মৃত্যুর
পর জীবাত্মার অবস্থা কিরূপ হয়ে থাকে, জীবাত্মার গতি কিরূপ থাকে
তদ্বিষয়ে উপনিষদ শাস্ত্রে যে সব তত্ত্ব বর্ণন করা হয়েছে তা বিস্তারিত
দর্শানো হলো -
মৃত্যুর
পশ্চাৎ আত্মার কিরূপ গতি হয়ে থাকে তা জানার পূর্বে জীবের স্বরূপ
সম্বন্ধে উপনিষদে যে সব বর্ণন উপলব্ধ তা দর্শানো আবশ্যক । উপনিষদে
জীবকে অল্পজ্ঞ, পরিচ্ছিন্ন, চেতন, অনীশ, নিত্য, অক্ষর,
সত্ত্ব-রজ-তম গুণসম্পন্ন, কর্মকর্তা তথা সুখ-দুঃখ রূপে সেই কর্মের
ফল ভোক্তা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে ।
শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ্-এ বর্ণন করা হয়েছে –
জ্ঞাজ্ঞৌ দ্বাবজাবীশানীশৌ । ( শ্বেতা: ১/৯ )
এই শ্লোকে জীবকে অজ্ঞ ( অল্পজ্ঞ ) অজ ( অজন্মা ), অনীশ ( পরাধীন ) সম্বোধন করা হয়েছে ।
ক্ষরং প্রধানমমৃতাক্ষরম্ । ( শ্বেতা: ১/২০ )
এই শ্লোকে প্রধান ( প্রকৃতি ), ক্ষর অর্থাৎ পরিণাম ধর্মযুক্ত এবং জীবকে অক্ষর ( অবিনাশী ) সম্বোধন করা হয়েছে ।
আরাগ্রমাত্রো হ্যপরোऽপি দৃষ্টঃ । ( শ্বেতা: ৫/৮ )
জীবাত্মাকে আরাগ্রমাত্র ( লৌহকণ্টকের অগ্রভাগের ন্যায় অতিসুক্ষ্ম ) উপমা দেওয়া হয়েছে ।
বালাগ্রশতভাগস্য শতধা কল্পিতস্য চ ।
ভাগো জীবঃ স বিজ্ঞেয়ঃ । ( শ্বেতা: ৫/৯ )
জীবাত্মকে
কেশাগ্রের একশত ভাগের এক ভাগ এবং শতধা কল্পিতস্য এ ভাগঃ ( শততম ভাগ
অর্থাৎ অতিসূক্ষ্ম ) উপমা হিসেবে অভিহিত করে জীবাত্মাকে পরম সূক্ষ্ম বলা
হয়েছে ।
গুণান্বয়ো য়ঃ ফলকর্মকর্তা কৃতস্য তস্যৈব স চোপভোক্তা । ( শ্বেতা: ৫/৭ )
শ্লোকে
জীবকে ত্রিগুণা অর্থাৎ, সত্ত্ব-রজ-তম গুণসম্পন্ন সম্বোধন করা হয়েছে ।
জীবকে ফলকর্মকর্তা অর্থাৎ, ফলের ভাবনা দ্বারা কর্মকারী তথা
উপভোক্তা সেই কর্মের ফল ভোক্তাকারীও বলা হয়েছে ।
পিপ্পলং স্বাদ্বত্তি । ( মুণ্ডক: ৩/১/১ )
জীবাত্মা তার স্বকৃত কর্মের ফল নিজেই ভোগ করে থাকে ।
ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্বিৎ । ( কঠ: ১/২/১৮ )
এই শ্লোকে জীবকে অজন্মা, অমর তথা বিপশ্বিৎ ( চেতন ) সম্বোধন করা হয়েছে ।
কঠোপনিষদ্
১/৩/৪ নং শ্লোকে " আত্মেন্দ্রিয়মনোয়ুক্তং ভোক্তেত্যাহুঃ " অর্থাৎ,
শরীর, ইন্দ্রিয় এবং মনের সংযোগেই জীবাত্মা সুখ-দুঃখের উপভোক্তা হয়
এমনটা বর্ণনা করা হয়েছে ।
শরীরে জীবাত্মার নিবাসস্থান
প্রশ্নোপনিষদ্
৩/৬ নং শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে " হ্যদি হ্যোষ আত্মা " অর্থাৎ, হৃদয়
জীবের নিবাস-স্থান । এই স্থানে অবস্থিত জীব মন, বুদ্ধি এবং
ইন্দ্রিয়সমূহের সাথে সংযুক্ত হয়ে জ্ঞান-তন্তু, যা মস্তিষ্ক থেকে শুরু
