যে
সময়ে বেদার্থের আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার প্রয়োগ লোপ হতে থাকে ,
সেই সময়ে বেদার্থের একটি নব্য প্রক্রিয়ার উদয় হয় । নাম – ঐতিহাসিক
প্রক্রিয়া ।
ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার উদ্ভবের কারণ
যখন
রজগুণ এবং তমগুণ বৃদ্ধির কারণে মনুষ্য জাতির জ্ঞানের সাধুত্ব লোপ পেতে
থাকে , তারা বেদ এর আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্মিক গূঢ় তত্ত্বের বোধগম্যে অসমর্থ
হতে থাকে, তখন ঋষিগণ মন্ত্রগত গূঢ় তত্ত্বকে বুদ্ধিগ্রাহ্য করানোর জন্য
মন্ত্রগত পদসমূহের আশ্রয়ে তদ্বিষয়ক আখ্যায়িকাসমূহ এর রচনা করতে থাকে ।
মহর্ষি যাস্ক উক্ত সিদ্ধান্তের প্রতিপাদন নিরুক্তে দুইবার দর্শিয়েছেন -
"ঋষেদংষ্টার্থস্য প্রীতির্ভবত্যাখ্যানসংয়ুক্তা"
(১০।১০, ৪৬)
অর্থাৎ - অর্থের সাক্ষাৎ কর্তা ঋষির প্রীতি হয়, যখন তার সাথে আখ্যান সংযুক্ত হয় ।
এই প্রকারে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া উদ্ভবের মূল আধার 'আধিদৈবিক' তথা 'আধ্যাত্মিক' প্রক্রিয়াই ।
ইতিহাস শব্দের অর্থ
ইতিহাস
শব্দের মূল অর্থ ' ইতি + হ্ + আস' অর্থাৎ এমনই ছিলো । এরূপ অর্থযুক্ত
ইতিহাস শব্দ ভূতকালের সত্য ঘটনা বর্ণন করে । পরন্তু গৌণী বৃত্তির মাধ্যমে
উক্ত ইতিহাস শব্দের ব্যবহার সেইসব কাল্পনিক পশু-পক্ষীদের আখ্যায়িকাসমূহর
জন্যও প্রযুক্ত হয়ে থাকে, যার বর্ণন 'অথাপ্যুদাহরন্তীমম্ ইতিহাসং পুরাতনম্'
এরূপ বচন উল্লেখ করে ভূতকালিক ঘটনার রূপে বর্ণন করা হয়ে থাকে । এমন
কাল্পনিক কাহিনীর জন্য ইতিহাস শব্দের প্রয়োগ রামায়ণ, মহাভারত আদি গ্রন্থে
অনেক উপলব্ধ । এজন্য কোনও গ্রন্থে ইতিহাস পদ উপলব্ধ হওয়া মাত্র তা
ভূতকালের বাস্তবিক ঘটনা হিসেবে গ্রহণ তথা বিবেচনা করা কদাপি উচিত নয় ।
সর্বপ্রথম বিচার্য করা আবশ্যক, কোনো স্থলে ইতিহাস পদ থাকলে সে স্থলে
ইতিহাস শব্দ মুখ্যার্থে প্রযুক্ত হয়েছে নাকি গৌণার্থে । অর্থাৎ সত্য ঘটনার
জন্য প্রযুক্ত হয়েছে নাকি কাল্পনিক বর্ণনের জন্য হয়েছে ।
বেদ এবং ইতিহাস
সমগ্র
প্রাচীন সংস্কৃত বাঙ্ময়, হোক তা বৈদিক অথবা দার্শনিক অথবা বৈজ্ঞানিক বা
লৌকিক, সব পক্ষই এক স্বরে বেদকে অপৌরুষেয় অথবা মহাভূত-নিঃশ্বসিত [1] মানে । পরন্তু এসব গ্রন্থেই বেদার্থ সম্বন্ধী ইতিহাস আখ্যান আদি পদসমূহের অসকৃৎ নির্দেশ উপলব্ধ ।
নিরক্ত শাস্ত্রের বিবিধ স্থলে মন্ত্রার্থ দর্শানোর পূর্বে "তত্রেতিহাসমাচক্ষতে" পদের প্রয়োগ উপলব্ধ । [2] ভগবান্ বেদ ব্যাস স্পষ্টতঃ বলেছেন –
'ইতিহাসপুরাণাভ্যাং বেদং সমুপবৃংহয়েৎ'
[আদিপর্ব]
একারণে বিচারণীয় যে, বেদার্থ বিষয়ক 'ইতিহাস' পদের বৈদিক স্বরূপ তথা প্রকৃত অর্থ কী ?
