পূর্ণস্যাবাহনং কুত্র, সর্বাধারস্য চাসনম্।
স্বচ্ছস্য পাদ্যমর্ঘ্যং চ, শুদ্ধস্যাচমনং কুতঃ।।
(পরা পূজা শ্লোক ২)
পূর্ণ সর্ব্যব্যাপকের আবাহন কিভাবে করা যেতে পারে ? সর্বাধারকে বসানোর জন্য আসনের দরকার কি ? নিত্য স্বচ্ছকে চরণ ধোয়ানোর জন্য পাদ্য, মুখ ধোয়ানোর জন্য অর্ঘ্য এবং নিত্যশুদ্ধকে আচমন করার জন্য জল কিভাবে দেওয়া যেতে পারে ?
কাউকে সেখানে ডাকা হয় যেখানে আহূত ব্যক্তি প্রথম থেকে বিদ্যমান না থাকে । যে প্রথম থেকেই সেখানে উপস্থিত রয়েছে তাঁকে আওয়াজ দিয়ে আসার জন্য ডাকাটা একেবারেই মূর্খতা হবে । জড় পাষাণ থেকে নির্মিত মূর্ত্তিতে ভগবান তখন আসে যখন তাঁকে আহ্বান করা হয় । এঁকে মূর্ত্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা বলা হয় । কণে কণে ব্যাপ্ত হওয়াতে যে সর্বদা মূর্ত্তিতে বিদ্যমান আছে - ভিতরেও এবং বাহিরেও - তাঁকে ডাকলে পরে সেখানে উপস্থিত হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।প্রাণ প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গে পৌরাণিক পণ্ডিত অথর্ববেদের একটি মন্ত্রকে প্রস্তুত করে থাকে - ‘ত্রহ্যশ্মানমাতিষ্ঠ অশ্মা ভবতুতে তনুঃ’ (অথর্ব্ববেদ ০২.১৩.৪) অর্থাৎ হে ঈশ্বর! এসো, এই পাথরে বসো এবং এই পাথর তোমার শরীর হউক । পরন্তু পণ্ডিতমশাই উক্ত মন্ত্রের পরের ভাগটি দেখেন নি যাতে বলা হয়েছে - ‘কৃণ্বন্তু বিশ্বে দেবাঃ আয়ুষ্টে শরদঃ শতম্’ — অর্থাৎ সব দেবতা তোমার আয়ুকে একশ বছর করুন । পৌরাণিকদের অর্থে এরকম মনে হয় যে পাষাণ মূর্তিতে ভগবানের জন্ম হওয়ার পর জাতকর্ম সংস্কারের সমাপ্তির পরে তাঁকে একশত বছর পর্য্যন্ত জীবিত থাকার আশীর্বাদ দেওয়া হচ্ছে । মূর্তিপূজাকে বেদসম্মত প্রমাণিত করার জন্য এই মন্ত্রের প্রাণপ্রতিষ্ঠাতে বলপূর্বক বিনিয়োগ করা হয়েছে ।
বাস্তবে উক্ত মন্ত্র সমাবর্তন সংস্কার অর্থাৎ ব্রহ্মচারীর বিদ্যার সমাপ্তিতে ঘর ফিরে আসার সময়ের মন্ত্র । এঁতে ব্রহ্মচারীকে আশীর্বাদ দিয়ে বলা হচ্ছে ‘‘হে ব্রহ্মচারী ! তুই এই পাষানের উপর পা রাখ । তোর শরীর পাথরের মতো সুদৃঢ় এবং বলিষ্ঠ হোক । ভগবান তোমাকে একশত বছর আয়ু অর্থাৎ দীর্ঘায়ু প্রদান করুন”। সায়নাচার্য্যও এই মন্ত্রের বিনিয়োগ সমাবর্তন সংস্কারে করে এঁর ভাষ্য এইভাবে করেছেন — হে মানব ! এহি