মহর্ষি
যাস্কের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থ
'পুষ্প-স্থানীয়' এবং আধিদৈবিক প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থ 'ফল-স্থানীয়' ।[1]
এ দ্বারা স্পষ্ট হয় যাজ্ঞিক বেদার্থ অপেক্ষা আধিদৈবিক বেদার্থ প্রধান ।
যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ার সহিত আধিদৈবিক প্রক্রিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রয়েছে ।
যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ার পূর্বে বেদার্থের ত্রিবিধ প্রক্রিয়া
আধিদৈবিক
প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থের অভিপ্রায় বোধগম্যের পূর্বে 'দেব' শব্দের অর্থ
জানা আবশ্যক । যখন যজ্ঞের প্রকল্পনা অবিদ্যমান ছিলো, তখন বেদার্থের
আধিভৌতিক, আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্মিক এই তিন প্রক্রিয়া বিদ্যমান ছিলো । সেই
সময়ে বেদার্থের আধিদৈবিক প্রক্রিয়া এবং যজ্ঞপ্রকল্পনার সাথে অনন্তর-কালের
আধিদৈবিক প্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ত পার্থক্য বিদ্যমান ।
প্রাগযজ্ঞপ্রকল্পনা-কালে
ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত পদার্থ 'দ্যু' এবং 'পৃথিবী' এই দুইটি বিভাগে ভাগ করা
হতো । একেই তাৎস্থ্য উপাধি দ্বারা 'দেব' এবং 'ভূত' বলা হতো । [2]
তদনুসারে সমস্ত পার্থিব পদার্থের বর্ণন আধিভৌতিক প্রক্রিয়ার অঙ্গ ছিলো এবং
পৃথিবী থেকে ঊর্ধ্বভাগ পর্যন্ত সমস্ত পদার্থের বর্ণন ছিলো আধিদৈবিক
প্রক্রিয়ার অঙ্গ । সেই সময়ে 'দেব' শব্দের অর্থ 'দেবো দ্যুস্থানো ভবতি'
বুদ্ধিগ্রাহ্য হতো । উত্তর-কালে যজ্ঞপ্রকল্পনার সাথে সাথে নব্য দেবতাবাদ
এরও উদয় হয় এবং দেব শব্দের প্রাচীন অর্থ 'দেবো দ্যুস্থানো ভবতি' বচনের
সহিত ''দানাদ্বা দ্যোতনাদ্বা'' [3]
অংশ সংযোজিত হয় । তদনুসার অগ্নি, জল, বায়ু, নদী, পর্বত, বৃক্ষ, ওষধি,
বনস্পতি আদি পদার্থের গণনাও দেব শব্দে করা হয়েছে । কেননা মনুষ্য এসব
পদার্থের মাধ্যমে কোন না কোনভাবে অনুগ্রহপ্রাপ্ত হয়ে থাকে ।
অতঃ
প্রাগযাজ্ঞিক কালে আধিভৌতিক প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থের বহুতর অংশ নব্য
পরিবৃংহিত আধিদৈবিক প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থের অন্তর্গত হয়ে যায় এবং
আধিভৌতিক প্রক্রিয়ার স্বতন্ত্র সত্তা লুপ্ত হয়ে যায়। পরন্তু যাজ্ঞিক