যাস্কীয়
নিরুক্ত শাস্ত্রে 'ইতিহাস' এবং 'আখ্যান' এই দুইটি পদের একার্থে প্রয়োগ
উপলব্ধ । নিরুক্তের গম্ভীর অনুশীলনের মাধ্যমে বিদিত হয়, নিরুক্তে প্রযুক্ত
'ইতিহাস' এবং 'আখ্যান' পদ বাস্তবিক (সত্য) ইতিহাস বাচক নয় ।
নিরুক্তকার মহর্ষি যাস্ক 'ত্বষ্টা দুহিত্রে' [ঋগ্বেদ. ১০।১৭।১] মন্ত্রের উপক্রমে 'তত্রেতিহাসমাচক্ষতে' পদের উল্লেখ করে মন্ত্রার্থের উপসংহার "মহতো জায়া বিবস্বতো ননাশ, রাত্রিরাদিত্যস্য, আদিত্যোদয়ে অন্তর্ধীয়তে" পদসমূহ দ্বারা দর্শিয়েছেন ।
এ
দ্বারা স্পষ্ট যে, উক্ত স্থলগুলোতে মহর্ষি যাস্ক দ্বারা প্রযুক্ত
ইতিহাস পদ কোনও বাস্তবিক ঐতিহাসিক ঘটনা বাচক নয়, বরং মন্ত্র-প্রতিপাদিত
অহোরাত্র-বিজ্ঞানের সুগমতা এর ব্যাখ্যা করার নিমিত্তে মন্ত্রার্থ দ্বারা
পূর্বে বর্ণিত কাল্পনিক আখ্যায়িকা বোধক । অন্যথা উপক্রম এবং উপসংহারে
একবাক্যতা গঠিত হতো না । [দ্রষ্টব্য - নিরুক্ত. ১২।১০, ১১]
মহর্ষি যাস্ক মন্ত্রার্থের পূর্বে এই প্রকার কাল্পনিক ইতিহাস বা আখ্যায়িকা বর্ণনার প্রয়োজন দুইটি স্থলে এরূপভাবে স্পষ্ট করেছেন,
'ঋষের্দৃষ্টার্থস্য প্রীতির্ভবত্যাখ্যানসংয়ুক্তা ।'
[নিরুক্ত. ১০।১০,৪৫]
অর্থাৎ
মন্ত্রার্থ-দ্রষ্টা ঋষির স্বদৃষ্ট মন্ত্রার্থকে বোধগম্য করানোর জন্য
সেটিকে কাব্যযুক্ত বর্ণনা দ্বারা সংযুক্ত করে বিবৃত করতে প্রীতি হয় ।
এই-ই অভিপ্রায় নিরুক্ত টীকাকার দুর্গ ইতিহাস শব্দের অর্থ নিরূপণ করার সময়
এই প্রকারে বর্ণনা করেছেন –
"য়ঃ কশ্চিদাধ্যাত্মিক শ্রাধিদৈবিক আধিভৌতিকো বার্থ প্রাখ্যায়তে দিষ্ট্য দিতার্যাবভাসনার্থং স ইতিহাস ইত্যুচ্যতে।"
[নিরুক্ত টীকা. ১০।২৬]
অর্থাৎ
যে-কোনো আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক অথবা আধিভৌতিক অর্থ ভাগ্যক্রমে বুদ্ধিতে
প্রকট হয়, তা প্রকট করার নিমিত্তে যে কথন (কাব্যযুক্ত বর্ণনা) করা হয়,
তাকে "ইতিহাস" বলা হয়।
মনুষ্যের
সহজাত প্রবৃত্তি যে, যখন তার কোনো বিষয়ে অভূতপূর্ব জ্ঞান প্রাপ্ত হয়,
তখন আরেকজনের নিকট প্রকাশ করার জন্য তার ইন্দ্রিয়ে এক প্রকার ব্যাকুলতার
উদ্ভব হয়। যতক্ষণ সেই মনুষ্যের প্রাপ্ত অভূতপূর্ব জ্ঞান অপরের প্রতি সে
প্রকাশ করতে না পারে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার ইন্দ্রিয় শান্ত হয় না ।
মনুষ্যের এরূপ সহজাত প্রবৃত্তির ন্যায় যখন কোনো ঋষির কোনো মন্ত্রের
অপূর্ব অর্থ প্রতিভাত হয়, তখন তিনি সেই অর্থ প্রকট করার জন্য অতিশয়
আকুল হয়ে পড়েন । এই বিজ্ঞান যত অতিশয় গূঢ় হয়, তা সরাসরি শব্দে ব্যক্ত
করা মাত্র অপর সেই সাধারণ ব্যক্তির হৃদয়ঙ্গম হওয়া অসম্ভব, অতঃ সর্ব
সাধারণ মনুষ্যের হৃদয়ঙ্গম করানোর জন্য সেই দৃষ্ট অর্থে বুদ্ধিগ্রাহ্যের
জন্য বিবিধ প্রকরণ সংযোজিত করা হয় অর্থাৎ আখ্যায়িকারূপ প্রদান করে
বর্ণনা করার স্পৃহা হয়ে থাকে ।
এই ভাব দ্বারাই ভগবান্ বেদব্যাসও 'ইতিহাসপুরাণাভ্যাং বেদং সমুপবৃংহয়েৎ' বাক্যে 'সমুপবৃংহয়েৎ'
পদের নির্দেশ করেছেন । অর্থাৎ বেদ এর গূঢ় অভিপ্রায়কে হৃদয়ঙ্গম করানোর জন্য
বেদার্থানুকূল কোন আখ্যায়িকার আশ্রয়ণ নেওয়া অত্যন্ত আবশ্যক এবং সেই
