আমাদের চারবেদ, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত কোথাও আমরা হরেকৃষ্ণের উল্লেখ পাই না। চারযুগে চার মহামন্ত্রের উল্লেখও পাইনা। তাহলে এই ষোল নাম বত্রিশ অক্ষর এলো কোথা থেকে? আজকে আমরা হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কতোটা ভ্রান্ত ও অশাস্ত্রীয় প্রমাণ করবো ।
১। কলিসন্তরণ উপনিষদ হরে কৃষ্ণের পক্ষে প্রধান প্রমাণ। কেননা এর নাম মুক্তিকোপনিষদের ১০৮টি উপনিষদের তালিকায় আছে। তাই একে শ্রুতি প্রমাণ হিসেবে বৈষ্ণবরা উপস্থাপন করেন। অথচ মজার বিষয় এখানে হরে কৃষ্ণ উল্টোভাবে আছে -
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
বৈষ্ণবরা তাহলে শ্রুতি বাক্যকে সঠিকভাবে কেন প্রচার না করে উলটো প্রচার করেন? মন্ত্র বিকৃতির [আদৌ যা মন্ত্রই না] অধিকার তাদের কে দিলো ? বৈষ্ণবদের দেওয়া ছবিতেও দেখুন উল্টোভাবেই দেওয়া -
আরো মজার ব্যাপার যদি ১০৮ উপনিষদের লিস্ট আপনাদের নিকট প্রামাণিক হয় তবে চৈতন্য উপনিষদ, পুরুষবোধিনী উপনিষদকে কেন মানছেন? এগুলোর নাম তো ১০৮টি উপনিষদের তালিকায় নেই।
আবার ১০৮ উপনিষদের তালিকায় অদ্বৈতবাদপরক উপনিষদ আছে যা সরাসরি অদ্বৈতবাদ নির্দেশ করে সেগুলোকে কী স্বীকার করেন? স্বীকার করলে দ্বৈতবাদ শ্রুতি সমর্থন করে কীভাবে? আর স্বীকার যদি না করেন তবে ১০৮টাই উপনিষদ আসল তত্ত্ব প্রকাশক বা প্রামাণিক এই দাবিই ভ্রান্ত ফলে আপনার কলিসন্তরন উপনিষদও ভ্রান্ত।
২। এরপরে রাধাতন্ত্রে [১।২৯] হরেকৃষ্ণের উল্লেখ আমরা পাই ।
রাধাতন্ত্র কী বৈষ্ণবরা সম্পূর্ণ মানে ? তাহলে দেখুন রাধাতন্ত্রে ঠিক এর পরেই ৩২নং শ্লোকে বলা হয়েছে -
এখানে বলা হয়েছে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র নাকি গায়ত্রী ছন্দ । আমরা সবাই জানি হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রে [?]৩২ অক্ষর আছে । বেদাঙ্গের মধ্যে ছন্দে এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে । পিঙ্গল ছন্দসূত্র ৩.৩ এ বলা হয়েছে গায়ত্রীর এক পাদে ৮টি অক্ষর থাকে ।
গায়ত্রী ছন্দ ত্রিপাদ । এখানে ৮*৩= ২৪ অক্ষর থাকে । পিঙ্গল ছন্দসূত্রে এই ২৪ অক্ষরের গায়ত্রীর আরেকটি ভেদ আছে যাতে চার পাদে ৬টি করে অক্ষর থাকে, এতেও ২৪টি অক্ষরই হয়। দেখুন পিঙ্গল ছন্দসূত্র ৩.৮ -
অনেকে বলতে পারেন এখানে তো গায়ত্রীরও নানা প্রকার আছে। তাঁদের জন্য গায়ত্রীর সব প্রকারের অক্ষর সংখ্যা দেওয়া হলো -
এখানে ৩২ অক্ষরের গায়ত্রী ছন্দের কোন প্রমাণ নেই। অতঃ এই রাধাতন্ত্রও যে বৈদিক শাস্ত্র বিরুদ্ধ ও মূর্খের রচনা প্রমাণিত।
৩। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ উত্তরখণ্ড ৬।৫৫
মজার বিষয় ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের এই তথাকথিত উত্তরখণ্ড গৌড়ীয় ব্যতীত কেউ মানে না। ব্রহ্মাণ্ডপুরাণের মূল অনুবাদে কোন খণ্ডের উল্লেখ নেই ।
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের এই মূল্ভাগেও শেষে এই পুরাণ সম্পূর্ণ এমনই আছে , অবশিষ্ট বা কোন উত্তরখণ্ডের কোন কথাই নেই ।
