শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা স্বাধ্যায় [৮] পর্ব- ১


যেমন
কাব্যে বলা হয় ❝সাগরে নদী লীন হয়❞ কিন্তু তা দিয়ে কি নদীর স্বরূপ
সম্পূর্ণ বিলুপ্ত বোঝানো হয় ? মোটেই নয়! এখানে ‘লীনতা’ মানে নদীর নিজস্ব
সত্তার নিঃশেষ নয় , বরং তার গন্তব্যের পূর্ণতা , চলমানতার নিবৃত্তি , এবং
বৃহৎ'এর সাথে তার ছন্দময় সংযুক্তি । নদী তার স্বরূপ বজায় রেখেই বৃহৎ'এর
সান্নিধ্যে পৌঁছয় । তেমনই , গীতার বহু বাক্যে আত্মার ব্রহ্মানন্দে
সম্পৃক্ততা বা পরমাত্মার সাথে সংযোগকে ‘অভেদ’ রূপে ভাবপ্রবণভাবে উপস্থাপন
করা হয়েছে । কিন্তু সেই ভাষা অলঙ্কারিক সেখানে অভেদতত্ত্ব নেই, আছে
তাদাত্ম্য, অনুগমন, বা সাদৃশ্য । সেই বাক্যসমূহকে আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করে
যদি জীব ও ব্রহ্মের মৌলিক অভিন্নতা প্রতিপাদন করা হয় , তবে তা মূল
দর্শনের বিকৃতি এবং ভাষার গভীরতা ও প্রসঙ্গবোধকে অগ্রাহ্য করার শামিল । এই
প্রকার ব্যাখ্যায় অলঙ্কারের স্তর, ভাবের তীব্রতা ও প্রসঙ্গের তাত্ত্বিকতা
অদৃশ্য হয়ে যায়, আর কেবল আক্ষরিকতা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এক কল্পিত একত্ব
যা বৈদিক সিদ্ধান্ত বা গীতার মূল সিদ্ধান্তের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় ।

মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ । মনঃষষ্ঠানীন্দ্রিয়াণি প্রকৃতিস্থানি কর্ষতি ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৫.৭
অনুবাদ: আমারই সনাতন অংশ জীবাত্মা প্রকৃতিতে স্থিত মনসহ ছয় ইন্দ্রিয়সমূহকে জীবলোকে আকর্ষণ করে ।
কয়েকজন
গীতাভাষ্যকারগণ উক্ত শ্লোকের দ্বারা জীবাত্মা এবং পরমাত্মার মধ্যে অভেদতা
সিদ্ধ করেছেন । অর্থাৎ পরমাত্মার অংশ জীবাত্মা । কিন্তু 'অংশ' অর্থে এখানে
ভিন্ন ভিন্ন বিভাগ বা বিচ্ছিন্ন টুকরা অর্থ সঙ্গত নয় । কেননা , পরমাত্মা
সর্বব্যাপী, একপদার্থাত্মক এবং নামরূপরহিত । 'অংশ' অর্থে 'টুকরা' হলে একের
অধিক পরমাত্মা হবে । আবার শ্লোকে 'সনাতন' শব্দদ্বারা এটি স্পষ্ট যে , জীব
ঘটাকাশ অথবা অগ্নির স্ফুলিঙ্গের মতোও পরমাত্মার অংশ নয় । কারণ , 'অংশ'
কালাতীত হতে পারে না । 'অংশ' কখনো না কখনো কোনো বস্তু থেকে উৎপন্ন হয়ে
নিজের অস্তিত্বে এসেছে । এজন্য সেটিকে সনাতন অথবা অনাদি বলা যেতে পারে না ।
যদি পরমাত্মাই জীবভাব প্রাপ্ত হতো , তাহলে এই অধ্যায়েরই ১৭শ শ্লোকে জীব
এবং পরমাত্মার ভেদ দেখানো হতো না- ❝উত্তমঃ পুরুষস্তুন্যঃ
পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ❞ এবং ১৩শ অধ্যায়ে ২০শ শ্লোকে জীবাত্মাকে অনাদি বলা হতো
