নিরুক্ত অনুসারে কি ঋগ্বেদ ও সামবেদের মন্ত্রসংখ্যা সমান?
( দুর্জনদের আক্ষেপ নিবারণ)
স্বাধ্যায়হীনদের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি ভুল ধারণা এবং অপপ্রচার চালু রয়েছে যে, নিরুক্ত অনুসারে (৭।১২) নাকি ঋগ্বেদ ও সামবেদের মন্ত্রসংখ্যা সমান! অথচ সামবেদের মন্ত্রসংখ্যা ১৮৭৫টি এবং ঋগ্বেদের মন্ত্রসংখ্যা ১০৫৫২টি। আবার নিরুক্তে ঋগ্ যজু সাম এ শব্দগুলো কি মন্ত্রপ্রকার বা শৈলীকেও নির্দেশ করছে নাকি কেবলমাত্র ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ ও সামবেদকেই নির্দেশ করছে তথা ‘ঋগ্ মন্ত্র কেবলমাত্র ঋগ্বেদে, যজু কেবলমাত্র যজুর্বেদে থাকে - তাই এই শব্দগুলো দ্বারা ঐ পৃথক পৃথক সংহিতাকেই কেবলমাত্র বোঝায়(!)’ — এরূপ অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে রিডিং সর্বস্বরা যে আস্ফালন শুরু করেছে তা নিবারণ করা জরুরি। যদিও এর মীমাংসা বাংলাদেশ অগ্নিবীরের সামবেদে “সামবেদের নামকরণ” এবং অনুবাদকগণের ভূমিকা অবলোকন করলেই সচেতন পাঠকের চোখে ধরা পড়বে যে কেন নিরুক্ত শাস্ত্রে ঋগ্ এবং সাম সমান বলা হয়েছে; তাই পুনরায় তার চর্বিত চর্বণ করার জন্য স্বাধ্যায়ীগণের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। তবে নিরুক্ত হতে যে বিস্তৃত আলোচনা করা হবে তা অবশ্যই পাঠকের নিকট বিশেষ বিচারণীয় হবে আশা করছি।
🚧 অপরপক্ষের দাবিগুলো হলো:
১) নিরুক্ত অনুযায়ী, ঋগ্ ও সাম সমান বলতে ঋগ্বেদ ও সামবেদের মন্ত্রসংখ্যা সমান বলা হয়েছে !
২) স্কন্ধস্বামী ও দুর্গাচার্যের টীকাতেও এই কথা বলা হয়েছে কেন ঋক্ মন্ত্র সুর দিলেই সাম হয়!
৩) সামবেদের মন্ত্রসংখ্যা=ঋগ্বেদের মন্ত্রসংখ্যা এবং সাম=ঋক্ কিন্তু সামবেদ আর ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলোতে পার্থক্য রয়েছে। অতএব ঋগ্বেদ সঠিক হলে সামবেদ বিকৃত। আর সামবেদ সঠিক হলে ঋগ্বেদ বিকৃত!
👉তাদের এই দাবিগুলোর অসারতা উপলব্ধির জন্য ধারবাহিকভাবে আর্ষানুকূল সিদ্ধান্ত ও পৌরাণিক আচার্যদের ব্যাখ্যা পর্যালোচনা করা হল—
১—প্রথমেই ঋগ্ ও সাম নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। কারণ কতিপয় রিডিং সর্বস্বের ধারণা ঋগ্ বলতে কেবলমাত্র ঋগ্বেদ, যজু বলতে কেবল যজুর্বেদ এবং সাম বলতে কেবলমাত্র সামবেদের মন্ত্র বোঝায়!
অথচ তাদের এই ধারণা যে ভুল তথা ঋগ্, সাম আদি দ্বারা যে কেবলমাত্র বেদ নয় বরং প্রকরণ অনুসারে মন্ত্রশৈলীও নির্দেশ করে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হতে পারে নিরুক্তের এই আলোচ্য অংশে (৭।১২) ঋগ্, যজু, সাম আদি বলতে বেদসমূহকে না বুঝিয়ে চার বেদের মন্ত্রশৈলী বা অন্য কোনো কিছু নির্দেশ করছে এর প্রমাণ কি?
