বেদের ভাষা সরল এবং সুবোধ । বিশ্বনাথকৃত কাব্য লক্ষণ 'অনলঙ্কৃতি পুনঃ ক্বাপি' শৈলী বেদ মন্ত্রের যত্রতত্র প্রতীয়মান, কেননা মন্ত্রের ভাষা সহজ এবং স্বাভাবিক । মন্ত্রে সমাসসমূহের দীর্ঘ পদাবলি অনুপস্থিত। বেদে ভাবাভিব্যক্তির অপূর্ব মহত্ত্ব বিদ্যমান। উদাহরণার্থ যখন বৈদিক নারী উচ্চারণ করেন- “মম পুত্রাঃ শত্রুহণোঽথো মে দুহিতা বিরাট্”[1], তখন এই মন্ত্র শ্রবণ মাত্রই ওজস্বী ভাবের পূর্ণ অভিব্যক্তি ঘটে । এইভাবে “হন্তাহং পৃথিবীমিমাং নি দধানীহ বেহ বা । কুবিৎসোমস্যাপামিতি ॥”[2] মন্ত্র পাঠে না কেবল পাঠকের, বরং শ্রোতাও তার হৃদয়ে আনন্দানুভূতির অনুভব করে ।
লোকভাষায় প্রচলিত লৌকিক শব্দের দীর্ঘকালীন প্রয়োগ এবং প্রচলনের কারণে তা রূঢ়ি শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত সাথে জড়বৎও হয়ে গিয়েছে । বৈদিক ভাষা নির্বচন প্রধান হওয়ায় তা শাশ্বত চেতনাদায়িনী । মনুষ্যের যতক্ষণ বৈদিক ভাষার নির্বচনগম্য অর্থের উপর বোধগম্য না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত বেদ মন্ত্রের অর্থ এবং ভাবের সম্যক্ অনুভূতির অনুভব করতে অক্ষম সে । সমগ্র বেদ এক কাব্য তথা মন্ত্রের অলৌকিকতার কারণই ঋগ্বেদে বেদকে দিব্য কাব্য বলা হয়েছে।[3] বেদ কাব্য সদা শাশ্বত, সজীব, সপ্রাণ । ঋগ্বেদের উষা সূক্তে উষাকে “পুরাণী দেবী য়ুবতিঃ পুরন্ধী চক্রমিব নব্যসি”[4] সম্বোন্ধনে বেদ বিষয়ে স্পষ্ট ব্যক্ত হয় যে, মন্ত্রে বর্ণিত স্বয়ং উষার স্বরূপের ন্যায় বৈদিক ভাষাও উপমারূপে পুরাতন দেবী তথা যুবতির ন্যায় । নবনবোন্মেষশালিনী এই ভাষা শৈলীর সমগ্র রহস্য অন্তিমরূপে জানা সম্ভব নয়। বিদ্বানগণ স্বীয়-স্বীয় প্রজ্ঞার মাধ্যমে নানা রূপ,শৈলী তথা উপমার মাধ্যমে বেদ মন্ত্রের ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু মন্ত্রের মহিমা “য়ো অস্যাধ্যক্ষঃ পরমে ব্যোমন্ সোঽঙ্গ বেদ য়দি বা ন বেদ” [5] এর ন্যায় দেদীপ্যমান ।
বেদের আনুপূর্বী নিত্য । মন্ত্রের ক্রম অনাদিকাল থেকে যেমন ছিল সেরকমই আছে এবং সর্বদা তেমনই থাকবে । উদাহরণার্থ - ঋগ্বেদের প্রথম মন্ত্রের অগ্নি পদকে পুরোহিত আদি বিবিধ বিশেষণে স্তুতি করা হয়েছে । এ স্থলে অগ্নির পর্যায়বাচী শব্দ বহ্নি, হুতভুক্ আদি প্রয়োগ করা সম্ভব নয় । হুতভুক্ শব্দের অর্থ কেবল 'হুতং ভুনক্তি' । যা উক্ত মন্ত্রের প্রকরণ অনুযায়ী অগ্নি পদের ভাব অভিব্যক্তিতে অক্ষম । অগ্নি পদের মহত্ত্ব নিরুক্তে প্রদর্শিত এর নির্বচনসমূহের মাধ্যমে সুস্পষ্ট । পিণ্ডে, ব্রহ্মাণ্ড , পৃথিবীতে, আকাশে সর্বত্র অগ্নিই তো প্রসৃত ।