না- ❝প্রকৃতিং পুরুষঞ্চৈব বিদ্ধ্যনাদী উভাবপি॥❞
আবার
অন্য কেউ কেউ বলেছেন , পরমাত্মা এবং জীবাত্মার সম্পর্ক পিতা পুত্রের মতো ।
অর্থাৎ সরাসরি পিতার শরীরের টুকরো না হলেও পিতার বীজ পুত্র হয়ে পৃথিবীতে
জন্মগ্রহণ করে । পুত্র যেরূপ পিতার অংশ , সেরূপ জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ ।
কিন্তু এই উদাহরণও সঙ্গত নয় । কেননা , পূর্বেই বলা হয়েছে 'অংশ' কখনো না
কখনো কোনো বস্তু থেকে উৎপন্ন হয়ে নিজের অস্তিত্বে আসে । এজন্য সেটিকে সনাতন
অথবা অনাদি বলা যেতে পারে না । পুত্র পিতার দ্বারা উৎপন্ন হয়ে থাকে ,
কিন্তু জীবাত্মা পরমাত্মা কোনো কিছু থেকে উৎপন্ন হয় না । যা কোনো কিছু থেকে
খণ্ডরূপে সৃষ্টি হয় , সেটি অনুৎপন্ন অথব অনাদি হতে পারে না । অতঃ যা নিত্য
তা অংশ হতে পারে না । পরমাত্মা যেরূপ অনাদি ও চেতন , জীবাত্মাও সেরূপ
অনাদি ও চেতন । আর এজন্য জীবাত্মাকে পরমাত্মার ন্যায় সনাতন বলা হয়েছে
(গীতা: ২.২৪) । সুতরাং উক্ত শ্লোকে 'অংশ' শব্দের আক্ষরিক অর্থ না করে
আমাদের তাত্ত্বিকদৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করতে হবে । ব্রহ্মসূত্র: ২.৩.৪৩ সূত্রের
ব্যাখ্যায় আচার্যগণ এরূপ ব্যাখ্যাই করেছেন-'অংশ' শব্দের তাৎপর্য ❝অংশ
ইবাংশঃ❞ অর্থাৎ অংশের মতো, বাস্তবিক অংশ নয় । ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এই
শ্লোকের টিপ্পনীতে লিখেছেন-❝This does not mean that the supreme is
capable of division or partition into fragments.❞ অর্থাৎ এই শ্লোকের
অর্থ এটি নয় যে , পরমাত্মা নিজেকে বিভাজন বা খণ্ড করতে পারেন । সমষ্টির
সমস্ত গুণ তত্ত্বত ব্যষ্টির মধ্যে বিদামান থাকে । উদাহরণস্বরূপ, এক গ্লাস
চিনির শরবতের প্রত্যেক ফোটাতেও মিষ্টত্ব গুণ থাকবেই । যদি জীবাত্মা
পরমাত্মার অংশ হয় , তাহলে পরমাত্মার সকল গুণ জীবাত্মার মধ্যে থাকবে ।
কিন্তু ঈশ্বরের সর্বজ্ঞতা , সর্বশক্তিমত্তা , সর্বব্যাপকতা , নির্ভান্তত্ব
ইত্যাদি গুণ জীব থেকে এবং জীবের অল্পজ্ঞতা , ভ্রান্তিত্ব তথা পরিচ্ছিন্নতা
ইত্যাদি গুণ ঈশ্বর থেকে ভিন্ন । শ্রুতি-প্রস্থানেও এই ভিন্নতার দৃষ্টান্ত
রয়েছে । শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ১ম অধ্যায়ের ৯ম শ্রুতিতে বলা হচ্ছে-


❝জ্ঞাজ্ঞেী দ্বাবজাবীশানীশাবজা হোকা ভোতৃভোগ্যার্থাযুক্তা । অনন্তশ্চাত্মা বিশ্বরূপো হ্যকর্তা এয়ং যদা বিন্দতে ব্রহ্মমেতৎ॥❞
অর্থাৎ
ঈশ্বর সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান , কিন্তু জীবাত্মা অল্পজ্ঞ এবং অল্প
শক্তিমান । উভয়েই অজন্মা । এছাড়া একটি তৃতীয় অজন্মা শক্তিও আছে , যাকে