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের ১ম অধ্যায় অনুক্রমণিকা তাতেও এই উত্তরভাগের কোন উল্লেখ বা কোন বিষয়েরই নাম নেই ।
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের যে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় সেই অনুযায়ী হিন্দি ও ইংরেজি যত অনুবাদ আছে তাতেও এই রাধাহৃদয় খণ্ড বা হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রের কোন অস্তিত্বই নেই ।
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের এই উত্তরখণ্ড তথা রাধাহৃদয় খণ্ড যে বানোয়াট তার প্রমাণ এটি নিজেই দিচ্ছে । ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ প্রকৃতি খণ্ড অধ্যায় ৪৯.৩৮ অনুযায়ী রাধার স্বামীর নাম "রায়াণ বৈশ্য" আর ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের এই রাধাহৃদয় খণ্ড ১৫.৪৬ অনুযায়ী নাম "আয়ান" ।
অর্থাৎ যে ব্যক্তি এই মিথ্যা গ্রন্থ লিখেছে সে নিজেদের পুরাণব সম্পর্কেও জানে না এবং প্রচলিত কাহিনী যা জানে তাঁর সাথে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখেছে।
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ উত্তরখণ্ড ৬.৫৭ - দেখুন, শ্রুতি লিখে আবার বেদ লিখেছে অর্থাৎ দুটো যে এক তাও জানে না রচয়িতা, পাশাপাশি শ্রুতি - স্মৃতি - বেদাঙ্গে কোথায় হরেকৃষ্ণ আছে ?
৪। এরপর বৈষ্ণবরা কিছু মহাভারত, পুরাণাদির বাক্য আনে যা নিম্নরূপ । আমরা সরাসরি তারা যেভাবে লিখেছে সেটাই ব্যবহার করলাম -
- বৃহন্নারদীয় পুরাণে (৩/৮/১২৬) বলা হয়েছে—
হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম্ ।
কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা ।।
অর্থ— হরিনাম হরিনাম হরিনাম কেবল, কলিযুগে ইহা বিনা গতি নাই নাই নাই ৷
একে তো রেফারেন্স ভুল, প্রথম বাক্যও ভুল , হবে অধ্যায় ৩৮ আর শ্লোক ১২৬ । আর এখানে ষোল নাম বত্রিশ অক্ষরের কথা আছে ?
- চৈতন্য ভাগবত আদি ১৪তম অধ্যায়-
"কলিযুগ-ধর্ম হয় নাম সংকীর্তন |
চারিযুগে চারি ধর্ম-জীবের কারোণ ||
অতএব কলিযুগে নামযজ্ঞ সার |
আর কোন ধর্ম কৈলে নাহি হয় পার ||
রাত্রিদিন নাম লয় খাইতে শুইতে |
তাহার মহিমা বেদে নাহি পারে দিতে ||
শুন,মিশ্র,কলিযুগে নাহি তপ-যজ্ঞ |
যেই জন ভজে কৃষ্ণ, তার মহাভাগ্য ||
অতএব গৃহে তুমি কৃষ্ণভজ গিয়া |
কুটিনাটি পরিহারি একান্ত হইয়া ||
সাধ্য-সাধন-তত্ত্ব যে কিছু সকল |
হরিনাম সংকীর্তনে মিলিবে সকল ||
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে |
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ||
এই শ্লোক নাম বলি লয় মহামন্ত্র |
ষোল নাম বত্রিশ অক্ষর এই তন্ত্র ||
সাধিতে সাধিতে যবে প্রেমাঙ্কুর হবে |
সাধ্য-সাধন তত্ত্ব জানিবা সে তবে ||
চৈতন্যভাগবত তো গৌড়ীয়দের নিজেদের গ্রন্থ, তাদের গ্রন্থও এখন বৈদিক শাস্ত্র ? কি পরিহাস!