বেদের শব্দ সুরুচিপূর্ণ শৈলী বিশিষ্ট । বেদের ভাষা সেই অতি উদাত্ত বাণীতে বদ্ধ যা স্বয়ং অদিতি । এই বাণীর আবরণে নির্মিত পুরুষও অহীন, অদীন এবং অমৃতরূপে প্রতিষ্ঠিত হয় ; “অদীনাঃ স্যাম শরদঃ শতম্” [6] মন্ত্রে এই ভাবেরই প্রকট হয়েছে ।
বৈদিক ভাষা তথা বেদ মন্ত্রের অনুবাদ সম্ভব নয়। অনুবাদের মাধ্যমে মন্ত্রের বিস্তৃত স্বরূপের প্রকট অসম্ভব । একমাত্র বিস্তৃত ব্যাখ্যার মাধ্যমেই স্বরূপ স্পষ্ট হওয়া সম্ভব । “হ্রদা ইব স্নাত্বা উ ত্বে” এর ন্যায় বিশুদ্ধ ভাবনার সহিত পূর্ণ মনোযোগপূর্বক যখন বৈদিক জগতে পূর্ণ প্রবেশ করা হবে, তখনই “জায়েব পত্যে উশতী সুবাসা” এর ন্যায় স্বীয় স্বরূপকে স্পষ্ট করা সম্ভব হবে । পূর্বাগ্রহ, অপরিপক্ব জ্ঞান তথা এসব ভিত্তিকে কেন্দ্র করা অনুবাদের কোনও প্রকার বৈধতা নেই এখানে। বিশ্বব্যাপিনী ভাষার রহস্যের উন্মোচনের সামর্থ্য নেই এসবের ।
বেদ অশ্ব শক্তি এবং ব্যাপকতার প্রতীক । এই ব্যাপকতার কারণেই অশ্বিনৌকে এই নামে সম্বোধন করা হয়েছে । এরূপভাবে বেদের ‘গো’ পদ জ্ঞান, ইন্দ্রিয়, কিরণ, গতি আদি অনেক অর্থবাচক । ‘গোস্তু মাত্রা ন বিদ্যতে’[7] মন্ত্রে এই’ই ভাব অভিপ্রেত হয়েছে । ঋগ্বেদ ১।৯২।১ নং মন্ত্রে উষাকেও ‘গৌ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে । নিরুক্ত ১২।৭-এ ‘গাবো গমনাৎ’ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বেদের ভাষায় সমগ্রতা বিদ্যমান, পূর্ণতা এবং রহস্যযুক্ত হয়েও স্পষ্টতা তথা ব্যাপকতা প্রতিষ্ঠিত । বৈদিক ভাষাকে কেবল পাণ্ডিত্যের আধারেই স্পষ্টকরণ সম্ভব নয় ।
বেদ মন্ত্র তথা সূক্ত পরস্পর সম্বদ্ধ । বেদের ব্যাখ্যা করার সময় সম্বদ্ধতা সম্পর্কে বোধবুদ্ধি থাকা অত্যাবশ্যক । এতদ্ উপস্থিত বিনা সেই ব্যাখ্যা অশুদ্ধ হিসেবে গণ্য হবে । এই বিষয়ে অরবিন্দ বলেন- “পৃথক্-পৃথক্ সন্দর্ভ বা সূক্ত দিয়ে বেদের ব্যাখ্যা করা অসম্ভব । যদি কেউ সঙ্গত অর্থ করতে চায় তাহলে বেদের ব্যাখ্যা সমগ্ররূপে করা আবশ্যক ।”