প্রকৃতি বলা হয় । প্রকৃতি ভোক্তা জীবাত্মার জন্য উপযুক্ত ভোগ সামগ্রী
প্রস্তুত করে । অন্যদিকে পরমাত্মা অনন্ত বিশ্বস্বরূপ এবং সর্বতোভাবে
নির্লিপ্ত । মানুষ যখন এই তিনটির বিশেষত্ব এবং বিভিন্নতাকে জ্ঞাত হয় , তখন
সে ব্রহ্মকে প্রাপ্ত করে । সুতরাং দেখা যাচ্ছে জীবাত্মা কখনোই আক্ষরিকার্থে
পরমাত্মার অংশ নয় । মূলত উক্ত শ্লোকে পরমাত্মা এবং জীবাত্মা-এই উভয়
তত্ত্বের চেতন ভাবের সমানতা বিবেচনা করে জীবাত্মাকে পরমাত্মার অংশের মতো
বর্ণনা করা হয়েছে । গীতার অনেক শ্লোকেই মূল তাৎপর্য বুঝাতে শব্দের
আক্ষরিকতা বর্জন করতে হয়েছে । যেমন, পরের শ্লোকটিতে 'ঈশ্বর' শব্দ 'দেহের
স্বামী জীব' অর্থে এবং ৮ম অধ্যায়ে ২৩শ শ্লোকে 'কাল' শব্দ 'মার্গ' অর্থে
গ্রহণ করতে হয়েছে ।
'মমৈবাংশো'
বলতে মূলত জীবকে পরমাত্মার 'সনাতন অংশ' বলা হলেও , এতে আক্ষরিক খণ্ড বা
বিচ্ছিন্নতা বোঝানো হয়নি । পরমাত্মা চিরনির্ভাজ্য, সর্বব্যাপী, অখণ্ড তাঁর
কোনো অংশ খণ্ডিত বা পৃথক হতে পারে না । পরমাত্মা যেমন অনাদি , চেতন , ও
স্বয়ংসম্পূর্ণ , তেমনি জীবাত্মাও অনাদি ও চেতন এই গুণেই তাকে 'সনাতন অংশ'
বলা হয়েছে ।
‘সনাতন’
পদ ইঙ্গিত করে যে জীব অনাদি ও নিত্য । কেননা কোনো খণ্ড বা অংশ কখনো না
কখনো মূল সত্তা থেকে উৎপন্ন হয় ; আর যা উৎপন্ন , তা কখনোই সনাতন হতে পারে
না । সুতরাং , যদি জীব পরমাত্মার খণ্ডরূপ হতো , তবে সে অনাদি ও সনাতন হতো
না । এখানে 'অংশ' শব্দটি আক্ষরিক নয়, বরং গুণগত অনুরূপতা, সদৃশ্য বা
আত্মসাম্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ জীব যেমন চেতনও অনাদি , এই গুণে সে
পরমাত্মার সদৃশ । জীব স্বতন্ত্র সত্তা, তার জ্ঞান সীমিত, সে বিভ্রান্ত
হয়, ও কর্মফলে আবদ্ধ থাকে; পক্ষান্তরে পরমাত্মা সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও
সর্বনিয়ন্ত্রক । গুণগত মিল থাকলেও স্বরূপগত ভিন্নতা থাকার কারণেই এই
'অংশত্ব' রূপক বাস্তব বিভাজন নয় । সুতরাং 'সনাতন অংশ' বলতে বোঝায়
চৈতন্যস্বরূপে সদৃশ, কিন্তু শক্তি, জ্ঞান ও স্বাধীনতায় পরমাত্মা থেকে
স্বতন্ত্র ও সীমিত এক অনাদি সত্তা ।


সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ ॥
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি।
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৬.২৯-৩০
অনুবাদ:
যোগযুক্ত মানুষ সর্বত্র সমদর্শী হয়ে পরমাত্মাকে সর্বভূতে স্থিত এবং
সর্বভূতকে পরমাত্মাতে দর্শন করে। এরূপে যে সর্বত্র আমাকে দর্শন করে এবং
আমাতে সর্বভূত দর্শন করে , আমি তার নিকট অদৃশ্য হই না , সেও আমার অদৃশ্য হয়
