https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

গীতা বিশ্লেষণঃ৪৩- অদ্বৈতবাদিগণ বলেন যে জীব ও ব্রহ্ম এক, মুক্তিতে জীব ব্রহ্ম হয়ে যায়। এ সম্পর্কে গীতা কি বলে?

Thursday, July 20, 2017


প্রশ্ন- অদ্বৈতবাদিগণ বলেন যে ব্রহ্ম তথা পরমাত্মা,
জীব তথা জীবাত্মা ও প্রকৃতি হল এক ব্রহ্মই।
মুক্তিতে নাকি জীব ব্রহ্মই হয়ে যান, এই ব্যাপারে
গীতায় কি বলা আছে? আর জগৎ কি মিথ্যা?

উত্তর- প্রথমেই প্রশ্ন থাকে উপাসক কি করে
উপাস্যের সমান হতে পারে? যদি সমানই হয় তাহলে
কে কার উপাসনা করবে?
অদ্বৈতবাদ দর্শন বেদ,
বেদান্ত ও গীতা বিরূদ্ধই মনে হয় আমার কাছে,
তবে পরমেশ্বর এক ও অদ্বিতীয়ত এতে
কোন সন্দেহ নেই।
দেখুন গীতায় কি বলা আছে-

"মদ্ভক্তা য়ান্তি মামপি অর্থাৎ আমার(ঈশ্বরের)
ভক্তগণ আমাকেই(ঈশ্বরকেই) প্রাপ্ত হন।"
গীতা ৭।২৩.
যদি মুক্তিতে জীবাত্মা ব্রহ্মই হয়ে যেত তাহলে
উপরের শ্লোকটা মিথ্যা হয়ে যায়। কারণ এখানে বলা
হয়েছে জীব ঈশ্বরকে প্রাপ্ত হন। কিন্তু ঈশ্বর
হয়ে যান না।

"ব্রহ্মসংস্পর্শমত্যন্তং সুখমশ্নুতে। অর্থাৎ ব্রহ্ম
সংস্পর্শে অন্তহীন আনন্দ বা সুখ লাভ করেন।"
গীতা ৬।২৮.
এখানেও দুয়ের মধ্যে ভেদ দৃশ্যমান, কারণ
এখানে ঈশ্বরের সংস্পর্শে জীবাত্মা সুখ ভোগ
করেন। ব্রহ্ম বা ঈশ্বর হয়ে যান না।

এছাড়াও- "হে কৌন্তেয়! প্রলয়কালে এই সব ভুত
আমার প্রকৃতিকে প্রাপ্ত হয় এবং উৎপত্তিরুপ
কল্পের আদিতে সেই সব ভূতকে আমি পুনরায়
রচনা করি।" গীতা ৯।৭
"নিজ আট প্রকার প্রকৃতিকে আশ্রয় করে এই ভুত
সমুদায় বা প্রাণিবর্গ এবং পরাধীন ভুত সমুদয়কে আমি
বারংবার প্রকৃতিরূপ কারন দ্বারা রচনা করি।"
গীতা৯।৮.

উপরের এই শ্লোক দ্বয় থেকেও পরিষ্কার যে,
ব্রহ্ম, জীব ও প্রকৃতি পৃথক। এই তিনের সমন্বয়ে
ব্রহ্ম নয়। এছাড়াও-

"য়ান্তি মদয়াজিনোহপি মাম্ অর্থাৎ যারা আমার উপাসক তারা আমাকেই লাভ করেন।"
গীতা ৯।২৫.

"সন্ন্যাসয়োগয়ুক্তাত্মা বিমুক্তো মামুপৈষ্যসি। অর্থাৎ
সন্ন্যাস যোগ যুক্ত আত্মা মুক্ত হয় ও আমাকে
প্রপ্ত হবে।"
গীতা ৯।২৮.

উপরের এই শ্লোকদ্বয় থেকেও এটা পরিষ্কার
মুক্তিতে জীব ঈশ্বর হয়ে যায় না। তারা ঈশ্বরকে
প্রাপ্ত হন। অর্জুনও বিশ্বরূপ দর্শন করে এটাই
বলেছেন, দেখুন-
"...আপনি এই বিশ্বের পরম আশ্রয় ও আপনি অব্যয়
সনাতন ধর্মের রক্ষক, আপনিই সনাতন পুরুষ, এই
আমার অভিমত। গীতা ১১।১৮.