করে পঞ্চাঙ্গুলের নখাগ্র পর্যন্ত বিস্তীর্ণ, তা দ্বারা এক দেশ-এ অবস্থিত
সর্ব শরীরান্তর্গত সুখ-দুঃখের অনুভূতি অনুভব করে থাকে । পক্ষাঘাত আদি
রোগসমূহ দ্বারা যখন স্নায়ু এবং জ্ঞান-তন্তু বিকৃত হয়ে যায়, তখন শরীরে
সুঁই প্রবেশের পরও আত্মার দুঃখ হয় না ; কেননা সেই স্থানে অবস্থিত
জীবাত্মা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । সর্বশরীরে চেতনার উপলব্ধি হেতু অনেক
বিদ্বান আত্মাকে সর্বশরীর ব্যাপী মেনে থাকেন । কিন্তু তা ভ্রমপূর্ণ
ভ্রান্ত ধারণা । কেননা এমনটা মানলে ছোট পাখি এবং হাতির শরীরে অবস্থিত
আত্মার পরিধি সংকোচ এবং বিস্তার মানতে হবে । সংকোচ এবং বিস্তার মানার
দরূণ জীবাত্মাতে বিকার এবং অনিত্যতা দোষ উৎপন্ন হবে ।
[ বি:দ্র: শরীরে জীবাত্মার অবস্থান বিষয়ে বেদ তথা সমগ্র বৈদিক শাস্ত্রে কী সিদ্ধান্ত দর্শানো হয়েছে তা বিস্তারপূর্বক জানতে মৎঅনূদিত " বেদানুসারে শরীরে আত্মার নিবাস স্থান " লেখ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য । লিংক - বেদানুসারে শরীরে আত্মার নিবাস স্থান ]
মৃত্যু
ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ৬/১১/৩ নং শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে –
" জীবাপেতং বাব কিলেদং ম্রিয়তে ন জীবো ম্রিয়তে ইতি "
অর্থাৎ,
নিশ্চয়ই আত্মা রহিত শরীরের বিনাশ হয়, আত্মার বিনাশ হয় না অর্থাৎ, শরীর
থেকে আত্মার পৃথকতাই মৃত্যু । মৃত পুরুষের বাণী অগ্নিতে, প্রাণ বায়ুতে,
নেত্রজ্যোতি আদিত্যে, মন চন্দ্রমায়, শ্রৌত দিশায়, শরীর পৃথিবীতে,
আত্মা আকাশে, লোম ঔষধে, কেশ বনস্পতিতে, বীর্য এবং রূধির জলে গমন
করে ।
যাজ্ঞবল্ক্যেতি
হোবাচ – য়ত্রাস্য পুরুষস্য মৃতস্যাগ্নিং বাগপ্যেতি, বাতং প্রাণাঃ,
চক্ষুরাদিত্যং, মনশ্চন্দ্রং, দিশঃ শ্রোত্রং, পৃথ্বীং শরীরম্, আকাশমাত্মা,
ওষধীর্লোমানি, বনস্পতীন্ কেশাঃ, অপ্সু লোহিতং চ রেতশ্চ নিধীয়তে ।
( বৃহদারণ্যক উপনিষদ্: ৩/২/১৩ )
মরণের সময় আত্মা তার জ্ঞান, কর্ম এবং পূর্ব জন্মের সংস্কাসমূহকে ধারণ করে এই শরীর ত্যাগ করে ।
তং বিদ্যাকর্মণী সমন্বারভেতে পূর্বপ্রজ্ঞা চ ।
( বৃহদারণ্যক উপনিষদ্: ৪/৪/২ )
অর্থাৎ,
শরীর হতে প্রয়াণের পরবর্তীতে জীবাত্মার অভ্যন্তর থেকে জ্ঞানের
উন্মোচন হয়, বাহ্য সংসারের জ্ঞান তার হয় না । সেই সময় বিদ্যা ( জ্ঞান )
কর্ম ( শুভাশুভকর্মসংকার ) পূর্ব প্রজ্ঞা ( পূর্ব জন্মের বুদ্ধি
অর্থাৎ জন্মজন্মান্তরের উপার্জিত সংস্কার ) এই আত্মার সহিত পরলোকে গমন করে ।
