বেদ বিষয়ে একটা প্রশ্ন সর্বদা আমাদের সামনে আসে , বেদে কি ইতিহাস রয়েছে ? বেদে অনেকেই শ্রীরাম , কৃষ্ণ , গণেশ থেকে শুরু করে ভৌগলিক পর্বত , নদী , স্থান রাজার রাজ্য আদির বর্ণনা মানেন ।
কথাটির তাৎপর্য হলো এই যে বেদে বিজ্ঞান , সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি , ধর্মনীতি , মানবজীবনের সকল আচার আচরণ সমূহের গুরুত্বপূর্ণ কিছুর বর্ণনা তো পাওয়া যায়ই , পাশাপাশি বেদে বিভিন্ন মত- মতান্তরের ব্যক্তি নিজ নিজ মতের প্রবর্তক যেমন কেউ নবী মুহাম্মদকে খুঁজে পায় , কেউ যিশু খ্রিষ্টকে খুঁজে পায় , কেউ শ্রীচৈতন্যদেবকে খুঁজে পায় , কেউ পায় শ্রীকৃষ্ণকে , কেউ রাধাকে , কেউ শ্রীরামচন্দ্রকে পায় , কেউ মা সীতাকে পায় , কেউ গণেশকে পায় , কেউ মা লক্ষ্মীকে পায় , কেউ মা দূর্গাকে পায় । জাকির নায়েক বেদে মক্কা ও কাবা শহরের বর্ণনা খুঁজে পেয়েছিল । কিন্তু বেদ তার স্বমহিমায় সর্বদা আপন গতিতেই সামনে এগিয়ে চলছে নিরন্তর না কেউ এর গতিরোধ করতে পারে , না কেউ এর মহিমা ম্লান করতে পারে ।
মূলত আমাদের এই উপমহাদেশে যতগুলো মানুষের বাবা মা তাদের নাম সংস্কৃত কোন শব্দ রেখেছে , বিশেষত হিন্দু , বৌদ্ধ , জৈন , শিখ এদের প্রায় সকলের নাম ই তৎসম কোন শব্দ , এদের প্রায় সবার নাম ই দেখবেন বেদের পিডিএফ বা ডক ফাইলে সার্চ দিলে আলাদা পদ অথবা যুক্তবর্ণ আকারে বেদে পাওয়া যাবে! কারণ উপমহাদেশে ভাষার উৎপত্তি ই বেদ থেকে । তাই আজ আমরা যে সব নাম খুব কমনলি বা খুব পরিচিত হিসেবে দেখতে পাই সে সব নাম মূলত বেদ থেকেই পরবর্তীকালে মানুষ নিয়ে নিজেদের ছেলেমেয়ের নাম রাখত ।

অর্বাচী সুভগে ভব সীতে বন্দামহে ত্বা।যথা নঃ সুভগাসসি যথা নঃ সুফলাসসি।।অনুবাদ- হে সৌভাগ্যদাতা, যেভাবে লাঙ্গলের হল দিয়ে টানা , নিচে চলমান রেখা ( সীতা) ও যেভাবে ভূমি আমাদের জন্য সৌভাগ্যদায়ী ও সুফলা হয়, ঠিক তেমনি তুমিও আমাদের জন্য সৌভাগ্যদায়ী ও ফলপ্রদা হও , এই কামনা করি ।

ইন্দ্রঃ সীতাং নি গৃহ্নাতু তাং পুষানু যচ্ছতু।সা নঃ পযস্বতী দুহমুত্তরামুত্তরাং সমাম্।।
খেয়াল করুন এখানেও সীতা শব্দটি আছে । এই মন্ত্রের অর্থ হলো হে কৃষিজ্ঞানে দক্ষ , তুমি জল দ্বারা সমৃদ্ধ , এই আমাদেরও তাই করো, ভূমি কর্ষণকৃত বস্তুকে( সীতাং) হে ভূমি চাষকারী গ্রহণ করো । প্রকৃতির এই উর্বরতা সমৃদ্ধ হোক , বারেবার উত্তরোত্তর আমাদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য উৎপন্ন হোক ।
অর্থাৎ সীতা শব্দটির অর্থ হলো চাষের ভূমিতে ভূমিকর্ষক বা সহজ ভাষায় লাঙল দিয়ে তৈরী গভীর রেখা যাতে জল দেয়া হয় । এই শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে পবিত্র বেদে । পরবর্তীতে রামায়ণের যুগে রাজা জনক তার রাজ্যে কৃষিখেতের এই লাঙল দিয়ে করা খাদে এক কন্যা সন্তানকে কুড়িয়ে পান , আর তিনি তাই সেই কন্যার নাম রাখেন সীতা । অর্থাৎ বেদে সীতার কথা নেই , বেদে উৎপন্ন সীতা শব্দ থেকেই রাজা জনক তার কুড়িয়ে পাওয়া কন্যা সন্তানের নাম রেখেছেন সীতা যিনি পরে শ্রীরামের ধর্মপত্নীরূপে খ্যাত হন ।

