https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

পাণ্ডবদের জন্মের রহস্য

Monday, March 3, 2025

 


পাণ্ডবদের জন্মের রহস্য 

পাণ্ডবদের জন্ম বিষয়ে মহাভারতে লেখা হয়েছে, পাণ্ডু মৃগয়ায় সঙ্গমরত মৃগ-মৃগীরূপী কিন্দম ঋষি বধের কারণে অভিশাপ লাভ করেন যে সে যদি স্ত্রীসংসর্গ করে তবে তার মৃত্যু হবে [ আদি০ অ০ ১১৮]। উক্ত বক্তব্য অনৈসর্গিক ও বেদবিরুদ্ধ বলে গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা - 

১। রতিকালের জন্য মৃগ-মৃগীরূপ ধারণের কোনো যৌক্তিকতা নেই।

২। জীবাত্মা পাপের জন্য তির্যকযোনিতে জন্মগ্রহণ করে, সেখানে মানবদেহ বিদ্যমান থাকতে তীর্যকযোনিতে রমণের জন্য ধারণ করার প্রসঙ্গ অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক। 

সিদ্ধান্ত: পাণ্ডু মূলত তার পাণ্ডুরোগ ও দুর্বল হৃদয়ের কারণে সন্তান জন্মদান কর্মে বিপদাপন্ন ছিলো। 

এরপরে পাণ্ডুর রাজ্যত্যাগ করে বনে গমন (অ০ ১১৯), ব্রহ্মলোক দর্শন ও ব্রহ্মলোক দর্শনে অপুত্রক পাণ্ডুর দুঃখের বর্ণনা (অ০ ১২০) রয়েছে। এই অধ্যায়ের শেষে পাণ্ডু নিয়োগবিধি অনুযায়ী কুন্তীকে সন্তান উৎপাদনের জন্য প্রোৎসাহত করেন - 

(১) মনুঃ স্বায়ংভুবোঽব্রবীৎ = যে বিধি স্বায়ম্ভুব মনু বলেছেন; নিয়োগের বিধি মহর্ষি মনু মনুস্মৃতির ৯ম অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন 

(২) উত্তমাদ্দেবরাৎপুংসঃ কাঙ্ক্ষন্তে পুত্রমাপদি = অর্থাৎ আপদ্‌কালে মানুষ নিজ থেকে উচ্চ ব্যক্তিদের থেকে পুত্রোৎপত্তির আশা করে। ঠিক কারণেই পাণ্ডবদের বারংবার 'দেব'পুত্র বলা হয়েছে। কেননা দেব অবশ্যই বিদ্বান, পণ্ডিত, মহামানবদেরই বলা হয়।

(৩) তস্মাৎ প্রহেষ্যাম্যদ্য ত্বাং হীনঃ প্রজননাৎস্বয়ম্ = পাণ্ডু নিজেকে সন্তান উৎপাদনের শক্তিহীন বলেছে। কোন শাপ নয়। অতঃ পূর্বাপর কথিত অভিশাপবাচক সর্ববাক্য পরবর্তীকালের যোজনা প্রমাণিত।

(৪) মন্নিয়োগাদ্যত ক্ষিপ্রমপত্যোৎপাদনং প্রতি = এই বাক্যে পাণ্ডু সুস্পষ্ট নিয়োগের আজ্ঞা প্রদান করছেন। 

এতে কথিত শারদণ্ডায়নীর উদাহরণ বাস্তবিক হলেও পরবর্তী ১২১ অধ্যায়ে কুন্তী ব্যুষিতাশ্বের মৃত শরীরের সাথে যৌনসংসর্গে ৭ সন্তানের জন্মের কাহিনী শোনান যা যথার্থই অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক। 

এই কাহিনীর সূত্র ধরে পাণ্ডুর ১২২ অধ্যায়ে প্রদত্ত ব্যাখ্যাও ভুল কেননা, উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতুর সময়ে বিবাহবিধান ও একপতিব্রত ছিলো না এটি সর্বৈব মিথ্যা কথা। কেননা বেদে বারংবার একপতিব্রতের নির্দেশ রয়েছে। তবে মধ্যাংশ থেকে বর্ণনা পুনরায় নিয়োগপরক হিসেবে স্বাভাবিক হয় এবং পাণ্ডু আবারও নিয়োগের নির্দেশ প্রদান করে - 

