বর্তমান সমাজে প্রচলিত শাস্ত্রের সংখ্যা শতাধিক। কিন্তু এসব শাস্ত্রে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মতই বেশী প্রতিফলিত হয়েছে। মূলত শাস্ত্রের মূল স্রোত হলো বেদ। এ জন্য মনু মহারাজ ধর্ম জিজ্ঞাসমনানং প্রমাণ পরম শ্রুতি ইহা মেনেছেন।
বাহ্য অন্ধকার দূর করার জন্য পরমাত্মা যেমন সূর্যের প্রকাশ দিয়েছেন। সেই প্রকার মনের অন্ধকার দূর করার বেদ জ্যোতি প্রকাশ করেছেন। যাতে সবাই শ্রেয় লাভ করে এবং সকলের কল্যান লাভ হয়।
কিন্তু বেদ বিষয়ে আজ সবচেয়ে প্রচলিত ভ্রম এই যে, বেদের মধ্যে পশুবলি তথা মাংসাহারের বিধান রয়েছে। এই ভ্রান্তির মূখ্য কারন পাশ্চাত্য বিদ্বান যেমন ম্যাক্সমুলার, গ্রিফিথ আদি এবং মধ্য কালে সায়ন, মহিধর আদি। কারন এদের বেদ ভাষ্যে পরিষ্কারভাবে পশু হত্যা তথা মাংসাহারের বর্ণনা রয়েছে। যার দরুন আজ বিধর্মীরা পর্যন্ত এই দাবী উপস্থাপন করে যে বেদে মাংসাহারের সমর্থন রয়েছে। কিন্তু এই দাবী ভিত্তি কতটুকু সত্য তা আমরা এই লেখায় বিস্তারিত পর্যালোচনা করে দেখবো।
অথর্ববেদ ৮।৩।১৫ তে আমরা দেখতে পাই সেখানে বেদ মাংস ভক্ষের সাপোর্ট না করে বরং মাংসাহারী কে কঠোরতম দন্ডের বিধান দিচ্ছে -
যঃ পৌরষেযেণ ক্রবিষাং সমঙ্কতে যো অশ্বয়েন পশুনাং যতুধান।
যো অঘ্ন্যায় ভরতি ক্ষীরমগ্নে তেষাং শীর্ষাণি হরসাপি বৃশ্চ।।
(অথর্ববেদ ৮।৩।১৫)
---- যে দুঃখদায়ী জীব পুরুষ বধ দ্বারা প্রাপ্ত মাংস দ্বারা যে ঘোড়ার মাংস এবং পশু দ্বারা নিজেকে পুষ্ট করে এবং যে হত্যার অযোগ্য গাভীর দুধকে নষ্ট করে হে অগ্নি তাহার শির কে নিজের বল দ্বারা ছিন্ন করো।
মনুস্মৃতিতে ও মাংসকে অত্যন্ত ঘৃণার সাথে দেখা হয়েছে এবং মাংস ভোজীদের ঘাতক সঙ্গা দেওয়া হয়েছে -
সমুপত্তিঞ্চ মাংসস্য বধবন্ধৌ চ দেহিনাম।
প্রসমীক্ষ নিবর্তে সর্ব্বমাংস্য ভক্ষণাৎ।।
(মনুস্মৃতি, ৫।৪৯)
--- শুক্র শোনিক দ্বারা মাংসের উৎপত্তি হইয়া থাকে অতএব ইহা ঘৃণিত। এবং বধ ও বন্ধন নিষ্ঠুর হদয়ের কর্ম। ইহা নিশ্চয় করিয়া সাধুরা মাংস ভক্ষন হইতে নিবৃত হন।
অনুমন্তা বিশাসিতা নিহতা ক্রয়বিক্রয়ী।
সংস্কর্তা চোপর্হত্তা চ খাদকশ্চেতি ঘাতক।
(মনুস্মতিঃ ৫।৫১)
--- যাহার অনুমতিতে পশু হনন করা হয়, যে অস্ত্র দ্বারা পশুর অঙ্গ প্রতঙ্গ খন্ড করা হয়, যে পশু বধ করে, যে মাংসের ক্রয় বিক্রয় করে, যে মাংস পাক করে, যে মাংস পরিবেশন করে, যে ব্যক্তি ভোজন করে ইহাদিগকে ঘাতক বলা যায়।
বিদ্বান পন্ডিতরা মাংস শব্দের অর্থ নিম্নোক্ত প্রকার করেছেন -
মাংসাভক্ষয়িতামুত্র যস্য মাংসমিহাদ্ম্যহম।
(মনুস্মৃতিঃ ৫।৫৫)
--- (মাম = আমাকে, স= ভোজন করবে) ইহ লোকে আমি যাহার মাংস ভোজন করিতেছি পরলোকে সে আমাকে ভোজন করবে।
