নিরুক্ত অর্থনির্বচন শাস্ত্র
নিরুক্তের
সহিত বেদার্থের অত্যন্ত নিগূঢ় সম্বন্ধ বিদ্যমান, কেননা
নিরুক্ত=নির্বচন শাস্ত্র, যা অর্থ এর আধারে প্রবৃত্ত হয়েছে, শব্দের
আধার ব্যাকরণ শাস্ত্র , যা পৃথক এবং মুখ্য বেদাঙ্গ । যদি নিরুক্ত
শাস্ত্র শব্দের আধারেই নির্বচন করতো, তাহলে এই শাস্ত্রের পৃথক্
বেদাঙ্গের কীরূপ আবশ্যকতা ছিলো । অতএব নিরুক্ত শাস্ত্র শব্দের অবলম্বনে
নয়, বরং অর্থের আশ্রয়ে নির্বচন বিদ্যা প্রতিপাদক শাস্ত্র ।
আরেকভাবে বলা যায় ব্যাকরণ শাস্ত্র শব্দনির্বচন, নিরুক্ত অর্থনির্বচন শাস্ত্র । দুইটি শাস্ত্রের এই ভেদ-ই প্রতিপাদন করে ।
(ক) নিরুক্ত টীকাকার দুর্গাচার্য লিখেছেন --
“য়স্মাৎ স্বতন্ত্রমেবেদং অর্থনির্বচনং, ব্যাকরণং তু লক্ষণপ্রধানম্” ।।
[ দুর্গাচার্য কৃত নিরুক্ত টীকা. ১।১৫ ]
অর্থাৎ– নিরুক্ত স্বতন্ত্র বিদ্যাস্থান, নির্বচনশাস্ত্র । ব্যাকরণ শাস্ত্র লক্ষণপ্রধান= শব্দপ্রধান ॥
(খ) প্রপঞ্চ হৃদয় —
“তান্যবয়বপ্রত্যবয়ববিভাগপূর্বকং স্বরবর্ণংমাত্রাদিভেদেনার্থনির্বচনায় নির্বচনানি" ।।
[ষড়ঙ্গ প্রকরণ পৃষ্ঠা সংখ্যা. ২৯ ত্রিবেন্দ্রম সংস্করণ]
অর্থাৎ – অবয়ব-প্রত্যবয়ব এর বিভাগপূর্বক স্বর-বর্ণ এবং মাত্রাদি ভেদ দ্বারা অর্থের নির্বচনে্য জন্য নিরুক্তশাস্ত্র নির্বচন বিদ্যা ।
(গ) অন্নংভট্ট ভাষিক সূত্র ––
"নির্বচনং নাম অর্থস্যান্বাখ্যানম্" ।।
[ভাষিক সূত্র ৩।৬ এর ব্যাখ্যায়]
নির্বচন শব্দের মুখ্যার্থ বা পর্যায় 'অন্বাখ্যান' শব্দ ।
(ঘ) নিরুক্তকার মহর্ষি যাস্ক প্রদর্শিত প্রমাণ–—
“তস্যোত্তরা ভূয়সে নির্বচনায়"
। উক্ত পঙ্ক্তি নিরুক্ত শাস্ত্রের কয়েক স্থলে বিদ্যমান । নিরুক্তকার
মন্ত্রার্থ করার সময় বলেন – পূর্ব প্রদর্শিত অর্থকে অধিক স্পষ্টতা
দর্শানোর জন্য উত্তরা ( পরবর্তী ) ঋচা (মন্ত্র) উপস্থিত করা হয় । অর্থকে
লক্ষ্য করে মহর্ষি যাস্ক ভিন্ন নির্বচন দর্শিয়েছেন, যা স্পষ্ট ।
(ঙ)
“তানি চেৎ সমানকর্মাণি সমাননির্বচনানি, নানাকর্মাণি চেন্নানানির্বচনানি, যথার্থং নির্বক্তব্যানি” ।।
[নিরুক্ত. ২ । ৭]
অর্থাৎ–যদি
শব্দ সমানার্থক হয়, তাহলে শব্দের নির্বচনও সমান হবে, যদি ভিন্ন
অর্থবিশিষ্ট হয়, তাহলে নির্বচনও ভিন্ন হবে । অর্থকে অনুসরণ করেই নির্বচন
করা আবশ্যক । এখানে সমানকর্মাণি এর অর্থ সমানার্থানি ।
