কেনোপনিষদের কথা প্রসঙ্গ উঠলেই সর্বপ্রথম আমাদের যে আখ্যানের কথা মনে পড়ে সেটি হচ্ছে ইন্দ্র এবং যক্ষের সংবাদ। কেনোপনিষদের ৩য় খণ্ডে এই আখ্যানটি এসেছে। আখ্যানটি এরকম—
“একসময় ব্রহ্ম দেবতাদের ওপর বিজয় লাভ করলেন। তখন ব্রহ্মের এই বিজয়ে মহিমান্বিত হয়ে দেবগণ ভাবলেন, “এই বিজয় তো আমাদেরই”। তখন ব্রহ্ম তাঁদের অহংকার দূর করার জন্য তাঁদের সামনে যক্ষরূপে প্রকট হলেন। কিন্তু দেবগণ তাঁকে চিনতে পারলেন না। তখন এই যক্ষকে জানার জন্য দেবগণ প্রথমে অগ্নিদেবকে প্রেরণ করে বললেন, এই যক্ষকে জানার চেষ্টা করুন। অগ্নিদেব দম্ভসহকারে যক্ষের সামনে উপস্থিত হলেন। তখন যক্ষ অগ্নিদেবকে বললেন তুমি কে? অগ্নিদেব উত্তর দিলেন আমি অগ্নি, আমি জাতবেদা নামেও প্রসিদ্ধ। যক্ষ বললেন, তোমার মধ্যে কি এমন সামর্থ্য আছে? অগ্নিদেব বললেন, এই জগতের সবকিছুই আমি দগ্ধ করতে পারি। তখন যক্ষ সেই অগ্নিদেবের সামনে একটি তৃণখণ্ড রেখে বললেন, এটি দগ্ধ করো। তখন অগ্নি তাঁর সমস্ত শক্তি দিয়েও সেটি দগ্ধ করতে পারলেন না। এরপর নিরাশ হয়ে অগ্নিদেব ফিরে এলেন এবং অন্যান্য দেবতাদের বললেন, এই যক্ষকে আমি জানতে পারলাম না। এরপর দেবগণ বায়ুদেবকে যক্ষকে জানার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন। যখন যক্ষের সামনে বায়ুদেব উপস্থিত হলেন তখন যক্ষ বললেন তুমি কে? বায়ুদেব অহংকারপূর্বক বললেন, আমি অতি বেগবান বায়ু এবং অন্তরিক্ষে দ্রুত গতিতে বিচরণের জন্য আমাকে মাতরিশ্বাও বলা হয়। যক্ষ বললেন, তোমার মধ্যে কি এমন পরাক্রম আছে? বায়ুদেব বললেন, পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা আমি উড়াতে পারি না। যক্ষ বায়ুদেবের সামনে একটি তৃণখণ্ড রেখে বললেন, এটি উড়িয়ে দেখাও। বায়ুদেব তার সম্পূর্ণ শক্তি দিয়েও সেই তৃণকে উড়ানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু ব্যর্থ হলেন। এরপর লজ্জিত হয়ে ফিরে এসে দেবতাদের বললেন, আমি এই যক্ষকে জানতে অসমর্থ। এরপর দেবগণ ইন্দ্রকে বললেন, হে ঐশ্বর্যবান! অগ্নি ও বায়ুদেব তো যক্ষকে জানতে ব্যর্থ হলেন, আপনি কৃপা করে এই যক্ষকে জেনে আসুন। দেবগণের কথা শুনে ইন্দ্র যক্ষের সামনে গেলেন, কিন্তু যক্ষ ইন্দ্রের সামনে থেকে অন্তর্ধান হলেন। তখন ইন্দ্রের অনেক দুঃখ অনুভব হলো। কারণ তিনি এই যক্ষকে জানার জন্য এসেছিলেন, কিন্তু জানার সেই সুযোগই হলো না। তখন আকাশে হৈমবতী উমা আবির্ভূত হলেন এবং বললেন এই যক্ষ আসলে ব্রহ্মই, তোমরা সকলে ব্রহ্মের বিজয়েই নিজেদের মহিমান্বিত মনে করেছিলে। এভাবে উমার মাধ্যমেই ইন্দ্র যক্ষের প্রকৃত স্বরূপ জানতে পেরেছিলেন এবং সকল দেবগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছিলেন।”
