বৈদিক পরম্পরার ঋষি-মুনিগণ, যাঁদের বেদসম্বন্ধী ব্যাখ্যানগ্রন্থ বর্তমানে উপলব্ধ, তাঁরা সকলেই তাঁদের স্ব-ব্যাখ্যান গ্রন্থে বেদার্থের ত্রিবিধ প্রক্রিয়ার বিস্তার উল্লেখ করেছেন । এমনকি অবৈদিক স্কন্দস্বামী, বেঙ্কটমাধব এবং সায়ণ এদের বেদভাষ্যে যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ার আধিক্য থাকার পরও তাদের বেদ ভাষ্যের বিবিধ মন্ত্রে আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার উল্লেখ স্পষ্ট প্রতীয়মান ।
যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ার প্রয়োগ অগ্নিহোত্র থেকে শুরু করে অশ্বমেধ পর্যন্ত যত যজ্ঞরূপ কর্মকাণ্ডে মন্ত্রসমূহ প্রযোজ্য তার সাপেক্ষে করা হয় । প্রাচীন আর্ষ গ্রন্থের মধ্যে বেদের শাখা সমূহে, ব্রাহ্মণগ্রন্থে এবং কল্পসূত্রে বেদার্থের প্রধানরূপ হিসেবে যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ার বর্ণনা বিদ্যমান ।
আধিদৈবিক প্রক্রিয়ার প্রধান বিষয়বস্তু বেদার্থের সৃষ্টি-উৎপত্তি স্থিতি এবং তদ্ভব পদার্থ সমূহের গুণ-ধর্ম-পরক বর্ণন করা তথা দর্শানো । উক্ত বেদার্থ প্রক্রিয়ার সাক্ষাৎ বিধায়ক গ্রন্থ বর্তমানে অনুপলব্ধ । শাখা সমূহে এবং ব্রাহ্মণগ্রন্থে উক্ত প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থ যত্র-তত্র বিদ্যমান । শুধুমাত্র মহর্ষি যাস্ক বিরচিত নিরুক্ত শাস্ত্রেই আধিদৈবিক প্রক্রিয়ানুসারী মন্ত্রার্থ বিস্তারিতভাবে উপলব্ধ ।
আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার প্রধান বিষয়বস্তু শরীর-বিজ্ঞান আত্মবিজ্ঞান এবং পরমাত্মবিষয়ক বর্ণন করা তথা দর্শানো । উক্ত বেদার্থ প্রক্রিয়ার সাক্ষাৎ বিধায়ক গ্রন্থও বর্তমানে অনুপলব্ধ । শাখা সমূহ, ব্রাহ্মণগ্রন্থ এবং উপনিষদে উক্ত প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থ যত্র-তত্র বিদ্যমান । মহর্ষি যাস্ক আধিদৈবিক প্রক্রিয়ানুসারে মন্ত্রার্থ করার সময়ে " ক্বচিৎ আথাধ্যাত্মম্ " উল্লেখ করে আধ্যাত্মপ্রক্রিয়ানুসারী মন্ত্রার্থ দর্শিয়েছেন ।
নিরুক্তের ১৩তম এবং ১৪তম অধ্যায়ে প্রাচীন নৈরুক্তোগণের মতানুসারে " অতিস্তুতি " নামে কয়েকটি মন্ত্রের আধ্যাত্মিক অর্থ সংগৃহীত হয়েছে । যজুর্বেদ এর ভাষ্যকার অবৈদিক উব্বট ৩১তম অধ্যায়ে আচার্য শৌনককৃত আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যান সমূহ উদ্ধৃত করেছেন । পরন্ত উক্ত প্রক্রিয়ানুসারে বেদের সহস্র মন্ত্রের বিস্তার ব্যাখ্যান শুধুমাত্র মহর্ষি দয়ানন্দ জীর বেদভাষ্যেই উপলব্ধ ।
বেদার্থের চতুর্থ প্রক্রিয়া — ব্যাবহারিকার্থ প্রক্রিয়া
যদ্যপি উক্ত প্রক্রিয়ানুসারী মন্ত্রার্থের সংকেত প্রাচীন আর্ষ গ্রন্থের যত্র-তত্র উপলব্ধ, তথাপি উক্ত প্রক্রিয়ানুসারে বেদভাষ্য করার শ্রেয় একমাত্র মহর্ষি দয়ানন্দ জী-ই প্রাপ্ত হয়েছেন ।
মধ্যবর্তী বিদ্বানগণের মতে বেদার্থ