বেদার্থানুকূল আখ্যায়িকার কল্পনা বিনা পুরাতন ইতিহাস জ্ঞাত হওয়া অসম্ভব
এবং এই তত্ত্ব বিনা মন্ত্রার্থে রোচকতা তথা সরলতা আসে না । অতঃ বেদার্থের
গূঢ় তত্ত্ব বোধগম্যের জন্য পুরাতন ইতিহাস সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া অতি
আবশ্যক ।
বেদে
এমন অনেক বর্ণন উপলব্ধ, যা আর্ষ-পরম্পরা জ্ঞান সম্বন্ধে সর্বতোভাবে
অজ্ঞাত ব্যক্তির নিকট ঐতিহাসিক অর্থাৎ লৌকিক ইতিহাস সম্বন্ধী প্রতীত
হবে, পরন্তু বাস্তবে এসব বর্ণন কোনও ভাবেই ঐতিহাসিকরূপ অর্থাৎ লৌকিক
ইতিহাসের ন্যায় নয় ।
যেমন বেদ-এ বর্ণিত 'ইন্দ্র-বৃত্র যুদ্ধ' ।
মহর্ষি যাস্ক নিরুক্ত শাস্ত্রে (২।১৬) ইন্দ্র-বৃত্র যুদ্ধ প্রতিপাদক একটি মন্ত্রের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেছেন –
"অপাং জ্যোতিষশ্চ মিশ্রীভাবকর্মণো বর্ষকর্ম জায়তে, তত্রোপমার্থেন যুদ্ধ বর্ণা ভবন্তি।"
অর্থাৎ মেঘস্থ জলের সহিত বিদ্যুতের সম্বন্ধ হওয়ায় বৃষ্টি হয়, বেদে এতদ্বিষয়ক ইন্দ্র-বৃত্র যুদ্ধের যেসব বর্ণন বিদ্যমান, তা সব উপমারূপ-এ অর্থাৎ ইন্দ্র নাম বিদ্যুৎ এবং বৃত্রের নাম মেঘ-বাচক । বিদ্যুতের সহিত মেঘের সংঘর্ষ হওয়ায় তা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায় এবং বৃষ্টি হয়ে থাকে ।
তৎপশ্চাৎ মহর্ষি যাস্ক উক্ত সিদ্ধান্তকে স্পষ্ট করার জন্য বর্ণনা করেছেন –
''অহিবত্তু
খলু মন্ত্রবর্ণা ব্রাহ্মণবাদাশ্চ । বিবৃদ্ধয়া শরীরস্য স্রোতাংসি
নিবারয়াঞ্চকার । তস্মিন্ হতে প্রসস্যন্দির প্রাপঃ । তদভিবাদিন্যেষর্ভবতি
দাসপত্নীরহিগোপা….''
অর্থাৎ
ইন্দ্র-বৃত্র এর বর্ণনা মন্ত্রসমূহ এবং ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে অহি=মেঘ এর
ন্যায় বিদ্যমান । অহি (মেঘ) শরীরকে বৃদ্ধি করে জলের স্রোতকে গতিরোধ করে
দেয় । তা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে=নষ্ট হওয়ার পর জল গড়িয়ে পড়ে।
এই 'অহিবত্তু খলু….তস্মিন্ হতে প্রসস্যন্দির আপঃ' বাক্যের অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে পরবর্তী 'দাসপত্নীরহিগোপাঃ' ঋচায়।
এই
প্রসঙ্গ দ্বারা অতীব স্পষ্ট যে, মহর্ষি যাস্কের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী
মন্ত্র প্রতিপাদিত ইন্দ্র-বৃত্র যুদ্ধ বস্তুতঃ ঐতিহাসিক (লৌকিক ইতিহাস)
ঘটনা নয়, বরং এই জগতে সদা ঘটিত হওয়া বর্ষার ঘটনা । যুদ্ধের বর্ণন 'ঔপমিক' ।
আরও বিস্তারিত জানতে –
মন্ত্রসমূহে ইতিহাসের কল্পনার একটি উদাহরণ
বেদ
মন্ত্রে কোনো প্রকার ইতিহাস (লৌকিক) এর বিন্দুমাত্র উল্লেখ না থাকা
সত্ত্বেও উত্তরকালীন অবৈদিক তথাকথিত ভাষ্যকারগণ প্ররোচনার জন্য কীরূপ
ইতিহাসের কল্পনা করেছিলেন, তার একটি বিস্পষ্ট উদাহরণ দর্শানো হলো —
ঋগ্বেদ. ৮।৩।২১ নং মন্ত্রের মন্ত্রাংশ – "পাকস্থামা কৌরয়াণঃ"
। এখানে 'কৌরয়াণ' পদ বিবেচনীয় । নিঘণ্টু এর প্রবক্তা এই মন্ত্রকে
'কৌরয়াণ' পদের অনবগত সংস্কার অর্থে (প্রকৃতি প্রত্যয় বিভাগ সম্বন্ধে সরলতা
জ্ঞান যার নেই) বিবেচনা করে নিঘণ্টু এর চতুর্থ অধ্যায়ে দর্শানো হয়েছে ।[3] মহর্ষি যাস্ক এই অনবগত সংস্কার পদ "কৃতয়ান" অর্থে করেছেন । [4] অর্থাৎ
যিনি শত্রুর উপর আধিপত্য রাখেন এমন ব্যক্তি । এ দ্বারা স্পষ্ট যে,
