https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

মহাভারতে জন্মকথা : অলৌকিকতা, নৈতিকতা বনাম বাস্তবতা

Wednesday, March 5, 2025

 মহাভারতে জন্মকথা : অলৌকিকতা, নৈতিকতা বনাম বাস্তবতা 


বর্তমান মহাভারত মহর্ষি বেদব্যাস রচিত ২৪০০০ শ্লোকেরই সৌতি কথিত হরিবংশসহ ১ লক্ষ শ্লোকেরই নবরূপ। মহাভারত একটি মহাকাব্যিক ইতিহাস। এতে যেমন ধর্মের কথা আছে তেমনই অধর্মের ইতিহাসও আছে। ধর্মাধর্মের এই মিশ্রণের মূল লক্ষ্য আমাদের শিক্ষা দেওয়া যে ধর্মাচারণ করলে কী হতে পারে, অধর্মাচরণ করলে কী হতে পারে। মহাভারত বা ইতিহাস পাঠ করার সময় আমাদের আরো সচেতন থাকতে হবে এদিক দিয়ে যে ব্যক্তির আচরণ ও কর্ম যদি বেদাদি শাস্ত্রবিরুদ্ধ হয় তা আমাদের জন্য কখনোই অনুসরণীয় নয়। কেননা আমরা কোন ধর্মের ব্যতিক্রম দেখলে যেমন না বুঝেই বলতে পারি না ঐ ব্যক্ত জেনে বুঝে অধর্ম করেছেন, কেননা আমরা জানিনা প্রকৃতপক্ষে তৎকালীন অবস্থা কেমন ছিলো যাতে কোন ব্যক্তি ধর্মযুক্ত কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেন ব্যতিক্রম ঘটিয়েছেন। 


একইভাবে এটাও স্মরণে রাখতে হবে মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে অলঙ্কার, রূপক, অতিশয়োক্তির মাধ্যমে ইতিহাসকে স্বীয় নৈপুণ্যে উপস্থাপন করা। এখন যেমন সব কিছুকে আক্ষরিকভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই তেমনই এতো পরিমাণে পরবর্তীকালে নানা লিপিকর ও ব্যক্তিদের দ্বারা ঘটনার সংযোজন ও প্রক্ষিপ্ততা ঘটেছে যে নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়ারও উপায় নেই। সংযোজন সেটিই যা বাদ দিলেও মূল কাহিনীর প্রবাহমানতায় কোন পরিবর্তন হয় না, আর প্রক্ষিপ্ততা মূল কাহিনীতে এমনভাবে মিশ্রিত হয়ে যায় যে সেখান থেকে প্রকৃত সত্য নির্ধারণ করা অত্যন্ত দুরূহ ও মতভেদ তৈরির কাজ । কিন্তু সত্যের নির্ণয়ে এই দুরূহ কাজ ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। তাই জনসাধারণের জন্য সহজ ব্যবস্থা হলো মহাকাব্যিক ইতিহাস থেকে বৈদিক ধর্মানুকূল সব গ্রহণ করা ও অধর্মাচরণ সকলই বর্জন করা। 


মহাভারতে নানা ব্যক্তির জন্মবিষয়ে অত্যন্ত অলৌকিক তথ্য রয়েছে। অনেকেই এই বিষয়গুলোকে রূপক বা প্রকৃত মাহাত্ম্য না বুঝে আক্ষরিকভাবেই মেনে নেয় যা কিনা মহাভারতের ঐতিহাসিক মূল্য ও বাস্তিবকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেপ্রকৃতপক্ষে খ্যাতিমান ব্যক্তিদের মাহাত্ম্য বৃদ্ধির জন্য পরবর্তীকালে এসব কাহিনী সংযুক্ত করা হয়েছে। যদিও মহাভারোত্তর দুর্মদ পাণ্ডিত্যের ফলাফল স্বরূপ এই সংযোজন সমস্যার বৃদ্ধিই করেছে, সমাধান নয়।  আসুন কিছু আলোচনা করি - 


১। কৃপাচার্যের জন্ম 


মহর্ষি গৌতমের শরদ্বান নামে এক শিষ্য ছিলেন, তাঁর ধনুর্বেদে যেমন বুদ্ধি ছিল বেদাধ্যয়নে তেমন ছিল না। তাঁর তপস্যায় ভয় পেয়ে ইন্দ্র জানপদী নামে এক অপ্সরা পাঠালেন। তাকে দেখে শরদ্বানের হাত থেকে ধনুর্বাণ প’ড়ে গেল এবং রেতঃপাত হ’ল। সেই রেতঃ একটি শরস্তম্বে প’ড়ে দু ভাগ হ’ল, তা থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করলে। রাজা শান্তনু তাদের দেখতে পেয়ে কৃপা ক’রে গৃহে এনে সন্তানবৎ পালন করলেন এবং বালকের নাম কৃপ ও বালিকার নাম কৃপী রাখলেন। 


“ জানপদী দেবরাজের আদেশানুসারে ধনুর্বনধারী শরদ্বানের পরামরমণীয় আশ্রমে উপস্থিত হইয়া তাঁহার লোভ জন্মাইবার নিমিত্ত হাবভাব প্রকাশ করিতে লাগিলেন। অলৌকিক রূপলাবণ্যসম্পন্না একমাত্রবসনা সেই ললনাকে নিরীক্ষণ করিবামাত্ৰ মহাত্মা শরদ্বানের নয়নদ্বয় বিকসিত হইয়া উঠিল, হস্ত হইতে ধনুর্বাণ ভূতলে পতিত হইল এবং বাতচালিত কদলীপত্রের ন্যায় সর্বাঙ্গ, কাঁপিতে লাগিল। এই অসাধারণ-জ্ঞানসম্পন্ন তপস্বী উক্ত প্রকারে কুসুমাশরাহত হইয়াও স্বীয় তপঃপ্রভাবে ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিয়া রহিলেন; কিন্তু দুঃসহ মদনবিকারপ্রভাবে রেতঃস্খলন হইল; তিনি তাহা জানিতে পারিলেন না। তিনি সেই তপস্যার অন্তরায়ভূত অপ্সরার সন্নিধান পরিত্যাগ করিবার মানসে যেমন আশ্রম হইতে প্ৰস্থান করিতেছিলেন অমনি তাহার স্বলিত রেতঃ শরস্তম্বে নিপতিত হইল। বীৰ্য্য পতিত হইবামাত্র দুই খণ্ডে বিভক্ত হইল এবং তাহাতে এক পুত্র ও এক কন্যা জন্মিল....মহারাজ শান্তনু তাহাদিগকে কৃপা করিয়া প্রতিপালন করিয়াছেন বলিয়া পুত্রটির নাম কৃপ ও কন্যাটির নাম কৃপী রাখিলেন।”


সূত্র: মহাভারত আদিপর্ব [কা. ১৩০, গী. ১২৯]


সিদ্ধান্তঃ শরদ্বানের পুত্র-কন্যা শান্তনু মহারাজের দায়িত্ব বড় হয়েছেন। সেটাকে অলৌকিক করার জন্য নামকে বিকৃত করে এই নিকৃষ্ট কাহিনীর অবতারণা করেছে প্রক্ষেপকরা । 



২। দ্রোণের জন্ম 


ভরদ্বাজ ঋষি গঙ্গোত্তরী প্রদেশে বাস করতেন। একদিন স্নানকালে ঘৃতাচী অপ্সরাকে দেখে তাঁর শুক্রপাত হয়। সেই শুক্র তিনি কলসের মধ্যে রাখেন তা থেকে দ্রোণ জন্মগ্রহণ করেন। 


“ ভারতবর্ষের উত্তর সীমায় পৃথিবীর মানদণ্ডস্বরূপ হিমালয় নামক পর্বত আছে, তথা হইতে ভগবতী ভাগীরথী নিৰ্গত হইতেছেন। পূর্বকালে সেই স্থানে দৃঢ়ব্ৰত মহর্ষি ভরদ্বাজ তপস্যা করিতেন। তিনি যজ্ঞদীক্ষিত হইয়া একদা মহর্ষিগণ সমভিব্যাহারে গঙ্গায় প্ৰাতঃস্নান করিতে গিয়াছিলেন। সেই সময়ে অপ্সরাগ্রগণ্যা ঘূতাচী স্নান করিয়া তীরে উঠিতেছিল, দৈবাৎ বায়ুবেগে তাহার গাত্রবসন উড্ডীন হইল। মহর্ষি সেই সুরূপা নবযৌবনা মদদৃপ্ত (কামমত্ততায় বিভ্রান্তা) অপ্সরাকে বিবসনা দেখিয়া কামশরে জর্জরিত কলেবর হইলেন। দুর্জয় কুসুমায়ুধের দুঃসহ প্রভাবে তপোধনের রেতঃ স্বলিত হইল। তিনি সেই রেতঃ দ্রোণ অর্থাৎ কলসের মধ্যে রাখিলেন। কিয়দ্দিন পরে সেই বীৰ্য্য এক পুত্ররূপে পরিণত হইল। মহর্ষি ভরদ্বাজ দ্রোণমধ্যে জাত বলিয়া ঐ পুত্রের নাম দ্রোণ রাখিলেন। ”


সূত্র: মহাভারত আদিপর্ব [কা. ১৩০, গী. ১২৯]


সিদ্ধান্তঃ মহর্ষি ভরদ্বাজের পুত্র ছিলেন দ্রোণ । দ্রোণকলশের উল্লেখ বেদেও আছে, সোম নিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় ।  সেটাকে অলৌকিক করার জন্য নামকে বিকৃত করে এই নিকৃষ্ট কাহিনীর অবতারণা করেছে প্রক্ষেপকরা । 



৩। দীর্ঘতমার দ্বারা অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র, সুক্ষ্ম ৫টি পুত্রের জন্ম 


উতথ্য ঋষির পত্নী মমতা যখন গর্ভিণী ছিলেন তখন তাঁর দেবর বৃহস্পতি সংগম প্রার্থনা করেন। মমতার নিষেধ না শুনে বৃহস্পতি বলপ্রয়োগে উদ্যত হলেন, তখন গর্ভস্থ শিশু তার পা দিয়ে পিতৃব্যের বীর্য প্রবেশ ব্যর্থ করলে বৃহস্পতি শিশুকে অভিশাপ দিলেন, তুমি অন্ধ হবে। ঊতথ্যের পুত্র অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন, তাঁর নাম হ’ল দীর্ঘতমা। তিনি ধার্মিক ও বেদজ্ঞ ছিলেন, প্রদ্বেষী নামে তার স্ত্রী ছিলো ও গৌতমসহ বেশ কিছু বিখ্যাত পুত্রও ছিলো। কিন্তু সৌরভেয়ের কাছে গোধর্ম শিখে [গোরুর মতো যত্রতত্র যৌনক্রিয়া] সেই আচরণ করায় প্রতিবেশী মুনিগণ ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে ত্যাগ করলেন। দীর্ঘতমার পুত্রেরা মাতার আদেশে পিতাকে ভেলায় চড়িয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলেন। ধর্মাত্মা বলি রাজা তাঁকে দেখতে পেয়ে সন্তান উৎপাদনের জন্য নিয়ে গেলেন এবং মহিষী সুদেষ্ণাকে তাঁর কাছে যেতে বললেন। অন্ধ বৃদ্ধ দীর্ঘতমার কাছে সুদেষ্ণা নিজে গেলেন না, তাঁর ধাত্রীকন্যাকে পাঠালেন। সেই শূদ্রকন্যার গর্ভে কাক্ষীবান প্রভৃতি এগারজন ঋষি উৎপন্ন হন। তারপর রাজার নির্বন্ধে সুদেষ্ণা স্বয়ং গেলেন, দীর্ঘতমা তাঁর অঙ্গ স্পর্শ করে বললেন, তোমার পাঁচটি তেজস্বী পুত্র হবে—অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ পুণ্ড্র সুহ্ন, তাদের দেশও এই সকল নামে খ্যাত হবে। বলি রাজার বংশ এইরূপে মহর্ষি দীর্ঘতমা থেকে উৎপন্ন হয়েছিল।


সূত্র: মহাভারত আদিপর্ব [কা. ১০৪, গীতাপ্রেস লজ্জাবোধে সম্পূর্ণ কাহিনীই বিলুপ্ত করে দিয়েছে, অন্য সব সংস্করণে যথাবৎ আছে]


সিদ্ধান্তঃ দীর্ঘতমা একজন দ্রষ্টা ঋষি । এর সাথে কোন সম্পর্ক নেই নিয়োগের কাহিনীর । ১০৫তম অধ্যায়ে ভীষ্ম ঠিকই ১০৪ তম অধ্যায়ের নিয়োগের ধারার আলোচনা আবার শুরু করেছেন । মাঝখানে অলৌকিক রোচন কাহিনীর নিকৃষ্ট কাহিনীর অবতারণা করেছে প্রক্ষেপকরা ।