প্রক্রিয়ার উদ্ভবের কারণে আধিভৌতিক বেদার্থ প্রক্রিয়া লুপ্ত হওয়ার পরও
বেদার্থপ্রক্রিয়ার 'ত্রিবিধত্ব' প্রতিষ্ঠিত থাকে ।
প্রারম্ভে আধিদৈবিক প্রক্রিয়ার অভিপ্রায় ব্রহ্মাণ্ডের কোন ক্রিয়া বা পদার্থের বর্ণন করা বুদ্ধিগ্রাহ্য হতো । এর আভাস নিরুক্ত [4] এবং ব্রাহ্মণ [5] শাস্ত্রে যত্র-তত্র বিদ্যমান । উত্তর-কালে আধিদৈবিক প্রক্রিয়ায় 'অধিষ্ঠাতৃবাদ'
এর অভ্যুদয় হয়। তদনুসার অগ্নি, বায়ু, সূর্য, চন্দ্র, ওষধি, বনস্পতি আদি
সমস্ত পদার্থে চেতনস্বরূপ দেব-বিশেষ এর কল্পনা করা হয় । সেই সময়ে আধিদৈবিক
প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থের প্রয়োজন অগ্নি, বায়ু, সূর্য আদি দেব এর মাধ্যমে
স্ব-অভিলষিত পদার্থসমূহের প্রাপ্তির জন্য এসবের প্রার্থনা করা সীমাবদ্ধ
মাত্র থাকে । [6] অপর শব্দে, অত্যুৎকৃষ্ট বিজ্ঞান
দ্বারা যুক্ত মন্ত্রসমূহের স্থিতি চারণ ভাট আদির স্তুতি-বচনসমূহের সমান
পরিণত হয় । এই কারণে প্রাচীন কালে বেদ এর আধিদৈবিক প্রক্রিয়া অনুসারে যে
বৈজ্ঞানিক অর্থ করা হতো, তা উত্তরকালে শনৈঃ-শনৈঃ লুপ্ত হয়ে যায় ।
দেবতার
স্বরূপ কীরূপ প্রকারে পরিবর্তন হয় এবং পরিবর্তনে কী কী 'বাদ' এর উদ্ভব
হয়েছে, এর সংক্ষিপ্ত নিদর্শন মহর্ষি যাস্ক 'দৈবতমীমাংসা' প্রকরণে
(নিরুক্ত. অধ্যায়. ৭) দর্শিয়েছেন ।
আধিদৈবিক প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থের বিস্তৃত বোধগম্যের জন্য বর্তমান সময়ে একমাত্র সহায়ক শাস্ত্র যাস্কীয় নিরুক্ত । তবে, ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে, বিশেষত শতপথ ব্রাহ্মণে এই প্রক্রিয়ার সম্বন্ধে কিছু নির্দশন যত্র-তত্র উপলব্ধ ।
নৈরুক্ত-প্রক্রিয়ার সম্বন্ধে একটি ভ্রান্তি
যাস্কীয়
নিরুক্তে মন্ত্রসমূহের আধিদৈবিক ব্যাখ্যা উপলব্ধ হওয়ায় লোকে
নৈরুক্ত-প্রক্রিয়ার অভিপ্রায় আধিদৈবিক প্রক্রিয়াই বুঝতো, পরন্তু এটি
অত্যন্ত ভ্রান্তিপূর্ণ ।
বস্তুতঃ নিরুক্ত শাস্ত্র 'শব্দ নির্বচন' এর পর্যায় । [7] এই নির্বচনও 'অর্থ-নির্বচন' , শব্দ-নির্বচন নয় । [8]
তদনুসার নির্বচন এর প্রধানতা দিয়ে যে মন্ত্রেরই ব্যাখ্যা করা হোক, তা
যাজ্ঞিক হোক, আধিদৈবিক হোক, অথবা হোক আধ্যাত্মিক ; সমস্ত ব্যাখ্যা
নিরুক্ত-প্রক্রিয়ানুসারী বোধগম্য হবে । যাস্কীয় নিরুক্তের 'দৈবত প্রকরণ'
দ্বারা বিদিত হয় যে, কিছু প্রাচীন নিরুক্তকার যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ানুসারেও