না ।
পরমাত্মা
সর্বব্যাপক ; তাই সর্বভূতে স্থিত এবং সর্বভূত পরমাত্মায় স্থিত যোগ যুক্ত
মানুষ এরূপ দর্শন করার ফলে পরমাত্মা কখনোই তার নিকট অদৃশ্য হয় না ।
যজুর্বেদে ৪০।৬ বলা হয়েছে -


য়স্তু সর্বাণি ভূতান্যাত্মন্নেবানুপশ্যতি ।
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বি চিকিৎসতি ॥
যজুর্বেদে ৪০।৬
পদার্থঃ
হে মনুষ্যগণ ! (য়ঃ) যে বিদ্বান (আত্মন্ এব) পরমাত্মার মধ্যেই (সর্বাণি)
সকল (ভূতানি) প্রাণী-অপ্রাণীকে (অনুপশ্যতি) বিদ্যা, ধর্মাচরণ ও যোগাভ্যাসের
পশ্চাৎ দর্শন করেন (তু) এবং যিনি (সর্বভূতেষু) সকল প্রকৃত্যাদি
পদার্থসমূহের মধ্যে (আত্মানম) সর্বত্র ব্যাপক পরমাত্মার দর্শন করেন (চ) এবং
(ততঃ) ওইরূপ সম্যক্ দর্শনের পর, তিনি (ন) না (বি চিকিৎসতি) সংশয়কে প্রাপ্ত
হন- এরূপ তোমরা জেনো ।
সরলার্থঃ
হে মনুষ্যগণ! যে বিদ্বান বিদ্যা, ধর্মাচরণ, যোগাভ্যাসের পশ্চাৎ পরমাত্মার
মধ্যেই প্রাণী-অপ্রাণী সকলকে দর্শন করেন এবং যিনি সকল প্রকৃত্যাদি
পদার্থসমূহের মধ্যে সর্বব্যাপক পরমাত্মাকে দর্শন করেন, তিনি ওইরূপ সম্যক্
দর্শনের পর কখনো সংশয়গ্রস্ত হন না॥৬॥
প্রকৃত
তাৎপর্য এই শ্লোকের উপাসক যোগী যখন পরমাত্মার 'সর্বব্যাপক' স্বরূপকে জানতে
পারেন, তখন তিনি পরমাত্মাকে সর্বভূতে এবং পরমাত্মাতে সকল ভূতসমূহ দর্শন
করেন । তিনি সংশয় মুক্ত হন । তিনি নিজের আত্মার সুখ-দুঃখের ন্যায় অন্যান্য
প্রাণীর সুখ-দুঃখকে উপলব্ধি করার মাধ্যমে সর্বজীবে সমদর্শী হন , অর্থাৎ যখন
যোগী পরমাত্মাকে সর্বভূতে এবং সর্বভূতকে পরমাত্মাতে দেখেন, তখন ওই
যোগযুক্ত পুরুষ সর্বত্র সমদর্শী হন । আর যিনি আমাকে (পরমাত্মাকে) সর্বভূতে
এবং আমাতে (পরমাত্মাতে) সর্বভূত অবস্থিত দেখেন, তাঁর দৃষ্টিতে আমি
(পরমাত্মা) নাশ হই না এবং আমার (পরমাত্মার) দৃষ্টিতে তিনি নাশ হন না ।
"অদেবদত্তং দেবদত্তং ইত্যাছ” যিনি দেবদত্ত নন, কিন্তু তাকে দূর থেকে
দেবদত্তের সাথে মিল দেখে তাকে 'দেবদত্ত' নামে ডাকা হয় । এ থেকে বোঝা যায়-
“দেবদত্তবৎ অয়ম্” ইনি দেবদত্তের ন্যায় । এভাবে এই শ্রুতিতে বলা হয়েছে-
নিজের আত্মার স্বরূপকে জেনে, সর্বভূতে ব্যাপ্ত পরমাত্মার দর্শনের পর
জ্ঞাতার দৃষ্টিতে সকল প্রাণী, নিজের আত্মার সমতুল্য হয়ে যায় । অর্থাৎ তিনি
অন্য প্রাণীর সুখ-দুঃখকে নিজের সুখ-দুঃখ বলে মনে করেন । যোগেশ্বর ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ এই বিষয়ে বলেছেন- "আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোঽর্জুন
।সুখং বা যদি বা দুঃখং স য়োগী পরমো মতঃ॥ (গীতা ৬।৩২)” অর্থাৎ হে অর্জুন!