যদ্যপি প্রাচীন বৈদিক পরম্পরা অনুসারে বেদার্থের উক্ত তিন প্রক্রিয়া সর্বমান্য, তথাপি মধ্যকালীন এবং বর্তমানকালীন অবৈদিক তথাকথিত বিদ্বানগণের মতানুসারে বেদ এর প্রাদুর্ভাব শুধুমাত্র যজ্ঞের নিমিত্তেই হয়েছে – বেদাঃ য়জ্ঞার্থ প্রবৃত্তাঃ, অর্থাৎ বেদার্থ এর ক্ষেত্র কর্মকাণ্ড পর্যন্তই সীমিত । অবৈদিক সায়ণ কাণ্ব সংহিতার ভাষ্যের উপোদ্ঘাত-এ বর্ণন করেছে –
তস্মিশ্চ বেদে দ্বৌ কাণ্ডৌ কর্মকাণ্ডো ব্রহ্মকাণ্ডশ্চ । বৃহদারণ্যকাখ্যো গ্রন্থো ব্রহ্মকাণ্ডঃ । তদ্ব্যতিরিক্তং শতপথব্রাহ্মণং সংহিতা চেতি অনয়োর্গ্রন্থয়োঃ । কর্মকাণ্ডত্বম্ । তত্র উভয়ত্রাধানাগ্নিহোত্রদর্শপৌর্ণমাসাদিকর্মণ এব প্রতিপাদ্যত্বাদ্ ইতি ।
অর্থাৎ, যজুর্বেদ এর দুটি কাণ্ড — কর্মকাণ্ড এবং ব্রহ্মকাণ্ড । বৃহদারণ্যকোপনিষদ্ ব্রহ্মকাণ্ড এবং শতপথ আর সংহিতাগ্রন্থে সর্বত্র কর্মকাণ্ড বিদ্যমান । এই দুটিতে আধান, অগ্নিহোত্র, দর্শপৌর্ণমাস আদি কর্মেরই বিধান বিদ্যমান ।
যদ্যপি সায়ণ এই উক্তি ব্যক্ত করেছে মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ উভয়কে বেদ মেনে, তথাপি এ দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, সায়ণ ব্রহ্মকাণ্ডের প্রতিপাদন উপনিষদ্ এবং সংহিতাতে কর্মকাণ্ডের প্রতিপাদন স্বীকার করছে ।
এই বিষয়কেই কেন্দ্র করে অন্য সব বেদভাষ্যকারগণ তাদের ভাষ্যেও তা প্রতিপাদন করেছে ।
প্রসঙ্গক্রমে এটিরও সংকেত দেওয়া আবশ্যক যে, বেদের কর্মকাণ্ডের সাথে আত্যন্তিক সম্বন্ধ স্থাপনের এক ফল এটিও হয়েছে যে, কর্মকাণ্ডিদের মধ্যে এক সম্প্রদায় এমন উৎপন্ন হয়ে গেল, যারা মন্ত্রসমূহের কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগমাত্র দ্বারা অদৃষ্ট মানতে শুরু করলো এবং তারা মন্ত্রসমূহের অনর্থকত্ব স্বীকার করে নিলো।
মহর্ষি যাস্ক এই সম্প্রদায়কে যুক্তিপ্রমাণপূর্বক নিরাকরণ করে মন্ত্রসমূহের অর্থবত্ব দর্শিয়েছেন । এমনটাই প্রযন্ত আচার্য জৈমিনি তাঁর মীমাংসাশাস্ত্রে করেছেন ।
এই বিষয়টি উল্লেখ করার তাৎপর্য এই যে, বেদকে কর্মকাণ্ড পর্যন্ত সীমিত রাখার কুফল মহাভারতকাল থেকেই বিভিন্ন বিদ্বানগণের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়, তথাপি উত্তরবর্তী বিভিন্ন তথাকথিত আচার্যগণ এই বিষয়টিকে ভয়াবহ পরিণতিতে নিয়ে গিয়েছে ।
সহস্র বর্ষ পশ্চাৎ বেদকে কর্মকাণ্ড থেকে উদ্ধার করার শ্রেয় মহর্ষি দয়ানন্দ জীর প্রাপ্ত হয় । তিনি প্রবল প্রমাণতার সহিত অতি স্পষ্টভাবে প্রমাণ তথা ঘোষণা দেন, বেদের কর্মকাণ্ডপরকের যে অর্থ ব্রাহ্মণ শাস্ত্র, শ্রৌতসূত্র এবং পূর্ব মীমাংসায় দর্শিত হয়েছে, এগুলোকে যথাবৎ স্বীকার করার পরও বেদের ক্ষেত্র অত্যন্ত বিস্তৃত । বেদ সব সত্য বিদ্যার আকর গ্রন্থ । এই বিষয়ে বিস্তারপূর্বক জানার জন্য মহর্ষি দয়ানন্দকৃত ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা গ্রন্থ এবং ভ্রান্তিনিবারণ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য ।
বেদার্থের ত্রিবিধ প্রক্রিয়া বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনের পূর্বে বেদ এর আর্থিক ক্ষেত্র প্রাচীন ঋষিগণের মতানুসারে কতদূর বিস্তৃত তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করা উচিত হবে ।