এস্থলে নিরুক্তেই বলা আছে -
❝ঋগ্ভি: শংসন্তি, যজুর্ভিযজন্তি, সামভিঃ স্তুবন্তিঃ॥❞
[নিরু-১৩।৭]
আর স্বয়ং নিরুক্তেরই আলোচ্য অংশে (৭।১২) আছে, “যজুর্যজতেঃ”
অর্থাৎ, নিরুক্তে বেদ হিসেবে নয় বরং ঋগ্,যজু,সাম দ্বারা প্রশংসাত্মক,যজ্ঞসূচক প্রভৃতি মন্ত্রশৈলীকে নির্দেশ করছে। যেগুলো সমগ্র চারবেদেই ছড়িয়ে আছে (এমন নয় যে, সামবেদে কেবলই সাম আছে আর যজুর্বেদে কেবলই যজু এবং ঋগ্বেদে কেবলমাত্র ঋগ্ রয়েছে) সুতরাং এগুলো দ্বারা এস্থলে বেদ বোঝায়নি। ঋগ্,যজু,সাম দ্বারা যে মন্ত্র শৈলীকে নির্দেশ করা হয়েছে এর প্রমাণ আর্ষগ্রন্থ হতে “যজুর্বেদে কি ব্রাহ্মণের মিশ্রণ রয়েছে” শিরোনামের লেখায় বিস্তৃত প্রমাণ ও মন্ত্র উদ্ধৃতপূর্বক দেখানো হয়েছে যে যজুর্বেদে ঋগ্ ও যজু উভয় শৈলীর মন্ত্র রয়েছে।
( বিস্তারিত —
ক. মূল যজুর্বেদে কি ব্রাহ্মণের মিশ্রণ রয়েছে ?
[ঋগ্,যজু,সাম এর ভেদ এবং যজুর্বেদে যজু ব্যতীত অপর শৈলীর মন্ত্রসমূহের বিচার অংশ দ্রষ্টব্য]
https://back2thevedas.blogspot.com/2024/07/blog-post_27.html )
সুতরাং, ঋগ্ ও সাম সমান বলতে উভয় বেদের মন্ত্রসংখ্যা সমান বলা হয়েছে এই দাবি প্রথমেই নিরুক্তের আলোচ্য সূত্রের প্রকরণ অনুসারে ঋগ্ ও সাম এর অর্থ দ্বারা খণ্ডিত হয়। তাই আর্ষ-অনার্ষ যেকোনো উৎস হতেই এর ব্যাতিক্রম বের করলেই তা গ্রহণযোগ্য হবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রকরণ অনুসারে সঠিক অর্থ গৃহীত হচ্ছে। যদি কেউ দ্বিমত পোষণ করে তাহলে তাকে প্রমাণ দিতে হবে —
ক) ঋগ্বেদে কেবল ঋগ্ ই আছে। অন্য যজু,সাম আদি শৈলীর মন্ত্র নেই বিধায় ঋগ্ মাত্রই ঋগ্বেদকে বোঝায়।
খ) যজুর্বেদে কেবলমাত্র যজুই আছে। অন্য ঋগ্, সাম আদি শৈলীর মন্ত্র নেই বিধায় যজু দ্বারা কেবলমাত্র যজুর্বেদকে বোঝায়।
গ) সামবেদে কেবলমাত্র সামই আছে অর্থাৎ সামবেদের মন্ত্রই সুর দিয়ে গান করা যায়। কোনো ঋগ্,যজু শৈলী সেখানে নেই তাই সাম দ্বারা কেবলমাত্র সামবেদকেই বোঝায়।
রিডিংসর্বস্ব প্রকরণজ্ঞানহীনদের কষ্ট হতে পারে বিধায় পূর্বেই জানানো হচ্ছে তাদেরকে প্রলয়কাল পর্যন্ত সময় দিলেও এই তিনটির একটির পক্ষেও কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারবে না। হ্যাঁ, প্রমাণের নামে প্রহসন রচনা ঠিকই করতে পারবে।
২—তাদের এই দাবিগুলোর মূল উৎসস্থল হলো অন্ধের যষ্টি অমরেশ্বরের কৃত নিরুক্তভাষ্য(৭।১২)। অমরেশ্বরের নিরুক্তভাষ্যে (৭/১২/৫) বলা হয়েছে—