মন্ত্র-ব্যাখ্যা করতেন । [9]
এই
প্রকারে নিরুক্তের পরিশিষ্ট প্রকরণ দ্বারা বিদিত হয় যে, কতিপয় নিরুক্ত
গ্রন্থ আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার নিরীক্ষণেও রচিত হয়েছে । [10] অতঃ নৈরুক্ত প্রক্রিয়ার অর্থ কেবল আধিদৈবিক প্রক্রিয়া অবহিত হওয়া ভ্রান্তিপূর্ণ । [11]
আধিদৈবিক-প্রক্রিয়ার উপর যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ার প্রভুত্ব
ভারতযুদ্ধকাল
পর্যন্ত বেদার্থের আধিদৈবিক প্রক্রিয়া যাজ্ঞিক প্রক্রিয়া থেকে অভিভূত
হওয়াও কথঞ্চিৎ জীবিত রয়েছে । অতঃপর যাজ্ঞিক প্রক্রিয়া উক্ত
প্রক্রিয়াকে সর্বথা সমাপ্ত করে দেয় ।
যাজ্ঞিক
প্রক্রিয়ার প্রভাব এতোটাই হয়েছিলো যে, যাস্কীয় নিরুক্ত 'আধিদৈবিক
প্রক্রিয়ানুসারী' হওয়ার পরও দুর্গ এবং স্কন্দ নিরুক্তান্তর্গত
মন্ত্রসমূহে যাজ্ঞিক-বিনিয়োগসমূহ উদ্ধৃত করে যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ানুসারে
ব্যাখ্যাও করেছে । একই ভাব নিরুক্ত-সমুচ্চয়কার আচার্য বররুচি
দর্শিয়েছেন ।
এতো কিছু হওয়ার পরও বররুচি, দুর্গ এবং স্কন্দের ব্যাখ্যায়ও 'বিশুদ্ধ আধিদৈবিক প্রক্রিয়ানুসারী' বেদার্থের আভাস বিবিধ প্রকরণে উপলব্ধ ।
এই প্রকারে যাস্কীয় নিরুক্ত, এর ব্যাখ্যাসমূহ তথা ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে যত্র-তত্র উল্লেখিত 'ইত্যধিদৈবতম্'
আদি পদের সংকেতের আধারে বেদমন্ত্রের আধিদৈবিক-প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থ
বুদ্ধিগ্রাহ্য হয়ে থাকে । এতে প্রাচীন যজ্ঞ-প্রক্রিয়া দ্বারা অতিশয়
সহায়তা প্রাপ্ত সম্ভব । বর্তমান ভৌতিক বিজ্ঞান তথা জ্যোতিষ বিজ্ঞানের
মাধ্যমেও পর্যাপ্ত সহায়তা প্রাপ্ত সম্ভব ।
— বিদুষাং বশংবদঃ
প্রমাণ সূত্র
1. ‘অর্থং বাচঃ (বেদবাণ্যাঃ ) পুষ্পফলমাহ – য়াজ্ঞদৈবতে পুষ্পফলে ।' [নিরুক্ত. ১।২০]
2. 'দেবো দ্যু স্থানো ভবতীতি বা' [নিরুক্ত. ৭।১৫]
'অয়ং বৈ (পৃথিবী) লোকো ভূতম্ ।' [তৈ. ব্রা. ৩।৮।১৮।৫]
3. নিরুক্ত. ৭।১৫
4. নিরুক্ত. ৩।১২ – ‘য়ত্রা সুপর্ণা' মন্ত্রের ব্যাখ্যা
5. ব্রাহ্মণ শাস্ত্রের অনেকত্র
6. 'য়ৎকাম ঋষির্য়স্যাং দেবতায়ামার্থপত্যমিচ্ছন্ স্তুতিং প্রয়ুঙ্ক্তে তদ্দৈবতঃ স মন্ত্রো ভবতি ।' [নিরুক্ত ৭।১]
7. ‘বর্ণাগমো বর্ণবিপর্য়য়শ্চ দ্বৌ চাপরী বর্ণবিকারনাশৌ ।
ঘ্রাতোস্তদর্থাতি শয়েন য়োগস্তদুচ্যতে পঞ্চবিধং নিরুক্তম্' ।।
[দ্রষ্টব্য. কাশিকা. ৬।৩।১৯]