সচন্তু যদুষসঃ সূর্যেন চিত্রামস্য কেতবো রামবিন্দন্।আ যন্নক্ষত্রং দদৃশে দিবো ন পুর্নযতো নকিরদ্ধা নু বেদ॥অনুবাদ- যখন উষা সূর্যের আলো সংযুক্ত হয়, তা সৃষ্টি করে অপূর্ব রমণীয় শোভা । এরপর দিবাভাগে আর দৃশ্যমান হয়না কোন নক্ষত্র , কেন ? তা কেউ জানেনা ।
অর্থাৎ রাম শব্দের অর্থ অতি রমণীয় , অতি সুন্দর ।
আবার রাম শব্দের আরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থ আছে যা হলো অন্ধকার । এটি রাত্রির সাথে সম্পর্কযুক্ত । যেমন ঋগ্বেদ ১০.৩.৩ নং মন্ত্রে এর প্রয়োগ আছে-
শভির্বর্ণৈরভি রামমস্থাৎঅর্থাৎ সূর্য উষাকালে তার অগ্নি দিয়ে রাত্রির অন্ধকারকে দূর করে।
এখানে রামম্ শব্দের অর্থ রাতের অন্ধকার ।
প্রফেসর মুনির উইলিয়ামস তার সংস্কৃত টু ইংলিশ ডিকশনারিতেও রাম শব্দের এই অন্ধকার অর্থের কথা উল্লেখ করেছেন ।
আর বেদে এবং বৈদিক কালেই এই সুন্দর শব্দটি সন্তানের নামকরণে ব্যবহার করতেন পিতামাতারা । যেমন পবিত্র ঋগ্বেদের ১০.১১০ নং সূক্তের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি হলেন ঋষি জমদগ্নির পুত্র রাম যাঁর নাম রাম জামদগ্ন্য অর্থাৎ জমদগ্নি থেকে উৎপন্ন পুত্র যার নাম রাম। তাঁকে জামদগ্নি ভার্গব নামেও ডাকা হতো কেননা তিনি ঋষি ভৃগুর বংশজ বলে ভার্গব এবং জমদগ্নির পুত্র বলে তার নাম জামদগ্নি ।
আখ্যা প্রবচনান্ (পূর্বমীমাংসা ১।১।৩০) পরস্তু শ্রুতিসামান্যমাত্রম্ (পূর্বমীমাংসা ১।১।৩১)
অর্থাৎ বেদে জমদগ্নি আদি শব্দ সামান্য (যৌগিক) শব্দ এবং পর প্রযুক্ত হয়েছে ।
অর্থাৎ বেদ মন্ত্রে জমদগ্নি বা কশ্যপ আদি যেসব শব্দ এসেছে সেগুলো কোন দেহধারী ব্যক্তির নাম নয় ৷ এ বিষয়ে প্রমাণ শতপথ ব্রাহ্মণেই রয়েছে ।
আর অযোধ্যার রাজা দশরথও অতি প্রচলিত সুন্দর এই শব্দটি দিয়ে নিজ পুত্রের নামকরণ করেছিলেন । আর নামকরণটি অত্যন্ত যথাযথ ও স্বার্থক ছিল । ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের ন্যায় রমণীয় , শোভনীয় আর কে হতে পারে!
এমনকি রঘুবংশের রাজধানী অযোধ্যার নামটিও নেয়া হয়েছে পবিত্র বেদ হতে । অযোধ্যা শব্দের অর্থ হলো যাকে যুদ্ধে জয় করা যায় না , অজেয় । আর পবিত্র অথর্ববেদের বিখ্যাত একটি মন্ত্রে ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট মানবদেহকে পুরী বা দূর্গ বা নগরীর সাথে তুলনা দিয়ে এর দৈবগুণ বর্ণনা করতে গিয়ে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে-
অষ্টাচক্রা নবদ্বারা দেবানাং পূরযোধ্যা।তস্যাং হিরণ্যযঃ কোশাঃ স্বর্গো জ্যোতিষাবৃতঃ।।(অথর্ববেদ, ১০.২.৩১)অনুবাদ- অষ্টচক্র ও নবদ্বার বিশিষ্ট মানবদেহ নামক এই দেবপুরী । এই হিরণ্যগুহা জ্যোতির্ময় ,সুখের সোপান , অজেয় এই পুরী ।
উল্লেখ্য যে মানবদেহের ৮ টি চক্র- রস, রক্ত, মেদ, মাংস, অস্থি, মজ্জা, শুক্র, ওজস ( কিছু কিছু ভাষ্যকার ওজস এর স্থানে ত্বকের কথা বলেছেন যেমন সায়ণ ও ভট্টভাস্কর) ।
এবং ৯ টি দ্বার বা পথ-
দুই চোখ,দুই কান,দুই নাক , মুখ , পায়ুপথ , যোনীপথ ।
আর এই অযোধ্যা শব্দ থেকেই রঘুবংশীয় পূর্বপুরুষগণ নিজেদের রাজধানীর শক্তিমত্তার গৌরব হিসেবে নগরীর নাম রেখেছিলেন অযোধ্যা।
আপনারাও নিজের নাম তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ হলে বেদের ডক বা পিডিএফ ফাইলে সার্চ দিয়ে দেখবেন , নিজেই দেখবেন অনেকের নাম ই বেদে পাওয়া যাচ্ছে! এই কারণেই বেদকে ভাষার জননী বলা হয় । কিন্তু পুত্র হতে যেমন পিতার জন্ম হয়না , পিতা হতেই পুত্রের জন্ম হয় , ঠিক তেমনি বেদ থেকেই ব্যক্তির নাম এসেছে , কোন ব্যক্তির নাম বেদে উল্লেখিত হয়নি ।
ঠিক এই কথাটাই পূর্ব মীমাংসা ১.১.৩১ এ বলা হয়েছে । এই সূত্রের শাবরভাষ্যে বলা হয়েছে-
বেদে ববর,প্রাবাহণি আদি নাম মনুষ্যবাচক প্রতীত হলেও তা মূলতঃ বায়ু নির্দেশক কেননা ' ববরেতি শব্দ কুর্বন্ বায়ুরভিধীয়তে ' - অর্থাৎ বায়ুর নাম ববর । অর্থাৎ বেদে যেসব নাম দেখলে মনে হয় এগুলো কোন মানুষের নাম তা আসলে কোন মানুষের নাম নয় ।
বেদ মন্ত্রে ইতিহাস নেই এই নিয়ে পৌরাণিক পরম্পরার ভাষ্যকার সায়ণাচার্য পূর্ব মীমাংসার এই ১.১.৩১ সূত্রটি ব্যবহার করে তার ঋগ্বেদ ভাষ্যের ভূমিকাতে বলেছেন -
"জৈমিনি সূত্র বা পূর্ব মীমাংসার ১.১.৩১ ' পরন্তু শ্রুতিসামান্যভাবম্' অর্থাৎ শ্রুতিতে যেকল নামের উল্লেখ রয়েছে তা ঐতিহাসিক বা ব্যক্তিবাচক নয় বরং ত শব্দানুকৃতি তথা অন্যাদি অর্থ বাচক ।"
( যদিও পরবর্তীকালে তার নিজের বলা এই কথা নিজেই ভঙ্গ করে বেদভাষ্যের শুরুতেই ঋগ্বেদে ইতিহাস , মনুষ্যের নাম ইত্যাদি দেখিয়ে এক সুবিশাল ভুল অনুবাদের বেদাঙ্গ বহির্ভূত রচনা করেছিলেন সায়ণাচার্য । এভাবে নিত্য বেদে তিনি অনিত্য ইতিহাস ভাষ্য করে বেদের নিত্যতার হানি ঘটিয়েছেন ৷ )
বেদ সার্বকালিক এবং সার্বভৌমিক । এর মধ্যে সাংসারিক বস্তু পাহাড় , নদী আদি মানুষের নাম নেই । বেদ সাংসারিক ইতিহাস ভূগোলের পুস্তক নয় । ইতিহাস ভূগোল বদলাতে পারে , বেদ বদলাতে পারে না । তাই বেদের মধ্যে অনিত্য ইতিহাস থাকতে পারে না । মনুষ্যের ঐতিহাসিক ক্রম বেদের উৎপত্তির পশ্চাতেই আরম্ভ হয়েছে । যেসব লোক বেদে শ্রী রাম , কৃষ্ণ , রাধা আদির ইতিহাস মানেন । তারা কিএটা মানবে যে , প্রত্যেক সৃষ্টিতে রামের বনবাসের কষ্ট ভোগ করতে হবে ? কি প্রত্যেক সৃষ্টিতে সীতার হরণ হবে ? কি প্রত্যেক সৃষ্টিতে কৃষ্ণের কারাগারে জন্ম নিতে হবে ? কি প্রত্যেক সৃষ্টিতে যাদব কুলের নাশ হবে ? না এটা কদাপি সম্ভব নয় । বরং সমস্ত সাংসারিক বস্তুর নাম বেদ থেকে নিয়ে রাখা হয়েছে । যেমন পুস্তকের কোন পংক্তিতে যদি কোন প্রসিদ্ধ ব্যক্তির নাম আসে তো এটা স্পষ্ট যে সেই ব্যক্তির আবির্ভাবের পরই সেই পুস্তক লেখা হয়েছে । কিন্তু বেদ তো সৃষ্টির প্ররম্ভেই এসেছে তো সেখানে বহুকাল পরে জন্মগ্রহনকারী কোন ব্যক্তির নাম কিভাবে থাকতে পারে ?