মূল সূত্র:
সাম সম্মিতমৃচাস্যতের্বর্চা সমং মেন ইতি নৈদানা । (নিরুক্ত ৭।১২)
অমরেশ্বর কৃত পদার্থ :
সাম=সম্মিতম্ ঋচা (ঋকের দ্বারা সম্মিত), অস্যতেঃ বা, স্যতেঃ বা (অথবা সাম শব্দ ‘অস’ ধাতু হইতে কিংবা ‘সো’ ধাতু হইতে নিষ্পন্ন)
ঋচং সমং মেনে (ঋকের সমান অর্থাৎ সম সংখ্যক মনে করিয়াছিলেন) ইতি নৈদানা (❝নিদানভিজ্ঞগণ এরূপ মনে করেন❞)
সমীক্ষা : ঋগ্ ও সাম সমান ইহা নিদানভিজ্ঞগণের মত যা মহর্ষি য়াস্ক সূত্রের শেষ ❝ইতি নৈদানা❞ শব্দদ্বয়ের উল্লেখ দ্বারা সুস্পষ্ট করেছেন! যদি এটি নিরুক্তের তথা নিরুক্তকারের তথা আর্ষ নিরুক্ত শাস্ত্র পরম্পরার আচার্য-ঋষিগণের মত হতো তাহলে সেটা প্রকাশ করার জন্য মহর্ষি য়াস্ক “ইতি নৈদানা” না লিখে ❝ইতি নৈরুক্তা❞ লিখতেন ঠিক যেভাবে তিনি নিরুক্তের অন্যত্র নিরুক্ত শাস্ত্র পরম্পরার সিদ্ধান্ত প্রকাশের জন্য ব্যবহার করেছেন। উদাহরণস্বরূপ -
“তৎ কো বৃত্রঃ? মেঘ ইতি নৈরুক্তাঃ, ত্বাষ্ট্রো অসুর ইত্যেতিহাসিকাঃ।” [নিরুক্ত - ২।১৬]
অর্থাৎ, ঐতিহাসিকগণের মতে বৃত্র হলো অসুর কিন্তু নৈরুক্ত পরম্পরার আচার্যগণ বলেছেন বৃত্র অর্থ মেঘ।
এরূপ মতভেদে শব্দশাস্ত্র নিরুক্ত তথা নৈরুক্ত আচার্যগণের মতই চূড়ান্ত মানা সমচীন। তেমনি, ঋগ্ ও সাম সমান এটি নিদানগণের মত, নৈরুক্ত আচার্যগণের মত হলে সরাসরিই য়াস্কাচার্য ইতি নৈরুক্তাঃ লিখতে পারতেন এই সূত্রের ন্যায়। “ইতি নৈদানা” লেখার দরকার পড়তো না। আরেকটা বিষয় লক্ষণীয় য়াস্ক যেখানে যেখানে নৈরুক্তগত অর্থ ও মত দেখিয়েছেন তার স্বপক্ষে বিস্তৃত ব্যাখ্যা-প্রমাণ প্রদর্শন করেছেন যেমন: বৃত্র অসুর না হয়ে মেঘ হলে মন্ত্রের অর্থ কিরূপ হবে, ইন্দ্র অর্থ কি হবে, এক্ষেত্রে ইন্দ্রের সাথে বৃত্র বা মেঘের যুদ্ধ কিভাবে সম্ভব—এগুলোর সদর্থ ঐতিহাসিক মত খণ্ডন করে মহর্ষি য়াস্ক ঠিক একই সূত্রে (২.১৬.১০) ব্যাখ্যা করেছেন যা দুর্জনদের অতিপ্রিয় অমরেশ্বরের নিরুক্তভাষ্যেও পাওয়া যাবে।
অথচ যেখানে ঋগ্ ও সামকে সমান বলা হচ্ছে (তথা দুর্জনদের দাবি অনুসারে, মন্ত্র”সংখ্যা” সমান বলা হচ্ছে) সেখানে না তো বৃত্র=মেঘ এর সূত্রের মতো কোনো অতিরিক্ত ব্যাখ্যা স্বয়ং নিরুক্তকার দিয়েছেন আর না তো এর স্বপক্ষে সরাসরি কোনো মন্ত্রপ্রমাণ দেখিয়েছেন! আর যেগুলো অতিরিক্ত ব্যাখ্যা বলে আমরা মনে করছি তা আসলে বিভিন্ন ভাষ্যকারদের। নিরুক্তকার যাস্কের