https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

যাজ্ঞিক-প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থ

Thursday, March 23, 2023

 


প্রাগযাজ্ঞিক কালীন বেদার্থ
 
প্রাচীন আর্ষ শাস্ত্রের অন্তর্গত ভগবান মনু রচিত মনুস্মৃতি‌ই একমাত্র শাস্ত্র, যা মূলরূপে প্রবচন কৃতযুগের অন্তিম চরণে এবং ভৃগু দ্বারা প্রবচন ত্রেতাযুগে হয়েছে [1] । এই সময়কালে মহর্ষি নারদ মানব ধর্মশাস্ত্রের রাজধর্ম প্রকরণ‌ পৃথক্‌রূপে প্রবচন দেন । কৃতযুগের দ্বিতীয় চরণে আদি বিদ্বান্ মহর্ষি ব্রহ্মা দ্বারা বিভিন্ন শাস্ত্রের অতি বিস্তৃত শাসন হয় । তৎপশ্চাৎ ঋষি-মহর্ষিগণ ব্রহ্মা দ্বারা শাসিত সুদীর্ঘ শাস্ত্রসমূহ ক্রমশঃ সংক্ষিপ্ত, সংক্ষিপ্ততর এবং সংক্ষিপ্ততম প্রবচন দেন । একারণে ঋষিগণ‌ কর্তৃক শাস্ত্রের সমস্ত প্রবচনকে “অনুশাসন” বলা হয় ।
 
অধুনাকালে বিবিধ‌ শাস্ত্রের যে সংখ্যক আর্ষ সাহিত্য উপলব্ধ, তা‌ প্রায়ঃ সব সেই-সেই বিষয়ের অন্তিম এবং সংক্ষিপ্ততম আর্ষ সংস্করণ । সমগ্র গ্রন্থ-প্রবচন বিদ্যা নীরজস্তম (রজোগুণ তমোগুণ রহিত) বৈদিক পরম্পরা‌র মনীষীগণের অনুপম উপঢৌকন । অধুনা‌ কালে উপলভ্যমান পরম্পরাগত আর্ষ শাস্ত্রে প্রাচীন আদ্যকালীন বেদার্থ সম্বন্ধী কতিপয় নির্দশন সুরক্ষিত রয়েছে । অতঃ এ স্থলে‌ মনুস্মৃতি তথা অন্য আর্ষ বাঙ্‌ময়ের আধারে প্রাগযাজ্ঞিক কালে বেদার্থ সম্বন্ধী‌ সামান্য‌ বিবরণ উপস্থাপন করা হল
 
সেনাপত্যং চ রাজ্যং চ দণ্ডনেতৃত্বমেব চসর্বলোকাধিপত্যং চ বেদশাস্ত্রবিদর্হতি॥”
[ মনুস্মৃতি‌. ১২।১০০ ]
অর্থাৎ, সংগ্রামে সেনা সঞ্চালন, রাজ্যপালন, প্রজার সংরক্ষণের জন্য উচিত দণ্ডব্যবস্থা এবং সার্বভৌম আধিপত্য বা সর্বলোক পৃথিবী, জল এবং অন্তরিক্ষের প্রভুত্বের অধিকারী‌ হ‌ওয়ার‌ জন্য বেদ শাস্ত্রের জ্ঞাতাই সক্ষম ।
 
পুনশ্চ -
ঋগ্বেদবিদ্‌ যজুর্বিচ্চ সামবেদবিদেব চ
ত্র্যবরা পরিষজজ্ঞেয়া ধর্মসংশয়নির্ণয়ে॥”
[ ১২।১১২ ]
অর্থাৎ, প্রত্যেক দেশ কালে ব্যবহর্তব্য 'ধর্ম'= কর্তব্য কর্মের [2] সংশয় নির্ণয়ের জন্য ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ এবং সামবেদ জ্ঞাতা, এরূপ তিন বিদ্বানের পরিষদ্ গঠন করবে ।
 
এই প্রসঙ্গে আর‌ও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে –
 
ভূতং ভব্যং ভবিষ্যং চ সর্ব বেদাৎ প্রসিদ্ধ্যতি।।
বিভর্তি সর্বভূতানি বেদশাস্ত্রং সনাতনম্।।”
[ মনু. ১২। ৯৭,৯৮]
অর্থাৎ, চার বর্ণ এবং চার আশ্রমের ভূত, বর্তমান এবং ভবিষ্য, এই তিন কালে কর্তব্য-কর্মের পূর্ণ জ্ঞান বেদ দ্বারা অর্জন হয়। সমগ্র‌ প্রাণীর রক্ষাকর্তা সনাতন বেদ।
 
মনুস্মৃতির রাজধর্ম প্রকরণে বর্ণনা করা হয়েছে -
ত্রৈবিদ্যেভ্যস্ত্রয়ীং বিদ্যাং দণ্ডনীতি চ শাশ্বতীম্ ।
আন্বীক্ষিকীং চাত্মবিদ্যাং চ বার্তারম্ভাংশ্চ লোকতঃ॥”
অর্থাৎ - রাজা ত্রৈবিদ্য= তিন প্রকার বিদ্যা গ্রহণের ফলে (ক) দণ্ডনীতি= রাজনীতি, (খ) আন্বীক্ষিকী= পদার্থবিজ্ঞান, [3] তথা (গ) অধ্যাত্ম = শরীর আত্মা এবং পরমাত্মা-সম্বন্ধী ত্রয়ী বিদ্যা এবং লোক থেকে বার্তারম্ভ= শিষ্টাচার জ্ঞান লাভ করে ।
 
উপরোক্ত শ্লোকসমূহ দ্বারা স্পষ্ট যে‌, ভগবান্ মনুর সিদ্ধান্ত অনুসারে বেদে (ক) সংগ্রামে সেনার সঞ্চালন, (খ) রাজ্যের পালন, (গ) দণ্ডব্যবস্থা, (ঘ) আধিভৌতিক তথা আধিদৈবিক পদার্থের বিজ্ঞান, (৫) অধ্যাত্ম [4] জ্ঞান অর্থাৎ শরীরের নৈরোগ্য, আত্মার স্বরূপজ্ঞান দ্বারা সাংসারিক দুঃখ থেকে নিবৃত্তি এবং পরমাত্মার জ্ঞান দ্বারা আনন্দ প্রাপ্তি আদি আদি অনেক বিদ্যার ভান্ডার বিদ্যমান । অর্থাৎ, বেদে এসব বিদ্যার বর্ণন থাকায় রাজর্ষি মনুর সিদ্ধান্ত অনুসারে বেদ এর অর্থ উক্ত বিদ্যাপরক করা উচিত ।
এজন্যে মহর্ষি মনু বেদ বিষয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট ব্যক্ত করেছেন -
 
সর্বজ্ঞানময়ো হি সঃ” ।। [২।৭]
অর্থাৎ - বেদ সমস্ত বিদ্যার আকর । [5]
 
শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ, জ্যোতিষ, ধর্মশাস্ত্র, পদার্থ-বিজ্ঞান, সাহিত্য, কলা, শিল্প, রাজনীতি, আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গন্ধর্ববেদ, কর্ম, জ্ঞান এবং উপাসনা [6] আদি অনেক বিষয়ে প্রতিবাদন‌ বেদে‌ বিদ্যমান ।
 
মহর্ষি কণাদ বেদের প্রামাণিকতার উপপাদন পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টি দ্বারা‌ করেছেন । তাঁর সিদ্ধান্ত -
অথাতো ধর্মং ব্যাখ্যাস্যামঃ
যতোঽভ্যুদয় নিঃশ্রেয়স সিদ্ধিঃ স ধর্মঃ
তদ্বচনাদ্ আম্নায়স্য প্রামাণ্যম্
ধর্মবিশেষপ্রসূতাদ্ দ্রব্যগুণকর্মসামান্যবিশেষসমবায়ানাং পদার্থানাং সাধর্ম্য বৈধর্ম্যাভ্যাং তত্ত্বজ্ঞানান্নিঃশ্রেয়সাধিগমঃ ।।”
[ বৈশেষিক‌. ১।১।১-৪ ]
অর্থাৎ, এখন ধর্মের ব্যাখ্যান প্রারম্ভ হবে । যা‌ দ্বারা লৌকিক তথা পারলৌকিক সুখ প্রাপ্তি হয়, তা ধর্ম । সেই ধর্মের প্রতিপাদন বেদে‌ বিদ্যমান হেতু‌ বেদ‌ প্রামাণ্য । দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ এবং সমবায় এই ষড় পদার্থের সাধর্ম্য এবং বৈধর্ম্য দ্বারা ধর্মবিশেষ এর জ্ঞান দ্বারা উৎপন্ন তত্ত্বজ্ঞানের মাধ্যমে পারলৌকিক সুখ সিদ্ধি হয়ে থাকে ।
 
বৈশেষিক এর উক্ত‌ সূত্রে 'ধর্ম' শব্দের অভিপ্রায় পদার্থের গুণের সহিত সম্বন্ধ, কোনো পুণ্য বা অদৃষ্টের সহিত নয় । কেননা সম্পূর্ণ দর্শনের প্রতিপাদ্য বিষয় পদার্থের গুণসমূহের মীমাংসা করা । যদি সূত্রে ধর্ম পদের অভিপ্রায় অদৃষ্ট হলে, তাহলে মহর্ষি কণাদ — “দৃষ্টানাং দৃষ্টপ্রয়োজনানাং দৃষ্টাভাবে প্রয়োগোঽভ্যুদয়ায়” [১০।২।৯] সূত্রে অনন্তর পুনঃ “তদ্বচনাদাম্নায়স্য প্রামাণ্যম্ ” সূত্রের ব্যাখ্যান দিতেন না ।
 
মহর্ষি কণাদের উপর্যুক্ত সূত্র দ্বারা স্পষ্ট যে‌, তিনি বেদে শুধু পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিপাদন মানতেন না, বরং তিনি বেদপ্রতিপাদিত পদার্থবিজ্ঞান [7] এর সত্যতার আধারে‌ই বেদ এর প্রামাণ্য‌ও সিদ্ধ করেছেন । মহর্ষি কণাদ বৈশেষিক‌ এর দুইটি স্থলে “বৈদিকং চ ” [৪।২।১০] তথা “বেদলিঙ্গাচ্চ ” [৪।২।১১] সূত্র দ্বারা স্পষ্টভাবে বেদের প্রমাণ‌ও দর্শিয়েছেন ।
 
