https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা স্বাধ্যায় [৬]- গীতায় [৩।৩৫;১৮।৪৭] 'স্বধর্ম-পরধর্ম' বলতে কী বুঝানো হয়েছে ?

Sunday, July 20, 2025


‎প্রশ্ন: শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় [৩।৩৫;১৮।৪৭] অনুযায়ী 'স্বধর্ম-পরধর্ম' বলতে কী বুঝানো হয়েছে❓
✅ উত্তর: শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতে ধর্ম , নৈতিকতা , মনস্তত্ত্ব ও আধ্যাত্মবাদের এক বহুস্তর বিশ্লেষণ সূক্ষ্মভাবে মেলে ধরা হয়েছে । গীতার প্রতিটি শ্লোক এক একটি অস্তিত্বচেতনার দীপ্ত আলোকে আলোকিত , যা মানুষের আত্মস্বরূপ , তার কর্তব্যপথ এবং পরমার্থ অন্বেষণের পথে শ্রেষ্ঠ পথনির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে । গীতার অন্তর্গত দুটি শ্লোক [ ৩.৩৫ ও ১৮.৪৭ -'স্বধর্ম' ও 'পরধর্ম' প্রসঙ্গে ] এক গূঢ় নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বোধ জাগ্রত করে , যা বহু সময়ে অপব্যাখ্যার কবলে পড়ে বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে । অধুনা কালে ধর্মীয় পরিচয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ বিভক্ত সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষিতে এই শ্লোকগুলিকে উপযুক্তভাবে বুঝতে হলে আমাদের সেই সংকীর্ণ ব্যাখ্যা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে এর অন্তর্নিহিত বিশ্বজনীন তাৎপর্য উপলব্ধি করতে হবে এবং সেটিই এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য ।
🌼
‎শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বির্গুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাত্ ।
‎স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ॥
‎শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৩.৩৫
‎অনুবাদ: উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা গুণরহিত স্বধর্ম শ্রেষ্ঠ । স্বধর্মে মৃত্যু শ্রেয় , পরধর্ম ভয়াবহ ।
 
🌼
‎শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ ।
‎স্বভাবনিয়তং কর্ম কুর্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্ ॥
‎শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৮.৪৭
‎অনুবাদ: স্বধর্ম গুণহীন হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । স্বভাব-নির্দিষ্ট কর্ম করে মানুষ পাপ প্রাপ্ত হয় না ।
‎গীতার উক্ত দুটি শ্লোক নিয়ে নানা ব্যাখ্যা প্রচলিত ।
 
‎অনেকে মনে করেন , শ্রীকৃষ্ণ এখানে বলতে চেয়েছেন হিন্দু , মুসলমান , বৌদ্ধ , খ্রিষ্টান - যে যেই ধর্মে জন্মগ্রহণ করেছে , তার সেই ধর্মেই থাকা উচিত । নিজের ধর্ম কিছু দোষযুক্ত মনে হলেও [অন্য ধর্ম] গ্রহণ করা অনুচিত । আবার মহাভারতের এই শ্লোক দ্বারা ও দেখানোর প্রয়াস করে ।
 
🌼
‎ন জাতু কামান্ন ভয়ান্ন লোভাদ্ধর্মং জহ্যাজ্জীবিস্যাপি হেতোঃ ॥
‎[মহাভারত উদ্যোগ পর্ব ৪০.১২]
‎অর্থাৎ কামনা , ভয় , লোভ এমনকি প্রাণভয়েও কখনো ধর্ম ত্যাগ করবে না ।
 
‎কিন্তু এই ব্যাখ্যার ভিত্তিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে : তবে কি সনাতন ধর্মই দোষযুক্ত , আর অন্য ধর্মগুলো শ্রেষ্ঠ ? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ইতিহাস ও শাস্ত্রের দিকে । আমরা দেখি, মহাভারতের যুগে "হিন্দু", "মুসলমান", "বৌদ্ধ", কিংবা "খ্রিষ্টান" - এই নামে কোনো ধর্মের অস্তিত্ব ছিল না । প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্র , উপনিষদ বা মহাভারতের মতো ধর্মগ্রন্থে এসব শব্দের উল্লেখ নেই । গবেষকদের মতে সনাতন ধর্ম সর্বপ্রাচীন । বৈদিক শাস্ত্র ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে আমরা কেবল সনাতন ধর্মের উল্লেখ পাই । অর্থাৎ মহাভারতীয় যুগে বা তারও পূর্বে সমগ্র মানবজাতিই সনাতন ধর্মের আশ্রয়ে ছিল । অতঃ শ্রীকৃষ্ণ যখন ‘স্বধর্ম’ ও ‘পরধর্ম’- এর কথা বলেন, তিনি আধুনিক অর্থে কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায় বোঝাননি । বরং, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ব্যক্তির নিজস্ব স্বভাব , গুণ ও কর্তব্য অনুযায়ী জীবনধারণ ।
‎প্রথমতঃ ধর্ম কি সেটা জানা আবশ্যক । ধর্ম-'ধৃ' ধাতুর সঙ্গে 'মন্' প্রত্যয় যোগ করে 'ধর্ম' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে । 'ধৃ' ধাতু দ্বারা নির্মিত হওয়ায় ধর্ম শব্দের অর্থ 'ধারণ করা' ।
 