এ কারণে নিরুক্তকার উক্ত প্রকরণের প্রারম্ভে 'অথ নির্বচনম্' পঙ্ক্তি উল্লেখ করে 'অর্থনিত্যঃ পরীক্ষেত' তথা 'য়থার্থং বিভক্তোঃ সন্নময়েৎ' এই বচনদ্বয় উল্লেখ করেছেন ।
অর্থাৎ
যেসব স্থলে প্রকৃতিপ্রত্যয় বোধগম্য হয় না, অর্থ সঠিক নয়, সেসব স্থলে
অর্থ অনুসারে নির্বচন করা আবশ্যক এবং এরূপভাবে উপর্যুক্ত স্থিতিতে
অর্থানুসারে বিভক্তি এর পরিবর্তন করাও উচিত ।
নিরুক্ত শাস্ত্রে বেদার্থ সিদ্ধান্ত
(১) “পুরুষবিদ্যাঽনিত্যত্বাৎ কর্মসম্পত্তির্মন্ত্রো বেদে” [নিরুক্ত. ১।২], "নিয়তবাচোয়ুক্তয়ো নিয়তানুপূর্ব্যা ভবন্তি” [নিরুক্ত. ১।১৫] তথা “ঋষিদর্শনাৎ স্তোমান্ দদর্শত্যৌপমন্যবঃ” [নিরুক্ত. ২।১১]
এই বচনসমূহ অনুসারে নিরুক্ত শাস্ত্র বেদকে অপৌরুষেয় এবং নিত্য মানে ।
(২) নিরুক্ত শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রতিটি মন্ত্রার্থের আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক তথা আধিযাজ্ঞিক এই তিন প্রক্রিয়া বিদ্যমান।
প্রাচীন ভাষ্যকার আচার্য স্কন্দস্বামী লিখেছেন —
“সর্বদর্শনেষু
চ সর্বে মন্ত্রা য়োজনীয়াঃ । কুতঃ ? স্বয়মেব ভাষ্যকারেণ সর্বমন্ত্রাণাং
ত্রিপ্রকারস্য বিপয়স্য প্রদর্শনায় 'অর্থং বাচঃ পুষ্পফলমাহ' [নিরুক্ত. ১।২০] ইতি য়জ্ঞাদীনাং পুষ্পফলত্বেন প্রতিজ্ঞানাৎ" ॥
[স্কন্দস্বামী কৃত নিরুক্ত টীকা. ৭।৫ ; ভাগ: ৩য়]
এ কারণে যেসব ভাষ্যে ত্রিবিধ প্রক্রিয়ায় অর্থ অনুপস্থিত, নিরুক্ত শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত অনুসারে তা সর্বথা অগ্রহণযোগ্য ।
(৩) “অথাপীদমন্তরেণ মন্ত্রেষ্বর্থপ্রত্যয়ো ন বিদ্যতে" [নিরুক্ত. ১ । ১৫]
অর্থাৎ
নিরুক্তকার মহর্ষি যাস্কের সিদ্ধান্ত অনুসারে বেদ-মন্ত্রের গহীন নিরুক্ত
বা নির্বাচনবিদ্যা বিনা বুদ্ধিগ্রাহ্য হওয়া সর্বথা অসম্ভব । অতঃ নির্বচন
এর আধারে মন্ত্রের যথার্থ অর্থের বোধগম্য হওয়া অতি আবশ্যক ।
বিবিধ
নির্বচন মন্ত্রগত পদসমূহ ব্যাপক অর্থের দ্যোতক । নিরুক্ত থেকে ভিন্ন
নির্বচনও হওয়া সম্ভব, এই বিষয় নিরক্তের মাধ্যমেই স্পষ্ট বিদিত হয়
যে, নিরুক্ত শাস্ত্রের সমস্ত নির্বচন তত্তদ্ ( অবগত সংস্কার তথা
অনবগতসংস্কার ) পদসমূহের যথার্থ অর্থকে উদ্দেশ্য করেই প্রতিপালন করা হয়েছে
; বেদার্থের যথার্থ তথা গহীন জ্ঞান বোধগম্যের জন্য অত্যন্ত সহায়কপূর্ণ ।
(৪) "নামান্যাখ্যাতজানীতি শাকটায়নো নৈরুক্তসময়শ্চ" । [ নিরুক্ত. ১ । ১২ ]
অর্থাৎ বেদ এর প্রতিটি পদই যৌগিক, প্রকৃতি-প্রত্যয় সংযোগে মন্ত্রের যথার্থ অর্থ প্রকাশ করে ।
