বেদে বামন অবতার আছে কি ? সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ
বেদে অবতারবাদ নেই এটি সর্বজনবিদিত। সর্বব্যাপক, সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর কখনোই নিজের শক্তিমত্তা ও স্বরূপ বিকৃত করে সীমাবদ্ধ দেহে অবতার গ্রহণ করেন না। এতে যেমন তার বৈশিষ্ট্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় একইভাবে তার দণ্ড ব্যবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যে পরমাত্মা সর্বজীবকে তার কর্মফল প্রদান করছেন বিশেষ সময়ে তার দেহধারণ যেভাবে সকল জীবের প্রতি তার সমদৃষ্টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, একইভাবে ভক্তগণের বিপদে যখন বাস্তবিকভাবে কোনো অবতারকে আসতে দেখা যায় না তখন আস্তিক্যবুদ্ধিরও দুর্বলতা দেখা দেয়। অবতারের উপর নির্ভরশীলতা যেভাবে ভক্তকে অকর্মণ্য, ভাগ্যবাদী ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে সেভাবেই অবিদ্যার বিস্তার ঘটায়। তারপরেও বেদের নানা মন্ত্র, ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থের রূপক আখ্যানকে বিকৃত করে সাম্প্রদায়িক বেদভাষ্য ও পুরাণাদিতে অবতারবাদের দৃষ্টান্ত দেখানোর প্রচেষ্টা বহুকাল ধরেই চলে আসছে। যদিও ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থের ব্যাখ্যা ও ক্রম পুরাণাদিতে অনুসৃত হয়নি তারপরেও সম্প্রদায়বিশেষ প্রমাণ হিসেবে এগুলোকে উত্থাপন করেন। আজ আমরা বামন অবতার বিষয়ে সামগ্রিক পর্যালোচনা করব।
ইদং বিষ্ণুর্বি চক্রমে ত্রেধা নি দধে পদম্ ।
সমূল়্হমস্য পাংসুরে ॥
ঋগ্বেদ ১।২২।৭, সামবেদ ২২২(-'লে' পাঠভেদ), সামবেদ ১৬৬৯, যজুর্বেদ ৫।১৫, অথর্ববেদ ৭।২৬।৪
আমরা এই মন্ত্রটির ভাষ্যকারগণের ব্যাখ্যা দেখার আগে মহর্ষি যাস্ক নিরুক্তে কী ব্যাখ্যা করেছেন তা দেখব,
বিষ্ণুর্বিশতের্বা ব্যশ্নোতের্বা যদিদং কিঞ্চ তদ্বিক্রমতে বিষ্ণুস্ত্রিধা নিধত্তে পদং ত্রেধাভাবায় পৃথিব্যামন্তরিক্ষে দিবীতি শাকপূণিঃ সমারোহণে বিষ্ণুপদে গয়শিরসীত্যৌর্ণবাভঃ সমূল়্হমস্য পাংসুরে প্যায়নেঽন্তরিক্ষে পদং ন দৃশ্যতেঽপি বোপমার্থে স্যাৎ পাংসুর ইব পদং ন দৃশ্যত ইতি পাংসবঃ পাদৈঃ সূয়ন্ত ইতি বা পন্নাঃ শেরত ইতি বা পংসনীয়া ভবন্তীতি বা।নিরুক্ত ১২।১৮-১৯