বিশ্বামিত্র জমদগ্নে বসিষ্ঠ ভরদ্বাজ গোতম বামদেব।
শার্দিনো অত্রিরগ্রভীন্নমোভিঃ সুসংশাসঃ পিতরো মৃদতা নঃ।।
(অথর্ববেদ ১৮.৩.১৬)
দেখেই সরল দৃষ্টিতে কী মনে হচ্ছে বিশ্বামিত্র,বসিষ্ঠ, গৌতম,জমদগ্নি, বামদেব, অত্রির মতো বিখ্যাত সব ঋষির নাম । কিন্তু না ।

(বিশ্বামিত্র) হে সকলের বন্ধু! (জমদগ্নি) হে অগ্নির প্রকাশক![যেমন শিল্পে ও যজ্ঞে] (বসিষ্ঠ) হে অত্যন্ত শ্রেষ্ঠ! (ভরদ্বাজ) হে বিজ্ঞান-বলের ধারণকারী! (গৌতম) হে অতিশয় স্তুতিকারী বা বিদ্যাকামনাকারী!(বামদেব) হে সর্বোত্তম শিষ্টাচারী![তোমরা সবাই] (সুংসশাসঃ)উত্তম রীতিদ্বারা সর্বদা শাসনকারী (পিতরঃ) হে পিতাগণ![রক্ষক মহাত্মাগণ] (নঃ) আমাদের (মৃডন) সুখী করুন (শর্দিঃ) বিজয়ী (অত্রিঃ) প্রাপ্তিযোগ্য জ্ঞানী পুরুষ (নমোভিঃ) অন্নের সাথে (নঃ) আমাদের (অগ্রভীৎ) গ্রহণ করেছেন ।ভাবার্থ: বিভিন্ন জ্ঞানী ও গুণান্বিত মহাত্মাদের খাদ্যাদি দ্বারা জগতের , জনসাধারণের বৃদ্ধি ও সুখ আনায়ন করা উচিত ।
এই যে বিশ্বামিত্র শব্দ মানেই কিন্তু একজন ব্যক্তি নয়, ঐতরেয় আরণ্যক ২.২.১ এ আমরা পাই-
বিশ্বং মিত্রং আসীদ্ কিম্ চ তস্মাদ্ বিশ্বামিত্রঃ অর্থাৎ বিশ্বের সকলের মিত্র যে সে ই বিশ্বামিত্র।
এই একই কণ্ডিকায় লেখা হয়েছে তং যদ্ দেবা অব্রুবন্ অয়ং বৈ নঃ সর্বৈষাং বাম ইতি তস্মাদ্ বামদেব ।
অর্থাৎ যিনি সবসময় সদাচার , শিষ্টাচারের পালন করেন তিনি বামদেব ।
এভাবেই প্রতিটি শব্দের প্রকৃত অর্থ জানলে দেখা যায় যা সরল চোখে দেখে ব্যক্তি মনে হচ্ছিল আসলে সেই ব্যক্তিদের নাম ই এই গ্রন্থের ভাষা হতে নামকরণ হয়েছে । মন্ত্রে এই শব্দগুলো নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম পরিচায়ক নয় বরং কোন শাব্দিক অর্থের নির্দেশক ।
"তস্মৈ নূনমভিদ্যবে বাচা বিরূপ নিত্যয়া"
ঋগবেদ ৮.৭৫.৬
হে যবিষ্ঠ্য=জগতো মিশ্রণকারিন্ ! হে সহসঃ+সূনো=সহসা বলেন যদুৎপাদ্যতে তৎ সহো জগৎ। সূতে জনয়তীতি সূনুর্জনয়িতা। হে জগতো জনয়িতঃ ! হে আহুত=সংসারপ্রবিষ্ট ! যদ্=যস্মাৎ। ত্বং+হ। তাবা=সত্যবান্। যজ্ঞিয়শ্চ=পূজ্যশ্চ। ভুবঃ=ভবসি। অতঃ সর্বত্র প্রার্থ্যসে ॥৩॥
পুরুষবিদ্যানিত্যৎবাৎ কর্মসংপত্তিঃ
সংজ্ঞাকরণং ব্যবহারার্থং লোকে ।
নিরুক্ত ১.২
"সদকারণবন্নিত্যম্" (বৈ০ দ০ ৪।১।১)
=> কারণ রহিত ভাবরূপ পদার্থ হলো নিত্য ৷
যে বস্তু সদা বিদ্যমান ও কখনো নিজের সত্তার জন্য অপর বস্তুর উপর নির্ভরশীল নয় তাকেই নিত্য বলে ৷ নিত্য বস্তু উৎপত্তি রহিত , নিরবয়ব ও ত্রিকালবর্তী হয় ।
বেদান্ত দর্শন-
অতএব চ নিত্যত্বম্।।
বেদান্ত দর্শন ১/৩/২৯
পদার্থঃ এই (বেদ) থেকে শুধুমাত্র নিত্যতা হয় ।
সৃষ্টির আদি থেকে বেদ যা ছিল, তাই আছে । তাই সত্যযুগ আসুক , কি ত্রেতা , দ্বাপর , কলিযুগ আসুক । বেদ তো বেদই, কোন কল্পে বা মতান্তরে তার পরিবর্তন হয় না এবং সদা সর্বদা বর্তমান । বেদ ঈশ্বরের নিত্য বিদ্যা , তার উৎপত্তি বা অনুৎপত্তি হতেই পারে না । অতএব তার বৃদ্ধি , ক্ষয় অথবা তাতে কোন পরিবর্তন ঘটতে পারে না । এইসব কারণে বেদ প্রতিপাদিত বৈদিক ধর্ম শ্বাশত , সত্য ও সনাতন ।

