মধুমন্ত্র—মধুগীত
মধু বাতা ঋতায়তে, মধুক্ষরন্তি সিন্ধবঃ।
মাধ্বীর্নঃ সন্ত্বোষধীঃ॥
[ঋগ্বেদ ১।৯০।৬ ]
সংসারের প্রত্যেক মানুষ যেন সত্যের সাধনা করে এবং প্রত্যেক সত্যসাধকের উপর মধু বর্ষিত হয়, মধুর ঝরনা প্রবাহিত হয়। পবন তার শীতল, মৃদু তরঙ্গে মধু বইয়ে আনে। কলকল ধ্বনিতে প্রবাহমান নদীসমূহ জলের ধারার সঙ্গে মধু প্রবাহিত করে আসে। রসময়ী ঔষধি অমৃতরসে জীবনে মধু সঞ্চারিত করে। এগুলোর থেকে মধু পেয়ে আমরা মধুময় হয়ে যাই।
মধু নক্তমুতোষসো, মধুমৎ পার্থিবং রজঃ।
মধু দ্যৈরস্তু পিতা॥
[ঋগ্বেদ ১।৯০।৭ ]
কখনও নিজের শ্যাম আঁচলে মায়ের মতো সবাইকে আচ্ছাদিত করে, আবার কখনও নিজের শান্ত, মধুর, ঝলমলে চন্দ্র-কিরণ ছড়িয়ে বিশ্রামদায়িনী রাত্রি আমাদের জন্য মধুময় হোক। জাগরণ ও নবস্ফূর্তি দানকারী স্বর্ণিম ঊষা মধুময় হোক। সমস্ত পার্থিব জগৎ মধুময় হোক। পিতৃতুল্য পালনকর্তা দ্যুলোকও মধুময় হোক।
মধুমান্নো বনস্পতির্মধুমা অস্তু সূর্যঃ।
মাধ্বীর্গাবো ভবন্তু নঃ॥
[ঋগ্বেদ ১।৯০।৮ ]
হরিৎ পত্রের আবরণে মোড়া এই বৃক্ষ, বনস্পতি আমাদের জন্য মধুময় হোক। রশ্মি দ্বারা জগৎকে প্রকাশিতকারী পবিত্র সূর্য মধুময় হোক। নিজের স্তন থেকে অমৃতসম দুগ্ধ দানকারী গাভীগণ মধুময় হোক।
ইয়ং বীরুন্মধুজাতা, মধুনা ত্বা খনামসি।
মধোরধি প্রজাতাসি, সা নো মধুমতস্কৃধি॥
[অথর্ববেদ ১।৩৪।১ ]
আহা! এই যে সম্মুখে মধুময় লতা দৃশ্যমান হচ্ছে। এই ‘মধুয়ষ্টি’ নিজের মধ্যে মধুরস নিয়ে উৎপন্ন হয়েছে। হে মধুলতা! আমরা তোমাকে মধুর জন্য কর্তন করছি। তুমি মধুময়, আমাদেরকেও মধুময় করো।
জিহ্বায়া অগ্রে মধু মে, জিহ্বামূলে মধুলকম্।
মমেদহ ক্রতাবসো, মম চিত্তমুপায়সি॥
[অথর্ববেদ ১।৩৪।২ ]
আমার জিহ্বায় মধু হোক, জিহ্বামূলে মধু হোক। হে মধু! তুমি আমার প্রতিটি জ্ঞানে, প্রতিটি সংকল্পে, প্রতিটি কর্মে বিরাজ করো, তুমি আমার চিত্তে অধিষ্ঠিত হও।
মধুমন্মে নিষ্ক্রমণং, মধুমন্মে পরায়ণম্।
বাচা বদামি মধুমদ্, ভূয়াসং মধুসন্দৃশঃ॥
[অথর্ববেদ ১।৩৪।৩ ]
আমার গৃহত্যাগ মধুময় হোক, কর্মক্ষেত্রে পদার্পণ মধুময় হোক। আমার বাক্যে মধু হোক, প্রত্যেক গতি-বিধিতে মধু হোক, আমি যেন স্বয়ং মধুময় হয়ে যাই।
য়দ্ গিরিষু পর্বতেষু গোষ্বশ্বেষু য়ন্মধু।
সুরায়াং সিচ্যমানায়াং, য়ৎ তত্র মধু তন্ময়ি॥
[অথর্ববেদ ৯।১।১৮ ]