ন্যায়সূত্রকার ভগবান্ গৌতম‌ও মন্ত্রান্তর্গত (মন্ত্রপ্রতিপাদিত) আয়ুর্বেদ (চিকিৎসাবিজ্ঞান) প্রামাণ্য দ্বারা বেদের প্রামাণ্য সিদ্ধ করেছেন । এই বিষয়ে প্রসিদ্ধ সূত্র –
মন্ত্রায়ুর্বেদপ্রামাণ্যবচ্চ তৎপ্রামাণ্যমাপ্তপ্রামাণ্যাৎ ।” [২।১।৬৮]
অর্থাৎ, বেদমন্ত্রে যে‌ আয়ুর্বেদ এর প্রতিপাদন হয়েছে, তা‌ লোকে সত্য ঘটিত হয়ে থাকে । এ কারণে মন্ত্রায়ুর্বেদরূপী এক দেশের প্রত্যক্ষ দ্বারা বেদের সেই ভাগের‌ও প্রামাণ্য বোধগম্য‌ উচিত‌, যাহাতে আয়ুর্বেদ এর প্রতিপাদন অনুপস্থিত । কেননা বেদোক্ত আয়ুর্বেদিক প্রত্যক্ষ বিজ্ঞান দ্বারা বেদের রচয়িতার আপ্তত্ব সিদ্ধ । সেই আপ্ত সেই ভাগের‌ও রচয়িতা, যাহাতে আয়ুর্বেদ এর সাক্ষাৎ প্রতিপাদন অনুপস্থিত ।
 
ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদে ক্রমশ: অর্থশাস্ত্র, ধনুঃশাস্ত্র, সঙ্গীতশাস্ত্র এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের [8] বিশেষরূপে প্রতিপাদন বিদ্যমান, এজন্যে এই শাস্ত্রগুলোকে ক্রমশঃ চারবেদের উপবেদ মানা হয় ।
এসব সংকেত দ্বারা স্পষ্ট যে‌, অতি প্রাচীন কালের ঋষি-মহর্ষিগণ "বেদে লোকোপযোগী সমস্ত বিদ্যার, আধিদৈবিক তথা আধিভৌতিক পদার্থের বিজ্ঞানসমূহ এবং আধ্যাত্মিক‌ তত্ত্বের‌ বিস্তার বিবেচনা করেছেন"।
 

  • পঞ্চবিধ বেদার্থ-প্রক্রিয়া
     

তৈত্তিরীয় উপনিষদে [১।৩।১] বেদার্থের পঞ্চ অধিকরণের (প্রক্রিয়া) নির্দেশ বর্ণন হয়েছে ।
যথা -
 
অথাতঃ সংহিতায়া উপনিষদং ব্যাখ্যাস্যামঃপঞ্চস্বধিকরণেষুঅধিলাকম্ অধিজ্যৌতিষম্, অধিবিদ্যম্, অধিপ্রজম্, অধ্যাত্মম্ ॥”
 
ত্রিবিধ বেদার্থ-প্রক্রিয়া
 
কৃতযুগের তৃতীয় চরণে মনুষ্য-সমাজে ক্রমশঃ সত্ত্বগুণসমূহের ন্যূনতা এবং রজোগুণের বৃদ্ধির সাথে-সাথে মানবজাতির মেধাশক্তি হ্রাস হতে থাকে। [9] এরূপভাবে মেধাশক্তি হ্রাসের দরুন প্রাচীন বিবিধ জ্ঞানবিজ্ঞানপরিগুম্ফিত বেদার্থ জ্ঞান হ্রাস হতে থাকে, তখন ঋষি-মহর্ষিগণ বিবিধ প্রক্রিয়ানুসারী বহুবিধ প্রাচীন বেদার্থকে 'সর্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধং ত্যজতি পণ্ডিতঃ' ন্যায় অনুসারে আধিভৌতিক, আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্মিক [10] এই ত্রিবিধ প্রক্রিয়ারূপে সীমিত করেন ।
 
তদনুসার পদার্থবিজ্ঞানের সমাবেশ আধিভৌতিক প্রক্রিয়ায়, গ্রহ-নক্ষত্রের স্থিতি গতি এবং চরাচর জগতে তাদের‌ প্রভাব অর্থাৎ জ্যোতিষবিজ্ঞান, কালবিজ্ঞান,ঋতুবিজ্ঞান আদি বহুবিধ বিজ্ঞানের সমাবেশ আধিদৈবিক প্রক্রিয়ায় তথা শরীরবিজ্ঞান জীববিজ্ঞান এবং ঈশবিজ্ঞানের সমাবেশ আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে
 
এরূপভাবে তৈত্তিরীয় উপনিষদে বর্ণিত পঞ্চবিধ প্রক্রিয়ার অধিলোক এবং অধিজ্যোতিষ প্রক্রিয়া আধিদৈবিক প্রক্রিয়ায়, অধিবিদ্য আধিভৌতিক প্রক্রিয়ায় তথা অধিপ্রজ এবং অধ্যাত্ম প্রক্রিয়াদ্বয় আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভাব হয়েছে ।
 
কৃতযুগের চতুর্থ চরণে উত্তরোত্তর মেধাশক্তির হ্রাসের দরুন পূর্বোক্ত সর্বদিকের ত্রিবিধ বেদার্থপ্রক্রিয়া‌ও দুরূহ হতে থাকে । এই সময়ে মনুষ্যের মধ্যে রজোগুণের বৃদ্ধি এবং তমোগুণের উৎপত্তির কারণে লোভের প্রাদুর্ভাব হয় ‌[11]।
 
বলবান এবং সাধন-সম্পন্ন ব্যক্তি লোভের বশীভূত হয়ে প্রজাকে বিভ্রান্ত করতে থাকে। এই মাৎস্যন্যায় [12] থেকে প্রজার ত্রাণ পাওয়ানোর জন্য ঋষি-মহর্ষিগণ বর্ণব্যবস্থা এবং রাজব্যবস্থার [13] সাথে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যয়নাধ্যাপন তথা এর প্রয়োগের উপর প্রতিবন্ধকতা‌র ব্যবস্থা করেন। এই প্রকারে পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্র সঙ্কোচের সাথে-সাথে বেদার্থের ক্ষেত্র‌‌ও অনেক সঙ্কুচিত হয়ে যায় 

  • বেদার্থে নব্য দু'টি মতবাদের প্রাদুর্ভাব

 
কৃতযুগের অন্তে অথবা ত্রেতার প্রারম্ভে বেদার্থপ্রক্রিয়ায় দু'টি নব্য‌ মতবাদের প্রাদুর্ভাব হয় - 'দৈবতবাদ' এবং 'যাজ্ঞিকবাদ' ।
নব্য দৈবতবাদ প্রাচীন আধিভৌতিক এবং আধিদৈবিক এই দুই প্রক্রিয়ার সম্মিলিতরূপে প্রতিনিধিত্ব করে । তদনুসার অগ্নি, জল, বায়ু, বিদ্যুৎ, সূর্য, চন্দ্র আদি পদার্থের দেবতারূপ প্রকাশ করে । শনৈঃ-শনৈঃ এই দেবতাবাদের পরিসমাপ্তি হয় অধিষ্ঠাতৃবাদে ।
 
এই তিন প্রক্রিয়ার নির্দেশের প্রমাণ -
 
ন শ্রুতমতীয়াৎ -
অধিদেবমথাধ্যাত্মমধিয়জ্ঞমিতি ত্রয়ম্
মন্ত্রেষু ব্রাহ্মণেষু চৈব শ্রুতমিত্যভিধীয়তে॥”
[শাঙ্খায়ন গৃহ্যসূত্র‌. ১।২।১৮, ১৯]
অধিযজ্ঞং ব্রহ্ম জপেদ্ আধিদৈবিকমেব চ
আধ্যাত্মিকং চ সততং বেদান্তাভিহিতং চ যৎ ॥”
[ মনুস্মৃতি. ৬।৮৩ ]
 

  • যাজ্ঞিক-প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থ

 
পূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে‌, কৃতযুগের অন্তিম চরণে আধিভৌতিক বেদার্থ প্রক্রিয়া হ্রাস হতে থাকে, আধিদৈবিক বেদার্থের দিশা পরিবর্তিত হয়ে যায় তথা কাম,ক্রোধ, লোভ, মোহ আদি দোষের কারণে আধ্যাত্মিক ভাবনা ন্যূন হয়ে যায় । সেই সময়ে আধিযাজ্ঞিক প্রক্রিয়ার প্রাদুর্ভাব হয়।
সৃষ্টির প্রারম্ভে সত্ত্বগুণবিশিষ্ট যোগজশক্তিসম্পন্ন পরাবরজ্ঞ ঋষি-মহর্ষিগণ তাঁদের‌ স্বীয় দিব্য মানসিক শক্তি দ্বারা এই চরাচর জগতে পরমাণু থেকে শুরু করে পরম-মহৎ তত্ত্ব পর্যন্ত সমগ্র পদার্থের হস্তামলকবৎ প্রত্যক্ষ করেছেন । তাঁদের জন্য‌ কোন‌ও পদার্থ অপ্রত্যক্ষ ছিলো না । উত্তরোত্তর সত্ত্বগুণের ন্যূনতা, রজোগুণ এবং তমোগুণের বৃদ্ধির দরুন কাম,ক্রোধ,লোভ এবং মোহ আদি সৃষ্ট হয় । এসবের বশীভূত হয়ে মানবী প্রজা সুখ বিশেষের ইচ্ছা দ্বারা প্রাজাপত্য শাশ্বত নিয়মের উল্লঙ্ঘন করে কৃত্রিম জীবনযাপন আরম্ভ করে । এর সাথে মানবের মানসিক দিব্য শক্তি‌ও হ্রাস পেতে থাকে । দিব্য‌ শক্তি‌ হ্রাসের‌ দরুন সূক্ষ্ম, দূরস্থ এবং ব্যবহৃত পদার্থের জ্ঞান সম্বন্ধে অজ্ঞেয় হতে থাকে । অতঃ ব্রহ্মাণ্ড এবং পিণ্ড (অধ্যাত্ম = শরীর) এর রচনা কীভাবে হয়েছে, তৎ সম্বন্ধে জানা জটিল সমস্যায় পরিণত হয় । এ কারণে আধিভৌতিক, আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থ‌ও দুরূহ হতে থাকে । এই কালে তাৎকালিক সাক্ষাৎকৃতধর্মা পরাবরজ্ঞ ঋষি-মহর্ষিগণ ব্রহ্মাণ্ড তথা অধ্যাত্ম বিন্যাসের জ্ঞান বোধ‌ করানো এবং তৎপরক প্রাচীন বেদার্থকে সুরক্ষিত করানোর‌ জন্য যজ্ঞকর্মের শুভারম্ভ করেন । যজ্ঞের প্রয়োজন দৈবত এবং অধ্যাত্ম এর জ্ঞান বোধ‌ করানো । আচার্য যাস্ক তাঁর প্রণীত নিরুক্ত শাস্ত্রে‌ও এই বিষয়ে সংকেত দর্শিয়েছেন – “যাজ্ঞদৈবতে পুষ্পফলে, দেবতাধ্যাত্মে বা” (নিরুক্ত.১।১৯) । তদনুসার যজ্ঞ এবং দেবতা এর জ্ঞান ক্রমশঃ পুষ্প এবং ফল স্থানীয়, অর্থাৎ যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ার জ্ঞান দৈবত (ব্রহ্মাণ্ড) এর জ্ঞানের কারণে প্রাপ্ত হয়ে থাকে । যখন দৈবতজ্ঞান অর্জন হয়, তখন তা‌ যাজ্ঞিকপ্রক্রিয়ার দৃষ্টিতে ফলস্থানী হয়ে‌ও অধ্যাত্মজ্ঞানের দৃষ্টিতে পুষ্পস্থানীয় হয়, অর্থাৎ অধ্যাত্মে দৈবত-জ্ঞান কারণ হয়ে থাকে । ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে যাজ্ঞিক প্রক্রিয়া‌র ব্যাখ্যা দর্শানোর‌ সময় অনেক স্থলে “ইত্যধিয়জ্ঞম্” পদ দর্শিয়ে “প্রথাধিদৈবতম ”, “অথাধ্যাত্মম্ ” এর নির্দেশ দ্বারা তিন প্রক্রিয়াকেই পরস্পর সমানতা দর্শানো হয়েছে । এরূপভাবে মীমাংসাশাস্ত্রের‌ও তিন বিভাগ রয়েছে । পূর্ব এবং উত্তর মীমাংসা বর্তমানে উপলব্ধ । পরন্তু “দৈবত মীমাংসা” নামে‌ও একটি ভাগ ছিলো, যা‌ অধুনাকালে লুপ্ত- প্রায়ঃ । তদনুসার ১২ অধ্যায় জৈমিনি প্রোক্ত কর্মমীমাংসা, ৪ অধ্যায় দৈবতমীমাংসা এবং অন্তিম ৪ অধ্যায় কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস প্রোক্ত ব্রহ্ম-মীমাংসা । এরূপভাবে বিশ‌ (২০) অধ্যায়াত্মক মীমাংসা শাস্ত্রেও ক্রমশঃ “যজ্ঞ-দৈবত-ব্রহ্ম” এর বিচার করা হয়েছে ।
 