স্বায়ম্ভুব মহর্ষি মনুর বেদ বিষয়ক সিদ্ধান্ত –
ভূতং ভব্যং ভবিষ্যং চ সর্বং বেদাৎপ্রসিধ্যতি ( মনু. ১২/৯৭ )
বিভর্তি সর্বভূতানি বেদশাস্ত্রং সনাতনম্ ।
তস্মাদেতৎপরং মন্যে যজ্জন্তোরস্য সাধনম্ ॥ ( ১২/৯৯ )
সেনাপত্যং চ রাজ্যং চ দণ্ডনেতৃত্বং এব চ ।
সর্বলোকাধিপত্যং চ বেদশাস্ত্রবিদর্হতি ॥ ( ১২/১০০ )
এই বচনসমূহ দ্বারা স্পষ্ট যে, বেদে সেনাপতির কর্ম ( যুদ্ধসঞ্চালন ), দণ্ডবিধান, ন্যায়াধীশের কর্তব্য, চক্রবর্তী রাজ্যের পরিপালনের উপায়, ভূত, বর্তমান এবং ভবিষ্যকালে দেশকালোপযোগী সমাজশাস্ত্রীয় বিধান সমূহের নির্দেশ । একমাত্র বেদই মনুষ্যগণের এমন এক সাধন, যাহাতে ইহলৌকিক এবং পরলৌকিক সমস্ত আনন্দ, সুখ, তৃপ্তি প্রাপ্তির পরিপূর্ণভাবে প্রাপ্ত করার বিধান রয়েছে । একারণে মহর্ষি মনু সুস্পষ্ট ভাবে দৃঢ়তার সহিত ঘোষণা দিয়েছেন – সর্বজ্ঞানময়ো হি সঃ ( ২/১৭ ) অর্থাৎ, বেদ সর্ববিধ জ্ঞানের পরিপূর্ণ ভাণ্ডার ।
তৎপশ্চাৎ মহর্ষি ব্যাসদেব মহাভারতে বর্ণন করেছেন —
য়ানীহাগমশাস্ত্রাণি য়াশ্চ কাশ্চিৎ প্রবৃত্তয়ঃ | তানি বেদ পুরস্কৃত্য প্রবৃত্তানি য়থাক্রমম্ ॥
( মহাভারত. অনুশাসন. অধ্যায়. ১২২ )
অর্থাৎ, যত প্রকারের বিদ্যা লোকে প্রসৃত হয়েছে, তার আগম ( মূলভূত শাস্ত্র ) যথাক্রমে বেদ থেকেই প্রসিদ্ধ হয়েছে এবং সমস্ত লৌকিক প্রবৃত্তির মূল বেদই ।
এই পরমতত্ত্ব পরম ব্রহ্মনিষ্ঠ ভগবান যাজ্ঞবল্ক্য এরূপভাবে ব্যক্ত করেছেন —
ন হি বেদশাস্ত্রাদন্যত্তু কিঞ্চিচ্ছাস্ত্রং হি বিদ্যতে ।
নিঃসৃতং সর্বশাস্ত্রং তু বেদশাস্ত্রাৎ সনাতনাৎ ॥
মহর্ষি ব্যাসদেব এবং যাজ্ঞবল্ক্য সদৃশ মহর্ষির উক্ত বচন দ্বারা অতি স্পষ্ট যে, সর্ব বিদ্যার প্রাদুর্ভাব বেদ থেকেই হয়েছে । অর্থাৎ, বেদে সর্ব বিদ্যার বীজ বিদ্যমান ।
এই পরম তত্ত্বের পুষ্টি সমগ্র সংস্কৃত বাঙময় দ্বারাও হয় । সংস্কৃত ভাষায় বর্তমানে যত প্রকারের বিবিধ বিদ্যার প্রামাণিক গ্রন্থ উপলব্ধ ; সেসব গ্রন্থ সমূহে প্রতিপাদিত্য মূল বিষয় বা বিদ্যার পরম তত্ত্ব বেদেরই তা স্পষ্টভাবে স্বীকার তথা দর্শিত হয়েছে ।
বৈদিক পরম্পরায় কয়েকজন প্রসিদ্ধ আচার্যগণের মত —
১. আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের প্রবক্তা মহর্ষি সুশ্রুত বর্ণন করেছেন –
ইহ খল্বায়ুর্বেদো নাম য়দুপাঙ্গমথর্ববেদস্য ( সূত্রস্থান. অধ্যায়. ১ )
আর্য়ুবেদ এর মূল অথর্ববেদ ।
২. জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রবক্তা আর্যভট্ট তাঁর স্বরচিত গ্রন্থে জ্যোতিষ শাস্ত্রের মূল বেদকে অভিহিত করেছেন ।
৩. পদার্থজ্ঞানের প্রতিপাদক মহর্ষি কণাদ পদার্থ ধর্মের মূল বেদ তা স্বীকার করেছেন ।
তদ্বচনাদাম্নায়স্য প্রামাণ্যম্ ( বৈশেষিক দর্শন. ১/১/৩ )
অর্থাৎ, অথাতো ধর্ম ব্যাখ্যাস্যামঃ এই প্রতিজ্ঞাসূত্র দ্বারা বৈশেষিকপ্রতিপাদ্য পদার্থ ধর্মের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় বেদে বিদ্যমান হওয়ায় এর প্রামাণ্য বেদানুকূল ।
