https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

কুন্তাপ সূক্ত - প্রাচীনতা ও প্রামাণিকতা প্রসঙ্গ

Monday, July 29, 2024

অথর্ববেদের ২০তম কাণ্ডের ১২৭ থেকে ১৩৬ সূক্ত পর্যন্ত ১০টি সূক্তকে বলা হয়ে থাকে কুন্তাপ সূক্ত। কুন্তাপ সূক্তে ১৪৭টি (১৪+১৬+২০+২০+২০+১৬+৬+৬+১৩+১৬) মন্ত্র রয়েছে। কুন্তাপসূক্তের উল্লেখ ও বিনিয়োগ শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্র ১২.১৩৭, শাঙ্খায়ন ব্রাহ্মণ ৩০.৫, আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্র ৮.৩.৭, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৬.৩০.৬-১০, বৈতান শ্রৌতসূত্র ৬.২.১৬, গোপথ ব্রাহ্মণ ২.৬.১২ ইত্যাদিতে বিদ্যমান।

সেখানে এই সূক্তকে কুন্তাপ সূক্ত হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই কুন্তাপ সূক্তের প্রাচীনতা শাস্ত্রীয় ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত। 

 

১২৭ -১২৮ সূক্তের মন্ত্র নারাশংসী, রৈভী, পারিক্ষিতী, কারব্যা, দিশাংক্লৃপ্তী, জনকল্পা, ইন্দ্রগাথা নামে সংজ্ঞায়িত। এরপরে ১২৯-১৩২ ঐতেশপ্রলাপ, ১৩৩ প্রবহ্লিকা, ১৩৪ আজিজ্ঞাসেন্যা, ১৩৫ প্রতিরাধ, অতিবাদ, ভূতচ্ছেদ্, ১৩৬ দেবনীথ, আহনস্য। সর্বমোট এই ১৪৭টি মন্ত্র মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাস নামকরণ করেছেন।

কুন্তাপ সূক্তের নাম 'কুন্তাপ' কেন এই প্রশ্ন পাঠকের মনে হতেই পারে। আসুন আমরা 'কুন্তাপ' শব্দটির শাস্ত্রীয় নির্বচন দেখি -

১। কু = কুৎসিতমাত্রং (পাপ-তাপ-দুরিত-দুর্গুণাদিকং) তাপয়ন্তি দহন্তি ইতি কুন্তাপানি, তথাবিধানি সূক্তানি - কুন্তাপসূক্তানি । কর্মণ্যুপপদস্য তপ-ধাতোঃ 'অণ্', মুমাগমশ্ছান্দসঃ ।

অথবা,

২। কুম্-পৃথিবীং পার্থিববিকারান্ (পাপ-তাপ-দুঃখ-দোষ- দুরিতাদিকান্) তাপয়ন্তি দহন্তি ইতি কুন্তাপানি । কুন্তাপানি চ তানি সূক্তানি (মন্ত্রসমুদায়াঃ) চেতি 'কুন্তাপ-সূক্তানি' ।

অথবা,

৩। কুয়ং হ নাম কুৎসিতং ভবতি, তদ্যৎ তপতি তস্মাৎ কুন্তাপাঃ, তৎ কুন্তাপানাং কুন্তাপত্বম্ । তপ্যন্তেঽস্মৈ কুয়ানিতি, তপ্তকুয়ঃ স্বর্গে লোকে প্রতিতিষ্ঠতি" (গোপ.ব্রা. ২/৬/১২) । 'তপ' ধাতোঃ কর্মণ্যুপপদে 'অণূ' কুয়শব্দস্য ছান্দসে যলোপে মুমাগমে 'কুন্তাপঃ'।


গোপথ ব্রাহ্মণ অনুযায়ী 'কুয়' অর্থ কুৎসিত, নিন্দিত, পাপাদি। কিংবা কু দ্বারা কেবল কুৎসিত পাপ-দুর্গুণাদি বা কুম্ দ্বারা পার্থিব - এই সকলকে যে মন্ত্রসমূহ 'তাপ' অর্থাৎ সন্তাপিত করে, দূর করে, ভস্মীভূত করে সেগুলোকেই কুন্তাপ বলে।