আগচ্ছ, অশ্বনমাতিষ্ঠ, দক্ষীনেন পাদেন আক্রম । তে সর্বতনুঃ শরীরং অশ্মা ভবতু, অশ্ববদ্ রোগাদিবিনির্মুক্তং দৃঢ়ং ভবতু । বিশ্বে দেবাশ্চ তে তব শত সংবৎসর পরিমিতং আয়ু কৃণ্বন্তু কুর্বন্তু।” অর্থাৎ হে ব্রহ্মচারী ! তুমি এখানে এসো এবং তোমার দক্ষিণ পা -কে এই পাথরের উপর রাখো । তোমার শরীর নীরোগ এবং এই পাথরের মতো দৃঢ় হোক্ । সর্বাধারঃ— যজুর্বেদে বলা হয়েছে - ‘স দাধার পৃথিবীং দ্যামুতেমাম্’ (১৩.৮)। সেই প্রভু প্রকাশরহিত ভূগোলাদি এবং প্রকাশযুক্ত সূর্য্যাদিলোক সমূহকে ধারণ করে রেখেছেন । অন্যত্র (যজুঃ ৩২.০৬) বলা হয়েছে - ‘যেন দৌরুগ্রা পৃথিবী চ দৃঢ়া যে স্ব স্তভিতং যেন নাকঃ’ অর্থাৎ ‘যেন পুরুষেণ দৌঃ উদ্গুণা বৃষ্টিদায়িনী কৃতা। পৃথিবী চ দৃঢ়া স্থিরা প্রাণীধারণায় বৃষ্টিগ্রহনায় চ অন্ননিষ্পাদদীয় চ কৃতা । যেন চ স্বঃ আদিত্যমণ্ডলং স্তভিতং স্তভিতং যেন চ নাকঃ স্বর্গো লোকঃ স্তভিতঃ । যশ্চান্তরিক্ষো রজসঃ উদকস্য বৃষ্টিলক্ষণস্য বিমানো নির্মাতা’ (উবট)। যিনি জগদীশ্বর তীব্র তেজযুক্ত সুর্য্যাদি প্রকাশযুক্ত পদার্থ এবং ভূমিকে দৃঢ় করেছেন - যিনি মধ্যবর্তী আকাশে বর্তমান লোকসমূহের নির্মাতা । সংসারে প্রসিদ্ধ কথা আছে যে, ‘শেষ’ পৃথিবীকে (সবাইয়ের উপলক্ষণ) ধারণ করে রেখেছেন, পরন্তু ‘শেষ’ কোনো সর্পের নাম নয়, অপিতুপরমেশ্বরের নাম । কেননা সব পদার্থের তাঁর নিজের মূল কারণে লয় হয়ে যাওয়ার পরে যখন সংসারে অন্য কিছু থাকে না তখন পরমেশ্বরই ‘শেষ’ থাকেন । অথর্ব্ববেদের ১০ম কাণ্ডের সপ্তম সূক্তে এই বিষয়ের কি এই সংসার কোন স্তম্ভের (থাম) আশ্রয়ে টিকে আছে, তাঁরই বিস্তৃত বিচার হয়েছে। উদাহরণার্থ - ‘যস্মিন্তস্তব্ধা প্রজাপতির্লোকান্তসর্বাং অধারয়ৎ। স্কম্ভং তং ব্রুহি কতমাঃ স্বিদেব সঃ ।। (৭) অর্থাৎ সে স্কম্ভ (স্তম্ভ), সেই সুখস্বরূপ পরমেশ্বর যিনি সব লোক-লোকান্তরকে ধারণ করে রেখেছেন । শঙ্করাচার্য্য ঠিকই বলেছেন যে এতবড় শক্তিশালী পুরুষকে না বসবার আবশ্যকতা আছে এবং না তাঁর অনুরূপ কোন আসন পাওয়া যেতে পারে ।
দ্যমর্ঘ চাঃ
পা ধোয়ার জন্য যে জল দেওয়া হয় তাকে ‘পাদ্য’ বলা হয় । এইরকম মুখ ধোয়ার জন্য দেওয়া জলকে ‘অর্ঘ্য’ বলা হয় । এই দুটি সমস্ত শরীরের প্রক্ষালনের জন্য অপেক্ষিত জলের উপলক্ষণ ।।
‘অদ্ভির্গাত্রাণি শুধ্যন্তি’
