বেদার্থের একটি অন্যতম মহত্ত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া "ভাষাবিজ্ঞান"
। এই প্রক্রিয়া অনুসারে বেদ এর বিবিধ সন্দিগ্ধ পদসমূহের কা অর্থ করার জন্য
বিভিন্ন দেশের ভাষার শাব্দিক, আর্থিক এবং ব্যাকরণ সম্বন্ধী সাম্যতার মুখ্য
আধাররূপে স্বীকার করা হয়েছে ।
যদ্যপি
এই প্রক্রিয়ার উদ্ভব বিংশ (২০) বিক্রম শতাব্দী মানা হয়, পরন্তু উক্ত
প্রক্রিয়া এতদ্দেশীয় বিদ্বানগণের জন্য নবীন নয়, যা অনুপদই ব্যক্ত হয়ে
যাবে । তবে মধ্যযুগে যখন ভারতীয় ভাষা পরিবার থেকে ভিন্ন ম্লেচ্ছভাষায়
অধ্যয়নাধ্যাপনের প্রতি ধার্মিক প্রতিবন্ধকতা নিযুক্ত করা হয়, [1] তখন এই প্রক্রিয়া লুপ্ত হয়ে যায় ।
অধুনা-কালে যাহাকে ভাষাবিজ্ঞান বলা হয়, এর তিনটি অঙ্গ – উচ্চারণ, শব্দের স্বরূপ এবং শব্দের অর্থ । বৈদিক মনীষিগণ ভাষাশাস্ত্রের উক্ত তিন অঙ্গের নিরূপণের জন্য ক্রমশঃ শিক্ষা, ব্যাকরণ এবং নিরুক্ত শাস্ত্রের অন্বাখ্যান করেছেন । নিরুক্ত শাস্ত্রের মুখ্য প্রয়োজন বৈদিক শব্দের নিঃসন্দিগ্ধ অর্থের [2] জ্ঞান বোধগম্য করানো । অপর শব্দে, অমুক অর্থের প্রয়োগ কেনো হয়েছে, এর উপপত্তি দর্শানোই নিরুক্ত শাস্ত্রের প্রধান বিশেষত্ব । [3] শব্দসমূহের
বর্ণানুপূর্বী সমান হওয়ার পরও অর্থে মহদ্ অন্তর বিদ্যমান, এ কারণে
শব্দের বিবিধ অর্থসমূহের মূল কারণসমূহ ব্যক্ত করার জন্যই নিরুক্ত
শাস্ত্রে একটি শব্দের অনেক ধাতুর নির্দেশ দ্বারা অর্থের উপপাদন দর্শানো
হয়েছে । [4]
যাস্কীয়
নিরুক্তের 'অথ নির্বচনম্' প্রকরণ (২।১৪) এর তুলনা আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের
নিয়মের সাথে করলে অত্যন্ত স্পষ্ট বিদিত হয় যে, মহর্ষি যাস্ক না কেবল
অধুনাতন ভাষাবিজ্ঞানের নিয়ম আশ্রয়ণ করেছেন, যা বিংশ (২০) বিক্রম
শতাব্দীতে প্রসারিত হয়েছে এমনটা মানা হয় ; বরং ধ্বনিবিকার তত্ত্বের
বিষয়ে এমন নিয়মের বিশদ বিবরণ দর্শিয়েছেন, যা আধুনিক তথাকথিত
ভাষাশাস্ত্রীদের এখনও পর্যন্ত বুদ্ধিগ্রাহ্য হয় নাই তথা ভবিষ্যতেও
হওয়া অসম্ভব, কিন্তু ভাষায় ধ্বনিবিকার স্পষ্ট পরিলক্ষিত [5]
। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান অনুশীলন করলে অতি স্পষ্ট বিদিত হয়, মহর্ষি যাস্কের
ভাষাবিজ্ঞান= নির্বচন-শাস্ত্রের নিয়ম অধিক ব্যাপক এবং পূর্ণ ।
অর্বাচীন
এবং প্রাচীন ভাষাবিজ্ঞানে একটি মৌলিক ভেদ বিদ্যমান । আধুনিক তথাকথিত
ভাষাবিজ্ঞানবাদী অতি প্রাচীনকালে অর্থাৎ কোন সময়েও সমগ্র মানব জাতির এক
ভাষা বিদ্যমান ছিলো এমনটা স্বীকার করে না । তারা আধুনিক সমস্ত ভাষাকে