অন্তি সন্তং ন জহাত্যন্তি সন্তং ন পশ্যতি।
দেবস্য পশ্য কাব্যং ন মমার ন জীর্যতি ॥
অথর্ববেদ ১০.৮.৩২
অনুবাদঃ (অংতি সন্ত) সমীপবর্তী পরমাত্মাকে (ন পশ্যতি) দেখে না (অন্তি সন্ত) , সমীপবৰ্তী পরমাত্মাকে (ন জহাতি) ছাড়েও না (দেবস্য কাব্য) ঈশ্বরের কাব্য বেদকে (পশ্য) দেখো ; [ সেটি ] ( ন মমার) মরে না (ন জীৰ্যতি) জীর্ণও হয় না ।
[ ভাষ্যকারঃ পণ্ডিত ক্ষেমকরণ দাস ত্রিবেদী আর্যসমাজ ]
অর্থাৎ বেদ সকল যুগ ও কালের জন্য প্রযোজ্য । এর বাণী কখনো অপ্রাসঙ্গিক হয়না , অচল হয়না । বেদ মন্ত্রে ইতিহাস কিংবা ভৌগলিক নাম আছে এ ধরনের অহেতুক প্রলাপ অনর্থক । বেদ সর্বযুগেই সমানভাবে প্রযোজ্য এবং তা সর্বদা আধুনিক । যেখানে বেদ বলছে এটা সব যুগের জন্য প্রযোজ্য সেখানে কতিপয় বিকৃত মস্তিষ্ক প্রসূত অজ্ঞানীদের এহেন আচরণ হাস্যজনক যারা কিনা নানাবিধ ইতিহাস রাজার রাজ্য আদির বর্ণনা খুঁজে পান । কেউ খুঁজে পাচ্ছে জামাত , সালাত , কেউ পাচ্ছে যীশু , কেউ কৃষ্ণকে খুঁজে পাচ্ছে অনার্য দেবতা হিসেবে , কেউ ইন্দ্রকে দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে বধ করাচ্ছে । কেউ সিদ্ধু নদী যার যা খুশি মনগড়া জিনিস বেদে পেয়েই যাচ্ছে । এরকম ভাবেই স্বাধ্যায়বিহীন কিছু ব্যাক্তি বেদে নদী সূক্তের ভেতরে ইতিহাস খুঁজে পেয়েছে সিন্ধু নদী সহ নানান নদী । বেদের মধ্যে সরস্বতীর নাম সিন্ধু অনেকবার এসেছে । কিন্তু এটা ধরণীর কোন স্থান বিশেষের উপর বহমান নদীর নামে আসে নি ।