না। মহর্ষি যাস্ক তো সূত্রে কেবলমাত্র লিখেছেন — “ঋচং সমং মেনে ইতি নৈদানাঃ” ! বলা বাহুল্য, আধুনিক ও মধ্যযুগের ভাষ্যকারগণ এই নৈদানগণের ঋগ্ ও সাম বিষয়ক মত ব্যাখ্যা করেছেন; মহর্ষি য়াস্কের মত নয়! এর কারণও স্বাভাবিক যেহেতু এটা নৈদানগণের মত, প্রাচীন নিরুক্তকারগণের মত নয়। আর তাই তাঁরা বা মহর্ষি য়াস্কাচার্য এটির (ঋগ্ মন্ত্রসংখ্যা=সাম মন্ত্রসংখ্যা) সমর্থন করে এমন কোনোকিছু সরাসরি সূত্রে বলেননি বা উপযুক্ত ব্যাখ্যা প্রমাণও প্রদর্শন করেননি কিংবা এমনকিছু নিরুক্তকারগণ সমর্থন করেন এরূপ আভাসমাত্রও সমগ্র নিরুক্তশাস্ত্রে পাওয়া যায় না।
✅ মোটকথা, এটি নৈরুক্তকারগণ দ্বারা মান্য হলে
শেষে “ইতি নৈরুক্তাঃ” থাকতো বা কোনোকিছুই থাকতো না কিন্তু আলাদা করে “ইতি নৈদানা” লেখাটি এর বিশেষ সম্প্রদায়গত মান্যতাকে নির্দেশ করে (সম্পূর্ণ আর্ষমান্যতাকে নয়) আর এই বিশেষ মান্যতার পক্ষে নিরুক্ত পরম্পরার আচার্য-ঋষিগণের সমর্থন নেই বা আধুনিক ও মধ্যযুগীয় ভাষ্যকারদের এবিষয়ক ব্যাখ্যার পক্ষে সম্পূর্ণ সমর্থন নেই এবং নিরুক্তশাস্ত্রের মূল সূত্রসমূহেও নেই।
৩— এরপর অবশ্য অনেকে দাবি করতে পারে নিরুক্তে (৭।১২) নৈদান বলতে নিরুক্তকারগণের পরম্পরার আচার্যগণকেই বোঝাচ্ছে! অথচ নৈদানদের পরম্পরা এবং নৈরুক্তিক পরম্পরা যে এক এই বিষয়ে কোনো সমর্থন নিরুক্তে নেই। উল্টো “ইতি নৈদানাঃ” শব্দদ্বয়ের উল্লেখ এর স্বতন্ত্রতাকেই সূচিত করে । তাই নৈদানগণ ও নৈরুক্তকারগণ একই —এমন দাবিও সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত সিদ্ধ হয় পাশাপাশি অন্য পৌরাণিক পণ্ডিত ও আর্ষ পরম্পরার বিদ্বানগণের ব্যাখ্যা তো রয়েছেই।
▪️ স্কন্ধস্বামীর নিরুক্তটীকায় (৭।১২) বলা আছে ,
❝এবমাদীনাং (এবং নৈদানা) নামগ্রন্থঃ তদ্বিদো মন্যন্ত ইতি শেষঃ।❞
অর্থাৎ, “এরূপ (ঋগ্ ও সাম সমান, প্রজাপতি ঋগ্ ও সাম সমানরূপে জ্ঞাতবান) নৈদান নামক গ্রন্থবিদগণ মানেন।”
▪️পৌরাণিক পণ্ডিত সীতারাম শাস্ত্রীও তাঁর নিরুক্তব্যাখ্যাতে (৭।১২) লিখেছেন যে, এসকল মত নিদানশাস্ত্রবিজ্ঞদের অর্থাৎ নিরুক্তকারের নয়। এতেও এটা বোঝা যায় নিদান বলে পৃথক শাস্ত্র ছিল যা নিরুক্ত হতে ভিন্ন।
যথা:
❝… এসা নিদান গ্রন্থকে জাননেওয়ালে লোক মানতে হ্যৈঁ।❞
▪️মহামোহপাধ্যায় পৌরাণিক পণ্ডিত ছজ্জুরামশাস্ত্রী তাঁর নিরুক্তপঞ্চাধ্যয়ী (৭।১২) তে লিখেছেন যে , নৈদান অর্থ যারা সাম প্রভৃতি শব্দের মূল অন্বেষণকারী বা নিদান নামক শাস্ত্রের অধ্যেতা বা বিশেষজ্ঞ। যথা—