অর্থাৎ, বিষ্ণু এই (জগতের) উপর তার পা রাখেন। তিনি তিন প্রকারে পা রাখেন। ধূলিসমৃদ্ধ (অন্তরিক্ষে) যে পা রয়েছে তা লুকানো (১/২২/১৭) যা কিছু যেখানে আছে তার উপর বিষ্ণু তার পা রাখেন (অর্থাৎ সকল কিছুর অধিষ্ঠাতা), তিন প্রকারে পা রাখেন। তিন প্রকার হওয়ার দরুণ পৃথিবীতে (অগ্নিরূপে) অন্তরীক্ষে (বিদ্যুৎ রূপে) এবং দ্যৌ-এ (সূর্যরূপে) যেটা শাকপূণি মান্য করেন। আরোহণে (এক পদ), মধ্যাকাশে (দ্বিতীয় পদ) এবং অস্তাচলের [গয়ঃ, অস্তম্, গৃহন্নাম - নিঘ০ ৩।৪] রেখায় তৃতীয় পদ (এই তিন পদ) ঔর্ণবাভ মান্য করেন।
আধ্যাত্মিক ও আধিভৌতিক অনুবাদ দ্রষ্টব্য- পণ্ডিত ভগবৎ দত্ত, স্বামী ব্রহ্মমুনি পরিব্রাজক বিদ্যামার্তণ্ড, পণ্ডিত চন্দ্রমণি বিদ্যালংকার।
বিষ্ণু রশ্মিভির্বিশেষেণ ব্যাপ্তঃ । যদিদং কিঞ্চ সর্বং জগৎ তদ্ বিষ্ণুর্বিক্রমতে বিজয়তে স্বাধীনং করোতি, অতস্ত্রিধা পদং নিধন্তে ত্রিধা ভাবায় পৃথিব্যামন্তরিক্ষে দিবি পদং স্বরূপং নিধত্তে নিয়তং করোতি-ইতি শাকপূণির্মন্যতে । ঔর্ণবাভংমতে সমারোহণে বিষ্ণুপদে গয়শিরসি । সমারোহণে পূর্বাহ্ণে কালে পূর্বস্যাং দিশি মধ্যাহ্ণে বিষ্ণুপদে যদা বিষ্ণুসংজ্ঞাং লভতে মধ্যাকাশে গয়শিরসি-উত্তরাহ্ণে পশ্চিমায়াং দিশি। গয়েঽস্তে গৃহে শিরো যস্মিন্ কালে দেশে বা স কালো দেশো বা 'গয়শিরাঃ' তস্মিন্ গয়শিরসি-উত্তরাহ্ণে পশ্চিমায়াং দিশি । অস্য পাংসুরে প্যায়নে বিস্তৃতেঽন্তরিক্ষে যৎ পদং তৎ সমূঢং সম্মূঢমর্থাৎ-ন দৃশ্যতে যদ্বা পাংসুলে-ইব পদং ন দৃশ্যতে যথা পাংসুলে ধূলিরাশৌ ক্ষিপ্তং পদং ন্যস্তমুৎক্ষেপণে চিহ্নং ন দৃশ্যতে । এবং মন্ত্রদৃষ্টয়া যাস্কদৃষ্টয়া চ ত্রীণি স্থানান্যত্র 'পৃথিবী, অন্তরিক্ষম্, দ্যুলোকঃ' সন্তি তেষাং পৃথিব্যাং ত্বগ্নিরূপেণ, দিবি কিলাদিত্যরূপেণ, অন্তরিক্ষে তু গুপ্তবিদ্যুদ্ভাবেন বর্ততে ন দৃশ্যতে । এবমত্র বিষ্ণোঃ স্বরূপমুক্তম্ । পূর্বাহ্ণাদারম্যোত্তরাহ্নপর্যন্তমাদিত্যস্য বিষ্ণুর্নাম । ত্রিষু লোকেষু হি কালেষু চ প্রবর্তমানো বিষ্ণুর্ভবতি ।
উল্লেখ্য, এই অংশে অমরেশ্বর ঠাকুর, লক্ষ্মণ স্বরূপের অনুবাদ একই রকম। স্কন্দস্বামী ও দুর্গাচার্যেও মূলপাঠে বিশেষ পার্থক্য দেখা যায় না।