যজ্ঞের ব্যাখ্যানকারী [14] সূত্রগ্রন্থকে কল্পসূত্র বলা হয় ।
 

  • যজ্ঞকে অধিদেবত সৃষ্টিযজ্ঞের‌ সহিত তুলনা

 
দ্রব্যযজ্ঞ এবং সৃষ্টিযজ্ঞের তুলনার জন্য শ্রৌতযজ্ঞের অগ্ন্যাধান প্রকরণ এ স্থলে উপস্থিত করা হচ্ছে ।
অগ্ন্যাধান বিধির ক্রম‌ নিম্নরূপ –
সর্বপ্রথম বেদিনির্মাণার্থ যজ্ঞোপযোগী ভূমির নিরীক্ষণ করা হয়ে থাকে ।
তৎপশ্চাৎ সেই ভূমিতে বেদি রচনার জন্য ভূমিতে নির্দিষ্ট পরিধির‌ মাটি‌ কাটা হয় । তৎপশ্চাৎ সেই স্থানে নিম্ন ক্রিয়া ক্রমশঃ করা হয় -
ক. জল সিঞ্চন করা হয়
খ‌. বরাহ-বিহত (শুকর দ্বারা খননকৃত) মাটি ছড়ানো
গ. উইপোকার তৈরী ঘরের মাটি ছড়ানো
ঘ. অনুর্বর জমির মাটি ছড়ানো
ঙ. সিকতা (বালু) বিছিয়ে দেওয়া
চ. শর্করা (রোড়ী) ছড়িয়ে দেওয়া হয়
ছ‌. তৎপশ্চাৎ ইট‌ সাজিয়ে দেওয়া হয়
জ‌. সুবর্ণ রাখা‌ হয়
ঝ‌. সমিধা রাখা হয়
তৎপশ্চাৎ অশ্বত্থ (=পিপল) অরণির (দুটি কাষ্ঠ) মন্থন করে (ঘষে) অগ্নি উৎপন্ন করার পর সমীধার উপর ধরতে হয় ।
অগ্ন্যাধানে বেদি নির্মাণে উক্ত ক্রিয়া করা হয়ে থাকে ; ইহা হিরণ্যগর্ভাখ্য মহদণ্ড থেকে পৃথিব্যাদির পৃথক হ‌ওয়ার সময় পৃথিবীর যে সলিলময়ী স্থিতি ছিলো, সেই স্থিতি থেকে শুরু করে পৃথিবীর পৃষ্ঠে অগ্নির প্রথম উৎপত্তি পর্যন্ত পৃথিবীকে বিবিধ পরিবর্তিত স্থিতি বোধ করানোর‌ জন্য । কেননা, স্বয়ং বেদ-ভগবান বলেছেন - “ইয়ং বেদিঃ পরো অন্তঃ পৃথিব্যাঃ” [যজুর্বেদ‌. ২৩।৬২] । শতপথ ব্রাহ্মণে নয় (৯) প্রকার সর্গের (সৃষ্টি) বর্ণনা হয়েছে ।
 
যথা-
স শ্রান্তস্তেপানঃ ফেনমসৃজত । ........ স শ্রান্তস্তেপানো মৃদং শুষ্কাপমূষং সিক্তং শর্করা অশ্মানম্ অয়োহিরণ্যম্ ওষধিবনস্পত্য সৃজত । তেনেমাং পৃথিবীং প্রাচ্ছাদয়ৎ ।” [ শতপথ‌. ৬।১।১।১৩ ]
এখানে যে‌ ৯ প্রকার সৃষ্টি বর্ণিত হয়েছে । তন্মধ্যে সফেন ( ফেনা‌) আপঃ প্রধান হ‌ওয়ায় বেদি নির্মাণ প্রক্রিয়ার অভ্যন্তরে একে‌ সম্মিলিত করা হয় নাই ।
 
এ স্থলে বৈদিক শাস্ত্রের‌ আধারে বেদি নির্মাণ এবং পৃথিবীর বিবিধ সর্গের বর্ণন দর্শানো হল‌ –
 
ক‌. প্রারম্ভে পৃথিবী সলিলময়ী ছিল । “আপো হ বা ইদমগ্রে সলিলমেবাস” [শতপথ ১১।৬।১।৬] । এই স্থিতি দর্শানোর জন্য বেদির স্থানে জলসিঞ্চন করা হয়।
 
খ‌. অগ্নির সংযোগে সলিলে ফেনা উৎপন্ন হয়, যেমনভাবে দুধ গরম করার সময় দুধের উপরিভাগে ফেনা সৃষ্ট হয় । এই ফেনা বায়ুর সংযোগে ঘনত্বকে প্রাপ্ত করে মৃদ্‌ভাব সৃষ্ট হয় । যেমন‌ভাবে‌ দুধের সর‌ উৎপন্ন হয় শতপথের ৬।১।৩।৩-এ বলা হয়েছে --
 
স (ফেনঃ) যদোপহন্যতে মৃদেব ভবতি ।” এই মৃদ্ এর উৎপত্তিতে সূর্য কিরণের বিশেষ মহত্ত্ব রয়েছে । সূর্যের এই আঙ্গিরস নামক কিরণকে বরাহ‌ও বলা হয় । [15] সেই সময় পৃথিবীর রূপ বরাহ মুখের সদৃশ ক্ষুদ্র ছিল । অতএব বেদি নির্মাণে বরাহ (শূকর) দ্বারা খননকৃত বারীক মৃত্তিকা‌ বিছিয়ে দেওয়া হয় । এ কারণে মৈত্রায়ণী সংহিতায় ১।৬।৩ -এ বলা হয়েছে – “যাবদ্ বৈ বরাহস্য চষালং তাবতীয়মগ্র আসীৎ । যদ্ বরাহবিহতমুপাস্যাগ্নিমাধত্তে ”।
 
গ‌. তখন সেই মৃত্ সূর্যের কিরণ দ্বারা‌ শুকিয়ে যায়‌, তখন তাকে শুষ্কাপ ( যার‌ জল‌ শুকিয়ে গিয়েছে ) বলা হয় । তার নিম্ন স্থানে জল বিদ্যমান । এই শুষ্কাপরূপ অবস্থার বোধের জন্য উইপোকার তৈরী ঘরের মাটি সাথে তুলনা করা যায় । মৈত্রায়ণী সংহিতার ১/৬/৩ - এ বলা হয়েছে -- “যদ্ বনীকবপামুৎকীর্যাগ্নিপাধত্তে ।”
 
ঘ. সেই শুষ্কাপ সূর্যের কিরণ দ্বারা শুষ্ক হয়ে ঊষ ভাব (ক্ষারত্ব) প্রাপ্ত হয় । এ কারণে বেদিতে অনুর্বর জমির মাটি বিছিয়ে দেওয়া হয় । মৈত্রায়ণী সংহিতার ১।৬।৩ -এ বলা হয়েছে – “যদূষানুপকীর্যাগ্নিমাবত্তে” ।
 
ঙ. সেই ঊষ অর্থাৎ ক্ষার মৃত্তিকা পুনঃ সূর্যের কিরণ দ্বারা তথা পৃথিবীগর্ভস্থ অগ্নির মাধ্যমে তপ্ত হয়ে বালুর রূপ ধারণ করে । এজন্যে বেদিতে‌ও বালু বিছানো‌ হয়ে থাকে — “যৎসিকতামুপকীর্যাগ্নিমাধত্তে” [মৈত্রায়ণী সংহিতা. ১।৬।৩] ।
 
চ. এই অন্তঃস্থিত বালু ভূগর্ভস্থ অগ্নি দ্বারা শুকিয়ে শর্করা =রোড়ীতে পরিণত হয় । এই অন্তঃ পরিবর্তনের বোধ করানোর‌ জন্য বেদিতে শর্করা =রোড়ী বিছানো হয়ে থাকে। মৈত্রায়ণী সংহিতার ১।৬।৩ -এ বলা হয়েছে– “যচ্ছর্করা উপকীর্য়াগ্নিমাধত্তে
 