আহা! প্রকৃতিতে সর্বত্র মধু মিশে আছে। এই যে মনোরম পর্বতমালা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, এদের মধ্যেও মধু আছে। এদের হরিৎবর্ণের মধ্যে মধু আছে, স্রোত ও ঝরনায় মধু আছে, বৃক্ষ-লতা ও ফল-ফুলে মধু আছে, অরণ্যে শান্তির মধু আছে, গৈরিক আদি ধাতুসমূহে মধু আছে, কঠোর শিলার মধ্যেও মধু আছে। সেই মধু যেন আমরাও প্রাপ্ত করি।
গাভীগুলোর মধ্যেও মধু আছে, গোরসের মধু আছে, পরোপকারিতার মধু আছে, সৌম্যতার মধু আছে, অহিংসার মধু আছে, মাতৃত্বের মধু আছে, সরলতার মধু আছে। সেই মধু আমাদেরও প্রাপ্ত হোক।
অশ্বদের মধ্যেও মধু আছে, বলের মধু আছে, বেগের মধু আছে, শক্তির মধু আছে, পুরুষত্বের মধু আছে।
দ্রাক্ষাসব প্রভৃতি আসবসমূহের মধ্যেও মধু আছে, বলবর্ধকতার মধু আছে, বিকারশামকতার মধু আছে, স্বাস্থ্যবর্ধকতার মধু আছে। সেই মধু আমাদেরও প্রাপ্ত হোক।
অশ্বিনা সারঘেণ মা, মধুনাংক্তং শুভস্পতী।
যথা বর্চস্বতীং বাচমাবদানি জনাং অনু॥
[ অথর্ববেদ ৯।১।১৯ ]
হে অশ্বিনীদেবগণ! তোমরাও আমাদের জীবনে মধু ভরো, এরূপ মধু, যেরূপ মধু মৌমাছির হয়; যার মধ্যে শুধু মিষ্টতাই মিষ্টতা আছে।
- হে দ্যাবাপৃথিবী! তোমাদেরকে অশ্বিযুগল বলা হয়, তোমরা মধুরসে পরিপূর্ণ, আমাদেরও মধুরস প্রদান করো।
- হে সূর্য-চন্দ্র! তোমরাও অশ্বিদ্বয় নামে প্রসিদ্ধ, তোমাদের মধ্যেও অনুপম মধু ভরপুর, আমাদেরকেও সেই মধুতে স্নাত করো।
- হে অহোরাত্র! তোমরাও ‘অশ্বিনৌ’, তোমরাও মধুতে বিকশিত, সেই মধুর বিকাশ আমাদের মধ্যেও দাও। হে প্রাণাপান! তোমাদেরও অশ্বিসংজ্ঞা, তোমরাও মধুসিক্ত, আমাদেরও মধুময় করো।
- হে শল্যচিকিৎসক ও ঔষধি-চিকিৎসক বৈদ্যগণ! তোমরাও অশ্বিযুগল, তোমাদের নিকটেও মধু আছে, যে মধু দিয়ে তোমরা দুঃখীদের দুঃখ, রোগীদের রোগ ও পীড়িতদের পীড়া দূর করো—সেই মধু থেকে কিছু অংশ আমাদেরও প্রদান করো।
হে শুভ মধুর অধিপতিগণ! আমাদের এরূপ মধুময় করে দাও যেন আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে মধুর বাস হয়ে যায়। আমাদের আত্মায় মধু হোক, আমাদের মনে মধু হোক, আমাদের প্রাণে মধু হোক, আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহে বর্চস্বিতার মধু উৎপন্ন করো, যাতে আমরা পরস্পর সৌম্য বাক্যে কথা বলি।
শেষে পুনরায় প্রকৃতির প্রত্যেকটি কণার নিকট মধুর যাচনা করি। আমার উপর মধুবর্ষণ হোক, আমার রাষ্ট্রের উপর মধুবর্ষণ হোক, পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের উপর মধুবর্ষণ হোক, মানবমাত্র মধুতে স্নাত হয়ে যাক।
0 মন্তব্য(গুলি)
Author
সত্যান্বেষী