উক্ত মন্ত্রটির কালানুক্রমিক ভাষ্যগুলো যদি আমরা দেখি,
১। স্কন্দস্বামী: 'বিষ্ণুশ্চ ভগবান্ বাসুদেবঃ বলি বন্ধনকালে বিক্রান্তবান্', 'বিষ্ণুস্তু ভগবানস্মদ্ভর্ত্তা বাসুদেবঃ । স চ বামনচ্ছদ্মনা মহাবলিং ববন্ধ' অর্থাৎ বিষ্ণু তথা ভগবান বাসুদেব বলি বন্ধনকালে যে বিচরণ করেছিলেন ইত্যাদি এবং তারপরে পূর্বোক্ত নিরুক্ত ব্যাখ্যা।
২। মুদ্গল: পাংসুরে = ধূলিযুক্তে পাদস্থানে। যদিও তার ভাষ্যে অবতারবাদের উল্লেখ নেই তবুও এই পদের অর্থে স্পষ্ট হয় না।
৩। বেঙ্কটমাধব: যদিও বেঙ্কটমাধব যাস্কীয় ব্যাখ্যাই যথারীতি উল্লেখ করেছেন তবুও সর্বানুক্রমণিকা ৮।৮ অনুযায়ী তাকে পৌরাণিক সাম্প্রদায়িক মতযুক্তই প্রতীত হয়।
৪। সায়ণ: 'বিষ্ণুঃ ত্রিবিক্রমাবতারধারী' অর্থাৎ বিষ্ণু তথা ত্রিবিক্রম অবতার যিনি ধারণ করেছেন ইত্যাদি এবং তারপরে পূর্বোক্ত নিরুক্ত ব্যাখ্যা।
৫। মহীধর: 'ত্রিবিক্রমাবতারং কৃত্বা' ইত্যাদি। মহীধর বামনাবতার-সূচক অর্থ করে তারপর দ্বিতীয় বৈকল্পিক অর্থ প্রদান করেছে। আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হলো দ্বিতীয় অর্থ অদ্বৈতবাদ প্রতিপাদক। অর্থাৎ তার উভয় ব্যাখ্যাই যাস্কের বিপরীত।
স্কন্দস্বামী থেকে শুরু করে মহীধর পর্যন্ত সকলেই যাস্কীয় ব্যাখ্যা থাকার পরেও সম্প্রদায়ের অনুরোধে সম্পূর্ণ বহিরাগত একটি কাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন নিজেদের ব্যাখ্যায়। বেদে তো 'বামন'-এর উল্লেখ মাত্র নেই। 'বলিম্' বা 'বলিনঃ' পদ যথাক্রমে ঋ০ ১।৭০।৫ ও ১০।৮৫।২ ইত্যাদি স্থানে উপহার, হবি, পূজা প্রভৃতি। ব্যক্তিবাচক 'বলি' শব্দের উল্লেখ বেদে, ব্রাহ্মণে কোথাও নেই। প্রমোদজনক বিষয়, পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী বলেন,
'বিষ্ণুস্ত্রিবিক্রমাবতারধারী...... সর্বং জগৎ সম্যগন্তর্ভূতম্' ইতি পুরাণসম্মতং সায়ণীয়ব্যাখ্যানং চ বৈদিকানাং নাদরণীয়ম্, যাস্কানুক্তেঃ অবতারশব্দস্যাপি বেদেঽদর্শনাচ্চ ।[নিরুক্তালোচন, দৈবতকাণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৬]অর্থাৎ, উক্ত ঋগ্বেদীয় শ্রুতির পুরাণসম্মত সায়ণীয় ব্যাখ্যা বৈদিকদের আদরণীয় নয়। কেননা যাস্ক তা উল্লেখ করেননি এবং বেদে অবতার শব্দটিও কোথাও দেখা যায় না।
