পৌরাণিক ভ্রাতাগণ বেদে সাকারবাদ প্রমাণে বিষ্ণুর বৃহৎ শরীর আছে এমন অনুবাদ তুলে ধরেছেন । অথচ যে অনুবাস তুলে ধরেছেন তাতে করা ব্যাখ্যাই লুকিয়ে গিয়েছেন । প্রতিটি জায়গাতেই তারা হয় ভুল অনুবাদ পেশ করেন নতুবা কুযুক্তি । মজার ব্যাপার হলো বিষ্ণু শব্দটির অর্থই সর্বব্যাপক যা নিজেই আকারের খণ্ডন করে । (বিষ্লৃ ব্যাপ্তৌ) এই ধাতুর [ধা০ ৩.১৩] সঙ্গে ‘নু’ প্ৰত্যয় [উ০ ৩.৩৯] যোগে ‘বিষ্ণু’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘বেবেষ্টি ব্যাপ্নোতি চরাঽচরং জগৎ স বিষ্ণুঃ পরমাত্মা’= চর এবং অচর রূপ জগতে ব্যাপক বলে পরমাত্মার নাম ‘বিষ্ণু’। তাহলে উক্ত মন্ত্রের অর্থ আসলে কী ? আসুন দেখি ।
চতুর্ভিঃ সাকং নবতিং চ নামভিশ্চক্রং ন বৃত্তং ব্যতীঁরবীবিপৎ ।
বৃহচ্ছরীরো বিমিমান ঋক্বভির্যুবাকুমারঃ প্রত্যেত্যাহবম্ ॥
ঋগ্বেদ ১.১৫৫.৬
সায়ণভাষ্যানুযায়ী অনুবাদঃ বিষ্ণু গতিবিশেষ দ্বারা বৎসরের চতুর্নবতি দিবস চক্রের ন্যায় বৃত্তাকারে চালিত করেছেন। বিষ্ণু বৃহৎ শরীর বিশিষ্ট ও সুতিদ্বারা পরিমেয়, তিনি নিত্য তরূণ ও অকুমার, তিনি আহাবে গমন করেন।
মজার বিষয়, অপপ্রচারকারীরা রমেশচন্দ্র দত্তের অনুবাদ দিলেও তিনি যে টীকা দিয়েছেন সায়ণ অনুযায়ী তা কেটে দিয়েছে । এ কেমন অসততা ? আসুন দেখি কী বলা -
অয়মাদিত্যাত্মা বিষ্ণুঃ “চতুর্ভিঃ “সাকং সহিতাং "নবতিং “চ । চতুর্নবতিমিত্যর্থঃ । এতৎসঙ্খ্যাকান্ কালাবয়বান্ “নামভিঃ স্বকীয়নমনপ্রকারৈঃ প্রেরণবিশেষৈঃ “বৃত্তং যথা ভবতি তথা “ব্যতীন্ বিবিধাতনস্বভাবান্ বৃত্তং “চক্রং “ন বহ্বরোপেতং চক্রমিব তং যথা শত্রোরুপরি প্রক্ষেপেণ ভ্রময়তি তদ্বদুক্তসঙ্খ্যাকান্ কালাবয়বান্ “অবীবিপৎ কম্পয়তি ভ্রময়তি॥ ‘ টুবেপৃ কম্পনে '। ণ্যন্তাৎ লুঙি চঙি রূপম্ ॥ কে পুনস্তে উচ্যতে । সংবৎসর একঃ । অয়নে দ্বে। পঞ্চর্তবঃ । দ্বাদশ মাসাঃ । চতুর্বিংশত্যর্ধমাসাঃ । ত্রিংশদহোরাত্রাঃ । অষ্টৌ যামাঃ । একস্মিন্ দিনে পর্যাবর্তমানানি মেষাদীনি দ্বাদশ লগ্নানীতি মিলিত্বা চতুরধিকনবতিসঙ্খ্যাকানবীবিপৎ। নন্বাদিত্যঃ স্বয়মপি ইতরবৎপরিভ্রমতি কথং ভ্রময়তি ইত্যুচ্যতে । নৈষ দোষঃ । এতেষাং ভ্রামকস্য ধুবস্য বিষ্ণোঃ মূর্ত্যংন্তরত্বাৎ।
= সায়ণ ৯৪ কালাবয়ব নির্দেশ করেছেন, যথা সম্বৎসর (১), অশ্বীদ্বয়, (২)পঞ্চঋতু (৫) দ্বাদশ মাস (১২), চতুর্বিংশতিপক্ষ (২৪) ত্রিংসৎ অহোরাত্র (৩০), অষ্টপ্রহর (৮), দ্বাদশ রাত্রি (১২)।
এর বাইরে সায়ণ এটিকে অধ্যাত্ম পক্ষেও ব্যাখ্যা করেছেন, সেখানে তিনি বৃহৎ+শরীরের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা অত্যন্ত চমকপ্রদ । অপপ্রচারকারীরা কী সেটি মানবে ?
সায়ণ বলেন,
এবং কলাত্মকঃ বিষ্ণুঃ “বৃহচ্ছরীরঃ" বিরাডাত্মনা সর্বদেবমনুষ্যাদিশরীরাণাং স্বশরীরত্বাৎ । বৃহচ্ছরীরত্বমেবোপপাদয়তি ।
অর্থাৎ, বিষ্ণুর বৃহৎ শরীর প্রকৃতপক্ষে সর্ব দেবতা ও মানুষের শরীর ।
বিষ্ণুর এই শরীর নিজস্ব আলাদা কোন শরীর না । যেভাবে পুরুষসূক্তে সহস্রশীর্ষ মূলতঃ পরমাত্মা সর্বজীবের শীর্ষে ব্যপ্ত বলে কথিত হয়েছে এখানেও ঠিক তাই। কিন্তু অপপ্রচারকারীগণ মূর্খ এবং তার সাথে মিথ্যাবাদী । এজন্য তারা বিষ্ণু শব্দের সূর্যপরক ভাষ্য ও টীকা এড়িয়ে গিয়েছে । আর সায়ণভাষ্যের সর্বব্যাপকত্বের উল্লেখ তো নেই-ই ।
যঃ পূর্ব্যায় বেধসে নবীয়সে সুমজ্জানয়ে বিষ্ণবে দদাশতি ।
যো জাতমস্য মহতো মহি বরবত সেদু শরবোভির্যুজ্যং চিদভ্যসত॥
ঋগ্বেদ ১.১৫৬.২
সায়ণভাষ্যানুযায়ী অনুবাদঃ যে মনুষ্য প্রাচীন, মেধাবী, নিত্য নুতন ও সুমজ্জানি বিষ্ণুকে হব্য প্রদান করেন; যিনি মহানুভব বিষ্ণুর পূজনীয় জন্ম (কথা) কীর্তন করেন, তিনিই যুজ্য (স্থান) প্রাপ্ত হন।
এখানেও মিথ্যাচারীরা যুজ্য অর্থ 'ভগবানের ধাম' লিখেছে৷ আচ্ছা তাও ধরে নিলাম একই হলো । তাদের মতে এখানে এখানে ঈশ্বরের জন্ম আছে কেননা মন্ত্রে 'জাতম্' শব্দ বিদ্যমান । কিন্তু এই জাত আসলে কী ? যদি জন্ম ধরা হয় তবে তা শাস্ত্রের সাথে বিরোধ হয় কেননা ঈশ্বর জন্ম নেন না । তিনি অজ ও অকায় তা শাস্ত্রে বহুবার উল্লেখিত । সায়ণভাষ্যেও পূর্বাগ্রহরূপে দেখা যায়, 'হিরণ্যগর্ভাদিরূপং জন্ম' উল্লেখিত ।
কিন্তু সায়ণ অদ্বৈতবাদী । আর অদ্বৈতবাদে হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্ম নয় । ব্রহ্ম নির্গুণ, নিরাকার । তাই পারমার্থিক দৃষ্টিতে তাও মিথ্যা । তাহলে সেই মিথ্যা তত্ত্ব দিয়ে পৌরাণিকরাও মিথ্যা সাকার প্রমাণ করে কী দেখাতে চাচ্ছেন ? কেননা এতে তো এটাই প্রমাণ হবে যে আপনারা ভ্রান্ত সাকারের উপাসনা করেন আর প্রকৃত ব্রহ্মবাদী মূলতঃ আমরাই৷
আর এই মন্ত্রের আধ্যাত্মিক অর্থও যদি আমরা দেখি তাতে ভগবান্ জগৎ সৃষ্টির সময় যে তৈরি জগতে ব্যপ্ত সেটিই জাত শব্দে প্রকাশিত হয় ।
পরো মাত্রয়া তন্বা বৃধান ন তে মহিত্বমন্বশ্নুবন্তি ।
উভে তে বিদ্ম রজসী পৃথিব্যা বিষ্ণো দেব ত্বং পরমস্য বিৎসে ॥
ঋগ্বেদ ৭.৯৯.১
সায়ণভাষ্যানুযায়ী অনুবাদঃ হে বিষ্ণু! তুমি মাত্রার অতীত শরীরে বর্ধমান হইলে তোমার মহিমা কেহ অনুব্যাপ্ত করিতে পারে না, পৃথিবী হইতে আরম্ভ করিয়া উভয় লোক আমরা জানি, কিন্তু তুমিই কেবল, হে দেব! পরমলোক অবগত আছ।
-এখানেও সায়ণভাষ্য ত্রুটিপূর্ণ । তার ভাষ্যে, মাত্রয়েতি ব্যত্যযেন তৃতীয়া। “মাত্রয়া “পরঃ পরস্তাদ্বর্তমানয়াপরিমিতয়া “তন্বা শরীরেণ “বৃধান বর্ধমান হে বিষ্ণো “তে তব “মহিত্বং মহত্ত্বং “ন “অন্বশ্নুবন্তি নানুব্যাপ্নুবন্তি । অর্থাৎ, রূপ রস গন্ধ স্পর্শ সব থেকে অতিরিক্ত বিষ্ণুর কথা বলে তার রূপ বা শরীর আসতে পারে না ।
কেননা তাহলে তো রূপ চলেই এলো। এতে পরস্পর বিরোধাভাস হয় । আর যদি এখানে সায়ণের পূর্ব কথিত সব দেব ও মানুষের শরীর অতিক্রম করেও বিষ্ণু আছেন এমন হয় তবে দ্বিধা থাকে না কেননা ঈশ্বর জগৎ অপেক্ষাও ব্যপ্ত তা শাস্ত্র সম্মত । অর্থাৎ এই মন্ত্রেও ঈশ্বরের শরীর সাক্ষাৎ প্রমাণ হয় না ।
শুধু তাই না, সায়ণ কাণ্ব যজুর্বেদে ৪০.৮ এ স্থূল এমনকি লিঙ্গশরীরও নেই বলেছে । অর্থাৎ প্রমাণিত যে সায়ণকে শরীর প্রমাণে ব্যবহার করা যাবে না তারপরেও জোর করে বা সায়ণ উল্লেখ করে তা প্রমাদ বলেই সাব্যস্ত হবে ।
অতঃ ব্রহ্মের সাকারত্ব সম্পূর্ণ খণ্ডিত হলো ।
0 মন্তব্য(গুলি)