বেদের বিভিন্ন প্রকরণে বিবিধ মাধ্যমে বিবিধ সন্দেশ ব্যক্ত হয়েছে। বেদ মন্ত্র কোথাও-কোথাও সংবাদাত্মক শৈলীতে, কোথাও-কোথাও আখ্যানাত্মক শৈলীতে বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু সেইসব সংবাদ বা আখ্যানকে লৌকিক ইতিহাস হিসেবে গ্রহণ করা আর্ষ পরম্পরা বিরুদ্ধ হবে। এইসকল সংবাদ-সূক্তসমূহে বর্ণিত অনেক নামপদও উক্ত প্রকারে প্রযুক্ত । যা ব্যক্তিবাচক ইতিহাস হিসেবে প্রতীত হয়, কিন্তু কোনও ব্যক্তিবিশেষের ইতিহাস বেদে অনুপস্থিত, বরং কোনো তথ্যকে প্রতিপাদনার্থ করা হয় এসব শৈলীর আশ্রয়ে । যথা-লোপামুদ্রা অগস্ত্যের সংলাপে মনুজসহজ প্রবৃত্তিকে অত্যন্ত স্বাভাবিক শৈলীতে বর্ণনা করা হয়েছে। একইভাবে যম-যমী সূক্তও মানব মনের নিম্নতম তথা উচ্চতম ভাবনাকে প্রকট করার উত্তম উদাহরণ হিসেবে খ্যাত । পুরূরবা-উর্বশী সংবাদে রাজনীতিকে অত্যন্ত সুন্দর প্রকারে বর্ণনা করা হয়েছে। এই প্রকার সংবাদসূক্ত তথা আখ্যানাত্মক মন্ত্রও বিদ্যমান বেদের অন্যত্র । বস্তুতঃ বেদে বিবিধ প্রতীকের মাধ্যমেই বিভিন্ন তত্ত্বকে প্রতিপাদন করা হয়েছে । আখ্যানাত্মক বা সংবাদসূক্তের মাধ্যমেই কোনো না কোনো প্রকার শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে, না কোনো লৌকিক ঐতিহাসিক ঘটনাকে বর্ণনা করা হয়েছে ।
বেদ কোনো তত্ত্বকে কোথাও ব্যক্তিবাচক নাম দ্বারা প্রকট করেছে তথা কোথাও বিনা নামেই শুধুমাত্র প্রতীকের মাধ্যমে প্রকট করেছে । যথা- ঋগ্বেদের অক্ষ সূক্তে কোনো নাম উল্লেখ না করেই এক জুয়াড়ির দুর্দশা বর্ণনা জুয়াড়ি শব্দেই করা হয়েছে । কোথাও-কোথাও পশু-পক্ষির মাধ্যমেও বিবিধ তত্ত্বের প্রতিপাদন করা হয়েছে । যথা- ঋগ্বেদের মণ্ডূক সূক্ত (৭।১০৩)।
যেমনভাবে বেদে চর্চিত ইন্দ্র, অগ্নি আদি দেব শব্দ পরমেশ্বরবাচক অর্থ হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির প্রতিরূপক, তেমনিভাবে বেদে চর্চিত ব্যক্তিবাচক অন্য নামপদও বিভিন্ন কার্য এবং ব্যক্তির বিবিধ শক্তির প্রতীক । আচার্য যাস্ক বিভিন্ন ব্যক্তিবাচক নামের নির্বচন দর্শিয়েছেন । যথা- 'পিজবনঃ স্পর্দ্ধনীয়জবঃ। কুশিকঃ ক্রোশতেঃ শব্দকর্মণঃ ইত্যাদি।' অর্থ বৈবিধ্য দ্বারা যুক্ত এই সকল শব্দের নিবদ্ধ বেদের ভাষা সরল, সুবোধ, গূঢ়, রহস্যাত্মক এবং স্পষ্ট । বৈদিক ভাষা সূক্তিসমন্বিত, সপ্রাণ, সজীব এবং প্রভাবোৎপাদক ।