বেদার্থের
গহিন জ্ঞান বোধগম্যের জন্য দর্শানো উক্ত সিদ্ধান্ত সমগ্র বেদের যথার্থ
স্বরূপ বুদ্ধিগ্রাহ্য হওয়ার জন্য পরম সহায়ক এবং বেদ মন্ত্রের গম্ভীর
বা ব্যাপক অর্থের জন্য পরম পোষক । এতদ্ব্যতীত বেদ এর ব্যাপক অর্থ সম্বন্ধে
কিঞ্চিৎ জ্ঞাত হওয়াও কদাপি অসম্ভব ।
এই
সিদ্ধান্তের যথার্থ স্বরূপ বোধগম্যের জন্য বিবিধ প্রকরণের বিস্তৃত
হৃদয়গ্রাহী সমাধানও দর্শানো হয়েছে । নিরুক্তকার মহর্ষি যাস্ক 'ইদমপীবরচ্ছির এতস্মাদেব' [নিরুক্ত ৪ । ১৩] ইত্যাদি বচন দ্বারা লৌকিক শব্দেরও ব্যাপক অর্থের প্রদর্শন এই যৌগিকবাদের আশ্রয়েই করেছেন ।
'
সব নাম ধাতুজ ' নিরুক্ত শাস্ত্রের এই মহত্ত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তথা
ব্যাকরণ এবং নির্বচন-বিদ্যা তত্ত্ব সম্বন্ধে পরিপূর্ণ অজ্ঞাত পাশ্চাত্য
তথাকথিত গবেষক এবং তার অনুগামী ভাব-পুত্রগণ বেদ মন্ত্রের যথার্থ অর্থ
বোধগম্যে সর্বথা অসমর্থই থাকবে ।
(৫) "বহ্বর্থা অপি ধাতবো ভবন্তি"
[মহাভাষ্য. ১।৩।১]
এই
বচন আর্ষ পরম্পরার মহান বৈয়াকরণ মহাভাষ্যকার মহর্ষি পতঞ্জলির ; যা
মহর্ষির পাণিনি প্রণীত ধাতুপাঠ দ্বারাও সিদ্ধ হয় । আর্ষ পরম্পরা এবং
সিদ্ধান্ত অনুসারে ধাতুসমূহের অনেকার্থত্ব বিদ্যমান ।
নিরুক্ত শাস্ত্রেও ধাতুসমূহের অনেকার্থতা সর্বত্র বর্ণিত হয়েছে । যথাঃ
(ক)
'মৃড সুখনে' 'মৃড হিংসায়াম্' (তুদা.), 'মৃড সুখে চ' (ক্রথা.) এই বচন
ধাতুপাঠে বিদ্যমান । নিরুক্তে উক্ত ধাতু দ্বারা ‘মৃডতির্দানকর্মা' [১০।১৫], 'মৃডয়তিরুপদয়াকর্মা, পূজাকর্মা বা' [১০।১৬] ইত্যাদি ভিন্ন-ভিন্ন অর্থে দর্শানো হয়েছে ।
(খ) ধাতুপাঠে ‘বিধ বিধানে' ( তুদা. ) পদ বিদ্যমান , নিরুক্তে [১০।২৩] 'বিঘতির্দানকর্মা' পদ বিদ্যমান ।
(গ) ধাতুপাঠে 'রিফ কত্তথনয়ুদনিন্দাহিংসাদানেষু, রিহ ইত্যেকে (তুদা.) পদ বিদ্যমান, নিরুক্তে [১০।৩৯] 'রিহন্তি লিহন্তি স্তুবন্তি বর্ধয়ন্তি পূজয়ন্তীতি' পঙ্ক্তি বিদ্যমান ।
(ঘ) ধাতুপাঠে 'তক্ষ তনূকরণে' (ভ্বা), 'তক্ষ ত্যচনে' (ভ্বা. ) বিদ্যমান । নিরুক্তে [৪।১৯] 'তক্ষতি' পদ 'করোতিকর্মা' অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে ।
এমন অনেক প্রমাণ দর্শানো যাবে । বেদমন্ত্রের সব ধাতুর অনেকার্থক বেদার্থের পরম ব্যাপকত্ব বোধক প্রদর্শন করে । এই গহীন তত্ত্ব গম্ভীরভাবে বোধগম্য হওয়া বিনা বেদ মন্ত্রের যথার্থ দর্শন কদাপি অসম্ভব ।
