প্রশ্ন: শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা স্বাধ্যায় [৫] শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় 'ব্রহ্ম' সম্পর্কে কী বলা হয়েছে 
উত্তর: শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ‘ব্রহ্ম’ শব্দটি বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে , তবে তা
কোনো একক অর্থে নয় । বরং গীতায় ‘ব্রহ্ম’ একটি বহুমাত্রিক ধারণা যা বিভিন্ন
প্রসঙ্গে বিভিন্ন দার্শনিক গভীরতা ধারণ করে । প্রাচীন ও অধুনা ভাষ্যকারগণ
গীতার 'ব্রহ্ম' শব্দটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রসঙ্গভেদে । কোথাও এটি পরমাত্মা
, কোথাও শব্দব্রহ্ম বা বেদ , কোথাও মহৎ প্রকৃতি বা প্রকৃতির গর্ভরূপ ,
কোথাও যজ্ঞস্বরূপ কর্ম, আবার কোথাও 'ও৩ম্' একাক্ষর রূপে নিরাকার পরমাত্মার
নাম । এই বহুত্বময় গভীরতাই গীতার দার্শনিক পরিধিকে অসাধারণভাবে
সম্প্রসারিত করে ।



কবিং পুরাণমনুশাসিতারম্ অণোরণীয়ংস্মরণম্
সর্বস্য
ধাতারমচিন্ত্যরূপম্ আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ ॥ প্রয়াণকালে মনসাচলেন
ভক্ত্যা যুক্তো যোগবলেন চৈব । ভ্রুবোর্মধ্যে প্রাণমাবেশ্য সম্যক্ স তং
পরং পুরুষমুপৈতি দিব্যম্ ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৮.৯-১০
অনুবাদ:
যে মানুষ সর্বজ্ঞ , সনাতন , সকলের নিয়ন্তা , অনু থেকেও অতি সূক্ষ্ম ,
সকলের ধারণাকর্তা , অচিন্ত্যস্বরূপ , সূর্যের ন্যায় প্রকাশস্বরূপ ,
অজ্ঞানতার অতীত ব্রহ্মকে স্মরণ করে , সেই ভক্তিযুক্ত মানুষ প্রয়াণকালে
একাগ্র মনে এবং যোগবলের দ্বারা ভ্রূযুগলের মধ্যে প্রাণকে সম্পূর্ণরূপে
স্থাপন করে সেই দিব্য পরমপুরুষকেই প্রাপ্ত হয় ।


অক্ষরং ব্রহ্ম পরমং স্বভাবোধ্যাত্মমুচ্যতে ।ভূতভাবোদ্ভবকরো বিসর্গঃ কর্মসংজ্ঞিতঃ ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৮.৩
শ্রীভগবান্
বললেন- পরম অক্ষর 'ব্রহ্ম'। স্বভাব অর্থাৎ নিজ স্বরূপকে 'অধ্যাত্ম' বলা হয়
। বিশ্বব্যাপী প্রাণিসমূহের উৎপত্তির যে সৃষ্টিক্রিয়া , তাকে 'কর্ম' বলা
হয় ।
ব্রহ্মসূত্রে
(১।৩।১০) বলা হয়েছে-“অক্ষরমম্বরান্তধৃতেঃ॥” অর্থাৎ অক্ষর ব্রহ্মেরই নাম ।
কারণ , অম্বর নাম আকাশাদির ধারণ করা ব্রহ্মের দ্বারাই সম্ভব । এই
অক্ষরাধিকরণের বিষয়বাক্য গ্রহণ করে ভগবান্ বলছেন যে, "অক্ষরং ব্রহ্ম
পরমম্।” অধ্যাত্ম নাম স্বভাবের (স্বস্য ভাবঃ = স্বভাব) , নিজ ভাব অর্থাৎ
আত্মভাব । ছান্দোগ্য উপনিষদে (৮।৩।৪) আছে, “পরং জ্যোতিরুপসম্পদ্য স্বেন
রূপেণাভিনিষ্পদ্যত", অর্থাৎ সেই পরম জ্যোতিকে প্রাপ্ত হয়ে স্বরূপে স্থির হয়
। সুতরাং অধ্যাত্মের অর্থ এখানে জীবাত্মার স্বভাবের । ভূতভাবোদ্ভবকরঃ
বিসর্গঃ বাক্যের অন্তর্গত ভূত শব্দের অর্থ পঞ্চ মহাভূত বা প্রাণী উভয়ই
পারে; ভাব শব্দের অর্থ সত্তা কিংবা পদার্থ ; উদ্ভব শব্দের অর্থ উৎপত্তি বা
সম্যক বিকাশ এবং বিসর্গ শব্দের অর্থ বিসর্জন , ত্যাগ বা সৃষ্টি । এই
সৃষ্টিক্রিয়ার তাৎপর্য যজ্ঞ ; কর্ম শব্দের দ্বারা যজ্ঞই অভিহিত । কর্ম
শব্দের সাধারণ অর্থ গ্রহণ করলে চলবে না , এজন্য ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ এখানে
কর্ম শব্দের সংজ্ঞার্থ দিয়েছেন-“ভূতভাবোদ্ভবকরো বিসর্গঃ কর্মসংজ্ঞিতঃ ।”