প্র সপ্তসপ্ত ত্রেধা হি চক্রমুঃ প্র সূত্বরীণামতি সিন্ধুরোজসা ।।১।।
পদার্থঃ (আপঃ) হে তোমার বিস্তৃত প্রবাহ! (বঃ) আপনার (উত্তমং মহিমানম্) উত্তম মহত্ত্ব কে (কারুঃ সু প্রবোচাতি) শিল্পী-সীমার কর্তা হেতু স্তুতিকর্তা প্রকৃষ্টরূপে বলেন (বিবস্বতঃ সদনে) বিশেষ বৈশিষ্ট্য সহ রাষ্ট্রের বিজ্ঞানস্থলে যিনি বসবাস করে, এমন বৈজ্ঞানিক রাজার বাসভবনে বা বিজ্ঞানভবনে (সপ্ত সপ্ত ত্রেধা হি প্রচক্রমুঃ) সাত-সাত করে তিন স্থানে, অর্থাৎ এক-এক স্থানে সাত-সাত হয়ে বহে (প্রসৃত্বরীণাম্) সেই ব্যাপ্ত ধারার (সিন্ধুঃ) বহনকারী (ওজসা-অতি) অতিবেগে বহে , সে অপ্ তত্ত্ব পদার্থ হলো দ্যুলোকে সাত রঙ্গের সূর্যের কিরণ , অন্তরিক্ষে সাত রঙের বৈদ্যুতিক ধারা আছে এবং সাতটি পৃথিবীতে সাত জলধারা আছে ।
ভাবার্থঃ আপ্ততত্ত্ব পদার্থ তিন লোকে সাত-সাত করে প্রবাহিত হয় । দ্যুলোকে সূর্যের সাতটি কিরণ , অন্তরিক্ষে বিদ্যুতধারা , পৃথিবীতে জলপ্রবাহ, এসবের জ্ঞানী বৈজ্ঞানিক শিল্পী রাজার রাজভবনে বা বিজ্ঞানভবনে প্রবচন করে, এর থেকে জ্ঞানলাভের জন্য ।

ভূম্যা অধি প্রবতা যাসি সানুনা যদেষামগ্রং জগতামিরজ্যসি ।।২।।
পদার্থ (সিন্ধো) হে স্যন্দনশীল অন্তরিক্ষস্থ জলপ্রবাহ ! (বরুণঃ) সবাইকে বহন করার যোগ্য বা আবশ্যক পরমাত্মা (তে মাতবে) আপনার গমন-প্রবাহের জন্য (পথঃ প্র-অদত্) মার্গকে তৈরি করে (ত্বং যত্) আপনি যে (বাজান্-অভ্যদ্রবঃ) অন্ন-ঔষুধী আদি পদার্থকে লক্ষ্য করে প্রবাহিত হন (সানুনা প্রবতা) পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে নিচে পর্যন্ত (ভূম্যাঃ-অধি য়াসী) ভূমির নিচে যায় (এষাং-জগতাম্-অগ্রম্) জঙ্গমাদির প্রথম সুখ সাধনের জন্য (যত্-ইরজ্যসি) যিনি পরিচরণ করেন ।
ভাবার্থঃ পরমাত্মার শক্তিতে জলপ্রবাহ পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে নিচের দিকে প্রবাহিত হয়, খাদ্য ঔষুধি ইত্যাদির উৎপত্তি তথা মনুষ্যাদি প্রাণির সুখসাধনার্থ গতি করে ।

অভ্রাদিব প্র স্তনয়ন্তি বৃষ্টয়: সিন্ধুর্যদেতি বৃষভো ন রোরুবৎ ।।৩।।
পদার্থঃ(ভাতুনা) অন্তরিক্ষস্থ জলসমূহ যখন বিদ্যুতের দ্বারা (শুষ্মম্) বল দ্বারা-বেগ কে (উদিয়র্তি) প্রেরিত করে (দিবিঃ স্বনঃ-যততে) তখন আকাশে এর শব্দ হয় (ভূম্যা-উপরি) ভূমির উপর (অনন্তম) বহুদূর পর্যন্ত যায় (অভ্রাত্-ইব) মেঘ থেকে (বৃষ্ট্যঃ স্তনয়ন্তি) বর্ষা শব্দ করে (বৃষভঃ-ন) বৃষভাদি (রোরুবত্) শব্দ করে (সিন্ধুঃ-যত্-এতি) স্যন্দনশীল অন্তরিক্ষস্থ জলসমূহ নিচে চলে আসে ।
ভাবার্থঃ বিদ্যুৎ থেকে তাড়িত মেঘের জল শব্দ করে ভূমিতে আসে এবং নিচু স্থানে দূর পর্যন্ত পৌঁছে , তা থেকে কৃষিকাজ ইত্যাদিতে উপকার নেওয়া উচিত ।