পৃথিবীর গর্ভে শর্করা উৎপত্তির দরুন ভূমি দৃঢ়ত্ব‌ প্রাপ্ত হয় । এই তথ্যকে আর্ষ শাস্ত্রে‌ এরূপ ভাবে দর্শানো হয়েছে – “শিথিরা ঘা ইয়মগ্র প্রাসীৎ । তাং প্রজাপতিঃ শর্করাভিরদ্দংহত” [মৈত্রায়ণী সংহিতা.১।৬।৩] ।
এই ক [16] =অগ্নিরূপ প্রজাপতির কর্ম ঋগ্বেদ. ১০।১২২।৫ নং মন্ত্রে‌ বিদ্যমান – “য়েন দ্যৌরুগ্রা পৃথিবী চ দৃঢ়া ” ।
 
ছ. শর্করা অন্তস্তাপের মাধ্যমে তপ্ত হয়ে পাষাণরূপ ধারণ করে । তাই চয়ন সংজ্ঞক যাগে বেদিতে পাষাণের স্থানে প্রতিনিধিরূপ ইট বিছানো হয়ে থাকে ।
তৈত্তিরীয় সংহিতার‌ ৫।২।৮ -এ বলা হয়েছে– “ইষ্টকা উপদধাত্তি‌” ।
 
জ‌. এই পাষাণ ভূগর্ভস্থ অগ্নির মাধ্যমে তপ্ত হয়ে লোহ দ্বারা সুবর্ণ পর্যন্ত ধাতুরূপে পরিণত হয়। [17] এই ধাতুৎপত্তি কালিক পৃথিবীর স্থিতি বর্ণন করার জন্য চয়ন যাগে বলা হয়েছে- “হিরণ্যং নিধায় চেতব্যম্‌” [18] তথা “রুক্মমুপদধাতি” [মৈত্রায়ণী সংহিতা. ৩।২।৬] ।
 
ঝ‌. পৃথিবী-গর্ভে অয়োহিরণ্য গঠন হ‌ওয়া পর্যন্ত পৃথিবী কূর্ম পৃষ্ঠের সমান লোম রহিত ছিল । তৎপশ্চাৎ পৃথিবীতে ওষধি বনস্পতির উৎপত্তি হয় । পৃথিবীর এই স্থিতির‌ স্বরূপ সম্বন্ধে ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে বর্ণন হয়েছে --
ইয়ং বাঽলোমিকেবাগ্র আসীৎ”।
[ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ. ২৪।২২ ]
ওষধিবনস্পতয়ো বা লোমানি”।
[ জৈমিনি. ব্রাহ্মণ. ২।৫৪ ]
এজন্যে বেদিতে হিরণ্য রেখে সমিধা অথবা তৎস্থানীয় আরণ্য উপরে স্থাপন করা হয় ।
বনস্পতিরূপ বৃহৎ-বৃহৎ বৃক্ষরাজির উৎপন্ন হ‌ওয়ার পর বায়ুর বেগে বৃক্ষের শাখাসমূহের প্রবল‌ ঘর্ষণে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম অগ্নির উৎপত্তি হয় । অতএব বেদ-ভগবান বলেছেন — “তস্যাস্তে পৃথিবি দেবয়জনি পৃষ্ঠেঽগ্নিমন্নাদমন্নাদ্যায়াদধে” [যজুর্বেদ. ৩।৫ ] । পৃথিবীর পৃষ্ঠে অগ্নির প্রথম প্রাদুর্ভাব বোধন করানোর জন্য বেদিতে যে‌ অগ্নির আধান করা‌ হয়, তা পিপল এর কাষ্ঠ থেকে নির্মিত অরণিসমূহকে তরলীকরণ করেই উৎপন্ন করা হয় ।
 
পূর্বে‌ শুষ্কাপরূপে যে পার্থিব স্থিতির বর্ণন করা হয়েছে, সেই সময়ে পার্থিব ভাগ জলের উপর বায়ুর বেগে পুষ্করপর্ণের ন্যায় এদিক-ওদিক দুলতে থাকে । ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে‌ বর্ণনা হয়েছে - “সা হেয়ং পৃথিব্যলেলায়ত যথা পুষ্করপর্ণম্” [শতপথ. ২।১।১।৮ ]। এই তত্ত্বের বর্ণন বায়ুরূপী ইন্দ্রকে কূর্মরূপে করা হয়েছে - “হন্তাহং পৃথিবীমিমাং নিদধানীহ বেহ বা ” [ঋগ্বেদ‌. ১০।১১৯।৯ ] অর্থাৎ ইন্দ্র =বায়ু বলেন আমি এতোটাই বলবান‌ যে‌, আমি যখন‌ ইচ্ছা‌ তখন‌ এই পৃথিবীকে থামিয়ে দিতে পারি ।
 
এই পুষ্করপর্ণবৎ স্থিতির নিদর্শন চয়ন যাগে পুষ্করপর্ণকে রেখে করা হয়েছে — “তস্মিন্ পুষ্করপর্ণম্ অপাং পৃষ্ঠম্ ইতি ” [কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র‌. ১৬।২।২৫] ।
 
নিরুক্তকার মহর্ষি যাস্ক সৃষ্টিযজ্ঞের অনুকরণ শ্রৌত যজ্ঞ মেনেছেন । তিনি বর্ণনা করেন –
অথাসাবাদিত্যঃ (বৈশ্বানরঃ ) ইতি পূর্বে যাজ্ঞিকাঃ । এষাং লোকানাং রোহেণ সবনানাং রোহ আম্নাতঃ । রোহাৎপ্রত্যবরোহশ্চিকীর্ষিতঃ । তামনুকৃতি হোতাগ্নিমারুতে শস্ত্রে বৈশ্বানরীয়েণ সূক্তেন প্রতিপদ্যতে ” [ নিরুক্ত ৭।২৩ ]
অর্থাৎ - প্রাচীন যাজ্ঞিকগণ আদিত্যকে বৈশ্বানর মানতেন । এই [পৃথিবী, অন্তরিক্ষ এবং দ্যু] লোকসমূহে আরোহ দ্বারা প্রাতঃসবন, মাধ্যন্দিন-সবন এবং তৃতীয় সবনকে আরোহ বলা হয়েছে, অর্থাৎ প্রাতঃ-সবনে যজমান পৃথিবী-স্থানীয় হন, মাধ্যন্দিন-সবনে অন্তরিক্ষ-স্থানীয় এবং তৃতীয় সবনে দ্যু-স্থানীয় হন । যজ্ঞ সমাপ্তির পূর্বে দ্যুলোকে পৌঁছে যাওয়া যজমানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা প্রয়োজন। ফিরে আসার অনুকৃতি (অনুকরণ) শুরু হয় বৈশ্বানরীয় আদিত্য-দেবতা সূক্ত দিয়ে।
 
বেদি-নির্মাণ, অগ্ন্যাধান পুষ্করপর্ণ-নিধান এবং সবনসমূহের আরোহাদ্যি অনুকরণ দ্বারা সৃষ্টিযজ্ঞের সাথে‌ যে‌ তুলনা ব্রাহ্মণাদি শাস্ত্রে‌ দর্শানো‌ হয়েছে, এ দ্বারা‌ স্পষ্ট যে‌, শ্রৌতযজ্ঞ সৃষ্টিযজ্ঞের‌ই রূপক । এবং সৃষ্টিযজ্ঞ অর্থাৎ আধিদৈবিক জগতের সহিত অধ্যাত্মের সম্বন্ধ রয়েছে । আধিদৈবিক জগতের জ্ঞান দ্বারা অধ্যাত্ম অর্থাৎ শারীরযজ্ঞের পরিজ্ঞান হয় । একারণে নিরুক্তকার মহর্ষি যাস্ক “দেবতাঽধ্যাত্মে বা” [পুষ্পফলে ] [ নিরুক্ত ১|১৯ ] বচন উল্লেখ করে অধিদৈবিক জ্ঞানকে অধ্যাত্ম জ্ঞানের কারণ দর্শিয়েছেন।
 
দর্শ-পৌর্ণমাস প্রক্রিয়ার সমস্ত মুখ্য-মুখ্য ক্রিয়া এবং পদার্থ আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্মিক জগতের সাথে তুলনা‌ দর্শানো হয়েছে শতপথ ব্রাহ্মণে [১১।২।৪।১ থেকে ১১।২।৭।৩৩ পর্যন্ত ] ।
উপর্যুক্ত সাম্যতার আধারে এই সিদ্ধান্তে‌ আসা যায়‌ যে‌, প্রারম্ভকালে যজ্ঞের‌ প্রত্যেক ক্রিয়া এবং পদার্থ আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্মিক জগতের ক্রিয়া এবং পদার্থের পূর্ণ প্রতিনিধিত্ব করতো।
 

  • যজ্ঞের প্রাদুর্ভাব কাল

আর্যাবর্তের ইতিহাস অনুসারে সর্গের প্রারম্ভে যদ্রূপভাবে বেদে বর্ণিত বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা, রাজ্য-ব্যবস্থা আদির প্রচলন ছিল না, তদ্বৎ-ই দ্রব্যময় যজ্ঞের প্রচলন হয় নাই। কেননা সেই সময়ে সমগ্র মানবজাতি সত্ত্বগুণ সম্পন্ন সাক্ষাৎকৃতধর্মা পরাবরজ্ঞ পরমমেধাবী ছিলেন । মহাভারত আদি ইতিহাস গ্রন্থের অনুসারে সেই সময়ে সমগ্র জগৎ ব্রাহ্মময় ছিল । [19]
 
যজ্ঞের প্রসঙ্গে শাঙ্খায়ন আরণ্যকে [৪।৫] বর্ণনা হয়েছে -
তদ্ধস্মৈতৎপূর্বে বিদ্বাংসোঽগ্নিহোত্রং চ জুহ্বাঞ্চক্রুঃ । ”
ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে‌ও অনেকত্র ‘‘য় উ চৈনং বেদ” বচন প্রয়োগ‌ করে যজ্ঞ করা এবং তা‌ তত্ত্বতঃ জানার সমান ফল দর্শানো হয়েছে । ইহাই মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী জী তাঁর প্রণীত সংস্কার-বিধি গ্রন্থের গৃহস্থাশ্রম প্রকরণে বর্ণনা করেছেন ।
 
অন্য সমস্ত সামাজিক ব্যবস্থার ন্যায় যাজ্ঞিক কর্মকাণ্ডের প্রাদুর্ভাব কৃতযুগ এবং ত্রেতাযুগের সন্ধিকালে হয়েছে । একারণে বিবিধ‌ স্থলে যজ্ঞের উৎপত্তি কৃতযুগের অন্তে এবং ত্রেতা যুগের আরম্ভে বলা হয়েছে । [20] প্রারম্ভে কেবল একাগ্নিসাধ্য যজুর্বেদমাত্র দ্বারা সম্পন্ন অগ্নিহোত্রাদি হোমের প্রচলন ছিল ।
 