যদক্ষরং বেদবিদো বদন্তি বিশন্তি যদ্ যতয়ো বীতরাগাঃ যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং চরন্তি তত্তে পদং সংগ্রহেণ
প্রবক্ষ্যে ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৮.১১
অনুবাদ:
বেদবিদগণ যাঁকে 'অক্ষর' বলেন , আনাসক্ত যত্নশীল মানুষগণ যাঁতে প্রবেশ করেন
, যাঁকে পাওয়ার জন্য ব্রহ্মচারিগণ ব্রহ্মচর্য পালন করেন, সেই পরমপদটি
তোমাকে সংক্ষেপে বলছি...
সূর্যের
ন্যায় প্রকাশস্বরূপ সনাতন ব্রহ্মকে স্মরণ করে একাগ্র মনে এবং যোগবলের
দ্বারা ভ্রূযুগলের মধ্যে প্রাণকে সম্পূর্ণরূপে স্থাপন করতে পারলে তিনি
মৃত্যুর পর ব্রহ্মকেই প্রাপ্ত করেন । ভ্রূযুগলের মধ্যস্থান মানসিক চেতনার
একটি ভূমি । প্রাণায়াম দ্বারা সেই ভূমিতে উঠে দেহত্যাগ করলে দিব্য পুরুষকে
প্রাপ্ত করা যায় । এবার ১১শ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই দিব্য পুরুষের
পরিচয় দিচ্ছেন-"বেদবিদগণ তাঁকে 'অক্ষর' বলেন ।" বৃহদারণ্যক উপনিষদে
(৩।৮।৯-১০) উক্ত বক্তব্যের প্রমাণ রয়েছে । নিরুক্ততে (১৩।১০) বলা
হয়েছে-"অক্ষর শব্দ 'ওম্' শব্দের বাচক ।" কঠ উপনিষদে (১।২ ১৫-১৬) বলা হয়েছে-
"যাঁকে পাওয়ার ইচ্ছায় সাধক ব্রহ্মচর্যের পালন করেন , সেই অক্ষরই ব্রহ্ম ,
সেটিই পরমপদ ।" মাণ্ডুক্য উপনিষদের ১ম শ্রুতিতে বলা হয়েছে-"এই সমস্ত জগৎ
'ওম'-এই অক্ষর-স্বরূপ ।" অর্থাৎ সেই দিব্য পুরুষ ব্রহ্মের মূল পরিচয়
একাক্ষর 'ওম' । আসক্তিহীন ধর্মজ্ঞ মানুষেরা সেই ব্রহ্মে প্রবেশ করেন ,
অর্থাৎ ব্রহ্মের ন্যায় আনন্দকে প্রাপ্ত করেন ।