8. ব্যাকরণ শব্দ-নিবচনশাস্ত্র অর্থাৎ শব্দ-ব্যুৎপত্তিশাস্ত্র এবং নিরুক্ত অর্থ-নির্বচন অর্থাৎ শব্দ-প্রবৃত্তিনিমিত্তবোধক শাস্ত্র ।
এরূপ
ভেদ সম্বন্ধে পুরোপুরি অজ্ঞাত পাশ্চাত্য ম্লেচ্ছগণ এবং তাদের ভাবপুত্র
তথাকথিত ভারতীয় গবেষকগণ মহর্ষি যাস্কের নির্বচনসমূহকে অধিকতর অশুদ্ধ
মূর্খতাপূর্ণ এবং নিরর্থক বলার দুঃসাহস করেছে ।
দ্রষ্টব্য. সিদ্ধেশ্বরবর্মা কৃত 'এটোমোলোজি অব যাস্ক' তথা রাজবাড়ে সম্পাদিত নিরুক্ত (পুনা সংস্করণ) এর ভূমিকা ।
9. য়দ্দৈবতঃ স য়জ্ঞো বা য়জ্ঞাঙ্গ তদ্দেবতা ভবন্তি [নিরুক্ত. ৭।৪] । অথোতাভিধানৈ: সংয়ুজ্য হবিশ্চোদয়তি – ইন্দ্রায় বৃত্রঘ্নে, ইন্দ্রায় বৃত্রতুরে, ইন্দ্রায়াংহোমুচে, তানপ্যেকে সমামনন্তি [নিরুক্ত ৭।১৩] ।
ইন্দ্র
থেকে বৃত্রহা ইন্দ্র, বৃত্রতুর ইন্দ্র, অহোমুক, ইন্দ্রকে পৃথক মেনে এই
বিশেষণযুক্ত পদসমূহ নিঘুণ্ট-এ পরিগণনা করা যাজ্ঞিক প্রক্রিয়া অনুসারেই
উপপন্ন হয় । কেননা যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন বিশেষণ-বিশিষ্ট দেবতা
পৃথক্-পৃথক্ মানা হয়ে থাকে ।
দ্রষ্টব্য. 'তস্মাদ্ দেবতান্তরমিন্দ্রান্মহেন্দ্রঃ' [শাবরভাষ্যকৃত মীমাংসা ভাষ্য. ২।১।১৬]
10. নিরুক্ত এর ১৩ এবং ১৪তম অধ্যায়দ্বয়ে আধ্যাত্মিক অর্থের প্রধানতা বিদ্যমান ।
অধ্যাত্ম-স্তুতিসমূহের প্রাচীন সংজ্ঞা 'অতিস্তুতি' । অতিস্তুতিরূপে
ব্যাখ্যাকারী নৈরুক্তও দেবতাপ্রকরণে 'অগ্নি' এরই প্রথম নির্দেশ করেছে (অধ্যায়.১৩, খণ্ড. ১) । ১৪তম অধ্যায়ে স্পষ্টতয়া বর্ণিত হয়েছে - 'অথাত্মনো মহতঃ প্রথমং ভূতনামধেয়াননুক্রমিষ্যামঃ' (খণ্ড. ২৩) ; ‘অথৈতং মহান্তমাত্মানমেতানি সূক্তানি, এতা ঋচোঽনুপ্রবদন্তি' (খণ্ড. ২৪) ; তুলনা - 'অরেঽস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বসিতমেতদ্ যদ্যগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদঃ' [শতপথ ব্রাহ্মণ. ১৪|৫|৪|১০]
11.
নিরুক্তের টীকাকার দুর্গ-স্কন্দ-মহেশ্বর আদি তথা নিরুক্তসমুচ্চয়কার বররুচি
নৈরুক্ত প্রক্রিয়ার অভিপ্রায় কেবল আধিদৈবিক প্রক্রিয়াই বুঝেছেন ।
যে
স্থলেই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার বিরোধে নৈরুক্ত প্রক্রিয়ানুসারী অর্থ দর্শানো
হয়েছে, সেসব স্থলে সর্বত্র আধিদৈবিক অর্থই উপস্থিত করা হয়েছে । সম্ভবতঃ
এই ভ্রমের কারণে যাস্কীয় নিরুক্ত 'আধিদৈবিক প্রক্রিয়ানুসারী'-ই হবে ।
0 মন্তব্য(গুলি)
Author
সত্যান্বেষী