জলের দ্বারা শরীর শুদ্ধ হয় । যিনি অকায় বা অশরীরী, তাঁর জন্য জলের কোন আবশ্যকতা নাই । যাঁকে মল স্পর্শ করতে পারে না সে সদা নির্মল থাকে । যাঁকে পিপাসা কষ্ট দেয় না তাঁর আচমনের কোন প্রয়োজন নাই । ‘শুদ্ধ শুদ্ধৌ’ থেকে শুদ্ধ শব্দ তৈরি হয় । যে স্বয়ং পবিত্র এবং অন্যদেরকেও পবিত্র করে তাঁকে শুদ্ধ বলা হয় — ‘যঃ শুদ্ধতি সর্বান্ শোধয়তি বা স শুদ্ধঃ গরমেশ্বরঃ’। ‘শুধ শৌচা’-র দ্বারাও ‘শুদ্ধ’ শব্দ নিষ্পন্ন হতে পারে - শুধ্যতি শোধয়তি বা স শুদ্ধঃ। স্বয়ং শুদ্ধ এবং পরিশোধক হওয়ার জন্য পরমেশ্বর হলেন ‘শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্’ (যজুর্বেদ ৪০.৮,)। সংসারে শুদ্ধিকরণের দুইটি সাধন -১) জল, ২) অগ্নি । দুইজনেই শুদ্ধ করে, পরন্তু দুইজনের মধ্যে একটি পার্থক্য রয়েছে । জলের সম্পর্কে আসা পদার্থ তো শুদ্ধ হয়ে যায় -কিন্তু তাঁর থেকে শোধিত জল স্বয়ং অশুদ্ধ হয়ে যায় । এঁর বিপরীতে অগ্নি তাঁর সম্পর্কে আসা অশুদ্ধিকে তো নষ্ট করেই দেয় এবং স্বয়ং-ও শুদ্ধ থাকে । পরমেশ্বর অত্যন্ত শুদ্ধ, নির্মল এবং পবিত্র । না তাঁর শারীরিক অশুদ্ধি আছে এবং না মানসিক বিকার আছে । শরীর না হওয়ার জন্য তাঁকে কোন ভৌতিক মলিনতা ছুঁতে পারে না । মানসিক দৃষ্টিতে ঈশ্বর হলেন ‘অপাপবিদ্ধ’ -পাপরহিত । জীবাত্মাকে নিজের কর্মের ফল ভোগার জন্য বাহ্য জগতের সাথে সম্বন্ধ রাখতে হয়, কেননা বিষয়রূপ সামগ্রী বাহ্য জগতেই উপলব্ধ হয় । আত্মা শরীরের ভিতরে থাকে, বাইরে তাঁর গতি নাই, এইজন্য বাহ্য জগতের সাথে সম্পর্ক করার জন্য তাঁকে মনের রূপে সম্পর্ক অধিকারীর দরকার হয়, পরন্তু পরমাত্মা তো সর্বব্যাপক । জগতের প্রত্যেকটি বস্তুর সাথে তাঁর সোজা সম্পর্ক আছে । এইজন্য তাঁকে মধ্যস্থরূপে মনের দরকার হয় না । মনও হোল সূক্ষ্ম শরীরের অঙ্গ, অশরীরী হওয়ার ফলে মন তাঁর কাছে নেই । যদি হোত তাহলে সত্ত্ব রজ-তমে প্রভাবিত হওয়াতে কখনও-না-কখনও তাঁর মধ্যেও মলিনতা আসতে পারতো । এইভাবে মন থেকে রহিত হওয়ার কারনে তিনি হলেন অপাপবিদ্ধ - ‘শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্’। পাপের মূলে অজ্ঞানতা থাকে । পরমাত্মা হলেন সর্বজ্ঞ, অতএব অজ্ঞান এবং অবিদ্যার কারণে হওয়া পাপ থেকে তিনি পূর্ণমুক্ত ।
0 মন্তব্য(গুলি)
Author
Back2thevedas