এই হচ্ছে আখ্যায়িকার সার কথা। সাধারণভাবে এই আখ্যান পড়লে এর বিশেষতার বোধ হয় না। স্বাভাবিকভাবে ইন্দ্র তো দেবগণের রাজা, তিনি যক্ষকে জেনে শ্রেষ্ঠতা লাভ করেছিলেন এতে আবার আশ্চর্য কী। কিন্তু যদি আমরা এই আখ্যানের প্রতিটি চরিত্র বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা এর প্রকৃত রহস্য উপলব্ধি করতে পারবো। কারণ উপনিষদ্ রহস্য বিদ্যার গ্রন্থ। এজন্য এর বর্ণনা স্থূল দৃষ্টিতে দেখার অথবা বোঝার কোনো অবকাশই নেই। আসুন এই আখ্যানটির রহস্য জানার চেষ্টা করি। প্রথমে আমরা আখ্যানের প্রতিটি চরিত্র সম্বন্ধে জানবো।
১। যক্ষ — যক্ষ’ হচ্ছেন পরব্রহ্ম পরমেশ্বর। “য়ক্ষ্যতে পূজ্যতেতি য়ক্ষঃ” যিনি পূজনীয়, তাঁর নাম যক্ষ। অথর্ববেদে বলা আছে, “এই শরীররূপ নগরী সমস্ত অগ্ন্যাদি দেবগণের (পঞ্চভূতের) অধিষ্ঠানভূত। আট চক্র ও নয়টি ইন্দ্রিয়রূপ দ্বার বিশিষ্ট এই নগরী অজেয়। এই নগরীতে এক প্রকাশময় কোশ (মনোময় কোশ) সুখময় জ্যোতি দ্বারা আবৃত। সেখানে সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ— তিন অরবিশিষ্ট; জ্ঞান, কর্ম, উপাসনায় প্রতিষ্ঠিত; জ্যোতির্ময় সেই মনোময় কোষে যে (যক্ষ) পূজনীয় ব্রহ্ম অধিষ্ঠিত থাকেন, তাঁকেই ব্রহ্মজ্ঞানিগণ নিশ্চিতরূপে জানেন (অথর্ব০ ১০।২।৩১-৩২)”। অথর্বববেদে আরো বলা হয়েছে— “মহদ্ য়ক্ষং ভুবনস্য মধ্যে তস্মৈ বলিং রাষ্ট্রভৃতো ভরন্তি (অথর্ব০ ১০।৮।১৫)” অর্থাৎ এই সংসারে রাষ্ট্রের সেবকগণ সেই মহান (যক্ষ) পূজনীয় ব্রহ্মকে পূর্ণ শ্রদ্ধার দ্বারা ধারণ করেন।
২। অগ্নিদেব— সর্বপ্রথম অগ্নিদেব যক্ষের সামনে গিয়েছিলেন এবং নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন (অগ্নির্বা অহমস্মীত্যব্রবীজ্জাতবেদা বা অহমস্মীতি) অর্থাৎ আমি প্রসিদ্ধ অগ্নি এবং আমিই জাতবেদা নামে প্রসিদ্ধ। এখানে অগ্নিকে ‘জাতবেদ’ বলার কারণ হচ্ছে, “জাতং বেদো ধনং য়স্মাৎ স জাতবেদাঃ” যার থেকে ধন উৎপন্ন হয় তার নাম হচ্ছে ‘জাতবেদ’ = অগ্নি; অথবা “জাতং জাতং বিদ্যতে ইতি জাতবেদাঃ” প্রত্যেক কার্য-পদার্থে (কাষ্ঠ প্রভৃতি উৎপন্ন বস্তুমাত্রে) বিদ্যমান হওয়ার কারণে অগ্নির নাম ‘জাতবেদ’। কঠোপনিষদে বলা হয়েছে— “অগ্নির্য়থৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব (কঠ০ ২।২।৯)” অর্থাৎ একই অগ্নি জগতের প্রত্যেক পদার্থে প্রবিষ্ট হয়ে তদাকার হয়ে বিদ্যমান।