( ৬ ) নিরুক্ত শাস্ত্র বেদে অনিত্য অর্থাৎ ব্যক্তিবিশেষের ইতিহাস মানে না । "উপমার্থেন য়ুদ্ধবর্ণা ভবন্তি" [নিরুক্ত.২।১৬], তথা "ঋষের্দ্দষ্টার্থস্য প্রোতির্ভবত্যাখ্যানসংয়ুক্তা [নিরুক্ত.১০।৪৬]
মন্ত্রার্থদ্রষ্টা ঋষিগণ আখ্যান রূপে ব্যক্ত করার প্রীতি করেছেন, বেদে
কোনও অনিত্য ইতিহাস নেই । ঔপচারিক বা আলঙ্কারিক বেদে বিদ্যমান, এরূপ
সিদ্ধান্ত নিরুক্তের ।
(ক) স্কন্দস্বামী কৃত টীকায় (২য় ভাগ) উপস্থিত — "এবমাখ্যানস্বরূপাণাং
মন্ত্রাণাং য়জমানে নিত্যেষু চ পদার্থেষু য়োজনা কর্ত্তব্যা । এষ শাস্ত্রে
সিদ্ধান্তঃ । ….. ঔপচারিকো মন্ত্রেষ্বায়ানসময়ঃ । পরমার্থেন নিত্যপক্ষ ইতি
সিদ্ধম্ ॥ "
অর্থাৎ
এরূপভাবে যে-যে মন্ত্রে আখ্যান, ইতিহাসের বর্ণন বিদ্যমান, সেই সব মন্ত্র
যজমানপরক, অথবা নিত্য পদার্থের সহিত যোজনা করা উচিত । এটিই
নিরুক্তশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত। মন্ত্রসমূহে ইতিহাস, আখ্যান এর সিদ্ধান্ত
ঔপচারিক অর্থাৎ গৌণ, বস্তুতঃ নিত্যপক্ষই মন্ত্রের বিষয় ।
(খ) নিরুক্তসমুচ্চয় —
"ঔপচারিকোঽয়ং মন্ত্রেষ্বাখ্যানসময়ো নিত্যত্ববিরোধাৎ ।
পরমার্থেন তু নিত্যপক্ষ এবেতি নৈরুক্তানাং সিদ্ধান্তঃ" ।
অর্থাৎ,
মন্ত্রে ইতিহাস ঔপচারিক (গৌণ), কেননা লৌকিক ইতিহাস মানলে বেদ এর
নিত্যত্বে বিরোধ দোষ আসবে। পরমার্থ দ্বারা নিত্যপক্ষ সঠিক, ইহাই
নৈরুক্তগণের সিদ্ধান্ত ।
(গ) নিরুক্ত. ১০।২৭ এর দুর্গাচার্য কৃত টীকা —
“ইতিবৃত্তং
পরকৃত্যর্থবাদরূপেণ য়ঃ কশ্চিদ্ আধ্যাত্মিক আধিদৈবিক আধিভৌতিকো বার্থ
আখ্যায়তে দিষ্টয়ুদিতাবভাসনার্থং স ইতিহাস ইত্যুচ্যতে । স পুনরয়মিতিহাসঃ
সর্বপ্রকারো হি নিত্যমবিবক্ষিতস্বার্থঃ, তদর্থপ্রতিপত্তৃণামুপদেশপরত্বাৎ ॥ "
অর্থাৎ
"কোনো বর্ণন আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক, আধিভৌতিক অর্থ-জ্ঞানের প্রকাশের জন্য
প্রসিদ্ধ করা হয়, তাকে ইতিহাস বলে । সুতরাং সর্ব প্রকার ইতিহাস নিঃসংশয়
নিত্য তথা অবিবক্ষিতস্বার্থ হয়ে থাকে, অর্থাৎ মুখ্যতয়া দৃষ্টিতে ইতিহাস
অর্থকে বলা হয় না, কেননা ইহা কেবল সেই যথার্থ অর্থকে অবগত হওয়ার জন্য
উপদেশের দৃষ্টিতে হয়ে থাকে (প্রকৃতপক্ষে ইহা কোনও লৌকিক ইতিহাস নয়) ।
উপর্যুক্ত
ত্রয়ী প্রমাণ দ্বারা ইতিহাস বিষয়ে নিরুক্তের প্রসিদ্ধ ভাষ্যকারগণের
সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রমাণিত হয় যে, নিরুক্তের মূলভূত সিদ্ধান্ত বেদের
অপৌরুষেয়ত্ব তথা নিত্যত্ব স্বীকার করে এবং বেদে কোনো প্রকার ইতিহাস
সর্বথা অবিদ্যমান । এই সিদ্ধান্ত মহর্ষি দয়ানন্দ জীর ভাষ্যে যথাবৎরূপে
সর্বত্র বিদ্যমান ।
( ৭ ) নিরুক্ত অর্থের কারণ বিভক্তি বা স্বরকে মানে ।
'অর্থনিত্যঃ পরীক্ষেত' [নিরুক্ত. ২।১]
'য়থার্থং বিভক্তোঃ সন্নময়েৎ' [নিরুক্ত. ২।১], 'কথমনুদাত্তপ্রকৃতি নাম স্যাৎ, দৃষ্টব্যয়ং তু ভবতি' [নিরুক্ত. ১।৮]
ইত্যাদি বচনে স্পষ্ট বিভক্তি তথা স্বর এর ব্যত্যয় স্বীকার করা হয়েছে ।
অর্থের প্রধানতা নিরুক্তের সিদ্ধান্ত । বেদার্থ জ্ঞানের গম্ভীরতা কতটা
গহিন, তা উক্ত উপযুক্ত বচনসমূহ দ্বারা স্পষ্ট বোধগম্য হয় ।
(৮) নিরুক্ত পদপাঠ এর সাথে অর্থকে যুক্ত করা স্বীকার করে না, মাসকৃৎ এবং মা সকৃৎ [নিরুক্ত. ৫ ।২১] আদি দুই প্রকারের পদবিভাগ উপরোক্ত বচন সিদ্ধ করে ।
উক্ত ৭ এবং ৮ নম্বর সিদ্ধান্ত একমাত্র মহর্ষি দয়ানন্দ জীর ভাষ্যে সর্বত্র অত্যন্ত উত্তম রীতিতে উপলব্ধ ।
( ৯ ) 'অর্থ' এর প্রধানতার কারণ নিরুক্ত মন্ত্রার্থে ব্যত্যয়কে স্পষ্ট স্বীকার করা হয়েছে । 'য়থার্থ বিভক্তোঃ সন্নময়েৎ' [নিরুক্ত ২।১] অর্থাৎ-অর্থের অনুকূল বিভক্তি পরিবর্তন করা আবশ্যক । তথা নিরুক্ত. ৬।১
বচনে "আশুশুক্ষণিঃ" পদকে প্রথমান্ত হওয়ায় নিরুক্তকার “পঞ্চম্যর্থে বা
প্রথমা” এই বচন উল্লেখ করে শুধু মনসা বাচা-ই নয়, বরং কর্মণা ব্যত্যয়কেও
স্বীকার করেছে ।
ব্যত্যয়
এর প্রয়োগ তখনই করা আবশ্যক, যখন বেদ এর গম্ভীর অর্থের মার্গে বিভক্তি বা
বচনের বাধা উপস্থিত হবে । এইজন্যই নিরুক্তকার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন,
'অর্থনিত্যঃ পরীক্ষেত' । ব্যত্যয় এর সিদ্ধান্ত দয়ানন্দ-ভাষ্যের এক মহান্ ভূষণ ।
(১০) মন্ত্রে উল্লেখিত পদকেই দেবতা নয়, বরং মন্ত্রে উল্লেখিত পদের অর্থকেও দেবতা মানা হয় ; ইহাই নিরুক্তের সিদ্ধান্ত ।
দ্রষ্টব্য. নিরুক্ত. ৯। ১১
নং শ্লোকে 'বনস্পতি' পদের অর্থ 'রথ'-কে দেবতা বলা হয়েছে । নিরুক্তের
সিদ্ধান্ত, কেবল লিঙ্গ অর্থাৎ চিহ্ন দেখেই দেবতা সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া
কদাপি অসম্ভব । দ্রষ্টব্য. নিরুক্ত.১।১৭ ॥
"এক এব আত্মা বহুধা স্তূয়তে” [নিরুক্ত.৭।৪] বচন দ্বারা নিরুক্তকার ব্রহ্মকে বেদ এর মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় মেনেছেন । 'অগ্নি', 'বায়ু' আদি সব তাঁর গুণভেদ নাম ।