নিরুক্তকার যাস্ক "কৌরয়াণ" পদের অর্থ 'কুরয়াণস্যাপত্যম্' পদের পক্ষে
দর্শান নাই । কেননা মন্ত্রের উক্ত পদের ব্যাখ্যায় 'কুরয়াণস্যাপত্যম্'
অর্থ মানলে 'কৌরয়াণ' পদ অন্য ঔপগব আদি অপত্য-প্রত্যয়ান্তের ন্যায়
বিস্পষ্ট অপত্যার্থ এর বোধক হবে, অনবগত সংস্কার থাকবে না । অস্তু, নিঘণ্টু
এবং নিরুক্তের পাঠ দ্বারা স্পষ্ট যে, এই দুইটি শাস্ত্রের প্রণেতাগণ
'কৌরয়াণ' পদ ঐতিহাসিক (লৌকিক) ব্যক্তিপরক 'কুরয়াণস্যাপত্যম্' পদবাচক অর্থ
দর্শান নাই । আরেকটি বিষয়, তাঁদের প্রবচনকাল পর্যন্ত মন্ত্রের উক্ত পদের
ঐতিহাসিক(লৌকিক) অর্থ করা হতো না ।
নিরুক্তের পশ্চাদ্বর্তী আচার্য শৌনক বৃহদ্দেবতায় (৬।৪২) দর্শিয়েছেন -
'পাকস্থাম্নস্তু ভোজস্য চতুর্ভির্য়মিতি স্তুতম্ ।'
অর্থাৎ ঋগ্বেদ ৮ম মণ্ডল, ৩য় সূক্ত, মন্ত্র সংখ্যা ২১-২৪ পর্যন্ত এর দেবতা 'পাকস্থামা ভোজ' এর দানস্তুতি ।
আচার্য
শৌনক 'পাকস্থামা' পদকে ব্যক্তিপরক দর্শিয়েছেন, পরন্তু 'কৌরয়াণ' পদের
কোনো ব্যাখ্যা করেন নাই । সম্ভবতঃ, তিনি মহর্ষি যাস্ক কৃত 'কৃতয়ান' পদের
অর্থ সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন । অতএব মন্ত্রের 'কৌরয়াণঃ' পদে অপত্যার্থ এর
কিঞ্চিৎ নিদর্শনও নেই । যদি 'কৌরয়াণঃ' পদের অর্থ অপত্যপ্রত্যয়ান্ত এর
পক্ষে হতো, তাহলে তিনি স্পষ্ট দর্শাতেন, এই মন্ত্রসমূহে 'কুরয়াণ এর পুত্র
পাকস্থামাকে দিয়ে দান বর্ণন' ।
শৌনকের এরূপ ইতিহাস কল্পনায় অবশিষ্ট অংশের পূর্তি শৌনক এর শিষ্য [5] কাত্যায়ন করেন । তিনি লিখেছেন –
'অন্ত্যাঃ কৌরয়াণস্য পাকস্থাম্নো দানস্তুতিঃ' ।
[ঋক সর্বানুক্রমণী]
অর্থাৎ - অন্ত্য এর চারটি ঋচা -- কুরয়াণ এর পুত্র পাকস্থামা নামক রাজার দানস্তুতিসমূহ ।
এই
বিবেচনা দ্বারা স্পষ্ট যে, নিঘণ্টু তথা নিরুক্ত এর প্রবক্তা মহর্ষি
যাস্কের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী 'পাকস্থামা কৌরয়াণঃ' মন্ত্রে কোনো পদ
ব্যক্তিবিশেষ বাচক নয়, পরন্তু যাস্কের উত্তরবর্তী বৃহদ্দেবতাকার শৌনক
'পাকস্থামা' পদকে ব্যক্তিবিশেষ বাচকের পক্ষে দর্শিয়েছেন । শৌনকের
উত্তরবর্তী কাত্যায়ন পাকস্থামা পদের সহিত 'কৌরয়াণ' পদকেও অপত্যার্থবাচক
পক্ষে দর্শিয়ে মূল প্রকরণটি সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক প্রকরণ করে দিয়েছেন এবং
তৎপশ্চাৎ অধুনাকালে অবৈদিক অর্বাচীন ভাষ্যকারগণ এই মন্ত্রসমূহে কোনো
কুরয়াণ এর পুত্র পাকস্থামা নামক রাজাকে অর্পিত দান স্তুতি মেধাতিথি কাণ্ব
করেছেন ।
কৌরয়াণ পদ বস্তুতঃ অপ্রত্যপ্রত্যয়ান্ত নয়
নিঘণ্টুতে
'কৌরয়াণ' পদের সহিত 'তৌরয়াণ' 'অহ্রয়াণ' এবং 'হরয়াণ' এই তিনটি অনবগত
সংস্কারপদ এর উল্লেখ রয়েছে । এই চারটি পদের 'য়ান' উত্তরপদ সমান এবং
চারটি পদেই বহুব্রীহি সমাসের পূর্বপদপ্রকৃতিস্বর বিদ্যমান । [6]
এজন্যে মহর্ষি যাস্ক এই চারটি পদের অর্থ ক্রমশঃ 'কৃতয়ান' 'তূর্ণয়ান'
'অহ্রীতয়ান' এবং 'হরমাণয়ান' করেছেন । যদি কথঞ্চিৎ কৌরয়াণ পদ অপত্যার্থ এর
পক্ষে ধরাও হয় তবুও তা অগ্রহণযোগ্য, কেননা কৌরয়াণ এর সর্বথা সমান
'তৌরয়াণ' পদ যে মন্ত্রে উল্লেখ রয়েছে, [7] সেই মন্ত্রে অপত্যার্থ (তুরয়াণ এর পুত্র) এর কথঞ্চিৎও উপপন্ন হওয়া সর্বথা অসম্ভব ।