সর্বদ্বারাণি সংযম্য মনো হৃদি নিরুধ্য চ ।
মূর্ধ্ন্যাধায়াত্মনঃ প্রাণমাস্থিতো যোগধারণাম্
ওমিত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম ব্যাহরন্মামনুস্মরন্ ।
যঃ প্রয়াতি ত্যজন্ দেহং স যাতি পরমাং গতিম্ ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৮.১২-১৩
অনুবাদ:
সকল ইন্দ্রিয়দ্বার সংযত করে , মনকে হৃদয়ে নিরুদ্ধ করে এবং নিজের প্রাণকে
ভ্রূযুগলের মধ্যদেশে ধারণ করে , যোগধারণে সম্পূর্ণরূপে স্থিত হয়ে , যে
ব্যক্তি 'ॐ'-এই একাক্ষররূপ ব্রহ্মকে উচ্চারণপূর্বক আমাকে স্মরণ করে
দেহত্যাগ করে প্রয়াণ করেন, তিনি পরমগতি প্রাপ্ত হন ।


কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্ ।
তস্মাৎ সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৩.১৫
অনুবাদ: কর্ম বেদ থেকে উদ্ভূত জানবে, বেদ অক্ষর থেকে সমুদ্ভূত; সেজন্য সর্বত্রস্থিত বেদ সর্বদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত ।
এই শ্লোকে প্রাচীন টীকাকারগণ প্রায় সকলেই 'ব্রহ্ম' অর্থ বেদ করেছেন ।


ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্ ।
ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্মসমাধিনা ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৪.২৪
অনুবাদ:
অর্পণ ব্রহ্ম, হবনীয় দ্রব্য ব্রহ্ম, ব্রহ্মের দ্বারা ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে
আহুতি প্রদান করা হয়েছে; সেই ব্রহ্মকর্মে সমাধি দ্বারা ব্রহ্মই গন্তব্য ।
এই শ্লোকে ব্রহ্মযজ্ঞের বর্ণনায় সমাধিবৃত্তির বর্ণনা করে ব্রহ্মকর্মে সমাধি যুক্ত যোগীর ব্রহ্মাকার বৃত্তির বর্ণনা করা হয়েছে ।


পূর্বাভ্যাসেন তেনৈব হ্রিয়তে হ্যবশোঽপি সঃ ।
জিজ্ঞাসুরপি যোগস্য শব্দব্রহ্মাতিবর্ততে ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৬.৪৪
অনুবাদ:
সে বাধ্য হয়ে সেই পূর্বজন্মের অভ্যাসবশতই পরমাত্মার প্রতিই আকৃষ্ট হন ।
কেননা , যোগের জিজ্ঞাসুও শব্দব্রহ্মকে অতিক্রম করেন ।
এই শ্লোকে ' শব্দব্রহ্ম ' অর্থ বেদ ।


আব্রহ্মভুবনাল্লোকাঃ পুনরাবর্তিনোঽর্জুন।
মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৮.১৬
অনুবাদ: হে অর্জুন ! ব্রহ্মভুবন থেকে সকল লোক পুনরাবর্তনশীল ; কিন্তু হে কৌন্তেয়! আমাকে প্রাপ্ত হলে পুনর্জন্ম হয় না ।
গীতাতে
'ব্রহ্ম' শব্দ কেবল পরমাত্মা বাচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি প্রকৃতি অর্থেও
উল্লেখ করা হয়েছে । (১৪.৩-৪) রামানুজাচার্য ভাষ্য । ১৬শ শ্লোকে ব্রহ্মভুবন
অর্থ ব্রহ্মের ভুবন বা ব্রহ্মলোক । বৈদান্তিক পরিভাষায় সমগ্র বিশ্বকে বলা
হয়েছে বলা হচ্ছে ' আব্রহ্মভুবনাৎ লোকাঃ' মূল প্রকৃতির কেন্দ্র থেকে শুরু
করে তৃণগুচ্ছ পর্যন্ত সমস্ত স্থান , ভুবনাঃ বলতে সমস্ত লোকই বুঝাচ্ছে । যে
পরিবেশের মধ্যে সকল বস্তু , জীবের অস্তিত্ব ও প্রাণধারণ , সেগুলোই ভুবনাঃ
রূপে খ্যাত ।