অপ্রকেত সলিলে তদেকম্ এর আধান দ্বারা উৎপন্ন অব্যক্ত বাণীর রুপান্তরই বৈদিক ভাষা । [8] এ কারণে এই ভাষায় অর্থের বিশদতা তথা সমৃদ্ধি বিদ্যমান । রূঢ় না হওয়ায় বৈদিক ভাষা অপরিমিত । এর প্রত্যেক পদ অনেক অর্থের দ্যোতক, যা আর্ষ পরম্পরায় যৌগিকবাদ নামে খ্যাত । বেদের ভাষা অতীন্দ্রিয়ার্থ দর্শী যোগীগণের হৃদয়ে প্রবিষ্ট ছিল । এর স্বরূপকে যজ্ঞ দ্বারাই জানা সম্ভব।[9] সব মনুষ্য এ ভাষার রহস্য বোধগম্যে অক্ষম । বৈদিক ভাষার রহস্য নিঘণ্টু তথা নিরুক্ত, ব্যাকরণাদি আর্ষ পরম্পরায় মান্য বেদাঙ্গের আশ্রয়েই জানা সম্ভব ।
শ্রীমৎ মহর্ষি স্বামী দয়ানন্দ জী বলেছেন, নিঘণ্টু শাস্ত্রে সঙ্কলিত পদনাম স্বীয় ধাতুজ অর্থের প্রকাশক হওয়ার সাথে-সাথে পদ শব্দের ধাতুজ অর্থের প্রকাশক, কেননা তা পদশব্দে পর্যায়। এই আধারে নিঘণ্টু শাস্ত্রের পদ নামসমূহ যেমন উর্বশী[10], চ্যবন[11], রুদ্র, যম, ইন্দ্র, বেন, পুরূরবাঃ[12] আদি ব্যক্তিবাচক (আপাতদৃষ্টিতে) পদ কোনো এক অর্থে রূঢ় শ্রেণির না হয়ে অনেক অর্থের প্রকাশক । এ কারণে এসব নামবাচক শব্দ লৌকিক ঐতিহাসিক ব্যক্তিবাচক নয় ।
বেদার্থ কখনও শব্দের অর্থ সীমায় নিবদ্ধ করা সম্ভব নয় । যখন আধ্যাত্মিক সাধনা পদ্ধতিতে বৈদিক ঋচার বিচার করা হয় তখনই বেদ স্বীয় রহস্যকে প্রকট করে, কেবল বাহ্য পাণ্ডিত্যের আধারে নয়। সত্য বেদার্থ জানার জন্য শাব্দিক পাণ্ডিত্যের সাথে তপস্যা তথা ঋষিবুদ্ধি অনিবার্য । এজন্যই যাস্কাচার্য বলেছেন, যে ব্যক্তি তপস্বী তথা ঋষি নয়, তার বেদার্থ স্পষ্ট হওয়া সম্ভব নয়।[13]
বেদে স্বয়ং বেদ মন্ত্রকে 'নিণ্যা বচাংসি' বলে সম্বোধন করা হয়েছে, যা কবি অর্থাৎ ক্রান্ত দর্শী বিদ্বানের জন্য ।[14]
বেদার্থ রূপী রথের দুটি চক্র বিদ্যমান- অধ্যাত্ম তথা রহস্য। এর সাধনা দ্বারাই ঋচাসমূহ স্বীয় স্বরূপ তথা তাৎপর্য প্রকট করে । নিম্ন মন্ত্র এই মাহাত্ম্যই তুলে ধরেছে-
মহো অর্ণঃ সরস্বতী প্র চেতয়তি কেতুনা । ধিয়ো বিশ্বা বি রাজতি ॥
ঋগ্বেদ ১।৩।১২
অর্থাৎ সরস্বতী অন্তর্দর্শন বা প্রজ্ঞান দ্বারা মানব চেতনাকে অবতরিত করিয়ে থাকে তথা আমাদের সমস্ত চিন্তনকে প্রদীপ্ত করে। এর পূর্ব ঋচায় সরস্বতীকে বাজেভির্বাজিনীবতী প্রকাশময় ঐশ্বর্য দ্বারা পরিপূর্ণ এবং ধিয়াবসু অর্থাৎ বিচার সম্পত্তি দ্বারা সমৃদ্ধ বলা হয়েছে, কিন্তু 'মহো অর্ণঃ' পদের সমানাধিকরণ মেনে অর্থ করলে সরস্বতী পাঞ্জাবের একটি নদী মাত্র প্রতীত হবে ।