🔰 মহাভারতের শান্তিপর্বে বলা হয়েছে -
‎ধারণাদ্ ধর্মম্ ইত্যাহুর্ধর্মেণ বিধৃতাঃ প্রজাঃ।
‎যঃ স্যাদ্ ধারণসংযুক্তঃ স ধর্ম ইতি নিশ্চয়।।
‎মহাভারত শান্তিপর্ব ১০৬.১৫
‎অনুবাদঃ ধারণ ক্রিয়া থেকে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি । ধর্ম সৃষ্টিকে বিশেষভাবে ধারণ করে আছে । সংক্ষেপে যা কিছুই ধারণ শক্তি সম্পন্ন তাই ধর্ম ।
 
▶️ ধর্মের স্বরূপ
‎ব্যাকরণের পরিভাষায় “ধৃঞ্-ধারণে” ধাতুর দ্বারা “অর্তিস্তু সুহুস্টধৃ" [উনাদি ১।১৪০] সূত্র হতে প্রাপ্ত 'মন্' প্রত্যয় যোগে ধর্ম শব্দ সিদ্ধ হয়। “ধারণাৎ ধর্মম্ ইত্যাহুঃ" “ধ্রিয়তে অনেন লোকঃ" আদি বুৎপত্তি অনুসারে, 'যা আত্মোন্নতি এবং উত্তম সুখের জন্য ধারণ করা হয়' অথবা যার দ্বারা লোকসকল ধারণ করে অর্থাৎ ব্যবস্থা বা মর্যাদায় স্থিত করা হয় , তাকেই ধর্ম বলে । এই প্রকারে আত্মার উন্নতি করে এমন, মোক্ষ বা উত্তম ব্যবহারিক সুখ প্রদানকারী সদাচরণ, কর্তব্য অথবা শ্রেষ্ঠ নিয়ম-কানুন বিধানই ধর্ম । 
 
‎মনে রাখতে হবে যে , ধর্ম শব্দটি আজকালকার রিলিজিওন (religion) অপেক্ষা ব্যাপক । জগতের প্রত্যেক বস্তু তার নিজ নিয়মে , তার স্বভাব-নিয়মে চলে , যা তার স্বধর্ম । আগুনের স্বভাব উত্তাপ বিকিরণ করা , সেটিই তার স্বধর্ম । মহাকর্ষ বলের প্রভাবে মহাকাশে সকল গ্রহ-নক্ষত্র নিজ অক্ষে পরিভ্রমণ করছে , সেটিই তার স্বধর্ম এবং এই নিয়ম শাশ্বত সত্য । ধর্মশাস্ত্রে এবং নীতিশাস্ত্রে সমাজ-জীবনের প্রেক্ষিতে 'ধর্ম' শব্দটির অর্থ করা হয়েছে , রিলিজিওন অর্থে শব্দটিকে গ্রহণ করা হয়নি । রিলিজিওন হলো কোনো এক অদৃশ্য শক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে , সেই ভয়ে তার উপাসনা করা , অথবা 'এটা করলে ওটা পাবা'- এরূপ লোভের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে সেই অদৃশ্য শক্তির উপাসনা । কিন্তু কোনো ছলনা , লালসা , কিংবা কিছু নীতিকথার সমষ্টি কখনোই শাশ্বত ধর্ম নয় । ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্রে 'ধর্ম' শব্দটির অর্থ হলো, শাস্ত্রসম্মত সামাজিক আচরণবিধি যা প্রত্যেক মানুষের তার 'বর্ণ' ও 'আশ্রম' অনুসারে অনুসরণীয় । সমাজে বসবাস করে নিজের এবং অপরের কল্যাণের জন্য মানুষকে যেসব আচরণবিধি অনুসরণ করতে হয় , সেটিই তার ধর্ম । ব্যক্তি ও সমাজ তথা বিশ্ববাসীর কল্যাণের জন্য কর্মসাধনই মানুষের ধর্ম । সৎকর্মই ধর্ম । স্বভাবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কর্মই ধর্ম । প্রকৃতপক্ষে , ভারতীয় ধ্যান-ধারণা অনুসারে ধর্ম ও নীতি বিশ্লিষ্টভাবে নেই , তা কখনো হয়েছে ধর্মভিত্তিক নীতি , আবার কখনো হয়েছে নীতিভিত্তিক ধর্ম । মহাভারতে (শান্তিপর্ব: ১০৯।১১) ভীষ্ম বলেছেন- "যা দ্বারা প্রজাগণ অভ্যুদয়শালী , দুঃখবিহীন ও পরিত্রাণ প্রাপ্ত হয় , সেটিই যথার্থ ধর্ম ।" সনাতন ধর্ম ।
 