ভারতীয়, ইউরোপীয়, সেমিটিক, হৈমটিক আদি অনেক বিভাগে বিভক্ত করে ভাষার
মূলভূত বিভিন্ন ভাষার কল্পনা করে থাকে । আর্যার্বতের প্রাচীন
ভাষাতত্ত্ববিদগণের মত, সমস্ত মানব জাতির মূল এক । এক স্থান থেকেই সমগ্র
বিশ্বে মানব জাতির বিস্তার হয়েছে । এ কারণে সমগ্র মানব জাতির আদি মূল ভাষা
একই এবং তা হলো "প্রাজাপত্যা দেবী বাক্" অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষা
। এই দেবী বাক্-এ রাজসিক, তামসিক পদার্থের অতিসেবন তথা দেশকালের
পরিবর্তনের কারণে জিহ্বাশক্তিতে বিকলতার উদ্ভব হয় তথা বর্ণোচ্চারণ
শাস্ত্রের উপর বিশেষ ধ্যান না দেওয়ার দরুন ধ্বনিতে পরিবর্তন হয়ে
"ম্লেচ্ছ" ভাষার উৎপত্তি হয় । ম্লেচ্ছ শব্দের মূল অর্থ অব্যক্তোচ্চারণকেই
বুঝায়- "ম্লেচ্ছ অব্যক্তে শব্দে" । এই অব্যক্তোচ্চারণের কারণে অব্যক্তোচ্চারণকারীও ম্লেচ্ছে পরিণত হয় ।
অতএব ভারতীয় বাঙ্ময়ের সর্বাতিপ্রাচীন গ্রন্থ মনুস্মৃতিতে ভাষার কেবল দুইটি বিভাগই দর্শানো হয়েছে —'আর্যবাক্' এবং 'ম্লেচ্ছবাক্' ।[6] এই দৃষ্টিতে সমগ্র সংসারের ভাষা প্রাজাপত্যা দেবী বাক্ এর অপভ্রংশ=ম্লেচ্ছ=ম্লিষ্ট উচ্চারণ দ্বারা উদ্ভব হয়েছে ।
অতঃ
সব ভাষাতেই শাব্দিক, আর্থিক এবং ব্যাকরণ সম্বন্ধী নিয়মসমূহের কিছু
সাম্যতা হওয়া অবশ্যম্ভাবী । পাশ্চাত্য ম্লেচ্ছ তথাকথিত ভাষাবিজ্ঞানবিৎ
যেসব সেমেটিক ভাষাসমূহের মূল ভারতয়োরোপীয় ভাষাসমূহের মূল থেকে পৃথক্ মানে,
তাদের মধ্যে আরবী ভাষাতে সংস্কৃত ভাষার সাথে এক এমন সমানতা পাওয়া যায় যা
ভারতয়োরোপীয় ভাষা পরিবারের কোনো ভাষাতে উপলব্ধ হয় না। সেই সমানতা হচ্ছে
একবচন, দ্বিবচন এবং বহুবচন — এই তিন বচনের সংস্কৃত থেকে বিকৃত প্রাকৃত তথা
আধুনিক প্রান্তীয় ভাষাসমূহ থেকেও দ্বিবচন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এর অতিরিক্ত
আরবী এবং সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মগুলোর মধ্যেও বেশকিছু সমানতা আছে। এই
সমানতাগুলোর কারণে মানতে হবে যে সেমেটিক পরিবারের আরবী ভাষা এবং
ভারতয়োরোপীয় পরিবারের সংস্কৃত ভাষার পরম্পরার সাথে কিছু না কিছু সম্বন্ধ
অবশ্যই আছে।
অতঃ বৈদিক পরম্পরার বিদ্বান্গণ সপ্তদ্বীপা বসুমতীর মূল ভাষা সংস্কৃতই মেনেছেন, [7]
এজন্য স্বদেশে প্রচলিত বৈদিক শব্দের অর্থ করার জন্য ম্লেচ্ছ প্রসিদ্ধ
অর্থসমূহেরও স্বীকার করা হত । এই দৃষ্টিতে মহর্ষি জৈমিনি তাঁর মীমাংসা
শাস্ত্রে " ম্লেচ্ছপ্রসিদ্ধার্থপ্রামাণ্য" নামক এক অধিকরণ প্রণয়ন করেছেন । [8] মহর্ষি যাস্কও নিরুক্তের “অথনির্বচনম্"