যিনি সর্বত্র সমদর্শী হয়ে সমস্ত জীবের সুখ-দুঃখকে নিজের সুখ-দুঃখের ন্যায়
অনুভব করেন, আমার মতে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী ।

যদা ভূতপৃথগ্ ভাবমেকস্থমনুপশ্যতি ।
তত এব চ বিস্তারং ব্রহ্ম সম্পদ্যতে তদা ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৩.৩১
অনুবাদ:
যখন তত্ত্বদর্শী সাধক পৃথিবী আদি ভিন্ন-ভিন্ন ভূতকে এক পরমাত্মায় স্থিত
এবং সেই পরমাত্মা থেকেই ব্রহ্মাণ্ডের বিস্তৃতি জানতে পারেন , তখন তিনি
ব্রহ্ম-সম্পত্তি প্রাপ্ত হন ।
অদ্বৈতবাদ
ভাষ্যানুসারে অনেকেই এর এই অর্থ করেছেন- ❝যেরূপে রজ্জুতে কল্পিত সর্প
রজ্জু থেকে ভিন্ন নয় এবং সুবর্ণের কুগুলাদি সুবর্ণ থেকে ভিন্ন হয় না,
এইপ্রকার সমস্ত ভূতকে যিনি ব্রহ্মে কল্পিত মনে করেন তিনি 'ব্রহ্ম
সম্পদ্যতে' ব্রহ্ম হয়ে যান❞ । এই শ্লোকে ভগবান্ মূলত বুঝাতে চেয়েছেন যে ,
পৃথিবী আদি ভূতের ভেদকে যিনি প্রলয়কালে একমাত্র পরমাত্মার মান্য করেন এবং
তাঁর থেকে পুনরায় উৎপত্তিকালে বিস্তৃতি ভাবা হয় , তিনি 'ব্রহ্ম সম্পদ্যতে'
ব্রহ্ম-সম্পত্তি প্রাপ্ত হন , অর্থাৎ ব্রহ্মের যে নির্গুণ মুক্তভাব তা তিনি
প্রাপ্ত করেন ।
উক্ত
শ্লোকে কল্পিত হওয়ার কোনো কথা কোথাও নেই এবং ব্রহ্ম হয়ে যাওয়ারও বর্ণনা
নেই । এখানে ব্রহ্মের সম্পত্তি প্রাপ্তির বর্ণনা রয়েছে । যেমন: যদি কেউ
একথা বলে যে, ❝দেবদত্তো গ্রামং সম্পদ্যতে❞ তাহলে এর এই অর্থ হয় যে ,
"দেবদত্ত গ্রামের সম্পদ প্রাপ্ত হয়েছে ।" এই বাক্য থেকে কখনোই এই অর্থ
প্রকাশ পায় না যে , দেবদত্ত স্বয়ং গ্রাম হয়ে গিয়েছেন । সুতরাং 'ব্রহ্ম
সম্পদ্যতে' অর্থ ব্রহ্মের সম্পদ নির্গুণ মুক্তভাবকে প্রাপ্ত হওয়া, কখনোই
স্বয়ং ব্রহ্ম হয়ে যাওয়া নয় । সাধক ভিন্ন-ভিন্ন ভূতাদি পদার্থের ভেদকে
প্রলয়কালে এক পরমাত্মায় স্থিত এবং সেই পরমাত্মা থেকেই ব্রহ্মাণ্ডের
বিস্তৃতি জেনে নির্গুণ মুক্ত পুরুষ হয়ে যান । যেহেতু ব্রহ্ম সমস্ত ভূতে
স্থিত রয়েছেন ।


মম যোনির্মহদ্ ব্রহ্ম তস্মিন্ গর্ভং দধাম্যহম্ ।
সম্ভবঃ সর্বভূতানাং ততো ভবতি ভারত ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৪.৩
অনুবাদ:
হে ভারত (অর্জুন) ! আমার অধীন উপাদান কারণ যে প্রকৃতি তার মধ্যে আমি
গর্ভকে ধারণ করাই, এর দ্বারা সকল প্রাণীদের উৎপত্তি হয় ।
❝মহদ্
ব্রহ্ম❞এখানে প্রকৃতির নাম । তা এই প্রকারে যে, সকল কার্যসমূহ থেকে
প্রকৃতি বড় হওয়ার কারণে "মহৎ" বলা হয়েছে , কার্যের বৃদ্ধির হেতু হওয়ায়