▶️ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে -
✅ত্বমক্ষরং পরমং বেদিতব্যং ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্ ত্বমব্যয়ঃ শাশ্বতধর্মগোপ্তা সনাতনস্ত্বং পুরুষো মতো মে ॥
‎শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১১.১৮
‎অনুবাদঃ তুমি পরম অক্ষর , একমাত্র জ্ঞাতব্য ; তুমি বিশ্বের পরম আশ্রয় ; তুমি অব্যয় , শাশ্বত ধর্মের রক্ষক এবং সনাতন পুরুষ , এই আমার অভিমত ।
 
‎বিবিধ ভাষ্যকার এখানে ' শাশ্বতধর্মগোপ্তা ' = সনাতন ধর্মের রক্ষক অর্থ করেছেন । তাদের এই অর্থ অসঙ্গত বলা যায় না । মহর্ষি শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতীকৃত ভাষ্যে ঋগ্বেদে ১.১২৪.২ (শশ্বতীনাম্) সনাতনীনামুষসাং প্রকৃতীনাং বা , ১.১৩৫.৭ (শশ্বতঃ) সনাতনবিদ্যায়ুক্তান্, ১.১৩৯.৮ (সনা) সনাতনানি, সামবেদ ১৮২০ (সানসিং রয়িম্) সনাতন ইত্যাদি সহ পুরাণ , সনাৎ , পূর্ব্যম্, সনা সমধর্মী পদ দ্বারা ৩০০এরও অধিকস্থলে সনাতন অর্থ পাওয়া যায় ।
 
✅সর্ব্বেহপ্যেতে যজ্ঞবিদো যজ্ঞক্ষয়িতকল্মষাঃ ।
‎যজ্ঞশিষ্টামৃতভুজো যান্তি ব্রহ্ম সনাতনম্ ॥
‎শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৪.৩০
‎অনুবাদঃ এই যজ্ঞবিদ্‌গণ সকলেই যজ্ঞদ্বারা নিস্পাপ হয়ে থাকেন ; যাঁহারা অমৃত-স্বরূপ যজ্ঞাবশিষ্ট অন্ন ভোজন করেন, তাঁহারা সনাতন ব্রহ্মপদ লাভ করেন ।
 
‎স্বধর্ম মূলত কী❓
▶️ স্বধর্ম শব্দটি গঠিত হয়েছে দুটি অংশে:
‎১। "স্ব" + "ধর্ম" = স্বধর্ম । "স্ব" (সংস্কৃত: स्व) উপসর্গ , যার অর্থ: স্বীয় , নিজের, নিজস্ব , নিজ সত্তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ।
‎২। "ধর্ম" শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ধাতু "ধৃ" (ধৃ = ধারণ করা, স্থাপন করা , পালন করা) থেকে । ধর্ম শব্দে "মন্" প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে ।
 