রাজেব যুধ্বা নয়সি ত্বমিৎসিচৌ যদাসামগ্রং প্রবতামিনক্ষসি ।।৪।।
পদার্থঃ(সিন্ধো) হে স্যন্দনশীল অন্তরিক্ষস্থ জলসমূহ ! (বশ্রা মাতরঃ) যে মায়েরা কামনা করে (ধেনাবঃ-ইব) গরুর ন্যায় , নদী (পয়সা) জলহেতুর জন্য (ত্বা শিশুম) জলদাতাকে [আপনাকে] আশ্রয় করে চলে (ত্বম্ রাজা-ইব যুধ্বা নয়সি) যেমন একজন যোদ্ধা-রাজা তার সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যায়, সেভাবে আপনি নদীকে পৃথিবীর পৃষ্ঠে নিয়ে যান (আসন প্রবতাম্-অগ্রম্) এই নদীগুলির সামনে প্রবাহিত হওয়াকে (সিচৌ-ইনক্ষসি) সেচের স্থানে প্রেরিত করে ।
ভাবার্থঃ পৃথিবীতে সেচ দিতে, নদী সমূহ পৃথিবীতে বহে । অন্তরিক্ষের জলরাশি এনাদের প্রেরক ।
ইমং মে গঙ্গে যমুনে সরস্বতি শুতুদ্রি স্তোমং সচতা পরুষ্ণ্যা।
অসিক্ন্যা মরুদ্বৃধে বিতস্তয়ার্জীকীয়ে শৃণুহ্যা সুষোময়া॥
পদার্থঃ- (গঙ্গে) হে গমনশীল নদী ! (যমুনে) হে অন্য নদীর সাথে মিশ্রিত হয়ে প্রবাহিত নদী ! (সরস্বতী) হে প্রচুর জল সমৃদ্ধ নদী ! (শুতুদ্রি) হে ক্ষিপ্র গতিশীল নদী ! (পরুষ্ণি) হে দীপ্তিময় কুটিলগামিনী নদী ! (অসিক্ন্যা) হে অশুক্ল অর্থাৎ কৃষ্ণ জল বিশিষ্ট নদী ! (মরুদ্ধৃধে) হে বায়ু দ্বারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত নদী ! (বিতস্তয়া) হে অবিদগ্ধা অর্থাৎ গ্রীষ্মকালেও শুকিয়ে যায় না এরূপ বৃহৎ কূল বিশিষ্ট নদী ! (আর্জীকীয়ে) হে পাড়সমূহকে বিধ্বংস করে সরল পথে এগিয়ে চলা নদী ! (সুষোময়া) সমুদ্রের সাথে (মে) আমার (ইমম্) এই (স্তোমং) অভিপ্রায়কে (সচত) তোমরা গ্রহণ করো, (আশৃণুহি) তোমরা সম্যকভাবে শ্রবণ করো৷
• গঙ্গা = "গঙ্গা গমনাৎ" [নিরু০ ৯।২৫]
• • • যমুনা = "যমুনা প্রয়ুবতী গচ্ছতীতি" [নিরু০ ৯।২৫]
• সরস্বতী = "সরস্বতী সর উদকনাম তদ্বতী" [নিরু০ ৯।২৫]
• • • শুতুদ্রি = "শুদ্রাবিণী ক্ষিপ্রদ্রাবিণ্যাশুতুন্নেব দ্রবতীতি বা" [নিরু০ ৯।২৫]
• পরুষ্ণ্যা = "ইরাবতী পরুষ্ণীত্যাহুঃ পর্ববতী ভাস্বতী কুটিলগামিনী" [নিরু০ ৯।২৫]
• • • অসিক্ন্যা = "অসিক্ন্যশুক্লাঽসিতা সিতমিতি বর্ণনাম তৎপ্রতিষেধোঽসিতম্" [নিরু০ ৯।২৫]
• মরুদ্বৃধে = "মরুত এনা বর্ধয়ন্তি" [নিরু০ ৯।২৫]
• • • বিতস্তয়া = "বিতস্তয়াবিদগ্ধা বিবৃদ্ধা মহাকূলা" [নিরুক্ত ৯।২৫]
• আর্জীকীয়ে = "আর্জীকীয়াং বিপাডিত্যাহুঃ ঋজীকপ্রভবা বা ঋজুগামিনী বা" [নিরু০ ৯।২৫]
• • • সুষোময়া = "সুষোমা সিন্ধুর্যদেনামভিপ্রসুবন্তি নদ্যঃ" [নিরু০ ৯।২৫]
( ঋগ্বেদ ১০|৭৫|১-৫ )
[ ভাষ্যকার স্বামী ব্রহ্মমুনি পরিব্রাজক , বিদ্যামার্তণ্ড ]

প্র সপ্তসপ্ত ত্রেধা হি চক্রমুঃ প্র সূত্বরীণামতি সিন্ধুরোজসা ।।১।।
হে (আপঃ) আপ্ত জন ! হে প্রাণগণ ! হে সর্বব্যাপক প্রভু ! (বঃ) আপনি মনুষ্যকে (উত্তমম) সব থেকে উৎকৃষ্ট ( মহিমানম্) মহান সামর্থকে (কারুঃ) ক্রিয়াশীল এবং মন্ত্রকে সাক্ষাতকারী বিদ্বান (প্র সু বোচাতি) উৎকৃষ্ট প্রকার উত্তম রীতিতে, খুব বর্ণন করেন । আপনি (বিবস্বতঃ সদনে) বিবিধ ঐশ্বর্যসমূহ বা লোকের আশ্রয় বা মহান আকাশে (সপ্ত সপ্ত ত্রেধা হি প্রচক্রমু) সাত-সাত এর তিন বর্গে কার্য করেন এবং জগতের নির্মাণ করেন এবং পালন করেন । (সৃত্বরীণাম্) সংসরণকারী সমস্ত শক্তির মধ্যে (সিন্ধুঃ) সমস্ত জগতকে বন্ধনে, নিয়ম ব্যবস্থায় রাখতে এবং বল দিয়ে (অতি প্র ক্রমতে) অনেক কার্য করেন এবং জগতের নির্মাণ আরম্ভ করেন ।
(২) জলের পক্ষেঃ
জলের উত্তম মহিমা অর্থাৎ মহান সামর্থের বর্ণন (কারুঃ) শিল্পী, কারিগর, প্রকৌশলী প্রকৃষ্ট প্রকারে বলতে পারেন, যে বিবিধ লোকের চাষের যোগ্য ভূমিখণ্ডের কোন স্থানে কেমন জল আছে । এই জল সাত সাত করে তিন প্রকারে প্রবাহিত হয় । আর নিরন্তর নিরন্তর প্রবাহসমূহের মধ্যে সব চেয়ে অধিক বেগে নদীরই প্রবাহ হয় । জলের প্রবাহের মূখ্য তিন প্রকার উপর থেকে নিচে, নিচে থেকে উপরে আর সমধারাতলে এবং এর সাথে দুই প্রকার তার অঙ্গবিদ্যা দ্বারা জানা উচিত ।
(৩) প্রাণীর পক্ষেঃ
প্রাণীর মহত্ত্ব এই যে, সে স্তুতিকর্তার বাণী, বেদে ব্যক্ত বাণীতে বলে । এবং ২১ রূপ হয়ে প্রাণ চলছে । গতিশীল শক্তিতে নিজের বলের কারণ সে ( (সিন্ধুঃ) সবকিছুকে বন্ধনকারী আত্মাই (অতি প্র) সব থেকে অধিক শক্তিশালী ।