উপরের আলোচনায় ২টি বিষয় স্পষ্ট। তা হলো-
১। বেদে বামনাবতারের কোনো উল্লেখ নেই। নিরুক্তে আধিদৈবিক অর্থাৎ প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা আছে।
২। পরবর্তীকালীন ভাষ্যকারগণ নৈরুক্তিক ব্যাখ্যা উল্লেখ করেও তারপর পৌরাণিক ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন।
এবার, আমরা 'ত্রেধা', 'বিক্রমণ' ও 'বিষ্ণু' পদ নিয়ে আলোচনা করব।

৩টি ধাতুতে বিষ্ণু শব্দ সিদ্ধ হয়। যথা-
(১) বিষ্লৃৃ ব্যাপ্তৌ
(২) বিশ প্রবেশনে
(৩) বি পূর্বক অশু ব্যাপ্তৌ সংঘাতে চ।
অর্থাৎ যিনি সর্বত্র ব্যাপ্ত কিংবা যার প্রবেশ সর্বত্র তাকেই 'বিষ্ণু' বলা হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণে এর মুখ্য তাৎপর্য 'পরমাত্মা', সূর্য ও যজ্ঞাদি গৌণরূপে আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক তাৎপর্য বহন করে। একইভাবে যদিও সূর্য পৃথিবী থেকে প্রায় ১৩ লক্ষ গুণ বড় কিন্তু এর আলো এবং উষ্ণতার মাধ্যমে সর্বত্র পৌঁছে যায় এইজন্য সূর্যকেও বিষ্ণু বলা হয়েছে। 'অথ যদ্বিষিতো ভবতি তদ্বিষ্ণুর্ভবতি, বিষ্ণুর্বিশতো ব্যশ্নোতোেবা' [নিরু০ ১২।১৮] অর্থাৎ, সূর্য তীব্র রশ্মির মাধ্যমে দৃশ্যমান সকল বস্তুতে প্রবিষ্ট হয়, রশ্মির মাধ্যমে সর্বপদার্থ ব্যাপ্ত করেন। আবার বিষ্ণু পদ দ্বারা ব্রাহ্মণ গ্রন্থে যজ্ঞকেও বোঝানো হয়েছে কেননা যজ্ঞ তার প্রভাবের মাধ্যমে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

যজুর্বেদ ২।২৫ অনুযায়ী,
দিবি বিষ্ণুর্ব্যক্রংস্ত... বয়ন্দ্বিষ্মোন্তরিক্ষে বিষ্ণুর্ব্যক্রংস্ত... পৃথিব্যাঁ বিষ্ণুর্ব্যক্রংস্ত... সঞ্জ্যোতিষাভূম ॥
অর্থাৎ বিষ্ণুর ত্রেধা স্থান দ্যুলোক, অন্তরিক্ষ ও পৃথিবীলোক।
ঋগ্বেদ ১০।৮৮।১০ মন্ত্রের ব্যাখ্যায় নিরুক্তকার যাস্ক শাকপূণির মত প্রদর্শন করে [৭।২৮] পূর্বোক্ত ত্রিবিধ স্থানে অগ্নির ৩ বিভাগ উল্লেখ করেছেন।
প্রসিদ্ধ নদীসূক্ত তথা ঋগ্বেদ ১০।৭৫।১-এ 'ত্রেধা' অর্থও পূর্বের মতো করা হয়েছে। তাই আলোচ্য মন্ত্রে সায়ণীয় অবতারত্বসমর্থনীয় ব্যাখ্যা অসঙ্গত ও বেদের আভ্যন্তরীণ প্রমাণ বিরুদ্ধ।