❝নৈদান কা অর্থ হ্যৈঁ শব্দমূলান্বেষণকর্তা- অর্থাৎ জিন লোগোঁ নে সাম আদি শব্দ কে মূলকে খোঁজ কী হ্যৈঁ। য়া “নিদানং বেদ অধীতে বা ইতি নৈদানঃ”- নিদান গ্রন্থবিশেষ হ্যৈঁ উসকে অধ্যেতা য়া তজ্ঞ লোগ নৈদান কহলাএ।❞
▪️ পৌরাণিক পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমীও তাঁর নিরুক্তটীকাতে (৭।৬) “নিদানগ্রন্থস্য” লিখে নিরুক্ত হতে এর পৃথকত্ব নিশ্চয়ণ করেছেন।
▪️ পৌরাণিক পণ্ডিত শিবদত্তা শর্মাও তাঁর “নিঘণ্টু ও নিরুক্ত” (৭।১২) তে লিখেছেন যে নিদান একটি পৃথক গ্রন্থ। আর এই শাস্ত্রের বিদ্বানগণকে নৈদান বলা হয়। যথা:
❝নিদান শাস্ত্রমিতি; তদ্বিদো নৈদানাঃ❞
একই বক্তব্য আমরা আর্ষ বিদ্বানদের নিকট থেকেও পাই,
▫️”নিরুক্তশাস্ত্রম” এ আর্ষ পণ্ডিত ভগবদত্তজী লিখেছেন— সাম এর সমপরিমাণ ঋগ্, ঋগ্ এ সাম প্রক্ষেপ করা হয়, ঋগ্ এর সমান সাম - এমন নৈদানগণ বলেন।
অর্থাৎ, এগুলো নিরুক্তকারের বক্তব্য না বরং নৈদানগণের বক্তব্য। যথা:
❝সাম পূর্ণতয়া মাপা হুয়া হোতা হ্যৈঁ ঋক্ সে অথবা ফেকা জাতা হ্যৈঁ ইয়া রাখা জাতা হ্যৈঁ ঋক্ কে সমান মানা ইয়ে নৈদান কেহ্তে হ্যৈঁ।❞
✅ সুতরাং এথেকে আমরা সিদ্ধান্তে আসলাম,
নিদান একটি পৃথক গ্রন্থ। এটি নিরুক্ত হতে ভিন্ন এবং নিরুক্তকার (৭।৯) এ উক্ত শাস্ত্রের একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন মাত্র কিন্তু এর সমর্থন করেননি আর তাই নিরুক্তকার এ বিষয়ে বিশেষ প্রমাণ প্রদর্শনও করেননি যে কিভাবে ঋগ্বেদ ও সামবেদের মন্ত্র কিংবা ঋগ্ ও সাম “মন্ত্রসংখ্যা”র দিক থেকে সমান বা ঋগ্ এ সাম প্রক্ষেপ করা হয় ইত্যাদি। ফলে নৈদান কিংবা পৌরাণিক ভাষ্যকারগণের এই বক্তব্যগুলো অপ্রামাণিক থেকে গেলো এবং কার্যত কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেলো না।
৪– “স্কন্দ স্বামীর টীকাতে বলা আছে, ঋগ্ মন্ত্রে সুর দিলেই সাম হয়। দুর্গাটীকাতেও আছে, ঋক্ ও সাম সমান!” - এর মীমাংসা নিম্নরূপ:
▫️”নিরুক্তসম্মর্ষ” তে স্বামী ব্রহ্মমুনিও দুর্গাটীকার অনুরূপ লিখেছেন যে, নৈদান শ্রেণির আচার্যগণ হেতুবাদী এবং শব্দের অর্থ অনুসন্ধানী। যথা:
❝ইতি নৈদানাঃ হেতুবাদিনঃ পারিভাষিক শব্দানাং লক্ষণানুবিধায়িনঃ।❞