সব চাইতে বড় ব্যাপার হল গীতার নিম্নোক্ত
শ্লোকটাই অদ্বৈতবাদকে মিথ্যা প্রমাণ করে দেয়,
দেখুন-

"প্রকৃতিং পুরুষষ্ণৈব বিদ্ধ্যনাদী উভাবপি। অর্থাৎ প্রকৃতি
ও পুরুষ উপয়কেই অনাদি বলে জেনো।" গীতা
১৩।২০.
এর থেকে একেবারেই পরিষ্কার যে ব্রহ্ম,
জীব ও প্রকৃতি অনাদি এবং জীব ও প্রকৃতি
ব্রহ্মের অংশ নয়।

অনেকে তখন-
"মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ। অর্থাৎ
আমারই সনাতন অংশ জীবলোকে জীব হয়েছে।"
গীতা ১৫।৭

শ্লোকটি দেখিয়ে প্রমাণ করতে চায় যে জীব
ব্রহ্মের অংশ। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে হয়, এই
শ্লোকে সনাতন শব্দ দ্বারা এই কথা সিদ্ধ হয় যে
জীব ঘটাকাশ তথা অগ্নির স্ফুলিঙ্গের সমান ব্রহ্মের
অংশ নয়। কিন্তু আদিকাল থেকে প্রকৃতি থেকে
ভিন্ন ব্রহ্মের বিভূতিরূপ। আর যদি ব্রহ্মই জীব
ভাবকে প্রাপ্ত হতো তাহলে পূর্বের সকল
শ্লোকই মিথ্যা হয়ে যাবে। তাছাড়া এই অধ্যায়ে ১৬
ও ১৭নং শ্লোকে জীব ও ঈশ্বরের ভেদ নিয়ে
আবার কথা হতো না। গীতার পূর্বোত্তর বিচার
করে এখানে অংশ শব্দে ঈশ্বরের বিভূতি হয় কিন্তু
অগ্নির স্ফুলিঙ্গের সমান অংশ হয় না।

এছাড়াও-
"আমাতে সমর্পিত চিত্ত হইয়া আমার ভক্ত ও আমার
পূজক হও। আমাকে নমষ্কার কর, আমাকেই পাইবে,
তোমার নিকট সত্য প্রতিজ্ঞা করিতেছি। কারণ তুমি
আমার প্রিয় হও।" গীতা ১৮/৬৫.
" যিনি পরম গুহ এই তত্বজ্ঞান আমার ভক্তজন মধ্যে
ব্যাখ্যা করিবেন, তিনি আমাতে পরা ভক্তি লাভ করিয়া
সংশয়হীন চিত্তে আমাকেই প্রাপ্ত হইবেন।"
গীতা ১৮/৬৮.

গীতার একেবারে শেষেও দেখা যায় যে উপাস্য
ও উপাসকের মধ্যে দ্বৈতভাব বিধ্যমান। তাহলে কি
করে বলবো যে ' উপাস্য ও উপাসক এক হল?

তাছাড়া প্রকৃতি বা জগৎ পূর্বে ছিল কিনা তা বেদ
থেকেই দেখুন-

"ন তং বিদাথ ষ ইমা জজানান্যদ্যুষ্মাকমন্তরং বভুব।
নীহারেণ প্রাবৃতা জল্প্যা চাসুতৃপ উক্থশাসশ্চরন্তি।"
যর্জুবেদ ১৭.৩১.  ঋগ্বেদ ১০.৮২.৬

অনুবাদঃ হে মনুষ্য! সেই পরমাত্মাকে বুঝিতেছে
না।তিনি এই জগৎ রচনা করিয়াছেন। তিনি তোমাদের
মধ্য বিরাজমান অথচ তিনি তোমা হইতে পৃথক। বিষয়াসক্ত পুরষেরা অবিদ্যার কুয়াসা ও শুষ্কতর্কে আবৃত থাকিয়া সাংসারিক বিষয়কেই তৃপ্তির লক্ষ্য মনে করে এবং এরূপ স্ত্রোত্র পাঠী ভক্তও ইতস্ততঃ ভ্রমন
করে।