মহাভারতে (শান্তিপর্ব ২০৪/৭৭) ভীষ্মদেব রাজা যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়েছেন—
“ভজস্বৈনং বিশালাক্ষং জপন্ কৃষ্ণেতি সত্তম ৷৷”
অর্থাৎ—তুমি কৃষ্ণনাম জপ করিতে থাকিয়া এই বিশালনয়ন কৃষ্ণের সেবা করো৷
এখানেও হরেকৃষ্ণ মন্ত্রের উল্লেখ নেই, গীতা ১০।৩৫ স্পষ্টভাবে গায়ত্রীকে বিভূতি বলেছে। কলিযগে বেদ বাদ দিয়ে গীতাকে মানবেন শুধু, তাহলে গীতার গায়ত্রীর বেলাতে মানেন না কেন ? আপনার প্রভুপাদকেই দেখুন -
শ্রীভগবান গীতায় (৯/১৪) বলেছেন—
সততং কীর্তয়ন্তো মাং যতন্তশ্চ দৃঢ়ব্রতাঃ।
নমস্যন্তশ্চ মাং ভক্ত্যা নিত্যযুক্তা উপাসতে।।
“তাঁহারা (সাত্ত্বিকী প্রকৃতি-প্রাপ্ত মহাত্মগণ) যত্নশীল ও দৃঢ়ব্রত হইয়া ভক্তিপূর্বক সর্বদা আযমার কীর্তন এবং বন্দনা করিয়া নিত্য সমাহিত চিত্তে আমার উপাসনা করেন ।”
[ এখানেও ১৬ নাম ৩২ অক্ষরের উল্লেখ নেই ]
শ্রীমদ্ভাগবতে (১২/৩/৫২) বলা হয়েছে,
কৃতে যদ্ধ্যায়তো বিষ্ণুং ত্রেতায়াং যজতো মখৈঃ |
দ্বাপরে পরিচার্যায়াং কলৌ তদ্ধ রিকীর্ত্নাৎ ||
~ সত্যযুগে বিষ্ণুকে ধ্যান করে, ত্রেতাযুগে যজ্ঞের মাধ্যমে যজন করে, এবং দ্বাপর যুগে অর্চন-আদি করে যে ফল লাভ হত, কলিকালে কেবলমাত্র 'হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র ' কীর্তনে সেই ফল লাভ হয়।
পৌরাণিক বৈষ্ণবদের ভণ্ডামির চূড়ান্ত নমুনা, এখানে কোথাও 'হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র' মূল শ্লোকে লেখা আছে? নেই। এরা হয় নিজেরা মূর্খ নাহলে সবাইকে মূর্খ বানানোর মিশনে নেমেছে। গৌড়ীয় মঠ ও গীতাপ্রেসের অনুবাদ দেখুন -
- বিষ্ণুপুরাণেও( ৬/২/১৭) এর সত্যতা প্রতিপন্য করে বলা হয়েছে -
ধ্যায়ন কৃতে যজন যোজ্ঞৈস্ত্রেতায়াম দ্বাপরে অর্চয়ন |
যদাপ্নোতি তদাপ্নোতি কলৌ সংকীর্ত্য কেশবং ||
~ এই কলিযুগে ধ্যান, যজ্ঞ বা মন্দিরে অর্চনার কোনো প্রয়োজন নাই। কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণের দিব্যনাম "হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র" কীর্তন করার ফলে পূর্ণ আত্মোপলব্ধি অর্জন করা যায়।
পূর্বের কথা এখানেও প্রযোজ্য, মূল শ্লোকে কোথাও " হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র" উল্লেখ নেই।
এখানে কোথাও হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রের উল্লেখ নেই বা ষোল নাম ৩২ অক্ষরের উল্লেখ নেই। এখানে হরির নাম, কীর্তন বা এসবই আছে। এখন শাস্ত্রে তো ওঙ্কারকেও ব্রহ্ম বলা হয়েছে, গায়ত্রীকেও ব্রহ্ম বলা হয়েছে অসংখ্যবার। আপনারা এই প্রমাণগুলোর অনুবাদে জোর করে 'হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র' ঢুকিয়ে দিয়ে আর কত সাধারণ স্বাধ্যায়হীন অজ্ঞ সনাতনীদের বোকা বানাবেন ? গৌড়ীয়দের শ্রীনামতত্ত্ব, নামাভাস, নামাপরাধসহ যত বই পাবেন সব বইতেই একই কৌশল অনুসরণ করা হয়েছে। যেখানেই বিষ্ণু বা কৃষ্ণ নাম কিংবা কীর্তনের উল্লেখ সেখানেই কৌশলে এরা 'হরেকৃষ্ণ' বলা হয়েছে তা দেখানোর কূটকৌশল অবলম্বন করে। তা এতো বড় মহামন্ত্র কেন এর উল্লেখ আমরা অন্যাদি শাস্ত্রে দেখি না ? কেন কোন বৈদিক শাস্ত্র যা প্রাচীন এমনকি রামায়ণ মহাভারতেও গায়ত্রীর উল্লেখ থাকলেও এর উল্লেখ নেই ?
উত্তর একটাই,
এই তত্ত্ব ও বাক্য ভ্রান্ত। মুক্তিপ্রদায়ক তো নয়ই বরং ভ্রান্তিময়।
0 মন্তব্য(গুলি)