যেহেতু হত্যা ব্যতিত মাংস প্রাপ্ত হয় না। সেহেতু বেদ বহু জায়গায় পরিষ্কারভাবে পশু হত্যার নিষেধ করেছে। এবং সেই সাথে সেসব হত্যাকারীকে শাস্তির বিধান দিয়েছে-
ইমং মা হিংসীদ্বিপাদ পশু সহস্রাক্ষ মেধায় চীয়মান।
(যজুর্বেদ ১১।৪৭)
---- হে সহস্র প্রকার দৃষ্টি যুক্ত রাজন! সুখ প্রাপ্ত করানোর জন্য নিরন্তর বৃদ্ধিশীল এই দ্বিপদী মনুষ্য এবং পশুকে হত্যা করো না।
প্র নু বোচং চিকিতুষে জনায় মা গামনাগা মদিতিং বধিষ্ট।।
(ঋগবেদ ৮।১০১।১৫)
--- হে জ্ঞানবান পুরুষের নিকট আমি বলেতেছি নিরপরাধ অহিংস পৃথিবী সদৃশ গাভীকে হত্যা করিও না।
যদি নো গাং হংসি যদ্যশ্বং যদি পুরুষম।তং ত্বা সীসেন বিধ্যামো যথা নোহসো অবীরহা।।
(অথর্বেদ ১।১৬।৪)
--- যদি আমাদের গাভীকে হিংসা কর যদি অশ্বকে যদি মনুষ্যকে হিংসা কর তবে তোমাকে সীসক দ্বারা বিদ্ধ করিব যাহাতে আমাদের মধ্যে বীরদের বিনাশক কেহ না থাকে।
"অনাগো হত্যা বৈ ভীমা কৃত্যে মা নো গাম অশ্বম পুরুষং বধী"
(অথর্ববেদ ১০।১।২৯)
--- নির্দোষের হত্যা অবশ্যই ভয়ানক। আমাদের গাভী, অশ্ব, পুরুষকে মেরো না।
"গোঘাতম্ ক্ষেধে যঃ গাম্ বিকৃন্তন্তম"
(যজুর্বেদ ৩০।১৮)
- গাভীর ঘাতক অর্থাৎ হত্যাকারী যে, ক্ষুধার জন্য গাভীকে হত্যা করে। তাকে দূর করি।
" অদিতিম মা হিংসী"
(যজুর্বেদ ১৩। ৪৯)
- হত্যার অযোগ্য গাভীকে কখনো মেরো না।
" মা গাম অনাগাম অদিতিম বধিষ্ট"
(ঋগবেদ ৮।১০১।১৫)
--- নিরপরাধ গাভী এবং ভূমিতূল্য গাভীকে কখনো বধ করো না।
--- "অঘ্না ইব" গাভী সমূহ বধের অযোগ্য। সর্বদা ( পশুন ত্রায়েথাম, যজুঃ ৬।১১) পশুদের রক্ষা করো তাদের পালন করো (অঃ ৩।৩০।১)।
অনেকে আবার এই কুতর্ক করা আরম্ভ করে যে, বৈদিক কালে সরাসরি মাংস ভক্ষন না করলেও যজ্ঞে পশুকে আহুতি দিয়ে তারপর করতো। কিন্তু যজ্ঞ সর্বদাই পবিত্র সেখানে কোনরুপ হত্যা সম্ভব নয়। সে জন্যই বেদ যজ্ঞকে অধ্বর সঙ্গা দিয়েছে। নিরুক্ত সংহিতা ১।৮ এ অধ্বর শব্দের অর্থ বলা হয়েছে "অধ্বর ইতি যজ্ঞনাম ধ্বরতিহিংসাকর্মা তৎপ্রতিষেধ " অধ্বর = হিংসারহিত কর্ম অর্থাৎ যাহাতে কোন রূপ হত্যা হয় না।
রাজসূয়ং বাজপেয়মগ্নিষ্টোমস্তদধ্বরঃ।
অর্কাশ্বমেধাবুচ্ছিষ্ট জীবর্বহিভমদিন্তম।।
(অথর্ববেদ ১১।৭।৭)
--- রাজসূয়, বাজপেয়, অগ্নিষ্টোম এইসব যজ্ঞ অধ্বর অর্থাৎ হিংসারহিত। অর্ক এবং অশ্বমেধ যজ্ঞ প্রভূর মধ্যে স্থিত, যাহা জীবের বৃদ্ধিকারী এবং অতন্ত্য হর্ষদায়ক।
অগ্নে যঃ যজ্ঞমধ্বরং বিশ্বত বিশ্বতঃ পরিভূরসি। স ইদ্দেবেষু গচ্ছতি।।
(ঋগবেদ ১।১।৪)
--- হে পরমেশ্বর যে অধ্বর অর্থাৎ হিংসা রহিত যজ্ঞকে সর্বত্র ব্যাপক হয়ে সব প্রকারে পালনকারী। এই হিংসারহিত যজ্ঞে বিদ্বান লোক সুখ প্রাপ্ত করে।