বিষ্ণুর ব্যাপকতা (বিক্রমণ) জন্য 'ক্রমু' ধাতু ব্যবহার করা হয়েছে, পাণিনীয় ধাতুপাঠ অনুযায়ী যার অর্থ 'পাদ বিক্ষেপে' অর্থাৎ পদস্থাপন৷ 'বৈ পাদ বিহরণে' [অষ্টা০ ১।৩।৪১] অনুযায়ীও পাদ বিক্ষেপ অর্থে 'বি' পূর্বক 'ক্রম' ধাতু থেকে আত্মনেপদ হয়। এজন্য এই প্রয়োগ বেদে বেশি দেখা যায়।
সম্ভবত এই কারণেই এমন ভুল ধারণা জন্মেছে যে, এই বর্ণনা কোনো পদযুক্ত (পায়ে চলার ক্ষমতাসম্পন্ন) সত্তারই কারণ যার পা-ই নেই, তার ক্ষেত্রে 'ক্রম' ধাতুর প্রয়োগই বা কীভাবে হতে পারে? কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত। কারণ, পাণিনির দ্বিতীয় সূত্রই হচ্ছে "বৃত্তিসর্গতায়নেষু ক্রমঃ" [অষ্টাধ্যায়ী ১।৩।৩৮]; যার অর্থ, 'অনিরোধ, উৎসাহ এবং বিস্তার' অর্থেও 'ক্রম' ধাতু থেকে আত্মনেপদ হয়। এই সূত্রে কাশিকাকার ব্যাখ্যা করেছেন, 'বৃত্তিরপ্রতিবন্ধঃ। সর্গ উৎসাহঃ। তায়নং স্ফীততা। বৃত্তৌ তাবৎ — ঋক্ষ্বস্য ক্রমতে বুদ্ধিঃ। ন প্রতিহন্যত ইত্যর্থঃ। যজুঃষ্বস্য ক্রমতে বুদ্ধিঃ। সর্গে — ব্যাকরণাধ্যয়নায় ক্রমতে। উৎসহত ইত্যর্থঃ। তায়নে — অস্মিন্ শাস্ত্রাণি ক্রমন্তে। স্ফীতীভবন্তীত্যর্থঃ'॥
পুনরায়, পাণিনির আর এক সূত্র “আঙ্ উদ্গমনে” [অষ্টাধ্যায়ী ১।৩।৪০], অর্থাৎ, ‘উদ্গমন’ অর্থে 'আঙ্' উপসর্গযুক্ত 'ক্রম' ধাতু আত্মনেপদ হয়। এ বিষয়ে কাশিকাবৃত্তি বলেছে, 'আঙ্পূর্বাৎ ক্রমতেরুদ্গমনে বর্তমানাদাত্মনেপদং ভবতি। আক্রমতে আদিত্যঃ। আক্রমতে চন্দ্রমাঃ। আক্রমন্তে জ্যোতীংষি।'
এখানে কাত্যায়নের একটি বার্ত্তিক আছে, 'জ্যোতিরুদ্গমনে ইতি বাচ্যম্'। এজন্যই বলা হয়, ধাতু বহু অর্থবাহী বা 'অনেকার্থক'।
পাদবিক্ষেপ অর্থ রাখলেও তাত্ত্বিকভাবে কোনো ক্ষতি হয় না। কেননা ঈশ্বরে মুখ, হাত, ইত্যাদি রূপকমাত্র৷ 'বিশ্বতশ্চক্ষুরুত...' ঋ. ১০।৮১।৩, 'সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ...' ঋ. ১০।৯০।১ ইত্যাদি স্থলে অঙ্গবাচক শব্দ সর্বব্যাপকতা ও শক্তিমানত্বেরই বাচক, স্থূল দেহের নয়। একইভাবে সূর্যের কিরণকে হস্ত ও চরণ ধরা হয়েছে, যজ্ঞও বহুদূর বিস্তার লাভ করে বিধায় যজ্ঞেরও এক প্রকার গতিশীলতা রয়েছে।