সামান্য ব্যতিক্রম ব্যতীত সকলেই কুন্তাপসূক্তকে মূল সংহিতার অন্তর্ভুক্ত হিসেবেই বিবেচনা করে । বেদভাষ্যকারদের মধ্যে আচার্য জয়দেব শর্মা মীমাংসালঙ্কার, পণ্ডিত ক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী, পণ্ডিত হরিশরণ সিদ্ধান্তালঙ্কার তাঁদের অথর্ববেদ ভাষ্যানুবাদে কুন্তাপসূক্ত মূল সংহিতা অন্তর্গতরূপে স্বীকার করেছেন। 


 

তন্মধ্যে পণ্ডিত ক্ষেমকরণ দাস ত্রিবেদী ও পণ্ডিত জগন্নাথ বেদালঙ্কার কুন্তাপসূক্তের সংস্কৃতভাষ্যও রচনা করেছেন । 


মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী প্রণীত 'চতুর্বেদ-বিষয়-সূচী অনুযায়ী অনেকেই কুন্তাপসূক্তকে সংহিতার অন্তর্গত নন বলতে চান। লক্ষ্যণীয়, মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর নির্বাণ পরবর্তী গ্রন্থসমূহ দুই প্রকার - প্রথমত যেগুলো মহর্ষি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন ও পাণ্ডুলিপিও প্রস্তুত করেছিলেন কিন্তু প্রকাশ করতে পারেননি এবং দ্বিতীয়ত মহর্ষি প্রণীত খসড়া বা কিছু লেখা যা প্রকাশের পরিকল্পনা ছিলো না বা পরিত্যক্ত হয়েছিলো কিন্তু তার স্মৃতি ও কৃতি হিসেবে প্রকাশ হয়েছে। চতুর্বেদ-বিষয়-সূচী দ্বিতীয় প্রকারের অন্তর্গত। মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংসক এই গ্রন্থের সম্পাদনার ভূমিকায় বলেছেন, ' বেদভাষ্যবিধানকালেঽত্র নির্দিষ্টেষু বিষয়েষু ক্বচিৎ পরিবর্তনে সংশোধনে চ কৃতে 'অর্থাৎ বেদমন্ত্রের বিষয়বস্তু সম্পর্কে মহর্ষির সিদ্ধান্ত ভাষ্যরচনাকালে পৃথক দেখা যায়। 

সুতরাং আমরা এটা নিশ্চিতরূপেই বলতে পারি মহর্ষি খসড়া রূপে প্রারম্ভিক সময়ে এই সূচি তৈরি করলেও তা চূড়ান্ত হিসেবে কখনোই মানেননি এবং না একে গ্রন্থাকারে প্রকাশের কোন পরিকল্পনা কোথাও দৃষ্ট হয়। যেমন গ্রন্থে মহানাম্নী আর্চিকের বিষয়নিরূপণ অনুপস্থিত তাই বলে এটিও কি বেদের বাইরে থাকবে? তাই শুধু একটি দৃষ্টান্তের উপর ভিত্তি করে কুন্তাপসুক্ত বেদান্তর্গত নয় এই সিদ্ধান্তে আসা মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর বৈদিক আস্তিক্যবাদের ভাবনার মূলে কুঠারাঘাত। পণ্ডিত বিশ্বনাথ বেদালঙ্কার এজন্যই আলোচনা করেও সম্পূর্ণ কুন্তাপ সূক্তেরই উপাদেয় আধ্যাত্মিক ভাষ্য রচনা করেছেন। রাজারাম শাস্ত্রী ও পণ্ডিত সাতবলেকর স্বীয় জ্ঞান দৌর্বল্যে যথাক্রমে ১৩৩,১৩৬ ও ১৩৫-১৩৬ ব্যাখ্যা করতে পারেননি। প্রফেসর রোথ, হিটনী, গ্রিফিট ইত্যাদি পাশ্চাত্য অনুবাদক নিরর্থক, অশ্লীল(?) ও অসম্বন্ধপ্রলাপমাত্র বলেছে যা সুধী প্রাজ্ঞজনের উপেক্ষণীয়। স্বামী হরিপ্রসাদ বৈদিক মুনি ও তার উপর ভিত্তি করে পণ্ডিত রঘুনন্দন শর্মার সিদ্ধান্তের খণ্ডন মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত আর্যমুনি 'বেদমর্যাদা', মহাত্মা নারায়ণ স্বামী 'বেদরহস্য' এবং পণ্ডিত ব্রহ্মমুনি বিদ্যামার্তণ্ড 'অথর্ববেদ-মুনিভাষ্য-ভূমিকাভাগ' ইত্যাদি গ্রন্থে খণ্ডন করেছেন।