মন্নিয়োগাৎসুকেশান্তে দ্বিজাতেস্তপসাঽধিকাৎ।

পুত্রান্ গুণসমাযুক্তানুৎপাদয়িতুমর্হসি।

 

এরপর কুন্তীর দুর্বাসার মাধ্যমে প্রাপ্ত মন্ত্রের কথা শোনান, মন্ত্রের মাধ্যমে সন্তান প্রাপ্তি অনৈসর্গিক ও বেদবিরুদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে কুন্তী উক্ত উক্ত দেবনামধারীদের সাথে নিয়োগধর্ম পালনপূর্বকই ৩ পাণ্ডবের জন্ম প্রদান করেছেন, মাদ্রীর বেলাতেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। কেননা পাণ্ডু ও ধৃতরাষ্ট্র তারাও বেদব্যাসের নিয়োগজাত সন্তানই। যদি তাদের সময় অলৌকিকতার কোন আবশ্যকতা না থাকে তবে এখানেই বা কেন ? অধিকন্তু, ধর্মকে আহ্বানের পর সংস্করণভেদে বেশ কিছু বিভেদ দৃশ্যমান হয় - 

১. দাক্ষিণাত্য সংস্করণ অনুযায়ী কালীপ্রসন্ন সিংহ ধর্মের প্রভাবে তৎক্ষণাৎ যুধিষ্ঠিরের জন্মের উল্লেখ করেছেন।


২. কুম্ভকোণম্ সংস্করণ ও হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ বনের মধ্যে দুজনের শারীরিক সমাগমের উল্লেখ স্পষ্টভাবে করেছেন ও নিম্নলিখিত শ্লোক তাতে বিদ্যমান - 

তস্মিন্বহুমৃগেঽরণ্যে শতশৃঙ্গে নগোত্তমে।

পাণ্ডোরর্থে মহাভাগা কুন্তী ধর্মমুপাগমৎ॥ 

ঋতুকালে শুচিঃ স্নাতা শুক্লবস্ত্রা যশস্বিনী।

শয়্যাং জগ্রাহ সুশ্রোণী সহ ধর্মেণ সুব্রতা॥

 


 


৩. গীতাপ্রেস ও CE এই শ্লোক রাখেনি। তবে গীতাপ্রেস ও হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ধর্মসমাগমে তৎক্ষণাৎ পুত্রজন্মের কথা লিখেও সুস্পষ্টভাবে তিথি-নক্ষত্র উল্লেখ করেছেন যুধিষ্ঠিরের জন্মের। 

 

 

সিদ্ধান্ত: মূল শ্লোকে স্পষ্ট 'সংযুক্তা' শব্দের উল্লেখ শারীরিক সম্পর্কই নির্দেশ করে। কেননা যদি শুধুমাত্র আহ্বান ও আশীর্বাদ করলেই সন্তান হতো তবে এই পদ নিরর্থক, পাশাপাশি একই বাক্যে 'যোগমূর্তিধরেণ' অর্থ যদি অলৌকিক ধরার কোন মানেই হয় না, বরং এর অর্থ হলো যোগিরূপী ধর্ম। পরবর্তী শ্লোকে 'সুষাব প্রবরং সুতম্' দ্বারা কুন্তীর সন্তান প্রসবেরই কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সন্তানটি দৈহিকই। অলৌকিক নয়। 

 


এভাবেই ভীমের জন্মও হয়, অর্জুনের জন্মের সময় কুন্তীকে মাঙ্গলিক ব্রত করতে বলা হয়। তারপর পাণ্ডুও তপস্যা করা শুরু করেন এবং ইন্দ্র এসে বরদানস্বরূপ পুত্রদান করবেন জানান। মন্ত্রের মাধ্যমে পুত্র প্রাপ্তির প্রক্ষিপ্ততা ও যোজনা এখানেই রহস্য খুলে যায়। কেননা যদি মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে যুধিষ্ঠির ও ভীমের জন্মের উল্লেখ যেভাবে প্রচলিত সংস্করণে পাওয়া যায় তবে অর্জুনের বেলায় সেটি কেন করা হলো না ? তপস্যার কী দরকার ? হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ এখানে যদিও 'সূর্যেন সহ' স্থলে 'ভার্যয়া সহ' লিখে ভুলে কুন্তীকেও পাণ্ডুর সাথে তপস্যায় যুক্ত করেছেন (অ০ ১২৩)। 