ভূম্যা অধি প্রবতা যাসি সানুনা যদেষামগ্রং জগতামিরজ্যসি ॥২॥
পদার্থঃ(সিন্ধোঃ যাতবে) যেই প্রকার বেগেবান জল প্রবাহের যাওয়ার জন্য (বরুণঃ) তাকে অনেক শাখাতে বিভক্তকারী বা জলাধ্যক্ষ বিদ্বান প্রকৌশলী বা কৃষক তার (পথঃ) মার্গৌ নালী কুল্যা, ইত্যাদি কে (অরদত্)খনন করে, এবং ঐ জলরাশি (বাজান্ অভিদ্রবতি) ক্ষেতের অন্ন পর্যন্ত পৌঁছায়, (ভূম্যা অধি প্রবতা সাতুনাযাতি) নিজের অতি বেগের মাধ্যমে ঐ জল নিচু মার্গ দিয়ে যায় । (এষাম্ অগ্রম জগতাম্ ইরজ্যতি) সে জল এই জঙ্গম প্রাণীর মুখ্য জীবনের আধার হয়, একই প্রকার
(২) হে (সিন্ধো) সমস্ত প্রজার বন্ধনে এবং দুষ্টদের কম্পনে সামর্থ রাজন ! (তে) আপনার (যাতবে) প্রয়াণের জন্য (বরুণঃ পথঃ প্র অরদত্) আপনাকে বরণকারী শ্রেষ্ঠ জন অনেক মার্গ বানাবে । (যত্) যা দ্বারা (ত্বম্ বাজান্ অভি অদ্রবঃ) আপনি সংগ্রামের মত বেগে প্রয়াণ করতে পারেন এবং অনেক ঐশ্বর্যসমূহের প্রাপ্ত করতে পারেন । আপনি (প্রবতা সানুনা) উৎকৃষ্ট উন্নত মার্গে (ভূম্যাঃ অধি প্র যাসি) পৃথিবীতে গমন করুন । আপনি (এষাং জগতাম্) এই জঙ্গম প্রজার (অগ্রম্) সব চেয়ে মূখ্য অংশেরও (ইরজ্যসি) স্বামী ।
(৩) আধ্যাত্মে
বরুণ পরমাত্মা মুখ্য প্রাণের সঞ্চারণের জন্য দেহে অনেক মার্গ ইন্দ্রিয় রুপ বানিয়েছেন । ঐ মার্গে তিনি অন্নের গ্রাহ্য বিষয় পর্যন্ত পৌঁছায় । তিনি (পৃথিব্যাঃ) পার্থিব দেহে উত্তম রীতিতে অধিকার করেন
(৪) প্রভু পক্ষে
হে (সিন্ধো) দয়াসিন্ধো ! সব শক্তির সমুদ্র ! সর্বপ্রবন্ধক সর্বসঞ্চালক প্রভু ! (তে যাতবে) আপানাকে প্রপ্তির জন্য (বরুণ) আপনার ভক্ত জন অনেক জ্ঞান-মার্গ বানায়, আপনি সমস্ত ঐশ্বর্যসমূহের প্রভু, আপনি সমস্ত ভূমিতে মেঘের সমান সমস্ত উৎপন্ন প্রজাদের উত্তম ঐশ্বর্য দিয়ে থাকেন । এই জঙ্গম জীবেরও আপনি সর্বপ্রথম (ইরজ্যসি) সবার স্বামী ।

অভ্রাদিব প্র স্তনয়ন্তি বৃষ্টয়: সিন্ধুর্যদেতি বৃষভো ন রোরুবৎ ॥৩॥
(ভূম্যা উপরি) ভূমির উপর (দিবি) আকাশে (স্বনঃ) গর্জন-শব্দকারী মেঘ (যততে) ব্যাপ্ত হয় । (ভানুনা) সূর্যের প্রকাশ দ্বারা (অনন্তম্ শুষ্মম্) অনন্ত বলরূপ জল (উত্ ইয়াত) উপর উঠে যায় । ততপশ্চাৎ (অভ্রাত্ ইব) যেভাবে মেঘ হতে (বৃষ্টয়ঃ প্র স্তনয়ন্তি) বর্ষা হয়, এবং (সিন্ধুঃ) বেগ সহিত প্রবাহিত জলপ্রবাহ (যত্ বৃষভঃ ন রোরুবত্) যেভাবে বৃষভ ন্যায় গর্জন করে (এতি) আসে । সেই প্রকার (যত্) যখন (রোরুবত্) গর্জন করে (সিন্ধুঃ) রাষ্ট্র-প্রবন্ধক এবং শত্রু-কম্পক বীর সেনাপতি বা রাজা (বৃষভঃ) বৃহৎ বৃষভ বা মেঘের সমান (এতি) প্রয়াণ করে, তখন (বৃষ্টয়ঃ অভ্রাত্ ইব) যেমন মেঘ থেকে বৃষ্টিপাত হয়, সেই প্রকার (বৃষ্টয়ঃ) শত্রুকে বিনাশ করতে বা পতনের মত শক্তিসহ, তোপ আকাশে (প্র স্তনয়ন্তি) গর্জন করে নিচে পতিত হয়, সে (ভানুনা) নিজের তেজ সহিত (অনন্তম্ শুষ্মম্ উত্-ইয়র্তি) অনন্ত শত্রুশোষককারী উৎপন্ন করে । সে (দিবি স্বনঃ) আকাশে গর্জনকারী মেঘ তুল্য (ভূম্যা উপরি যততে) পৃথিবীতে উদ্যোগ করে, বিজয় লাভ করে ।
(৩) আধ্যাত্ম পক্ষেঃ
আত্মা হলো "সিন্ধু", সে (দিবি) মস্তকে (স্বনঃ= সু-অনঃ) উত্তম চেতনা , বা প্রাণশক্তির স্বামী হয়ে (ভূম্যাঃ উপরি যততে) এই পার্থিব দেহের উপর যত্নশীল হয়, তার উপর স্বামীবৎ উপযোগ করে । সে নিজের তেজ দিয়ে এই দেহে অনন্ত বল উৎপন্ন করে, মেঘ থেকে বৃষ্টির তুল্য হৃদপিণ্ডে রক্তধারা প্রবাহিত হয়, সে আত্মা এতে হর্ষিত হয়ে ব্যাপ্ত হয় ।