যজ্ঞের জন্য অধ্বর (হিংসারহিত) শব্দের প্রয়োগ ঋগবেদ ১।১।৮, ১।১৪।২১, ১।১৯।১, ১।২৮।১, ৩।২১।১ এরূপ বহু স্থলে এসেছে। এবং মহাভারতেও স্বীকার করা হয়েছে যে যজ্ঞে পশু হত্যার স্বিকৃতি নেই। এগুলো যে ধূর্তেরাই প্রচলন করছে সে কথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে -
সুরা মৎসা মধু মাংসমাসবং কৃসরোদনম্।
ধুর্তেঃ প্রবর্তিতং হোতন্নৈবদ্ বেদেষু কল্পিতম।।
(মহাঃ শান্তি পর্বঃ ২৬৫,শ্লোক ৯)
---সুরা, মৎস, মধু, মাংস, তালরস, স্বাগু এইসব বস্তুকে ধুর্তেরাই যজ্ঞে প্রচলিত করেছে। বেদে এসব উপযোগের বিধান নেই।
অব্যবস্থিতমর্যদৈবিমূঢর্নাস্তিকৈর্তবৈ।
সংশয়াত্মাভিরব্যক্তৈহিংসা সমনুবর্তিত।।
(মহাঃ শান্তি পর্বঃ অঃ ২৬৫, শ্লোক ৪)
--- যে ধর্মের মর্যাদা থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে মূর্খ, নাস্তিক তথা যার আত্মা সংশয়যুক্ত এবং যার কোন প্রসিদ্ধি নেই এইরূপ লোকই হিংসাকে সমর্থন করে।
মানান্মোহাচ্চ লোভাচ্চ লৌল্যমেত্যপ্রকল্পিতম্।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব, অঃ ২৬৫, শ্লোক ১০)
--- সেই ধূর্তেরা অভিমান, মোহ এবং লোভের বশীভূত হয়ে সেই সব বস্তুর প্রতি লোলুপতা প্রকট করে থাকে।
যজ্ঞের মহিমা বর্ণনার জন্য পিতামহ ভীষ্ম যুধিষ্ঠির কে এক উপ্যাখান শোনান। উপাখ্যান টি মহাভারতের শান্তি পর্বের ২৭২ নং অধ্যায়ে এসেছে। সেই উপখ্যানে এক ব্রাহ্মণ যিনি কি না যজ্ঞে পশু বলি দেবার কথা চিন্তা মাত্রেই তার সমস্ত তপস্যা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।
তস্য তেনামুভাবনো মৃগহিংমমসাত্মনস্তদা।
তপো মহৎসমুচ্ছিন্নং তস্মাদ্হিংসান যজ্ঞিয়া।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব, অঃ২৭২, শ্লোক ১৮)
----আমি সেই পশু কে বধ করে স্বর্গলোক প্রাপ্ত করবো। এই ভেবে মৃগকে হিংসা করার জন্য উদ্যত সেই ব্রাহ্মণের মহান তপস্যা তৎক্ষণাৎ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই জন্য হিংসা যজ্ঞের জন্য হিতকর নয়।
এই জন্য বেদ আমাদের সর্বদা হিংসারহিত কর্ম করার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং আমাদের শরীর এবং দন্তের উপযোগী খাবার হিসেবে ভাত, ডাল,যব ইত্যাদি এসব খাবারের অনুমোদন দিয়েছে।
ব্রীহিমন্নং যবমত্তমথো মাষমথো তিলম ।
এষ বাং ভাগো নিহিতো রত্নেধেয়ায় দন্তৌ মা হিংসিষ্ট পিতরং মাতরং চ।।
(অথর্ববেদ ৬।১৪০।২)
--- হে দন্ত! অন্ন খাও যব খাও মাষ কালাই এবং তিল খাও তোমার এই ভাগ উত্তম পদার্থ ধারনের জন্য স্থাপন করা হয়েছে হে দন্ত! পিতা ও মাতাকে হিংসিত করো না [মাংসাহার থেকে দূরে থাকো]