  • প্রারম্ভিক যজ্ঞ

 
প্রারম্ভে যজ্ঞের‌ বিবিধ‌ প্রকরণের‌ নিয়মাবলী মহত্ত্বপূর্ণ দৃষ্টিতে বৈজ্ঞানিক আধারে করা হতো‌ । অতঃ প্রারম্ভে যজ্ঞের বিবিধ প্রকরণ আধিদৈবিক জগতের সাথে সাক্ষাৎ সম্বন্ধ ছিল । যথাঃ অগ্নিহোত্র অহোরাত্রের‌ সাথে, দর্শপৌর্ণমাস কৃষ্ণপক্ষ এবং শুক্লপক্ষের সাথে, তথা চাতুর্মাস্য তিন ঋতুর সাথে । অগ্নিহোত্র এবং দর্শপৌর্ণমাস‌ বিধির‌ আধিদৈবিক ব্যাখ্যা শতপথ ব্রাহ্মণের‌ ১১তম কাণ্ডে উপলব্ধ
চাতুর্মাস্য বিষয়ে ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে বর্ণন হয়েছে-
ভৈষজ্যযজ্ঞা বা এতে যচ্চাতুর্মাস্যানি । তস্মাদৃতুসন্ধিষু প্রয়ুজ্যন্তে । ঋনুসন্ধিষু হি ব্যাধির্জায়তে ।”
[ কৌষীতকি‌ ব্রাহ্মণ. ৫।১ ]
 
এরূপভাবে গোপথ ব্রাহ্মণের‌ উত্তরার্ধ ১।১৯ নং শ্লোকে‌ও বলা হয়েছে ।
 
মহাভারতের শান্তিপর্ব ২৬৯ তম অধ্যায়ে অগ্নিহোত্র, দর্শপৌর্ণমাস এবং চাতুর্মাস্য এই ত্রয়ী যজ্ঞকে প্রাচীন যজ্ঞ বলা হয়েছে ।
যথা -
দশং চ পৌর্ণমাসং চ প্রগ্নিহোত্রং চ ধীমতঃ।
চাতুর্মাস্যানি চৈবাসন্ তেষু ধর্মঃ সনাতনঃ॥’’
 

  • যাজ্ঞিক প্রক্রিয়া এবং বেদার্থ

প্রারম্ভে যখন আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্মিক জগতের সাম্য আধারে যজ্ঞের বিবিধ প্রকরণের প্রচলন‌ হয়, তখন আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্মিক জগতের ক্রিয়া তথা পদার্থসমূহের বর্ণনকারী বেদমন্ত্রের অভিপ্রায় বোধগম্য করানোর‌ জন্য সেই-সেই মন্ত্রের সম্বন্ধ যজ্ঞের তত্তৎ ক্রিয়াসমূহের‌ সাথে করা হয়েছে ।
আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্মিক জগতের বর্ণনকারী বেদমন্ত্রসমূহ সেই-সেই প্রতিনিধিভূত যাজ্ঞিক ক্রিয়া তথা পদার্থের সাথে কোন‌ও সাক্ষাৎ সম্বন্ধ নেই । অর্থাৎ যাজ্ঞিকপ্রক্রিয়ানুসারে ব্যাখ্যাত বেদার্থ বেদের মুখ্য অর্থ নয় । এই প্রক্রিয়া শুধুমাত্র আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্মিক বেদার্থকে বুদ্ধিগ্রাহ্য‌ করানোর নিমিত্তমাত্র ।
 
যজ্ঞের প্রারম্ভিক কালে যাজ্ঞিকপ্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থের এরূপ স্থিতিই ছিল । একারণে সেই সময়ে যাজ্ঞিক ক্রিয়াসমূহেই মন্ত্র বিনিযুক্ত করা হতো, যা আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্মিক অর্থের সাথে-সাথে তার প্রতিনিধিরূপ যাজ্ঞিক ক্রিয়াসমূহের‌ও শব্দশঃ বর্ণন করায় সমর্থ ছিল । [21] উত্তরকালে যখন যজ্ঞের প্রধানতা বৃদ্ধি পেতে‌ থাকে, তখন বেদের আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ানুসারী মুখ্যার্থ গৌণরূপে প্রকাশ পেতে থাকে এবং যাজ্ঞিক-প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থের প্রধানতা বৃদ্ধি পায় । পরিণামস্বরূপ সমগ্র‌ বেদার্থ যাজ্ঞিক প্রক্রিয়া পর্যন্ত‌ই সীমিত হয়ে যায় । অর্থাৎ “যজ্ঞার্থং বেদাঃ প্রবৃত্তাঃ” [22] বাদে প্রবৃত্ত হয় ।

  • কাল্পনিক বিনিয়োগ

উত্তরকালে যখন আর্যাবর্তে যজ্ঞের মান তথা প্রভাব বৃদ্ধি এবং প্রত্যেক কামনা সিদ্ধির জন্য যজ্ঞের প্রচলন হয়, তখন সেই সমস্ত যজ্ঞের‌ বিবিধ ক্রিয়ার অনুরূপ বেদমন্ত্র উপলব্ধ না হ‌ওয়ায় মন্ত্রার্থ উপেক্ষা করে যাজ্ঞিক ক্রিয়ার সাথে এসবের সম্বন্ধ যুক্ত‌ করে অর্থাৎ মন্ত্রার্থের বিপরীত বিনিয়োগ প্রয়োগের আরম্ভ হয় । ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে এবং শ্রৌতসূত্রে এই প্রকার অনেক কাল্পনিক বিনিয়োগ উপলব্ধ রয়েছে ।
যথা – মৈত্রায়ণী সংহিতার ৩।২।৪ -এ বর্ণন হয়েছে –
নিবেশনঃ সঙ্গমনো বসূনাম্ ইত্যৈন্দ্রয়া গার্হপত্যমুপতিষ্ঠতে ।
অর্থাৎ অগ্নিচয়নে ‘‘নিবেশনঃ সঙ্গমনো বসূনাম্’’ [মৈ. সং. ২।৭।১২ (১৫১) ] এই ইন্দ্রদেবতাযুক্ত ঋচা দ্বারা গার্হপত্যাগ্নি উপস্থান করা হয় ।
যাজ্ঞিকগণের সিদ্ধান্ত অনুসারে ইন্দ্র দ্বারা বিশেষণ-বিশিষ্ট মহেন্দ্র, বৃত্রহা ইন্দ্র, পুরন্দর ইন্দ্র আদি‌ যখন‌ ভিন্ন-ভিন্ন দেবতা [23], তখন ইন্দ্র এবং অগ্নি ভিন্ন-ভিন্ন দেবতা হ‌‌ওয়ার‌ কোন‌ও সন্দেহ নাই । এই অবস্থায় ইন্দ্র দেবতাবিশিষ্ট ঋচা দ্বারা গার্হপত্য অগ্নিকে উপস্থান অভিঘাবৃত্তির মাধ্যমে কীরূপ হ‌ওয়া সম্ভব‌ ? [24] এ প্রকরণে‌ নিশ্চিত‌ভাবে ইন্দ্র পদের মুখ্যার্থ ত্যাগ করে গৌণী কল্পনা করা হয়েছে । [25] এ দ্বারা স্পষ্ট যে‌, এই প্রকার বিনিয়োগ ‘‘য়ৎকর্ম ক্রিয়মাণমৃগ্যজুর্বাঽভিবদতি” রূপী বিনিয়োগের পরিভাষার দৃষ্টিতে তা সম্পূর্ণ কাল্পনিক‌ই ।
এই প্রকারের অনেক কাল্পনিক বিনিয়োগ শ্রৌতসূত্রে উপলব্ধ ।
যথা –
দধিক্রাব্ণো প্রকারিষম্ ইতি বা সম্বুভূষন্ দধিভক্ষম্ ।”
[ শাঙ্খায়ন শ্রৌত. ৪।১৩।২ ]
দধিক্রাব্ণো প্রকারিষম্ ইতি অগ্নীধ্রীয়ে দধিদ্রপ্সান্ প্রাশ্য” [26]
[ আশ্বলায়ন শ্রৌত. ৬।১৩ ]
অর্থাৎ—‘দধিক্রাব্ণো অকারিষম্' দ্বারা দ‌ই ভক্ষণ করতে হবে । মন্ত্রগত 'দধিক্রাবা' পদ অশ্ববাচক । দ্রষ্টব্য‌. নিঘণ্টু. ১|১৪ । 'দধিক্রাবা' পদান্তর্গত 'দধি' অবয়ব এর 'দ‌ই' বাচক 'দধি' শব্দের সাথে কোন‌ও সম্বন্ধ নেই। অতএব মহর্ষি যাস্ক দধিক্রাবা সদৃশ তথা সমানার্থক 'দধিক্রাঃ' পদের নির্বচন “দধৎ কামতীতি বা, দধৎ ঋন্দতীতি বা, দধদ্ আকারী ভবতীতি বা” [নিরুক্ত. ২।২৬] দর্শিয়েছেন । তদনুসার 'দধি' শব্দ 'কি' অথবা 'কিন্' [অষ্টা. ৩।২।১৭১] প্রত্যয়ান্ত । উত্তরকালে‌ ধূর্ত‌, স্বার্থোদ্ধত তথাকথিত যাজ্ঞিকগণ না কেবল 'দধিক্রাবা' পদের, বরং সম্পূর্ণ মন্ত্রার্থ উপেক্ষা করে দ‌ইবাচক 'দধি' শব্দের সাথে অক্ষর-বর্ণসাদৃশ্য-মাত্রের আধারে উক্ত মন্ত্রকে 'দধিপ্রাশন'-এ বিনিয়োগ করেছে‌।
নিরুক্ত ৭।২০ নং শ্লোকে‌‌ও বর্ণিত হয়েছে - “ঋগ্বেদ এর সমস্ত শাখায় 'জাত-বেদাঃ' দেবতাবিশিষ্ট এক‌ই 'গায়ত্র তৃচ' বিদ্যমান । যজ্ঞে 'জাতবেদাঃ' দেবতা-বিশিষ্ট অনেক গায়ত্রীছন্দস্ক ঋচার আবশ্যকতা হয়ে‌ থাকে। একারণে 'জাতবেদাঃ' দেবতাবিশিষ্ট ঋচার‌ স্থানে, যা‌ 'অগ্নি' দেবতা-বিশিষ্ট গায়ত্রীছন্দস্ক ঋচা‌ প্রযুক্ত‌ হয়েছে, তা‌ বিনিযুক্ত হয়ে যায়‌ ।" [27]
নিরুক্ত ১২।৪০ নং শ্লোকে পুনঃ বর্ণিত হয়েছে- "ঋগ্বেদ এর সমস্ত শাখায় 'বিশ্বেদেব' দেবতা-বিশিষ্ট এক‌ই গায়ত্র তৃচ উপলব্ধ । অতঃ তৎ-স্থানে যা 'বহুদেবতা'-বিশিষ্ট গায়ত্র ঋচা রয়েছে , তা‌ বিনিযুক্ত হয় । শাকপূণি 'বিশ্বেদেব' দেবতা-বিশিষ্ট ঋচার স্থানে 'বিশ্ব' পদ ঘটিত ঋচার বিনিয়োগ মানতেন ।" [28]
উপলব্ধ ব্রাহ্মণ শাস্ত্রের‌ মধ্যে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ সর্ব প্রাচীন শাস্ত্র । এই ব্রাহ্মণে যজ্ঞে ক্রিয়মাণ তত্তৎ ক্রিয়াকলাপকে সাক্ষাৎ বর্ণনাকারী মন্ত্র বিনিয়োগকে যজ্ঞের সমৃদ্ধি (শ্রেষ্ঠতা) বলা হয়েছে । [29]
এ দ্বারা স্পষ্ট যে‌, উক্ত ব্রাহ্মণের‌ সময়কালে তত্তৎ যজ্ঞীয় ক্রিয়াকলাপকে সাক্ষাৎ অথবা বৈদিক‌ পরম্পরার কথঞ্চিৎ প্রতিপাদন না করে এমন মন্ত্রের পদ যা অক্ষরবর্ণের সাদৃশ্য দ্বারা বিনিয়োগ [30] করার পরিপাটি আরম্ভ হয় ।
অতঃ পদ অক্ষর বর্ণমাত্র সাদৃশ্য দ্বারা কাল্পনিক বিনিয়োগের আরম্ভ হয় ভারত-যুদ্ধের ২০০০ বর্ষ পূর্ব থেকে ।
 