(১১)
নিরুক্ত শাস্ত্র বিনিয়োগকে অর্থানুসারী দর্শিয়েছে । মন্ত্রের যে
যথার্থ অর্থ হবে, তদনুসারই মন্ত্রের বিনিয়োগ হবে, অন্যথা বিনিয়োগ
অগ্রহণযোগ্য হবে । দ্রষ্টব্য. নিরুক্ত.১।১৬ ॥
এই উপর্যুক্ত প্রমাণসমূহ দ্বারা বেদার্থ সম্বন্ধে নিরুক্তের মৌলিক সিদ্ধান্তসমূহ অতি সংক্ষেপে নির্দেশমাত্র দেওয়া হয়েছে । এই সিদ্ধান্ত সমূহের বিস্তৃত তথা মহত্ত্বপূর্ণ নিদর্শন শুধুমাত্র মহর্ষি দয়ানন্দ জীর ভাষ্যেই সর্বত্র উপলব্ধ ।
মহর্ষি দয়ানন্দ জী ঋগ্বেদভাষ্যের নমুনা অঙ্কের প্রথম মন্ত্রের ভাষ্যের অন্তে বর্ণনা করেছেন —
“ কশ্চিদ্
ব্রূয়াৎ – সায়ণাচার্যাদিভির্নিরুক্তাদিপ্রামাণ্যয়ুক্তং ভাষ্যং বিহিতং কথং
দোষবদিতি ? অত্রোচ্যতে– নিরুক্তাদিবচনানি তু লিখিতানি, পরন্তু তানি
তদ্বচনাদ্ বিরুধ্যন্ত এব" (পৃষ্ঠা. ৬) ॥
একমাত্র
দয়ানন্দভাষ্যই উপর্যুক্ত সিদ্ধান্তের অবলম্বনে করা হয়েছে । নিরুক্ত
শাস্ত্রে বর্ণিত বেদার্থ জ্ঞানের পরম সত্য সিদ্ধান্ত কেবল দয়ানন্দভাষ্যেই
সম্পূর্ণতা বিদ্যমান । এর বিপরীতে সকল তথাকথিত ভাষ্য ঈশ্বর প্রদত্ত
আর্ষ-পরম্পরা বিরুদ্ধ, অবৈদিক এবং সর্বথা অমান্য ।
নিরুক্ত শাস্ত্র এবং অনেকবাদ
নিরুক্ত শাস্ত্রের বিবিধ স্থলে অনেকবাদ এর বর্ণনা বিদ্যমান ।
নিম্নে দর্শানো হলো –
ক. আধ্যাত্মম্ → ১০-১২টি স্থলে
খ. আধিদৈবতম্ → ১০-১২টি স্থলে
গ. আখ্যান সময় → ১৯টি স্থলে
ঘ. ঐতিহাসিকাঃ → ১৯টি স্থলে
ঙ. নৈদানাঃ
চ. নৈরুক্ত পক্ষ → ২০টি স্থলে
ছ. পরিব্রাজক মত → ১টি স্থলে
জ. পূর্বে যাজ্ঞিকাঃ → ১টি স্থলে
ঝ. যাজ্ঞিকঃ → ৮টি স্থলে
বেদার্থ
এর দুর্বোধ্য জ্ঞান তথা প্রক্রিয়া সম্বন্ধে কিঞ্চিত পরিমাণও জ্ঞান না
থাকায় অনার্য, যবনরা সর্বত্র নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে থাকে প্রতিনিয়ত ।
পরমাত্মা
প্রদত্ত আর্ষজ্ঞান তথা গুরুপরম্পরায় গহিন স্বাধ্যায় বিনা যথার্থজ্ঞান
সমগ্র আয়ুতে কিঞ্চিতও প্রাপ্ত কস্মিনকালেও অসম্ভব ।
আর্ষ
পরম্পরার আপ্ত ঋষিগণের সিদ্ধান্ত তথা বৈদিক বাঙ্ময়ের স্তম্ভ মহর্ষি
পাণিনি-পতঞ্জলি-যাস্ক সদৃশ আপ্ত মহর্ষিগণের পরম সত্য সিদ্ধান্তের কিঞ্চিতও
অনুধাবন করতে সর্বদা অসমর্থ থাকিবে এসব অনার্য,ম্লেচ্ছগণ ।
" অলমতিবিস্তরেণ বিদ্বদ্বর্য়েষু "
0 মন্তব্য(গুলি)
Author
সত্যান্বেষী