শ্রুতি শব্দও বেদ শব্দের সমান বিবাদাস্পদ । এর সাথেই যেমনভাবে ব্রাহ্মণগ্রন্থের জন্য পারিভাষিকভাবে বেদ সংজ্ঞার বিধান উপলব্ধ রয়েছে, তেমনভাবে শ্রুতিসংজ্ঞার কোনো পারিভাষিক সংজ্ঞা উপলব্ধ নয় ।
শ্রুতি শব্দ " শ্রু শ্রবণে " ধাতু থেকে ভাব কর্ম এবং করণ কারকে " স্ত্রিয়াং কিতন্ "
(অষ্টা: ৩/৩/৯৪ ) দ্বারা " কিতন্ " প্রত্যয় হয়ে নিষ্পন্ন হয়েছে । তদনুসার " শ্রবণং শ্রুতিঃ " এর অর্থ -- " সুননা । শ্রুয়ত ইতি শ্রুতিঃ " এর অর্থ - যা কর্ণের মাধ্যমে শোনা যায়, অর্থাৎ - ধ্
বনি । " শ্রুয়তেনয়া সা শ্রুতিঃ " এর অর্থ -- যার দ্বারা অর্থকে শ্রবণ করা যায়, অর্থাৎ - জানা যায় ।
এই বুৎপত্তির অনুসারে শব্দ বাক্য বা গ্রন্থমাত্র অর্থ সাধারণত জানা যায় । পরন্তু বৈদিক বাঙ্ময়ে এই শব্দ বিশেষ অর্থে প্রযুক্ত হয় ।
তদনুসার মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ বচন দুই ক্ষেত্রেই শ্রুতি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।
মনুস্মৃতিতে প্রযুক্ত নিম্ন প্রয়োগ দ্রষ্টব্য --
১. শ্রুতিদ্বৈধং তু যত্র স্যাত্তত্র ধর্মাবুভৌ
স্মৃতৌ।
উদিতেহনুদিতে চৈব সময়াধ্যুষিতে তথা।
সর্বথা বর্ততে যজ্ঞ ইতীয়ং বৈদিকী শ্রুতিঃ।।
[ ২/১৫ ]
২. শ্রুতিস্তু বেদো বিজ্ঞেয়ো ধর্মশাস্ত্ৰস্তু বৈ
স্মৃতিঃ ।। [ ২/১০ ]
৩. শ্রুতীরথর্বাঙ্গিরসীঃ কুর্যাদিত্যবিচারয়ন্।।
[ ১১/৩৩ ]
৪. ধর্মং জিজ্ঞাসমানানাং প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ
।। [ ২/১৩ ]
৫. বিবিধাশ্চৌপনিষদীরাত্মসংসিদ্ধয়ে শ্রতীঃ।।
[৬/২৯ ]
মনুস্মৃতির এই উদাহরণ গুলোতে শ্রুতি শব্দ নিঃসন্দেহে মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণের জন্য প্রযুক্ত হয়েছে । ৫নং প্রমাণে উপনিষদ সম্পর্কিত শ্রুতির নির্দেশ দিচ্ছে । উপনিষদের সমাবেশও ব্রাহ্মণ গ্রন্থেই হয়ে থাকে ।
৩নং প্রমাণে উদ্ধৃত অথর্বাঙ্গিরসী শ্রুতি অথর্ববেদের সাথে সম্পর্কিত । খুব সম্ভবত উক্ত প্রমাণে অথর্ববেদ-সম্বন্ধ ব্রাহ্মণ গ্রন্থেরও গ্রহণ হতে পারে ।
মনুস্মৃতির প্রমাণের উপর বিচার করার সময় যে বিষয়টা লক্ষ্যণীয় যে, মনুস্মৃতি একটি ধর্মশাস্ত্র । ধর্মশাস্ত্র কল্পসূত্রের অন্তর্গত [ কল্পসূত্রের তিনটি বিভাগ -- শ্রৌতসূত্র, গৃহ্যসূত্র এবং ধর্মসূত্র ] ।
অতএব, মনুস্মৃতিতে উল্লেখিত বহুধা শ্রুত শ্রুতি শব্দ থেকে মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ দুটোরই গ্রহণ হয় ।
পূর্বমীমাংসা শাস্ত্রে