এ থেকে এটা বোঝা গেলো যে নৈদানগণ ঋগ্ ও সাম সমান কিংবা ঋগ্ এ সাম প্রক্ষেপ করা হয় এসব ধারণা “ঋগ্” ও “সাম” এর অর্থ হতে পেয়েছেন যেমনটা অমরেশ্বরও তার নিরুক্তে সাম শব্দের অর্থ বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন। অর্থাৎ এসব ধারণা শব্দের অর্থ অনুসারে বা ভাব অনুসারে বটে কিন্তু বস্তুনিষ্ঠভাবে তথা প্র্যাকটিক্যালি কিভাবে তা প্রত্যক্ষ নয়। আর একারণেই কোনো প্রকার গণনা বা প্রত্যক্ষ প্রমাণও এবিষয়ে দর্শানো যায়নি যে আক্ষরিকভাবেই ঋগ্বেদের মন্ত্রসংখ্যা ও সামবেদের মন্ত্রসংখ্যা সমান।
এরপর আসা যাক মন্ত্রে সুর দেয়ার বিষয়টি। সামবেদের ঋচাসমূহে সুর রয়েছে। কিন্তু সামবেদের যেসব ঋচায় সুর রয়েছে সেই একই সুর কি ঋগ্বেদের মন্ত্রে রয়েছে? উত্তর হলো না।
য় সামগানাং প্রথমঃ স বেণোর্মধ্যমঃ স্বরঃ। য়ো দ্বিতীয়ঃ স গান্ধারস্তৃতীয়স্ত্বৃষভঃ স্মৃতঃ॥
চতুর্থঃ ষড়জ ইত্যাহু পঞ্চমো ধৈবত ভবেৎ। ষষ্ঠো নিষাদো বিজ্ঞেয়ঃ সপ্তমঃ পঞ্চমঃ স্মৃতঃ॥
[নারদীয় শিক্ষা- ৫।১।২]
অর্থাৎ, সামগানের স্বরে মধ্যম,গান্ধার,ঋষভ,ষড্জ,ধৈবত,নিষাদ,পঞ্চম যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থক, মন্ত্র, কুষ্ট, অতিস্বার — এসকল স্বর কি আদৌ ঋগ্বেদ এবং সামবেদের সব মন্ত্রে পাওয়া যায়? উত্তর না। তাহলে তারা কিসের ভিত্তিতে বলছে যে ঋগ্বেদের সব মন্ত্রকেই সুর দিয়ে সাম বানানো যায়??? অন্ধের মতো কেবলমাত্র দোষ আর ভুল খুঁজতে গিয়ে তারা নিজেরা নিজেদের মূর্খতার নমুনা কিভাবে তাদের লেখার ছত্রে ছত্রে প্রকাশ করেছে সেটা কি তারা টের পাচ্ছে?
যেহেতু ঋগ্বেদের সব মন্ত্রে সামবেদের অনুরূপ সুর দেয়া যায় না, তাই “ঋচাসমূহে সুর দিলেই সাম হয়” — এই বক্তব্য ঋগ্বেদের সকল ঋচার ক্ষেত্রে খাটে না। তাই কোনো ভাষ্যকার বা টীকাকরই বলেননি “দুনিয়ার ‘সমস্ত ঋচাতে’ সুর দিলেই সাম হয়ে যায়!” এর কারণও রয়েছে- এমন ৪৫০টি ঋচা সামবেদে রয়েছে যাতে সুর দেয়া হয় না। তাই “ঋচাসমূহে সুর দিলে সাম হয়” এই বক্তব্য পরিমিত সংখ্যক ঋচার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, সকল ঋচার ক্ষেত্রে নয় এবং কোনো নিরুক্ত ভাষ্যকার বা টীকাকার সমস্ত ঋচাতে সুর দিয়ে সাম বানানোর কথা বলেননি। এবিষয়টি আরেকবার মনে করিয়ে দেয়া হলো যে, নির্দিষ্ট সংখ্যক ঋচাতে সুর দিলে সাম হয় বটে কিন্তু ””সমস্ত ঋচাকে সুর দিয়ে সাম বানানো যায়”” - একথা প্রাচীন স্কন্দস্বামীসহ প্রাচীন টীকাকারগণের কেউই বলেননি আর না আর্ষ, পৌরাণিক মান্যতার কেউ বলেছেন!