(নির্বচন-নিয়ম প্রদর্শক) প্রকরণে (২।১-৪) স্বদেশে অব্যবহৃত কিন্তু
দেশান্তরে প্রসিদ্ধ ধাতুসমূহের স্বদেশীয় শব্দের নির্বচন করার বিধান করেছেন
যথা –
"অথাপি প্রকৃতয় এবৈকেষু ভাষন্তে, বিকৃতয় একেষু । শবতির্গতিকর্মা কম্বোজেষ্বেব ভাষ্যতে, বিকারমস্যার্য়েষু ভাষন্তে শব ইতি……. " (২।২)
ইস
বিবেচনা দ্বারা স্পষ্ট যে, বৈদিক আচার্যগণ বর্তমান ভাষাবিজ্ঞানের মূলভূত
সিদ্ধান্তকে বেদার্থে উপযোগ করার সম্বন্ধে পরিপূর্ণ জ্ঞাত ছিলেন । শুধু এই
নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের মূল ভাষা একমাত্র প্রাজাপত্যা দেবী বাক্
সংস্কৃত মানার কারণে এর শব্দার্থ সাম্যতার ক্ষেত্র অধুনাতন তথাকথিত
ভাষাবিজ্ঞানবাদিগণ অপেক্ষা অতিশয় বিস্তৃত ছিলো, কেননা আধুনিক
তথাকথিত ভাষা-বিজ্ঞানবাদীদের ন্যায় সংস্কৃতভাষাকে সেমিটিক আদি অন্য
তথাকথিত পরিবারের ভাষার সাথে কোনও প্রকার বিন্দুমাত্র সম্বন্ধ মানা হতো না
। পাশ্চাত্য ম্লেচ্ছ তথাকথিত ভাষাবিজ্ঞানবাদিগণ অনেক নিরাধার কল্পনার
কারণে ভাষাবিজ্ঞানের স্বরূপ অতীব বিকৃত করে দিয়েছে । এই কারণে যেখানে এই
ভাষা বিজ্ঞানের যথার্থ প্রয়োগ দ্বারা বেদার্থে সহায়তা প্রাপ্ত হওয়া
সম্ভব, সেখানে এসব ম্লেচ্ছদের কপোলকল্পিত দুরুপযোগের দরুন বেদার্থের হানি
হচ্ছে । শ্রেষ্ঠ পর্যায় 'আর্য' শব্দ লিথোনিয়ন ভাষার আধারে [8] 'কৃষক' অর্থ করা, "কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম" [9] 'কস্মৈ' পদের প্রশ্নার্থক বিন্যাস করা,[10] "উষো বাজেন বাজিনী' (ঋগ্বেদ. ৩।৬১।১) The Goddess of Dawn having flet horses[11] অর্থ করা এরূপ ভ্রান্তিপূর্ণ তথা কপলোকল্পিত সিদ্ধান্তের অন্তর্গত ।
বেদার্থের অন্য প্রক্রিয়াসমূহ
বেদার্থের কয়েকটি অন্য প্রক্রিয়ার নির্দেশ যাস্কীয় নিরুক্তে উপলব্ধ ।
যথা –
১. আখ্যানসময়ঃ (৭।৭)
২. নৈদানাঃ ( ৭।১২)
৩. নৈরুক্তাঃ (বহুত্র)
৪. পরিব্রাজকাঃ (২।৮)
এর
মধ্যে 'আখ্যানসময়ঃ' ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, 'পরিব্রাজকাঃ'
অধ্যাত্মপ্রক্রিয়ায় অন্তর্ভাব হয়ে থাকে । 'নৈদানাঃ' এবং 'নৈরুক্তাঃ'
এই দুইটি নির্বাচন প্রধান । (উভয় প্রক্রিয়ায় সাধারণ অন্তর বিদ্যমান)। এই
প্রক্রিয়া বেদার্থে মূল-ভূত স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া নয় । শব্দ-নির্বচন
দ্বারা এই প্রক্রিয়ার সম্বন্ধ আধিযাজ্ঞিক, আধিদৈবিক এবং আধ্যাত্মিক আদি
সমস্ত প্রক্রিয়ার সহিত ।
বেদার্থ প্রক্রিয়া দুটিই (২)
যদ্যপি মহর্ষি যাস্ক তাঁর নিরক্ত শাস্ত্রে 'বাচং শুশ্রুবাং ভবত্যফলামপুষ্পাম্' মন্ত্রাংশের ব্যাখ্যায় 'য়াজ্ঞদৈবতে পুষ্পফলে দেবতাধ্যাৎ বা'