মহর্ষি কণাদ বেদে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রতিপাদনের কেবল প্রতিজ্ঞাই করেন নাই, বরং স্বশাস্ত্রে বৈদিকং চ ( ৫/২/২০ ), বেদ লিঙ্গাচ্চ ( ৪/২/১১ ) ইত্যাদি সূত্র দ্বারা বৈশেষিকের মূল বেদ, তার প্রামাণ্য প্রতিপাদন করেছেন ।
যদি বিবিধ বিদ্যাসমূহের মূল বেদ না হতো, তাহলে বৈদিক পরম্পরার প্রসিদ্ধ ঋষি-মহর্ষিগণ তাঁদের স্ব-স্বশাস্ত্রের মূল স্রোত বেদে বিদ্যমান তা দর্শাতেন না ।
এখানে বিচার্য একটি বিষয় যে, যেমনভাবে মহর্ষি কণাদ সহস্র বর্ষ পূর্বে পদার্থবিজ্ঞানের মূল জ্ঞান বেদে বিদ্যমান মেনেছেন , তদ্রুপ বর্তমানে এই বিজ্ঞান যুগে বেদ দ্বারা সেই জ্ঞান প্রতিষ্ঠা করার সাহস মহর্ষি দয়ানন্দই করেছেন তথা অতি স্পষ্ট প্রবল প্রমাণতার সহিত প্রমাণ করেছেন ।
বেদের স্বরূপ বিষয়ে সংক্ষেপে দর্শানো হলো । এখন মূল বিষয় বেদার্থের ত্রিবিধ তথা চতুর্বিধ প্রক্রিয়া দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক ।
যে প্রক্রিয়া দ্বারা বেদ এর সর্ববিদ্যাময়ত্বের প্রকাশ হয়, সেই সব প্রক্রিয়াই বেদার্থের বাস্তবিক তথা বেদানুকূল প্রক্রিয়া । বিদ্যা অনন্ত হওয়ায় বেদার্থ প্রক্রিয়াও অনন্ত । পরন্ত বৈদিক পরম্পরার ঋষি-মুনিগণ অতি বিস্তৃত বেদার্থ প্রক্রিয়ার সংক্ষেপ যাজ্ঞিক, আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্মিক এই তিন প্রক্রিয়ার রূপে স্বীকার করেছেন তথা দর্শিয়েছেন । এইসব প্রক্রিয়ার বর্ণনার পূর্বে যে যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ার বিষয় যজ্ঞ, তার বিষয়ে অতি সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল –
পৌরাণিক গোষ্ঠী এবং কিছু আর্য বিদ্বানের মতানুসারে অগ্নিহোত্র থেকে শুরু করে অশ্বমেধ পর্যন্ত যত যজ্ঞীয় কর্মকাণ্ড বিদ্যমান, তার সাক্ষাৎ প্রতিপাদন বেদে উপলব্ধ ।
পরন্তু প্রসিদ্ধ শ্রৌতযজ্ঞ তার স্বরূপে স্বতন্ত্র তত্ত্ব নয় এবং বেদের সহিত এ যজ্ঞের সাক্ষাৎ সম্বন্ধ নেই । এই যজ্ঞের প্রকল্পনা ঋষিগণ সৃষ্টিবিজ্ঞানকে বোধগম্য করানোর হেতু করেছিলেন । বেদে যে সব স্থলে যজ্ঞের বর্ণন বিদ্যমান, তা প্রধানরূপ সৃষ্টিরূপী যজ্ঞেরই ।পুরুষসূক্ত অথবা পুরুষাধ্যায় এর মন্ত্রসমূহ তা অতি স্পষ্টভাবে প্রতিপাদন করে । বৈদিক পরম্পরার প্রাচীন আচার্যগণও এমনরূপ ব্যাখ্যান করেছেন ।
যজ্ঞের বাস্তবিক স্বরূপকে এই প্রকারে অনুধাবন করা যায় – যেমনভাবে পুরাকালীন ঐতিহাসিক ঘটনাকে প্রত্যক্ষ পরিজ্ঞানের জন্য নাটক হিসেবে লিখিত হত এবং নাট্যশালায় প্রস্তুত করা হয়, অথবা ভূগোল-আকাশ মণ্ডলের নকশা তার স্বরূপে বিশেষ মহত্ত্ব না রেখেও ভূগোল-আকাশ মণ্ডলের পরিজ্ঞানে সহায়ক হওয়ায় মহত্ত্বপূর্ণ হয়ে থাকে । তদ্রুপ একই স্থিতি শ্রৌতযজ্ঞের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য । অতঃ এ দ্বারা অত্যন্ত সূক্ষ্ম তত্ত্বসমূহের বোধগম্য হয়ে থাকে । অতঃ এটাও মহত্ত্বপূর্ণ করলাম হিসেবে বিবেচ্য । এ দ্বারা ঋষিগণ যোগবিদ্যার মাধ্যমে উপলব্ধ সৃষ্টি বিজ্ঞানের সমস্ত প্রকরণ প্রত্যক্ষবৎ জানানোর প্রযন্ত করেছেন ।