উপরোক্ত এই মন্ত্রে স্পষ্ট করে বলছে
ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান কিন্তু সর্বত্র বিরাজমান
হলেও সবকিছু ঈশ্বর নয়। সেই বস্তু থেকে
ঈশ্বর পৃথক। এইরূপ একটা শ্লোক গীতা ৯/৫ নং
শ্লোকেও আছে।

এছাড়াও ব্রহ্ম(ঈশ্বর বা পরমাত্মা), জীবাত্মা ও প্রকৃতি
যে অনাদি তা বেদে আরো স্পষ্ট করেই বলা
আছে, দেখুন-

"দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।
তয়োরন্যং পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্যনশ্ নন্নন্যো অভিচাক
শীতি॥"

বঙ্গানুবাদঃ- সুন্দর পক্ষবিশিষ্ট সম সম্বন্ধযুক্ত দুইটি
পক্ষী মিত্র রূপে একই বৃক্ষে (প্রকৃতিতে)
আশ্রয় করিয়া আছে। তাহাদের মধ্যে একটি বৃক্ষের
ফলকে স্বাদের
জন্য ভক্ষণ করে(জীবাত্মা) এবং অন্যটি ফলকে
ভক্ষণ না করিয়া সব দিক দেখিতেছে(পরমাত্ মা বা
ঈশ্বর)।

ভাবার্থঃ- বৃক্ষটি জগৎ এবং দুইটি পক্ষীর একটি
জীব, অন্যটি ব্রহ্ম। প্রকৃতি, জীব ও ব্রহ্ম এরা
অনাদি।
জীব সংসারে পাপ পূণ্যের ফলভোগ করে এবং
ব্রহ্ম ফল ভোগ না করিয়া সাক্ষী রূপে বর্ত্তমান॥
ঋগ্বেদ_১_৬৪_২০ ।

এছাড়াও-  যজুর্বেদ৪০।৮ এ বলা আছে
"  শাশ্বতীভ্য_সমাভ্যঃ " অর্থাৎ অনাদি সনাতন জীবরূপ
প্রজার জন্য পরমাত্মা বেদ দ্বারা সকল বিদ্যা প্রকাশ
করেছেন।

এছাড়াও- "  এই সমস্ত জগৎ সৃষ্টির পূর্বে অন
্ধকারাচ্ছন্ন , রাত্রিরূপে অবিজ্ঞেয়, আকাশরূপে সব
জগৎ
তুচ্ছ অর্থাৎ অনন্ত পরমেশ্বরের সম্মূখে
একদেশী ও আচ্ছাদিত ছিল। পরমেশ্বর নিজ
শক্তিবলে কারণস্বরূপ হতে কার্যরূপ করিয়াছেন।"
ঋগবেদ১০ ।১২৯।৩.

এবার মনুসংহিতায় কি বলা আছে তাও একটু দেখি-

"আসীদিদং তমোভূতমপ্রজ্ঞাত মলক্ষণম্।
অপ্রতর্ক্যমবিজ্ ঞেয়ং প্রসুপ্তমিব সর্বতঃ।।"
মনুসংহিতা১ ।৫.

ভাবার্থ-  এই পরিদৃশ্যমান বিশ্বসংসার এককালে
(সৃষ্টির পূর্বে)  গাঢ় তমসাচ্ছন্ন ছিল । তখনকার
অবস্থা প্রত্যক্ষের গোচরীভূত নয়। কোনও
লক্ষণ দ্বারা অনুমেয় নয়, তখন ইহা তর্ক ও
জ্ঞানের অতীত ছিল। এই চতুবির্ধ
প্রমাণের অগোচর থাকায় এই জগৎ সর্বতোভাবে
যেন প্রগাঢ় নিদ্রায় নিদ্রিত ছিল।

"তারপর অপ্রকাশিত ভগবান স্বয়ম্ভু প্রলয় অবস্থায়
ধ্বংসক, মনান্তরে প্রকৃতি প্রেরক হয়ে এই স্থুল
আকাশাদি মহাভূত, যা পূর্বে অপ্রকাশিত ছিল সেই বিশ্ব
সংসারকে ক্রমে ক্রমে প্রকটিত করে তিনিও
প্রকাশিত
হলেন।"  মনুঃ১ ।৬.