রাজেব যুধ্বা নয়সি ত্বমিৎসিচৌ যদাসামগ্রং প্রবতামিনক্ষসি ॥৪॥
(মাতরঃ শিশুম্ ইত্ ন) যেই প্রকার মাতা নিজের পুত্রকে প্রেমবশত প্রাপ্ত করেন, সেই প্রকারে, হে (সিন্ধো) সবাইকে নিজের সাথে বন্ধনকারী এবং সবার পাপ হরণকারী বা সবাইকে প্রেরিতকারী প্রভু ! স্বামী ! (বাশ্রাঃ) আপনাকে স্মরণকারী মনুষ্য, প্রজা, (শিশুম্ ত্বা) সবার ভিতর গুপ্ত রূপে ব্যাপ্ত, বা প্রশান্ত রূপে বিদ্যমান আপনাকেই (অভি অর্ষন্তি) লক্ষ্য করে আপনার দিকে যায় । (ধেতবঃ বাশ্রাঃ পয়সা ইব) যেই প্রকার গাভী পোষক দুধ দিয়ে নিজের সন্তানের দিকে ঝুঁকে, সেই প্রকার (বাশ্রাঃ) স্তুতিশীল মনুষ্য (ত্বা অভি অর্ষন্তি) আপনার দিকেই গমন করে । (যুধ্বা রাজা ইব) যুদ্ধশীল রাজা যে প্রকার (সিচৌ) শরবর্ষী সৈন্যসমূহকে আগে নিয়ে যান, সেই প্রকার (ত্বম ইত্) আপনিই (সিচৌ) সেচনকারী, নিষেক আদি দ্বারা সন্তান উৎপাদনকারী সমস্ত নর-নারী জীবকে (নয়সি) চালনা করেন, (যত্) তাই আপনি (প্রবতাম্ আসাম্) সম্মুখে অগ্রসরণকারীদের (অগ্রম্) আগের মূখ্য পদকে (ইনক্ষসি) প্রাপ্ত হন, এতে সবার সম্মুখ আপনিই । আর যেই প্রকার প্রবাহমান নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রমুখ মুখ্য সিন্ধু অর্থাৎ বেগবান নদ প্রমুখ হয়, অন্যদের নিজের সহিত নিয়ে যায় এবং নদীসমূহ নিজের জল সহিত তার সাথে মিলে যায় । সেই প্রকার সমস্ত প্রজা সেই প্রভু স্বামীর দিকে গমন করে এবং তিনিই নিজের সাথে পরমধামে নিয়ে যান । এই প্রকার মুখ্য প্রাণের সাথে দেহগত অন্য প্রাণেরও ব্যবহার জানা উচিত ।

অসিক্ন্যা মরুদ্বৃধে বিতস্তয়ার্জীকীয়ে শৃণুহ্যা সুষোময়া॥৫
সায়ণাচার্য এই মন্ত্রে দশ নদীর বর্ণনা মেনেছেন । এবং বলেছেন তোমরা আমাদের স্তুতিকে শোন ।
কিন্তু বেদের তাৎপর্য কখনোই ভৌগলিক স্থিতির বর্ণনা করে না । যাস্কাচার্য এবং স্বামী দয়ানন্দজীর মতে বেদ বিশ্বজনীন জ্ঞান , এতে কোন ইতিহাস ও ভুবিদ্যা বিষয়ক জ্ঞান নেই ৷ যদি কোন নির্দিষ্ট নদীকে এই সকল নামে ডাকা হয় , বুঝতে হবে এই নাম সমূহ বেদ হতে এসেছে বেদে এই নাম সমূহ শব্দ হিসেবে পূর্বেই ছিল এবং নদীর বৈশিষ্ট্য এই নাম-শব্দের অনুরূপ ৷ এ কারনেই অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ শরীরের নির্দিষ্ট স্নায়ু , ধমনী ও শিরাকেও এই বৈদিক শব্দ-নামে ডাকা হয় ৷


অনবরত প্রবাহিত গঙ্গা হল ইড়া , যাহা আমাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানে পরিচালিত করে ৷ যমুনা হল পিঙ্গলা যাহা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সহিত সুশৃঙ্খলভাবে যুক্ত ৷ সরস্বতি হল সুষুষ্মা যাহা আমাদিগকে জ্ঞানের আনন্দের দিকে পরিচালিত করে ৷ পরুশ্নি (প্রভাবতী , ভাস্বতী , কুটিলগামিনী) যাহা মেরুদন্ডের ভার্টিব্রার মধ্য দিয়ে যায় জ্বলজ্বল করছে ৷ অসিক্ন্যা হল অন্ধকার , মারুদবৃধে হল সকল প্রবাহ দ্বারা বর্ধিত , শুতুদ্রী হল দ্রুতগতিসম্পন্ন ও পূর্ণ, বিতস্তা শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করে, অর্জীকীয়া ব্রেনের রুজুকা নামক কেন্দ্র হতে উদ্ভুত , একে বিপদ নামেও ডাকা হয়, যদি ইহা কখনও ছিড়ে যায় তবে মৃত্যু ঘটে এবং প্রাণসমূহ ও আত্মা শরীরকে কম্পিত করে ৷ এ কারনেই ইহাকে উরুনজারাও বলা হয় ৷ সিন্ধু হল প্রধান যাহাতে সকল প্রাণ ও (নদী) প্রবাহ সমাপ্ত হয় ৷ এভাবেই স্রোতসমূহ ও স্রোতসমূহের নাম জীবের প্রাণশক্তির সাধারন পরিভাষা বিবিধ শারিরীক , মানসিক ও আধ্যাত্মিক বর্ণনা ৷
(ঋগ্বেদ ১০|৭৫|১-৫)
[ ভাষ্যকারঃ পণ্ডিত জয়দেব শর্মা বিদ্যালঙ্কার , মীমাংসাতীর্থ ]

- নমস্কার l
0 মন্তব্য(গুলি)