শ্রৌতযজ্ঞের প্রয়োজন সৃষ্টিযজ্ঞের তত্ত্বসমূহের পরিজ্ঞান করানো । এর নির্দেশ বেদ, বেদের শাখা সমূহে এবং ব্রাহ্মণগ্রন্থে বিস্তর বর্ণন বিদ্যমান । এসব বর্ণন সমূহ একত্রে সঙ্কলন পূর্বক বৈদিক শ্রৌতযজ্ঞের মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠাপন করা আবশ্যক ।
যেরূপভাবে সাধন যতক্ষণ পর্যন্ত প্রাপ্ত করা যায় না, ততক্ষণ পর্যন্ত তার উপযোগিতা দ্বারা যে প্রকারে চক্ষুদ্বয়ের প্রকৃত আবরণ উন্মোচিত করা সম্ভবপর হয় না, তদ্রুপ আধিদৈবিক জগতের পরিজ্ঞানের প্রমুখ সাধন হওয়ার জন্যে ঋষিগণ এই তত্ত্বকেও সাধ্যের সমানই মহত্ত্ব দিয়েছেন । এই দৃষ্টিতে বেদার্থের ত্রিবিধ প্রক্রিয়ার বর্ণন বৈদিক পরম্পরার ঋষি-মুনি-আচার্যগণ বিস্তরভাবে করেছেন ।
এ বিষয়ে কিছু প্রমাণ দর্শানো প্রযোজ্য –
মহর্ষি যাস্ক " বাচং শুশ্রুবা অফলামপুষ্পাম্ " ( ১০/৭১/৪ ) এই ঋগমন্ত্রের ব্যাখ্যান করেছেন –
অর্থ বাচঃ পুষ্পফলমাহ – য়াজ্ঞদৈবতে পুষ্পফলে দেবতাধ্যাত্মে বা । ( নিরুক্ত. ১/১৯ )
অর্থাৎ, বেদের মন্ত্র বেদবাণীর পুষ্প এবং ফলের নির্দেশ করে । এই পুষ্প এবং ফল হলো ক্রমশঃ আধিযাজ্ঞিক এবং আধিদৈবিক বিজ্ঞান অথবা আধিদৈবিক এবং আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান ।
এটা সর্বলোকবিদিত যে, প্রথমে পুষ্পের আগমন ঘটে, তৎপশ্চাৎ ফল । পুষ্প ফলের নিষ্পত্তিতে কারণ হয় । তদনুসার মহর্ষি যাস্কের সিদ্ধান্ত এই যে, যাজ্ঞিক অর্থের পরিজ্ঞান পুষ্পস্থানীয় এবং তা ফলস্থানীয় আধিদৈবিক বিজ্ঞানের কারণ । এই প্রকারে যখন মানব আধিদৈবিক জগতে বিজ্ঞাত হয়ে যায়, তাহলে সে আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের কারণ হয় । অর্থাৎ, যাজ্ঞিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যেটা আধিদৈবিক বিজ্ঞানের ফলস্থানীয় ছিলো, তা উত্তর আধ্যাত্মবিজ্ঞানের প্রতি পুষ্পস্থানীয় হয়ে থাকে । এই ভিত্তিতে লোকে একটি প্রবাদের চর্চা হয় যে, য়দ্ ব্রহ্মাণ্ডে তৎপিণ্ডে । অর্থাৎ, যা কিছু ব্রহ্মাণ্ডে বিদ্যমান তা এই পিণ্ড মানে শরীরে বিদ্যমান ।
এ দ্বারা উক্ত তত্ত্ব অত্যন্ত বিস্পষ্ট হয়ে যায় যে, শ্রৌতযজ্ঞের প্রক্রিয়া, রচনা এবং শরীর রচনায় অত্যন্ত সাদৃশ্য বিদ্যমান । এই তত্ত্বের নির্দেশ ব্রাহ্মণগ্রন্থের প্রবক্তা যাজ্ঞিক তত্ত্ব সমূহের ব্যাখ্যা করার সময় " অথাধিদৈবতম্ অথাধ্যাত্মম্ " উল্লেখ করে সৃষ্টি এবং শরীর সমন্ধী তত্ত্ব সমূহের সাদৃশ্য দর্শিয়েছেন ।
আফসোস ! মহর্ষি দয়ানন্দ জী অগ্নিহোত্র থেকে শুরু করে অশ্বমেধ পর্যন্ত যে শ্রৌতযজ্ঞ তাঁর স্বরচিত গ্রন্থ সমূহে যত্র তত্র প্রতিপাদন করেছেন, বেদ এর শাখা সমূহ ব্রাহ্মণগ্রন্থ এবং শ্রৌতসূত্রে যার প্রবচন করে ; যার ব্যবস্থা করার জন্য মহর্ষি জৈমিনি পূর্ব মীমাংসা শাস্ত্রের প্রণয়ন করেছেন । আর্য সমাজ বিগত শত বর্ষে এই বৈদিক শ্রৌতযজ্ঞের প্রতি দৃষ্টিপাতও করে নাই । অস্তু !