একইভাবে বেদ মন্ত্রে বর্ণিত ‘ঋতম্’ পদের আধ্যাত্মিক অর্থ হলো পরম সত্য। যদি এর অর্থ জল বা অন্ন আদি অবান্তর অর্থ করা হয় তাহলে বেদার্থের গূঢ় রহস্য থেকে দূরে অবস্থান করা হবে । বেদে যত্রতত্র বর্ণিত ‘অগ্নি’ পদের অর্থ যদি যৌগিক পদ্ধতিতে 'ক্রতু হৃদি' অর্থাৎ ‘হৃদয়ের সত্য’ করা হয় তাহলে এই অর্থ অধিক ব্যাপক তথা উদাত্ত প্রকাশ করবে । ‘অগ্নি’ পদের অর্থ সাধারণ ভৌতিক অগ্নি অর্থ গ্রহণ করলে উক্ত সত্য প্রকট হবে না । একইভাবে ‘মিত্রাবরুণৌ’ পদকে 'ঋতাবৃধৌ' তথা ‘ঋতস্পৃশৌ’ অর্থে বর্ণনা করা হয়েছে। এই শব্দদ্বয়ের অর্থ হলো ‘সত্যের স্পর্শকর্তা’ তথা ‘অভিবৃদ্ধিকারক’। ‘গৌ’ শব্দ গোরু প্রাণীবাচক অর্থের পাশাপাশি ‘প্রকাশ’ বা ‘রশ্মি’বাচকও।
বেদার্থে বেদ
বেদ মন্ত্রের তিন প্রকার অর্থ হয়ে থাকে । ষড় বেদাঙ্গ বেদার্থে পরম সহায়ক । কিন্তু ষড় বেদাঙ্গ ব্যতীত বেদের মাধ্যমেও বেদ মন্ত্রের ব্যাখ্যা করা সম্ভব । বেদের অনেক মন্ত্রের শব্দার্থ স্বয়ং সেই সূক্ত বা মণ্ডলের, কিছু ক্ষেত্রে বেদের অন্য প্রকরণেও প্রকাশ করে থাকে ।
এই বিষয়ে সংক্ষিপ্তভাবে কতিপয় উদাহরণ দর্শানো হল-
(১). ঋগ্বেদ ১।১।১ নং মন্ত্রের পুরোহিত আদি বিশেষণযুক্ত অগ্নিকে স্তুতি করার বর্ণনা করা হয়েছে। এর পরের মন্ত্রেও অগ্নি’র চর্চা করা হয়েছে । এই সকল মন্ত্রের ‘অগ্নি’ পদের বিবিধ অর্থ করা সম্ভব, কিন্তু এই সূক্তেরই অন্তিম মন্ত্রে [15] বর্ণনা করা হয়েছে যে, “হে অগ্নে ! তুমি আমাদের ঐশ্বর্য প্রাপ্তির জন্য সুপথে নিয়ে চলো। তুমি আমাদের সমস্ত কর্ম সম্পর্কেই জ্ঞাত। তুমি আমাদের কুটিল পাপ থেকে রক্ষা করো । এজন্যে আমরা তোমার নম্রতাপূর্বক স্তুতি করি । এ স্থলে যে সকল গুণের কথা বলা হয়েছে, সেসবের সামর্থ্য একমাত্র পরমেশ্বরেই বিদ্যমান । পরমেশ্বরই সর্বান্তর্যামী, সর্বজ্ঞ । অতঃ তিনি আমাদের সমস্ত কর্ম সম্বন্ধে জানেন । ভৌতিক অগ্নি এসব করতে অসমর্থ। পরমেশ্বরই আমাদের মনে পাপ থেকে রক্ষা হতে প্রেরণা দেন । এই ভাবে উক্ত মন্ত্রের অর্থ কেবল পরমেশ্বরবাচকই হবে ; স্বয়ং বেদের অন্য মন্ত্রের আধারেই তা সিদ্ধ হয়ে গেলো।
(২). অথর্ববেদের একটি সুপ্রসিদ্ধ মন্ত্র-
অষ্টাচক্রা নবদ্বারা দেবানাং পূরয়োধ্যা ।
তস্যাং হিরণ্যয়ঃ কোশঃ স্বর্গো জ্যোতিষাবৃতঃ ॥
– অথর্ববেদ ১০।২।৩১