 


যাই হোক, আবার কুন্তীকে ইন্দ্রকে আহ্বান করিয়ে আনলে অর্জুনের জন্ম হয়।  

আর রইলো, নকুল ও সহদেব। মাদ্রী কুন্তীর ৩ সন্তান ও দুর্যোধনাদি ভাইদের জন্মের পরেও নিঃসন্তান থাকায় সেই দুঃখ পাণ্ডুকে জানায়। পাণ্ডু তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কুন্তীকে বলে মাদ্রীকে সাহায্য করতে। কুন্তী মাদ্রীকে বলে কোন দেবতার স্মরণ করতে, তাহলেই পুত্র হবে। 

এবমুক্তাঽব্রবীন্মার্দ্রীং সকৃচ্চিন্তয় দৈবতম্।

তস্মাত্তে ভবিতাঽপত্যমনুরূপমসংশয়ম্॥ 

মাদ্রী অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে স্মরণ করে ও নকুল-সহদেবকে জন্ম দেয় (অ০ ১২৪)। 

ততো মাদ্রী বিচার্যৈকা জগাম মনসাঽশ্বিনৌ।

তাবাগম্য সুতৌ তস্যাং জনয়ামাসতুর্যমৌ।

নকুলং সহদেবং চ রূপেণাপ্রতিমৌ ভুবি॥

 


লক্ষ্যণীয়, এই সম্পূর্ণ প্রসঙ্গে কুন্তীর পূর্বে কথিত মন্ত্রের কোন উল্লেখ নেই। অর্থাৎ এই অংশ এখানেও অনুপস্থিত থাকায় প্রমাণিত, মন্ত্রের মাধ্যমে সন্তানের কোন জন্মই হয়নি। কুন্তী প্রকৃতপক্ষে মাদ্রীকে পরবর্তী দুটি সন্তান জন্ম দিতে সাহস দিয়েছিলেন। 

আরেকটি লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, দেবগণকে মানবভিন্ন প্রমাণ করার জন্য বারংবার দৈববাণী ও নামকরণের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ যখনই যুধিষ্ঠির, অর্জুন, ভীমের জন্ম হয়েছে তখনই দৈববাণী হয়ে নামধাম, কর্ম, ভবিষ্যৎ নানা অলৌকিকতার বর্ণনা রয়েছে। এটিও যে প্রক্ষিপ্ত তার প্রমাণ নকুল-সহদেবের জন্মের পরেই পাওয়া যায়। যদিও হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ স্বভাবসুলভ অযৌক্তিক যোজনা দ্বারা স্নেহ ও নামকরণ সংস্কার দেখা চেয়েছেন কিন্তু ঋষিরা আশীর্বাদপূর্বক যে নাম রেখেছেন এবং 'ভক্ত্যা চ কর্মণা' বালকদের বৈশিষ্ট্য হিসেবেই শ্লোকে জ্বাজ্জল্যমান। শতশৃঙ্গবাসী তপস্বীদের দ্বারা বালকদের 'কর্ম ও ভক্তি' দেখে নামকরণের উল্লেখ পাওয়া যায়-

নামানি চক্রিরে তেষাং শতশৃঙ্গনিবাসিনঃ।

ভক্ত্যা চ কর্মণা চৈব তথাঽঽশীর্ভির্বিশাংপতে॥


যদি পূর্বেই নাম অনৈসর্গিকভাবে নির্ধারিতই থাকতো তাহলে আবার নামকরণের জন্য 'ভক্ত্যা চ কর্মণা চৈব' বলা হতো না। তাঁদের প্রত্যেকের নামকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে-

জ্যেষ্ঠং যুধিষ্ঠিরেত্যেবং ভীমসেনেতি মধ্যমম্।

অর্জুনেতি তৃতীয়ং চ কুন্তীপুত্রানকল্পয়ন্॥

পূর্বজং নকুলেত্যেবং সহদেবেতি চাপরম্।

মাদ্রীপুত্রাবকথয়ংস্তে বিপ্রাঃ প্রীতমানসাঃ॥ 


© বাংলাদেশ অগ্নিবীর