এখন বেদার্থ আধিযাজ্ঞিক, আধিদৈবিক এবং আধ্যাত্মিক ভেদ দ্বারা তিন প্রকারে হয়ে থাকে । এই বিষয়ে কতিপয় প্রাচীন আচার্য গণের বচন দর্শানো হলো —
১. শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্র ( ১/১/১৮, ১৯ ) - এ বর্ণন হয়েছে –
ন শ্রুতমতীয়াৎ । অধিদৈবমথাধ্যাত্মমধিয়জ্ঞমিতি ত্রয়ম্ ।
মন্ত্রেষু ব্রাহ্মণে চৈব শ্রুতমিত্যভিষীয়তে ।।
অর্থাৎ, শ্রুত ( শব্দশ্রবণমাত্র ) দ্বারা গম্যমান অর্থের পরিত্যাগ অনুচিত । দেবসম্বন্ধী আত্মসম্বন্ধী এবং যজ্ঞসম্বন্ধী এই তিনটির অর্থ মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণগ্রন্থে " শ্রুত " বলা হয় ।
২. মহাভাষ্যের টীকাকার ভর্তৃহরি ( ১/১/২৭ ) নং-এ ব্যাখ্যা করেন –
য়থা ইদং বিষ্ণুর্বিচক্রমে ( ঋগ্বেদ. ১/২২/১৭ ) ইত্যত্র এক এব বিষ্ণুশব্দোऽনেকশক্তিঃ সন্নধিদৈবতমধ্যাত্মমধিয়জ্ঞং চ আত্মনি নারায়ণে চষালে চ তয়া শকত্যা প্রবর্ততে ।
অর্থাৎ, " ইদং বিষ্ণুর্বিচক্রমে " মন্ত্রে বিষ্ণু শব্দের অর্থ অধিদৈবত, আধ্যাত্ম এবং অধিযজ্ঞ পক্ষে ক্রমশঃ সূর্য, পরমাত্মা এবং চষাল অর্থ হয়ে থাকে ।
৩. নিরুক্ত ব্যাখ্যাকার স্কন্দ স্বামী ৩য় অধ্যায়ের ৫ম খণ্ডে ব্যাখ্যা করেছেন —
সর্বদর্শনেষু চ সর্বে মন্ত্রা যোজনীয়াঃ । কুত: ? ভাষ্যকারেণ সর্বমন্ত্রাণাং ত্রি প্রকারস্য বিষয়স্য প্রদর্শনায় অর্থ বাচঃ পুষ্পফলমাহ ইতি যজ্ঞাদীনাং পুষ্পফলত্বেন প্রতিজ্ঞানাৎ ।
অর্থাৎ, সব দর্শনে = অধিযজ্ঞ, অধিদৈবত, আধ্যাত্ম পক্ষে সব মন্ত্রের অর্থের যোজনা করা আবশ্যক । কেননা, ভাষ্যকার মহর্ষি যাস্ক তিন প্রকার বিষয়ে প্রদর্শনের জন্য " অর্থ বাচঃ পুষ্পফলমাহ " বচন দ্বারা যজ্ঞ আদিকে পুষ্পফলরূপ দ্বারা নিদর্শন করেছেন ।
৪. স্কন্দস্বামীর থেকে নিরুক্তের প্রাচীন ব্যাখ্যাকার দুর্গাচার্য বর্ণনা করেছেন —
অধ্যাত্মাধিদৈবতাধিয়জ্ঞাভিধায়িনাং মন্ত্রাণামর্থা বিজ্ঞায়ন্তে । ( নিরুক্ত. টীকা. ১/১৮ )
অর্থাৎ, আধ্যাত্ম, অধিদৈবত এবং অধিযজ্ঞ পক্ষে সম্বোধনকারী মন্ত্রসমূহের তিন প্রকার অর্থ হয়ে থাকে ।
৫. শতপথের ব্যাখ্যাতা হরিস্বামী প্রথম কাণ্ডের আরম্ভে লিখেন –
মন্ত্রা আধিয়াজ্ঞিকা ইষে ত্বাদয়ঃ, ত এব দেবতাপদত্বেনাধিদৈবিকাঃ, ত এবাত্মানমধিকৃতা আধ্যাত্মিকাঃ । ইশা বাস্যাদয়সত্বাধ্যাত্মিকা এব ।
অর্থাৎ, " ইবে ত্বা " আদি মন্ত্র অধিযজ্ঞবিষয়ক, এই মন্ত্রই দেবতাপরক অর্থের অভিধান করার পর আধিদৈবিক হয় এবং উহাই আত্মার প্রতি অধিকৃত হয়ে আধ্যাত্মিক পক্ষে অর্থ হয় । " ঈশা বাস্যম্ " আদি মন্ত্রের অর্থ আধ্যাত্মিক পক্ষেই হয়ে থাকে ।
উপরোক্ত প্রাচীন আচার্যগণের বচনানুসারে এটা স্পষ্ট যে, বেদ মন্ত্রের যজ্ঞ-দৈবত-আত্মবিষয়ক ত্রিবিধ অর্থ হয়ে থাকে ।
যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ার প্রভাব
বেদার্থের উপর যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ার এতোটাই অধিক প্রভাব পড়েছিলো যে, নিরুক্তকার যেসব মন্ত্রের ব্যাখ্যা আধিদৈবত প্রক্রিয়ানুসারী করেছেন, সেসব মন্ত্রের অর্থও স্কন্দাদি টীকাকারগণ জোরপূর্বক যজ্ঞপরক করেছেন ।
ত্রিবিধ অর্থের গৌণ-প্রাধান্যভাব