বেদার্থ বাঙ্ময় সম্বন্ধে অজ্ঞ কতিপয় তথাকথিত বিদ্বান এই মন্ত্রের অভিধেয়ার্থ আধারে রামায়ণকালীন অযোধ্যার বর্ণনা করে থাকে, কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্তিপূর্ণ। এ মন্ত্রে অযোধ্যাকে দেবগণের নগরী তথা জ্যোতি দ্বারা পূর্ণ হিরণ্যয় কোশের স্থিতি বর্ণনা করা হয়েছে ।
এই মন্ত্রের মূল ভাব এই সূক্তেরই অন্য মন্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে । এই শরীরই দেবপুরী, চক্ষু আদি দেবগণের নিবাস স্থান । এই অমৃত স্বরূপ পরমেশ্বর দ্বারা আবৃত।[16] এই হিরণ্যয়ী পুরী জীবের হিতকারী তথা রমণীয়।[17] এতেই শির রূপী দেবকোশ বিদ্যমান। মন, প্রাণ তথা অন্ন তার রক্ষা করে। [18] এই মস্তিষ্কই জ্যোতি প্রকাশ তথা জ্ঞান দ্বারা আবৃত স্বর্গলোক । সমস্ত দেবের অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহের সংজ্ঞা কেন্দ্র মস্তিষ্কেই অবস্থিত । মস্তিষ্কে সর্বত্র সংজ্ঞান কেন্দ্র (SENSORY AND MOTOR CENTRES) ছড়িয়ে রয়েছে । যে এই পুরীকে ভালোভাবে জেনে থাকে তথা তদনুসারে এর রক্ষা করে, তার বৃদ্ধাবস্থা হওয়ার পূর্বে তার প্রাণ তথা চক্ষু আদি ইন্দ্রিয় ত্যাগ করে না।[19] এই অর্থ যৌগিকবাদের আধারেই সম্ভব ।
অথর্ববেদ ৬।৯৫।৯ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে - “অশ্বত্থো দেবসদনস্তৃতীয়স্যামিতো দিবি”। এখানে অশ্বত্থকে দেবসদন বলা হয়েছে। এখানে বর্ণিত মস্তিষ্কের বিলক্ষণ নাড়ি জালই অশ্বত্থ বৃক্ষ, যার উপর দেবগণের বাস ।
(৩). ঋগ্বেদের একটি মন্ত্র –
কেশ্যগ্নিং কেশী বিষং কেশী বিভর্তি রোদসী।
কেশী বিশ্বং স্বর্দৃশে কেশীদং জ্যোতিরুচ্যতে॥
– ঋগ্বেদ ১০।১৩৬।১
যদি মন্ত্রে বর্ণিত ‘কেশী’ পদের অর্থ লৌকিক অনুযায়ী সমান কেশযুক্ত করা হয় তাহলে মন্ত্রার্থ অস্পষ্ট হবে। এ স্থলে স্বয়ং বেদই কেশী পদের অর্থ দর্শিয়েছে ; জ্যোতিকেই কেশী বলা হয়। এই সূর্য রূপী জ্যোতিই বিষ[20] অর্থাৎ উদককে তথা দ্যুলোক পৃথিবী লোককে ধারণ করে। এ মন্ত্রে কেশী পদের অর্থ জ্যোতি দেখিয়েই বেদ স্বয়ংই স্বীয় আশয়কে স্পষ্ট করে দিয়েছে। মহর্ষি যাস্কও এই অভিপ্রায় বর্ণনা করেছেন – “কেশীদং জ্যোতিরুচ্যত ইত্যাদিত্যমাহ।” মহর্ষি যাস্ক কেশী পদের নির্বচনও বেদ অনুযায়ী এটিই করেছেন যে, রশ্মিকে কেশা বলে, কেননা এটি প্রকাশক । রশ্মি দ্বারা যুক্ত হওয়ার কারণে সূর্যই কেশী।[21]