কৌরয়াণ এবং তৌরয়াণ পদ উপলব্ধ সমগ্র বৈদিক বাঙ্ময়ে একই স্থলে প্রযুক্ত, অতঃ স্থানভেদেও অর্থভেদ ধারণার উপপন্ন হওয়া অসম্ভব ।
এ
দ্বারা স্পষ্ট বিদিত হয় যে, 'কৌরয়াণ' পদের মূল অর্থ 'কুরয়াণ এর অপত্য'
নয় । এই কপোলকল্পিত অর্থের প্রয়োগ প্ররোচনার জন্য পরবর্তীকালে করা
হয়েছে।
এই
প্রকারে স্পষ্ট যে, প্রারম্ভিক কালে বেদার্থের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মূলে
কোনও বাস্তবিক ঐতিহাসিক ঘটনার সহিত সম্বন্ধ কদাপি ছিলো না । শনৈঃ শনৈঃ এই
ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াতেও পরিবর্তন হয়েছে । বেদার্থ বোধগম্যের জন্য উদ্ভাবিত
সর্বথা কাল্পনিক আখ্যানসমূহে লৌকিক ঐতিহ্য বিশেষরূপে সংমিশ্রণ হতে থাকে ।
উপলব্ধ ব্রাহ্মণ শাস্ত্রেও এমন অনেক নিদর্শন উপলব্ধ, যা দ্বারা স্পষ্ট
প্রতীত হয় সেই কালেও অনেক বিদ্বান বেদের অর্থ লৌকিক ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহর
আধারে করেছেন।
নিরুক্তে উল্লেখিত 'তত্রেতিহাসমাচক্ষতে'
পদের প্রয়োগ যেরূপ শৈলীতে উপলব্ধ, এ দ্বারাও ধারণা করা যায় নিরুক্তের
প্রবচনকালেও এই কাল্পনিকবাদের প্রয়োগ প্রচলিত ছিলো । বিশেষরূপে মহর্ষি
জৈমিনি এবং মহর্ষি যাস্ক সামান্যরূপে এই কাল্পনিক ঐতিহাসিকবাদ এর খণ্ডন
করেছেন । [ দ্রষ্টব্য. পূর্বমীমাংসা. ১।১।২৭-৩২ তথা নিরুক্ত. ২।১৬॥ ]
শতপথ
ব্রাহ্মণের একটি স্থলেও বেদে বর্ণিত দেব-অসুর সংগ্রাম এবং অসুরের
পরাজয়কে লৌকিক ঐতিহাসিক দেবাসুর সংগ্রাম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রতিপাদন করা
হয়েছে ।
'' তস্মাদাহুর্নৈতদস্তি য়দ্দৈবাসুরং য়দিদমন্বাখ্যানে ত্বদুদ্যতে ইতিহাসে ত্বৎ ।"
[শতপথ. ১১।১।৬।৯]
অর্থাৎ উপরে প্রতিপাদিত দেব-অসুর এবং তাদের বৃত্ত সেটি নয়, যা অন্বাখ্যানে বর্ণনা করা হয়ে থাকে বা ইতিহাসমূলক(লৌকিক) কাহিনী ।
ব্রাহ্মণ
শাস্ত্রেও এমন কিছু প্রাচীন সংকেত উপলব্ধ হয়ে থাকে, যার আধারে বলা যায়
বেদ মন্ত্রের যেসব পদ উত্তরকালে ব্যক্তিবিশেষ বাচক পক্ষে গ্রহণ হয়,
সেসব পদ বৈদিক কালে ব্যক্তিবিশেষবাচক পক্ষে কদাপি গ্রহণ হতো না বা
বর্ণিত হতো না ।
যথা–
১. যজু. ১৩।৫৪ নং মন্ত্রে শ্রূয়মাণ 'বসিষ্ঠ' পদের ব্যাখ্যানে – "প্রাণো বৈ বসিষ্ঠঃ" [শতপথ. ৮।১।১।৬]
২. যজু. ১৩।৫৬ নং মন্ত্রে অয়মাণ 'জমদগ্নি' পদের ব্যাখ্যান – "চক্ষুর্বে জমদগ্নির্ঋষির্য়দেনেন জগৎ পশ্যতি, অথো মনুতে" [শতপথ. ৮।১।২।৩]
৩. যজু. ১৩।৫৭ নং মন্ত্রে শ্রূয়মাণ 'বিশ্বামিত্র' পদের ব্যাখ্যানে – "শ্রাত্রং বৈ বিশ্বামিত্র ঋষির্য়দেনেন সর্বতঃ শৃণোতি, য়দস্মৈ সর্বতো মিত্রং ভবতি" [শতপথ.৮।১।২।৩]
অর্থাৎ যজুর্বেদের এই মন্ত্রসমূহে প্রযুক্ত বসিষ্ঠ, জমদগ্নি এবং বিশ্বামিত্র পদ ক্রমশঃ প্রাণ, চক্ষু এবং শ্রোত্রবাচক । [8]
যদ্যপি
মহর্ষি যাস্ক, জৈমিনি এবং যাজ্ঞবল্ক্য বেদ-এ লৌকিক ইতিহাস দর্শানোর
বিষয়ে প্রতিবাদ করেছেন, তথাপি উত্তরকালে অবৈদিকতার প্রভাবে লৌকিক ইতিহাস
বাচক অর্থের প্রয়োগ ব্যাপকভাবে হয়েছে । অতএব যেই প্রকারে যাজ্ঞিক