বেদার্থ ত্রিবিধ প্রক্রিয়ায় হয়ে থাকে, যা পূর্ব উদাহরণ সমূহ দ্বারা অতি স্পষ্ট । যতঃ যাজ্ঞিক প্রক্রিয়া স্বয়ং সৃষ্টিযজ্ঞ অর্থাৎ, আধিদৈবিক জগতের ব্যাখ্যানার্থে প্রবৃত্ত, অতঃ অধিযজ্ঞ এবং অধিদৈবত পক্ষে অধিযজ্ঞবিষয়ক অর্থ গৌণ এবং অধিদৈবত অর্থ প্রধানভূত । এই দৃষ্টিতে বেদের প্রতিপাদ্য বিষয় অধিদৈবত এবং আধ্যাত্ম পক্ষই । অন্যভাবে বলা যায়, বেদের প্রতিপাদ্য বিষয় তৃণ থেকে শুরু করে ঈশ্বর পর্যন্ত সমগ্র পদার্থের জ্ঞান-বিজ্ঞান ।
আধিদৈবিক অর্থেরও পরিণতি আধ্যাত্ম পক্ষেই হয়ে থাকে, অতঃ এই দুই পক্ষের মধ্যে আধ্যাত্ম পক্ষই প্রধান । অতএব উপনিষদকার গণ বর্ণনা করেছেন –
সর্বে বেদা য়ৎপদমামনন্তি তপাংসি চ সর্বাণি য়দ্বদন্তি । য়দিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্য চরন্তি তসে পদং সংগ্রহেণ ব্রবীম্যোম্ ইত্যেতৎ ।।
অর্থাৎ, সমগ্র বেদ " ও৩ম্ " পদবাচ্য পরমাত্মারই বর্ণন করে । তাঁরই ব্যাখ্যান সব তপস্বীজন করে থাকে এবং তাঁকে প্রাপ্ত করার জন্যই ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন করা হয় ।
উক্ত বচন মহর্ষি ব্যাসদেবও তাঁর পুত্র শুকদেবকে আধাত্ম্য শাস্ত্রের উপদেশ প্রদানের সময় ব্যক্ত করেছেন –
দশেদমৃক্সহস্রাণি নির্মথ্যামৃতমুদৃধৃতম্ । নবনীতং য়থা দধ্নি কাষ্ঠেऽগ্নির্য়থা তথা ॥
অর্থাৎ, হে পুত্র ! আমি দশ সহস্র ঋচা মন্থন করে যে আধ্যাত্ম জ্ঞান উপলব্ধ করেছি, তা এটাই । যা বেদ এর প্রত্যেক মন্ত্রে সেই প্রকারেই নিহিত, যেমনভাবে দধিতে মাখন এবং কাষ্ঠে অগ্নি থাকে ।
এই মুখ্য তত্ত্বের কথন একটি ঋচায় এই প্রকারে বর্ণন রয়েছে –
ঋচো অক্ষরে প্রথমে ব্যোমন্যস্মিন্দেবা অধি বিশ্বে নিষেদুঃ ।
য়স্তন্ন বেদ কিমৃচা করিষ্যতি য় ইত্তদ্বিদুস্ত ইমে সমাসতে ।।
( ঋগ্বেদ: ১/১৬৪/৩৯ )
অর্থাৎ, যে অবিনাশী পরম ধামে সমস্ত দেবগণ অবস্থান করে, যিনি সেই পরম তত্ত্ব সম্বন্ধে অজ্ঞাত, তিনি ঋগ্বেদ দ্বারা কি করবেন ? এবং যিনি তাঁকে জানেন, তিনিই মুক্ত হয়ে সেই ব্রহ্মে বিরাজমান হন ।
বেদের এই আধ্যাত্মিক বিচার পরা বিদ্যা । উপনিষৎকারগণ " অথ পরা য়য়া তদক্ষরমধিগম্যতে " দ্বারা দৈবী বাক্ এর মাধ্যমে এই তাৎপর্যের দিকে সংকেত ব্যক্ত করেছেন । আধিদৈবিক বিজ্ঞান অপরা বিদ্যায় পরিগণিত হয় । কর্মকাণ্ডীয় বিজ্ঞান আধিদৈবিক বিজ্ঞানের বাহ্যস্বরূপ ।
চতুর্থ বেদার্থপ্রক্রিয়া
এ পর্যন্ত বেদের যতজন আচার্য হয়েছেন, তারা প্রায়ঃ স্বকালে প্রসিদ্ধ কোনো একটি পক্ষের বেদার্থ প্রক্রিয়ার আশ্রয়ণ করে বেদব্যাখ্যান লিখেছেন । মহর্ষি দয়ানন্দ এদের সকলের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক্ ছিলেন । " মুরারেস্তৃতীয়ঃ পন্থা " সুভাষিত অনুসারে তাঁর বেদার্থব্যাখ্যান সবচেয়ে, সর্বদিক দিয়ে ব্যতিক্রমমূলক ।
এই ব্যতিক্রমীর চারটি প্রধান কারণ –
১. যে যাজ্ঞিক প্রক্রিয়া আর্যাবর্তে সহস্র বর্ষ ধরে একাধিপত্য অবস্থান করছিলো, যার কারণে বেদ এক নির্জীব প্রেরণারহিত গ্রন্থে জায়গা করে নিয়েছিলো, এই মহাভ্রম মহর্ষি দয়ানন্দ পরিত্যাগ করে অত্যন্ত সাহসিক সত্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন ।
উক্ত কথনের তাৎপর্য কেউ এটা না গ্রহণ করে যে, তিনি বেদের যাজ্ঞিক প্রক্রিয়া বা কর্মকাণ্ডের বিরোধী ছিলেন । তিনি যজ্ঞ আদি কর্মসমূহকে শ্রেষ্ঠ কর্তব্য মানতেন । তিনি ব্রাহ্মণাদি শাস্ত্রে বর্ণিত যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ানুসারে বেদ ব্যাখ্যানকে প্রামাণিক মানতেন । পরন্তু সেইসাথে তিনি ওই ব্যাখ্যানকে পুনরুক্তি করা পিষ্টপেষণবৎ দোষ মানতেন।