(৪). কোথাও-কোথাও প্রশ্নাত্মক শৈলীতে বেদ স্বীয় আশয়কে স্বয়ং স্পষ্ট করেছে। যজুর্বেদে এমন মন্ত্র পর্যাপ্ত বিদ্যমান। যথা “পৃচ্ছামি ত্বা পরমন্তং পৃথিব্যাঃ” মন্ত্রের উত্তর “ইয়ং বেদিঃ পরোঽন্তঃ পৃথিব্যাঃ”[22] মন্ত্রে দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি। এরূপ ভাবে অথর্ববেদ (৫।১০।২) মন্ত্রে প্রশ্নাত্মিকা শৈলীতে বলা হয়েছে- “কেন নু ত্বমথর্বন্ কাব্যেন কেন জাতেনাসি জাতবেদাঃ।” এর উত্তর পরবর্তী মন্ত্রেই বর্ণনা করা হয়েছে- “সত্যমহং গভীরঃ কাব্যেন সত্যং জাতেনাস্মি জাতবেদাঃ।”
(৫). অথর্ববেদের একটি মন্ত্রে ভিন্ন-ভিন্ন স্বরূপবিশিষ্টা দুই যুবতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। [23] শাব্দিক অর্থ দ্বারা এই মন্ত্রের কোনোকিছু স্পষ্ট হবে না । কিন্তু এই সূক্তেরই ৬ষ্ঠ মন্ত্রে[24] উক্ত মন্ত্রকে কেন্দ্র করে বর্ণনা করা হয়েছে যে, দিন তথা রাত্রীর রূপই হলো এই দুই যুবতি। এই দুইয়ের স্বভাব পরস্পর বিপরীত । সুতরাং মন্ত্রের যুবতি অর্থ দিন তথা রাত্রীবাচক ।
(৬). ঋগ্বেদের আরও একটি মন্ত্র -
“আ বহেথে পরাকাৎপূর্বীরশ্নন্তাবশ্বিনা”
– ঋগ্বেদ ৮।৫।৩১
এই মন্ত্রের "অশ্নন্তাবশ্বিনা" পদ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য । স্বয়ং বেদ মন্ত্রই অশ্বিনী শব্দের ব্যুৎপত্তি পরমপিতা পরমাত্মা অর্থে দর্শিয়েছে । "অশ্নন্তৌ" হওয়ার কারণে 'অশ্বিনৌ' বলা হয় । এই স্বতঃ প্রমাণ বেদ দ্বারাই সিদ্ধ করা হলো ।
বৈদিক শব্দের যে অর্থ বেদে বিদ্যমান, লৌকিক অর্থে সেই শব্দই অন্য অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। যথা লৌকিকে ‘অপ্সরা’ শব্দ রূপবতী স্ত্রী অর্থে প্রসিদ্ধ । বেদে ‘উর্বশী’ তথা ‘অপ্সরা’ এ দুই শব্দ বিদ্যুৎবাচক। টীকাকার দুর্গাচার্য অর্থ করেছেন জল থেকে বের হওয়ার কারণে একে অপ্সরা বলে।[25] আবার স্ত্রী পক্ষে “অপ্স’ অর্থ ‘রূপ’।[26] 'র' প্রত্যয় মত্বর্থ । এই দুই নির্বচন প্রসঙ্গানুকূলেই অর্থ করা উচিত । প্রকরণ বিরুদ্ধ যদি কোনো শব্দের ব্যাখ্যা করা হয় তাহলে তা বাস্তবিক অর্থবোধক হবে না ।