এবং বেদ মন্ত্রে সেই পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে যে, আমাদের দন্ত যেন ব্যাঘের ন্যায় না হয়। কারন বাঘের দন্ত সর্বদা মাংসাহার করে থাকে। সে জন্য আমাদের দন্ত কে ব্যাঘের ন্যায় না করে কল্যাণকারী করো।
যৌ ব্যাঘ্রাববরূঢৌ জিঘত্সতঃ পিতরং মাতরং চ।
তৌ দন্ত ব্রহ্মণস্পতে শিবৌ কৃণু জাতবেদঃ।।
(অথর্ববেদ ৬।১৪০।১)
--- যে দন্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় পিতা ও মাতাকে খাওয়ার জন্য চেষ্টা করে সেই দাঁত কে হে সর্বব্যাপক জ্ঞানের পরিপালক কল্যাণকারী করো।
অর্থাৎ বেদ আমাদের সর্বদাই কল্যাণকারী হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। যাতে করে আমাদের কাছ থেকে কেউ যেন কষ্ট না পায়। আমরা যেন নিরীহ প্রাণীদের হিংসা না করি। কারন, "অহিংসা পরম ধর্ম " (মহাঃ আদিঃ অঃ ১১, শ্লোঃ ১৩) এবং "হিংসা অধর্মস্তথহিত" (মহাঃ শান্তিঃ ২৭২, শ্লোক ১৮) হিংসা অধর্ম এবং অহিতকর। "প্রাণিনামবধস্তাত সর্বজায়ান্" (মহাঃ কর্ণ পর্ব, অঃ ২৬৯, শ্লোক ২৩) অর্থাৎ প্রাণীদের বধ না করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
জীবিতুং যঃ স্বযং চেচ্ছেত্ কথং সোন্যং প্রঘাতয়েত।
যদ যদাৎমসি চেচ্ছেত তত পরস্যাপি চিন্তয়েত।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব, অঃ ২৫৯, শ্লোক ২২)
--- যে স্বয়ং জীবিত থাকতে চায় সে অন্যের প্রাণ কিভাবে নিতে পারে? মানুষ নিজের জন্য যে যে সুখ সুবিধা চায় সে অন্যের জন্যও সুখের চিন্তা করে।
এ জন্যই বেদ বলছে -
স্বস্তি মাত্রে উত পিত্রে নো অস্তু স্বস্তি গোভ্যো জগতে পুরুষেভ্যঃ।
বিশ্বং সুভুতং সুবিদত্রং নো অস্তু জ্যোগেব দৃংশেম সূর্যম।।
(অথর্ববেদ ১।৩১।৪)
--- আমাদের মাতার জন্য এবং পিতার জন্য সুখদায়ক হও এবং গাভীর জন্য পুরুষের জন্য জগতের জন্য সুখদায়ক হও সম্পূর্ণ উত্তম ঐশ্বর্য এর উত্তম জ্ঞান আমাদের জন্য হও এভাবে বহু কাল পর্যন্ত সূর্য কে ই দেখতে থাকবো।
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি
Joss
ReplyDelete"ভক্ষ্য ও অভক্ষ্য সম্পর্কে বেদোক্ত নির্দেশ" এই লেখাতে তো অথর্ববেদ(৬/১৪০/২) এর ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়া আছে।
ReplyDeleteব্রীহি মত্তং যবমত্তমথো তিলম্।
এষ বাং ভাগো নিহিতো রত্ন ধেয়ায় দন্তৌ মা হিংসিষ্টং পিতরং মাতরং চ।।
(অথর্ববেদ ৬।১৪০। ২ )
বঙ্গানুবাদঃ —
চাউল, যব, মাষ এবং তিল ভক্ষণ কর।
রমণীয়তার জন্য ইহাই তোমাদের জন্য বিহিত
হইয়াছে! পালক ও রক্ষককে ভক্ষণ করিও না।
কোনটা অধিক গ্রহণযোগ্য???