"ব্রহ্ম" এবং মহৎ নাম মহত্ত্বের , তার বৃদ্ধির হেতু হওয়া প্রকৃতিকে "মহদ্
ব্রহ্ম” বলা হয়েছে । মায়াবাদীদের মতে এখানে "মহদ ব্রহ্ম” মায়ার নাম ।
তাঁদের মতে মায়া থেকেই ঈশ্বরের মধ্যে কর্তৃত্ব রয়েছে , বাস্তবে নেই ।
কিন্তু সেই মায়া তাঁদের মতে ব্রহ্মের অজ্ঞানই , কোনো ভিন্ন বস্তু নয় । পরের
শ্লোকেই ১৪.৪ ❝ব্রহ্ম মহদ্যোনিরহং❞ প্রকৃতি তার উপাদানকারণ করা হয়েছে ।

ক্ষেত্রজ্ঞং চাপি মাং বিদ্ধি সর্বক্ষেত্রেষু ভারত ।
ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞয়োর্জ্ঞানং যত্তজ্ জ্ঞানং মতং মম ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৩.৩
অনুবাদ:
হে ভারত (অর্জুন) ! সকল ক্ষেত্রেই আমাকে ক্ষেত্রজ্ঞ বলে জানবে এবং
ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞের যে জ্ঞান, সেটিই 'যথার্থ জ্ঞান'-এই আমার অভিমত ।
এই
শ্লোকে অদ্বৈতবাদীগণ ব্যাখ্যা করে সমস্ত জীবদেহে এক ও অভিন্ন ব্রহ্ম আত্মা
অধিষ্ঠিত , তিনিই 'আমি'। এই চৈতন্যকে ক্ষেত্রজ্ঞরূপে সবক্ষেত্রে উপলব্ধি
করাই যথার্থ জ্ঞান । এখানে আত্মা ও ঈশ্বর ভিন্ন নয়, আত্মা যদি সঠিকভাবে
নিজেকে চিনে , তবে সে বুঝবে সে ঈশ্বর স্বরূপই । কিন্তু এই ব্যাখ্যা সঙ্গত
নয় এটা শ্রুতি বিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত!
সকল
ক্ষেত্রে পরমাত্মাই ক্ষেত্রজ্ঞ এই শ্লোকে বলা হয়েছে কিন্তু
ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজের যে তত্ত্বজ্ঞান , সেটিই যথার্থ জ্ঞান । তাহলে এই
ক্ষেত্র এবং ক্ষেত্রজ্ঞের তত্ত্বজ্ঞান কী ? ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞের বিচারে
তিনটি তত্ত্ব পাওয়া যায় । সেই তিনটি তত্ত্বের নাম: পরমাত্মা, জীবাত্মা ও
প্রকৃতি । যেরূপ এক একটি ক্ষেত্রে (শরীরে) এক একটি ক্ষেত্রজ্ঞ (জীবাত্মা)
আছেন , সেরূপ সকল ক্ষেত্রে (সমগ্র জগতে) প্রধান ক্ষেত্রজ্ঞ হচ্ছেন পরমাত্মা
। ঋগ্বেদে (১।১৬৪।২০) রয়েছে- ❝ব্রহ্ম ও জীব উভয়ে চেতনত্ব , পালকত্ব
প্রভৃতি গুণবশত সদৃশ ব্যাপ্য-ব্যাপকভাবে সংযুক্ত পরস্পর মিত্রতাযুক্ত ,
সনাতন এবং অনাদি ; তেমনি অনাদি মূলস্বরূপ কারণ এবং শাখারূপ কার্যযুক্ত
বৃক্ষ , অর্থাৎ যা স্থূল হয়ে পুনঃ প্রলয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় , সেই তৃতীয়
অনাদি পদার্থ-এই তিনটির গুণ , কর্ম , স্বভাবও অনাদি । এই জীব ও ব্রহ্মের
মধ্যে প্রথম জীব এই বৃক্ষরূপ সংসারে পাপ-পূণ্যরূপ ফলসমূহ উত্তমরূপে ভোগ করে
। আর দ্বিতীয় পরমাত্মা, কর্মফল ভোগ না করে চারদিকে অর্থাৎ অন্তরে বাহিরে