য়োনিমন্যে প্রপদ্যন্তে শরীরত্বায় দেহিনঃ । স্থাণুমন্যেঽনুসংয়ন্তি যথাকর্ম যথাশ্রুতম্ ॥
( কঠোপনিষদ্: ২/২/৭ )
জীব
মরণের পশ্চাৎ অনন্তর স্থাবর এবং জঙ্গম যোনিসমূহে যথাকর্ম ( কর্মানুসারে )
এবং যথাশ্রুত ( জ্ঞানানুসারে ) গমন করে । যেমনভাবে সংকল্প করে জীব এই
লোকে অবস্থান করে, মরণের সময় সেই সংকল্পকে সাথে নিয়ে গমন পূর্বক তা
অনুসারে ভিন্ন-ভিন্ন যোনিতে জন্মলাভ করে ।
এমন বর্ণন ছান্দোগ্য উপনিষদ্-এ উপলব্ধ -
অথ খলু, ক্রতুময়ঃ পুরুষো য়থাক্রতুরস্মিঁল্লোকে পুরুষো ভবতি তথেতঃ প্রেত্য ভবতি । ( ছান্দোগ্য. ৩/১৪/১ )
য়ৎ কর্ম কুরুতে তদভিসম্পদ্যতে । ( বৃহদারণ্যক. ৪/৪/৫ )
জীব যেমন কর্ম করে, মরণের পশ্চাৎ তদ্রুপ ফল প্রাপ্ত হয় ।
মরণের সময় জীবের অভ্যন্তর থেকে জ্ঞানের পরিস্ফুটন হয় এবং তার অভ্যন্তরে প্রকাশ হয় ।
প্রদ্যোতেনৈষ আত্মা নিষ্ক্রামতি…. সবিজ্ঞানো ভবতি ।
( বৃহদারণ্যক. ৪/৪/২ )
আত্মা
নেত্র, মূর্ধা, মুখ, নাসিকা আদি যেকোনো ছিদ্রের মাধ্যমে এই নশ্বর দেহ
হতে বহির্গমন করে । শরীর ত্যাগ করার পর ঈশ্বরের নিত্য ব্যবস্থা অনুসারে
নিজে নিজেই উদান বায়ু দ্বারা নিজের কর্মফল অনুযায়ী ভিন্ন-ভিন্ন স্থাবর
এবং জঙ্গম যোনি প্রাপ্ত করে থাকে ।
অথৈকয়োর্ধ্ব উদানঃ পুণ্যেন পুণ্যং লোকং নয়তি, পাপেপাপমুভাভ্যমেব মনুষ্যলোকম্ । ( প্রশ্নোপনিষদ্. প্রশ্ন. ৩/৭ )
অর্থাৎ,
একটি নাড়ী ( সুষুম্না ) দ্বারা ঊর্ধ্বগামী হয়ে উদানবায়ু, পূণ্যকর্মের
ফলে জীবকে পূণ্যলোক, পাপকর্মের ফলে পাপলোক এবং পাপ-পূণ্যে উভয় সমভাবে
প্রধান হলে মননুষ্যলোক প্রাপ্ত হয় ।
য়চ্চিত্তস্তেনৈষ প্রাণমায়াতি, প্রাণস্তেজসা যুক্তঃ সহাত্মনা য়থাসঙ্কল্পিতং লোকং নয়তি ॥ ( প্রশ্নোপনিষদ্. প্রশ্ন. ৩/১০ )
সেই
চিত্ত অর্থাৎ, জীবের ভাব উদয় হয়, তাহলে তার সাথে যুক্ত উদান বায়ু
সেই জীবকে তার সংকল্প অনুসারে ভিন্ন-ভিন্ন লোকে গমন করায় ।
জীবাত্মা
তার সংকল্পানুসারে উদান প্রাণ দ্বারা স্বয়মেব উচ্চ-নিম্ন যোনিতে
জন্মলাভ করে । এ দ্বারা পরমাত্মার কোনো জীবকে বার বার বিভিন্ন যোনিতে
গমন করানোর প্রয়োজন পড়ে না । ভগবানের এই সমস্ত ব্রহ্মচক্র অটোমেটিক (
Automatic ), অর্থাৎ, স্বয়ং সিদ্ধ রূপেই চলতে থাকে ।
প্রজ্ঞানেত্রো লোকঃ……. প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম ।
( ঐতরেয়োপনিষদ্. ৩/১/৩ )
এই
ব্রহ্মাণ্ড প্রজ্ঞানেত্র । অর্থাৎ, জ্ঞানের ব্যবস্থা দ্বারা ব্যবস্থিত এবং
সেই জ্ঞান ব্রহ্মই যিনি এই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডকে পরিচালনা করেন ।