‎অতঃ স্বধর্ম শব্দের অর্থ দাঁড়ায় নিজের দ্বারা ধারণযোগ্য ধর্ম , নিজস্ব প্রকৃতি অনুসারে যা ধারণ করা উচিত সেই আচরণবিধি অথবা নিজের স্বভাব-নির্ধারিত কর্তব্যপথ । স্বধর্ম বলতে সেই ধর্ম বা কর্তব্যপথকে বোঝায় , যা ব্যক্তি তার নিজস্ব স্বভাব , গুণ ও প্রকৃতির অনুসারে পালন করে থাকে এবং যা আত্মার বিকাশ ও সমাজের কল্যাণে সহায়ক হয় । অর্থাৎ , প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই জন্মগতভাবে কিছু গুণ ও প্রবৃত্তি থাকে। সেই গুণ অনুযায়ী তার কর্ম ও আচরণপন্থা নির্ধারিত হয় । এই নিজস্ব গুণধর্ম ও কর্মবিধিই হলো তার স্বধর্ম ।
‎জন্ম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জন্মজন্মান্তর ধরে মানুষ দিব্য জীবনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে , আত্মার বিকাশ করছে । মানুষের এই যে ক্রমবিকাশ এটি প্রত্যেকের নিজ নিজ স্বভাব অনুসারেই হয় । যার যেমন স্বভাব সে সেভাবেই অগ্রসর হবে । পর্যায়ক্রমে সেই স্বভাব পরিবর্তিত হয় । কিন্তু স্বভাব অনুসারে কর্ম করতে গিয়ে সেই কর্ম থেকে পিছপা হওয়া কখনোই উচিত নয় । এই স্বভাব প্রকৃতির গুণত্রয়ের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় । সত্ত্ব,রজঃ ও তমঃ-এই তিনটি প্রকৃতির গুণ । মানুষের স্বভাব এই তিন গুণের সমন্বয়ে গঠিত । কিন্তু কোনো মানুষের মধ্যেই উক্ত গুণসমূহ সমানভাবে থাকে না , কোনো গুণের আধিক্য থাকে । এই গুণবৈষম্য অনুসারে মানুষের স্বভাবকে চার ভাগে বিভক্ত করা হয় । যে স্বভাব সত্ত্বপ্রধান তার নাম ব্রাহ্মণ , সত্ত্বমিশ্রিত রজঃপ্রধান স্বভাবের নাম ক্ষত্রিয় , তমোমিশ্রিত রজঃপ্রধান স্বভাবের নাম বৈশ্য এবং রজোমিশ্রিত তমঃপ্রধান স্বভাবের নাম শূদ্র । কোনো বিশেষ স্বভাববিশিষ্ট সমস্ত মানুষকে বর্ণ বলে ।
 
💥 যেমন: ব্রাহ্মণ-স্বভাববিশিষ্ট সমস্ত মানুষ ব্রাহ্মণ বর্ণ, ক্ষত্রিয়-স্বভাববিশিষ্ট সমস্ত মানুষ ক্ষত্রিয় বর্ণ, বৈশ্য-স্বভাববিশিষ্ট মানুষ বৈশ্য বর্ণ এবং শূদ্র-স্বভাববিশিষ্ট শূদ্র বর্ণ বলে অভিহিত হয় । মানুষের কর্মও তার স্বভাব অনুসারেই নির্দিষ্ট হয়ে থাকে । কর্ম স্বভাবের অনুকূল হলেই তা ব্যক্তি ও সমাজের হিতকর হয় । যে কর্ম যার প্রকৃতি থেকে স্বভাবত উৎসারিত হয় , সেটিই তার স্বধর্ম ।
 
‎পরধর্ম কী ❓
‎পরধর্ম বলতে বোঝায় অন্য কারো ধর্ম, যা নিজের প্রকৃতি অনুসারে নয়, যে কর্ম বা আদর্শ বাহ্যিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে অথচ তা অন্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় । পরধর্ম হলো এমন এক ধর্ম বা কর্তব্যপথ , যা ব্যক্তির নিজস্ব স্বভাব , গুণ বা প্রকৃতি অনুসারে নির্ধারিত নয় , বরং বাহ্যিক অনুকরণ বা চাপের ফলে গৃহীত । এই ধর্ম আত্মিক বিকাশের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে । যা আমাদের নিজস্ব নয় , যা অন্তর থেকে আসে না , বরং বাহির থেকে আরোপিত হয় তা কখনোই কল্যাণকর হতে পারে না । পরধর্ম সেই পথ , যা কারও গুণ বা স্বভাবের সঙ্গে না মিলিয়ে কেবল বাহ্যিকভাবে অনুসরণ করা হয় । এ যেন এক আত্মবিরোধী জীবনযাপন , যেখানে মানুষের আত্মিক সম্ভাবনা স্তব্ধ হয়ে যায় ।
 
🔰গীতা এই সত্যকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছে-
‎'পরধর্মো ভয়াবহঃ'
‎অর্থাৎ , অন্যের ধর্ম ভয়ংকর ।
‎এই ভয়াবহতার কারণ হল , পরধর্ম মানুষের স্বাভাবিক বিকাশধারাকে রুদ্ধ করে , তাকে নিজস্ব সত্য থেকে বিচ্যুত করে । এর ফলে ব্যক্তি তার প্রকৃত লক্ষ্য , অর্থাৎ আত্মসিদ্ধির পথ থেকে বিপথগামী হয় । আমরা যখন নিজের অন্তর্জাত গুণ-প্রবৃত্তিকে উপেক্ষা করে কেবল বাহ্যিক কৃতিত্ব বা সামাজিক চাহিদার অনুকরণে জীবনযাপন করি , তখন আমরা আসলে পরধর্মের আশ্রয়ে থাকি । এই জীবন পরাধীন , অনিরাপদ এবং আত্মহীন ।
 