৩। বায়ুদেব— অগ্নিদেবের পর বায়ুদেব যক্ষের সামনে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, (বায়ুর্বা অহমস্মীত্যব্রবীন্মাতরিশ্বা বা অহমস্মীতি) অর্থাৎ আমি প্রসিদ্ধ বায়ু এবং আমিই অন্তরিক্ষে বিচরণকারী মাতরিশ্বা। বায়ুকে মাতরিশ্বা বলার কারণ হিসেবে নিরুক্তাকার মহর্ষি যাস্ক বলেছেন— “মাতরিশ্বা বায়ুঃ, মাতরি = অন্তরিক্ষে শ্বসিতি, মাতর্য়শ্বনিতীতি বা॥” (নিরুক্ত ৭।২৬) = অন্তরিক্ষে শীঘ্র গমন করার কারণে বায়ুকে ‘মাতরিশ্বা’ বলা হয়।
৪। ইন্দ্র— দেবগণ ইন্দ্রকে “মঘবন” বলে সম্বোধন করেছেন। ঐশ্বর্যবান হওয়ার কারণে ইন্দ্রকে ‘মঘবন্’ বলা হয়েছে। এই প্রকরণে ‘ইন্দ্র’ শব্দের অর্থ জীবাত্মা। পাণিনীয় সূত্রানুযায়ী— “ইন্দ্রিয়মিন্দ্রলিঙ্গমিন্দ্রদৃষ্টমিন্দ্রসৃষ্টমিন্দ্রজুষ্টমিন্দ্রদত্তমিতি বা॥ (অষ্টা০ ৫।২।৯৩)” অর্থাৎ ‘ইন্দ্র’ তিনিই, যার কর্ম সাধনের জন্য ‘ইন্দ্রিয়’ রয়েছে। ষষ্ঠী সমর্থ ‘ইন্দ্র’ শব্দ দ্বারা লিঙ্গ অর্থে ‘ঘচ্’ প্রত্যয়ের নিপাতন হয়। অষ্টাধ্যায়ীর এই সূত্রের কাশিকা-বৃত্তির ব্যাখ্যায় এই ভাবকে স্পষ্টরূপে বলা হয়েছে— “ইন্দ্র আত্মা, স চক্ষুরাদিনা করণেন অনুমীয়তে।” যদিও ‘ইন্দ্র’ শব্দটি পরমেশ্বর, জীবাত্মা, রাজা, বিদ্যুৎ ইত্যাদি অনেক অর্থে বৈদিক সাহিত্যে প্রযুক্ত হয়েছে, কিন্তু এই উপনিষদে যক্ষের (ব্রহ্মের) জ্ঞাতা হলেন ইন্দ্র।
৫। হৈমবতী উমা— এই প্রকরণে ‘উমা’ হিমালয় দুহিতা পার্বতী নয়, বরং “উম্ পরমাত্মানং মাতি প্রমাপয়তি ইতি উমা” অর্থাৎ যা পরমাত্মার সম্পর্কে জ্ঞান প্রাপ্ত করায়, তার নাম ‘উমা’। এই ব্যুৎপত্তি অনুসারে ব্রহ্মবিদ্যাই ‘উমা’। “হন্তি উষ্মাণমিতি হিমম্” = যে সন্তাপকে দূর করে তার নাম ‘হিম’ এবং “হৈমং বিদ্যতে য়স্যা সা হৈমবতী” = যার মধ্যে হিমের ভাব আছে, তার নাম ‘হৈমবতী’। এই প্রকার শান্ত্যাদি গুণসম্পন্ন হওয়ার কারণে ব্রহ্মবিদ্যাকে ‘হৈমবতী’ বলা হয়েছে। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী এই প্রকরণ সম্পর্কে বলেছেন— “এরূপ বর্ণনার মাধ্যমে হৈমবতী নামক যে ব্রহ্মবিদ্যা আছে, তার মাহাত্ম্য দেখানো হয়েছে” (পূনা প্রবচন, সপ্তম প্রবচন, যজ্ঞ ও সংস্কার বিষয়ক)।
এই হলো আখ্যানের চরিত্রগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয়। এবার আখ্যানে ফিরে আসা যাক। এই প্রকরণে ব্রহ্মের যক্ষরূপে প্রকট হওয়া এবং অগ্নি, বায়ু প্রভৃতি দেবগণের তাঁকে না জানা, একটি আলংকারিক বর্ণনা। এখানে রূপকালঙ্কার দ্বারা পরমাত্মার যক্ষরূপে প্রকট হওয়ার বর্ণনা করা হয়েছে। এর ব্যাখ্যা বেদান্ত-দর্শনের (১।২।