প্রকৃতি ও ঈশ্বর যে পূর্বেও ছিল এবং এই দুইটাই
অনাদি এটাও তার একটা প্রমাণ!

তাই এটাই বলবো যে, ব্রহ্ম, জীব ও প্রকৃতি এই
তিনই অনাদি। সৃষ্টির পূর্বে নিমিত্ত কারণ পরমাত্মায়
উপাদান কারণ হিসেবে প্রকৃতি বিরাজমান ছিলো। আর
পরমাত্মা নিজ সামর্থ্যের দ্বারা এই প্রকৃতিকে
প্রকাটিত করেন এবং জীবের সাথে প্রকৃতির
সম্ভন্ধ স্থাপন করে বলেই আমাদের উচিত শুধমাত্র
এক পরমাত্মার বা ঈশ্বরের উপাসনা করা। জীবাত্মা ও
প্রকৃতির উপাসনা করা উচিত নয়। এক কথায় সব কিছু
ঈশ্বর নয় এবং "জগৎ মিথ্যা" এই কথা ভুলেও স্বীকার
করা উচিত নয়।

আবার বেদান্ত সূত্রের একেবারে শেষের
দিকের সূত্রগুলোতেও মুক্ত জীবাত্মা ও
পরমেশ্বরের মধ্যে ভেদ দেখা যায়, অর্থাৎ
মুক্তিতে জীবাত্মা, পরমেশ্বর বা ব্রহ্ম হয়ে
জাননা। বেদান্ত থেকেই দেখুন-

" ভোগ্যমাত্রসাম্যলিঙ্গাচ্চ।।"  বেদান্তসূত্র
৪/৪/২১.
অর্থাৎ শুধুমাত্র ভোগ ব্যাপারে পরমেশ্বর এবং
মুক্ত পুরুষের মধ্যে সাম্যভাব আছে।"

কিন্তু সৃষ্ট্যাদি শক্তি ব্যাপারে মুক্ত পুরুষের কোন
ক্ষমতা নেই, দেখুন-
"জগদৃব্যাপারবর্জম্ প্রকরণাৎ, অসন্নিহিতত্বাচ্চ।।
বেদান্তসূত্র ৪/৪/১৭.
অর্থাৎ মুক্ত আত্মা সৃষ্টি স্থিতি ইত্যাদির ক্ষমতা
ব্যতীত অন্য ক্ষমতার অধিকারী হন। কারণ যে
প্রকরণে সৃষ্ট্যাদির কথা বলা আছে সেখানে
পরমেশ্বরের উল্লেখ আছে, মুক্ত আত্মার
উল্লেখ নেই।

এখানে স্পষ্টই দেখা যায় যে মুক্তিতেও জীব ও
পরমেশ্বরের মধ্যে শক্তির তারতম্য তথা ভেদ বা
পার্থক্য বিদ্যমান। কারণ মুক্ত পুরুষের সৃষ্টির ক্ষমতা
থাকে না। যদি মুক্ত পুরুষ ব্রহ্মই হয়ে যেতেন
তাহলে কেন মুক্ত পুরুষের সৃষ্টির ক্ষমতা থাকে
না? পরিশেষে এটাই বলতে চাই যে- জীব
মুক্তিতে ব্রহ্ম হয়ে যান না, বরংচ ঈশ্বরে অবস্থান
করে আনন্দ ভোগ করেন। আর প্রকৃতিও
কারণরূপে পরমেশ্বরে অবস্থান করে, কিন্তু
পরমেশ্বর বা ব্রহ্ম হয়ে জান না এবং জগৎও মিথ্যা
নয়, বরংচ পরমাত্মা, জীবাত্মা ও প্রকৃতি চিরন্তন সত্য।