সর্বত্র প্রকাশ হয়ে আছেন । জীব অপেক্ষা ঈশ্বর , ঈশ্বর অপেক্ষা জীব এবং উভয়
অপেক্ষা প্রকৃতি ভিন্ন-স্বরূপ এবং তিনটিই অনাদি❞ । জীবাত্মা ভোক্তা ,
অর্থাৎ তিনি ভোগ করেন ; প্রকৃতি ভোগ্যা , অর্থাৎ প্রকৃতি ভোগের উপযুক্ত হন ,
জীবাত্মা প্রকৃতির মাধ্যমেই ভোগকরেন ; এবং পরমাত্মা নিয়ন্তা , অর্থাৎ
জীবাত্মা এবং প্রকৃতির নিয়ামক । জীবাত্মা যখন বুঝতে পারে সে পরমাত্মা থেকে
ভিন্ন, তখন পরমাত্মার উপাসনা দ্বারা মুক্তি প্রাপ্ত হয় । শ্বেতাশ্বতর
উপনিষদে (৪।৫) বলা হয়েছে- ❝প্রকৃতি, জীব এবং পরমাত্মা এই তিন অঙ্গ অর্থাৎ
যার কখনো জন্ম হয় না এবং এরা কখনো জন্মগ্রহণ করে না । অর্থাৎ এই তিন সমগ্র
জগতের কারণ, এদের কোনো কারণ নেই। অনাদি জীব অনাদি প্রকৃতিকে ভোগ করতে অবদ্ধ
হয়, কিন্তু পরমাত্মা তাতে আবদ্ধ হন না এবং ভোগ করেন না❞ । জীব ও পরমাত্মার
এইপ্রকার ভেদ অবগত হয়ে ঈশ্বরের উপাসনা করলে ঈশ্বরের অনুগ্রহে দেই ব্যক্তি
অমৃতত্ব লাভ করেন । যজুর্বেদে (৩৬।২) উল্লেখ আছে- ❝হে পরমাত্মা ! আমার
চক্ষু, হৃদয় এবং মনের যে ছিদ্র রয়েছে তাকে তুমি পূর্ণ করো । এই সম্পূর্ণ
ভুবনের স্বামী তুমি আমাদের জন্য কল্যাণকারী হও❞ । এরকম অসংখ্য মন্ত্রে
ব্রহ্মকে জীবের উপাস্যদের বর্ণনা করা হয়েছে এবং ব্রহ্মসূত্রেও (১।২।৩-৬)
জীব ও ব্রহ্মের ভেদ স্পষ্ট-❝অনুপপত্তেস্তু ন শারীরঃ❞
❝কর্মকর্তৃব্যপদেশাচ্চ❞, ❝শব্দবিশেষাৎ❞, ❝স্মৃতেশ্চ❞ ইত্যাদি সূত্রে
বর্ণনা করা হয়েছে যে -
(১) জীব কখনোই ব্রহ্ম হতে পারে না ।
(২) ব্রহ্ম উপাস্য এবং জীব উপাসক ।
(৩) জীব ব্রহ্মের বর্ণনাকারী শব্দেরও ভেদ রয়েছে ।
(৪) স্মৃতি দ্বারাও জীব ব্রহ্মের ভেদ পাওয়া যায় ।
বেদে
প্রকৃতি , জীব ও পরমাত্মার ধর্মের পার্থক্যের বিষয়েই উল্লেখ রয়েছে ।
ঋগ্বেদ (১০।৮২।৬) এবং যজুর্বেদে (১৭।৩১) উল্লেখ আছে-❝পরমাত্মা এই জগৎ রচনা
করেছেন । তিনি তোমাদের মধ্যে বিরাজমান অথচ তিনি তোমাদের থেকে পৃথক❞ ।
ঋগ্বেদ (১।১৬৪।৪৪) উল্লেখ আছে- ❝তিন প্রকাশময় পদার্থ নিয়মানুসারে বিবিধ
কার্য করছেন । ব্রহ্ম সৃষ্টিকালে বীজ বপন করেন , জীব সামর্থ্য দ্বারা
সংসারকে শুভ অশুভ দুই দিক থেকেই ভোগ করে , প্রকৃতির শুধু বেগ দেখা যায়
কিন্তু (সূক্ষ্ম হওয়ার জন্য) রূপ দেখা যায় না❞ পরমাত্মা ও জীবাত্মা উভয়েই
'অজ' অর্থাৎ জন্মরহিত । কিন্তু তাদের ছাড়াও অন্য এক শক্তি আছেন, যিনি
ভোক্তা জীবের ভোগ্য বিষয়সকল প্রদান করেন, তিনিও অজা ; অর্থাৎ প্রকৃতিও