'আমাদের জ্যোতিষ ও ধর্মশাস্ত্র' গ্রন্থে [পৃ. ১৬৮, সং. ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ] আচার্য হরিহর পাণ্ডেয় উক্ত মন্ত্রের ব্যাখ্যায় বলেছেন, সূর্যরূপী বিষ্ণু উদয়ের সময় বামন (ক্ষুদ্রাকৃতি) থাকেন, কিন্তু মধ্যাহ্নে তিনি তেজোময় ও বিরাটরূপ ধারণ করেন এবং অন্ধকাররূপী বলিকে পাতালে নিক্ষেপ করেন (অর্থাৎ বিপরীত প্রান্তে তখন মধ্যরাত)। তিনি সূর্যোদয়রূপী তিন পদের মাধ্যমে সমগ্র আকাশকে পরিমাপ করে ফেলেন।

(বিষ্ণুঃ) নিজের প্রকাশ দ্বারা সবকিছুকে ব্যাপ্তকারী সূর্য (ইদম্) এই সমস্ত গ্রহোপগ্রহ চক্রে (বিচক্রমে) নিজের কিরণরূপ চরণ স্থাপিত করে রেখেছে। (ত্রেধা) পৃথিবী, অন্তরিক্ষ, দ্যুলোক এই তিন স্থানে সূর্য (পদম্) নিজের কিরণরূপ চরণকে (নিধদে) স্থাপিত করে রেখেছে = বিষ্ণুরূপ আদিত্য এই ৩ স্থান প্রকাশিত করে। কিন্তু (পাংসুলে) ধূলিময় স্থান বা অন্তরিক্ষে [বিদ্যুৎরূপী] (অস্য) এই সূর্যের কিরণরূপ চরণ (সমূঢম্) তর্ক দ্বারা গম্য, প্রত্যক্ষ নয়।

অথ বিষ্ণুক্রমান্ ক্রমতে । দেবান্বা এষ প্রীণাতি যো যজত এতেন যজ্ঞেনঽর্গ্ভিরিব ত্বদ্যজুর্ভিরিব ত্বদাহুতিভিরিব ত্বৎস দেবান্প্রীত্বা তেষ্বপিত্বী ভবতি তেষ্বপিত্বী ভূত্বা তানেবাভিপ্রক্রামতি। যদ্বেব বিষ্ণুক্রমান্ ক্রমতে । যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুঃ স দেবেভ্য ইমাং বিক্রান্তিং বিচক্রমে যৈষামিয়ং বিক্রান্তিরিদমেব প্রথমেন পদেন পস্পারাথেদমন্তরিক্ষং দ্বিতীয়েন দিবমুত্তমেনৈতাম্বেবৈষ এতস্মৈ বিষ্ণুর্যজ্ঞো বিক্রান্তিং বিক্রমতে তস্মাদ্বিষ্ণুক্রমান্ ক্রমতে তদ্বা ইত এব পরাচীনং ভূয়িষ্ঠা ইব ক্রমন্তে।
শতপথ ব্রাহ্মণ ১।৯।৩।৮-৯
অর্থাৎ, যজ্ঞকার্য ও তপস্যার কঠোর পরীক্ষার পর যজমান নিজেকে বিষ্ণুর একজন ভক্ত মনে করতে থাকে এবং তাঁর ৩ পদাঙ্ক অনুসরণ করে। যজ্ঞই বিষ্ণু অর্থাৎ পারমার্থিক শক্তি ও সাংগঠনিক বল। যজ্ঞ ও বেদীয় আহুতি দ্বারা দেবগণ (প্রাকৃতিক ও বিদ্বান) প্রসন্ন করে সে তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে এবং তাঁদেরই পথে চলতে থাকে। এই পথচলা ‘বিষ্ণুক্রম’ প্রকৃতপক্ষে সংঘবদ্ধভাবে সংঘটিত ধর্মানুশীলন, যা বিষ্ণুরই স্বরূপ। এই বিষ্ণুক্রম অনুযায়ী যজমান ত্রৈআশ্রমিক জীবন অতিক্রম করে এবং সেই অনুশীলনের মাধ্যমেই আরও অনেক মানুষ প্রেরণা পেয়ে এগিয়ে চলে।