  • কাল্পনিক মন্ত্র রচনা

 
যখন বিবিধ প্রকারের যজ্ঞের প্রচলন অত্যন্ত বৃদ্ধি‌ পেতে থাকে, তখন সেই সব যজ্ঞে ক্রিয়মাণ বিবিধ ক্রিয়া-কলাপের অনুরূপ মন্ত্র উপলব্ধ না হ‌ওয়ার‌ দরুন মন্ত্রকল্পনার আরম্ভ হয় । [31] এই প্রকারে কে অনেক কাল্পনিক মন্ত্র ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং শ্রৌতসূত্র আদি গ্রন্থে উপলব্ধ । বিশেষতঃ গৃহ্যসূত্রসমূহে এরূপ কাল্পনিক মন্ত্রের‌ আধিক্য‌ বিদ্যমান ।
 
এসব কাল্পনিক মন্ত্রের রচনার আরম্ভ ভারত যুদ্ধ থেকে প্রায়ঃ দুই-আড়াই সহস্র বর্ষ পূর্বে হয়েছে‌ । [32] বৈদিক সাহিত্যে প্রযুক্ত বিশিষ্ট শব্দসমূহ সন্নিবেশমাত্র করে স্বীয় স্বার্থ সিদ্ধির জন্য কাল্পনিক তথাকথিত মন্ত্র রচনা করে ।
 
 

  • মন্ত্রানর্থক্য-বাদ

 
যাজ্ঞিক কালে বেদ এর উপযোগের একমাত্র কেন্দ্র যজ্ঞ নির্ধারিত হয় । [33] কর্মকাণ্ডে সাক্ষাৎ অবিনিযুক্ত বেদভাগ নিষ্প্রয়োজন যেনো না মানা হয় [34], একারণে বেদের সমস্ত মন্ত্র কর্মকাণ্ডের সাথে যেন তেন প্রকারেণ সম্বন্ধ যুক্ত‌ করে [35] । মন্ত্রের মুখ্যতা সমাপ্ত হয়ে বিনিয়োজক ব্রাহ্মণ গ্রন্থ‌ই মুখ্য হয় । ব্রাহ্মণ গ্রন্থের জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে 'উরু প্রথস্ব' ইত্যাদি মন্ত্রে বিদ্যমান সাক্ষাৎ বিধায়ক লোট্ লিঙ এবং লেট্ লকারসমূহকে বিধায়ক না মেনে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের 'প্রথয়তি' ইত্যাদি পদগুলিকেই বিধি অর্থসম্পন্ন (বিধায়ক) মানা হয়েছে। [36] অর্থাৎ প্রারম্ভে মন্ত্রের কোন পদ বিশেষের মূখ্য অর্থ উপেক্ষিত ছিল। কিন্তু উত্তর কালক্রমে, সম্পূর্ণ মন্ত্রটিকে অর্থহীন বিবেচনা করে, এটির পদমাত্রের সাদৃশ্য দ্বারা বিনিয়োগের কল্পনা করা হয়েছিল। "ভদ্রং কর্ণেভিঃ শৃণুয়াম দেবাঃ' তথা 'বক্ষ্যন্তি বেদাগনী- গন্তি কর্ণম্" ইত্যাদি মন্ত্রসমূহের কর্ণবেধ সংস্কারে বিনিয়োগ [37] এমনই। এই মন্ত্রগুলিতে এমন কোনও পদ নেই, যা কর্ণভেদের বাচক। মন্ত্রে পঠিত কর্ণ পদমাত্রকে দেখে চোখ বন্ধ করে কর্ণভেদে এর বিনিয়োগ করে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে পদৈকদেশমাত্রের সাদৃশ্যে বিনিয়োগ শুরু হয়। যথা দধিভক্ষণে [38] 'দধিক্রাভনো প্রকাশম'। এরপর অক্ষরমাত্রের সাদৃশ্যে বিনিয়োগের কল্পনা শুরু হয়। যেমন - 'শন্নো দেবী' শনৈশ্বরের, এবং 'উদবুধ্যাস্ব' বুধের পূজা করা হয়। [39]
এই প্রকারে উত্তরোত্তর কাল্পনিক বিনিয়োগের আধিক্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কৌৎস এর‌ ন্যায় কর্মকাণ্ডী স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন- "মন্ত্র অনর্থক " । [40] অর্থাৎ মন্ত্র যজ্ঞের ক্রিয়মাণ কর্মের সাথে কোন‌ও আর্থিক সম্বন্ধ নেই । যজ্ঞান্তর্গত কোন‌ও কর্মবিশেষে প্রয়োগ হওয়ার অদৃষ্ট ( ধর্ম বিশেষ ) সৃষ্ট হয় ।
এরূপভাবে‌ ধূর্ত যাজ্ঞিক দ্বারা উদ্ভাবিত মন্ত্রানর্থক্যবাদ এর প্রভাব বেদের তাৎকালিক শাখা তথা ব্রাহ্মণ গ্রন্থে‌ও স্পষ্ট লক্ষিত হয় । উক্ত কারণেই এসব শাখা তথা ব্রাহ্মণ গ্রন্থসমূহে (শতপথ ব্রাহ্মণ‌ ব্যতীত) বিনিয়োগের‌ই ( এই মন্ত্র দ্বারা যজ্ঞের অমুক কর্ম করো ) উল্লেখ পাওয়া যায় । অতএব ব্রাহ্মণের লক্ষণ‌ই “বিনিয়োজকং ব্রাহ্মণম্” [41] এমন ধারণা‌ যাজ্ঞিকগণের মধ্যে প্রসিদ্ধ হয়ে যায় । এসব ব্রাহ্মণ গ্রন্থের যেসব স্থলে মন্ত্রের অর্থ উপলব্ধ হয়ে থাকে, তা‌ প্রায়ঃ আনুষঙ্গিক, অর্থাৎ মন্ত্রার্থের পরিজ্ঞানের নিমিত্তে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের রচনা হয় নাই । অতঃ এসব ব্রাহ্মণ গ্রন্থ (শতপথ ব্যতীত) দ্বারা বেদের যাজ্ঞিক অর্থ‌ বুদ্ধিগ্রাহ্য হ‌‌ওয়া সম্ভবপর নয় । কেবল ব্রাহ্মণ- প্রদর্শিত বিনিয়োগের আধারে যাজ্ঞিকপ্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থের ধারণা হয়ে থাকে ।
 

  • মন্ত্রানর্থক্যবাদ এর খণ্ডন

 
কৌৎস আদি যাজ্ঞিকগণ দ্বারা পল্লবিত মন্ত্রানর্থক্যবাদের প্রতিবাদ মহর্ষি‌ জৈমিনি [42] এবং মহর্ষি যাস্ক [43] অত্যন্ত‌ প্রগাঢ়তার সহিত‌ করেছেন ।
মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য [44] শতপথ ব্রাহ্মণে যাজুষ মন্ত্রসমূহের বিনিয়োগ দর্শানোর স্থলে শুক্ল যজুর্বেদ প্রায়ঃ ১৮টি অধ্যায়ের মন্ত্রের যাজ্ঞিক অর্থ‌ও দর্শিয়েছেন ।
এই বিস্তর বিবরণ দ্বারা স্পষ্ট যে‌, যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ায় উত্তরোত্তর হ‌ওয়া পরিবর্তন এবং পরিবর্ধনের‌ দরুন বেদার্থের উপর‌ও জটিল প্রভাব পড়েছে ।
যদি মহর্ষি যাস্ক, মহর্ষি জৈমিনি এবং মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য আদি মন্ত্রানর্থক্যবাদ এর প্রবল খণ্ডন না করতেন, তাহলে‌ বর্তমানে উপলব্ধ বাঙ্‌ময়ে‌ যাজ্ঞিক-প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থের যেসব নির্দশন‌ পাওয়া যায়‌, তাও‌ অপ্রাপ্য‌ হতো ।
 