২৩) “রূপোপন্যাসাচ্চ” সূত্রে করা হয়েছে। কেননা, ব্রহ্ম নিরবয়ব, নিরকার অতএব তাঁর শরীরধারী হয়ে সংলাপে অংশগ্রহণ কখনো সম্ভব নয়। তাই আখ্যায়িকার রূপে ব্রহ্মের সর্বোৎকৃষ্টতার বোধ করানোর জন্য এরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা সংসারে দুটি প্রধান শক্তি দেখতে পাই একটি হচ্ছে, প্রকাশ এবং অন্যটি গতি। এদের আশ্রয়ে আমরা সংসারে অনেক কিছু লাভ করে থাকি। কিন্তু ব্রহ্মের কাছে এই দুই শক্তিও তুচ্ছ। কেননা, অগ্নি ভৌতিক পদার্থে ব্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও যদি ব্যক্তরূপে না আসে তাহলে তা কোনকিছুই জ্বালাতে পারবে না। বায়ুও ব্যক্ত অবস্থায় এসেই কোনোকিছু ওড়াতে পারেন, নতুবা নয়। আর তাদের অব্যক্ত থেকে ব্যক্ত অবস্থায় আনেন স্বয়ং ব্রহ্ম। সেজন্য বায়ু, অগ্নি প্রভৃতি মহাভূতের যা কিছু সামর্থ্য রয়েছে, তা ব্রহ্ম প্রদত্ত। ব্রহ্মের শক্তির কাছে ভৌতিক অগ্নি, বায়ু, জল প্রভৃতি জড় দেবগণ যে শক্তিহীন এটি বোঝানোর জন্যই এই আখ্যায়িকা। আর অগ্নি, বায়ু দেবগণের যক্ষকে জানতে না পারার কারণ হচ্ছে, তাঁরা উভয়েই অচেতন সেজন্য যক্ষকে জানার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। কিন্তু ইন্দ্রে (জীবাত্মাতে) চেতনা-শক্তি থাকার কারণে তার সেই সামর্থ্য আছে। কিন্তু যদি জীবও যদি অবিদ্যাগ্রস্ত হয়ে সাংসারিক ভোগবিলাসে নিমগ্ন হয়, তখন তারও ঈশ্বর-প্রাপ্তি হতে পারে না। ইন্দ্রকে (জীবাত্মাকে) দেখে যক্ষের (ব্রহ্মের) অন্তর্ধান হওয়ার দ্বারা এটিই স্পষ্ট হয়। এরপর ইন্দ্র (জীবাত্মা) স্বাধ্যায় ও যোগাভ্যাস দ্বারা অন্তঃকরণকে শুদ্ধ করলেন। তখন জীবাত্মার হৃদয়াকাশে ‘উমা’ অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ্যার আবির্ভাব হলো এবং তার দ্বারা তিনি ব্রহ্মকে জানতে পারলেন। কারণ জীব যোগসাধনা দ্বারা যখন দিব্যপ্রজ্ঞা লাভ করেন, তখনই ব্রহ্মবিদ্যার দ্বারা তার বুদ্ধি নির্মল হয় এবং তিনি ব্রহ্মকে জানতে সক্ষম হন। আর এই ব্রহ্মপ্রাপ্তি আমাদের হৃদয়াকাশেই হয়। ছান্দোগ্যোপনিষদ্ বলছে, “অথ য়দিমস্মিন্ ব্রহ্মপুরে দহরং পুণ্ডরীকং বেশ্ম দহরোহস্মিন্নন্তরাকাশস্তস্মিন্ য়দন্তস্তদন্বেষ্টব্যং তদ্বাব বিজিজ্ঞাসিতব্যমিতি॥ (ছান্দোগ্য০ ৮।১।১)” অর্থাৎ ‘ব্রহ্মপুর’ নামক এই শরীরে যে সূক্ষ্ম হৃদয়পদ্মরূপ গৃহ আছে, তার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম আকাশ রয়েছে। সেই আকাশের অন্তর্বর্তী স্থানে যে ব্রহ্ম আছেন, তিনিই অন্বেষণ করার যোগ্য এবং তিনিই বিশেষরূপে জ্ঞাতব্য। তাই ব্রহ্ম যেখানে প্রকট এবং অন্তর্ধান হয়েছিলেন সেটি আমাদের এই হৃদয়াকাশ, বাইরের আকাশ নয়। এভাবে যদি আমরা উপনিষদের আখ্যানগুলি অনুধাবন করার চেষ্টা করি তাহলেই আমরা এর প্রকৃত রস আস্বাদন করতে সক্ষম হবো নতুবা স্থূল চিন্তা করলে শুধু একটি কাল্পনিক গল্প বলেই মনে হবে।
সন্দর্ভ গ্রন্থ— উপনিষদ্ সংগ্রহ ১ম খণ্ড (স্বাধ্যায় প্রকাশনী)
আরো পড়ুন -
0 মন্তব্য(গুলি)