বিষ্ণুস্ত্বা ক্রমতামিতি যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুঃ স দেবেভ্য ইমাং বিক্রান্তিং বিচক্রমে যৈষামিয়ং বিক্রান্তিরিদমেব প্রথমেন পদেন পস্পারাথেদমন্তরিক্ষং দ্বিতীয়েন দিবমুত্তমেনৈতাম্বেবৈষ এতস্মৈ বিষ্ণুর্যজ্ঞো বিক্রান্তিং বিক্রমতে।
শতপথ ব্রাহ্মণ ১।১।২।১৩
অর্থাৎ, 'বিষ্ণু’ নামটি যজ্ঞের, সংঘবদ্ধতার সেই বৃহত্তম সংগঠনের নাম, যার ভিত্তি স্বয়ং পরমেশ্বর। এইভাবে, বিষ্ণুনাম রাষ্ট্রেরও প্রতীক এবং বৃহত্তর মানবসমাজেরও। যজমান বলেন “আমি কেবল নিজের স্বার্থের প্রতিনিধি হয়ে আহুতি গ্রহণ করছি না; হে শকট (যজ্ঞদ্রব্যবাহক রথ), আজ তোমার কাছে এই আহুতি জাতির পক্ষ থেকেও চাওয়া হচ্ছে, সমগ্র মানবসমাজের পক্ষ থেকেও।” এবং কারণ, সত্য রাষ্ট্রও পরমেশ্বরের উদ্দেশে নিবেদিত, তাই এই আহুতি আদতে মহাবিষ্ণুরই উদ্দেশে নিবেদিত হচ্ছে। এইরূপ যজ্ঞমূর্ত বিষ্ণু দেবতাদের জন্য যে তিন পদক্ষেপের পথ নির্দিষ্ট করেছেন, সেটিই তাঁদের জীবনযাত্রার নিয়মরূপ পদ্ধতি। প্রথম পদক্ষেপে তিনি এই দৃশ্যমান ভৌতিক পৃথিবীলোকে, অর্থাৎ ব্রহ্মচার্যাশ্রমে অবস্থান করেছেন। দ্বিতীয় পদক্ষেপে তিনি অন্তরীক্ষলোক অর্থাৎ গার্হস্থ্যাশ্রমে প্রবেশ করেছেন; এবং তৃতীয় পদক্ষেপে দ্যুলোক অর্থাৎ বানপ্রস্থাশ্রমে। বিষ্ণুর আজ্ঞাবলে, যজ্ঞস্বরূপ মানবসমাজ এই বিক্রান্তিকে অর্থাৎ এই ত্রৈআশ্রমিক জীবনযাত্রার পথকে নিজ নিজ নিয়ম ও কর্তব্য দ্বারা অতিক্রম করে চলে। এটাই মানবধর্ম, এটাই আদর্শ গমনপথ।

(বিষ্ণু) সর্বব্যাপক পরমেশ্বর (ইদং) এই জগতে (বিচক্রমে) ব্যাপ্ত হয়ে আছেন [কোথায়?] (ত্রেধা) দ্যুলোক, অন্তরিক্ষ, পৃথিবীলোকে। জগতে তিনি (পদম্) নিজের স্বরূপ তথা সত্তাকে (নিধদে) স্থাপিত করে রেখেছেন। কিন্তু (অস্য) এই পরমেশ্বরের সেই অস্তিত্ব (পাংসুরে) পাঞ্চভৌতিক এই জগতে(সমূঢম্) লুকায়িত রয়েছে অর্থাৎ চর্মচক্ষু দ্বারা তা অগোচর।
কঠোপনিষদ্ [১।২।১৫] অনুযায়ী, 'তত্তে পদং সংগ্রহেণ ব্রবীম্যোমিত্যেতৎ' অর্থাৎ ওঙ্কারই সেই পদ, পরব্রহ্মের স্বরূপ।
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর
0 মন্তব্য(গুলি)