৫. তাহলে এখন প্রশ্ন হতে পারে বাস্তবিক অর্থেই প্রকরণ অনুসারে ঋগ্ ও সাম সমান বলতে আদৌতে কি বোঝানো হয়েছে? এপ্রশ্নটির সদুত্তর আর্ষগ্রন্থসমূহ হতে পাই এবং নিরুক্তের আলোচ্য সূত্রের সম্পূর্ণ ও পরবর্তীঅংশগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে তা সহজেই পাঠকের কাছে বোধগম্য হয়।
ক. নিরুক্তশাস্ত্র অনুসারে, “ঋক্ ও সাম সমান” বলতে যা বোঝানো হয়েছে —
▪️ড০ উমাশঙ্কর শর্মা তাঁর নিরুক্তভাষ্যে (৭।১২) লিখেছেন যে যারা ছন্দশাস্ত্রে নিষ্ণাত বিদ্বান ছিলেন তারাই হলেন নৈদান।
নিরুক্তের আলোচ্য অংশ পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতেই পাই যে, নৈদানগণের মত (ঋগ্ ও সাম সমান) বলার ঠিক পরেই ছন্দের প্রসঙ্গ এসেছে।
অর্থাৎ ঋগ্ ও সাম সমান বলার পর সমছন্দ নির্বচনের প্রসঙ্গ এসেছে যা স্পষ্টভাবে আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর করে যে কেন ঋগ্ ও সাম সমান বলা হয়েছে। এর উত্তর হলো ছন্দের দিক্ থেকে। মূল সূত্রে [নিরুক্ত ৭।১২।৫] লেখা রয়েছে -
“গায়ত্রী গায়তেঃ স্তুতিকর্মণঃ ত্রিগমনা বা বিপরীতা গায়তে…”
সূত্রের উক্ত অংশের শুরুতেই প্রোফেসর উমাশঙ্কর ব্যাখ্যা করেছেন যে , নৈদানগণ হলো ছন্দবিশেষজ্ঞ এবং ছন্দের সমতুল্যতার কারণেই তাই তারা সামকে ঋগ্ এর সমান মেনেছেন। (মন্ত্রসংখ্যা সমান হওয়ার কল্পিত কারণে নয়!) যথা—
বৈদিক ছন্দো মেঁ নিষ্ণান (নৈদান) লোগোঁ কা কেহনা হ্যাঁ - “ইসে ঋচা কে সমান সমঝা”।
খ. অন্য আর্ষশাস্ত্রাদি অনুসারে, “ঋগ্ ও সাম সমান” বলতে যা বোঝানো হয়েছে—
সামবিধান ব্রাহ্মণ অনুসারে, “সম” থেকে সাম শব্দ নিষ্পন্ন হয়। সেখানে বলা হয়েছে, ঋগ্বেদের ছন্দ ও সামবেদের ছন্দ সমান এবং সম ছন্দযুক্ত হওয়ার কারণেই সামবেদের নাম “সাম” পঠিত হয়েছে।
অর্থাৎ ঋগ্ ও সাম তথা ঋগ্বেদ ও সামবেদ সমান ছন্দের দিক থেকে। মন্ত্রসংখ্যার দিক থেকে নয়। যথা:
❝সমা উ হ বা অস্মিশ্ছন্দাংসি সাম্যাদিতি তৎ স্যাম্নঃ সামস্যম।❞ [সামবিধান ব্রাহ্মণ - ১।১।৫]
সূত্রের উক্ত অংশের অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আচার্য উদয়ন মীমাংসক তাঁর নিরুক্ত নির্বচনানি (৭।১২) গ্রন্থে জৈমিনী উপনিষদ ব্রাহ্মণ [৩।২১] হতে প্রমাণ দেখিয়েছেন যে,
“সাম বৈ স্তোত্রিয় ঋগনুরূপঃ।”