পুরুষ এভ্যোऽঙ্গেভ্যঃ সংপ্রমুচ্য পুনঃ প্রতিন্যায়ং প্রতিয়োন্যাদ্রবতি প্রাণায়েব ।
( বৃহদারণ্যক উপনিষদ্. ৪/৩/৩৬ )
পুরুষ এই শরীর হতে মুক্ত হয়ে ন্যায়ানুসারে
যথাগত পথে প্রাণলাভ করার জন্য বিবিধ যোনিতে গমন করে ।
তদাথা
পেশস্কারী পেশসো মাত্রামপাদায়ানান্নবতরং কল্যাণতরং রূপং তনূত
এবমেবায়মাত্মেদং শরীরং নিহত্যাবিদ্যাং গময়িত্বানান্নবতরং কল্যাণতরং রূপং
কুরুতে পিত্র্যং বা গান্ধর্বং বা দৈবং বা প্রাজাপত্যং বা ব্রাহ্মং
বাऽন্যেষাং বা ভূতানাম ।।
( বৃহদারণ্যক উপনিষদ্. ৪/৪/৪ )
সরলার্থ
: যেমন স্বর্ণকার একখণ্ড স্বর্ণ নিয়ে (তাকে ) অভিনব ও সুন্দরতর রূপ দেয়
তেমনি এই আত্মা দেহ ত্যাগের পর অবিদ্যা দূর করে পিতৃগণ, গন্ধর্বগণ বা দেব,
প্রজাপতি ব্রহ্মা কিংবা অন্য কোনো জীবের উপযোগী একটি নতুন ও সুন্দরতর রূপ
প্রস্তুত করে ।
পরবর্তী ৫নং শ্লোকে " য়থাকারী য়থাচারী তথা ভবতি " দ্বারা বর্ণনা করা হয়ে যে, কর্ম এবং ধর্মাচরণের মাধ্যমে বিভিন্ন জন্মলাভ হয় ।
উপনিষদ
শাস্ত্রে মৃত্যুর পর জীবাত্মার তিনটি মার্গের বর্ণনা করা হয়েছে ।
দেবমার্গ, পিতৃভাগ এবং দংদশূক মার্গ । দংদশূক এর অপর নাম
জায়স্ব-ম্রিয়স্ব ।
ছান্দোগ্য
উপনিষদ্ ৫/১০/২-৮ নং শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি এই প্রকারে ভগবানে
জেনে থাকেন এবং মনে শ্রদ্ধা এবং তপ দ্বারা সেই পরমাত্মার আরাধনা করেন,
তিনি পুরুষ জ্যোতি প্রাপ্ত হন তথা এরূপ নিষ্কাম কর্মকর্তা পুরুষগণকে
পরমাত্মা তাঁর স্বরূপের দর্শন দেন, যা দেবমার্গ । এই মনুষ্যগণ
মুক্তিপ্রাপ্ত হয় । যিনি সকাম কর্মের মাধ্যমে ইষ্টাপূর্ত্ত আদি যজ্ঞ করেন
তিনি মৃত্যুর পর অনন্তর পিতৃলোকে গমন করেন । সেখানে তিনি পুণ্যফল প্রাপ্ত
করে পুনরায় এই মানবলোকে ফিরে আসেন । যে মনুষ্যগণ দেবযান এবং পিতৃযান
এই মার্গদ্বয় অনুসারে ধর্মাচরণ না করে তারা ক্ষুদ্র জন্ম-মৃত্যুর চক্রে
আবর্তন করতে থাকে, যা দংদশূক মার্গের অন্তর্গত ।
একই ভাবার্থ মুণ্ডকোপনিষদ্-এ বর্ণনা করা হয়েছে ।
অথৈতয়োঃ পথোর্ন কতরেণচন, তানীমানি ক্ষুদ্রাণ্যসকৃদাবর্তীনি ভূতানি ভবন্তি । জায়স্ব ম্রিয়স্বেত্যেতত্তৃতীয়ং স্থানম্ ।
( মুণ্ডকোপনিষদ্: ২/১০/১১ )
উপনিষদে
জীবাত্মাকে নিত্য এবং পুনঃ পুনঃ জন্ম-মৃত্যুর চক্রাকারে আবদ্ধ হিসেবে
স্পষ্ট সর্বত্র দর্শানো হয়েছে । দেবযান মার্গে গমনকারী জীব মুক্ত হয়ে
যায় এবং নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হয় না ।
পিতৃযান এবং দংদশূক মার্গে গমনকারী জীবগণ জন্ম-মৃত্যুর চক্রে অবস্থান
করে ।
– বিদুষাং বশংবদঃ
নমস্কার
0 মন্তব্য(গুলি)