প্রমাণ সূত্রঃ
 
1.‌ মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্ব অনুসারে যখন‌ জামদগ্ন্য পরশুরাম অমর্শে এসে মেদিনীকে নিঃক্ষত্রিয় করে দেন এবং দ্রাবিড় আভীর পুণ্ড্রাদি বৃষলে পরিণত হয় (“বৃষলত্বং গতা লোকে” মনু. ১০।৪৩) ; তৎপশ্চাৎ ভৃগু মানব ধর্মশাস্ত্রের প্রবচন দেন ।
2. 'ধর্ম' শব্দের মূলার্থ -- “ধরতি লোকং, ধার্য়তে বা জগদ্ য়েন, সঃ” যাহাতে সংসার সম্যক্‌রূপ দ্বারা‌ স্থিতি রয়েছে । এরূপ ভাবে ধর্ম শব্দের মানবীয় কর্তব্য কর্মের বাচক । একারণে বেদে শ্রেষ্ঠতম=যজ্ঞস্বরূপ কর্মের জন্য (“যজ্ঞো বৈ শ্রেষ্ঠতমং কর্ম ।” শতপথ‌. ১।৭।১।৫ ) ধর্মশব্দের প্রয়োগ বিদ্যমান – “য়জ্ঞেন য়জ্ঞময়জন্ত দেবাস্তানি ধর্মাণি প্রথমান্যাসন্” (যজু. ৩১।১৬ )
3. আন্বীক্ষিকী এর মুখ্য গ্রন্থ - গৌতমীয় ন্যায়শাস্ত্র তথা কণাদীয় বৈশেষিক শাস্ত্র । এই শাস্ত্রদ্বয়ের প্রতিপাদ্য বিষয় --পদার্থের স্বরূপ এবং তার গুণসমূহের বর্ণন । প্রমাণ আদির প্রতিপাদন প্রমেয়বিজ্ঞান = পদার্থ বিজ্ঞানকে নির্দেশ করে করা হয়েছে, অর্থাৎ প্রমেয়জ্ঞান প্রমাণজ্ঞানের সাধন। প্রমেয় এর জ্ঞান বুদ্ধিগ্রাহ্য করানো এই শাস্ত্রদ্বয়ের মুখ্য প্রয়োজন । অতএব মনুস্মৃতির উক্ত‌ শ্লোকের আন্বীক্ষিকী পদ পদার্থ বিজ্ঞান অর্থে প্রযুক্ত‌ হ‌ওয়া‌ যথার্থ । কৌটিল্য “সাংখ্য যোগো লোকায়তং চেত্যান্বীক্ষিকী” এই বচনে সাংখ্য এবং যোগ শাস্ত্রকেও আন্বীক্ষিকী বলে অভিহিত করেছেন । ইহা‌ উক্ত‌ সিদ্ধান্তের‌ পোষক ।
4. আত্মা শব্দ শরীর, জীব এবং ঈশ্বর এই ত্রয়ী সত্তার জন্য প্রযুক্ত হয় । আত্মা এর জীব এবং ঈশ্বর অর্থ সর্বপ্রসিদ্ধ ।
“হন্তি আত্মানমাত্মনা” তথা “তস্মিন্ য়দ্ য়ক্ষমাত্মন্বদ্” (অথর্ববেদ‌. ১০।২।৩২) আদি মন্ত্রে আত্মা শব্দ শরীর অর্থেও প্রযুক্ত হয়েছে ।
5. দ্রষ্টব্য‌. মেধাতিথি, গোবিন্দরাজ আদি প্রাচীন টীকাকারগণের টীকা ।
6. আর্যভট্ট তাঁর স্বীয় গ্রন্থের অন্তে জ্যোতিষ শাস্ত্রকে বেদ থেকে নিঃসৃত বলেছেন । সুশ্রুত সংহিতায় আয়ুর্বেদকে অথর্ববেদ এর উপবেদ বলা হয়েছে —“ইহ খল্বায়ুর্বেদো নাম য়দুপাঙ্গমথর্ববেদস্য” (সূত্র স্থান. অধ্যায়. ১ )
সমস্ত শাস্ত্র বেদমূলকতার জন্য দ্রষ্টব্যঃ -
“য়ানীহাগমশাস্ত্রাণি যাশ্চ কাশ্চিৎ প্রবৃত্তয়ঃ। তানি বেদং পুরস্কৃত্য প্রবৃত্তানি য়থাক্রমম্ ।।”
[ মহাভারত. অনুশাসন. অধ্যায়.১২২ ]
“ন বেদশাস্ত্রাদন্যত্তু কিঞ্চিচ্ছাস্ত্রং হি বিদ্যতে । সর্বং বিনিঃসৃতং শাস্ত্রং বেদশাস্ত্রাৎ সনাতনাৎ ।।
দুর্বোধং তু ভবেদয়স্মাদধ্যেতু নৈব শক্যতে । তস্মাদুদ্ধৃত্য সর্বং হি শাস্ত্রং তু ঋষিভিঃ কৃতম্॥”
[ বৃহদ্‌যোগিযাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি.অধ্যায় ১২ ; স্মৃতিসন্দর্ভ ৪র্থ ভাগ ]
7. বেদ মন্ত্রে বহুত্র পদার্থবিজ্ঞান স্পষ্ট প্রতিপালন বিদ্যমান । যথা— “অগ্নিহিমস্য ভেষজম্” (যজুর্বেদ‌. ২৩।১০, ৪৬) ; “অপ্স্বন্তরমমৃতমপ্সু ভেষজম্” (অথর্ববেদ‌. ১।৪।৪) ; “ক্ষুধামারং তৃষ্ণামারমগোতামনপত্যতাম্ । অপামার্গ ত্বয়া বয়ং সর্বং তদপ মৃজ্মহে” (অথর্ববেদ. ৪।১৭।৬) । সৌর এবং চান্দ্র বর্ষের ভেদকে মলমাস দ্বারা সমঝোতা করার নির্দেশ – “বেদ মাসো ধৃতব্রতো দ্বাদশ প্রজাবতঃ । বেদা য় উপ জায়তে” (ঋগ্বেদ. ১।২৫।৮) ইত্যাদি ।
8. অনেক আচার্য চিকিৎসাশাস্ত্রকে ঋগ্বেদ উপবেদ মানেন ( দ্রষ্টব্য - চরণব্যূহ ; ব্রহ্মোক্ত যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা- স্মৃতিসন্দর্ভ ৪র্থ ভাই ;সংস্কার-বিধি বেদারম্ভ সংস্কারের অন্তে) । পরন্তু সুশ্রুত (সূত্রস্থান. ১।৩) ; কাশ্যপ (বিমান স্থান ) আদি সংহিতায় আয়ুর্বেদকে অথর্ববেদ এর উপবেদ বলা হয়েছে ।
9. “পুরা খলু অপরিমিতশক্তিপ্রভাপ্রভাববীয়ং…….. ধর্মসত্ত্বশুদ্ধতেজসঃ পুরুষা বভূবুঃ । তেষাং ক্রমাদপচীয়মানসত্ত্বানাম্ উপচীয়মানরজস্তমস্কানাং……… তেজোঽন্তর্দধে ।” পরাশরকৃত জ্যোতিষসংহিতার বচন, ভট্ট উৎপলকৃত বৃহৎসংহিতার টীকায় উদ্ধৃত তথা পণ্ডিত সূরমচন্দ্র জী বৈদ্যবাচস্পতিকৃত 'আয়ুর্বেদ কা ইতিহাস' ।
10. এর নির্দেশ দুর্গাচার্য নিরুক্ত টীকার ৪।১৬ নং শ্লোকে -“মন্ত্রার্থ পরিজ্ঞানাদেব হ্যগ্নেরব্যাত্মাধিদৈবাধিভূতাধিয়জ্ঞেষ্ববস্থানম্” বেদার্থের ত্রিবিধ প্রক্রিয়া অনুসারে অধিদেব-অধিভূত-অধ্যাত্ম এক ত্রিক ; অপর ত্রিক অধিদেব-অধিযজ্ঞ-অধ্যাত্ম । দুর্গাচার্য এই দূই ত্রিক একত্রিত করে চতুর্বাদরূপে লিখেছেন ।
11. “ভ্রশ্যতি তু কৃতয়ুগে............'লোভঃ প্রাদুরাসীৎ ॥ ২৮ ॥ ততস্ত্রেতায়াং লোভাদভিদ্রোহঃ , অভিদ্রোহাদ্ অনৃতবচনম্ ,অনৃতবচনাৎ কামক্রোধমানদ্বেষপারুষ্যাভিঘাত- ভয়তাপশোকচিন্তোদ্বে গাদয়ঃ প্রবৃত্তাঃ” ॥২৯॥ (চরক সংহিতা. বিমানস্থান. অধ্যায়.৩ )
12. “জলে মৎস্যানিবাভক্ষ্যন্ দুর্বলং বলবত্তরাঃ । অরাজকাঃ প্রজাঃ পূর্বং বিনেশুরিতি নঃ শ্রুতম্ । পরস্পরং ভক্ষয়ন্তো মৎস্যা ইব জলে কৃশান্ ॥”
( মহাভারত‌. শান্তিপর্ব. অধ্যায়. ৬৭ )
13. “মাৎস্যন্যায়াভিভূতাঃ প্রজা মনুং বৈবস্বতং রাজানং চক্রিরে” । (অর্থশাস্ত্র ১।১৩)
14. যজ্ঞং ব্যাখ্যাস্যামঃ ।
(কাত্যায়ন শ্রৌত. ১।২।১ )
15. বেদে বিষ্ণু‌ এর আরেকটি নাম সূর্য, তার অঙ্গিরস নামক কিরণকে বরাহ নামে অভিহিত করা হয় । একে জাতিরূপে একবচনে এমূষ বরাহ‌ও বলা হয় । শতপথ ব্রাহ্মণে‌ (১৪।১।২।১১) বলা হয়েছে - “তামেমূষ ইতি বরাহ উজ্জঘান” ।
এই এমূষ বরাহ এর বর্ণন ঋগ্বেদে (৮।৭৭।১০) বিদ্যমান । এমূষ শব্দের‌ অর্থ‌– আ= সবদিক‌ থেকে, ঈম্ =জল ( ঈম্ উদকনাম, নিঘণ্টু ১।১২ ) ঊষ= তপ্তকারী ।
16. ব্রহ্মাণ্ডে এই 'ক' অগ্নিরূপ প্রজাপতি । শরীরে 'ক' অগ্নিরূপ জীবাত্মা প্রজাপতি ।
17. 'অশ্মনো লোহসমুত্থিতম্' । (মহাভারত‌. উদ্যোগপর্ব) ; রসার্ণব তন্ত্রে (৮।৯৯) মেলোহসঙ্করজ সুবর্ণ এর বর্ণন বিদ্যমান ।