🍁 গীতাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যখন বলেন -
‎“স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ”
 
‎তিনি বোঝাতে চান , নিজের ধর্ম পালন করতে গিয়ে যদি মৃত্যুও আসে , তবু তাতে আত্মার বিকাশ থেমে যায় না । কিন্তু অন্যের ধর্ম অবলম্বন করলে সেটি বাহ্যিকভাবে যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন তা আত্মার বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে , এবং সেইজন্যই তা ভয়ংকর । অর্জুনের ক্ষেত্রেও এই সংকট ছিল । তিনি নিজের ক্ষত্রিয়ধর্ম ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু সেই পথ ছিল পরধর্ম , কারণ তা ছিল না তাঁর প্রকৃতি অনুসারে । তাই শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে স্বধর্মেই প্রতিষ্ঠিত থাকতে উপদেশ দেন ।
‎অন্যের ধর্ম অনুসরণ করা সব সময়েই বিপজ্জনক । কারণ , তা মানুষের স্বাভাবিক বিকাশকে বিপর্যস্ত করে, তা ভিতর থেকে আসে না , বাহির থেকে কৃত্রিমভাবে চাপিয়ে দেয়া হয় এবং সেই চাপে মানুষ তার প্রকৃত অধ্যাত্ম-সিদ্ধির দিকে অগ্রসর হতে পারে না । স্বধর্ম পালন করতে গিয়ে যদি জীবনে অকৃতকার্য হতে হয় এমনকি মৃত্যুকেও বরণ করতে হয় , তাহলে সেটিও শ্রেয় । কারণ , স্বধর্ম পালনের দ্বারা আমাদের আধ্যাত্মিক বিকাশ বিপর্যস্ত হয় না । সকল সফলতা-বিফলতা , জন্ম-মৃত্যুর ভিতর দিয়ে মানুষ অমৃতত্বের দিকে চলছে , কিন্তু নিজের প্রকৃতির অনুসরণ না করলে সে এই কল্যাণমার্গ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়ে । আমাদের অন্তরের যা সত্য সেই অনুসারেই আমাদেরকে কর্ম করতে হবে । কোনো বাহ্যিক বা কৃত্রিম আদর্শের সঙ্গে আপস করলে চলবে না । আমাদের কর্ম যেন হয় আমাদের আত্মার এবং তার অন্তর্নিহিত শক্তির জীবন্ত ও যথার্থ প্রকাশ । কিন্তু অর্জুন নিজ প্রকৃতির অনুসরণ না করে , অর্থাৎ ক্ষত্রিয়ধর্ম পরিত্যাগ করে সন্ন্যাস আশ্রম অবলম্বন করে কর্ম ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন । তাই ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ উক্ত শ্লোকের অবতারণা করে বললেন, 'পরধর্ম ভয়াবহ'।
 
🌸 অতঃ গীতার 'স্বধর্ম' দর্শন আমাদের শেখায় আত্মার স্বরূপে স্থিত থাকার অপরিহার্যতা । এটি কোনো গোষ্ঠী , জাতি বা সম্প্রদায়ভিত্তিক ধর্মের প্রশস্তি নয় , বরং প্রত্যেক জীবের নিজস্ব প্রকৃতি , গুণ এবং তার অন্তর্নিহিত কর্মপথের শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরা । মানুষ যখন নিজের অন্তর্জাত প্রবৃত্তি , স্বভাব ও স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করে বাহ্যিক অনুকরণে জীবনের পথ নির্বাচন করে, তখন সে আত্মবিরোধী এক যন্ত্রণার দিকে ধাবিত হয় । স্বধর্মে মৃত্যুও যদি আসে , তবে তা ভয়ের নয় , কারণ সেই পথেই মুক্তি নিহিত ; কিন্তু পরধর্মের বহিরঙ্গ শোভা আধ্যাত্মিক বিকাশকে নষ্ট করে , বিভ্রান্ত করে আত্মার অগ্রযাত্রা । এই শ্লোকদ্বয়ের অন্তর্নিহিত বাণী তাই চিরন্তন "নিজস্ব স্বভাব ও কর্তব্যপথই শ্রেয় , অন্যের আদর্শের অনুকরণ ভয়াবহ । সত্য , স্বভাব ও ধর্ম - এই তিনের সম্মিলনে মানবজীবন পূর্ণতা পায় । 
 
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক