শত কৌরবের জন্ম রহস্য
মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্রের ১০০শত পুত্রের ইতিহাস আছে। এই একশ পুত্র সম্পর্কে মোটামুটি দুই প্রকার ধারণা প্রচলিত -
১। ১০০ পুত্র বেদব্যাসের তপপ্রভাবে গান্ধারীর প্রসবিত পিণ্ড থেকে জন্মেছে ।
২। টেস্টটিউব বেবী হিসেবে জন্মেছে। তারা টেস্টটিউব বলতে বুঝেন কলসির বা ঘটের মধ্যে ঐ খণ্ড করা পিণ্ডগুলো বড় হয়েছে।
প্রথমটি অলৌকিক এই হিসেবে অগ্রহণযোগ্য। আর যারা টেস্টটিউব সন্তানের কথা বলেন তারা আসলে সম্পূর্ণ প্রসেসটা না বুঝেই এক প্রকার জোড়াতালি দেওয়ার চেষ্টা করেন।
টেস্টটিউব বেবি একটি সাধারণ এবং একটি অ-চিকিৎসা শব্দ যা ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) শিশুর জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, এটি কেবল যেভাবে বলে।
আইভিএফ-এর মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুটি সফল নিষিক্তকরণের ফল যার মধ্যে একটি পুরুষ এবং একজন মহিলার মধ্যে যৌন মিলনের পরিবর্তে ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু কোষ উভয়ই হস্তক্ষেপের সাথে চিকি সার হস্তক্ষেপ জড়িত।
একটি টেস্ট-টিউব বেবি একটি শব্দ যা একটি ভ্রূণকে বর্ণনা করে যা ফ্যালোপিয়ান টিউবের পরিবর্তে একটি টেস্ট টিউবে তৈরি হয়। ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু একটি পরীক্ষাগারের থালায় নিষিক্ত হয় এবং নিষিক্তকরণের এই প্রক্রিয়াটি যা একটি গ্লাস বা পেট্রি ডিশে ঘটে তাকে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বলে। তাই টেস্টটিউব বেবি টেকনিককে ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) বলা হয়।
সূত্র: https://www.mayoclinic.org/tests-procedures/in-vitro-fertilization/about/pac-20384716
এখানে দেখা যাচ্ছে, নিষেক প্রক্রিয়াটি টেস্টটিউবে হয় বলেই নাম টেস্টটিউব বেবি। কিন্তু শিশুটিকে মাতৃগর্ভে আবার স্থাপন করা হয়, সেখানেই সে বড় হয় ও মা সন্তানকে জন্মদান করেন। এমন না যে বাচ্চাটি টেস্টটিউবের মধ্যে বড় হচ্ছে। শুধু পিতার শুক্রাণু ও মায়ের ডিম্বাণুর নিষেকটি বাইরে ঘটিয়ে তা আবার মায়ের জরায়ুয়ে স্থাপন করা হয়।
অর্থাৎ দুটো সম্ভাবনাই বাতিল। তাহলে কী ১০০ পুত্র কী কাল্পনিক, পাশাপাশি দুঃশলা নামের এক কন্যা ? সেটিও সম্ভব না কেননা মহাভারতে যত্রতত্র এদের প্রসঙ্গ, উল্লেখ ও কর্ম বর্ণনা আছে। প্রচলিত মহাভারত বলে -
ব্যাস বর দিয়েছিলেন যে গান্ধারীর শত পুত্র হবে। যথাকালে গান্ধারী গর্ভবতী হলেন, কিন্তু দুই বৎসরেও তাঁর সন্তান ভূমিষ্ঠ হ’ল না এবং কুন্তীর একটি পুত্র (যুধিষ্ঠির) হয়েছে জেনে তিনি অধীর ও ঈর্ষান্বিত হলেন। ধৃতরাষ্ট্রকে না জানিয়ে গান্ধারী নিজের গর্ভপাত করলেন, তাতে লৌহের ন্যায় কঠিন একটি মাংসপিণ্ড প্রসূত হ’ল। তিনি সেই পিণ্ড ফেলে দিতে যাচ্ছিলেন এমন সময় ব্যাস এসে বললেন, আমার কথা মিথ্যা হবে না। ব্যাসের উপদেশে গান্ধারী শীতল জলে মাংসপিণ্ড ভিজিয়ে রাখলেন, তা থেকে অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ এক শ এক ভ্রূণ পৃথক হ’ল। সেই ভ্রূণগুলিকে তিনি পৃথক পৃথক ঘৃতপূর্ণ কলসে রাখলেন। এক বৎসর পরে একটি কলসে দুর্যোধন জন্মগ্রহণ করলেন।
দুর্যোধন জ’ন্মেই গদর্ভের ন্যায় কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার ক’রে উঠালেন, সঙ্গে সঙ্গে গৃধ্র শৃগাল কাক প্রভৃতিও ডাকতে লাগল এবং অন্যান্য দুর্লক্ষণ দেখা গেল। ধৃতরাষ্ট্র ভয় পেয়ে ভীষ্ম বিদুর প্রভৃতিকে বললেন, আমাদের বংশের জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র যুধিষ্ঠির তো রাজ্য পাবেই, কিন্তু তার পরে আমার এই পুত্র রাজা হবে তো? শৃগালাদি শ্বাপদ জন্তুরা আবার ডেকে উঠল। তখন ব্রাহ্মণগণ ও বিদুর বললেন, আপনার পুত্র নিশ্চয় বংশ নাশ করবে, ওকে পরিত্যাগ করাই মঙ্গল। পুত্রস্নেহের বশে ধৃতরাষ্ট্র তা করলেন না। এক মাসের মধ্যে তাঁর দুর্যোধন দুঃশাসন দুঃসহ প্রভৃতি একশত পুত্র এবং দুঃশলা নামে একটি কন্যা হ’ল। গান্ধারী যখন গভর্ভারে ক্লিষ্ট ছিলেন তখন এক বৈশ্যা ধৃতরাষ্ট্রের সেবা করত। তার গর্ভে যুযুৎসু নামক পুত্র জন্মগ্রহণ করে।
সূত্র: মহাভারত আদিপর্ব ১১৫-১১৬ অধ্যায়, প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা ভালো ১১৭ অধ্যায়ে শতপুত্রের নামও আছে।
▪️ কাহিনীতে বিসঙ্গতিঃ
বেদব্যাস বর দিলেন ১০০, ভ্রুণ ভাগ হলো ১০১ কেন ? আর এই ভাগ নিয়েও পরস্পর বিরোধ আছে ক্রমাগত দুই অধ্যায়ে । একবার বলা হলো গান্ধারীর জলসেচনে মাংসপিণ্ড ১০১ খণ্ডে বিভক্ত হয় -
সুগুপ্তেষু চ দেশেষু রক্ষা চৈব বিধীয়তাম্॥
শীতাভিরদ্ভিরষ্ঠীলামিমাং চ পরিষিঞ্চয়॥
সা সিচ্যমানা হ্যষ্ঠীলা হ্যভবচ্ছতধা তদা।
অঙ্গুষ্ঠপর্বমাত্রাণাং গর্ভাণাং তৎক্ষণং তথা॥
একাধিকশতং পূর্ণং যথায়োগং বিশাম্পতে।
ততঃ কুণ্ডশতং তত্র আনায়্য তু মহানৃষিঃ॥ [অধ্যায় ১১৪]
ঠিক তার পরের অধ্যায়েই [১১৬] বলা হলো, বেদব্যাস জলসিঞ্চন করে নিজেই মাংসপিণ্ডকে ১০১ ভাগে বিভক্ত করেছেন ও তিনি গুণে দেখলেন ১০১ ভাগ হয়েছে -
অভবচ্চাপরং খণ্ডং বামহস্তে তদা কিল।'
গণয়িত্বা শতং পূর্ণমংশানামাহ সৌবলীম্॥
ব্যাস উবাচ
পূর্ণং পুত্রশতং ত্বেতন্ন মিথ্যা বাগুদাহৃতা।
দৈবয়োগাচ্চ ভাগৈকঃ পরিশিষ্টঃ শতাৎপরঃ॥
এষা তে সুভগা কন্যা ভবিষ্যতি যতেপ্সিতা।
দুটো পরস্পর বিরোধী ঘটনায় প্রমাণিত হয় অলৌকিকতা দেখাতে চেয়ে প্রক্ষিপ্তকারী আসলে অত্যন্ত অপরিপক্বের মতো কাজ করেছে।
১১৫ অধ্যায়ে বলা হয়েছে -
প্রথমে দুর্যোধনের জন্ম হয়। তারপর বাকি ৯৯ পুত্র ও দুঃশলা নামে কন্যা জন্মগ্রহণ করে। পাশাপাশি ধৃতরাষ্ট্রের ভার্যা বর্ণতঃ বৈশ্যার গর্ভে যুযুৎসু নামের সন্তান হয়।
▪️রাজা ধৃতরাষ্ট্রের বহুস্ত্রী:
মহাভারতের ক্রিটিক্যাল এডিশন অর্থাৎ পুনা সংস্করণের টীকায় অন্যান্য পাণ্ডুলিপিতে উপস্থিত হিসেবে কিছু শ্লোকের উল্লেখ করা হয়েছে, এই শ্লোকগুলো কুম্ভঘোণম্ সংস্করণেও ১১৯ অধ্যায়ে পাওয়া যায় -
তস্যাঃ সহোদরাঃ কন্যাঃ পুনরেব দদৌ দশ।
গান্ধাররাজঃ সুবলো ভীষ্মেণ বরিতস্তদা॥
সত্যব্রতাং সত্যসেনাং সুদেষ্ণাং চ সুসংহিতাম্।
তেজঃশ্রবাং সুশ্রবাং চ তথৈব নিকৃতিং শুভাম্॥
শম্ভুবাং চ দশার্ণাং চ গান্ধারীর্দশ বিশ্রুতাঃ।
একাহ্না প্রতিজগ্রাহ ধৃতরাষ্ট্রো জনেশ্বরঃ॥
ততঃ শান্তনবো ভীষ্মো ধনুষ্ক্রীতাস্ততস্ততঃ।
অদদাদ্ধৃতরাষ্ট্রায় রাজপুত্রীঃ পরশ্শতম্॥
অর্থাৎ, গান্ধাররাজ সুবল গান্ধারীর ১০ বোনের সাথেও ধৃতরাষ্ট্রের বিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের নাম সত্যব্রতা, সত্যসেনা, সুদেষ্ণা, সুসংহিতা, তেজঃশ্রবা, সুশ্রবা, নিকৃতি, শুভা, শম্ভুবা ও দশার্ণা। ধৃতরাষ্ট্র একই দিনে সবাইকে বিয়ে করেছিলেন। শান্তনু পুত্র ভীষ্ম ধনুর্বলে আরো ভিন্নস্থানীয় কন্যার সাথেও ধৃতরাষ্ট্রের বিয়ে দিয়েছিলেন।
📍 অনেকেই বলতে পারেন, এই শ্লোক সব সংস্করণে নেই তাহলে কীভাবে মেনে নেবো ১০ বা একাধিক পত্নীই ছিলো। আসুন আমরা আভ্যন্তরীণ প্রমাণ দ্বারাই এর সমাধান করবো -
১। পাণ্ডবগণ বারণাবতে যাওয়া আগে 'সর্বমাতৃগণের' আজ্ঞা নিয়েছিলেন । পাণ্ডবদের জীবিত মাতা তো কুন্তী, আর যদি গান্ধারীকেও বিবেচনা করি তবে হলো দুইজন । তাহলে 'সর্বা' শব্দ শ্লোকে প্রয়োগ হলো কেন ? এর মানে হলো অবশ্যই দুইয়ের অধিক রাজস্ত্রী বিদ্যমান ছিলো। শ্লোকটি হলো -
সর্বা মাতৄস্তথাঽঽপৃষ্ট্বা কৃত্বা চৈব প্রদক্ষিণম্ ।
সর্বাঃ প্রকৃতয়শ্চৈব প্রয়যুর্বারণাবতম্ ॥ ১.১৪৪.৪
২। স্ত্রীপর্বে যখন কৌরবদের স্ত্রীগণ প্রাসাদ থেকে বিলাপ করতে করতে বের হবে, তার আগে তারা তাদের শাশুড়িদের সামনে উপস্থিত হয় -
ব্রীডাং জগ্মুঃ পুরা যাঃ স্ম সখীনামপি যোষিতঃ ।
তা একবস্ত্রা নির্লজ্জাঃ শ্বশ্রূণাং পুরতোঽভবন্ ॥ ১০.১৪
এখানে 'শ্বশ্রূণাং' বহুবচনাত্মক পদ 'শাশুড়িদের' নির্দেশ করে, যা ধৃতরাষ্ট্রের একাধিক পত্নী ছিলো এটাই প্রমাণ করে।
৩। যখন দ্রোণপর্বে ধৃতরাষ্ট্র দ্রোণের মৃত্যুসংবাদ সঞ্জয়ের কাছে শোনেন তখন তিনি শোকাতুর হয়ে হতোদ্যম হয়ে মাটিতে পড়ে যান, তখন তার স্ত্রীরা চারিদিক থেকে তার পাশে বসে তাকে হাত দিতে সান্ত্বনা দিতে থাকেন -
পতিতং চৈনমালোক্য সমন্তাদ্ ভরতস্ত্রিয়ঃ ।
পরিবব্রুর্মহারাজমস্পৃশংশ্বৈব পাণিভিঃ ॥ ১০.৩
এখানে সুস্পষ্টভাবে ধৃতরাষ্ট্রেরই একাধিক স্ত্রীর উল্লেখ রয়েছে যে আরো কোনো সন্দেহেরই অবকাশ থাকে না।
৪। আদিপর্বে যখন রাজকুমাররা শস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শন করতে আসে, তখন ধৃতরাষ্ট্র তার সব স্ত্রীদের নিয়ে মঞ্চে আরোহন করেন, এখানে 'স্ত্রিয়শ্চ রাজ্ঞঃ সর্বাস্তাঃ' বহুস্ত্রীরই পরিচায়ক।
স্ত্রিয়শ্চ রাজ্ঞঃ সর্বাস্তাঃ সপ্রেষ্যাঃ সপরিচ্ছদাঃ॥ ১৩৩.১৭
৫। সভাপর্বে ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে বোঝানোর সময় বলেন, 'তুমি আমার জ্যেষ্ঠ রাণীর জ্যেষ্ঠ পুত্র'। যদি একাধিক স্ত্রী না থাকে তবে জ্যেষ্ঠ বা বড় রাণীর কথাই কেন বলা হবে ? অর্থাৎ এখানেও একাধিক স্ত্রী প্রমাণিত।
ধৃতরাষ্ট্র উবাচ
ত্বং বৈ জ্যেষ্ঠো জ্যৈষ্ঠিনেয়ঃ পুত্র মা পাণ্ডবান্দ্বিষঃ ।
দ্বেষ্টা হ্যসুখমাদত্তে যথৈব নিধনং তথা ॥ ৫৪.১
৬। দ্রোণপর্বে সঞ্জয় বলেন, ধৃতরাষ্ট্রের ৫ পুত্র যারা কিনা সহোদর ছিলো তারা কর্ণকে পরাজিত হতে দেখে ভীমকে আক্রমণ করেন। এখানে 'সোদর্যাঃ' অর্থাৎ সহোদর বলা হয়েছে এজন্যই যে তা গান্ধারী নয় বরং অন্য স্ত্রীর ৫ পুত্র ছিলো, যারা কিনা একই মায়ের পেটের ভাই। নাহলে ১০০ সন্তান যদি গান্ধারীর একারই হয় তবে এখানে সহোদর আলাদা করে বলার কী দরকার? কেননা, ১০০ পুত্র স্বাভাবিকভাবেই সহোদর হবে।
দৃষ্ট্বা কর্ণং তু পুত্রাস্তে ভীমসেনপরাজিতম্ ।
নামৃষ্যন্ত মহেষ্বাসাঃ সোদর্যাঃ পঞ্চ ভারত ॥ ১৩৫.২৯
পরের শ্লোকে এদের ৫ ভাইয়ের নাম আছে - দুর্মর্ষণ, দুঃসহ, দুর্মদ, দুর্ধর ও জয় ।
এভাবে অকাট্যরূপে প্রমাণিত হলো যে ধৃতরাষ্ট্রের একাধিক স্ত্রী ছিলো । সব স্ত্রীর গর্ভে যদি সন্তান জন্ম গ্রহণ করে তবে ১০ বছরের মধ্যেই ১০০ সন্তান জন্ম গ্রহণ করা অস্বাভাবিক নয় এবং এটিই একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা ।
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর
0 মন্তব্য(গুলি)