18. শাবর ভাষ্য ১।২।১৮ -এ উদ্ধৃত শ্রুতি ।
19. সর্বং ব্রাহ্মমিদং জগৎ । (মহাভারত‌. শান্তিপর্ব. ১৮৮)
20.
ইদং কৃতয়ুগং নাম কালঃ শ্রেষ্ঠঃ প্রবর্তিতঃ। অহিংস্যা যজ্ঞপশবো যুগেঽস্মিন্ন তদন্যথা।।
(মহাভারত‌. শান্তিপর্ব. ৩৪০)
ত্রেতাদৌ কেবলা বেদা যজ্ঞা বর্ণাশ্রমাস্তথা।
(মহাভারত‌. শান্তিপর্ব. ২৩৮ )
ত্রেতায়ুগে বিধিস্ত্বেষ যজ্ঞানাং ন কৃতে যুগে।
(মহাভারত‌. শান্তিপর্ব ২৩২)
যথা ত্রেতায়ুগমুখে যজ্ঞস্যাসীৎ প্রবর্তনম্ ।
(বায়ু পুরাণ‌. ৫৭ )
তদেতৎ সত্যং মন্ত্রেষু কর্মাণি কবয়ো যান্যপশ্যংস্তানি ত্রেতায়াং বহুধা সন্ততানি।
(মুণ্ডক উপনিষদ. ১।২।১)
21. 'এতদ্ বৈ যজ্ঞস্য সমৃদ্ধংয়দ্রপসমৃদ্ধ যৎকর্ম ক্রিয়মাণমৃগ্যজুর্বাভিবদতি ।
(গোপথ ব্রাহ্মণ‌.২।২।৬)
তুলনা – ঐতরেয় ব্রাহ্মণ. ১।৪
22. 'বেদা হি যজ্ঞার্থমভিপ্রবৃত্তাঃ'
(বেদাঙ্গজ্যোতিষের অন্তে )
'আম্নায়স্য ক্রিয়ার্থত্বাৎ ...।'।
(মীমাংসা.১।২।১)
23. তুলনা – 'তস্মাদ্ দেবতান্তরমিন্দ্রান্মহেন্দ্রঃ (শাবরভাষ্য মীমাংসা. ২।১।১৬) 'অথোতাভিধানঃ সংয়ুজ্য হবিশ্চোদয়তি – ইন্দ্রায় বৃত্রঘ্নে, ইন্দ্রায় বৃত্রতুরে, ইন্দ্রায়াংহোমুচে । (নিরুক্ত ৭।১৩)
24. বচনাত্ত্বয়থার্থমৈন্দ্রী স্যাৎ ( মীমাংসা. ৩।২।৩)
25. মীমাংসা ৩।২।৪ সূত্রস্থ শাবরভাষ্যে এই প্রসঙ্গে উল্লেখ‌ হয়েছে — 'গুণসংয়োগাদ্ গৌণমিদমভিধানং ভবিষ্যতি । ভবতি হি গুণাদপ্যভিধানম্ । যথা সিংহো দেবদত্তঃ, অগ্নির্মাণবক ইতি । এবমিহাপ্যনিন্দ্রে গার্হপত্যে ইন্দ্রশব্দো ভবিষ্যতি ।'
এই অভিপ্রায়কে সায়ণ অথর্ববেদ এর ১।১।১ নং মন্ত্র-ভাষ্যে‌ লিখেছে - 'বলীয়স্যা শ্রুত্যা লিঙ্গ বাধিত্বা গুণ কল্পনয়াপি বিনিয়োগসম্ভবাৎ । তত্র হি ঐন্দ্রমন্ত্রে ইন্দ্রশব্দস্য গৌরণীং বৃত্তিমাশ্রিত্য গার্হপত্যোপস্থানে বিনিয়োগঃ কৃতঃ । '
26. তুলনা — 'দধিক্রাব্ণো প্রাঙ্‌মুখো দধি প্রাশ্য ।' কাশ্যপ ( আয়ুর্বেদীয় ) সংহিতা ।
27. ‘তদেতদেকমেব জাতবেদসং গায়ত্রং তৃচং দশতয়ীষু বিদ্যতে যত্তু কিঞ্চিদাগ্নেয়ং তজ্জাতবেদসানাং স্থানে বিনিয়ুজ্যতে ।'
28. তদেতদেকমেব বৈশ্বদেবং গায়ত্রং তৃচং দশতয়ীষু বিদ্যতে । যত্তু কিঞ্চিদ্ বহুদেবতং তদ্বশ্বদেবানাং স্থানে বিনিয়ুজ্যতে । যদেব বিশ্বলিঙ্গমিতি শাকপূণিঃ ।'
29. ‘এতদ্বৈ যজ্ঞস্য সমৃদ্ধং যদ্বপসমৃদ্ধং যৎকর্ম ক্রিয়মাণমৃগভিবদতি ।'
(১।৪, ১৩, ১৬ ইত্যাদি )
30. পদসাদৃশ্য দ্বারা, যথা- 'দধিক্রাব্ণো অকারিষমিতি দধিভক্ষম্' (শাঙ্খায়ন. শ্রৌত ৪।১৩।২); অক্ষরবর্ণংসাদৃশ্য দ্বারা, যথা – 'শন্নো দেবী' মন্ত্রকে শনৈশ্চর পূজায়, 'উদবুধ্যস্ব' মন্ত্রকে বুধ পূজায় । (অগ্নিবেশ্য গৃহ্যসূত্র. অধ্যায়.৫) ; (বৈখানস গৃহ্য অধ্যায়. ৪, খণ্ড ১৩, ১৪) ইত্যাদি ।
31. দ্র০ - ব্রাহ্মণ ধম্মিয় সুত্ত ১৯ এর পূর্ব পৃষ্ঠা নং ৮৮, টিপ্পনী. ৩-এ উদ্ধৃত বচন । নিরুক্ত ৭।৩-এ উদ্ধৃত‌ হয়েছে 'তদেতদ্ বহুলম্ আধ্বয়ম্বে যাজ্ঞেষু চ মন্ত্রেষু ।' অর্থাৎ আশীঃ রহিত স্তুতিমাত্রের প্রয়োগ আধ্বর্যব= যজুর্বেদে এবং যজ্ঞপ্রয়োজনকারী মন্ত্রে অনেক উপলব্ধ । যাজ্ঞেষু= যজ্ঞ এবং প্রয়োজনং যেষাং মন্ত্রাণাং তেষু, অর্থাৎ যজ্ঞার্থং সৃষ্টেষু মন্ত্রষু ।
32. বিবিধ‌ কাল্পনিক যজ্ঞের অত্যধিক কল্পনা দ্বাপর যুগে হয়েছে – “সংরোধাদায়ুষস্ত্বেতে ব্যস্বন্তে, দ্বাপরে যুগে” (মহাভারত. শান্তিপর্ব. ২৩৮) ।
33. ‘বেদা হি যজ্ঞার্থমভিপ্রবৃত্তাঃ' । (বেদাঙ্গজ্যোতিষ কে অন্তে‌ উদ্ধৃত বচন )
'আম্নায়স্য ক্রিয়ার্থত্বাৎ ... ' । (মীমাংসাং. ১| ২।১।)
34. দ্রষ্টব্য‌. 'আম্নায়স্য ক্রিয়ার্থত্বাদানর্থক্যমতদর্থানাম্ ' ( মীমাংসা . ১।২।১ ) পূর্বপক্ষোপস্থাপন ।
35. 'আশ্বিনে সম্পৎস্যমানে সূর্যো নোদেয়াদ্ অপি সর্বা দাশতীরনুব্রূয়াৎ
( আপস্তম্ব‌. শ্রৌত. ১৪।১।২ )
তথা - 'সর্বা ঋচঃ সর্বাণি যজূংষি সর্বারিণ সামানি দাচস্তোমে পারিপ্লবে শংসতি । (সায়ণ কৃত ঋগ্ভাষ্যোপোদ্ঘাতে উদ্ধৃত)
36. ‘অপি বা প্রয়োগসামর্থ্যান্মন্ত্রোঽভিধানবাচী স্যাৎ
( মীমাংসা‌. ২।১।৩১)
37. দ্রষ্টব্য‌ – কাত্যায়ন গৃহ্যসূত্র‌ – কর্ণবেধ সংস্কার । পারস্কর গৃহ্যসূত্র‌ টীকায় উদ্ধৃত ।
38. শাঙ্খায়ন শ্রৌত‌. ৪।১৩।২; তথা আশ্বলায়ন শ্রৌত. ৬। ১৩ এর বচন ।
39. দ্রষ্টব্য – অগ্নিবেশ্য গৃহ্য. ৫; বৈখানস গৃহ্য. অধ্যায়‌. ৪, খণ্ড‌. ১৩, ১৪, বৌধায়ন গৃহ্য. শেষ অধ্যায়‌. ১৬, ১৭ তে নবগ্রহ পূজার মন্ত্র ।
40. ‘য়দি মন্ত্রার্থপ্রত্যায়নায়, অনর্থকং ভবতীতি কৌৎসঃ, অনর্থকা হি মন্ত্রাঃ । তদেতেনোপেক্ষিতব্যম্ ।' ( নিরুক্ত‌. ১।১৫ )
41. তৈত্তিরীয় সহিতা ভাষ্য, ভট্টভাস্কর বিরচিত‌. ভাগ ১, পৃষ্ঠ ৩; তথা 'কর্মচোদকা ব্রাহ্মণানি' (আপ. শ্রৌ. পরি. ১।৩৪)
42. পূর্বমীমাংসা. অধ্যায়.১, পাদ. ২, অধিকরণ. ১
43. নিরুক্ত. ১।১৬
44. মহর্ষি‌ যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর সময়কালে অত্যন্ত‌ প্রগাঢ়তা পূর্ণ‌, প্রগল্‌ভ, উচ্চকোটির তর্কজীবী মহান বিদ্বান্‌ ছিলেন । তিনি অনেক প্রাচীন যাজ্ঞিক গমের মত খণ্ডন করেছেন । যথা - 'তদু হ চরকাধ্বর্যবঃ পৃষদা জ্যমেবাগ্রেঽভিঘারয়ন্তি প্রাণাঃ পৃষদাজ্যমিতি বদন্তঃ, তদু হ যাজ্ঞবল্ক্যং চরকাধ্বর্যুরনু- ব্যাজহারার্নবং কুর্বন্তং প্রাণং বা অয়মন্তরগাদধ্বর্যুঃ প্রাণ এনং হাস্যতীতি । স (যাজ্ঞ- বল্ক্যঃ) হ স্ম বাহূ মন্বেক্ষ্যাহ- ইমো পলিতো বাহূ, বয়স্বিদ্ ব্রাহ্মণস্য বচো বভূব, ইতি ন তদাদ্রিয়েত' ।
(শতপথ. ৩।৮।২।২৪, ২৫)
এই প্রকারে - 'অবসভা অহ দেবানাং পত্নীঃ করোতি পরঃ পুংসো হাস্য পত্নী ভবতীতি, তদু হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্যো যথাদিষ্টং পত্ন্যা অস্তু, কস্তদাদ্রিয়েত যৎপরঃ পুংসো বা পত্নী স্যাদিতি' । (শতপথ‌. ১।৩।৪।২১)

বিদুষাং বশংবদঃ