সর্বযোনিষু কৌন্তেয় মূর্তয়ঃ সম্ভবন্তি যাঃ।
তাসাং ব্রহ্ম মহদ্যোনিরহং বীজপ্রদঃ পিতা ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৪.৪
অনুবাদ: হে কৌন্তেয় (অর্জুন)! সকল যোনিতে যে শরীর উৎপন্ন হয়, এই প্রকৃতি তার উপাদানকারণ এবং আমি বীজ প্রদাতা পিতা ।
এই শ্লোকে 'ব্রহ্ম' প্রকৃতি অর্থে ।


পশ্যামি দেবাংস্তব দেব দেহে সর্বাংস্তথা ভূতবিশেষসঙ্ঘান্ । ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনস্থমৃষীংশ্চ সর্বানুরগাংশ্চ দিব্যান্ ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১১.১৫
অর্জুন
বললেন- হে দেব ! তোমার শরীরে সকল দেবগণকে , স্থাবর ও জঙ্গম ভূতসমূহকে এবং
কমল আসনে স্থিত ঈশ্বর ব্রহ্মা ও দিব্য ঋষিগণকে এবং উদরের ভরে গমনকারী সকল
সর্পকে দর্শন করছি ।
অর্জুন
সেই বিশ্বাত্মক শরীরে বেদ ও যোগবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ 'দেব' পদবাচ্য (বিদ্যাং
এব দেবঃ) সাধকগণকে , যে-সকল স্থির (স্থাবর) ও গতিশীল (জঙ্গম) পদার্থ রয়েছে
সেসকল বস্তুকে এবং এ সকল সাধক ও বস্তুর মধ্যে যিনি বেদাশয়ের জ্ঞানরূপ সাধন
দ্বারা পরাবিদ্যাকে ধারণপূর্বক পরমাত্মাকে অবগত হয়েছেন সেই ঈশ্বর ব্রহ্মা
কমল আসনে স্থিত এবং যে-সকল ঋষি বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা হয়েছিলেন সেই দিব্য
ঋষিগণকে দর্শন করলেন । এখানে মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝাতে
'দিব্য' এবং বেদ-বিদ্যায় বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব বুঝাতে 'ব্রহ্মা'
শব্দের পূর্বে 'ঈশ্বর' বিশেষণ যুক্ত করা হয়েছে । যখন কোনো ব্যক্তি
চতুর্বেদের জ্ঞাতা ও বক্তা হন , যজ্ঞের মুখ্য ও অথর্ববেদীয় ঋত্বিক হয়ে
যথাযথ নির্দেশ দান করেন , তখনই তাঁকে মুখ্যরূপে 'ব্রহ্মা' বলা হয় । মহর্ষি
যাস্কাচার্য নিরুক্ত শাস্ত্রে (১.৮) বলেছেন- " ব্রহ্মা সর্ব বিদ্যাসম্পন্ন ,
সবকিছু জানার যোগ্য , বেদ বা শ্রুত জ্ঞান দ্বারা সবার থেকে মহান ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় 'ব্রহ্মা' শব্দটি প্রধানত নিম্নোক্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে:

১. পরমাত্মা বা অক্ষর পুরুষ - যে অনাদি, অব্যয়, সর্বব্যাপী চেতনসত্তা ।
২. বেদ বা শব্দব্রহ্ম - ঋষিমনীষীদের শ্রুত জ্ঞান বা শাস্ত্ররূপ ব্রহ্ম পরমাত্মার জ্ঞান ।
৩. প্রকৃতি বা মহৎতত্ত্ব - সৃষ্টির উপাদান কারণ ।
৪. যজ্ঞ বা কর্ম - বৃহৎ সৃষ্টিপরিচালনার এক যজ্ঞতুল্য কার্য ।
৫. ও৩ম্ বা একাক্ষর ব্রহ্ম- পরমাত্মার শ্রেষ্ঠ নাম ।
৬. ব্রহ্মা (ব্যক্তি) – ব্রহ্মারূপ ঋত্বিক বা সর্ববিদ্যাবিশারদ দেবতা ।

বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক ।
0 মন্তব্য(গুলি)