" শ্রুতিলিঙ্গবাক্যপ্রকরণস্থানসমাখ্যানাং সমবায়ে পারদৌর্বল্যম্ অর্থবিপ্রকর্ষাত্ " ( ৩/৩/১৪ ) সূত্রে শ্রুতির উদাহরণ সমস্ত মীমাংসকগণ " এন্দ্রেয়া গার্হপত্যমুপতিষ্ঠতে " ( মৈ.স. ৩/২/৪ ) এর উদাহরণ দিয়ে থাকেন, এবং " গার্হপত্যম্ " শব্দ শ্রবণকে শ্রুতি মানতেন । মীমাংসকদের মতানুসারে
" শ্রুতি " শব্দের অর্থ সাক্ষাৎ শব্দ শ্রবণ হওয়ার পরও উপযুক্ত বিচার হলো, শ্রুতি শব্দের অর্থ
" শ্রুয়তে সম্বন্ধো যেন " যার মাধ্যমে সম্বন্ধবিশেষের পরিজ্ঞাত হয়, সেই ব্রাহ্মণ বাক্যকে শ্রুতি বলে । এই সম্বন্ধ হোক সেটা দ্রব্যদেবতা বা হোক সেটা মন্ত্র এবং কর্মের । এই প্রকারে শ্রুতি শব্দ বিনিয়োগের পর্যায় ।
কর্মকাণ্ডীয় শাখা-ব্রাহ্মণসূত্র গ্রন্থে বিনিয়োজক পদসমুদায়ে মন্ত্র হোক বা ব্রাহ্মণবচন সবই শ্রুতি বলা হয় । এই অর্থে এমন কিছু প্রমাণ উপস্থিত করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে " শ্রুতি " শব্দের অর্থ স্পষ্ট রয়েছে
যথা -
১. মাধ্যন্দিন সংহিতার ভাষ্যকার উব্বট
২৪ নং অধ্যায়ের প্রারম্ভে লিখেছেন --
" ইত উত্তরং শ্রুতিরূপা মন্ত্রা আশ্বমেধিকানাং পশুনাং দ্রব্যদেবতাসংবন্ধস্যাভিধায়িতঃ ।
অর্থাৎ - এখান থেকে শ্রুতিরুপ ( শ্রুতিসমান ) মন্ত্রের শুরু, যা অশ্বমেধের পশু দ্রব্য এবং দেবতা সম্বন্ধে বলা হয়েছে ।
২. শুক্ল যজুর্বেদ এর পণ্ডিত এবং মহাযাজ্ঞিক পণ্ডিত শ্রীধরশাস্ত্রী বারে জী ( নাসিক নিবাসী )
" ঋগ্যজুঃ পরিশিষ্ট " এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন --
ঋগ্যজুঃ পরিশিষ্ট - " দেব সবিতরিতি তিস্রঃ প্রাকপৈষেভ্যো ব্রাহ্মণপাঠেভ্যঃ " । [ পৃষ্ঠা: ৮৮ ]
শ্রীধর শাস্ত্রীর টীকা - " প্রাকপৈষেভ্যো নিগদেভ্যো ব্রাহ্মণপাঠেভ্যঃ শ্রুতিরুপেভ্যো যজুষঃ প্রাক্ " ।
অর্থাৎ -- প্রৌষ-সঙ্গক নিগদ-সঙ্গক শ্রুতিরুপ ব্রাহ্মণপাঠের পূর্বে দেব সবিতঃ তিনটি ঋক বিদ্যমান ।
এই দুইটি উদাহরণের মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, ব্রাহ্মণের " বিনিয়োজকং ব্রাহ্মণম্ " লক্ষণ যে মন্ত্রতে উল্লেখ হয়, সেই মন্ত্রকে ব্রাহ্মণ বা শ্রুতি শব্দে সম্বোধন করা হয় । এই প্রকারে স্পষ্ট হওয়া যায় যে, যাজ্ঞিক গ্রন্থগুলোতে বেদ সঙ্গার সমান শ্রুতি সঙ্গার পরিভাষা না দেওয়ার পরও যাজ্ঞিকদের মতানুসারে শ্রুতি সঙ্গাও বিনিয়োজক বাক্যের পারিভাষিক সঙ্গাই নির্দেশ করে ।
শ্রুতি শব্দের প্রধান অর্থ গুরু-পরম্পরা দ্বারা নিয়মতঃ অধীয়মান মন্ত্রকেই বলা হয় । পরন্তু ব্যাখ্যেয়-ব্যাখ্যাসম্বন্ধরূপ লক্ষণ দ্বারা এর প্রয়োগ ব্রাহ্মণ বচন সমূহের জন্যও হয়ে থাকে ।
0 মন্তব্য(গুলি)
Author
সত্যান্বেষী