প্রক্রিয়া দ্বারা পরাভূত হয়ে দুর্গ, স্কন্দ আদি নৈরুক্তগণ নিরুক্তান্তর্গত
মন্ত্রসমূহের ব্যাখ্যা যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ানুসারে দর্শিয়েছেন , সেই প্রকারে
এই লৌকিক ইতিহাসবাদ দ্বারা পরাভূত হয়ে উক্ত নিরুক্ত-টীকাকারগণ
সিদ্ধান্তরূপে ঐতিহ্যবাদ এর খণ্ডন করেও বিবিধ মন্ত্রের ব্যাখ্যায় এই
লৌকিক ইতিহাসবাদ দর্শিয়েছেন । একই দশা যাজ্ঞিকপ্রক্রিয়ানুগামী স্কন্দ,
বেঙ্কট মাধব, ভট্টভাস্কর এবং সায়ণ আদি বেদ ভাষ্যকারগণের । তারাও পদে পদে
যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ার উল্লঙ্ঘন করে মন্ত্রের ঐতিহাসিক (লৌকিক) ব্যাখ্যা করেছে
। সায়ণ তার স্বীয় ঋগ্বেদভাষ্য ভূমিকায় লৌকিক ইতিহাসের খণ্ডন দর্শিয়েছে,
পরন্তু বেদভাষ্যে প্রায়ঃ সর্বত্র স্থলেই লৌকিক ইতিহাসবাচক অর্থ করেছে ।
যা তার স্পষ্ট দ্বিচারিতার প্রকাশ ।
যেই
প্রকারে উত্তরকালে বেদার্থের অন্য প্রক্রিয়ার অবৈদিক কপোলকল্পিতমূলক
ব্যাখ্যা দর্শানো হয়েছে , সেই একই দশা এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার
ক্ষেত্রেও হয়েছে । মন্ত্রসমূহের শাব্দিক সমানতাকে গ্রহণ করে বেদে বিভিন্ন
মনুষ্যবাচক চরিত্রের দর্শানো হয়েছে, এবং নামমাত্র সমানতা দ্বারা অনেক
কাল্পনিক ইতিহাসমূলক অর্থ করা হয়েছে । এরূপ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার উৎকৃষ্ট
উদাহরণ 'মন্ত্ররামায়ণ' এবং 'মন্ত্রভাগবত' গ্রন্থ ।
পাশ্চাত্য
তথাকথিত গবেষকগণ বেদকে পৌরুষেয় গ্রন্থ মেনে অনেক প্রাচীন ভৌগোলিক তথা
মানবীয় ইতিহাস দর্শিয়েছে। প্রাচীন কালে বেদ-এ বাস্তবিক ইতিহাসের মান্যতা
দেওয়া ব্যক্তিগণও এই বিষয়ে এতোটা প্রয়াস করে নাই, কেননা সেই সময়ে সত্য
ইতিহাসবাদও প্রাচীন কাল্পনিক ইতিহাসবাদের এক পরিবর্তিত রূপ ছিলো । যদি তখন
সত্য ইতিহাসবাদের প্রবলতা বিদ্যমান থাকতো, যতটা অধুনাকালে দৃশ্যমান, তাহলে
বেদ এর অপৌরুষেয়বাদের খণ্ডনে বৌদ্ধ এবং জৈনগণ উক্ত ইতিহাসবাদকে
বিশেষরূপে আশ্রয়ণ করতো । পরন্তু বৌদ্ধ এবং জৈনদের দার্শনিক গ্রন্থসমূহে এই
বাদের উপযোগ সেই সাধারণরূপেই করা হয়েছে, যেই-রূপে মহর্ষি জৈমিনি এই বাদকে
পূর্বপক্ষে নির্দেশ করেছেন ।
শাখাগত ঐতিহাসিক পদসমূহের সামান্য অর্থ করার শৈলী
বেদের
সমস্ত শাখা বেদের রূপান্তর । বর্তমানে উপলব্ধ শাখাসমূহের তুলনাত্মক
অধ্যয়ন করলে প্রতীত হয়, এসব শাখার রূপান্তরীকরণে দুইটি প্রধান কারণ ছিলো
। ১. অপ্রসিদ্ধার্থ পদের স্থানে প্রসিদ্ধার্থ পদের নির্দেশ করে অর্থ বোধ
করানো এবং ২. যাজ্ঞিক কর্মকাণ্ডের জন্য বিবিধ সুবিধা বিন্যাস করা ।
এসব
শাখার বিভিন্ন মন্ত্রের সাদৃশ্যের মাধ্যমে এটিও স্পষ্ট যে, মন্ত্রের
বিবিধ স্থানে সামান্যার্থবাচক শব্দের স্থানে যাজ্ঞিক প্রক্রিয়া আদির
সুগমতার জন্য ব্যক্তি, জাতি, দেশ বিশেষ বাচক শব্দেরও প্রয়োগ হয়েছে ।
এই স্থলে একটি মন্ত্রের উপলব্ধ শাখার পাঠান্তর দর্শানো আবশ্যক –
'এষ বোঽমী রাজা' ( ৯।৪০)মাধ্যন্দিন
'এষ বঃ কুরবো রাজৈষ পঞ্চালা রাজা' (১১।১১)কাণ্ব
'এষ বো ভরতা রাজা' (১।৮।১০)তৈত্তিরীয়
'এষ তে জনতে রাজা' (১৫।৭)কাঠক
'এষ তে জনতে রাজা' (২।৬।৯)মৈত্রায়ণী
