ যে‌, বেদের‌ সহিত‌ পুরুষের‌ সম্বন্ধ‌ অর্থাৎ সমাখ্যা‌‌ ( নাম‌ ) দেখা যায়‌ ( যেমন‌ শাকলাদি‌ ), অতঃ বেদ‌ অনিত্য‌ ।
 
এই শঙ্কার‌ সমাধান‌ করেন‌ —
উক্তং‌ তু‌ শব্দপূর্বত্বাৎ ।
( মীমাংসা. ১/১/২৯ )
এর ব্যাখ্যা পূর্বেই উল্লেখ করা‌ হয়েছে । এখানে‌ সমাখ্যা‌মাত্রের‌ পরিহার‌ করে বর্ণনা‌ করেন –
 
আখ্যা‌ প্রবচনাৎ‌ ।। ( মীমাংসা.১/১/৩০ )
আখ্যা‌ ( সমাখ্যা‌ ) প্রবচনের‌ জন্য‌ হয়েছে । পদপাঠাদি‌র প্রবচন‌ দ্বারা‌ও এর‌ সমাখ্যা‌ পুরুষের‌ সাথে সমন্ধ‌ রয়েছে ।
 
এই বিষয়ে‌ মীমাংসা শাস্ত্রের‌ প্রকাণ্ড আচার্য বৌদ্ধমত বিধ্বংসক কুমারিল ভট্ট‌ও বেদের‌ নিত্যতা স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন ‌ । তিনি মীমাংসা ১/১/২৯ নং সূত্রের‌ ব্যাখ্যায় তন্ত্রবার্তিকে বর্ণনা করেছেন –
 
"সর্বে হি যথৈব গুরুণাধীতং তথবাধিজিগাংসন্তে, ন পুনঃ স্বাতন্ত্র্যেণ কশ্চিদপি প্রথমোऽধ্যেতা বেদানামস্তি, যঃ কর্তা স্যাৎ । তস্মাৎ কর্ত্তৃস্মরণাভাবাদপৌরুষেয়া বেদা ইতি ভাবঃ । এবং চ পূর্বমেব বেদাপৌরুষেয়ত্বস্য সিদ্ধত্বাৎ তদ্বিষয়ে পুনঃ প্রয়ত্নো ন করণীয় ইতি কেবলং সমাখ্যাদ্যবলম্বনেন কৃতস্যাক্ষেপস্য পরিহারো বক্তব্যোऽভিধীয়তে” ।
অর্থাৎ, অধ্যয়ন‌ বিনা‌ বেদ জ্ঞান প্রাপ্ত অসম্ভব । বেদ অপৌরুষেয় । এখানে এটাও বর্ণনা করা হয়েছে যে‌, পূর্বসূত্র‌ " বেদাংশ্চৈকে সন্নিকর্ষ‌ পুরুষাখ্যা‌ " ( মীমাংসা. ১/১/২৭ ) সূত্রে যে‌ পূর্বপক্ষ উত্থাপিত করা হয়েছে, তা কেবল‌ সমাখ্যা‌ ( সংজ্ঞা, শাকলাদি‌ নাম‌ ) নামকেই নির্দেশ করে শঙ্কা করা হয়েছে, এমনটা বুঝতে হবে । কেননা, বেদের অপৌরুষেয়ত্ব প্রথমৈই দর্শানো হয়েছে । এ দ্বারা সিদ্ধ হয় যে‌, কুমারিল ভট্ট‌ও বেদের‌ অপৌরুষেয়ত্ব তথা নিত্যত্ব স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন ।

শাঙ্খ্যায়ন শ্রৌতসূত্র‌ ভাষ্য‌

কথং‌ বেদস্য‌ প্রমাণ্যম্‌ ? অপৌরুষেয়ত্বাৎ‌, অর্থপ্রত্যায়কত্বাৎ‌, বাধকপ্রত্যয়াভাবাৎ‌ ।
( আনর্ত্তীয় ভাষ্য‌ )
এই প্রকারে অন্য‌ শ্রৌতসূত্রের ভাষ্যকারগণ‌‌ও বেদের‌ অপৌরুষেয়‌ত্ব‌ মেনেছেন ।
নিরুক্ত‌ টীকাকার‌ স্কন্দস্বামী‌, দুর্গাচার্য‌ তথা‌ ইতিহাস খ্যাত‌ প্রসিদ্ধ‌ বিদ্বান‌ ভর্তৃহরি‌, উদয়নাচার্য‌, বিজ্ঞানভিক্ষু‌, বাচস্পতিমিশ্রাদি‌ সহ সমস্ত বিদ্বান‌ বেদের‌ অপৌরুষেয়ত্ব‌ স্বীকার তথা নিত্য‌ মেনেছেন । প্রায়ঃ সমস্ত‌ শ্রৌত-গৃহ্য‌ তথা‌ ধর্মসূত্রকার‌গণ এবং এসব শাস্ত্রের টীকাকারগণ‌‌ও বেদের‌ নিত্যতা‌ দর্শিয়েছেন ।