বৈদিক শব্দরাজির ব্যাখ্যা প্রকরণাকূলই হতে হবে। এই প্রকরণ কোনো একটি সূক্তেও থাকতে পারে তথা অনেক সূক্তেও ব্যাপ্ত হয়ে থাকতে পারে । ‘দূরান্বয়’ আধারে প্রকরণ চলতেই থাকবে । যথা- পাণিনীয় অষ্টাধ্যায়ীতে ‘মণ্ডূকপ্লুতি ন্যায়’ এর মাধ্যমে অনুবৃত্তিসমূহ এক টানা চলেছে । কোথাও-কোথাও প্রকরণ বা প্রসঙ্গ অনেক সূক্তেও থাকতে পারে । যথা- সামবেদেরই প্রথম মন্ত্র - “অগ্ন আয়াহি বীতয়ে গৃণানো হব্য দাতয়ে। নি হোতা সৎসি বর্হিষি।” আচার্য সায়ণ এই মন্ত্রের যজ্ঞপরক ব্যাখ্যা করেছে । পরন্তু সামবেদ উপাসনা কাণ্ডের অন্তর্গত । তাই সামবেদের ব্যাখ্যা আধ্যাত্মিক প্রধানই হওয়া উচিৎ । সুতরাং প্রথম মন্ত্রের ‘অগ্নি’ পদ পরমেশ্বরবাচকই গৃহীত হবে । তা ছাড়া সামবেদের পূর্বাচিক ৭৯ তম মন্ত্রে অগ্নি পদেরই আধ্যাত্মিক স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে ।
সাহচর্য- অর্থনির্ধারণে সাহচর্য নিয়ম অত্যন্ত মহত্ত্বপূর্ণ । বৈদিক তথা লৌকিক শব্দ উভয়ই এই নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
যথা- ‘মিত্র’ তথা ‘বরুণ’ পদ বেদে বিভিন্ন অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে, কিন্তু যদি অনেক স্থলে এই দুই পদ একত্রে প্রযুক্ত হয় তাহলে সেই প্রকরণে জলের উৎপত্তি বিজ্ঞানের বর্ণনা করা হয়েছে -
“মিত্র হুবে পূতদক্ষং বরুণং চ রিশাদশম্। ধিয়ং ঘৃতাচীং সাধন্তা”
–ঋগ্বেদ ১।২।৭
এই মন্ত্রে “ঘৃতাচীং” পদও বিদ্যমান। মন্ত্রে এই পদ ‘ধিয়ম্’ পদের বিশেষণ । নিঘণ্টু (১।১২)তে ‘ঘৃত’ পদ ‘উদক’ নামে পঠিত হয়েছে । মন্ত্রে মিত্র তথা বরুণকে জলের উৎপাদক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । আধুনিক বিজ্ঞান অনুসারে অক্সিজন = O তথা হাইড্রোজন = H এই দুই মৌল মিলেই জলোৎপত্তি হয়ে থাকে । যখন এই দুই ধারা অন্তরিক্ষে পরস্পর অবস্থান করে, তখনই বর্ষা হয় । এটাই বৃষ্টিবিজ্ঞান ।
সন্দর্ভ
1.ঋগ্বেদ ১০।১৫৯।৩
2.ঋগ্বেদ ১০।১১৯।৯
3. ঋগ্বেদ ১০।৫৫।৫
4. ঋগ্বেদ ৩।৬১।১
5. ঋগ্বেদ ১০।১২৯।৭
6. ঋগ্বেদ ৭।৬৬।১৬
7.যজুর্বেদ ২৩।৪৮
8. ঋগ্বেদ ১০।১২৯।৩
9.ঋগ্বেদ ১০।৭১।৩
10. নিঘণ্টু ৪।২
11. নিঘণ্টু ৪।১
12. নিঘণ্টু ৪।৪
13.নিরুক্ত ১৩।১২
14. ঋগ্বেদ ৪।৩।১৬
15. ঋগ্বেদ ১।১৮৯।১
16.অথর্ববেদ ১০।২।২৮, ১০।২।৩৩
17. নিরুক্ত ২।১০
18. অথর্ববেদ ১০।২।২৭
19. অথর্ববেদ ১০।২।৩০
20. নিঘণ্টু ১।১২
21. নিরুক্ত ১২।২৫
22. যজুর্বেদ ২৩।৬২
23. অথর্ববেদ ১০।৭।৪২
24. অথর্ববেদ ১০।৭।৬
25. অপঃ প্রতি নিত্যমেব সরতি তৎপ্রভবত্বাৎ। অথবা অদ্ভয়ঃ সৃতেত্যপ্সরাঃ।
(নিরুক্ত ৫।১৩. দুর্গটীকা)
26. নিঘণ্টু ৩।৭

0 মন্তব্য(গুলি)