এই পাঠসমূহ লক্ষ্য করলে স্পষ্ট বিদিত হয় যে, মাধ্যন্দিনী সংহিতার পাঠ সর্ব প্রাচীন । উক্ত সংহিতার পাঠে সর্বনাম 'অমী' পদের উল্লেখ রয়েছে, উক্ত পদটির সাথে কোনও জাতি বা দেশবিশেষের সম্বন্ধ নেই ।
অপর
সংহিতাগুলোতে 'কুরবঃ ' 'ভরতাঃ' 'পঞ্চালাঃ' আদি জাতিবিশেষ বাচক পদ । এই
পদসমূহ দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, যে দেশে যে শাখার বিশেষ প্রচার ছিলো,
সেসব দেশের নিবাসীদের সম্বোধন করে অভিষিক্ত রাজার নির্দেশ করা হয়েছে ।
কাঠক
এবং মৈত্রায়ণী শাখায় যদ্যপি জাতিবিশেষ বাচক পদের প্রয়োগ হয় নাই, তথাপি
'জনতে' পদ নির্দেশ দ্বারা স্পষ্ট নির্দেশ করে, উক্ত দেশগুলোতে
বাস্তবিকরূপে কোনো ব্যক্তি বিশেষ আজন্ম রাজা হতেন না অর্থাৎ
প্রজাতন্ত্ররাজ্য [9] ছিলো, 'জনতা'-কেই সম্বোধন করা হয়েছে ।
এরূপ
বিশিষ্ট পদসমূহের অর্থও প্রাচীন আচার্যগণ সামান্যই দর্শাতেন অর্থাৎ যেমন
'এষ বোঽমী রাজা' মন্ত্র রাজ্যাভিষেক-এ উচ্চারণ করার সময় 'এষ' পদের
প্রারম্ভে অভিষিক্ত রাজবিশেষ এর নাম উচ্চারণ করা হতো (এষ যুধিষ্ঠিরো বো
ভরতা রাজা) এবং তা নামবিশেষ মন্ত্রের অবয়ব হতো না । এরূপভাবে 'অমী'
সর্বনামপদের স্থানে প্রযুক্ত 'কুরবঃ' 'ভরতাঃ' 'পঞ্চালাঃ' আদি পদও সেই
মন্ত্রের অবয়ব নয়। রাজার নাম প্রতি রাজ্যাভিষেকে পরিবর্তন হতো, পরন্তু
জাতি চিরস্থায়ী হয় । অতঃ শাখাকারগণ রাজনাম-স্থানাপন্ন 'এষ' সর্বনাম পদ
হিসেবে রেখেছেন, পরন্তু 'অমী' এর স্থানে 'পঞ্চালাঃ' আদি জাতিবাচক পদ রাখেন ।
এ দ্বারা স্পষ্ট যে, যেমন 'এষ যুধিষ্ঠিরো বো ভরতা রাজা' বাক্যে
যুধিষ্ঠির ব্যক্তিবিশেষের সহিত মন্ত্রার্থের কোনো সম্বন্ধ নেই, তদ্রূপ
'কুরবঃ, ভরতাঃ, পঞ্চালাঃ' পদের মন্ত্রার্থ এর সহিত কোনও সম্বন্ধ নেই । অতঃ
হতে পারে যে, এই পদসমূহকে উপলক্ষণার্থ মেনে এর সামান্য অর্থ দর্শানো
হয়েছে অথবা এসব পদের ধাত্বর্থকে গ্রহণ করে পদগুলোকে সামান্যার্থ বাচক
হিসেবে দর্শানো হয়েছে, উক্ত দুইটি মার্গ হওয়া সম্ভব ।
বৈদিক
পরম্পরা আচার্যগণ শাখাসমূহকে রূপান্তরিত হওয়া মন্ত্রের ঐতিহাসিক জাতি,
ব্যক্তি এবং দেশপরক নামের ধাত্বর্থ এর আধারে সামান্যার্থ প্রয়োগের
সিদ্ধান্তের পক্ষে । একারণে বৈদিক আচার্যগণ মন্ত্রসমূহের পাঠান্তর হওয়ার
পরও তাতে অর্থভেদ স্বীকার করেন নাই ।
ভগবান্ পতঞ্জলি স্পষ্ট দর্শিয়েছেন –
'য়দ্যপ্যর্থো নিত্যো য়া ত্বসৌ বর্ণানুপূর্বী সানিত্যা । তদ্ভেদাচ্চৈতদ্ ভবতি কাঠকং, কালাপকং, পৈপ্পলাদকম্ ইতি' ।
অর্থাৎ
ছন্দসমূহ= শাখাসমূহের বর্ণানুপূর্বী ভেদ হওয়ার পরও অর্থ নিত্য অর্থাৎ
একই, অর্থে ভেদ অবিদ্যমান । কেবল বর্ণানুপূর্বীর ভেদ হওয়ার জন্যই এসব
শাখায় মোদকং পৈপ্পলাদকম্ আদি শব্দের ব্যবহার হয়েছে ।
এই সিদ্ধান্তের প্রতিপাদন বায়ুপুরাণে এরূপ দর্শানো হয়েছে –
'সর্বাস্তা হি চতুষ্পাদাঃ সর্বাশ্চৈকার্থবাচিকাঃ।
পাঠান্তরে পৃথক্ ভূতা বেদশাখা য়থা তথা ॥'
[ বায়ু পুরাণ; ৬১তম অধ্যায় ]
অর্থাৎ
সেই চতুষ্পাদ্ এক পুরাণেরই প্রবচন ভেদে অনেক সংহিতার রচনা হয়, তাতে
পাঠান্তর অতিরিক্ত কোনও ভেদ নেই, সব সংহিতার একই অর্থ ছিলো, যেমনভাবে বেদ
এর শাখাসমূহে পাঠান্তর থাকার পরও অর্থ একই ।
এই বিষয়ে একই অধ্যায়ে পুনঃ বলা হয়েছে –