কুন্তাপসূক্ত সম্পর্কে ৩টি ধারণা বিদ্যমান - দুরূহ, অস্পষ্ট ও প্রক্ষিপ্ত । দুরূহ ও অস্পষ্টতা বিষয়ে অধিকতর পাশ্চাত্য ও কতিপয় প্রাচ্য বিদ্বানদের যে মতামত তা ভিত্তিহীন এবং তাদের আর্ষগ্রন্থে অনভিজ্ঞতাই মূল কারণ। বেদব্যাখ্যাতার জন্য আর্ষগ্রন্থের স্বাধ্যায়, শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব ও যোগাভ্যাস অত্যাবশ্যক। প্রক্ষিপ্ত বলার পূর্ব কিছু কারণ আমরা ইতোমধ্যে খণ্ডন করে এসেছি। অনেকেই সায়ণাচার্য পদপাঠ করেননি এজন্য একে প্রক্ষিপ্ত দায়ী করেন। এই দাবি অমূলক কেননা সায়ণাচার্য অঘমর্ষণ সূক্তের (ঋ০ ১০।১৯০) পদপাঠ প্রদান করেননি, অথচ বৈদিকদের সন্ধ্যার নিত্যপাঠ্য মন্ত্রসমুদায়ে এটি বিদ্যমান। 

তাতে কী এই সূক্ত প্রক্ষিপ্ত ঘোষিত হবে? কতিপয় পণ্ডিতন্মন্য ব্যক্তি ১৯ বা ২০ কাণ্ড সম্পর্কেও সন্দেহ পোষণ করেন, তাই বলে কি আমাদের শাস্ত্রীয় প্রত্যক্ষ প্রমাণ পরিত্যাগ করে ব্যক্তিমত গ্রহণ করতে হবে? আবার ঋগ্বেদীয় খিল হিসেবে প্রসিদ্ধ বালখিল্য সূক্ত খিল হিসেবে সম্পাদকগণ পরিশিষ্টে ভ্রান্তিপূর্বকস্থান দিলেও সেটিও প্রামাণিক ও মূল সংহিতার অন্তর্গত। কিন্তু অথর্ববেদে এই ভ্রান্তিরও ন্যূনতম অবকাশ নেই কেননা, কুন্তাপ সূক্ত অথর্ববেদের সংহিতাপাঠের অন্তর্ভুক্তই, পাশাপাশি এরপরে সর্বমান্য ও অবিসংবাদিত আরো ৭টি সূক্ত (২০.১৩৭-১৪৩) বিদ্যমান। তাই এই সূক্ত প্রক্ষিপ্ত নয় তা প্রমাণিত। 


  • কুন্তাপসূক্তের বিষয়বস্তু কী কী ?

সূক্ত ১২৭ উপাসক, রাজার মহত্ত্ব ও কর্তব্য, ত্রিতাপ দুঃখনিবারণ বর্ণনা করে। সূক্ত ১২৮ জ্ঞানী, নীচ ইত্যাদি উৎকৃষ্ট নিকৃষ্ট ব্যক্তি, পরমাত্মার সখ্যতা বর্ণনা করে। সূক্ত ১২৯-১৩২ অধ্যাত্ম জ্ঞান ও ত্রৈতসিদ্ধান্ত, ১৩০ জীবাত্মা বিজ্ঞান, ১৩১ সাংসারিক বিষয়ত্যাগ, ১৩২ যোগ ও বৈরাগ্য, ১৩৩ রাজসিক ও তামসিক প্রবৃত্তির পরিত্যাগে পরমেশ্বর ও জীবাত্মার ভূমিকা, ১৩৪ সর্বত্র দুর্গুণ পরিত্যাগ, ১৩৫ কূট অর্থাৎ গভীর প্রতীকাত্মক তত্ত্ব এবং ১৩৬ সাধ্বী, বিদুষী স্ত্রী ও তার বিপরীত স্ত্রীর বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে।

🖋️ বাংলাদেশ অগ্নিবীর