[ দ্রষ্টব্যঃ – ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা, প্রতিজ্ঞা বিষয় ]
২. আধিদৈবিক প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থ প্রায়ঃ লুপ্ত । এই পক্ষকে নিরুক্ত তথা ব্রাহ্মণশাস্ত্রের আধারে পুনঃ প্রকট করার সাহস করেছেন ।
৩. বেদের পরতত্ত্বের প্রতি সমাজে অনেকের মনে বিবিধ ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হয়েছিলো । তারা বেদে বহু দেব-দেবীর অস্তিত্ব এবং উপাসনা মানা শুরু করে । পাশ্চাত্য ম্লেচ্ছও বেদের বিষয়ে এমন মিথ্যাচার প্রকাশ করতে থাকে । অতঃ মহর্ষি দয়ানন্দ এই প্রকার অবৈদিক, মিথ্যা আরোপ নিরাকরণে বিশেষ প্রযত্ন করেছেন তথা এসব ভ্রমকে প্রবলভাবে প্রমাণের সহিত খণ্ডন করেছেন । শতশঃ প্রাচীন বচন উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেছেন বেদে সর্বত্র উপাস্যদেব এক পরমব্রহ্ম ।
৪. কর্মকাণ্ডীয় অর্থের প্রচলনের কারণে সমাজে এই ধারণার উৎপন্ন হয় যে, বেদের সহিত মানবজীবনের সাক্ষাৎ কোনো সম্বন্ধ নেই । এই ভ্রান্ত নিবারণে মহর্ষি দয়ানন্দ বেদের ব্যবহারিক অর্থ বিশেষরূপে প্রস্তুত করেছেন তথা দৃঢ় প্রমাণের সহিত তা দর্শিয়েছেন ।
তিনি তাঁর স্বরচিত ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা গ্রন্থের প্রতিজ্ঞা-বিষয়ে প্রাচীন বৈদিক পরম্পরাপ্রাপ্ত ত্রিবিধ অর্থের সাক্ষাৎ স্বীকার করে স্ব বেদভাষ্যের সম্বন্ধে এই প্রকার বর্ণন করেছেন –
" অথাऽত্র য়স্য য়স্য মন্ত্রস্য পারমার্থিকব্যাবহারিকদ্বয়োরর্থয়োঃ শ্লেষালঙ্কারা-দিনা সপ্রমাণ: সম্ভবোऽস্তি, তস্য দ্বৌ দ্বাবর্য়ৌ বিষাস্যেতে । "
অর্থাৎ, যে যে মন্ত্রের শ্লেষাদি অলঙ্কারসমূহ দ্বারা পারমার্থিক এবং ব্যাবহারিক ভিন্ন-ভিন্ন অর্থের সম্ভব হবে, সেখানে ভিন্ন-ভিন্ন অর্থ করবে । অন্যথা কেবল ব্যবহারিক অর্থের প্রয়োগ হবে।
এই প্রকারে মহর্ষি দয়ানন্দ বেদের পারমার্থিক অর্থাৎ, আধ্যাত্মিক এবং ব্যাবহারিক অর্থের প্রয়োগ তাঁর স্ব বেদভাষ্যে বিশেষরূপে প্রযত্ন করেছেন ।
পূর্বে বিস্তারভাবে দর্শানো হয়েছে যে, বেদের ব্যাবহারিক অর্থাৎ মানবসমাজ দ্বারা সম্বদ্ধ অর্থসমূহের সংকেত প্রাচীন গ্রন্থে উপলব্ধ রয়েছে । পরন্তু এসবের প্রধানতা দিয়ে বেদ এর ব্যাবহারিক অর্থের উদ্ঘাটিত করার পরম শ্রেয় একমাত্র মহর্ষি দয়ানন্দ জী-ই করেছেন ।
এই ব্যবহারিক অর্থের মূলভিত্তি(মেরুদণ্ড) হচ্ছে অলঙ্কারসমূহের একত্রীকরণ। অন্য তথাকথিত বেদ ভাষ্যকারগণও তাদের ভাষ্যে যত্র-তত্র কিঞ্চিৎ অলঙ্কার প্রয়োগ করেছে । এটাও মহর্ষি দয়ানন্দ জীর বেদভাষ্যের অন্যতম বিশেষতা ।
মহর্ষি দয়ানন্দ দ্বারা সমাশ্রিত ব্যাবহারিকার্থ প্রক্রিয়া এমন একটি মহত্ত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, যার অভ্যন্তরে ত্রিবিধ প্রক্রিয়ার অন্তঃপুট অবস্থান করেও একটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়ার স্থান গ্রহণ করতে সর্বোতভাবে সমর্থ ।
এই প্রকারে উপরোক্ত লেখ-এ বেদার্থ, তাঁর প্রক্রিয়া এবং মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী দ্বারা প্রমুখরূপে আশ্রিত ব্যাবহারিকার্থরূপ চতুর্থ প্রক্রিয়া নিরূপণ করা হয়েছে ।
বস্তুতঃ বেদার্থ প্রক্রিয়াসমূহ এতোটাই প্রগাঢ়তাপূর্ণ যে, এই বিষয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থ বিস্তারপূর্বক লেখা সম্ভব ।
– বিদুষাং বশংবদঃ
নমস্কার
0 মন্তব্য(গুলি)