জন্মরহিত । যজুর্বেদ (২৩।৫৬) উল্লেখ আছে-❝জন্মরহিত প্রকৃতি প্রলয়কালে নিজের
রূপকে সম্বরণ করে এবং সংসাররূপে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে রূপকে প্রকট করে❞ ।
ক্ষেত্র প্রকৃতির সাথে ক্ষেত্রজ্ঞ জীব ও পরমাত্মার যে ভেদ জ্ঞান , সেটিই
প্রকৃত জ্ঞান; আর সমস্তই অজ্ঞান-এটিই ভগবানের অভিমত । প্রকৃতি, জীব ও
পরমাত্মা পরস্পর সংশ্লিষ্ট হলেও তাদের ধর্মের মিশ্রণ হয় না । ব্রহ্মসূত্রে
(২।১।৯) উল্লেখ আছে- ❝ন তু দৃষ্টান্তভাবাৎ॥❞ অর্থাৎ ❝জড়জগৎ প্রলয়কালে
ব্রহ্মের সঙ্গে মিলন হলেও ব্রহ্মের জড় দোষ জন্মাতে পারে না । কেননা, তাঁর
সর্বকালীন শুদ্ধতার দৃষ্টান্ত আছে❞ ।


ইতি ক্ষেত্রং তথা জ্ঞানং জ্ঞেয়ং চোক্তং সমাসতঃ ।
মদ্ভক্ত এতদ্বিজ্ঞায় মদ্ভাবায়োপপদ্যতে ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৩.১৯
অনুবাদ: এইপ্রকার ক্ষেত্র ও জ্ঞান এবং জ্ঞানের বিষয় সংক্ষেপে বলা হলো । আমার ভক্ত এটি তত্ত্বত জেনে আমার স্বরূপ হওয়ার যোগ্য হন ।
এই
শ্লোকে অদ্বৈতবাদীগণ ব্যাখ্যা করেন 'মদ্ভাবায়োপপদ্যতে' পরমব্রহ্মের
স্বরূপ হওয়ার অর্থ হচ্ছে জীবাত্মা ব্রহ্মকে প্রাপ্ত করে ব্রহ্মে বিলীন হয়ে
যান । যেমন কোনো সাগরে নদীর জল মিশে গেলে সেই নদীর জল সাগরের জলের স্বরূপ
প্রাপ্ত হয় , তেমন জীবাত্মা যদি পরমব্রহ্মকে প্রাপ্ত করেন তাহলে জীবাত্মাও
স্বয়ং ব্রহ্ম হয়ে যান । কিন্তু সাগর-নদীর এই ব্যাখ্যা জীবাত্মা এবং
পরমাত্মার ক্ষেত্রে সঠিক নয় । গীতাতেই বলা হয়েছে-❝মস্তক্তা যান্তি মামপি॥❞
অর্থাৎ "আমার ভক্তগণ আমাকেই প্রাপ্ত করেন" - (৭।২৩) ।
❝ব্রহ্মসংস্পর্শমত্যন্তং সুখমন্নুতে।❞ অর্থাৎ(জীবাত্মা) ব্রহ্মের
সংস্পর্শজনিত অনন্ত সুখ অনুভব করেন- (৬।২৮)।" মূলত ❝মদ্ভাবায়োপপদ্যতে❞এর
অর্থ এই যে, ক্ষেত্র-প্রকৃতি এবং জ্ঞেয়-ব্রহ্ম , এই পূর্ণ জ্ঞানকে উপলব্ধ
করে জিজ্ঞাসু সত্য-সংকল্পাদি ব্রহ্মের ধর্মকে ধারণ করেন । অর্থাৎ জীবাত্মা
পরমাত্মাকে জেনে পরমাত্মার ন্যায় নির্গুণতাকে প্রাপ্ত করে মুক্ত হয়ে যান,
কিন্তু স্বয়ং পরমাত্মা হয়ে যান না । সবচেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে
ব্রহ্মসূত্রে (৪।৪।২১)-❝ভোগমাত্রসাম্যলিঙ্গাচ্চ।❞ অর্থাৎ 'ভোগমাত্রতে
মুক্ত আত্মার পরমাত্মার সাথে সাম্য হয় , সৃষ্টিকর্তৃত্বে সাম্য নয়' ।
সুতরাং জীবাত্মা পরমাত্মার ভোগাংশে সাম্য থাকলেও সামর্থ্য ও স্বরূপাংশে ভেদ
থেকেই যায় ।

বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক ।
0 মন্তব্য(গুলি)