'প্রাজাপত্যা শ্রুতির্নিত্যা তদ্বিকল্পাস্ত্বিমে স্মৃতাঃ' ।
[ বায়ু পুরাণ; ৬১তম অধ্যায় ]
অর্থাৎ
প্রজাপতির মাধ্যমে প্রাপ্ত শ্রুতির পাঠ নিত্য । শাখাভেদে বিভিন্ন পাঠ সেই
প্রাজাপত্য নিত্য শ্রুতি এর বিকল্প= পাঠান্তর মাত্র ।
এই
বিবেচনার মাধ্যমে স্পষ্ট যে, শাখাসমূহের বিভিন্ন পাঠান্তর এর অর্থ সমান ।
এই দৃষ্টিতে শাখা মন্ত্রসমূহের যেখানে-যেখানে ঐতিহাসিক নাম এসেছে,
মন্ত্রার্থ দৃষ্টিতে উক্ত নাম সমূহের তাৎপর্যও সামান্যই গ্রহণ হবে,
অন্যথা 'কুরবঃ, ভরতাঃ পঞ্চালাঃ পদের এক অর্থ কীভাবে সম্ভব ? যদি একার্থের
উপপত্তি এর জন্য এসব পদের ধাত্বর্থ অনুসারে অর্থ দর্শানো হয়, তাহলে তা
মনুষ্যসামান্য বাচক হয়ে যাবে । এর অভিপ্রায় এটি নয় যে,
শাখা-মন্ত্রসমূহে পাঠান্তররূপে প্রযুক্ত ঐতিহাসিক পদসমূহে কোনও গুরুত্ব
নেই । ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এর গুরুত্ব অত্যাধিক, পরন্তু বেদার্থ দৃষ্টিতে এই
ঐতিহাসিক ব্যক্তি বা জাতিবাচক পদসমূহের বিন্দুমাত্রও গুরুত্ব নেই ।
উত্তরকালে
যখন শাখাসমূহ, ব্রাহ্মণগ্রন্থ এবং উপনিষদ এই সব গ্রন্থকে বেদরূপে মানতে
থাকে এবং এসব গ্রন্থকেও অপৌরুষেয় বা মহাভূত নিঃশ্বসিতরূপে গ্রহণ হতে থাকে,
তখন শাখা-মন্ত্রসমূহে পাঠান্তররূপে উল্লেখিত ঐতিহাসিক পদসমূহের ন্যায়
ব্রাহ্মণ ভাগে শ্রুত ঐতিহাসিক পদসমূহেরও সামান্য অর্থ দর্শানো হতে থাকে।
মীমাংসা দর্শনের ব্যাখ্যাতা শবর স্বামী আদি 'ববরঃ প্রাবাহণিরকাময়ত' (তৈ. সং. ৭।২।১০।২) ইত্যাদি পদের এই প্রকার অর্থ দর্শিয়েছেন । [10]
অর্থাৎ যে সিদ্ধান্ত প্রাচীনকালে কেবল শাখা-মন্ত্রসমূহের বিশিষ্ট পদের
অর্থ দর্শানোর পক্ষে সম্মতিদান করা হতো, এর অতিদেশ তারা ব্রাহ্মণ বচনেও
করেছেন, যা কেবল অনুচিতই নয়, বরং যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ার ইতিহাসেরও বিরুদ্ধ
।
প্রমাণসূত্র
1. শতপথ ব্রাহ্মণ. ১৪।৫।৪।১০
2. নিরুক্ত. ২।১০, ২৪ ইত্যাদি
3. নিরুক্ত. ৪।১
4. নিরুক্ত. ৫।১৫
5. ননু একো হি শৌনকাচার্য়শিষ্যো ভগবান কাত্যায়নঃ; কথং বহুবচনম্ । [ঋকসর্বানুক্রমণী. টীকা. ষড্গুরুশিষ্য]
6. নিরুক্ত
৫।১৫ 'তৌরয়াণ' পদের যে নিগম উদ্ধৃত করা হয়েছে, সেখানে তৌরয়াণ পদ
পূর্বপদ অন্তোদাত্ত উপলব্ধ হয় । পরন্তু নিঘণ্টুতে 'তৌরয়াণ' পদ
পূর্বপদাদ্যুদাত্ত পক্ষে পঠিত হয়েছে এবং দুর্গ-টীকার পাঠে সর্বত্র পূর্বপদ
আদ্যুদাত্ত বাচকই উপলব্ধ। অতঃ নিশ্চয়ই মূল নিরুক্তের মন্ত্র পাঠে স্বর
এর অশুদ্ধি হয়েছে । কৌরয়াণ পদও পূর্বপদাদ্যুদাত্ত বাচক । এ দ্বারা
তৌরয়াণ পদের পূর্বপদাদ্যুদাত্ত স্বরের পুষ্টি হয় ।
7. জাতং য়ত্ত্বা পরি দেবা অভূষন্মহে ভরায় পুরুহূত বিশ্বে । স তৌরয়াণ উপ য়াহি য়জ্ঞ মরুদ্ভিরিন্দ্র সখিভিঃ সজোষাঃ ।
[দুর্গ-টীকা ৬।১৫ -এ উদ্ধৃত]
8. তুলনা – বৃহদারণ্যক. ২।২।৪ নং শ্লোকে ইন্দ্রিয়সমূহের জন্য প্রযুক্ত গৌতম, ভারদ্বাজ আদি পদের সহিত ।
9. কাঠক
এবং মৈত্রায়ণী এর পাঠ দ্বারা স্পষ্ট যে, আর্যাবর্তে অতি প্রাচীনকালেই
প্রজাতন্ত্র রাজ্য স্থাপিত হয়েছিলো এবং প্রচলন ছিলো ।
10. মীমাংসা-ভাষ্য. ১।১।৩১
0 মন্তব্য(গুলি)
Author
সত্যান্বেষী