বচন উল্লেখ করে বেদার্থের তিনটি প্রক্রিয়ার উল্লেখ করেছেন, পরন্তু যাজ্ঞিক
প্রক্রিয়া উত্তরকালীন হওয়ায় বেদ এর দৃষ্টিতে 'আধিদৈবিক' এবং
'আধ্যাত্মিক' এই দুটি প্রক্রিয়াই বেদার্থের বিশেষত্ব । যজ্ঞের
প্রাদুর্ভাব 'অধিদৈবত সৃষ্টিযজ্ঞ' এর বোধগম্যের জন্য হয়েছে । এই প্রকারে
অন্য প্রক্রিয়াও উত্তরকালীন কল্পিত ।
প্রমাণসূত্র
1. 'ন বদেদ্ য়াবনী ভাষাং প্রাণৈঃ কণ্ঠগতৈরপি' । বিস্তারিত দ্রষ্টব্য. মহর্ষি দয়ানন্দ জী সরস্বতী প্রণীত সত্যার্থপ্রকাশ গ্রন্থ ।
2. 'অথাপীদমন্তরেণ মন্ত্রেষ্বয়ম্প্রত্যযো ন বিদ্যতে' । [নিরুক্ত ১|১৫]
3. যথা- 'পাদ' শব্দের প্রয়োগ মনুষ্য-পশু-পক্ষী আদি কা পা, মৃত্তিকায় মনুষ্য আদি পায়ের চিহ্ন [দ্রষ্টব্য - 'সোমক্রয়িণ্যাঃ সপ্তমং পদং গৃহ্ণাতি' মীমাংসা, শাবর কৃত ভাষ্য. ৪।১।২৫
নং সূত্রে উদ্ধৃত], চতুর্থভাগ এবং ভাগমাত্র [মীমাংসা দর্শনের ৩য়, ৬ষ্ঠ,
১০ম অধ্যায়ে ৮ পাদ] অর্থে প্রযুক্ত হয় । এই বিভিন্ন অর্থের দরুন
নিরুক্তকার এই প্রকার দর্শিয়েছেন - 'পাদঃ পদ্যতেঃ, তন্নিধানাৎ পদম্, পশুপাদপ্রকৃতিঃ প্রভাগপাদঃ, প্রভামপাদসামান্যাদিত রাণি পদানি ।
4. যথা - অথাপ্যাদ্যন্তব্যাপত্তির্ভবতি — ওঘঃ মেঘঃ নাধঃ গাধঃ বধূঃ মধুঃ ইতি [নিরুক্ত ২।১,২] । এখানে সব উদাহরণে মহর্ষি যাস্ক 'হ' কে 'ঘ' এবং 'ধ' হবে এরূপ বর্ণনা করেছেন ।
মহর্ষি
যাস্কে বর্তমান ব্যাখ্যানুসারে এই শব্দসমূহ ক্রমশঃ উহ, মিহ, ণহ=নহ, গাহূ,
বহ, মহ ধাতু দ্বারা গঠিত হয়েছে । নৈরুক্তগণের মতানুসারে ঋগ্বেদ. ১।১১।৩ নং
মন্ত্রে ঘনবাচী ‘মঘ' শব্দের নিরুক্তি 'মংহ' ধাতু দ্বারা দর্শানো হয়েছে -
"স্তোতৃভ্যো মংহতে মঘম্" ।
তথাকথিত পাশ্চাত্য ভাষাবিজ্ঞানবাদী 'হ' এর স্থলে বর্গীয় দ্বিতীয় এবং চতুর্থ বর্ণের ব্যাপত্তি (পরির্বতন) স্বীকার করে নাই ।
(দ্রষ্টব্য. মঙ্গলদেব কৃত ভাষা-বিজ্ঞান)
আর্য বিদ্বানগণ পাশ্চাত্যদের এই ভ্রন্তিপূর্ণ মিথ্যাচার সপ্রমাণ খণ্ডন করেছেন ।
5. 'ম্লেচ্ছবাচশ্চার্য বাচঃ সর্বে তে দস্যবঃ স্মৃতাঃ ' । ১০।৪৫
6. সপ্তদ্বীপা বসুমতী ত্রয়ো লোকাশ্চত্বারো বেদা……. আদি প্রকরণ ।
[মহাভাষ্য. ১।১ প্রথমাহ্নিক]
7. অধ্যায়. ১ পাদ. ৩ অধিকরণ. ১০ । এর অপর নাম 'পিকনেমাধিকরণ'
8. লিথোনিয়ন ভাষায় 'ঋ' ( অর্থাৎ অর্) কৃষ্যর্থে প্রযুক্ত হয় ।
9. ঋগ্বেদ. ১০।১২১ -এ অসকৃৎ ॥
10. ভাণ্ডারকর অভিনন্দন গ্রন্থ, পুনা, ১৯১৭ সন
11. বাসুদেবশরণ অগ্রবাল কৃত 'উরুজ্যোতি' গ্রন্থ ।
0 মন্তব্য(গুলি)
Author
সত্যান্বেষী