অর্থাৎ, ঋগ্ (শাস্ত্র) ও সাম(স্তোত্র) উভয়ই হতে কৃত দেবতার স্তুতি সমান মানা হয় তাই এর নাম “সাম” তথা সমান স্তুতি মানার কারণে তা ঋগ্ এর সমান।
যথা—
❝ঋগ্ মন্ত্র (শাস্ত্রপাঠ) সে অঔর সামগান (স্তোত্রপাঠ) সে কী জানি বালী দেবতাও কী স্তুতি সমান হী মানী জাতি হ্যৈ।❞
এছাড়া, ছান্দোগ্য উপনিষদে[১।৩।৪]ও বলা হয়েছে— “য়ৎ ঋক্ তৎ সাম্”
অর্থাৎ, ঋক্ ও সাম ছন্দের দিক থেকে সমান (শঙ্করভাষ্য অনুসারে এর কারণ বলা যায় - উভয়ই প্রাণ-অপানের বৃত্তি নিয়ন্ত্রণপূর্বক আবৃত্তি বা গায়ন করা হয় বিধায়)।
📌 সারসিদ্ধান্ত
১. ঋগ্ ও সাম সমান - ইহা যাস্ক নয় বরং নৈদানগণের মত।
২. নৈদানগণ শব্দের অর্থবেত্তা অথবা তাঁরা ছন্দশাস্ত্রে নিষ্ণাত ছিলেন এবং ছন্দের দিক্ থেকে ঋগ্ ও সাম কে সমান বলেছেন আর ছন্দের দিক্ থেকে ঋগ্ ও সামকে সমতুল্য মানার প্রকরণসম্মত আর্ষপ্রমাণ ঐ একই সূত্রের ঠিক পরবর্তী পঙ্ক্তিতে পাওয়া যায়।
৩. নৈদানগণ যদি কেবলমাত্র অর্থবেত্তা হয়ে থাকেন তাহলে উক্ত সূত্রের ব্যাখ্যা হবে সাম কিভাবে অর্থগত দিক্ থেকে ঋচা এর সমান হয়; (মন্ত্রসংখ্যার দিক্ থেকে নয়)
আচার্য উদয়ন মীমাংসক সুস্পষ্টভাবে অর্থবেত্তা নৈদানগণের এবিষয়ে মত তাঁর নিরুক্ত নির্বচনানি গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন যা দ্রষ্টব্য।
৪. ছন্দের দিক্ থেকে ঋচা ও সাম সমান মানা হলেই নিরুক্ত উক্ত (৭।১২) সূত্রের প্রত্যেকেটি পঙ্ক্তি আগের ও পরের পঙ্ক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এই মত প্রোফেসর উমাশঙ্কর শর্মা তার নিরুক্তভাষ্যে (৭।১২) ব্যাখ্যায় দিয়েছেন যা সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক।
অন্যথা মূর্খের ন্যায় “ঋগ্বেদ ও সামবেদের মন্ত্র সংখ্যার দিক্ সমান বলা হয়েছে” - এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হলে এর পরবর্তী পঙ্ক্তিতে মন্ত্র সংখ্যার আলোচনা না দেখিয়ে গায়ত্রী আদি ছন্দের আলোচনা কেন দেখানো হলো এর কোনো সদুত্তর বা প্রকরণসম্মত মীমাংসা দিতে মূ/র্খ হঠ/কারী রিডিং সর্বস্বরা অনন্তকাল অক্ষম থাকবে ।
অতঃ, আর্ষ ও পৌরাণিক উভয় সিদ্ধান্ত ও প্রমাণ উপস্থাপন পূর্বক ঋগ্বেদ ও সামবেদের মন্ত্রসংখ্যা সমান কিংবা উভয়ই বিকৃত - এহেন আক্ষেপ নিবারণ করা হলো।
— বিদুষাং বশংবদঃ
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক।।
0 মন্তব্য(গুলি)